‘Long, long afterward, in an oak
I found the arrow, still unbroke;
And the song, from beginning to end,
I found again in the heart of a friend.’
―Henry Wadsworth Longfellow
১.
ভুলু বাঁশি বাজায় এবং টুলু পশুপাখি শিকার করে; শিকারী ও বংশীবাদক―দুই বন্ধু।
গাঁয়ের এক কোণায় দুই বন্ধুর দু’টো কুঁড়েঘর; মাটির দেয়াল, শনপাতায় ছাওয়া। দুর থেকে খুব সহজে চোখে পড়ে না―ঘন গাছপালার সবুজ আড়ালে ঘেরা। দু’জনের বয়স কাছাকাছি।
জরির স্বামী টুলু শিকারে যায় আর পরির স্বামী ভুলু বাঁশি নিয়ে বেরিয়ে পড়ে।
জরি ও পরি―হরি হর আত্মা; এক অপরকে পছন্দ করে ও ভালোবাসে। তারাও সই পাতায়; বিপদে আপদে পরস্পর কাছে এসে দাঁড়ায়।
এই দু’টো বাড়ি ব্যস্ত জনপদ হতে একটু দূরে―গ্রামের আলো ছায়ার শেষপ্রান্তে ; মাঠ পেরিয়ে বিলের শেষ দিকে পাহাড় ঘেঁষে। মূল গ্রামের লোকজনের সাথে পুজো-পার্বন, ঈদ-কোরবান ছাড়া তাঁদের যোগাযোগ তেমন নেই। দুই বন্ধু যখন হাটে যায়, এক সাথে যায়; এক সাথে ফিরে। যখন গাঁয়ের এই আঁকাবাঁকা মেটোপথ মাড়িয়ে তারা বাড়ি ফিরে শেষ বিকেলের ঘন ছায়া নেমে আসে। বনের ঝোঁপে ঝিঁ ঝিঁ ডাকে। কালি বাড়ির তেতুল গাছে পাখা ঝাপটায় ঝুলন্ত বাদুড়ের দল। ঘরমুখো হাটুরে লোকজন তাদের দেখে ঈর্ষা করে । কেউ কেউ মুখ ফসকে বলে বসে―ওই দেখো, মানিকজোড় যায়। তারা এসব যেন শুনেও শোনে না; কোন উত্তর না দিয়ে চুপচাপ ঘরে ফিরে।
বাড়ির পাশেই ছোট একটি পাহাড়ি ঝর্ণা―পানি জমতে জমতে তৈরি ছোট পুকুর। ঝর্ণার পানিতে তারা রান্নাবান্না করে; আর কাপড়-চোপড় ধোয়। আর দুই বন্ধু যখন তাদের কাজে বেরিয়ে পড়ে―দুই সই কলসি কাঁখে আস্তে আস্তে ঘর থেকে বেরোয়। গ্রামের মাঝামাঝি এক পাঠশালা; সেখানে আছে একটি নলকূপ । এই নলকূপ থেকে কলসি ভরে পানি আনে। খাবারের পানি। আসা যাওয়ার এই সময়টুকু তারা গালগল্প করে। নিজের গল্প, পরের গল্প আর কখনো কখনো তাদের বরের গল্প।
দুই সই যেন দুই দেহে এক প্রাণ। তারা এক সঙ্গে নলকূল থেকে পানি আনে। এক সঙ্গে ঝর্ণায় নেমে গোসল করে; হাতে সময় থাকলে মাঝে মাঝে সাঁতার কাটে। ডুব দেয়। জরি ডুব দিলে পরি অপেক্ষায় থাকে, পরি ডুব দিলে জরি অপেক্ষায় থাকে কখন অন্যজন ঝর্ণার তলা থেকে হেসে হেসে ভেসে ওঠবে। আবার কখনো কখনো তারা ঝর্ণার জলে মাছ ধরে। চিংড়ি, বাইম, টাকি, পুঁটি আর কই মাছে তাদের পুটুলি ভরে যায়।
দুই বাড়ির সামনে-পেছনে, ডানে-বামে সবুজ ফসলের মাঠ। জরি আর পরি সেখানে লাউ, করলা, শিম, বেগুন, মরিচ, শসার চাষ করে। উঠানে আছে ফলের বাগান। জরি আর পরির বাগানে পেঁপে, কলা, লেবু সারা বছর ফলতে থাকে। আরো আছে আম, কাঁঠাল, জাম, বেল, আমলকি, পেয়ারা, আমড়া প্রভৃতি সুস্বাদু ফলের বাগান।
বলতে কী জরি আর পরির কোন অভাব নেই। কারো প্রতি তাদের কোন অভিযোগ-অনুযোগও নেই। গ্রামের কোন মানুষ এই দুই দম্পতির কথা বার্তায়, আচার ব্যবহারে কষ্ট পেয়েছে, ব্যথিত হয়েছে এমন কথা কে কখনো শোনেনি।
টুলু প্রতিদিন সকালে একমুটো সাদা ভাত মুখে দিয়ে তির-ধনুক-ছুরি নিয়ে পাহাড়ের দিকে ছুটে চলে; বনে বনে ঘুরে বেড়ায়।
আর ভুলু সকালে উঠে ভাত দুটো মুখে দেয়, মুখে দেয় এক খিলি পান। তারপর অজানার পথে পা বাড়ায়। কাঁধে নেয় এক কুদরতি ঝোলা। তার এই ঝোলার ভেতরে মুরলি, সানাই, ঝাঁঝি, খোল, করতাল, কাড়া আর কত কী?
