" মানুষের হৃদয়ে কোনটি সবচেয়ে বেশী গেঁথে থাকে ? গান, দুঃখ- বেদনা, অর্থসম্পদ ? এগুলির কোনটিই নয়। অন্তত আমার ক্ষেত্রে কখনোই তা ঘটেনি। একজোড়া চোখ প্রায়শই আমার মনে পড়ে। একবার, কখন , কবে, মনে নেই। এক বিশাল তেঁতুল তলায় একজোড়া চোখ আমার দিকে তাকিয়েছিল। কেন তাকিয়েছিল, কী বলতে চেয়েছিল, আমি জানিনা। সে অনেক অনেকদিন আগের কথা। তারপর সেই আঙ্গুরিকে আমি আর কোনদিনই দেখিনি। সে এখন কোথায়? নেই। কিন্তু সেই চোখ, একজোড়া কাজল কালো চোখের ইশারা রয়ে গেছে। কোথায় রয়ে গেছে ? চোখের দৃষ্টি কোথায় জমা থাকে ? হৃদয়ে। হৃদয়ে তো রক্তের ঝংকার থাকে। তবে কি আঙ্গুরির চোখের ঝিলিক আমার রক্তে মিশে গেছে ? থাকতেও পারে। মাঝে মাঝে হৃৎপিন্ডে ধকধক করে শব্দ হলে ঐ চোখ মনে পড়ে যায়।
আমি একরাতে বর্শা হাতে বর্ষায় নৌকায় চেপে একটি বড় টর্চলাইট নিয়ে ধানের ক্ষেতে মাছ শিকারে গিয়ে এক বিশালাকার মাছের চোখ দেখে চমকে উঠি। এক চরম মুহূর্তে, পরম সত্যক্ষণে দেখা হলে মানুষ যেমন তাকায়, আমাকে দেখে সেভাবে তাকিয়ে রইলো মাছটি। আমি একদৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকি, এতো আঙ্গুরির চোখ, বর্শা না ছুড়েই ফিরে আসি।
কোরবানীর পশুর বাঁচার আকুতি ভরা চোখের যে চাহনী , হাসপাতালের বেডে মৃতু্য পথ যাত্রীর চোখ, ঢেউ খেলানো নদীতে ভাসমান খরশোলার ঠিকরে বের হওয়া চোখ , এমনকি আমার কাজের মেয়েকে প্রথম দিন দুটো চড় দেয়ার সময় সে পৃথিবীকে যে চোখে দেখে _ সেই সব চোখের তাকানো, চোখের ভাষা একেবারেই এক। আমি পৃথিবীর পথে যতবার যত মাছ রাঙ্গা , ঘুঘু , বিড়াল , ঘাসফড়িং, সূর্য মুখী দেখেছি,সবার একই চোখ। পৃথিবীকে তারা সবাই দেখে অপার বিস্ময়ে ,কৌতুহল নিয়ে মায়াজালে। সব চোখই মানুষকে খোঁজে পার্থিব আলোয়। আমি যতবার ভিন্ন চোখ খুঁজি , প্রতিবারই অতি পুরোনো তেঁতুলতলায় দেখা সেই আঙ্গুরীর চোখ দেখি।"এক শীতের পাতাঝরা সন্ধ্যায় আমার মৃতু্যপথযাত্রী স্ত্রী চোখ সম্পর্কে আমার কাছে জানতে চাইলে আমি বলি ,
_' জানো অনন্যা ! এই আমার চোখ দেখার অভিজ্ঞতা।'
_' তা' হলে আমার চোখের দিকে এত তাকিয়ে থাকো কেন ? আমি যখন জানালায় চোখ রাখি অথবা অন্য কাজে থাকি তখন আড়চোখের চাহনী দেখি, তুমি আমার চোখের দিকে তাকিয়ে আছো । কেন?'
_' কারন এই দ্বিতীয়বারে মত আমি এক ব্যতিক্রম চোখের চাহনি দেখেছি।'
_' আর কবে দেখেছিলে ?'
