আজ আকাশটা সম্পূর্ণ নীল। কোন প্রকার মেঘমালা নেই। মনে হয় ঐ উদার মনের অধিকারী নীল আকাশে স্বাধীন পাখিদের মত সারা পৃথিবী ঘুরে বেড়াই। তাছাড়া প্রাকৃতিক দৃশ্যাটাও মনকাড়া। আমায় মুগ্ধ করছে। সবুজ-শ্যামল গাছ-গাছালির সমারোহ। কুকিলের কুহ্ কুহ্ কন্ঠে সুুমধুর গানে আমার প্রাণাত্না নাচ্ছে । গোলাপ, জুই-চামেলী ফুলের সুঘ্রাণে আশপাশসহ আকাশ-বাতাস সুশভিত। মনে হয় এতে হারিয়ে থাকি সারাক্ষণ। মনটাও খুব ভাল লাগছে আজ। সব মিলিয়ে যেন এক নতুন আনন্দের সৃষ্টি হয়েছে। হেঁটে হেঁটে দৃশ্যাগুলো দেখছিল এবং বলছিল আসলাম নামের টগবগে এক তরুণ।
এলাকার সর্বজনস্বীকৃত আসলাম একজন ভাল মানুষ। ধার্মিক, শিক্ষানুরাগী, সৎ, স্বার্থত্যাগী, পরোপকারী এবং সামাজিক সকল উন্নয়ণমূলক কর্মকান্ডে অগ্রণী ভূমিকা রাখে আসলাম নামের এ যুবক। তাও আবার বন্ধু আলকামার সাহচর্যে তার চরিত্রের এ বিপ্লব ঘটে ।
আসলাম হাঁটতে হাঁটতে সামনে অগ্রসর হতে না হতেই তার একটু অদূরে একজন মানুষকে বসা দেখতে পায়। আসলামের চেনা চেনা মনে হচ্ছিল লোকটাকে। কিন্তু ভালভাবে পরিচয় করতে পারছিল না, মাথা নিচের দিকে ঝুঁকানো বলে। আসলাম ভাবছে লোকটা নিশ্চয় বহু টেনশনে আছে। কোন কিছু হয়েছে ভেবে আসলাম লোকটার কাছে এসে মাথায় হাত বুলায়। অমনি লোকটি তরগড়িয়ে আসলামের দিকে থাকায়। দুু'জন একে অপরের দিকে মৌন অবস্থায় অপলক দৃষ্টি নিবদ্ধ রেখে দীর্ঘ একটা মুহুর্ত কাটিয়ে দেয় । একে অপরকে চিনতে থাকে।
চোখের পলক ফেলে আসলাম বলল বন্ধু সালাম তুই এখানে কি করছিস? আর তোর দু'চোখে পানিই বা কেন? তোর কি হয়েছে?
আমার কিছু হয় নি। তুই এখান থেকে চলে যা। আমায় ডিস্টার্ব করিস না।
আরে কি হয়েছে বলবে তো? আমার কাছে মুক্তমনে সব খুলে বল্। দেখি আমি তোর্ কোন সাহায্যে আসতে পারি কি না। বল্ বন্ধু, বল্, তোর কি হয়েছে? তোর্ কষ্ঠ যে আমি সঁইতে পারি না বন্ধু।
তারপরও সালাম মুখ খুলছে না। ফ্যালফ্যালিয়ে শুধু বন্ধু আসলামের দিকে তাঁকিয়ে তার কথাগুলো শুনছে।
আসলাম বলল, বন্ধু শান্ত হয়ে যা। আর কাঁদিসনে। কাঁদলে কি সব সমস্যার সমাধান হয়ে যাবে? বরং কি হয়েছে আমায় সব খুলে বল্।
এ বলে আসলাম বন্ধু সালামের দু'চোখের পানি মুছে দিচ্ছে । অনেক্ষণ পর সালাম শান্ত হয় এবং বন্ধু আসলামের গলা জঁড়িয়ে ধরে বলে বন্ধু মনের ভেতরে থাকা কষ্ঠের বিষাক্ত পোঁকা বারবার অন্তরে দংশন করে আমায় বিষিয়ে দিচ্ছে । কেন জানিস? তার পেছনে অনেক যন্ত্রনাদায়ক মর্মান্তিক ঘটনা লুকিয়ে আছে।
বন্ধু শুনবি?
