গো-বৎস

অসহায়ত্ব (আগষ্ট ২০১৪)

আরমান হায়দার
  • ১৪
আজকাল মোবাইল ফোন হওয়াতে কতই না সুবিধা। এই ঈদে বাড়ি যাওয়া হয় কি না সন্দেহ - এ কথা জানাতেই সাদেকার মা বুঝে গেলেন তার মেয়ের এবার ঈদে বাড়ি ফেরা হচ্ছেনা। গাজীপুরে যে গার্মেন্টসে কাজ করে তার মালিক নাকি তিন মাসের বেতন বাকি রেখে এখন ঈদের আগে উধাও হয়ে গেছে। গার্মেন্টসের সব শ্রমিক রাস্তা বন্ধ করে দিয়ে কারখানার সামনে বিক্ষোভ করছে। বেতন না দিলে ওরা নাকি ঈদের দিনও রাস্তায় দাঁড়িয়ে থাকবে। মেয়ের এই বিপদের কথা শুনেই মা মোবাইলে সাথে সাথে সান্তুনা দিয়ে বলেছে, তোর এত চিন্তা করার দরকার নাই। গাড়ী ধরে চলে আয় , বাড়ির খরচের জন্য চিন্তা করিস না। দরকার হলে লালুকে বেচে দিবে। তা দিয়ে দু’এক মাস চলবে, চিন্তা থাকবে না। পড়ে বেতন দিলে দিবে না দিলে আর কি করা। তুই বাড়ি চলে আয়।’

সাদেকা মোবাইলে কথা বলতে বলতেই বাসন -ভোগড়া সড়ক ধরে সহকর্মীদের সাথে হাঁটতে হাঁটতে কারখানার দিকে এগিয়ে যাচ্ছিলো। লালুর কথা মনে পড়ে যায় তার। বছর তিন চার হবে, যখন সাদেকা গার্মেন্টসে কাজ করতে আসেনি তখন বাড়িতে লালুকে নিয়ে এক ঘটনা ঘটে। সবে লালু জন্মেছে। গাভী দুইয়ে যে এভাবে দুধ নিয়ে যায় সেটা এই পৃথিবীতে সাদেকা প্রথম ভালভাবে লক্ষ্য করলো। সেদিন পড়ন্ত বিকেলে গাভীটি যখন লালুকে দুধ খাওয়ানোর জন্য হাম্বা হাম্বা করে ডাকতে থাকে, মা বললেন যা বাইরের উঠোনে যা, গরু দোহাতে আসবে এখন, দেখগে। সাদেকা উঠোনে গিয়ে দেখে লালুকে দুরে আমগাছের সাথে বেঁধে রাখা হয়েছে। মায়ের ডাক শুনে লেজ নাড়াচ্ছে লালু। পেটটা একে বারে পিঠের সাথে লেগে গেছে। সাদেকা দুর থেকে দেখে ভাবে যাক! এখন লালু পেট পুড়ে দুধ খেতে পারবে। সাদেকা এগিয়ে গিয়ে লালুর গলার রশিটি খুলে দিতেই লালু দৌড়ে গেল মা গাভীটির কাছে। কিন্তু দুধে মুখ লাগাতে না লাগাতেই পাশের বাড়ি থেকে মজিদ মোল্লা গলা খাকারি দিয়ে বলে উঠলো ,’আহা করে কি ? করে কি? কে করলো এই কাজ। ”

