খুব যত্ন করে দাঁড়ি কাটতে লাগলো মতিন । মতিন আর যতো কাজেই অবহেলা করুক না কেন এই দাঁড়ি কাটার ব্যাপারে সে খুব যত্ন নেয় । তার কাছে দাঁড়ি কাটা একটা শিল্প । আসলে সবাই দাঁড়ি কাটতে পারে না । শেভ করে খুব যত্ন করে রেজরটা ধুয়ে রাখল সে । তার চোখের ওপর এখন রূপলী পর্দা । যাই দেখে তাই ভালো লাগে ।
তাকে যদি এখন দুনিয়ার সবচাইতে সুন্দর মানুষটাকে বেছে নিয়ে হয়, তবে সে একজনকেই বেছে নেবে । সে হল রূপা । রূপা দেখতে সুন্দর বটে কিন্তু তার বিশেষত্ব অন্য কারণে । তার কথা যেন মুক্তো মালা । ঝরে পড়ে অবিরাম জল ধারার মতো । আর সে কাঁদলে মনে হয় পুরো পৃথিবী কাঁদছে । চৈত্রের রোদ্দুরে সে যদি কাঁদে তবে মনে হয় শ্রাবণের সব মেঘ এসে হাজির হয়েছে আকাশে । এক বিষণ্ণ হাহাকার বুকের মাঝে সেই মেয়েটার জন্য । কখনও সে গম্ভীর হয়ে থাকে । তখন সে ফিজিক্সের সমীকরণ নিয়ে ভাবতে থাকে ।
রূপার বয়স আঠারো থেকে বিশের মাঝে । অতিরিক্ত লেখাপড়ার কারণে চোখে সেলুলয়েডের মোট ফ্রেমের চশমা । তার সাথে কথা বলতে গেলে সব সময় ফিজিক্স এসে পড়ে । প্রেম করতে এসে মতিন, শিখে গেল আর্কিমিডিস, নিউটনের সূত্র !
এইতো সেদিন যখন রূপাকে সে বলল, ‘আমি তোমাকে একটা কথা বলতে চাই’ ।
‘থামলে কেন বলো’
‘আমি তোমাকে...’
‘তুমি আমাকে ? কি ? স্পষ্ট করে বল’
‘আমি তোমাকে...’
পৃথিবীর অন্য কোন মেয়ে হলে নিশ্চিত বুঝতে পারতো ব্যাপারটা কিন্তু যার মাথায় ফিজিক্স বাদে অন্য কোন বিষয় নেই সে কি করে বুঝবে এ প্রেমের কথা ? মতিন অনেক চেষ্টা করেছে বলবার কিন্তু কখনও পারেনি । ইউনিভার্সিটিতে সব সময় নীল শাড়ি পড়ে আসে রূপা । নীল রঙ খুব ভালো লাগে না মতিনের । কিন্তু রূপাকে দেখে নীল রঙের একরকম ভক্ত হয়ে গেল সে । তার মনে হয়ে পৃথিবীর সবচাইতে সুন্দর সৃষ্টি হল নীল রঙ !
আজ মতিনের জন্য একটি বিশেষ দিন । সে আজ রূপাকে তার ভালো বাসার কথা জানাবে । অনেক দিন পর তাই সে দাঁড়ি কাটলো ।
মার্চ মাসে যখন বঙ্গবন্ধু ডাক দিলেন স্বাধীনতার তখনই মতিন বুঝে গেল আর বাড়িতে থাকা চলবে না । তার বন্ধুরা যেখানে নিজের জীবনকে তুচ্ছ করে স্বাধীনতার জন্যে ঝাপিয়ে পড়েছে তখন সে পিছিয়ে থাকবে কেন ? সে কাউকে না জানিয়ে একদিন নিরুদ্দেশ হল, তার সাথে এ সময় নানা মানুষের পরিচয় হল । তাদের মাঝে কেউ হকার, খুঁজলির মলম বিক্রি করে, আবার কেউ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের মেধাবী ছাত্র আবার কেউ গ্রামের সহজ সরল চাষা ।
