০১
সোহরাব হোসেন মুচকি হাসলেন। হাসতে হাসতে মাটির দিকে তাকালেন। মনে হচ্ছে কিছুটা লজ্জা পেয়েছেন । নিজের কৃতকর্মের অনুশোচনায় মানুষ লজ্জা পায় । আবার অন্যের হীন কাজ দেখেও কেউ লজ্জা পায়। কখনো স্মৃতির জানালা থেকে লজ্জা চলে আসে। এক্ষেত্রে কোনটি হয়েছে বুঝা মুশকিল।
কে যেন গা ঘেষে দাঁড়িয়েছে। ঘাড় ঘুরালেন সোহরাব হোসেন, কে? অরণি?
অরণি লতার মতো ঘাড় পেঁচিয়ে তাঁর পিঠের উপর ঝুলে পরলো। কিছুই বলল না। সোহরাব হোসেন উঠে দাঁড়ালেন। অরণি গলায় হাত পেঁচিয়ে ঝুলে রইলো। অরণি খুব মজা পাচ্ছে। সোহরাব সাহেবও কম মজা পাচ্ছেন বলে মনে হলো না।
সোহরাব হোসেন বললেন, আমি কিন্ত ঝাঁকি দেব মামনি। আমি ঝাঁকি দেব আর তুমি পটাস করে নিচে পড়ে যাবে।আর পড়ে গেলে একটা দাঁত ভেঙে যাবে। দাঁত ভাঙলে শ্বাশুড়ি তোমায় আদর করবে না।
অরণি শব্দ করে হাসলো, হা, হা, হা। তুমি ঠিক বল নাই বাবা, আমারতো সবে দুধ দাঁত, পড়লে সংগে সংগে ইঁদুরকে দিয়ে দেব। ইঁদুর আমাকে আরও সুন্দর দাঁত উপহার দিবে। হা হা হা , ঠিক বলিনি বাবা? আর হা, সত্যি করে বলোত তুমি মিটি মিটি হাসছিলে কেন?
-তোমার এত বুদ্ধি কেন মামনি?
প্রসঙ্গ বদল হওয়ায় অরণি কপট রাগ প্রকাশ করলো - তুমি কিন্তু শাক দিয়ে মাছ ঢাকছো বাবা, সত্যি কথাটা বলে ফেল ঝটপট । আর বলতো বড়রা এমন হয় কেন?
-কেমন হয় মামনি?
- এই যে ছোটদের ছোট মনে করে--।
- এটা কেমন কথা হলো, ছোটদের ছোট মনে করবে না তো ছোটদের বড় মনে করবে নাকি?
-আমি কি তাই বলেছি বাবা? আমি বলতে চেয়েছি, আমরা যতটা না ছোট তার চাইতেও ছোট মনে করা হয় আমাদের।
সোহরাব সাহেব আবার মিষ্টি করে হাসলেন, তাই নাকি?
-একদম দুষ্ঠুমি করবে না কিন্তু বলে দিচ্ছি। দুষ্টুমি করলে পিঠে ধপাধপ কিল শুরু হবে। নতুবা দেব চুল ছিঁড়ে।
- ঘাঁট মানছি মামনি, আমারই ভুল হয়েছে। আর শোন , পিঠে কিল দিলেতো তুমি সংগে সংগে নিচে পড়ে যাবে।
- বাবা, তুমি না আস্ত বোকা,একদম কিছু বুঝ না। আমি দু’পায়ে তোমার কোমর পেঁচিয়ে ধরবো না? তারপরতো কিল আর কিল। আর আসল কথাটা বলে ফেল, তুমি হাসছিলে কেন?