টুলু পাহাড়ের কোলে ঝোঁপের আড়ালে গিয়ে বসে। ফাঁদ পাতে। বন মোরগের বাসা খোঁজে। ডাক শুনতে চেষ্টা করে। বুনো পাখির সন্ধানে গাছের ডালে, পাহাড়ের গুহায়, নদীর ধারে দৃষ্টি ছুড়ে। বক, মোরগ, ঘুঘু , শালিক তার তির থেকে রেহাই পায় না। পাখি ধনুকের গায়ে গেঁথে হুমড়ি খেয়ে পড়ে। সে ছুরি নিয়ে জবাই করে। বেতের ছিলায় গেঁথে নেয়। বিকেলে যখন ঘরে ফিরে পাখির লম্বা গাঁথুনি তার কাঁধে ঝুলতে থাকে। প্রতিদিন ঘরে ফিরে সে কলামুড়ি খায়। এক খিলি পান মুখে দেয়ার আগে ভুলুকে খবর দেয়। ভুলুকে ডেকে এনে পাখিগুলো তিন ভাগ করে বিলি করে। এক ভাগ সে নিজের জন্যে রাখে, একভাগ ভুলু ও পরির জন্যে। অন্য ভাগটি প্রতিদিন গ্রামের যে কোন পছন্দের একজনকে দিয়ে আসে। তারা এই ভাগ একজনকে একবারই দেয়। পাখির ভাগ বাঁটোয়ারার কাজটি প্রায়শ ভুলুই করে ; কখনো কখনো জরি। এই ভাবে টুলুর শিকারী জীবন চলতে থাকে। মাঝে মাঝে সে জরির দীর্ঘশ্বাস অনুভব করে। বুঝতে পারে নিঃসঙ্গ জরি সাথি চায়। বন্ধু চায়। সন্তানের প্রত্যাশায় দিন গোনে। শেষ বিকেলে দুই বন্ধু গ্রামের হাটে যায়-আড্ডা পেটায়। এক সঙ্গে ফিরে।
ভুলু তার কুদরতি ঝোলা কাঁদে ঘুরে বেড়ায়―হাটে মাঠে বাটে। সে প্রথমে গ্রামের পাঠশালার কোণায় গিয়ে বসে―কৃষ্ণচূড়া গাছের তলায়। তার সাতরঙা শতরঞ্জিটি সে বিছায়। তারপর তার সুরসরঞ্জামগুলো সামনে সাজিয়ে রেখে মুরলি দিয়ে শুরু করে। ছোট ছোট ছেলেমেয়েগুলো তখন বুঝতে পারে এ ভুলুর সুর। ভুবন ভোলানো সুর। তারা তার চারপাশে বসে পড়ে । সে একে একে সানাই বাজায়, মাদল বাজায়, খোল বাজায়, করতাল বাজায়, কাড়া বাজায়। ঘুরিয়ে ফিরিয়ে বার বার বাজায়। প্রতিটি বাদনের আগে বাজনার নাম বলে, ওস্তাদকে স্মরণ করে তারপর শুরু করে। তার প্রতিটি বাদন তিন তালির মাধ্যমে শেষ হয়―তালিতে সবাই অংশ নেয়। বেল বাজার সঙ্গে সঙ্গে সে উঠে পড়ে। সে এভাবে বংশী বাজায়, বাজনা বাজায়―হাটে মাঠে বাটে। ভুলু ঘরে ফিরলে পরির রাঙা মুখখানি দেখে অলৌকিক আনন্দে অপার ভালোবাসায় মগ্ন হয়ে পড়ে। লুলু আর সুরি তার কোলে আর কাঁধে জড়িয়ে থাকে।
২.
