অপ্রতিরুদ্ধ

সবুজ (জুলাই ২০১২)

SOUMYADEEP LAHIRI
  • ১০
  • ৬৬
পল্টু ভাবে আর ভাবে...আর মনে মনে হাসে...বুড়োটা কিচ্ছু জানেনা...কি যে বলে!
বলে নাকি যেদিন এ পৃথিবী থেকে সবুজ চলে যাবে, আকাশ থেকে নেমে আসবে আগুন...
পল্টু ভাবে ওত্ত উপরে কে আগুন জ্বালবে? ধুর বয়সের সাথে মাথাটা বিগড়েছে বুড়োর...
পল্টুকে খুব ভালবাসেন গ্রামের একমাত্র পাঠশালার পণ্ডিত সামসের আলী। পল্টু হিন্দুর ছেলে। বলেন তাতে কি হয়েছে...ও আমার নিজের ছেলে হয়ে যদি আসত?
নিজের ছেলেপুলে নেই আলী সাহেবের। তিন কুলে থাকার মধ্যে ওই এক রতি ছেলেটি- পল্টু। এদিকে পল্টুতারও এই কচি সবুজ বয়েসে এক বুড়ো মাষ্টারটি ছাড়া ছায়া দেওয়ার কেউ নেই। তাই দুটিতে জমেছে ভালই।

বঙ্গদেশে সবুজের তারুণ্যের প্রতি আলী সাহেবের জীবনের শুরু থেকেই অদ্ভুত এক অন্তরঙ্গতা থেকে গিয়েছে। সে রঙে তিনি পল্টুটাকেও রাঙিয়েছেন। বলেন, “সবুজের মধ্যে থাকবি, দেখবি সব দুঃখ – ব্যথা কিরকম দৌড়ে পালায়...তুই যা বলবি ওরা মন দিয়ে তা শুনবে...তোর প্রতিবাদ করবেনা...একেবারে নিজের লোকের মতো...”
পল্টু মানে বোঝেনা। কিন্তু কথা গুলো যে আর পাঁচ জনের চেয়ে আলাদা সেটা বুঝতে পারে। তাই অবসরে সেগুলো মাথায় ঘুরপাক খায়।

পাঠশালাটা যখন করেন তখন পিতৃপুরুষের বিঘা দশেক জমিতে ধান হত বছরে তিনবার। তবে আলী সাহেবের সবচেয়ে পছন্দের জায়গাটা তার পাঠশালার ঠিক পাশেই ছিল। ভেবেছিলেন পছন্দ মতো একটা আমের বাগান করবেন। বাংলা তখন অবিভক্ত। খোলা নীল আকাশ সবুজের দিগন্তে যেখানে খেলা করে, স্বপ্নিল দৃষ্টি সেখানে ছুটে যেতে বাধেনা। কিন্তু অনতিবিলম্বে দৃষ্টি বাধল। আলী সাহেবের স্বপ্নের বাগানের বুক চীরে চলে গেলো একটা উঁচু কাঁটাতারের বেড়া।
সমস্ত আবহাওয়াটা এক রাতের আঁধারে যেন বদলে গেল। খাকি উর্দির মহরা চলল সবুজের বুক চীরে। সর্বদাই একটা স্তব্ধ সন্ত্রস্ত ভাব। গুমোট পরিবেশ চোখের ঘুম নিলো কেড়ে। গভীর রাতের আঁধারে কান পাতলে শোনা যায় বুলেটের নিষ্ঠুর শব্দে ভীত বাচ্চাদের কান্না। কারোর জমি গেছে, কারোর পরিবার। কেউ হয়েছে অনাথ, কেউ বা বিকলাঙ্গ।
আলী – সাহেবের স্বপ্নের পাতে পড়ে রইল আর এক ছটাক জমি। তাই সই। ছোট্ট খুরপিটা আর ভাঙা ঝাঁঝরিটা হাতে তুলে সেই কোন ভোর থেকে চারটে আম আর কিছু ফুল গাছের পেছনে অক্লান্ত পরিশ্রম করতে দেখলে কেউ বিশ্বাস করবেনা বয়সটা নির্দ্বিধায় কখন ষাটের গণ্ডি পেড়িয়ে গিয়েছে।