-মাশাল্লাহ, অনেক বুদ্ধি হয়েছে আমার মামনির। তাহলে তো বলতেই হয়। তুমি লাল শাড়ি পড়ে একেবারে বউ সেজে এসেছ। একদম টুক টুক নতুন বউয়ের মতই লাগছে তোমাকে। আর অবিকল তোমার মায়ের মত। তুমি এখন অনেক বড় হয়ে গেছ মামনি।
- ‘বড় হবো না?’ এই বলে সে গাছ থেকে নামার মত করে বাবার পিঠ থেকে নামলো গড়িয়ে গড়িয়ে । আর আদেশের সুরে বলল, তুমি কুঁজো হও বাবা।
সোহরাব হোসেন কুঁজো হয়ে দাঁড়ালেন। অরণি তার বাবার পাশে দাঁড়িয়ে তার উচ্চতা মেপে নিল, এই দেখ আমিতো তোমার সমান হয়ে গেছি। হা, হা । বলেই অরণি লাফাতে শুরু করলো।এমন সময় অরণির চোখ থেকে চশমাটা নিচে পরে গেল।
০২
সকালে ঘুম থেকে উঠেই অরণি দেখল, তার রুমে তারই সমবয়সী একটি ছেলে খেলা করছে। সে অবাক হয়ে রুমের নানা জিনিসপত্র ধরে ধরে দেখছে। অরণি প্রথমে কিছুটা বিস্মিত হলেও পরক্ষণে বুঝতে পারলো, নিশ্চয় ছেলেটি তার ফুফাত ভাই রাজু। গতকাল আসার কথা ছিল। কিন্তু অনেক রাত অবধি এসে পৌঁছায়নি। অরণি উঠে ছেলেটির কাছে গেল, তুমি রাজু?
- হ্যা, আমি রাজু । তুমি অরণি?
স্বয়ংক্রিয়ভাবে পরিচয় হলো দু’জনের। এরা দু’জনে দু’জন সম্পর্কে জানে অনেক কিছু। কিন্তু দেখা হলো এই প্রথম। আর কিছুক্ষণের মধ্যেই দু’জনের মধ্যে খুব ভাব জমে উঠলো।
অরণি রাজুকে তার সবগুলো খেলনা দেখাতে ব্যস্ত হয়ে পড়লো, এটা হচ্ছে আমার পরী, হাসতে পারে, নাচতে পারে, গাইতে পারে ...
রাজু পুতুলটাকে হাতে নিয়ে দেখলো, সত্যি খুব সুন্দর! সুইচে টিপ দিলে নানান ভঙ্গিমা ও শব্দ করে।
অরণি রাজুকে একে একে তার সব খেলনা দেখাতে লাগলো । রাজু একেকটি দেখে আর অবাক হয়। অরণি কি আনন্দেই না আছে!
খেলনাগুলো দেখানো শেষ হলে অরণি একটা টিভি’র মত যন্ত্রের সুইচ অন করলো, রাজু এটা হচ্ছে কম্পিউটার। এটা দিয়ে তুমি সব কিছু করতে পারবে। গান, শুনতে পারবে, সিনেমা দেখতে পারবে, ভিডিও গেমস খেলতে পারবে, পড়াশোনা করতে পারবে, আরো অনেক কিছু...।
রাজু বলল, তাহলে তো এটা একটা যাদুর বাক্স !
-তুমি ঠিকই বলেছ রাজু, এটা সত্যি একটা যাদুর বাক্স। এটা দিয়ে তুমি পৃথিবীর প্রায় সব কাজ করতে পারবে।
বলতে বলতে কম্পিউটার চালু হয়ে গেল। অরণি প্রথমেই একটা কার্টুন ছবি বের করলো। রাজু কাটুন দেখে খুব মজা পেল। অরণি কম্পিউটারের একটা যন্ত্র হাত দিয়ে নাড়াচাড়া করছে বার বার । এটা দিয়ে সে যন্ত্রটাকে নিয়ন্ত্রণ করছে বলে মনে হয়।
রাজু বলল, অরণি এটার নাম কি?
অরণি বলল - হা ,হা, কি বোকা ছেলে ... , এটাও জানোনা? এটা হচ্ছে মাউস। আর এটা হচ্ছে মনিটর, এটা হচ্ছে সিপিইউ ...
রাজু ভাবলো, আসলেই সে খুব বোকা। অরণি কত কিছু জানে!
