এক
আমি হা করে তাকিয়ে ছিলাম।
উঠোনের ঠিক মাঝখানটা দিয়ে নিকষ কালো এলো চুলের এক পরী হেঁটে যাচ্ছিলো।
আধো রোদ আধো ছায়ায়,লাল জামা পড়া মেয়েটিকে কি যে মায়াবী লাগছিলো সেদিন! আহ চোখ জুড়িয়ে যাবার মতো।
ও রায়া।আমার বড় মামার বড় মেয়ে।
ও তখন ক্লাস টেন এ পড়ে। আর আমি ইন্টারমিডিয়েট পরীক্ষা দিয়ে রেজাল্টের অপেক্ষায় ছিলাম।
আমার পাশেই বসা ছিলো আমার খালাতো ভাই অভি।আমি এতটাই অবাক আর হতবিহ্বল হয়ে গিয়েছিলাম যে আমার ঘোর অভিকেও নাড়া দিয়েছিল।
আমি শুধু অভিকে বললাম , অভি, এটা আমি কি দেখলাম?
অভি আমার বছর দুয়েকের ছোট কিন্তু আমাদের চলাফেরা বন্ধুর মতো।অভি বেশি কিছু বললো না , শুধু বললো ,ভাইয়া তুমি গেছো।
তারপর আরো অনেকবার।এ ঘর থেকে ও ঘর।কারণে অকারণে আসা যাওয়া করছিলো সে ।জানিনা আমাকে দেখাবার জন্যই কিনা?
আর ওকে আসতে বা যেতে দেখলেই অভি বলে উঠতো ,ভাইয়া তোমার পরী।
সেদিনের পরীর কথাই ভাবছিলাম....
বছর তিনেক আগে এই রায়াকেই খুব ছোট দেখেছি।অথচ আজ কত বড় আর কি সুন্দর হয়েছে রায়া, বিশ্বাসই হচ্ছে না।
দুই
মামা কৃষক। কৃষি কাজই তার পেশা।দু চার জন কাজের লোক বাড়িতে সব সময়ই থাকে।সব কাজ তারাই করে মামা শুধু দেখাশুনা করেন।লেখাপড়া খুব বেশি করেন নি।কিন্তু তবুও তিনি ছিলেন খুবই প্রজ্ঞবান।
মামা যেমন ধার্মিক ছিলেন তেমনি পাড়া প্রতিবেশিরাও সবাই বেশ মান্য করতো।
প্রতি বছর অনেক ফসল ঘরে তোলেন তিনি।প্রয়োজনের বেশিটা বিক্রি করে প্রচুর আয়ও করেন।
মামা প্রতি বছর নতুন ফসল ঘরে তোলার নবান্ন উৎসবে সবাইকে দাওয়াত করেন। সে বছরও তার ব্যতিক্রম হয়নি।
ব্যতিক্রম বলতে এইটুকুই যে ,আমার মা আর বছর আমাকে নিয়ে আসেন।সে বছর তিনি আসেননি।
আমাকে একাই আসতে হয়েছে।
কারণ আমার মা যে আর নেই।মহান আল্লাহর ডাকে সাড়া দিয়ে তিনি পরপারে চলে গেছেন দু বছর হলো।
বছর তিনেক আগে শেষবার মায়ের সাথে এসেছিলাম মামা বাড়ির নবান্ন উৎসবে।
মাঝের বছর তিনেক আর আসা হয়নি।কারন আমি হোস্টেলে থেকে পড়াশোনা করেছি। ছুটিও তেমন পাইনি ,আর আসাও হয়নি।
কিন্তু মামী প্রায়ই বাবাকে ফোন করে আমাকে নিয়ে আসতে বলতো।মামী আমাকে মায়ের মতোই আদর করতেন।
মা মারা যাবার পর দুদিন ছিলেন তিনি আমাদের বাড়ি।একরকম মায়ের মতোই আগলে রেখেছিলেন। নিজ হাতে খাইয়ে দিতেন।মায়ের শোক ভুলতে নানান ভাবে আমাকে বোঝাতেন। মামীতো আমাকে তার সাথে করে নিয়ে আসতে চেয়েছিলেন কিন্তু বাবা রাজি হননি।
তিন
এদিক ওদিক ঘোরাঘুরি করে এসে বেলা তিনটায় দুপুরের খাবার খেতে আসলাম। মামার তিন সন্তানের ছোট দুই জন ,মেয়ে মায়া আর ছেলে রিফাত দৌড়ে আমাদের ডেকে আনতে গিয়েছিলো । আমরা বিলের ঘাটপাড় মাচায় বসে হাওয়া খেতে খতে গল্প করছিলাম।
মামী খুব রাগ করেছিলেন , কত বেলা হয়েছে খবর আছে ? ক্ষিদে লাগেনা বুঝি তোমাদের ?