গাছপালা – সবুজের প্রতি পল্টুরও আগ্রহ খুবই। ওর নিজের একটা খুরপি আছে। হাট থেকে কিনে দিয়েছিলো আলী সাহেব। পড়াশোনা বাদ দিলে দিনের সিংহভাগ কাটে ওর ওই বাগানেই। বন্ধু-বান্ধব খুব একটা নেই ওর। থাকার মধ্যে একটা আমের গাছ আছে। ওটার সাথেই যেন বড়ো হচ্ছে ও। লোহার তারের বেড়াটার গা ঘেঁসেই সেটা বেড়ে উঠেছে। নব যৌবনের সবুজ ঘন এলোমেলো বাড়িয়ে ধরা সুঠাম ডালপালাগুলির বেশ কটা অনেকটা অনৈতিক - নাকি খানিকটা ইচ্ছাকৃত ভাবেই তারকাটা অমান্য করে গিয়েছে ওধারে। হয়ত গন্ডীবদ্ধতার শিক্ষা তার বীজের আদিমতম কোষে অবর্তমান। হয়ত যে মাটি বায়ু জল আলোয় সে বেড়ে উঠেছে তার কেউই ভাগের সাম্রাজ্যের রাজনীতি শেখায়নি। তাই অজান্তে এ অপরাধ। গাছটাকে প্রাণ দিয়ে ভালোবাসে পল্টু। ওর যত অভাব অভিযোগ সব ঐ গোড়াটাতেই একরকম ঢেলে দেয়। গাছটিও হয়ত সেই অনুভুতি গুলিকে প্রতিটি পাতায় ডালে অনুভব করে। তার ছায়ার অদ্ভুত মাতৃ শীতলতায় পল্টু কোন কোন নিদাঘ দুপুরে ছোট্ট শিশুর মতো নিঃস্বারে ঘুমায়।


তার বন্ধুটির মতো পল্টুর মনেও কখনো কখনো অপরাধী প্রশ্ন ঘুরপাক খায়। জিজ্ঞেস করে বসে,
- “বেড়াটার ওপারে কি আছে গো ?”
- “তোর আমার মতোই লোক আছেরে...”
- “তবে কেনদিয়ে রেখেছে ওটা ?”
আলী সাহেব চুপ করে থাকে। কি জবাব দেবে এর? সঠিক জবাবটাকি তিনিও জানেন?

কোন কোন আলস দুপুরে পল্টু ওদিকের বিস্তৃত দিগন্তে হাঁ করে তাকিয়ে থাকে। ভাবে, দুরের ঐ আমগাছগুলিও একই রকম লাগে যেন। সবুজ। কাল বৈশাখীর যে হাওয়ায় পল্টুর বন্ধুর বিস্তৃত ডালপালাগুলি নির্দয় ভাবে দুলতে থাকে, ওপারের সবুজের বনেও যেন একই ছন্দ দেখতে পায় ও। বোঝেনা পল্টু। সবুজের সাথে সমস্ত মিশিয়ে ফেলে ছোট্ট অবুঝ ওর মনটা। মনে ভাবে বড়ো হলে যখন গায় জোর হবে “বেড়াটা দেব ভেঙে...”

সেদিন পড়ন্ত বিকেলের রোদে হঠাৎই পল্টু আবিষ্কার করে ফেলল, বেড়ার ওধারের ডালটিতে দুটি আম ধরেছে যেন! উচ্ছ্বসিত, তক্ষুনি হাত ধরে টেনে আনল বুড়োকে। হ্যাঁ দুটি আম ধরেছে বটে; তবে কোন কসরতেই বাগে আসেনা। শেষে পরাজিত হয়ে পল্টুর মাথায় হাত রেখে বললেন “ ও দুটো না হয় ওদিকের ওদের দিলই।“ আম দুটির দিকে চকচকে দৃষ্টিতে চেয়ে থাকল ছোট্ট পল্টু।

সে রাতে কাল বৈশাখী এলো। উন্মাদ ঝরে বাগানটা তচনচ করে গেলো। পরদিন সকালে পল্টু যখন বাগানের ধ্বংশস্তুপের উপর দাঁড়িয়ে বোবা দৃষ্টিতে ক্ষতির পরিমাণ হিসেব করছিল, ওর দুঃখ ভেজা চোখে হথাৎই ধরা পড়ল ওপারে অদূরে মাটিতে পড়েথাকা আম দুটি। এক মুহূর্তে পল্টুর মনটা চঞ্চল হয়ে উঠল। ঝরের ধাক্কায় ভেঙেপড়া ডাল পালাতে এমনিতেই বেড়াটা ক্ষতিগ্রস্ত। আর দিগ্বিদিক শূন্য পল্টু দিল এক ছুট। দৌড়ল...ছোট্ট হাতে পায়ে খুব সন্তর্পণে এবং সাবলীল ভাবে বেড়াটার ফাঁক দিয়ে গলে গেলো। পা দুটিতে তখন বাঁধন হারা গতি। বুকের মাঝে বন্ধুর নীরব দানের প্রতি অধীর আকাঙ্ক্ষার আগুন।
আম দুটি হাতে নিয়ে পল্টু সাম্রাজ্য বিজয়ীর মতো নেচে উঠল। আর ঠিক তক্ষুনি সমস্ত স্তব্ধতা চীরে যেন কোন এক অদূরে গর্জে উঠল কাল বৈশাখী। খোলা নীল আকাশে...নাকি ঐ দূর দিগন্তে...না নিতান্ত নিকটে...বুঝতে পারলনা পল্টু। শুধু বুঝতে পারল কোন এক নিষ্ঠুর ব্যথা বুকের এপার ওপারটা ফুঁড়ে বেরিয়ে গেলো। হাতের আমটা গরিয়ে গেলো। শীর্ণ দেহটা নরম ঘাসের গালিচায় রক্তের ফরাশে এলিয়ে দিল ও। মাথার ক্রম-স্থবির হওয়া শিহরণে পল্টু দেখল হ্যাঁ আকাশ বেয়ে নেমে আসছে আগুন... কিন্তু কে জ্বালল অত উপরে...কে জানে...