আসলাম বলল, বল্ বন্ধু বল্।
তাহলে শুন্। বন্ধু তোর বন্ধুত্বের পূর্বে আমার আরেকজনের সাথে বন্ধুত্ব ছিল। তার নাম ছিল কালাম। বন্ধু কালামের মা-বাবা, ভাই-বোন এ দুনিয়ায় কেউ ছিল না। কোন এক দুর্ঘটনায় তাদের পরিবারের সবাই মারা যায়। কিন্তু "রাখে আল্লাহ মারে কে" শ্বাশ্বত সত্য বিধান অনুসারে বন্ধু কালাম বেঁচে যায়। বন্ধু কালাম ছিল এ গ্রামের ধন-দৌলতের প্রাচুর্যের অধিকারী আব্দুল্লাহর একমাত্র সন্তান। তবে কালাম তার বাবার প্রাচুর্যের কারণে অহংকারী ছিল না। ছিল নম্র,ভদ্র এবং শান্ত। বন্ধু কালামের কাছে ধনী-গরীব সবাই সমান ছিল। অসম্য-বৈষম্যতার কোন প্রকাশ ঘটায় নি কালাম। উঁচু-নিচু সব শ্রেণীর মানুষদের কালাম একচোখে দেখত। তাই বলে বন্ধু কালাম ছিল আমার দৃষ্টিতে এক অসাধারণ ব্যক্তিত্ব। আমার সাথে তার বন্ধুত্বের কোন প্রকার মিথ্যে ছিল না। বন্ধুত্বের উচ্চ শিঁকড়ে ছিল কালামের বন্ধুত্ব। কিন্তু আমি আমার বন্ধুকে তেমনভাবে চিনতে পারি নি। বন্ধু কালাম আমার বিপদে-আপদে সর্বক্ষণ আমার পাশে থাকত। বন্ধু আসলাম আমি একবার বিরাট সমস্যার সম্মুখীন হয়েছিলাম। তখন আমার বন্ধু কালাম এ সমস্যার নিরসনে এগিয়ে এসেছিল।
কিভাবে বন্ধু? সালাম বলে একদা আমার আম্মার মাথা ব্যাথা রোগ দেখা দিয়েছিল। সর্বক্ষণ মাথা ব্যাথা করত। এমন অবস্থায় আমি আমার আম্মাকে হাসপাতালে নিয়ে যাই। রোগী দেখার কেবিনে আম্মাকে রেখে আমি বাইরে চলে আসি। এখনও ডাক্তার আসে নি। তাই আমি আগ থেকেই প্রস্তুত, ডাক্তার আসা মাত্রই আমার আম্মার কেবিনে নিয়ে যাব ডাক্তার সাহেবকে। তাই বাইরে বসে অপেক্ষা করছিলাম। ডাক্তার আসছে না কেন? আর বারবার ঘড়ি দেখছিলাম । হাসপাতালে আসার সময় তো পার হয়ে যাচ্ছে। কিন্তু ডাক্তার যে এখনো আসছে না। তা ভেবে এদিক-সেদিক তাকাই। বসে বসে অপেক্ষার প্রহর গুনছিলাম। অমনি দেখি শাহীরোড ধরে ডাক্তারের মত কে যেন আসছে। কাছে আসতেই দেখি ডাক্তার সাহেব। আমি ডাক্তারের সামনে গিয়ে দাঁড়াই এবং বলি ডাক্তার সাহেব আমার আম্মাকে দেখেন। আম্মার অবস্থা ভাল না।
ডাক্তার বলে তোমার আম্মার কি হয়েছে?
আমার আম্মার কি হয়েছে আমি নিজেও জানি না। তবে দেখে যান ডাক্তার সাহেব, আমার আম্মাকে দেখে যান।
আরে বল তো তোমার আম্মার কি হয়েছে?
আমার আম্মার মাথা ব্যাথা করে সর্বক্ষণ ।
চল তো দেখি বলে ডাক্তার সাহেব আমার আম্মার কেবিনে আসে এবং আমাকে বাইরে বসতে বলে। আমি ডাক্তারের কথামত বাইরে অপেক্ষা করি। কিছুক্ষণ পর ডাক্তার সাহেব বের হয়ে আসলে আমি ডাক্তার সাহেবকে আমার আম্মার কথা জিজ্ঞেস করি। আমার আম্মার কি হয়েছে, কি হয়েছে বলে আমি ডাক্তারের পেছনে পেছনে ছুঁটতে থাকি। ডাক্তার আমায় বললেন, রোগীর অবস্থা খুব খারাপ।
ডাক্তার সাহেব কি হয়েছে, আমার আম্মার কি হয়েছে?