লাজুক হেসে এড়িয়ে গিয়েছিলাম।
অনেকক্ষন হয় রায়াকে দেখছি না । মনটা কেমন অস্থির হয়ে আছে ওকে একটু দেখার জন্য । সাহস করে জিজ্ঞেস করেই ফেললাম ,মামী রায়া কোথায় ?দেখছি নাযে ? ও কি খেয়েছে ?
কি জানি ,এখানেই তো ছিলো , হুম খেয়েছে।
বিকেলে একটু ঘুমিয়ে নিয়ে খলার দিকে যাচ্ছিলাম।
গল্প করতে করতে হাঁটছিলাম আমি আর অভি। হঠাৎ দৌড়ে এসে সামনে দাড়ালো রায়া। রিফাত রায়া কে মারার জন্য তেড়ে আসছিলো। আমাদের দেখে আর এগোয়নি।হাপাচ্ছিলো রায়া।
স্লামুআলাইকুম। ভাইয়া, কেমন আছেন?
আমি মুচকি হেসে বললাম, আলহামদুলিল্লাহ। ভাল আছি।তুমি কেমন আছ?
ভাল।
রায়া,আমি এসেছি দুপুরে,এখন বিকেল গড়িয়ে প্রায় সন্ধ্যা, এতক্ষনে বুঝি মেহমানের খোজ নিতে ইচ্ছে হলো!
"স্যরি" বলে লাজুক হাসি হাসলো রায়া।আমাকে সুযোগ করে দেবার জন্য অভি সামনে এগিয়ে গেলো।আমি আবার বলতে শুরু করলাম,
আর একটা কথা ,স্লামুআলাইকুম বলে কোন শব্দ নেই। আমি তোমাকে লজ্জা দেবার জন্য বলিনি।আমি জানি তুমি সালামের শুদ্ধ উচ্চারণটা কি তা জানো।
রায়া চুপ।
একটু থেমে একটু মোহনীয় সুরে ডাকলাম , রায়া?
রায়া উৎসুক দৃষ্টিতে আমার দিকে তাকালো , জ্বি।
তোমাকে অনেক সুন্দর লাগছে।
লজ্জায় লাল হয়ে দৌড়ে পালালো রায়া।
আমি মুচকি হেসে ওর যাবার পথে চেয়ে রইলাম।
একটু দূর থেকে সবই আন্দাজ করে নিয়েছে অভি।তাই সে নিজে থেকেই বললো , কাজ হয়ে গেছে।
আমি মনে মনে খুব খুশি। কিন্তু সেটা প্রকাশ করলাম না। বললাম , হতে পারে , শিওর না।
খলায় গিয়ে দেখলাম এক পাশে ধান মাড়াই চলছে।আর এক পাশে চলছে খরের মলন।
খরের গাদার উপরে হুড়োহুড়িতে ব্যস্ত দুই মামার চার চারটে ছেলে মেয়ে।
খলার পাশেই বিরাট জায়গা জুড়ে পাকা করা। এখানেই ধান শুকানো হয়। তখন প্রায় সন্ধ্যেবেলা। তাই দেখলাম ধানের স্তুপ ত্রিপল দিয়ে ঢেকে রাখা হয়েছে।
চার
রাতে ঘুম আসছিলো না।বিছানায় শুয়ে এপাশ ওপাশ করছিলাম। চিন্তা করছিলাম কি করা যায়।হঠাৎ মাথায় একটা বুদ্ধি এলো।
আর তর সইছে না। কালই প্রপোজটা করে ফেলি। ব্যাপারটা অভির সাথে শেয়ার করলাম।
অভি সায় দিলো।
সকালে রিফাতের কাছ থেকে কলম আনিয়ে একটা চিরকুট লিখে ফেললাম।
"রায়া,তোমাকে আমার কিছু কথা বলার ছিলো। আজ বিকেল পাচটায় হিজল গাছটার কাছে। প্লিজ এসো। -শায়ন
অভিকে দিয়ে চিরকুট পাঠিয়ে দিলাম রায়ার কাছে।
ভেবে রেখেছিলাম চিরকুট দিয়ে এলেই অভিকে নিয়ে নিরুদ্দেশ হয়ে যাবো সারা দিনের জন্য। কিন্তু অভি ফিরতেই জানতে পারলাম রায়া চিঠি পড়েনি। টুকরো টুকরো করে ফেলে দিয়েছে।
তবুও নিরুদ্দেশ হয়েই রইলাম সারাদিন। ভেবেছিলাম চলে যাবো। অভি না করলো। বললো,
"সবকিছু এত তাড়াতাড়ি চিন্তা করা ভাল না। একটু সময় নাও , দেখো কি হয়।"
রয়ে গেলাম। বাসায় ফিরলাম সারাদিন পর। কাছাকাছি একটা পার্কে নামাজ পড়ে , খেয়ে ,ঘুরে ফিরে সময় কাটিয়েছি।
মামী আমাকেই শাসালেন বেশি।সতর্ক করে দিলেন আর যেন এমন না হয় ,আর যেন অনিয়ম না করি।
খেয়ে দেয়ে মাগরিবের নামাজ পড়ে ঘরে বসে আছি।
হঠাৎ উঠে বেরিয়ে গিয়ে সোজা রায়ার পড়ার ঘরে। এমনকি অভিকেও কিছু বলিনি।
রায়া পড়ছিল। আমি দরজা নক করে অনুমতি চাইলাম , রায়া আসবো ?