রাজু বলল, তুমি আমাকে সব শিখিয়ে দাও অরণি । আমি সবকিছু শিখতে চাই।
দু’জন মিলে সারাবেলা কার্টুন আর ভিডিও গেমস এ মেতে রইলো। এমন কি তারা অনেক রাত পর্যন্ত কম্পিউটারে মেতে রইলো। ফলে সকালে ঘুম ভাঙতে দেরী হলো রাজুর। রাজুর সাধারণত এমন হয় না কোনদিন।
আজ অরণির স্কুল খোলা। সে একটা ইন্টারন্যাশনাল স্কুলে পড়ে। এখানে লেখাপড়া সম্পূর্ণ কম্পুটারাইজড। তাদের কোন বই নেই। পড়ে সব ই-বুক। ই-বুকের ফাঁকে ফাঁকে নানা বিনোদন। টিচারগণ সব হেল্পফুল। নিজেরা খুব একটা পড়ান না । শুধু নির্দেশনা দেন। শিক্ষার্থীরা ইন্টারনেট ঘেটে পড়াশোনা করে।
এতে করে অরণিদের স্কুল আর বাসা শুধু কম্পিউটার আর কম্পিউটার। চোখে ব্যথা হয়ে যায় অনেকের।
দিনশেষে সবাই সমস্বরে বলে উঠলো, হু-র-রে --
উপলক্ষ্য একটি নোটিশ। ছুটির নোটিশ। গ্রীষ্মের ছুটি।
অরণি মনে মনে ফন্দি আটলো, বাবাকে বুঝিয়ে এবার যেভাবেই হোক ফুফুদের বাড়িতে বেড়াতে যেতে হবে।
০৩
মা-মরা মেয়েটাকে সোহরাব সাহেব সব সময় বুকে আগলে রাখেন। ইদানিং মেয়েটার চোখে সমস্যা হচ্ছে। ঝাপসা দেখছে। চশমা নিতে হয়েছে। তদুপরি মেয়েটা খেতে চায় না কিছু। শুধু চিপস , বার্গার, যতসব ফাস্টফুড। অরণিকে নিয়ে চিন্তার অন্ত নেই সোহরাব সাহেবের।
রাতে শোবার সময় বাবার গলা জড়িয়ে ধরে অরণি বলল, বাবা আমি গ্রীষ্মের ছুটিতে রাজুদের সাথে ফুফুর বাড়িতে বেড়াতে যেতে চাই।
সোহরাব সাহেব আকাশ থেকে পড়লেন, মেয়ে বলে কি?
মেয়েকে বুকে টেনে নিয়ে আদর করলেন, তুমি আমাকে ছাড়া গ্রামে গিয়ে থাকতে পারবে মামনি?
অরণি খুশিতে গদ গদ হয়ে বলল, আলবৎ পারবো বাবা। রাজু খুব ভাল। আমি তার সাথে সারাদিন খেলব। আমিতো কখনো গ্রাম দেখিনি বাবা। আমি গ্রাম দেখবো। রাজুদের নাকি দোতলা টিনের ঘর আছে। সে সেখানে থাকে। জানালা দিয়ে চাইলে নদী দেখা যায় , পাখি দেখা যায়। আর ওখানে তুমি যেদিকেই তাকাবে না কেন শুধু সবুজ আর সবুজ।
সোহরাব সাহেব মেয়ের চোখের দিকে চেয়ে রইলেন।
অরণি বাবার দু’গালে দু’টো চুমু খেয়ে বলল, তাহলে আমি কিন্তু যাচ্ছি বাবা!
সোহরাব সাহেব কিছুই বলতে পারলেন না । মেয়ের চোখের স্বপ্নে হারিয়ে গেলেন।
০৪
আজ খুব ভোরে ঘুম ভাঙল অরণির। অবশ্য এর আগেও দুই তিন বার ঘুম ভেঙ্গেছে অরণির । আজ তার জন্য একটা বিশেষ দিন। সে গ্রামে বেড়াতে যাচ্ছে। অরণি গ্রাম শুধু ছবিতে দেখেছে। বাস্তবে দেখেনি কখনও । আজ সে স্বপ্ন পুরণ হতে যাচ্ছে।
অরণি হাত মুখ ধুয়ে ফ্রেস হয়ে রাজুর গায়ে নাড়া দিয়ে ডাকলো, রাজু, রাজু... , উঠো, দেখ কেমন সকাল হয়ে গেছে।
আড়মোড়া ভেঙে উঠে বসলো রাজু। বাড়ির জন্য তারও মনটা কেমন যেন করছে! কতদিন হল সে মায়ের হাতে খায় না!
