০১
খোলা বারান্দায় ইজি চেয়ারে বসে শরতের শুভ্র আকাশের দিকে এক দৃষ্টে তাকিয়ে আছেন ডাঃ শুভ । দেখে মনে হচ্ছে যেন কারো সাথে বিড় বিড় করে কথা বলছেন । তাঁর পুরো নাম জুলফিকার হায়দার । পিতার নাম রশীদ হায়দার । তিনিও নামকরা ডাক্তার ছিলেন । জুলফিকার সাহেব বাবা মায়ের একমাত্র সন্তান । তবে আজকালকার ছেলে মেয়েদের মত অতি আদরে বড় হননি । তাঁর পিতা রশীদ হায়দার অত্যন্ত বাস্তববাদী মানুষ ছিলেন । কোমলে কঠোরে মিশানো একজন সত্যিকার মানুষ । ঢাকার গুলশানে বাসা । বাসার নাম রাজিয়া ভিলা । জুলফিকার সাহেবের নিজের রোজগারে গড়া । ছোট খাট একটি রাজ প্রাসাদ ।
জুলফিকার সাহেবের পিতা ছেলেকে কখনও যাচ্ছেতাই করে বেড়াতে দেননি । সারাদিনের প্রতিটি কাজকর্ম করতে হত তাঁর বেঁধে দেওয়া নির্দিষ্ট ছকে । একচুলও এদিক সেদিক হওয়ার কোন উপায় ছিল না । প্রয়োজনের অতিরিক্ত একটি পয়সাও বাবা হাতে দিতেন না । বরং সব সময়ই কিছু কম দিতেন । আর বলতেন, “যা দিলাম পুরোটাই কিন্তু তোমার খরচের জন্যে নয় ; এর থেকে কিছু জমানো চাই । আপদ কালে যেন কাজে লাগাতে পার” । জুলফিকার সাহেব মাথা নিচু করে থাকতেন । কখনও কিছু বলতেন না । মা রাবেয়া হায়দার মাঝে মাঝে ছেলের অসহায়ত্ব দেখে মৃদু প্রতিবাদ করতেন । বলতেন, একটি মাত্র ছেলে আপনার । আমাদের তো আল্লাহর রহমতে টাকা পয়সার কোন অভাব নেই ---- । ব্যাস এতটুকুই; এরপর রশীদ সাহেবের সেকি লেকচার । একটি ছেলে বলে তুমি ওকে আদর যত্ন দিয়ে নষ্ট করে ফেলতে পার না গিন্নী । আমি ওর ভাল মন্দ বুঝি । ওকে পরনির্ভরশীল করে তোল না । শক্ত হাতে বড় হতে দাও । নতুবা তোমাকেই পস্তাতে হবে বলে রাখছি । বেগম সাহেবা আর কোন কথা বলার সাহস পেতেন না ।
বাবার দেওয়া শিক্ষায় জুলফিকার সাহেব সুশিক্ষিত । মাস খানেক আগে তাঁর প্রিয়তমা স্ত্রী গত হয়েছেন । দীর্ঘ কয়েক যুগের সংসারের মায়া কাটিয়ে আজ রাজিয়া বানু জান্নাত বাসিনী । বলার মত কোন অসুখই ছিল না রাজিয়ার । সেদিন ফজরের নামাজ পড়ে শুধু বললেন,
আমার ভাল লাগছে না ।এক গ্লাস পানি---- ।
জুলফিকার সাহেব তাড়াতাড়ি পানি নিয়ে আসলেন ।ততক্ষণে বেগম সাহেবা বিছানায় গড়াগড়ি দিচ্ছেন ।মুখ দিয়ে লালা জাতীয় কিছু একটা বের হচ্ছে ।পানি খাওয়ার মত অবস্থায় নেই ।
জুলফিকার সাহেব নাড়ী পরীক্ষা করলেন ।কিছুটা দ্রুত ।হাসপাতালে নেওয়া দরকার ।গাড়ী গ্যারেজে নেই । বদমাইশ ড্রাইভার কোথায় নিয়ে বের হয়ে গেছে । কি করবেন স্থির করতে পারছেন না । কিন্তু কিছু একটা করা দরকার । অবস্থার দ্রুত অবনতি হতে পারে ।তাড়াতাড়ি একটা নরমাল স্যালাইন পুশ করলেন ।ভাল ভাবে চলছে না । জুলফিকার সাহেব চিন্তিত হয়ে পড়লেন ।ক্লিনিকে ফোন করে দ্রুত অ্যাম্বুল্যান্স চাইলেন । কিছুক্ষণ পর রাজিয়াকে কিছুটা সুস্থ মনে হল । দুচোখ বড় বড় করে স্বামীর মুখের দিকে তাকিয়ে আছেন । এক হাতে শক্ত করে ধরে আছেন স্বামীর হাত ; যেন কোনদিনই ছাড়বেন না । জুলফিকার সাহেব মাথার চুলে বিলি কাটতে কাটতে জিজ্ঞেস করলেন,
একটু ভাল বোধ করছ এখন ?