রাগত স্বরে রায়ার উত্তর , কেন ?
আমিতো অবাক।মনে মনে বললাম , বলে কি ? কেন মানে ?আমি কিছু না বলে ভেতরে ঢুকে পরলাম।
কাছে যেতেই রায়া চেচিয়ে বলে উঠলো , আপনি চলে যান।
কেন?
এমনি।
কারণ বলো।
কোন কারণ নেই। আপনি এ মুহুর্তে এখান থেকে চলে যান।
আমি আর কথা না বাড়িয়ে বের হয়ে গেলাম।
পরদিন সকালে নাস্তা সেরে বেরিয়ে যাবার সময় রায়ার সাথে আমার দেখা হয়েছিলো। দেখলাম চোখ দুটো লাল আর ফোলা। কিছু বলতে চাইনি। কিন্ত ওই অবস্থা দেখে কিছু না বলে পারলাম না।
"চোখ লাল হয়ে আছে কেন ? রাতে ঘুমাওনি ?"
"সেটা জেনে আপনি কি করবেন ? আপনিতো ভালই ঘুমিয়েছেন।" ওর বলা কথাটার এপ্রোচ খুব পজিটিভ মনে হয়েছে। আরো কিছু বলতে চেয়েছিলাম কিন্তু আমাকে আর কিছু বলার সুযোগ না দিয়ে চলে গেলো রায়া।
পাঁচ
মনটা ভীষণ খারাপ। ভেবেছিলাম কি,আর হলো কি ?প্রেম বুঝি এমনই!রায়া আমাকে অবিরাম হতাশাই উপহার দিয়ে যাচ্ছে।
ভাবছিলাম হোস্টেলে ফিরে যাবো। কিন্ত পরদিন আমার বাবা ,আমার একমাত্র খালামনি মানে অভির মা আর ছোট দুই ভাই বোন আসার কথা।তাই আর যাওয়া হলো না।
দিনটা কাটিয়ে দিলাম ক্রিকেট খেলে। বিকেলটা কেটেছে অস্থিরতায়।রায়াকে দেখতে ইচ্ছে হচ্ছিলো । জানতে চাচ্ছিলাম ও কেন এমন করছে?অস্থিরতায় বিলের জলের ধারে কিছু সময় হাঁটাহাঁটি করে ফিরে এলাম বাড়ি।মামী অভিকে কোন একটা কাজে কোথাও পাঠিয়েছে। সন্ধ্যায় মাগরিবের নামাজ পড়ে খাটে হেলান দিয়ে একটা বই পড়ছিলাম।
মনে মনে রায়ার কথা ভাবছিলাম।
মেঘ না চাইতেই বৃষ্টি। চেয়ে দেখি চা নাস্তা হাতে ঘরে ঢুকছে রায়া। টেবিলে নাস্তা রেখেই বেরিয়ে যাচ্ছিলো সে।আমি পিছু ডাকলাম।
সে দাড়ালো। বললাম, রায়া তুমি আমার সাথে এমন করছো কেন? আমি কি করেছি?
আপনি কিছু করেননি। আমিওতো কিছু করিনি।
আমি নিজের অজান্তেই রায়ার হাত ধরে ফেললাম।
রায়া তুমি আমার চিরকুট পাওনি?