তোমার আম্মার মাথায় টিউমার হয়েছে। অপারেশন করতে হবে। নইলে রোগীকে বাচানো সম্ভব নয়।
ডাক্তার সাহেব অপারেশন করতে কত টাকা লাগবে?
প্রায় দশ লাখ তো লাগবেই। এর কম হলে চলবে না।
আমাদের আর্থিক অবস্থা তেমন ভাল ছিল না। এত টাকা আমি কোথায় পাব? কার কাছে পাব এত টাকা, কে দেবে আমাকে? ভিক্ষা করা শুরু করব? নাকি চুরি-ডাকাতি করব ভাবতে ভাবতে আমি অজ্ঞান হয়ে মাটিতে লুটে পড়ে যাই। জ্ঞান ফেরা মাত্রই আমি টাকার খুঁজে হাসপাতাল থেকে বের হয়ে আসি।
এদিকে, আমার বন্ধু কালাম আমার মায়ের মারাত্বক রোগের কথা শুনে সোঁজা হাসপাতালে চলে আসে এবং জানতে পারে আমার মাকে বাচাতে নিম্নে দশ লাখ টাকা লাগবে। কালাম ভাবে আমার তো মা নেই। একজন মায়ের জীবন বাচানো মানে আমার মায়ের জীবন বাচানো। আর বন্ধুর মা তো আমার মায়ের মতই। এতে কোন তফাৎ নেই। একথা চিন্তা করে কালাম ব্যাংক থেকে এগার লাখ টাকা তুলে আনে এবং আমার মাকে বাচাতে ডাক্তারের সাথে কথা বলে। কথামত ব্যাংকে টাকা জমা দিয়ে তৎক্ষনাত অপারেশনের জন্য ডাক্তারকে তাগিদ দেয়। ডাক্তার রোগীকে অপারেশন থিয়েটারে নিয়ে যাওয়ার জন্য নার্সদের আদেশ দেন। অপারেশন থিয়েটারে নিয়ে যাওয়ার পর ডাক্তার তার সহকর্মীদের নিয়ে অপারেশন শুরু করেন।
বন্ধু কালাম অপারেশন থিয়েটারের পাশে দাঁড়িয়ে অপেক্ষা করছিল। আর আল্লাহর কাছে দোয়া করছিল। যাতে করে আম্মা সুস্থ্য হয়ে উঠে। এসব ঘটনা আমি জানি না।
এদিকে, আমি টাকার জন্য উদভ্রান্ত পথিকের মত হন্যে হয়ে ঘুরছি। কিন্তু কোথাও টাকা পাচ্ছি না। আমি জানি এই পৃথিবীর মানুষ বদলে গেছে। এখন আর বিনা সুদে টাকা দিতে চায় না কেউ। কিন্তু এ করুণ মুহুর্তে সুদেও টাকা পাওয়া যাচ্ছে না। আমার দ'ুচোখ ঝাঁপসা দেখাচ্ছে। পৃথিবীতে সূর্যের এত আলো থাকা স্বত্বেও চোখের দৃষ্টিতে যেন জ্যোতি নেই। মনে হচ্ছে একটু পরেই অন্ধচোখে বন্ধঘরে আটকা পড়ে যাব। আর মায়ের কাছে যেতে পারব না।
আমার আম্মার মাথার অস্ত্রপাচার সফল হয়েছে। সুস্থ্য হয়ে অপারেশন থিয়েটার থেকে বের হয়ে আসে । চোখে দুই আঙ্গুল দিয়ে চোখ বন্ধ করে কালাম অপারেশন থিয়েটারের পাশে দাঁড়িয়ে কি যেন চিন্তা করছিল। চোখ খুলতেই বন্ধু আমার আম্মাকে সুস্থ্য দেখে ভীষণ খুশি হয় ।
আমি কোন উপায়ন্তর না পেয়ে হাসপাতালে ফিরে আসি মাকে একনজর দেখার জন্য। কিন্তু আল্লাহর কি লীলাখেলা আমার মাকে সুস্থ্য অবস্থায় দেখতে পাই । বন্ধু কালাম পাশে দাঁড়িয়ে আছে। তখন আমি বন্ধু কালামকে দেখে আশ্চর্য্য হয়ে বলি কালাম তুই? তুই জানলি কি করে? আমি তো তোকে খরব দেইনি।