বেনামী পল্টুর অখ্যাত জীবন আজ বহুকাল হল উধাও হয়েছে। উধাও হয়েছে আলী-সাহেব আর তার সাজানো বাগান – পাঠশালা। শুধু বেড়াটা আজও প্রাণপণে মাটি কামড়ে দাঁড়িয়ে। আর তার দু’ধারে অপরাজেয় দুটি আমগাছ কালের বুকের উপর সেই মরচে ধরা বেড়াটাকে উপেক্ষা করে ছোট্ট পল্টুর বন্ধনহীন অপ্রতিরুদ্ধ ভাবনায় উর্ধমুখি। সত্যিই ওদের নিজস্বতা নেই। ওদের নীল আকাশের ভাগ নেই, নেই মক্ত বাতাসের ভাগ, নেই মাটির বাটয়ারা। জীবনের আনন্দেই স্বাধীন ওরা। কোন এক তারকাটার বাঁধনে ওরা ধরা দেয়না। ছোট্ট পল্টু বুঝতে পেরেছিলো সবুজের এ রূপ; তাই ও সমস্ত কাটাছেঁরা গুলিকে সবুজের ঘ্রাণে মিশিয়ে দিতে চেয়েছিলো। আমরা কি পারব না কোনদিন সবুজের রঙে বাঁধনহারা হতে?
আপনার ভালো লাগা ও মন্দ লাগা জানিয়ে লেখককে অনুপ্রানিত করুন
মামুন ম. আজিজ সুন্দর নির্ভেজাল মানব জীবন গল্পে সবুজের জয়গানে
স্বাধীন বাংলা তখন অবিভক্ত।----- সময়কালটা কি সাতচল্লিশ আটচল্লিশ? সুন্দর আবেগী গল্প। মাটি-জল-হাওয়ার কি ভাগ হয়।
sayani ghosh গল্প তা খুব ভালো লেখা হয়েছে , পড়ে ভালো লাগলো , আরো ভালো ভালো লেখার অপেক্ষায় রইলাম.....
আহমেদ সাবের আমাদের সবুজ হৃদয় / স্বার্থের নখরাঘাতে চিহ্ন-ভিন্ন হয় / বিভেদের বেড়াগুলো মাথা তুলে / আকাশকে ছোঁয়। আপনার গল্পের থিমটা ভাল লাগল। লেখাও।
নিলাঞ্জনা নীল খুবভাল লাগলো গল্পটা
মিলন বনিক কি চমত্কার অভিব্যক্তি..সুন্দর গল্পের বুনন..কিন্তু পাঠক কম কেন বুজলাম না...অনেক অনেক ভালো লাগলো...শুভ কামনা...
খন্দকার আনিসুর রহমান জ্যোতি akjon poltur jibon kahini khub valo laglo......golper bornona soilio sundor .....LAHIRI DA ....suvokamona apnar jonno........
মোহাম্মদ ওয়াহিদ হুসাইন ....................কেন পল্টুরা মরে... কাঁটা তারের বেড়ায়? ঞ্চমতকার লিখেছেন। শুভেচ্ছা রইল।

২৮ মে - ২০১২ গল্প/কবিতা: ২ টি

বিজ্ঞপ্তি

এই লেখাটি গল্পকবিতা কর্তৃপক্ষের আংশিক অথবা কোন সম্পাদনা ছাড়াই প্রকাশিত এবং গল্পকবিতা কর্তৃপক্ষ এই লেখার বিষয়বস্তু, মন্তব্য অথবা পরিণতির ব্যাপারে দায়ী থাকবে না। লেখকই সব দায়ভার বহন করতে বাধ্য থাকবে।

প্রতি মাসেই পুরস্কার

বিচারক ও পাঠকদের ভোটে সেরা ৩টি গল্প ও ৩টি কবিতা পুরস্কার পাবে।

লেখা প্রতিযোগিতায় আপনিও লিখুন

  • প্রথম পুরস্কার ১৫০০ টাকার প্রাইজ বন্ড এবং সনদপত্র।
  • দ্বিতীয় পুরস্কার ১০০০ টাকার প্রাইজ বন্ড এবং সনদপত্র।
  • তৃতীয় পুরস্কার সনদপত্র।

আগামী সংখ্যার বিষয়

গল্পের বিষয় "স্থিতিশীলতা”
কবিতার বিষয় "স্থিতিশীলতা”
লেখা জমা দেওয়ার শেষ তারিখ ২৫ নভেম্বর,২০২৪