উত্তর না দিয়ে রায়া হাত ছাড়িয়ে নিতে নিতে বলল ,ছাড়েন। কেউ দেখে ফেলবে।
এমন সময় জানালা দিয়ে কাজের লোকদের কেউ একজন দেখে ফেলে। আমি রায়ার হাত ছেড়ে দিলাম।সে ও খুব দ্রুত বেরিয়ে গেলো ঘর থেকে।
ছয়
পরদিন খালামনি আসলো।অভির ছোট বোন ছবি আর সবার ছোট ভাই জারিফ, ওরাও এলো।
আমার বাবা আসেনি। মামী ফোন দিয়েছিলেন। বলেছে, আসবে না। পরদিন আসলেও আসতে পারে ,নাও আসতে পারে।
মামাতো , খালাতো ভাইবোনেরা মহা আনন্দে হৈ-হুল্লোড় করে কাটাচ্ছে। গোল্লাছুট , দাড়িয়াবান্ধা কানামাছি ভো ভো এসব খেলায় মেতে আছে সারাটা দিন।
বড় মামী , ছোট মামী , খালামনি ব্যস্ত পিঠা পায়েস বানাতে।পুলি পিঠা , কুলি পিঠা , গোটা পিঠা ,তেলের পিঠা , তালের পিঠা ,চিতল পিঠা ইত্যাদি বাহারী পিঠার মেলা বসেছে রীতিমতো। ছেলে মেয়েরা গরম গরম পিঠা দৌড়ে দৌড়ে আনছে আর খাচ্ছে। এরই ফাকে খালামনি বাইরের বারান্দায় চেয়ারে বসে আমাকে কাছে ডেকে নিলেন। অভি আমার ডান পাশে আর খালার বাম পাশে এসে বসলো রায়া।
রায়া আমার দিকে আঁড়চোখে তাকাচ্ছে। আমিও।
খালা স্নেহভরা কন্ঠে বললেন ,শায়ন বাবা আমি তোর মায়ের মতো না ,আসিস না কেন বাসায় ?
আমিও খালামনির আবেগের মূল্য দিতে চাইলাম , মায়ের মতো কি তুমি তো আমার মা-ই। ক্লাস, পরীক্ষা , টেস্ট , মডেল টেস্ট , ফাইনাল আরো কত কি! সময় কোথায় বলোতো খালামনি ?তারপর খালামনি মাথায় হাতবুলিয়ে দিলেন। আরো কত গল্প!
এশার নামাজের পরে মাথাটা ঝিম ধরে আছে।
রায়া আসলে চাচ্ছেটা কি ? কখনো মনে হয় আমাকে চিনতেই পারছে না আবার কখনো কখনো ওর চাহনি ,খোচা মেরে কথা বলায় কেমন মায়া মায়া ভাব জাগে , ঠিক বুঝে উঠতে পারছিলাম না। কিছু একটা সুরাহা না হলে মনকে মানাতে পারছিলাম না। অস্থির হয়ে ঘরে ঢুকছিলাম আর বের হচ্ছিলাম। হঠাৎ রায়ার ঘরের সামনেই ওকে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে ইশারায় একটু আড়ালে বাড়ির বাইরে আসতে বললাম।
রায়া এলো।
আধো পূর্ণিমায় গাছগাছালির ফাঁকা বেয়ে হালকা আলো ঠিকরে পড়ছিলো। বাড়ির সামনে পিছনে লাগানো বাতির আবছা আলোর রেশও ওদিকটায় ছিল।
আমি ঘামছিলাম। সে-ও ইতস্তত করছিলো।
এখানে ডেকেছেন কেন ?
রায়া আমি সরাসরিই বলি।
অবশ্যই সরাসরি বলবেন।
রায়া।
জ্বি বলেন।
রায়া , আমি তোমাকে পছন্দ করি।
"রায়া একটু হাসলো , ও এই কথা।এটাতো বাড়িতেও বলতে পারতেন।আচ্ছা চলেন।"বলে যেতে শুরু করতেই আমি রায়ার হাত ধরে ফেললাম।
রায়া?
খুব স্বাভাবিকভাবেই বললো , আবার কি হলো?
তুমি কিছু বলবেনা ?
কি বলবো ?
তুমি আমাকে পছন্দ কর না ?