দেখতে দেখতে ঘড়িতে ন’টা বেজে গেল । এরি মধ্যে নাশতার পর্ব শেষ হয়েছে। সোহরাব সাহেবের মনটা ভীষণ খারাপ। কিন্তু মেয়েকে সেটা টের পেতে দিচ্ছে না। কষ্ট লুকানোটা খুবই কষ্টের। মেয়ের ইচ্ছের উপর কোন দিন না বলতে পারেননি তিনি।
জিনিসপত্র সব গাড়িতে উঠানো হয়েছে। রাজুর বাবা , রাজু , আর ড্রাইভার অরণির সঙ্গে যাচ্ছে। সোহরাব সাহেব অরণির জন্য বাড়তি দু’টো চশমা তৈরী করে রেখেছেন। মেয়ের ব্যাগের পকেটে ঢুকালেন সযত্নে। আর বার বার করে বললেন, অরণি , বাবাকে ভুলে যেও না। যখন ইচ্ছে ফোন করবে।
গাড়ি যখন ছাড়লো, সোহরাব সাহেবের দু’চোখ বেয়ে অশ্রু গড়িয়ে পড়লো যেন মেয়ে বিয়ে দিয়ে ঘরের বাইরে পাঠিয়ে দিচ্ছেন।
০৫
ঘন্টাখানেকের মধ্যে গাড়ি ঢাকা শহর ও শহরতলী পার হয়ে গ্রামের আভাস দেখতে পেল। অরণি জানালার কাঁচ গলে বাইরে তাকিয়ে অবাক হয়ে গেল। চারিদিকে বিস্তীর্ণ প্রান্তর। গাছে গাছে ছেয়ে আছে মাইলের পর মাইল। আর পাতাগুলো কি সবুজ! চোখ জুড়িয়ে যায় । অরণি প্রায় চিৎকার করে বলল- দেখ, দেখ রাজু কী সুন্দর! লতার মতো গাছে কত শশা ঝুলে আছে...
রাজু বলল, ঐ দেখ কলাবাগান, কাদি কাদি কলা। তোমাদের ঢাকার কলাবাগান নয়, সত্যিকারের কলাবাগান। দেখ কত বড় বড় সবুজ পাতা। আমরা গ্রামে কোন অনুষ্ঠান হলে কলা পাতায় খাই।
একটা খোলা জায়গায় এসে সোহরাব সাহেব ড্রাইভারকে গাড়ি থামাতে বললেন । গাড়ি পার্ক করে নেমে আসলেন সবাই। বাবা বললেন, এটা হচ্ছে নরসিংদী এলাকা। তোমরা লক্ষ্য করেছো ভেলানগর থেকে রাস্তার দু’পাশে সবজি আর সবজি। রায়পুরা পর্যন্ত তোমরা এরকম সবুজ সবজির বাহার দেখতে পারবে।
অরণির চোখ মুখ খুশিতে ভরে উঠলো। সে হাঁটতে হাঁটতে সব্জির জমিতে নেমে এলো এবং সব্জিগুলোকে ছুঁয়ে দেখতে লাগলো । অরণি একটা সবুজ ফলমত দেখিয়ে বলল, রাজু এটার নাম কি?
রাজু হেসে বলল, কি বোকা মেয়েরে বাবা, ওটাও চেন না ! এটা হচ্ছে পটল। বইয়ে পড় নাই , পটল খেয়ো কিন্তু পটল তোল না ।
রাজুর বাবাকে একটু পর পর গাড়ি থামাতে হল। সোনাইমুড়ি এসে ছোট্ট সবুজ পাহাড় । অরণির চোখে রাজ্যের বিস্ময়, আহা কি সুন্দর!
এর মধ্যে অরণি কয়েক প্রকার বেগুন, উচ্ছে, শশা , ঝিঙা ,ঢেঁড়স এরকম অনেক সব্জির সাথে প্রত্যক্ষ পরিচয় ঘটে গেছে। রাজু হঠাত করে অরণির কপালে একটা চিচিঙ্গার ফুল ফুটিয়ে দিল। অরণি চমকে উঠে পরক্ষণেই হেসে উঠলো ।
ভৈরব ক্রস করে কুলিয়ারচর, বাজিতপুর। রাস্তার দু’পাশে প্রচুর পাট আর ধানের ক্ষেত । আর একটু পর পর মুরগির খামার। অরণির খুব শখ হলো মুরগির বাচ্চাগুলো ছুঁয়ে দেখবে... । তাই হলো। মুরগির বাচ্চা হাতে অরণির খুশি দেখে কে?