এদিকে মজিদ মোল্লা গলার আওয়াজ শুনেই লুকিয়ে পালিয়ে গেল সাদেকা। তবে একদম পালালো না । একটু দুর থেকে সে লুকিয়ে দেখতে লাগলো সেই দুধ দোহনের দৃশ্য। বাছুর টাকে গলায় গামছা দিয়ে টেনে নিয়ে এলো গাভীর ওলানের কাছ থেকে। তারপর শক্ত করে বাঁধলো গাভীর পিছনের দু’পায়ের সাথে। বাছুর লালু বার কয়েক মাথা দিয়ে গুঁতো মারলো। গলা এদিক ওদিক করে মায়ের দুধে মুখ লাগানোর চেষ্টা করলো। গাভীটি করুন দৃষ্টিতে দেখলো লালুর এসব বৃথা চেষ্টার দৃশ্য । মজিদ মোল্লা দুধ দুইয়ে চললো। শো শো শব্দ হতে লাগলো। এক সময় ভরে উঠলো দুধের বালতি । সফেদ ফেনা থেকে ভেসে আসা গন্ধ বোধ হয় নাকে এসে লাগলো লালুর। লালু, গোবৎসটা বার কয়েক গুঁতো দিয়ে আবারো বৃথা চেষ্টার জানান দিল। দুধ যখন ওলান থেকে বের হওয়া বন্ধ হল তখন দুধের বালতিটা তুলে নিয়ে মজিদ মোল্লা বাছুরের গলার গামছাটা খুলে দিলো। লালু এবার যেন হামলে পড়লো তার মায়ের দুধের বাটে। গাভীটি আর একবার করুন দৃষ্টিতে তাকালো গোবৎসের দিকে।

এদিকে সাদেকা এসে তার মাকে জিজ্ঞেস করলো, ‘মা গরুর দুধ দোহনের সময় বাছুরকে ওমন করে গামছা দিয়ে বেধে রাখলো কেন?’
মা বললেন, ! তা না হলে বাছুরই তো সব দুধ খেয়ে ফেলবে ,মজিদ মোল্লা দুধ পাবে কোথায়। সে দুধ দুইয়ে নিবে , আমরা গাভী আর বাছুরটাকে খাওয়াবো। পেলে পুষে , দেখে শুনে রাখবো । বিনিময়ে বাছুরটা পাব , লালুকে আমরা পাব। এই শর্তেই তো গরুটাকে আমাদের দিয়েছে মজিদ সাহেব। ’