জী , আস্তে আস্তে জবাব দিল রাজিয়া ।
তাহলে তুমি একটু শুয়ে থাক, আমি দেখি অ্যাম্বুলেন্সটা আসল কি না ।
না । দৃঢ় স্বরে জবাব দিল রাজিয়া ।
কেন ?
আপনার সাথে আমার কিছু কথা আছে । বসুন ।
জুলফিকার সাহেব স্ত্রীর মাথার পাশে আবার বসলেন । মাথায় হাত বুলাতে বুলাতে জিজ্ঞেস করলেন, কি বলতে চাইলে যেন ?
হঠাত রাজিয়া স্বামীর হাত ধরে কাঁদতে কাঁদতে বললেন, সারা জীবন আপনার কাছে অনেক অপরাধ করেছি, আপনার সেবা যত্ন ঠিক মত করতে পারিনি, অনেক ভুল ত্রুটি হয়েছে ।আপনি আমাকে মাফ করে দেন । আপনি মাফ না করলে আল্লাহ আমাকে মাফ করবেন না ।
জুলফিকার সাহেব কিংকর্তব্যবিমুঢ় হয়ে পড়লেন ।স্ত্রীর হাতটি আরও জোরে ধরে বললেন, হঠাত অমন করছ কেন রাজিয়া ? তুমি তো আমার কাছে কোন অপরাধ করনি । দোষ যদি কেউ করে থাকে সেটা আমিই করছি । তুমিও আমাকে মাফ করো । এই বলে তিনি উঠতে চাইলেন।
রাজিয়া উঠতে দিলেন না । বললেন, আর একটি কথা ।
জুলফিকার সাহেব জিজ্ঞাসু দৃষ্টিতে প্রিয়তমা স্ত্রীর মুখের দিকে তাকালেন ।
রাজিয়া বেগম বললেন, ছেলে মেয়েদের কোন অপরাধ নিবেন না । ওরা অবুঝ ।
ঠিক আছে কোন অপরাধ নেব না । নিচে অ্যাম্বুলেন্সের হর্ন শোনা যাচ্ছে ।আমি দেখি ওরা এসেছে কিনা ।এই বলে উঠতে চাইলেন ।
রাজিয়া বানু স্বামীর হাত ছাড়লেন না । আস্তে আস্তে বললেন,
আর একটি কথা---- ।
বল ।
আপনার নিজের যত্ন নিবেন ।
জুলফিকার সাহেব কোন কিছু না ভেবেই জবাব দিলেন, আচ্ছা নেব, নেব ।
এই বলে তিনি দ্রুত পদে বের হয়ে গেলেন ।রাজিয়া বানু স্বামীর গমন পথের দিকে তাকিয়ে রইলেন ।
কিছুক্ষণ পর জুলফিকার সাহেব ফিরে এসে দেখলেন রাজিয়া বানু আর ইহ জগতে নেই । তিনি কিছুতেই বিশ্বাস করতে পারছিলেন না ।এ কি করে সম্ভব ! এই তো অল্প ক্ষণ পূর্বেই তাঁর সাথে কথা বললেন । জুলফিকার সাহেব একবার নাড়ী দেখেন আর একবার স্টেথিসস্কোপ দিয়ে বুকের স্পন্দন শুনেন । না, কোন সাড়া নেই । অবিশ্বাস্য ! কোন মতেই হিসাব মিলাতে পারছিলেন না তিনি । মৃত্যু এত সহজ !