করিতো। হাত ছাড়েন।
ছাড়বো না।.....রায়া , আমাদের বয়স যদিও কম ,তথাপি বলে রাখছি, আমি তোমাকে সারা জীবনের জন্য পেতে চাই। বলতে বলতেই হাত ছাড়িয়ে নেবার জন্য একরকম জোরাজোরি শুরু করলো রায়া। একটা কিছুর শব্দ কানে এলো। রায়া জোর করেই হাত ছাড়িয়ে নিয়ে গেলো। যাবার আগে শুধু ফিসফিসিয়ে বললো , বাবা।
কিছু বুঝে উঠার আগেই পিঠে দুটো বেতের আঘাত।
"আমার চৌদ্দ গোস্টীর কাউকে এমন শিক্ষা দেইনি। বেয়াদব।"
মামার কন্ঠে আমি হতবিহ্বল হয়ে গেলাম। বসে পড়লাম ওখানেই। এ সময় সাধারণত তিনি বাড়ি থাকেন না। সাপ বিচ্ছুর আক্রমণ থেকে বাচার জন্য এ বেত তিনি সাথে রাখতেন। বিশেষ করে রাতে।
আমার চিৎকারে থেমে গেলো রায়া। পেছনে ফিরে আবার তিন চার কদম এগিয়েছিলো। কিন্তু রায়া তার বাবার গর্জনে থেম গেলো ,শয়তান হয়েছিস ? রাত বিরাতে বাড়ির বাইরে যাস ?
খালামনি আর অভি দৌড়ে এসে আমাকে ধরলো। পিঠে খুব জ্বালা করছিলো। আমি টি শার্ট তুলতেই অভি চেঁচিয়ে বলে উঠলো , মা ভাইয়ার পিঠে রক্ত।
খালামনি বললেন,বলিস কি? এমন করেই মারলো ! ভাইজান এটা কি করলো?
তারপর মামী রক্তপাতা নিয়ে এসে ছেঁচে আমার পিঠে লাগিয়ে দিতেই খানিক পরে রক্ত পড়া বন্ধ হলো।অভি ওয়ান টাইম ব্যান্ডেজ এনে লাগিয়ে দিলো। আমি ঘুমিয়ে পড়লাম।
সাত
রাত তখন সাড়ে দশটা।আমার প্রচন্ড শীত করছে।অভি পাশেই ছিল।ওকে ডেকে কাথা আনতে বললাম ।অভি আমার মাথায় হাত দিয়ে বলে উঠলো ,ভাইয়া তোমার তো জ্বর।অভি দৌড়ে গিয়ে খালামনিকে ডেকে আনলো। খালামনি মাথায় পানি ঢাললেন ।মুছে দিয়ে হাত বুলিয়ে দিলেন।
একটু পরে মামী এলেন।কোন কথা বললেন না।চুপচাপ মাথায় জলপট্টি দিলেন।ছোট মামী প্যারাসিটামল দিয়ে গেলেন।বড় মামী খাইয়ে দিয়ে চুপ করে ঘুমাতে বললেন। আমি চোখ বুজে রইলাম।
হালকা তন্দ্রায় চোখ বুজে এলো। কেউ একজন আমার চুলে বিলি কাটছে।নরম হাতের স্পর্শে চোখ মেলে তাকালাম। আমার দিকে মুখ করে খাটে পাশেই বসে আছে রায়া।
"রায়া তুমি" বলেই উঠতে যাবো এমন সময় আমাকে জোর করে শুইয়ে দিয়ে আমার হাত ধরে বললো,
আচ্ছা তুমি এতো বোকা কেন বলো তো ?
আমি অবাক হয়ে জানতে চাইলাম, কেন ?
মনে হলো রায়া তার জমানো কথা বলা শুরু করেছে , প্লিজ আমাকে বলতে দাও। শায়ন আমাকে চিরকুট দিয়ে হিজল গাছের ছায়ায় আসোনি তুমি।
আমি সারাদিন পাঁচটা বাজার অপেক্ষায় ছিলাম। আধাঘন্টা বসে থেকেছি হিজল গাছের ছায়ায়। তুমি এলে না। সেদিন তোমাকে ঘর থেকে বের করে দিয়ে আমি সারারাত ঘুমুতে পারিনি। এমন করে পাগল করলে কেন আমাকে ?
আমার চোখ বেয়ে অশ্রু ঝরছে। রায়া ওড়না দিয়ে মুছে দিয়ে বললো , আমি ছোট ফুফুকে সব বলে দিয়েছি। উনিই আমাকে নিয়ে এসছেন তোমার কাছে।
আমি বললাম , রায়া ভাল থেকো। আমি কাল ভোরেই চলে যাবো।
এবার রায়ার চোখের দু ফোটা জল গড়িয়ে পরলো আমার বুকে। আমি রায়ার চোখের জলে মুছে দিতে দিতে বললাম , প্লিজ রায়া কেঁদো না। রায়া ফুপিয়ে ফুপিয়ে কাঁদতে কাঁদতে বেরিয়ে গেলো।
আট
চার বছর পর......