তখন বন্ধু কালাম আমায় বলে, বন্ধুত্ব কি জিনিস তুই আজও চিনলি না-রে। বন্ধুত্ব যে দুই দেহ এক প্রাণ। মনে প্রাণে এক জান। বন্ধুর বিপদে-আপদে কোন খবর দেয়া লাগে না। এমনিতে খবর এসে যায়। আর তোর মা কি আমার মা নয়? মায়ের কষ্ঠ আমার কষ্ঠ। তাই খবর পাওয়া মাত্রই আমি হাসপাতালে চলে আসি এবং মায়ের সুস্থ্যতায় দশ লাখ টাকা লাগবে জেনে আমার নিজস্ব একাউন্ট থেকে এক লাখ টাকা বেশী উত্তোলণ করি এবং সাথে সাথে দশ লাখ টাকা দিয়ে মায়ের অপারেশন করাই। আর বাকী টাকা মায়ের নিকট রাখতে বলি।
একথা শুনে আমার চোখে আনন্দের পানি টলমল করছে! এবং দুটি ঠোট বাঁকা করে কেঁদে ফেলি। আমি কাঁন্নাজড়িত কণ্ঠে বন্ধু কালামের গলায় জড়িয়ে বন্ধু কালামকে বলে বন্ধু তোর ঋণ আমি জীবনেও শোধ করতে পারব না। আমি তোর কাছে চিরঋণী রয়ে গেলাম-রে বন্ধু। আমি তোর কাছে চিরকৃতজ্ঞ থাকব।
আসলাম এতক্ষণ সালামের বন্ধুর ঘটনা খুব মনযোগ দিয়ে শুনছিল। বন্ধু আসলাম নির্বাক! আসলামের কাছে অবাক লাগছে। এখনো কি এমন বন্ধু আছে? এত দুর্লভ বন্ধুত্বের কাহিনী শুনালে।
বন্ধু সালাম, বন্ধু আসলামকে উদ্দেশ্য করে বলল, আরে বন্ধু এখানেই ঘটনার শেষ নয়। ঘটনার করুণ কাহিনী তো রয়েই গেছে। এ তো সূচনা ছিল মাত্র।
বন্ধু জানিস? আমি আমার বন্ধু কালামকে এর বিনিময়ে কি উপহার দিয়েছিলাম? এ কথা বলে সালাম আবার কাঁন্নায় ভেঁঙ্গে পড়ে। নিজেকে সামলাতে পারছে না সালাম। ভাঙ্গাকন্ঠে বলছে, হায়! আমার কেন মরণ হল না। এ বলে সালাম নিজেকে দোষারোপ করছে আর বঁকছে । একটু পর সালাম শান্ত হয়।
আসলাম বলে বন্ধু বাকী ঘটনাটা খুলে বল্ । কি হয়েছে?
বন্ধু বাকী ঘটনার বলার মত আমার যে আর অবস্থা রইল না। আমি যে আর পারছি না। যে বন্ধুকে আমি প্রানের চেয়ে বেশী ভালবাসতাম। যে বন্ধু আমার চাইতে আমাকে ভীষণ ভালবাসত, সে বন্ধুকে আমি ভুলতে পারছি না। বন্ধুর কথা স্বরণ হলে আমার খুব খারাপ লাগে-রে। কি করে আমার বন্ধু কালামের করুণ কাহিনী বলি ।
আরে বল্ না, বল।
বন্ধুর পীড়াপীড়িতে সালাম বলল, হে বন্ধু আমি একজন বিশ্বাসঘাতক। আমি বন্ধুর সাথে চরম বিশ্বাসঘাতকতা করেছি। বন্ধুর মাঝে কলঙ্কের দাগ লেপন করেছি। দুনিয়ার সমস্ত বন্ধুদের একে অপরের প্রতি বিশ্বাসঘাতকতার জন্ম দিয়েছি। এখন থেকে আর কোন বন্ধু অপর বন্ধুকে বিশ্বাস করবে না। এটা একমাত্র আমার কারণে। আমি এর-জন্য দায়ী। এ পৃথিবীতে যত সমস্ত বন্ধুদের মাঝে ফাঁটল দেখা দিবে এবং বন্ধুদের মাঝে কোন দুর্ঘটনা ঘটবে তার এক-তৃতীয়াংশ পাপ আমাকে পাবে।