০২
সেই থেকে জুলফিকার সাহেব একা । মাত্র বছর তিনেক হল সরকারি চাকুরি থেকে অবসর নিয়েছেন । এখন প্র্যাকটিসও খুব একটা করেন না । কেন জানি মন থেকে সাড়া পান না । তিনি নিজে একজন মনোবিজ্ঞানী ; সারা জীবন মানুষের মন নিয়ে কাজ করেছেন । যশ খ্যাতিও কম ছিল না । আর এখন নিজের মনেরই কোন কূল কিনারা করতে পারেন না । এক রাশ অন্ধকারে ছেয়ে গেছে তাঁর মনের আকাশ । অনুভূতি গুলোও কেমন জানি মরা মরা । নাওয়া-খাওয়া কোনটাই ঠিক মত হচ্ছে না । কোন কিছুতেই হৃদয় থেকে সাড়া পাচ্ছেন না । স্বাভাবিক ঘুমও হচ্ছে না । এক ধরনের বিষণ্ণতা তাকে সারাক্ষণ কুরে কুরে খাচ্ছে ।
তিনি জানেন বিষণ্ণতার চেয়ে বড় কোন ব্যাধি এখনও আবিস্কৃত হয়নি । পত্রিকা, ম্যাগাজিন, প্রিয় লেখকের কিছু ব্ই, দিগন্ত বিস্তৃত আকাশ আর এলোমেলো কিছু ভাবনা ; এখন এই তাঁর
নিত্য দিনের সঙ্গী । বলা চলে তাঁর নিজের পৃথিবী !
জুলফিকার দম্পতির তিন সন্তান । দুই ছেলে ।বড় ছেলে অরণ্য হায়দার আর ছোট ছেলে নিঝুম হায়দার । একমাত্র মেয়ে মীম হায়দার । সবাই প্রতিষ্ঠিত এবং সংসারী । বড় ছেলে অরণ্য আমেরিকা প্রবাসি । নিউইয়র্কের একটি বড় হসপিটালের নামকরা ডাক্তার । ছোট ছেলে নিঝুম সফটওয়্যার ইঞ্জিনিয়ার । থাকেন কানাডায় ।কানাডা সরকারের উচ্চ বেতন ভুক্ত কর্মচারী । দুজনেই বিয়ে করেছেন । যথারীতি যুক্তরাষ্ট্র ও কানাডার মেম । দেশে খুব কমই আসেন । সবার ছোট মীম স্বামীর সাথে দুবাই থাকে । তার স্বামী একটি মাল্টিন্যাশনাল কোম্পানিতে কাজ করেন । মীম নিজেও একটি স্কুলে শিক্ষকতা করেন । মাঝে মাঝে ফোন করে বাবা মায়ের সংবাদ নেন ।রাজিয়া বানু মারা যাওয়ার পর সবার আগে ফোন করেছিল মীম । মায়ের জন্য মেয়েটির আকাশ ভরা রোদন যেন আর শেষ হতে চায় না । মাকে শেষ দেখা দেখার জন্য সেকি আকুতি ! জুলফিকার সাহেবও মেয়ের জন্য অপেক্ষা করতে চেয়েছিলেন । কিন্তু বাধ সাজল মীমের হাজব্যানড । নানা অযুহাতে কিছুতেই আসতে দিল না । এর পর বড় ছেলে অরণ্যও বাবাকে ফোন করে বলেছিল,
বাবা আমি কি আসব ?
আসবে কি আসবে না ; এটা তোমার নিজস্ব ব্যাপার । আমি কখনও তোমাদের ব্যক্তি স্বাধীনতায় হস্তক্ষেপ করিনি । নাকি করেছি বল ?
কর নাই বাবা । আমার আসার খুব ইচ্ছে হচ্ছে । কিন্তু এখানে কিছু জরুরি কাজ জমে আছে । আমি কিছুদিন পরে আসি বাবা ।
বলেছি তো সেটা তোমার ব্যাপার । যখন মন চাইবে আসবে আর মন না চাইলে আসবে না ।
বাবা তুমি মনে হয় রেগে যাচ্ছ ?