এই সেই লালু যার কথা মা একটু আগে মোবাইল ফোনে বলছিলো। কিন্তু এই লালুকে তো কোরবানির ঈদের সময় বিক্রি করার কথা। কোরবানির সময় যাতে ভাল দাম পাওয়া যায় এজন্য ইনজেকশন দিয়ে মোটা তাজা করা হচ্ছিলো, গতবার বাড়ি থেকে আসার সময় এমনি তো দেখে এসেছে সাদেকা। এখন রোজার ঈদের সময় বিক্রি করলে তো বেশী দাম পাওয়া যাবে না। সাদেকা আবার ফোন করলো তার মাকে।ু লালুকে বিক্রি করার দরকার নাই, মা। দেখি যদি শেষ পর্যন্ত বেতন পাই তা হলে আর এখন লালুকে বিক্রি করতে হবে না। লালুকে এখন বিক্রি করার দরকার কি। আর একটু দেখি। ” বলেই আবার মোবাইল বন্ধ করার আগেই সে তার গার্মেন্টস কারখানার সামনে এসে দাঁড়িয়েছে। বৃষ্টির পানিতে চ্যাপচ্যপে কাদায় বাসন সড়কে তখন গার্মেন্টস শ্রমিকে, ঈদের বাজার করতে যাওয়া স্থানীয় লোকদের জটলায় , রিক্সা-টেম্পুর গাদাগাদিতে এক প্রাণান্তকর অবস্থা। এমন সময় সামনে পটকা ফুটানোর শব্দ পাওয়া গেল , কোথা থেকে যেন পুলিশ এসে হাজির। লাঠিপেটা শুরু হল। এদিক সেদিক দৌড়াদৌড়ি। মাইকে ঘোষণা করতে থাকলো আপনারা বেতনের জন্য এমন জটলা করলে , কারখানা বন্ধ করে দেওয়া ছাড়া কোন পথ থাকবে না। তখন বেতন তো দুরের কথা চাকুরীও থাকবে না। কিন্তু তারপরও শ্রমিকরা আবার জড়ো হতে লাগলো। মালিকের লোকজনও এসেছে বলে শোনা যাচ্ছে ,কিন্তু বেতন দেওয়ার কোন লক্ষণ দেখা গেল না। ধীরে ধীরে জটলা আরো বড় হতে লাগলো । চাঁদ রাতের কেনাকাটা করে বাসন ভোগরা সড়ক দিয়ে কত লোক ফিরে গেল। ফিরলো না শুধু সাদেকারা। সব শ্রমিক রাস্তায় দাড়িয়ে থাকতে থাকতে একে একে বসে পড়লো। এক সময় রাত পোহালো ঈদের দিনের সকাল এলো। অনেক মানুষ নতুন জামা কাপড় পড়ে ঈদগাহে যাচ্ছে আর জটলার শ্রমিকদের দিকে তাকাচ্ছে। রাস্তা পাশের চায়ের দোকানে চলতে থাকা টেলিভিশনের পর্দায় আনন্দ উদ্দীপনার সাথে ঈদ উদযাপনের খবর হচ্ছে । অন্যান্য শ্রমিকের মত সাদেকাও সেই টেলিভিশনের দিকে তাকিয়ে সারা রাত দাড়িয়ে থাকার ক্লান্তি দুর করার চেষ্টা করলো। হঠাৎ আবার মোবাইল বেজে উঠলো। সাদেকা দেখলো তার মায়ের ফোন। ফোনটা কেটে দিল সাদেকা। কারণ, সে জানে মা কি বলবেন। বলবেন , ‘ লালুকে , বাছুরটাকে বিক্রি করে দেব। তুই বাড়ি ফিরে আয়।” এসব শুনতে এখন তার ভাল লাগছে না সাদেকা’র। সারা রাজ্যের ক্লান্তি এসে ভর করেছে তার চোখে। লালুর ছবিটা ভেসে উঠছে তার সামনে । সাদেকার মনে হল তারা শ্রমিকরা সবাই যেন একেকটা লালু, একেকটা বাছুর। সেই কয়েক বছর আগে দেখা গলায় গামছা বাঁধা লালুকে তার মনে পড়ছে। গলার রশিটা খুলে দিতেই মায়ের দুধ খাওয়ার জন্য যেমন দৌড়েছিল সেদিন লালু । হ্যাঁ ঠিক সেভাবেই যেন অনেক লালু , অনেক বাছুর , অনেক গোবৎস সার বেঁধে এদিকেই ছুটে আসছে। তারপর মিশে যাচ্ছে সাদেকাদের এই জটলার মধ্যে। ক্রমশ দীর্ঘ থেকে দীর্ঘতর হচ্ছে গার্মেন্টস শ্রমিকদের লাইন।
আপনার ভালো লাগা ও মন্দ লাগা জানিয়ে লেখককে অনুপ্রানিত করুন
মোহাম্মদ ওয়াহিদ হুসাইন দারুণ লিখেছেন! শুধু শ্রমিকরা ন্য, ক্ষমতাবানদের বলয়ের বাইরে যারা তারা সবাই...। শুভেচ্ছা রইল।
নেমেসিস শ্রমিকরা সবাই যেন একেকটা লালু, একেকটা বাছুর। সেই কয়েক বছর আগে দেখা গলায় গামছা বাঁধা লালুকে তার মনে পড়ছে।--খুব ভালো লাগল। হৃদয় ছুঁয়ে গেল।
সুখেন্দু মল্লিক বাহ খুব ভালো লাগলো
মাইদুল আলম সিদ্দিকী অসাধারণ লিখেছেন শ্রদ্ধাভাজন।
শামীম খান স্নায়ুর ভেতর জমাট হাহাকার ঢুকিয়ে দিলেন । অসাধারন গল্প । ভাল লাগা আর ভোট রইল ।
সরি , এটি ভোটের জন্য নয় আগে খেয়াল করি নি ।
এশরার লতিফ চমৎকার গল্প। খুব ভালো লাগলো।
মোজাম্মেল কবির বিষয়ে আমার লেখার সাথে সাদৃশ্য পাওয়া যাচ্ছে। লেখা ভালো লেগেছে। শুভ কামনা রইলো।
আখতারুজ্জামান সোহাগ পেশাগত জীবনে আমি একজন টেক্সটাইল ইঞ্জিনিয়ার। তাই টেক্সটাইল সেক্টরটাকে নিজের সেক্টর মনে করি। লালুদের সাথে সাদেকাদের সাদৃশ্য, এক কথায় রূপকাশ্রয়ী গল্পটি বললো আমার সেই কর্মজগতের কথা। মন ছুঁয়ে গেল আপনার গল্প। তোবা গার্মেন্টের আন্দোলনরত শ্রমিকদের কথাও মনে পড়ছিল আপনার গল্প পড়তে পড়তে। ভালো থাকবেন লেখক।
Thank you for reading this story. Some times I cann't write in Bengali from my site / net. Sorry for this.
সাদিয়া সুলতানা বিরতির পর ফিরে আসাটা বেশ হলো। শুভকামনা ও শ্রদ্ধা জানবেন। ভোটিং বন্ধ রাখাটা কষ্ট দিল।
এস, এম, ইমদাদুল ইসলাম মজিদ মোল্লাদের দুধের বালতির সাথে পুজিবাদি সভ্যতায় তথা কথিত বৃহত্তর অর্থনৈতিক কর্মকান্ড জড়িত । সুতরাং বাছুরকে তো মূল্য দিতেই হবে , যেমন মূল্য দিচ্ছি আমরা শ্রমিক, কৃষক , মেহনতি মানুষেরা --- আপনার এ অসাধারণ সৃষ্টি !! মুগ্ধ হলাম । অনেক ধন্যবাদ । অনেকদিন পরে আপনার সাথে আমার মোলাকাত হল ।
Thanks for reading this story and making a valuable comment.