আর কিছু দূর এগিয়ে রাজু বলল - দেখ, দেখ, কি সুন্দর গরুর বাথান। ঐ যে বাছুরটা তার মায়ের দুধ পান করছে। মায়ের কথা শুনে অরণির মন খারাপ হয়ে গেল । তার যে মা বেঁচে নেই ।
তারা যখন বাড়িতে এসে পৌঁছালো ততক্ষণে দুপুর। বাড়ির সামনে এসে গাড়ি থামতেই তার ফুফু এসে অরণিকে একদম কোলে উঠিয়ে নিলেন - আহা , ছোট্ট মা আমার।
৬
সকালে নাশতার টেবিলে অরণি এবং রাজু পাশাপাশি বসেছে ।রাজুর মা পরম মমতায় দু’জনকে পাশে বসে খাওয়াচ্ছেন । পৃথিবীতে অনেক মানুষ আছেন - তাদের কেউ খেয়ে খুশি হন আবার কেউ খাইয়ে খুশী হন। রাজুর মা সালেহা বেগম হচ্ছেন দ্বিতীয় প্রকারের একজন।
অরণির প্লেটে কয়েকটি মলা মাছ দিলেন সালেহা বেগম - মামনি, বেশী করে মলা, ঢেলা আর ছোট মাছ খেতে হয়। এতে করে চোখের জ্যোতি বাড়ে। নিয়মিত খাও, দেখবে তোমার চোখ ভাল হয়ে যাবে দ্রুত। তোমার আর চশমা লাগবে না।
অরণির চোখ ছানাবড়া হয়ে গেল, কাঁটা লাগবে যে ---
সালেহা বেগম হাসলেন - রাজু, অরণিকে খেয়ে দেখাওতো কিভাবে মাছ খেতে হয়।
রাজু পুরো মলা মাছটা মুখে দিয়ে নিমেষেই চিবিয়ে ফেলল । আর হা করে দেখালো তার মুখে কিছু নেই।
অরণি অবাক হলো - আহা, কি রাক্ষস ছেলেরে বাবা!
সালেহা বেগম বললেন- কিছু হবে না মামনি, তুমি মাছটা মুখে দিয়ে আস্তে আস্তে চিবুতে থাক। গিলতে হবেনা। একসময় দেখবে এমনিতে খাওয়া হয়ে গেছে।
অরণি চোখ বন্ধ করে চেষ্টা করল। তাইতো কেমন করে যেন পুরো মাছটা খাওয়া হয়ে গেল অল্প সময়ে। অমনি করে ছোট মাছ, সবুজ শাক সবজি, হলুদ ফলমূল এখন আগ্রহ করে খায় অরণি।
সালেহা বেগম বললেন- তোমরা বিকেলে ঘুরতে যাবে, অরণিকে লতাপাতা ও গাছপালা চিনিয়ে দেবে। আর শোন, বেশী বেশী করে প্রকৃতির দিকে তাকাবে। সবুজের দিকে তাকালে চোখের জ্যোতি বাড়ে।
যেমন কথা তেমন কাজ। রাজু আর অরণি প্রতিদিন গ্রামের আনাচে-কানেচে ঘুরে বেড়াতে লাগলো। গ্রামের পাশ দিয়ে বয়ে গেছে মনু নদী। নদীতে পাল তোলা নৌকার বহর। জেলেরা মাছ ধরছে। গাংচিল টুপ করে ডুব দিচ্ছে।রাজু আর অরণি তাকিয়ে আছে নিবিষ্ট মনে।
নদীর ওপারে প্রান্তর। প্রান্তরের পর প্রান্তর। সবুজ ধানের ক্ষেত। বাতাসে ঢেউ খেলে যায়। কৃষক সেওতি দিয়ে সেচ দিচ্ছে। কেউবা নিড়াচ্ছে জমি।
হিমেল বাতাস এসে শরীরে শিহরণ দিয়ে যায়। মনে দোলা দিয়ে যায়। আকাশে সাজের মায়া খেলা করে। শাদা মেঘ উড়ে বেড়ায়। দু’একটা শাদা বক ফক ফক করে। চোখ জুড়িয়ে যায় অরণির।
গাঁয়ের মেঠোপথে হাঁটছে অরণি আর রাজু। দু’পাশে আম ও কাঁঠাল গাছের সারি। গাছে গাছে ঝুলে আছে কত না কাঁঠাল। অরণি ভাবে এত বড় কাঁঠাল গাছে ঝুলে কি করে? আম গাছে ঝুলে আছে পাকা আম। জামগাছে পেকে আছে কাল জাম। একটা জাম গাছের কাছে এসে দাঁড়ালো দু’জন। জাম পাড়া হচ্ছে। গাছে উঠে একজন ডালে ঝাঁকি দিচ্ছে। নিচে চারজন জাল পেতে ধরে আছে।কি আশ্চর্য কৌশল! অরণি অবাক হয়ে গেল । গ্রামের মানুষের কত বুদ্ধি!
নতুন মেহমান দেখে ওরা তাদেরকে এক ডুলা জাম দিল। রাজু নিতে চায়নি, ওরা জোড় করে ধরিয়ে দিল।মানুষগুলো কত ভাল!