না, না রেগে যাব কেন ? এই বলে জুলফিকার সাহেব টেলিফোন নামিয়ে রাখলেন ।কেন জানি
দুচোখ ভিজে উঠছে । বার বার রাজিয়ার কথা পড়ে পড়ছে । তিনি বুঝতে পারছেন না সব কিছু কেন এমন দ্রুত বদলে যাচ্ছে, ভেঙ্গে যাচ্ছে । পরিবার, সমাজ, বন্ধু-বান্ধব, পরিবেশ, প্রতিবেশ সব, সব, সব । রোগ, শোক, মৃত্যু কোন কিছুর আবেদনই আর আগের মত নেই ।
যান্ত্রিকতা কেড়ে নিচ্ছে সব । ইট পাথরে চাপা পড়ছে আবেগের পর আবেগ । সামান্য কারণে যে মনে ঝড় উঠত ; এখন অতি বড় বড় কারনেও সেই মনে মেঘ দেখা যায় না । কী সেলুকাস !
এর কয়েকদিন পর কানাডা থেকেও একটি ফোন এসেছিল । ছোট ছেলে ইঞ্জিনিয়ার নিঝুম হায়দারের ।
হ্যালো বাবা
শুনছি বল ।
ভাইয়া তো বাংলাদেশে আসতে চেয়েছিল । আমি বললাম, মা তো মারাই গেছে; এখন যেয়ে কি করবে ? বেঁচে থাকলে না হয় এখানে এনে ডাক্তার দেখাতে পারতে । এখন আর যাওয়ার দরকার কী ? ঠিক বলিনি বাবা ?
জুলফিকার সাহেব মনে মনে একটি দীর্ঘ নিঃশ্বাস গোপন করে বললেন, খুব ঠিক বলেছ বেটা, খুব ঠিক বলেছ । আর কিছু বলার আছে তোমার ?
আর কি যেন বলব বাবা ঠিক মনে করতে পারছি না । মনে হলে আবার না হয় তোমাকে ফোন দেব ।
এখন রাখি বাবা ?
জুলফিকার সাহেব কিছু বললেন না । কেবল রিসিভারটি নামিয়ে রেখে বালিশে মুখ গুঁজলেন ।
কিছুক্ষণ পর রাজিয়ার একটি ছবি বের করে বুকের সাথে চেপে ধরে শিশুর মত হাউ মাউ করে কাঁদতে লাগলেন । প্রিয়তমা স্ত্রীর মৃত্যুতে যে মানুষটির চোখে জল আসেনি; আজ সেই জল অঝোর ধারায় গড়িয়ে চলল ।
০৩
অনবরত কলিং বাজছে । জুলফিকার সাহেব নির্বিকার । কোন ভ্রুক্ষেপ নেই তার । দরজা খোলার কোন আগ্রহ পাচ্ছেন না । মস্তিষ্কের সাড়া নেই । কেনই বা সাড়া থাকবে ? কার জন্য থাকবে ? এতদিন রাজিয়ার জন্য অপেক্ষা করতেন; এখন কার জন্য করবেন ? স্ত্রী-পুত্র-কন্যা কোথাও কেউ নেই । সব ফাঁকা । শুধুই ফাঁকা ।
অনেকক্ষণ পর দরজা খুলে দিলেন । জরিনা । কাজের বুয়া । মধ্যবয়সী মহিলা । কথা না বলে থাকতে পারেন না । এটা সেটা বলতেই থাকেন । জুলফিকার সাহেবকে মামা বলে ডাকেন । বেশ কয়েক বছর হল সে এখানে কাজ করছে । স্বভাব চরিত্র ভাল । হাত টানের অভ্যাস নেই । রান্না বান্নার হাতও নেহায়েত মন্দ নয় । পরিষ্কার পরিচ্ছন্ন । সারাদিন কাজ করে সন্ধ্যার পর পর চলে যান । কিছু একটা বলার জন্য জরিনা অনেকক্ষণ ধরে চেষ্টা করছে । কেন জানি বলতে পারছে না । বিষয়টি জুলফিকার সাহেবের অভিজ্ঞ চোখকে এড়াতে পারল না । জুলফিকার সাহেব জিজ্ঞেস করলেন, কিছু বলবে জরিনা ?