ভুলু টুলুর কষ্ট কোথায় বুঝতে পারে। পরি জরির শূন্যতার বেদনাটুকু উপলব্ধি করে সব চেয়ে বেশি। পরি এ কারণে সব সময় লুলু আর সুরিকে জরির কাছেই রেখে ক্ষেতে কাজ করে। রান্নাবান্না সেরে নেয়। শেষে জরির ঘরে গিয়ে জরিকে সময় দেয় রান্নাবান্নায় সাহায্য করে। এতে জরির সময় কাটে। কিন্তু মন ভরে না। কখনো কখনো লুলু আর সুরিকে দেখলে তার বুকের ভেতরের হাহাকারটুকু হুহু করে ফেটে পড়ে। সে আর নিজেকে ধরে রাখতে পারে না।
টুলুর সঙ্গে একদিন ভুলু শিকারে যায়। টুলু যথারীতি তির নেয়, ধনুক নেয়, ছুরি নেয়। টোটামিয়ার পাহাড় পার হয়ে আলতাবানুর ছড়া দিয়ে তারা এগিয়ে যায়। হঠাৎ বংশীবাদক জানতে চায়:
―টুলু, এটি কিসের ডাক ? এতো সুন্দর। এতো মিষ্টি।
―ওই দেখ শিমুল ডালে। বউ কথা কও ডাকছে।
ছড়ার এক পাশে পানির স্রোতের ধারে বালির চর পড়েছে। এই চরে একটি ছোট সাদাকালো পাখি লম্বা লেজ নেড়ে নেড়ে দ্রুত হাঁটছে। ছুটছে।
―টুলু, ওই পাখিটি কী সু›ন্দর নাচছে দেখো। এটির নাম কী? বংশীবাদক আবার প্রশ্ন করে।
―ওহ, তুই চিনিস না। এটি খঞ্জনা। এটি নাচের পাখি। সে দিন টুলু শুধু একটি সাদা বক মেরেছিল। বকটির বুকে তির লাগলে দ’ুটো লম্বা সাদা পাখা ঝাপটিয়ে কক কক করে পালাতে গিয়ে মাটিতে লুটে পড়ে। এক দৌড়ে টুলু তা ধরে এনে ভুলুকে দেয়। সে ছুরিটি হাতে নিয়ে বকটি জবাই করতে গিয়ে দেখে ভুলুর চোখ দুটো ভিজে গেছে, গাল বেয়ে গড়িয়ে পড়ছে অশ্র“র শুভ্রদানা। বিষয়টি টুলু বুঝতে পেরে সেদিন শিকার বন্ধ রেখে তারা ঘরে ফিরে আসে।
পরদিন টুলু আর শিকারে যায়নি। উঠোনে বসে জরির বাগানের দিকে তাকিয়ে আছে। ভুলু তার ঝোলা কাঁধে ঠিকই বেরিয়ে পড়েছে। সে টুলুর কাছে এসে দাঁড়ায়; জরি তাকে বসতে বলে। এক খিলি পান এনে দেয়। তারপর ভুলুর সঙ্গে টুলুও বেরিয়ে পড়ে। টুলু কোথায় যাবে, কী করবে সে জানে না। তার কোন কাজ নেই। আনমনে তারা হাঁটে; হাঁটতে থাকে। সে দেখে কয়েকটি ছেলেমেয়ে ভুলুর পিছু নিয়েছে; তারা তখন পাঠশালায় যাচ্ছে। হঠাৎ একটি মেয়ে একটু এগিয়ে এসে ভুলুর হাত ধরে বলে ওঠে:
―ভুলুকাকু, এই পাখাটি তোমার জন্যে; আম্মুর কাছ থেকে তোমার জন্যে নিয়ে এসেছি। আমার আম্মু পাখা বানায় তো। তোমাকে বাঁশি বাজাতে নিয়ে যাবো একদিন। আমার ভাইয়া বাঁশি শোনবে।
―ঠিক আছে কাকু। আমি আগামীকাল যাবো। দুপুরে তোমার আব্বুকে থাকতে বলো।
ওরা চলে গেলে তারা হাটের দিকে এগুতে শুরু করে। ভুলুর হাত থেকে টুলু পাখাটি নেয়। হাতের কাজ খুব সুন্দর ; কাপড়ের উপর রঙিন সুতোয় বোনা―আলপনা আঁকা। মোল্লার চা দোকানে তখন অনেকে ভুলুর অপেক্ষায়। তারা দোকানে ঢোকার সঙ্গে সঙ্গে চা নাশতা চলে আসে। আসে পানও। তারপর ভুলুর ভুবনজয়ী বাঁশির সুরের মূর্ছনা দুপুর অবধি বাজতে থাকে।
৩.
