অণু? অনুসুয়া তুমি! এখানে?
কি ব্যাপার অমন করে তাকিয়ে আছ যে, ভূত দেখছ না আমি, সোয়েব।
হ্যাঁ তাই তো; তুমি?
কতদিন পরে! তাই না, যাচ্ছ বুঝি কোথাও?
যাচ্ছি না, মাঝে মাঝেই পড়ন্ত বেলায় এখানে চলে আসি। এ আমার বহুদিনের অভ্যাস। কিন্তু তুমি এখানে কেন? নীরব জোর করে নিয়ে এলো, তুমি তো চেন ওকে। এখন আমার সাথেই থাকে।
হ্যাঁ চিনতাম এক সময়, গ্রামের বাড়ী গেল বুঝি?
শেষ ট্রেনেই উঠল। বাড়ীতে স্ত্রী-সন্তান তর সইল না ছুটি পেতেই ছুটল।
আর তুমি?
আমার কথা বাদ দাও। কেমন আছ বল।
যেমন দেখছ।
শান্ত দীঘির মত লাগছে তোমায়, সেই উচ্ছ্বাস সেই কলরব কোথায় খুইয়েছ সব?
তোমার বুক পকেটের তলায়।
তা যা বলেছ, আমার অন্দরে আজো সেই তোমারই বসবাস।
সত্যি বলছ?
মিথ্যে আমার আসে না, তুমি তো জান। চল ঐ বেঞ্চিটাতে গিয়ে বসি, তারা নেই তো?
নাহ এক্কেবারেই না।
বাদাম খাবে? ভয় নেই ছুলে খাইয়ে দিতে বলব না।
অধিকার হারিয়েছ বুঝি?
তা তো জানি না, তবে .........
তবে কি?
না থাক, নাও ধর।
তোমার মনে আছে, একটা সময় ছিল হোস্টেলের সামনের ফুটপাতে আমরা রোজ বসতাম। প্রতিদিন জোর করতে আমায় বাদাম ছুলে খাইয়ে দিতে, বিরক্ত হতাম।
আমি তো তোমার হাতে বাদাম নয়, ভালবাসা মেখে খেতাম।
আজ কতদিন পরে আমার হাতে বাদামের ঠোঙ্গা! আবার তুমিই তুলে দিলে। নতুন বইটি বেড়িয়েছে তোমার? নিলাদ্রি দা বলেছিল এ মাসেই বেরুবে।
আমার সব খবরই রাখ, শুধু আমাকে ছাড়া।
ঐ আর কি, জানোই তো বই পড়া আমার পুড়নো অভ্যাস। আচ্ছা বল তো আমায় এতটা ঘৃণা কর কেন?
ঘৃণা! তোমায়! হায় নারী এই চিনিলে মোরে শেষে, অথচ আমি তোমারই সৃষ্টি।
বাজে বকো না, তোমার কোন লেখায় আজ অবধি আমার চিহ্নমাত্র পাইনি। আমাকে নিয়ে লেখা পুরনো একটি কবিতাও তুমি প্রকাশ কর নি। নতুন তো নয়ই।
তাই বুঝি মনে হল, তুমি ঘৃণার পাত্রী?
নয় তো কি?
পাছে বিরক্ত হও, অশান্তির আঁচড় লাগে গায়। তোমাকে বিব্রত করতে চাই নি মোটেই। নয়ত কত যে বিনিদ্র রজনী আমার কেটেছে তোমার বাড়ির বাইরে দাঁড়িয়ে, কখনো জানতে পেরেছ তুমি। পরিযায়ী পাখির মত কতবার ছুটে গেছি গভীর রাতে, ভোরের আলো ফোটার আগেই ফিরে এসেছি। পাছে টের পাও, বিরক্ত হও।
কি বলছ তুমি? অথচ আমি কতদিন ভেবেছি এই বুঝি তুমি এলে। কতবার ছুটে গেছি বন্ধ দরজার কাছে। বার বার আশাহত হয়েছি।
এখনো তো আগের বাসাতেই আছ জানি।
ঠিকানা বদলে কি হবে। তোমার দেয়া বিশেষণের সেই পোড় বাড়ী। আরশোলার সাথে সানন্দ সহবাস। ও আমার বড় মায়ার সংসার।
এখনো মনে রেখেছ!
ঐ তো সম্বল আমার, ভুলে গেলে চলবে কেন? জানো তো, সব কিছু ভীষণ যত্নে লালিত আছে। প্রথম দেয়া নীল খাম, গোলাপ। অবশ্য এখন তা গন্ধহীন বিবর্ণ। আনন্দে-বিষাদে এলোমেলো সংলাপ, যোগ্য হয়ে উঠতে বলা নির্দয় আদেশ। সব আছে ঠিক ঠাক। কিছু এখানে, এই বুকের পিঞ্জরে, কিছু সেলফে সাজানো থরে থরে।
নিজেকে ভীষণ বোকা আর ছেলে মানুষ মনে হয় জানো? আমি অনেক দিন পর্যন্ত বুঝেই উঠতে পারিনি তোমার অভিমানের সূত্রটি কি ছিল। ভীষণ রাগ হত তখন তোমার উপর। আর যখন বুঝতে পেরেছি তখন থেকেই লজ্জায় গুটিয়ে গেছি নিজের ভেতর। নিজেকে কতবার ধিক্কার জানিয়েছি, যে আমি নিজেই যোগ্য হয়ে উঠতে পারি নি কোনদিন অথচ সেই আমিই কিনা তোমায় যোগ্য হয়ে উঠতে বলেছি! জানো তো, মানুষের বয়সের সাথে সাথে বিবেচনা শক্তি বাড়ে ঠিকই কিন্তু ততদিনে ফিকে হয়ে যেতে থাকে আজন্ম লালিত স্বপ্ন গুলো।
বাদ দাও, তুমি কিন্তু এখনো বললে না এই প্লাটফর্মে কেন।
বিশেষ কোন কারণ নেই শেষ বিকেলের এই ফাকা প্লাটফর্মটি আমার বেশ পছন্দ।
হাঁ হাঁ কি বলছ? এমন জনারণ্যকে তোমার ফাঁকা মনে হচ্ছে?