জী মামা, একখান কথা কইতাম ।
বল ।
জরিনা কিছু বলছে না । চুপ করে আছে । সুনসান নীরবতা । জুলফিকার সাহেব বিষয়টি আঁচ করতে পেরে বললেন, তোমার কোন ভয় নেই । নিশ্চিন্তে বলে ফেল ।
জরিনা মাথা নিচু করে আমতা আমতা করতে করতে বলল, মামা আমি আর কাজে আসুম না ।
জুলফিকার সাহেব আকাশ থেকে পড়লেন না । তাঁর মুখ দেখে মনে হচ্ছে বিষয়টি তিনি জানতেন । তাছাড়া কাজ করা না করার ব্যাপারটি তার সম্পূর্ণ ইচ্ছাধীন । তবু বললেন,
কেন কাজ করবে না জানতে পারি কী ?
বাসায় একা একা সারাদিন আমার ভালা লাগে না ।
কেন আমি তো আছি ।
আপনার সাথে কি এত কথা বলা যায় ?
কেন বলা যাবে না; আমি কী মানুষ না?
সেইটা না মামা ।
জুলফিকার সাহেব আর কথা বাড়ালেন না । বাথরুমে ঢুকলেন । কোন প্রয়োজন নেই তবু । একাকীত্ব আর নির্জনতাকে আরও বাড়িয়ে তোলার অপপ্রয়াস মাত্র !
০৪
জরিনা সেদিনের পর আর আসেনি । মাঝে একবার মীম ফোন করেছিল । ছেলেরা কেউ
ফোন করেনি । হয়ত সময় পায়নি ; নয়ত করার প্রয়োজনও বোধ করেনি । জগত সংসারে এত মানুষ ; তবু জুলফিকার সাহেবের যেন কেউ নেই ।রাজিয়া ভিলা এখন শূন্য । খাঁ খাঁ ।
। অনিয়ম আর অযত্ন - অবহেলায় দিন দিন জুলফিকার সাহেবের শরীরের অবনতি হচ্ছে । এত বড় বাসা, এত গুলো রুম সবই যেন বিরান মরুভূমি । দেয়ালে
দেয়ালে সাঁটানো নামি দামি পেইন্ট গুলো যেন অনবরত কেঁদে চলেছে । কেউ শুনে না । অথচ এমন তো হবার কথা ছিল না । ছেলে মেয়ে, নাতি, নাতনিদের কোলাহলে যেখানে আনন্দ উপচে পড়ার কথা; সেখানে আছে শুধু অন্ধকার কবরের নিস্তব্দতা ! আছে রাজিয়ার অশরীরী
আত্মা । মাঝে মাঝে কথা হয় জুলফিকার সাহেবের সাথে !
রাজিয়া জিজ্ঞেস করে, কী কেমন আছ ?
জুলফিকার সাহেব দ্বিধায় পড়ে যায় । রাজিয়া কি না সন্দেহ হয় । রাজিয়া তো তাকে কখনও তুমি করে বলেনি । জুলফিকার সাহেব জিজ্ঞেস করেন, কে তুমি ?
আমাকে চিনতে পারলে না, আমি রাজিয়া । রাজিয়া বানু । পৃথিবীর জিন্দেগীতে তোমার স্ত্রী ছিলাম । বলেই খিল খিল করে হেসে উঠল ।
তুমি তো কোনদিন আমাকে তুমি করে বলতে না; এখন বলছ কেন ?
এখন আমি তোমার স্ত্রী না তাই !
স্ত্রী না কেন ?
ওমা মৃত্যুর পর স্বামী স্ত্রীর সম্পর্ক থাকে না তাও জানো না ।হাঃ হাঃ হাঃ
না জানতাম না । আচ্ছা, তুমি বলছ স্বামী স্ত্রীর সম্পর্ক শেষ; তাহলে আমার কাছে এসেছ কেন ?
তোমার কাছে আসিনি; বাসাটা দেখতে এসেছি । অনেকদিন ছিলাম তো । মায়া কাটাতে পারছি না ।
আমার প্রতি তোমার কোন মায়া নেই ?
ছিল; এখন নেই ।
এখন নেই কেন ?