আমি বুয়েট থেকে ইঞ্জিনিয়ারিং পাশ করে সবে একটা প্রাইভেট কোম্পানিতে জব স্টার্ট করেছি।
আবার মামা বাড়িতে নবান্নের দাওয়াত। মাঝের চার বছর আর আসিনি অভিমান করে।
আমি মোবাইল ফোন কিনেছি দু বছর হলো। অভি, বড় মামী, ছোট মামী আর খালামনির সাথে নিয়মিতই যোগাযোগ হতো। যোগাযোগ হয়নি শুধু রায়ার সাথে। মাঝে একবার মামীর ফোনেই কথা হয়েছিলো ওর সাথে। মামী কাছাকাছি ছিলেন না। সেদিন খুব ইমোশনাল হয়ে গিয়েছিলো রায়া। আমি শুধু বলেছিলাম , সবর করো। কারণ সবরে মেওয়া ফলে।
রায়া স্থানীয় আবুল হাশেম ডিগ্রি কলেজ থেকে ডিগ্রি ফাইনাল দিয়েছে। রেজাল্টের অপেক্ষায় দিন গুনছিলো। মেয়েরা অত দূরে গিয়ে অনার্স করবে, পর্দার খেলাপ হতে পারে।রায়াকে তাই ডিগ্রিই করতে হলো।
মোবাইল নিলে মেয়েরা নষ্ট হয়ে যায় তাই রায়াকে মোবাইল ফোনও কিনে দেয়া হয়নি।
আমি যখন এলাম তখন বিকেল গড়িয়ে প্রায় সন্ধ্যা।
অভি তখনো এসে পৌছেনি।
বাড়ির বাইরে থেকেই দেখলাম রায়া দাঁড়িয়ে আছে।
ভেতরে এসে দেখি রায়ার ঘরের দরজা বন্ধ। ধারণা করে নিলাম হয় লজ্জা পেয়েছে নয় অভিমান করেছে।
সবার খোজখবর নিয়ে মাগরিবের নামাজ পড়তে গেলাম।এসে সুরা ওয়াকিয়া পড়লাম।এটি সচ্ছলতার দোয়া।যে প্রতি রাতে এ সুরা পাঠ করবে তার অভাব থাকবে না।
রায়ার সাথে তখনো দেখা হয়নি। ওকে খুব দেখতে ইচ্ছে করছে। কতদিন দেখিনা। চলে গেলাম সোজা ওর রুমের সামনে। যেয়ে দেখি রায়ার রুমের দরজা বন্ধ। ডাকাডাকি শুনে পাশের ঘর থেকে মায়া বেরিয়ে এলো।
আমি অবাক হয়ে বললাম,আরে মায়া যে !তুমিও দেখছি কত বড় হয়ে গেছো ! রায়া কোথায় ?
ভাইয়া, আপু তো ঘরেই। খুলছে না কেন ? আপু... আপু..দ্যাখো কে এসেছে।
আচ্ছা, ঠিক আছে পরে দেখা করবো। বলেই চলে গেলাম।
রাতের ডিনার শেষ করে খাটে হেলান দিয়ে বই পরছিলাম। অভি আসেনি। ফোন দিয়ে জানলাম পরদিন খালামনিকে সাথে নিয়ে আসবে।
অপেক্ষায় ছিলাম রায়া আসবে। আসেনি। অপেক্ষা করতে করতে কখন যে ঘুমিয়ে গেছি মনে নেই।
পরদিন ভোরে ফজরের নামাজ আদায় করে হাঁটতে বের হলাম। ফেরার পথে বিলের ধারে পথ আগলে দাড়ালো রায়া। সে-ও ফজর পড়ে ভোরের হাওয়া গায়ে লাগাতে গিয়েছিল।
রায়া চুপ।
আমি জানতে চাইলাম ,কেমন আছো ?
ভাল। আপনি কেমন আছেন ?
তুমি কি আমার উপর রেগে আছো ?
মাথা নেড়ে সে জানালো ,না। আমি রাতে আপনার রুমে গিয়েছিলাম। আপনি ঘুমুচ্ছিলেন।
তাহলে তুমি থেকে আপনি তে গেলে কেন ?
একটা দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে রায়া বললো ,এতটা সময় তুমি না হয় থাকতে পেরেছো ,কিন্তু আমি থাকতে পারবো কিনা বা পেরেছি কিনা একবারের জন্যও জানতে চাইলে না। আমার যে কতটা কষ্ট হয়েছে সেটা কি জানো তুমি ?