বন্ধু জানিস্ না তুই আমি আমার বন্ধু কালামকে নির্মমভাবে খুন করেছি নিজ হাতে। তখন আমার বন্ধু আমার কাছে প্রাণভিক্ষা চেয়েছিল। কিন্তু আমি কোন কথা না শুনে আমি আমার বন্ধুর বুকে ছুরিকাঘাত করি এবং একটু পরেই বন্ধু কালাম ছটফট করে মারা যায়। তবে হে বন্ধু, আমার বন্ধু কালামকে যখন খুন করতে যাই, তখন বন্ধু কালাম তার বিশাল বড় বাড়ীতে একা থাকত। রাতে বন্ধুর ঘরে প্রবেশ করে ঘুমন্তবস্থায় বন্ধুকে বেঁধে ফেলি। তৎক্ষনাত সজাগ হয়ে আমায় দেখে আমার বন্ধু আমাকে বলেছিল, আরে বন্ধু একি করছিস? আর তুই এত রাতে এলেই বা কি করে? কেনই বা আমায় বেধেছিস? মজা করার আর বুঝি সময় পেলি না । ছাড়্ আমায় ছাড়্ ।
কিন্তু না, সালাম তো আজ মজা করতে আসে নি। সালাম এসেছে বাস্তবেই খুন করতে। সালাম বন্ধু কালামকে চোখ রাঙ্গিয়ে বলে এখানে আসার একমাত্র কারণ তোকে খুন করব।
বন্ধু তুই একি বলছিস?
হ্যা! সত্যি বলছি, এজন্যই তোকে বেঁধেছি।
কেন বন্ধু, আমি তোর কি ক্ষতি করিছি? আমি তো সব সময় তোর মঙ্গল কামনা করেছি।
বন্ধু তুই জানিস না, তোকে খুন করলে আমি অনেক টাকা পাব, অনেক টাকা । তোর মরণ চাই মরণ।
না বন্ধু, না। তুই এমন কাজটা করতে পারিস না। প্রয়োজনে তুই আমার সমস্ত ধন-সম্পদ, টাকা-পয়সা সবকিছু নিয়ে নে, তারপরও তুই আমায় মারিস না।
নারে বন্ধু, না, তোকে আমায় খুন করতেই হবে। তোর ধন-সম্পদের সাথে সাথে তোকে খুন করার চাপ সৃষ্টি করা হয়েছে আমার উপর।
বলিস কি? কে চাপ সৃষ্টি করেছে? বল্ তাদের নাম বল্ আমি তাদের শেষ করে দেব।
বন্ধু তুই আমায় ক্ষমা করে দিস্। তোকে যে আমায় খুন করতেই হবে। নইলে তারা আমার মা এবং আমাকে মেরে ফেলবে বলে হুমকি দিয়েছে। তুই আমায় ক্ষমা করে দিস্ বন্ধু, তুই আমায় ক্ষমা করে দিস্। একথা বলেই কাছে গিয়ে একহাত লম্বা ছুরিটা ঢুকিয়ে দেই বন্ধু কালামের বক্ষদেশে। ততক্ষনে কালামের বুকের পিঞ্জিরার ভেতর থাকা পরান পাখিটা নীল আকাশে মুক্ত হাওয়াতে স্বাধীনতার গান গাইতে গাইতে কালামের দেহত্যাগ করে চলে যায় আজীবনের জন্য। শুধু কালামের মরদেহটা পড়ে থাকে । এ ছিল আমার বন্ধু খুনের মর্মান্তিক ঘটনা।
অতঃপর সালাম বন্ধুকে বলে পরে তিন মাস অতিবাহিত হওয়ার পর যাদের নির্দেশে আমি আমার বন্ধু কালামকে খুন করেছিলাম, তারা আজ আমাকে টাকা দেবে তো দূরের কথা বরং আমাকে পুলিশের হাতে ধরিয়ে দেবে বলে হুমকি-ধমকি দিয়ে সমস্ত টাকা-পয়সা এবং ধন-সম্পদসহ বাড়ী_ঘর দখল করে নিয়েছে।