এখন থাকতে নেই ।
আচ্ছা, তোমার ছেলে মেয়ের খোঁজ-খবর নিয়েছ ? ওরা কেমন আছে ?
খোঁজ নিয়েছি । ওরা খুব ভাল আছে । স্বার্থপরেরা সব সময় ভালই থাকে ।
স্বার্থপর বলছ কেন ?
এই যে ওরা তোমার কোন খোঁজ খবর নিচ্ছে না ; বাবার নামটি পর্যন্ত ভুলে গেছে ! তুমি এই পাপিস্টদের কোনদিন ক্ষমা করো না ।
মরণের আগে কিন্তু আমাকে অন্যকথা বলেছিলে ?
কী কথা বলেছিলাম ?
ওরা অবুঝ ; ওদের ক্ষমা করতে বলেছিলে ।
আগে বুঝতে পারিনি ; এখন বুঝতে পারছি । ওরা ক্ষমার যোগ্য নয় ।এই বলে ছায়া মূর্তি অদৃশ্য হয়ে গেল ।
জুলফিকার সাহেব রাজিয়া রাজিয়া বলে ডাকতে লাগলেন । কেউ সাড়া দিল না ।
০৫
গত দুদিন ধরে জুলফিকার সাহেবের খুব জ্বর । তাঁর জীবনে অসুখ বিসুখ তেমন একটা হয়নি । এমন কি সর্দি কাশিও না । তাই মাত্র দুইদিনের জ্বরেই তিনি অত্যন্ত কাবু হয়ে পড়েছেন । তাছাড়া একজন অসুস্থ মানুষের যত টুকু সেবা যত্ন প্রাপ্য তার কিছুই তিনি পাচ্ছেন না । এক গ্লাস পানি খেতে হলেও বিছানা ছেড়ে উঠতে হয়; জগ থেকে গ্লাসে পানি ঢালতে হয় । এই দুই দিনে বাসায় কোন খাবার রান্না হয়নি; চুলাও জ্বলেনি ।শুকনো খাবার আর পানি । পানি আর শুকনো খাবার । বাসায় প্রাথমিক চিকিতসার সব ঔষধই আছে । জুলফিকার সাহেব ঔষধ খাচ্ছেন না । খেতে ইচ্ছে করে না । সারাক্ষণ খোলা বারান্দা দিয়ে আকাশের দিকে তাকিয়ে থাকেন । জ্বরে পড়ার পর থেকে মায়ের কথা খুব মনে পড়ছে । জ্বরের তীব্রতায় কখনও কখনও মাগো মাগো বলে ডাকছেন । স্মৃতির পাতা খুলে পড়তে বসছেন । কিন্তু ভাঙ্গা মনে কোন কিছুতেই শান্তি পাচ্ছেন না ।
এখন জ্বরের উত্তাপ কিছুটা কম । কলিং বেল বাজছে । কেউ এসেছে । কে আসতে পারে ?
এ বিষয়ে কিছুই অনুমান করতে পারছেন না । কষ্ট করে কোন রকমে দরজা খুলে দিলেন ।
আক্কাস আলী । হাসপাতালের পিয়ন । বড় ভাল মানুষ । নরম দিল । আর্থিক অবস্থা ভাল নয় । ছয়জনের সংসার একার রোজগারে চলে । মাঝে মাঝে জুলফিকার সাহেবের নিকট থেকে
টাকা ধার নিতেন । বেতন পেয়েই ফেরত দিতে আসতেন । জুলফিকার সাহেব হাসতে হাসতে বলতেন এখন নয় পরে দিয়েন । সেই আক্কাস আলী স্যারকে সালাম দিয়ে জিজ্ঞেস করলেন,
স্যার কেমন আছেন ?
আমি ভাল আছি আক্কাস মিয়া । কি মনে করে এতদিন পরে ?
এমনি স্যার । অনেক দিন ধরে আপনাকে দেখি না । খুব মনে পড়ছিল । তাই চলে আসলাম ।
খুব ভাল করেছেন । বসুন ।
স্যার ম্যাডাম কোথায় ?
তিনি তো কিছুদিন আগে মারা গিয়েছেন ।
ইন্না লিল্লাহি অ ইন্না ইলাইহি রাজিউন ।
তাহলে তো স্যার আপনি খুব সমস্যায় আছেন । একা বাসায় কিভাবে কি করছেন ?