শেষ ট্রেনটা চলে গেছে, একটু পরেই ফাঁকা হয়ে যাবে এখানটা, অনেকটা আমার মতই। অণুর শেষের কথাটা সগতোক্তির মত শোনাল।
কি বললে, তোমার মত মানে?
ও কিছু না।
তোমার কথা বল।
আমার আবার কথা। আমার তো আর নতুন কোন গল্প নেই। পুরনোকে আঁকড়ে ধরেই বেঁচে আছি।
এই এতটা বছরেও একটুও বদলাও নি তুমি।
লক্ষ করলে দেখতে পেতে দু পাশের চুলে রুপালি রঙ লেগেছে।
এটুকুই?
আর সব তোমার ফেলে যাওয়া সময়ের সাথেই মিশে আছে। বলতে পার আমার ক্যালেন্ডারে আজো নতুন কোন দিন যুক্ত হয়নি। না কোন বিশেষ মুহূর্ত। আমি সেই সময়েই পরে আছি। তোমাকে হারিয়েছি স্মৃতিটুকুও যদি মুছে যায় তাহলে আর কি নিয়ে বেঁচে থাকা বল।
এখনো পারলে না, ঝেরে ফেলতে?
তবে যে ঘৃণা করতে হয়!
কেন পারছ না ঘৃণা করতে?
ভালোবাসার অমন অপমান!
অথচ আমি.....
অণু সত্যি করে বল তো, ভাল আছ তুমি?
ততটা ভাল যার থেকে বেশি ভাল থাকার অধিকার আমার নেই।
বিয়ে করলে না কেন?
কি জানি কিসের অপেক্ষায়। আসলে মন থেকে সারা পাই নি বলেই হয়ত...। নটা পাঁচটা অফিস করি। স্মৃতির এ্যালবামের ধুলো উড়োই। সময় তো আর থেমে থাকছে না।
একটিবার ফিরে এলে পারতে।
তুমিও তো এলে না।
আমি যে যোগ্যতার মাপকাঠি জানি না।
উফ দয়া কর, এবার অন্তত ক্ষমা কর। বিশ্বাস কর আমি আর পারছি না।
অণু তুমি কাঁদছ, আমি কিন্তু ঠিক সেভাবে বলি নি কথাটা।
আমি জানি লেখক তুমি আর বাস্তবের তুমি এক নও। কোন কথার কোন মানে খুঁজতে যাও না কখনো। যেমন আমাকে বোঝ নি এক ফোঁটা।
জানই যখন এলে না কেন?
আমার বুঝি অভিমান থাকতে নেই? জানতাম ফিরে চাইলেই পাব কিন্তু কোন মুখে গিয়ে দাঁড়াতাম বল তো?
নিজের আসনে কি মুখ লুকিয়ে বসতে হয়?
হয় বৈ কি? আসন চ্যুত হয়ে পরে ফিরে পেতে চাওয়ার মত লজ্জার আর কিছু নেই।
যদি তাই বল, তাহলে বলব লজ্জার তো আমারও কম কিছু নেই। আপন যে জন তাকে ধরে রাখতে না পারা, বুঝতে না পারা সর্বোপরি আগলে রাখতে না পারার লজ্জাই বা কম কিসে? সন্ধ্যা পেরিয়ে রাত নেমেছে, চল ফিরবে। তোমাকে পৌঁছে দেই?
দুজনে উঠে দাঁড়াল, রেল লাইনের পাশ ঘেঁসে নির্বাক দুটি মানুষ হেটে যাচ্ছে। সোয়েব তখনো ভাবছে এ যেন এক স্বপ্ন! স্বপ্নের পথ ধরে ও হেটে চলেছে এতক্ষণ ধরে। এত বছরের চাওয়া আজ স্বপ্নের মত করেই যেন ধরা দিল। কতবার ভেবেছে আর একটিবার, কোথাও না কোথাও যদি ক্ষণিকের জন্য দেখা হত। কোন কথা না হয় না হল। শুধু চোখের দেখা। অবশেষে আজ এলো সেই মাহেন্দ্রক্ষণ এ কি স্বপ্ন নয়? আনমনে ডেকে উঠল ‘অণু’ চুপ করে গেলে যে বড়।
অণু দাঁড়িয়ে পরল। আধারে দেখা যাচ্ছিল না তাঁর চোখে জল, ভাঙ্গা গলায় জানতে চাইল, আর দেখা হবে না?
সোয়েব এমন প্রশ্নের জন্য প্রস্তুত ছিল না।
থমকে গেল শুনে, অপ্রস্তুত কণ্ঠে বলল, তুমি যদি চাও, তবে.........।
ততক্ষণে অণুর ধৈর্যের বাধ ভেঙ্গে গেছে, সখেদে বলে উঠল, কেন আমাকেই চাইতেই হবে বার বার, কেন আমি বারংবার ভুল করে জ্বলব? তুমি কি একটিবার চাইতে পার না? অণুকে কখনো কাঁদতে দেখেনি সোয়েব। বোকার মত সেও কেঁদে ফেলল। অঝরে কাঁদছে অণু সোয়েবকে জড়িয়ে ধরে। দুজনের চোখের জলে জোছনার নাচন নতুন গল্পের পটভূমি লিখতে ব্যস্ত।