রায়ার বলা শেষ হতেই আমি ,"আর কখনো আমার সামনে এসে দাঁড়াবে না" বলেই ওর গালে একটা চড় বসিয়ে দিয়ে আমি হেটে চলে গেলাম।
রায়া অবাক হয়ে গালে হাত দিয়ে পেছনে তাকাতেই দেখলো একটু দূরে ওর বাবা দাড়িয়ে।
নয়
আমি বাড়ি থেকে বেরিয়ে গেলাম। অভিকে ফোন দিয়ে সেই পার্কে আসতে বললাম। সব খুলে বললাম অভিকে। অভির পরামর্শে ওদের বাড়ি চলে গেলাম। যদিও সে খালামনিকে মামার বাড়ি রেখেই আমার সাথে দেখা করতে গিয়েছিল।
দুপুরে খেয়ে বিকেলে ঘুমিয়ে ছিলাম। বাবার ফোনে ঘুম ভাঙলো । আসরের নামাজ তখনও পড়া হয়নি।
বাবা মামা বাড়ি গেছেন কিছুক্ষণ আগে। আমাকেও যেতে বললেন। ফোন রেখে দেখি আরো কয়েকটা মিসড কল। খালামনি আর মামীর। আমি ভয়ে আর লজ্জায় ফোন ব্যাক করিনি।
মামা বাড়ি যাওয়ার সিদ্ধান্ত নিলাম।
মাগরিব পড়ে বের হলাম। আসতে আসতে এশার নামাজের সময় হয়ে গেলো।পথেই একটা মসজিদে জামাতের সাথে এশার নামাজ আদায় করে বাড়ির দিকে গেলাম।
বাড়িতে ঢুকেই কেমন উৎসব উৎসব আমেজ পেলাম।নাকে ভেসে আসলো রান্না করা গোস্ত পোলাও এর তীব্র সুগন্ধি। ছোট ছোট ছেলে মেয়েরা দৌড়াচ্ছে আর বলছে ,রায়া আপুর বিয়ে ,রায়া আপুর বিয়ে।
আমার মাথা চক্কর দিয়ে উঠলো,বলে কিরে অভি ?রায়ার বিয়ে মানে ? বলতে বলতেই খালামনি এসে আমাকে একরকম টেনে নিয়ে গেলেন ড্রয়িংরুমে।। বাবা, বড় মামা ,ছোট মামা ,খালু ,রায়াদের পাশের বাড়ির কাকা ,দুইজন হুজুর ড্রয়িং রুমে বসে গল্প করছেন।
আমি আবার অবাক হয়ে জানতে চাইলাম, খালামনি ব্যপার কি ?রায়াকে কোথায় বিয়ে দিচ্ছো ?
খালামনি মুচকি একটা হাসি দিয়ে বললো , আগে বস এখানে।
আমি সালাম দিয়ে বসে পড়লাম । খালু বড় মামাকে বললো , ভাইজান তাহলে শুরু করা যাক,নাকি ?
বড় মামা সম্মতি দিলেন।
হুজুর ,ছোট মামা , খালামনি বাইরে বেরিয়ে রায়ার রুমে ঢুকে একটু পর ফিরে এলেন।
খালু আমার হাতে হাত বেঁধে বসলেন।কাজী খালুকে বললেন , আমার সাথে সাথে বলুন। এবার কাজী হুজুর উচ্চস্বরে বলতে শুরু করলেন ,আমার ওকালতিতে জনাব আকবর আলীর প্রথমা কন্যা রেহনুমা আরজুমান্দ ওরফে রায়ার সাথে দুই লক্ষ পঞ্চাশ হাজার টাকা দেনমোহর ধার্য করিয়া জনাব মনসুর আহমেদ এর একমাত্র পুত্র সাব্বির আহমেদ ওরফে শায়নের বিবাহ দিলাম।
আমার নাম শোনার পর আত্নায় শান্তি পেলাম। মনে হলো অনেক বড় একটা পাথর নেমে গেলো বুক থেকে।
কবুল বলতে আর এক মূহুর্ত দেরি করিনি।কাজী হুজুর যা যা বলেছেন,মুখস্থ বলে দিয়েছি। আলহামদুলিল্লাহ। দেন মোহরের পুরো টাকাটাই আমার পকেটে গুজে দিলেন বাবা।
খালামনি আমাকে খুব সুন্দর একটা পাঞ্জাবি পায়জামা আর পাগড়ি পরিয়ে আমাকে বাসর ঘরে ঢুকিয়ে দিলেন।
বাসর ঘরটা এত সুন্দর করে সাজানো হয়েছে যা বলার মতো নয়। আয়োজন বলতে এই বাসর ঘর সাজানোই।