জুলফিকার সাহেবকে চিন্তিত মনে হল । তিনি কিছু বলছেন না । আক্কাস আলী বুদ্ধিমান লোক । যা বুঝার বুঝে নিয়েছেন । দুজনেই চুপচাপ । কেউ কিছু বলছেন না । কিছুক্ষণ পর আক্কাস আলী বললেন,
স্যার আপনি অনুমতি দিলে একটা কথা বলি ।
জী বলেন ।
এত বড় বাসায় আপনার পক্ষে একা থাকা কোন ভাবেই সম্ভব না স্যার । রান্না বাড়া, অসুখ-বিসুখ কত কিছুই তো আছে । যদি কিছু মনে না করেন আমি আপনাকে আমার বাসায় নিয়ে যেতে চাই । আমার এখানে থাকতে আপনার অনেক কষ্ট হবে স্যার । তবু এখানে আপনাকে আমি একা ফেলে রেখে যেতে পারব না । কোন মতেই না ।
আপনার বাসা কোথায় ?
ঝিকাতলায় স্যার ।
আক্কাস আলীর কথা শুনে অনেক অনেক দিন পর জুলফিকার সাহেবের দু চোখ ছলছল করে উঠল । কী উত্তর দিবেন তিনি ভেবে পাচ্ছেন না । গত কদিন ধরে একটি প্রশ্ন তার মনের ভিতর ঘুর পাক খাচ্ছে ; পরিবার প্রথা কি ভেঙ্গে যাচ্ছে ? নাকি ভেঙ্গে গেছে । পৃথিবীর সময়
যত গড়াচ্ছে; জ্ঞান বিজ্ঞানের, প্রযুক্তির তত উন্নতি হচ্ছে । শুধু ক্ষয়ে ক্ষয়ে যাচ্ছে বন্ধন । পারিবারিক বন্ধন, সামাজিক বন্ধন, আত্মীয়তার বন্ধন ধীরে ধীরে বিলুপ্তির পথে ক্রম ধাবমান । যৌথ পরিবার ভেঙ্গে গেছে, একক পরিবারও ভেঙ্গে যাওয়ার পথে । শুরু হয়েছে ভাঙনের খেলা ! এ খেলার শেষ কোথায় ? উন্নত বিশ্বে বিবাহ বহির্ভূত ভাবে সন্তান জন্ম হচ্ছে । ডে-কেয়ার গুলোতে বড় হচ্ছে কোমলমতি শিশুরা । বঞ্চিত হচ্ছে মা-বাবার স্নেহ থেকে । আর ঐ সব দেশের উল্টা হাওয়া আমাদের মত উন্নয়নশীল দেশ গুলোতেও বইতে শুরু করেছে ।
জুলফিকার সাহেব কিছুই বলছেন না দেখে আক্কাস আলী ডাকল, স্যার ! আমার প্রস্তাবটা ?
জুলফিকার সাহেব সম্বিত ফিরে পেলেন । বললেন, হু আপনার প্রস্তাবটা খুবই সুন্দর । আমি খুব খুশী হয়েছি । আমার একটি ভুল ধারনাও আপনি ভেঙ্গে দিলেন ।
কী যে বলেন স্যার আমি----
হু আপনি । আপনি আমার বড় উপকার করলেন । আমি ভেবেছিলাম পরিবার প্রথা ভেঙ্গে গেছে । আসলে এখন বুঝতে পারলাম আমার ধারনা ঠিক নয় । নদীর এপার ভাঙলে ওপার
গড়ে ।
এত কঠিন কথা আমি বুঝি না স্যার । আমার প্রস্তাবটা ?