রাতে শিকারী ভুলুর কান্নার বিষয়টি স্ত্রী জরিকে বলে। ঘটনাটি শুনে সেও কেঁদে দেয়। টুলু ব্যাপারটি টের পেলে জরির কান্না আরো বেড়ে যায়। সে ফুঁপিয়ে ফুঁিপয়ে বলতে থাকে:
―গতকাল দুপুরে ক্ষেতে কাজ করতে করতে হঠাৎ আমি ঘুমিয়ে পড়ি। ঘুমের ঘোরে আমি স্বর্গের বাগানে গিয়ে ঘুরে ঘুরে বেড়াতে থাকি। সেখানে আমি দেখি―চারদিকে নানা বর্ণের নানা ধরনের শত শত পুষ্পরাজি সুবাস ছড়াচ্ছে। বিচিত্র পাখির ডাক ও নানা ফুলের সুগন্ধে আমি প্রায় আচ্ছন্ন; হঠাৎ শুনতে পাই কয়েকটি শিশু আমাকে মা মা করে ডাকছে। একটি মেয়ে আমার কোলে উঠে বসে এবং বলে আমাকে ছাড়া মেয়েটির স্বর্গে আর ভালো লাগছে না । সে আমাকে কাছে পেতে চায়, আমার কাছে যেতে চায়; কিন্তু আমাদের দু’জনের মাঝে বয়ে চলছে একটি দীর্ঘ নদী। প্রতিনিয়ত এর স্রোত তীব্র গতিতে ধেয়ে চলছে―এই রক্তগঙ্গা পাড়ি দিয়ে সে আর আমার কাছে যেতে পারছে না। যখন আমার বাগানে ফুল ফোটে, পাখি গায়, ফুল সুবাস ছড়ায় তখন রক্তনদীটি শুকিয়ে যায়-আস্তে আস্তে শীর্ণ হতে থাকে; তারা কয়েকজন মিলে আমাদের কাছে যেতে চেষ্টা করে। কিন্তু পরদিন যখন তুমি পাখি শিকার কর, পাখি মারো, জবাই করো নদীটি আবারও দীর্ঘ ও গভীর হয়ে পড়ে। তারা আর যেতে পারে না। তারপর কাঁদতে কাঁদতে আমার ঘুম ভেঙ্গে যায়।
ঘুম ভাঙ্গার পর জরি বুঝতে পারে টুলু পাখি শিকার বন্ধ না করলে তারা কখনো বাবামা হতে পারবে না। টুলু আনন্দের ঘোরে তার শিকারের নেশার সঙ্গে প্রাণপাতের প্রসঙ্গটি কখনো এভাবে ভাবেনি। ভাববার সুযোগও হয়নি তার। এবার তার নিজের ভেতর টানাপোড়েন চলতে থাকে। হঠাৎ নিজেকে সে ভীষণ অপরাধী ভাবতে শুরু করে ; শত শত পশুপাখির রক্তাক্ত ছবি হাড়গোড় তার চোখে বারবার ভেসে ওঠতে থাকে। দীর্ঘজীবনের সখ শিকারের সঙ্গে নির্মমতার সম্পর্ক এবং অন্ধকারের আনন্দ সে বুঝতে পারে।
টুলু আর শিকারে যায় না। সে জরির সঙ্গে বাগানে ব্যস্ত সময় কাটায়। শত শত পাখির ডাক ও বহুবর্ণ ফুলের সুবাস তাদের হৃদয়ে অপার আনন্দের দোলা দেয়। পাখির আর ফুলের এক যাদুময় আচ্ছন্নতায় তারা বুঁদ হয়ে পড়ে।
হয়তো একদিন ওই রক্তগঙ্গা শুকোবে―টুলু আর জরি প্রতীক্ষায় প্রহর গোনে।