আমি ভেতরে ঢুকেই দেখি লাল টুকটুকে শাড়ী পড়ে মাথায় ইয়া বড় একটা ঘোমটা টেনে বসে আছে রায়া।
রায়া সালাম দিলো।
আমি উত্তর দিয়ে দুই রাকাত নামাজ পড়লাম।বিয়ের দোয়া পড়ে রায়ার কপালে চুমু খেলাম।পাঞ্জাবিরর ডান পকেট থেকে দেন মোহরের টাকা আর বাম পকেট থেকে গিফট হিসেবে একটা এন্ড্রয়েড সেট রায়ার হাতে তুলে দিলাম। তারপর রায়াকে বুকে নিয়ে জনম জনমের দুঃখ ভুলে শান্তির পরশ পেলাম।
দশ
সিনেম্যাটিক কাহিনীকে হার মানিয়ে যাকে কাছে পেলাম তাকে এত তাড়াতাড়ি এভাবে হারিয়ে ফেলবো ঘুর্নাক্ষরেও কোনদিন কল্পনা করিনি।
বিয়ের বছর খানেকের মাথায় রায়ার পেটে আমাদের প্রথম সন্তান এলো।
ছয় মাস ধরে ওর বাবার বাড়ি। আদর যত্নের এতটুকু কমতি নেই।
আমি তখন অফিসের কাজে চট্রগ্রাম। আমার শ্বাশুড়ি তার এক পরিচিত দাইমা কে বলে রেখেছেন।তার কথা হলো আমাদের বংশের সবাই এই দাইমার হাত ধরেই নরমাল ডেলিভারিতে জন্ম নিয়েছে। আমার শ্বশুর,ডাক্তার- সিজার এসবের পক্ষে নন।তার কথা হলো,সিজারে পর্দার খেলাপ হয় ,সিজারের সন্তান সুস্থ হয়না,সমস্যা থাকে।
আমি অনেক বুঝিয়ে রাজি করালেও তারা বলে রেখেছেন আগে চেষ্টা করবেন। কাজ না হলে ডাক্তারের কাছে নেবেন।
নির্ধারিত তারিখের বাইশ দিন আগেই ব্যাথা শুরু হলে অনাকাঙ্ক্ষিত ভাবে আমি তখন রায়ার কাছে ছিলাম না।
অল্পতেই প্রেসার বেড়ে যেতো ওর।ব্যাথায় অসহ্য হয়ে ও নিজেই আমাকে ফোন দিলে আমি সব ক্যান্সেল করে ছুটে এলাম।
কিন্তু ততক্ষণে বড্ড দেরি করে ফেলায় রায়াকে আর বাঁচানো যায়নি।
আমি এসে দেখি ফুটফুটে একটা ছেলে বাবু মা হারানোর বেদনায় অবিরাম কেঁদে চলেছে।
ওর নাম রেখেছি রাইয়ান।ছোট ছোট বাচ্চাদের জান্নাতের নাম রাইয়ান।
রাইয়ানকে দেখবে কে ?
"আল্লাহ দেখবে।"বলে আমার কোল থেকে চার দিনের রাইয়ানকে নিয়ে গেলো মায়া। আমার শ্যালিকা।
মামা মামী আমাকে নিজেদের সন্তানের চাইতে বেশি ভালবাসতো তাই তারা চাননি আমি পর হয়ে যাই। তাই রায়ার ছোট বোন মায়াকে আমার হাতে তুলে দিয়েছিলেন। সেই মায়াই এখন রাইয়ানের মা।
আমার পাওয়া আর হারানোর গল্পের শ্রোতা আমার প্রাইমারীর বন্ধু অয়ন। বিশ বছর পর ওর সাথে দেখা।
অয়ন,আমার রায়াকে পাওয়ার গল্পে যেমনি মুগ্ধ। ওকে হারানোর গল্পেও তেমনি বাকরুদ্ধ।
অয়নের চোখে জল।পাশের ঘরে মায়ার চোখেও হয়তো।
অয়ন আমাকে জড়িয়ে ধরলো। এবার আমি হাউমাউ করে কাঁদতে শুরু করলাম। অয়নকে বললাম ,বন্ধু এক নবান্নে রায়ার প্রেমে মুগ্ধ হলাম, আরেক নবান্নে বিয়ে পরের নবান্নে রাইয়ান কে তুলে আনলাম। হায় !! জীবনটাই বুঝি এমন ! রবীন্দ্রনাথের ভাষায় বলতে হয় ,যে জীবন তরী বেয়ে রায়া সোনার ফসল রাইয়ানকে ঘরে তুলে আনলো সেই তরীতে তারই ঠাই হলো না।