২৩ জানুয়ারী - ২০১২ গল্প/কবিতা: ১৬ টি

বিজ্ঞপ্তি

এই লেখাটি গল্পকবিতা কর্তৃপক্ষের আংশিক অথবা কোন সম্পাদনা ছাড়াই প্রকাশিত এবং গল্পকবিতা কর্তৃপক্ষ এই লেখার বিষয়বস্তু, মন্তব্য অথবা পরিণতির ব্যাপারে দায়ী থাকবে না। লেখকই সব দায়ভার বহন করতে বাধ্য থাকবে।

প্রতি মাসেই পুরস্কার

বিচারক ও পাঠকদের ভোটে সেরা ৩টি গল্প ও ৩টি কবিতা পুরস্কার পাবে।

লেখা প্রতিযোগিতায় আপনিও লিখুন

  • প্রথম পুরস্কার ১৫০০ টাকার প্রাইজ বন্ড এবং সনদপত্র।
  • দ্বিতীয় পুরস্কার ১০০০ টাকার প্রাইজ বন্ড এবং সনদপত্র।
  • তৃতীয় পুরস্কার সনদপত্র।

বিজ্ঞপ্তি

“মে ২০২৪” সংখ্যার জন্য গল্প/কবিতা প্রদানের সময় শেষ। আপনাদের পাঠানো গল্প/কবিতা গুলো রিভিউ হচ্ছে। ১ মে, ২০২৪ থেকে গল্প/কবিতা গুলো ভোটের জন্য উন্মুক্ত করা হবে এবং আগামি সংখ্যার বিষয় জানিয়ে দেয়া হবে।

প্রতিযোগিতার নিয়মাবলী