বন্ধু বন্ধুর সাথে এত বড় অন্যায় কাজ এবং বেইমানী করতে পারে ভেবে শ্রবনরত সালামের বন্ধু আসলাম হতবাক। আসলামের মাথায় যেন পুরো আসমানটা ভেঙ্গে পড়েছে। শরীর নিস্তেজ হয়ে জবান বন্ধ হয়ে গেছে। কোন কথা বলতে পারছে না আসলাম । সমস্ত শরীর অবস হয়ে গেছে। মাথা ঘুঁরছে। শুধু মাথাই ঘুঁরছে না। মনে হচ্ছে সারা পৃথিবী ঘুঁরছে। গাছ-পালা নড়ছে। আকাশ-বাতাস কাঁপছে। ঐ মেঘমুক্ত নীল আকাশটা মুহুর্তের মাঝে মেঘাচ্ছন্ন আকার ধারন করেছে। বন্ধু সালামের কথা শুনে আসলামের মন আয়না ভাঙ্গার মত ভেঙ্গে টুকরো টুকরো হয়ে গেছে। উদার মনের নীল আকাশে উতাল-পাতাল মেঘমালা এদিক-সেদিক ঘুরে দৌড়াদৌড়ি করছে। বিজলীর সাথে সাথে বজ্রপাত হচ্ছে। যে কোন সময় প্রচন্ড বৃষ্টি নেমে আসতে পারে। তীব্র বাতাসের সাথে কালো মেঘমালায় দুনিয়া অন্ধকারাচ্ছন্ন হয়ে এক ভয়ানক অবস্থার সৃষ্টি হয়েছে। অমনি করে জমিনে বৃষ্টি নেমে আসে। তখন উভয় বন্ধু এখানেই দাঁড়িয়ে বৃষ্টির শীতল পানিতে ভিজছে। আর কেঁদে কেঁদে বন্ধুর মর্মান্তিক ঘটনার কথা স্বরণ করে সমবেদনা প্রকাশ করছে...........................।
বেশ কয়েকদিন পর বন্ধু সালামের সাথে আবার দেখা হয় আসলামের। একে অপরকে দেখে শান্তির বার্তা সালাম বিনিময় করে হাঁটতে হাঁটতে স্কুলের বারান্দায় এসে বসে এবং দু'জনে মিলে নানান কথাবার্তা শুরু করে দেয়। কথার একফাঁকে সালাম বন্ধু আসলামকে বলে আজ আমি তোর ওছিলায় নিয়মিত পাঁচ ওয়াক্ত নামাজ পড়ি। খারাপ কাজ ছেড়ে দিয়েছি। এখন থেকে চেষ্টা করি কারো ভাল কাজ করে দিতে । তাছাড়া দুষ্টমীও এখন আর করি না। মানুষকে জ্বালা-যতন দেই না। আমি সম্পূর্ণ ভাল হয়ে গেছি। আমার ভবিষ্যতের জন্য দোয়া করিস্ বন্ধু।
বন্ধু সালাম আমিও তোর মত খারাপ মানুষ ছিলাম। যেভাবে তুই আমার ওছিলায় আজ ভাল মানুষ হয়েছিস, ঠিক তেমনি আমিও একজন ভাল বন্ধুর সাহচর্যে ভাল মানুষ হয়ে তোর মত খারাপ মানুষকে ভাল পথের দিকে আনতে পেরেছি।
আর এ বন্ধুর কথাই তোকে বলা হয়নি। তোর পূর্বে আমারও একজন পুরনো বন্ধু ছিল। তার নাম ছিল আলকামা। আলকামা ছিল ইলমে দ্বীনের একজন সম্যক জ্ঞানী ব্যক্তি। যেমন ধার্মিক তেমনি ইবাদতেও তার নাম সবার উধের্্ব। বন্ধু আলকামা সমাজের মানুষদের বোঝাত। সৎ কাজে উৎসাহ দিত, আর অসংকাজে বাধা দিত। আমি আলকামার উপদেশমূলক বক্তৃতা শুনতাম। শুধু ভালই লাগত না বরং মনের কান দিয়ে শুনে এর উপর আমলও করতাম।