আপনার প্রস্তাবটা আমি মেনে নিয়েছি ।
আক্কাস আলীর চোখে মুখে বিশ্ব বিজয়ের আনন্দ হাসি । সে হাসিতে কোন খাদ নেই; শুধু আছে
নিঃস্বার্থ ভালবাসা ।
তাহলে স্যার এখনই রেডি হয়ে নেন । এখানে একা একা থাকা একদম নিরাপদ নয় ।
আজ নয় আক্কাস মিয়া । আমি একটু গোছ-গাছ করি । আপনি তিন দিন পরে আসুন । আজ ২৯ তারিখ । আপনি আগামি মাসের এক তারিখে আসুন । সকাল দশটা থেকে এগারটার মধ্যে আসবেন । কোন রকম দেরি করবেন না যেন ।
ঠিক আছে স্যার । আপনি রেডি হয়ে থাকবেন । আমি এখন আসি স্যার ।
আসুন ।
০৬
আজ ১ লা এপ্রিল । রবিবার । দশটা বাজতে আর খুব একটা দেরি নেই । জুলফিকার সাহেব মহা আনন্দে প্রস্তুতি নিচ্ছেন । রাতে অনেক দিন পর ভাল ঘুম হয়েছে । এমন একটি
সিদ্ধান্ত নিতে পেরে তিনি খুবই গর্বিত ও উল্লাসিত । আক্কাস আলী এখনও আসছে না কেন ?
কোন অসুবিধা হল না তো আবার । এই সব চিন্তা করতে করতে জুলফিকার সাহেব সিঁড়ি ভেঙ্গে ছাদে উঠলেন । টবের গাছ গুলোতে হরেক রকম ফুলের মেলা । তিনি পরম মমতায় আপন সন্তানের মত ফুল গুলোর গায়ে হাত বুলিয়ে দিলেন । টেপ ছেড়ে প্রত্যেকটি গাছের গোঁড়ায় পানি দিলেন । ফাঁকে ফাঁকে আকাশের দিকে তাকিয়ে কার কথা জানি ভাবলেন ।
কিছুক্ষণ পর আক্কাস আলী এসে উপস্থিত হলেন । তার মনেও আর আনন্দ ধরে না । তিনি ড্রয়িং রুমে বসে আছেন । স্যারের জন্য অধীর আগ্রহে অপেক্ষা করছেন । কিছুক্ষণ পর একটি
ব্রিফকেস হাতে জুলফিকার সাহেব ড্রয়িং রুমে ধীরে ধীরে প্রবেশ করলেন । আক্কাস আলী উঠে দাঁড়ালেন । জুলফিকার সাহেব ব্যাগের ভিতর থেকে একটি নীল রঙের খাম বের করে আনলেন । অতঃপর খামটি আক্কাস আলীর দিকে এগিয়ে দিয়ে বললেন,
এই নিন আক্কাস সাহেব । এটা আপনার জন্য ।
এটা কী স্যার ?
এই বাসার দলিল ।
এটা দিয়ে আমি কি করব স্যার ?
জুলফিকার সাহেব সহজ সরল আক্কাস আলীর কাঁধে হাত রেখে বললেন, আজ থেকে আপনি এই
রাজিয়া ভিলার মালিক । আমি এই বাসা আপনার নামে লিখে দিয়েছি । আপনি আপনার স্ত্রী,
সন্তান নিয়ে এখানে বাস করুন । আমার কিংবা আমার কোন বংশধরের এ বাসার উপর আর
কোন অধিকার নেই ।
একি করেছেন স্যার ; এ আমি চাই না । এই বলে আক্কাস আলী জুলফিকার সাহেবের দুপায়ে
লুটিয়ে পড়লেন ।
জুলফিকার সাহেব আক্কাস আলীকে দুহাতে টেনে তুলে বুকে জড়িয়ে নিলেন । তারপর বললেন, আমার জন্য চিন্তা করবেন না । আমি মাঝে মাঝে আপনার বাসায় বেড়াতে আসব ।
এখন কোথায় যাবেন স্যার ?
জুলফিকার সাহেব অত্যন্ত দৃঢ় কন্ঠে জবাব দিলেন, আমি আজ থেকে বৃদ্ধাশ্রমে থাকার সিদ্ধান্ত নিয়েছি । এ ছাড়া আমার অন্য আর কোন উপায় ছিল না । আমি আসি । আপনারা ভাল
থাকবেন । এই বলে জুলফিকার সাহেব সামনে পা বাড়ালেন ।
আর আক্কাস আলী স্যারের গমন পথের দিকে ফ্যাল ফ্যাল করে তাকিয়ে রইলেন ।
*****