এদিকে সে যখন বাড়ি ছেড়ে চলে গেল যুদ্ধের জন্য তখন তার বাবা আহাদ আলি চিৎকার করে বাড়ি মাথায় তুলল । আহাদ আলির বয়স পঞ্চান্ন থেকে ষাটের মাঝে । থুতনিতে অল্প ছাগলের মতো দাঁড়ি । তাকে দেখলে যে কোন সাধারণ বুদ্ধির লোকই বুঝতে পারবে যে সে কোন ভালো কাজের মাঝে নেই । জামায়াতে ইসলামির সদস্য সে । পাকিস্তান তার কাছে এতই প্রিয় যে সে ঘুমের মাঝেও পাকিস্তানের জাতীয় সংগীত গায় । কাজেই তার ছেলে মুক্তিযুদ্ধে চলে গেছে এই কথা শোনার পর সে যারপরনাই উত্তেজিত হল ।
বলল, ‘ওই মরিয়ম । বজ্জাত মাগী, তোর পোলা মালাউন গো লগে যোগ দিছে’ ।
মতিনের মা মরিয়ম বেগম কিছু বললেন না । “বজ্জাত মাগী” নামক গালিটা শোনা তার নিত্ত ব্যাপার হয়ে গেছে । কিন্তু তারপর এক অপ্রত্যাশিত কথা সে শুনলো ।
‘ওই শুয়োরের বাচ্চা, তোরে আমি তালাক দিলাম । আইন তালাক, গাইন তালাক, বাইন তালাক । তোর মতো যেই মাগীর প্যাড দিয়া এমন বজ্জাত বাইর হইছে তারে আমি আমার ঘরে রাখুম না’ ।
এই অপ্রত্যাশিত বাক্যটি শোনার পর মরিয়ম বেগম মূর্ছা গেলেন । সেই যে মূর্ছা গেলেন আর জাগলেন না ।
মতিন তখন খুব সানন্দে ট্রেনিং করছে । সে এখন খুব ভালো রাইফেল চালাতে পারে । গেরিলা হামলার জন্য সে প্রস্তুত হচ্ছে ।
তারপর যুদ্ধে যোগদান । কিন্তু প্রথম প্রথম মৃত্যু দেখতে অভ্যস্ত না হওয়ার কারণে সে কাঁদত ।
তার বন্ধু তানভীর তাকে দেখে মৃদু হেসে বলল, আরে কাঁদছিস ? আমাদের সাথে থাক, খুব তাড়াতাড়ি শক্ত হয়ে উঠবে মন ।
আসলে ভুল বলেনি তানভীর । সে খুব সহজেই সবকিছু মেনে নিতে পারলো ।
যুদ্ধ চলছে । ঝাকে ঝাকে গুলি কানের পাশ থেকে চলে যেতে লাগলো । হঠাৎ এক বুকফাটা আরদনাত ।
একী !
তার পাশে নিথর তানভীর ।
মতিনের মন আসলেই আসলেই শক্ত হয়ে গেছে । তার চোখে পানি এলো না । তার মরে যেতে ইচ্ছে করলো না । সে মরে গেলে বাংলাদেশ স্বাধীন হবে কীভাবে ?
আহাদ আলি খুব ভালো ভাবে শান্তি কমিটি তৈরি করেছে । সে সভাপতি । আর মসজিদের খতীব ও আরো কিছু ইসলামপন্থী (!) লোক তার সাথে রয়েছে । খতীব প্রতি শুক্রবার ধর্ম ছেড়ে যারা মালাউনদের সাথে যারা যোগ দিয়েছে তাদের বিরুদ্ধে সোচ্চার হতে বলেন । ‘ভাইরা, আমাদের মুসলমানদের সাথে যারা এতো বড় অন্যায় করেছে তাদের ছেড়ে দেওয়া যাবে না । আর হিন্দুদের এই এলাকা দিয়ে নির্বংশ করতে হবে । একটা হিন্দু মারলে সাত আসমানের সমান নেকি পাওয়া যায় ...’
আহাদ আলির দিন বেশ ভালো যাচ্ছে । তার বউ নাই তাতে কি হয়েছে ? গ্রামের সব সুন্দরী অসুন্দরী মেয়েদের ধরে আনা হচ্ছে টর্চার সেলে ।
আহাদ আলি বলে, ‘মা, জামা খোল । দেখি তোমার মাঝে কতো সুন্দর লুকিয়ে আছে ?’