আর বন্ধু তুই জানিস না। আমি এরপূর্বে খুব খারাপ লোক ছিলাম। মা-বাবার সাথে অসৎব্যবহার করতাম। মানুষদের কষ্ট-যাতনা দিতাম। মদ-গাঁজা সেবন করতাম। নামাজ রোজার কাছেও যেতাম না। এ পৃথিবীর প্রতিপালক একজন মহাপরাক্রমশালী আল্লাহকে চিনতাম না। যা মনে ইচ্ছে হত, তাই করতাম। আমায় বাধা দেবার মত কেউ ছিল না। কিন্তু আল্লাহর কি মহিমা! আমি একটি প্রবাদ বাক্য একটি বইতে পড়েছিলাম যে, "সৎসঙ্গে স্বর্গবাস, অসৎসঙ্গে সর্বনাশ"। আমি রাস্তা দিয়ে হেঁটে যাচ্ছিলাম। দেখা যায় পথের পাশ্বর্ে একটি বাড়ীতে লোকের উপচে পড়া ভীড়। আমি সাথে সাথে সেখানে যাই। তখন মাইক ছিল না। মুখে ভাষণ দিয়ে মানুষদের হেদায়াতের দিকে আহ্বান করত আগেকার মানুষেরা।
যখন আমি সেখানে পৌছি, তখন বন্ধু আলকামা সূরায়ে যুখরুকের ৬৭নং আয়াত তিলাওয়াত করে আয়াতের চুলছেঁড়া ব্যাখ্যা-বিশ্লেষণ করে মানুষদের বুঝাচ্ছে। বন্ধু আলকামা বলছে আয়াতের সারমর্ম হল, খোদাভীরু বন্ধু ছাড়া সকল বন্ধু সেদিন (কালকিয়ামত দিবসে) একে অপরের শত্রু হয়ে যাবে। ওহে বন্ধু সালাম, আমার বন্ধু আলকামা তখন এমন একটা ঘটনা বর্ণনা করেছে, যারপর আমি আলকামার সাথে বন্ধুত্ব না করে থাকতে পারলাম না। আজকে আমরা যারা বন্ধুত্ব সম্পর্ক নিয়ে দুনিয়াতে যত গর্ব করি এবং যার জন্য হালাল হারাম এক করে দেই। কাল কিয়ামতের দিবসে সে সম্পর্ক কেবল নিষ্ফলই হবে না, বরং শত্রুতায় পর্যবসিত হবে। হযরত আলী (রা)-এর উক্তি উল্লেখ করে বন্ধু আলকামা বলে, দু'জন সৎ বন্ধু ছিল এবং দু'জন অসৎ বন্ধু ছিল। সৎ বন্ধুদের একজন মারা গেলে তাকে জান্নাতের সুসংবাদ দেয়া হয়। তখন তার আজীবন সৎ বন্ধুর কথা মনে পড়লে সে দোয়া করল, হে আল্লাহ, আমার অমুক সৎ বন্ধু আমাকে আপনার এবং আপনার রাসূলের আনুগত্যের আদেশ দিত, সৎকাজে উৎসাহ দিত, অসৎ কাজে বাধা দিত এবং আপনার সাথে সাক্ষাতের বিষয় স্বরণ করিয়ে দিত। কাজেই হে আল্লাহ, আমার পরে তাকে পথভ্রষ্ট করবেন না, যাতে সেও জান্নাতের দৃশ্য দেখতে পারে, যা আপনি আমাকে দেখিয়েছেন। আপনি আমার প্রতি যেমন সন্তুষ্ট,তার প্রতিও তেমনি সন্তুষ্ট হোন। জবাবে বলা হবে, যাও তোমার বন্ধুর জন্য এমন পুরস্কার ও ছওয়ার রেখেছি, যা জানলে কাঁদবে কম, হাসবে বেশী। অতপর অপর বন্ধু মারা গেলে উভয়ের আত্মা একত্রিত হবে। আল্লাহ তা'য়ালা তাদের বলবেন, তোমরা একে অপরের প্রশংসা কর। তখন প্রত্যেকেই অপরের সম্পর্কে বলবে, সে শ্রেষ্ঠ ভাই, শ্রেষ্ঠ সঙ্গী এবং শ্রেষ্ঠ বন্ধু।