অরণির জাম খেতে ইচ্ছে করছে। মুঠো ভর্তি করে জাম নিল সে। রাজু চাপ দিল, অরণি কলের পানিতে ধুয়ে নিল। দু’জনে জাম খেতে খেতে মুখ রাঙিয়ে বাড়ি ফিরল।
অরণির প্রতিদিনই নতুন অভিজ্ঞতা হচ্ছে। উঁচু আলের পাশে নতুন ঘাস। তরতাজা সবুজ । হাসছে যেন। গালিচার মত মনে হল। অরণি ঘাসের উপর শুয়ে পড়লো। আহা কি আরাম! কি শান্তি!! নিচে সবুজ ঘাস, উপরে নীল আকাশ। চোখে খেলা করে সবুজ বাতাস। অল্পদিনেই অরণি গ্রামের মেয়ে হয়ে গেল।
০৭
প্রায় এক মাস হয়ে গেল অরণি কাছে নেই। সোহরাব সাহেবের মনটা উতলা হয়ে উঠলো। জানি কি অবস্থায় আছে অরণি! ইদানিং ফোন করলেও সব সময় পাওয়া যায় না মেয়েকে। তিনি ছুটলেন মেয়ের উদ্দেশ্যে।
সোহরাব সাহেব রাজুদের বাড়ির খুব কাছাকাছি চলে এসেছেন। বাড়ির সামনেই ঢেঁড়সের জমি। বাঁশের কঞ্চি দিয়ে বেড়া দেওয়া। পাশেই রাস্তা। তার চোখে পড়লো, দু’টি শিশু গুটি গুটি পায়ে কি যেন করছে। তিনি চমকে দাঁড়ালেন। হ্যাঁ, রাজু আর অরণি। ইচ্ছে হলো দৌড়ে গিয়ে কোলে তুলে নিতে।কিন্তু তিনি অবাক চোখে দেখতে থাকলেন। অরণি আর রাজু দু’জনে একটি প্রজাপতি ধরার জন্য হন্যে হচ্ছে, ধরতে পারছে না। বার বার ধরতে যাচ্ছে আর প্রজাপতি উড়ে পালাচ্ছে। তিনি আরও বিস্মিত হয়ে লক্ষ্য করলেন, অরণির চোখে চশমা নেই। ভয়ে আতকে উঠলেন সোহরাব সাহেব, মেয়েটা চোখে কম দেখে- কখন যে আলের নিচে পড়ে যাবে! তিনি দ্রুত কাছে যেয়ে ডাকলেন, অরণি!
অরণি শুনতেই পেল না।
তিনি আরও জোড়ে ডাকলেন, অ-র-ণি!!
অরণি ঘাড় ফেরাল, বাবা! বলেই দৌড়ে এসে বাবার বুকে ঝাপিয়ে পড়লো। সোহরাব সাহেবের চোখের কোণে দু’ফোটা অশ্রু এসে ভীড় করলো।
বাবার আঙুল ধরে বাড়ির দিকে হাঁটছে অরণি। পাশে পাশে হাঁটছে রাজু।
সোহরাব সাহেব ডাকলেন, অরণি!
- জী বাবা!
- এতক্ষণ কি করছিলে তোমরা?
- প্রজাপতি ধরছিলাম।
- তোমার চশমা কোথায়?
- আহা! একদম মনে নেই।
- মনে নেই মানে?
- বাবা এখন না আমার চশমা পড়তে মনে থাকে না। আর আমিতো এখন চশমা ছাড়াই দেখি।
সোহরাব সাহেব ফেল ফেল করে মেয়ের মুখের দিকে তাকালেন।
রাজু বলল- মামা, আপনি অরণিকে নিতে এসেছেন?
সোহরাব সাহেব প্রশ্নের উত্তর না দিয়ে অরণির দিকে তাকালেন। অরণিও বাবার দিকে তাকাল। এ দৃষ্টিতে কিসের যেন আবেদন--
সোহরাব সাহেব বললেন, কিছু বলবি মা?
অরণি বলল, আমরা গ্রামে থাকতে পারি না বাবা?
সোহরাব সাহেবের চোখে ভাসতে থাকলো, তার মেয়ে অরণি সবুজ প্রান্তরে ছুটাছুটি করছে। চোখে কোন চশমা নেই। একটা প্রজাপতির পিছু ছুটছে তো ছুটছে --। আর প্রজাপতি উড়ছে ফুলে ফুলে।