কেউ কেউ আপত্তি করে । কিন্তু সকলের অবস্থা এক না । কাউকে কাউকে বলার সাথে সাথে অজ্ঞান হয়ে যায়, আসলে অজ্ঞান মেয়েদের ধর্ষণ আর একটা লাশের সাথে সেক্স করা একই কথা ।
ধর্ষণের পর মেয়েদের স্তনের বোঁটা কামড়ে ছিড়ে ফেলে আহাদ আলি । বেয়নেট দিয়ে খুঁচিয়ে ক্ষতবিক্ষত করা হয় যোনি । তারপর সেই লাশ ভাসিয়ে দেওয়া হয় নদীতে । আসলে একই জিনিস প্রত্যেকদিন ভালো লাগে না ।
মতিন এক সময় পাকা যোদ্ধা হয়ে উঠলো । হিংস্র পশুর মত মানুষদের পৃথিবী থেকে সরিয়ে দেওয়া আর পায়খানার পর হাত ধোয়া একই ব্যাপার ।
কম্যান্ডার হিসেবে মতিনের পদন্নোতি হল । সে কম্যান্ডার হবার পর চিন্তা করলো নিজের গ্রামে একটা অপারেশন করা যায় ।
সে জানে এখানে শান্তি বাহিনীর আহ্বায়ক তার বাবা । তথাপি সে তার বাবাকে খুব ভালোবাসে । কিন্তু তার বাবার চাইতেও দেশ তার কাছে বড় ব্যাপার ।
তাই আজ দাঁড়ি কামাচ্ছে সে । বেশ ভালো লাগছে । পাকিস্তানিরা আবার টুপি, দাঁড়িঅলা লোক খুব পছন্দ করে । তাই, দাঁড়ি রাখতে হয়েছিল ।
কিন্তু এখন দেশের অনেকটাই হানাদার মুক্ত হয়েছে ।
তাই, নিজ গ্রামকে হানাদার মুক্ত করতে সে এসেছে । দাঁড়ি কামিয়ে সে তার মিশনে যাবে ।
সকলকে প্রস্তুত হিসেবে দেখে বেশ ভালো লাগলো মতিনের । আনন্দে চোখ ভিজে আসলো তার । তার দেশ আজ পশুদের হাত থেকে রক্ষা পাবে, এদেশের সাধারণ জনগন যেভাবে উঠেপড়ে লেগেছে সে দেশ স্বাধীন না হয়ে যাবে কোথায় !
তারপর সে রূপাকে বিয়ে করবে । সুন্দর একটা মেয়ে হবে তাদের । মতিন চায় রূপার মতো গায়ের রঙ হয়ে যায় যেন তার মেয়ের । মিশন শেষে সে যাবে রূপাদের বাড়ি । পুরো গ্রামটা এখন শ্মশান হয়ে আছে, না ভুল বললাম, এটাকে লাশ কাটা ঘরের সাথে তুলনা করা যায় । শকুন, কাক ঘোরাফেরা করছে মাথার ওপর ।
আহাদ আলি আজ একটা ভালো মেয়ে পেয়েছে । তবে, বেশ তেজি মেয়ে ছিল সে । কোনও ভাবে কাপড় খুলতে দেবে না সে । কিন্তু অনেক কষ্ট করে চেপে ধরে ধর্ষণ করলো সে ।
তারপর, ফেলে রাখে পরদিন ভাসিয়ে দেবার জন্য ।
এক রক্তাক্ত যুদ্ধের পর মতিন গেল টর্চার সেলে । তার বাবা আহাদ আলি অবশ্য পালিয়ে যেতে পেরেছে ।
কিন্তু...
তার সামনে নিথর রূপা, বোঁটাহীন স্তন, ক্ষতবিক্ষত যোনি । মনে হচ্ছে খুব শান্তিতে ফিজিক্স নিয়ে চিন্তা করছে ।
মতিনের বুকের বাম দিকে চিনচিন করে ব্যাথা করে উঠলো । মনে হল কেউ কামড়ে ধরেছে হৃদপিণ্ড । সে পড়ে গেল মেঝেতে ।
না, না, সে মরবে না । সে মরলে যুদ্ধ করবে কে ?
২৬ মার্চ - ২০১২
গল্প/কবিতা:
১০ টি
বিজ্ঞপ্তি
এই লেখাটি গল্পকবিতা কর্তৃপক্ষের আংশিক অথবা কোন সম্পাদনা ছাড়াই প্রকাশিত এবং গল্পকবিতা কর্তৃপক্ষ এই লেখার বিষয়বস্তু, মন্তব্য অথবা পরিণতির ব্যাপারে দায়ী থাকবে না। লেখকই সব দায়ভার বহন করতে বাধ্য থাকবে।
প্রতি মাসেই পুরস্কার
বিচারক ও পাঠকদের ভোটে সেরা ৩টি গল্প ও ৩টি কবিতা পুরস্কার পাবে।
লেখা প্রতিযোগিতায় আপনিও লিখুন
-
প্রথম পুরস্কার ১৫০০ টাকার
প্রাইজ বন্ড এবং সনদপত্র।
-
দ্বিতীয় পুরস্কার ১০০০ টাকার
প্রাইজ বন্ড এবং সনদপত্র।
-
তৃতীয় পুরস্কার সনদপত্র।
আগামী সংখ্যার বিষয়
লেখা জমা দেওয়ার শেষ তারিখ ২৫ ডিসেম্বর,২০২৪