ওহে বন্ধু সালাম পরে আমার বন্ধু অসৎ বন্ধুদের ক্ষেত্রে উপরোক্ত ঘটনার সম্পূর্ণ বিপরীত একটা ঘটনা বর্ণনা করে বলে, অসৎ বন্ধুদ্বয়ের একজন মারা গেলে তাকে জাহান্নামের ঠিকানা জানিয়ে দেয়া হবে। তখন তার ইহকালীন অসৎ বন্ধুর কথা মনে করে আল্লাহর কাছে বদদোয়া করে বলবে, হে আল্লাহ আমার অমুক অসৎ বন্ধু আমাকে আপনার এবং আপনার রাসূলের অবাধ্যতা করার আদেশ দিত, মন্দ কাজে উৎসাহ দিত এবং সৎকাজে বাধা দিত। হে আল্লাহ আমার পরে তাকে তুমি পথভ্রষ্ট কর, যাতে হেদায়াত না পায় এবং জাহান্নামের দৃশ্য দেখে, যা আপনি আমাকে দেখিয়েছেন। আর আমার উপর যেভাবে অসন্তুষ্ট, তেমনি তার উপর অসন্তুষ্ট থাকুন। পরে দ্বিতীয় বন্ধু মারা গেলে তাদের আত্মা একত্রিত হবে। তাদেরকে বলা হবে, তোমরা একে অপরের সংজ্ঞা বর্ণনা কর। তখন তাদের প্রত্যেকেই একে অপরকে নিকৃষ্ট ভাই, নিকৃষ্ট সঙ্গী এবং নিকৃষ্ট বন্ধু বলবে।
বন্ধু জানিস? আমার বন্ধু আলকামা পরে কি বলেছিল।
কি বলেছিল?
বন্ধু আলকামা বলেছিল যা সূরায়ে ফুরকানের ২৭-২৮নং আয়াতের সারসংক্ষেপ হল, সেইদিন (কিয়ামত দিবসে) জালিম আপন হস্তদ্বয় দংশন করতে করতে বলবে, হায় আফসোস! যদি আমি রসুলের পথ অবলম্বন করতাম! হায় আমার দূর্ভাগ্য, আমি যদি অমুক অসৎ বন্ধুকে বন্ধুরূপে গ্রহণ না করতাম।তাহলে কতইনা ভাল হতো । মোট কথা, সেইদিন আফসোস ছাড়া আর কিছুই করার থাকবে না। বন্ধু আর বন্ধু থাকবে না, বরং উভয়েই উভয়ের শত্রুতে পরিণত হয়ে যাবে।
পরিশেষে আসলাম বন্ধু সালামকে লক্ষ্য করে বলে যে, আমার পুরনো বন্ধু আলকামা ভাল বন্ধু চেনার উপায়ও বলে দিয়ে গেছে। বলেছে, (যা আবার হাদিছের মর্মার্থ) "যাকে দেখে আল্লাহর কথা স্বরণ হয়, যার কথাবার্তায় তোমার জ্ঞান বাড়ে এবং যার কাজ দেখে পরকালের স্মৃতি তাজা হয়"।) সেই হল ইহকালীন এবং পরকালীন প্রকৃত অকৃত্রিম পরম বন্ধু।
ওহে বন্ধু সালাম অতঃপর আমি সরাসরি আলকামার কাছে যাই। এবং তার হাতে হাত রেখে বন্ধুত্বের সম্পর্ক গড়ে তুলি। এরপর থেকেই আমি আর আলকামা আমরা উভয়ে পরম বন্ধু।
কিন্তু বন্ধু একদিন ফজরের নামাজের পর সহসা আমার কাছে খবর আসে বন্ধু আলকামা অসুস্থ্য । খবর পেয়ে আমি সাথে সাথে বন্ধুর বাড়ীর দিকে রওয়ানা দেই এবং বাড়ীর কাছে পৌছা মাত্রই উক্ত এলাকার মোয়াজ্জিন মসজিদের মাইকে "ইন্নালিল্লাহি ওয়া ইন্না ইলাইহি রাজিউন" পড়ে শোকের আওয়াজ ধ্বনিত করে তুলে আকাশজুঁড়ে। তখন বুঝতে বাকী রইল না আমার বন্ধু মারা গেছে। আমিও ইন্নালিল্লাহি ওয়া ইন্না ইলাইহি রাজিউন পড়ি। অতঃপর কাফন-দাফন এবং জানাযা শেষে শোকের বার্তা নিয়ে বাড়ীতে ফিরি । এখনো আমার বন্ধু আলকামার স্মৃতি স্বরণে হৃদস্পন্দনে কম্পন সৃষ্টি হয়। এখন এমন বন্ধুর খোঁজ পাওয়াই কঠিন।