_' এক বৃদ্ধার চোখে আমি জানতাম না সে অন্ধ। পরে শুনেছি সে দেখতে পায় না। '
_' কিন্তু আমি তো দেখতে পাই , সব দেখি। '
_' হ্যাঁ এজন্যই তো তোমার নাম রেখেছি অনন্যা। পৃথিবীতে কিছু মানুষ আছে যাদের চোখের তারায় এমন ছবির প্রতিফলন থাকে যেখানে ভবিষ্যৎ ভেসে ওঠে। তুমি সেই অসাধারনদের একজন। এবার সত্যি করে বলোতো অনন্যা ! তোমার চোখের তারায় আমার ভবিষ্যত দেখ কিনা ?
_'ভবিষ্যৎ কেউ জানে না, দেখতেও পারে না। শুধু অাঁচ করতে পারে মাত্র।''
_' আমার ধারনা তুমি শুধু অনুমানই করতে পারো না,ভবিষ্যৎ দেখতেও পাও।'
আমার কথা শুনে অনন্যা হাসে । এক অদ্ভুত অস্বাভাবিক হাসিতে উচ্চকিত হয়ে ওঠে হাসপাতালের কেবিন। এক সময়ে এ হাসির শব্দ ছড়িয়ে পড়ে সমস্ত করিডোরে বাতাসে বাতাসে। তার পর হাসি থামিয়ে শান্ত স্বরে বলে যায়,
_' তুমি কি এই হাসপাতালে আমাকে মেরে ফেলতে চাওনি ?'
ওর কথায় আমি চমকে উঠি ; বলি,
_' হাসপাতালে এত লোকের সামনে তোমাকে মেরে ফেলবো কিভাবে ?'
_ ' মেরে ফেলতে হয়তো চাওনি কিন্তু এটাতো চেয়েছিলে আমি মরে যাই। '
_'কারো চাওয়া না চাওয়ার উপর একজনের জীবন-মৃতু্য নির্ভর করে না।'
_'তুমি সরাসরি হঁ্যা বা না উত্তর দাও। তুমি কি চেয়েছিলে আমি বেঁচে থাকি।'
_'সব প্রশ্নের উত্তর বা না তে হয় না।
_'কেন নয় ? '
_' কারন এতে সব সত্য সব সময় প্রকাশ পায় না।
আমার কথা শুনে অনেকক্ষন চুপ থাকে অনন্যা। তারপর বলতে থাকে ,
_' জানো ! তোমার মত আমার মাও আমাকে ভয় পেতেন। তার ধারনা ছিল ,আমার জন্মের পর আমার মুখ দেখামাত্রই আমার বাবা মারা গেছেন। '
_' যদি বলি মুখ দেখে নয় , চোখ দেখে'
_' মুখ আর চোখের মধ্যে পার্থক্য করে কি আসে-যায়। '
_' কারন আমি তোমার চোখকেই সন্দেহ করি ; মুখকে নয়।'
_' কেন , আমার চোখ কেমন ?'
_' মৃত।'
_' আর তোমার চোখ ?'
_' জানি না। '
_' তোমার চোখ আঙ্গুরীর মত । কারন তুমি আঙ্গুরীকে ভালবাস।'
_' অসম্ভব।'
_' তুমি অবশ্যই তাকে ভালবাস। '
_'আমার স্মৃতি তা বলে না।'
_' তুমি আঙ্গুরীকে চেনো , ভালবাস। তোমাদের বিয়ে হয়েছিল। '
_' অনন্যার কথা শুনে এবার হাসি পায় আমার । জিজ্ঞেস করি,
_'কোথায় আমাদের বিয়ে হয়েছিল ?'
_'আত্মার রাজ্যে।'
_'সে খবর আমি জানি না।'
_'কিন্তু হয়েছিল। তোমার অবচেতন মনে রয়েছে আঙ্গুরী। তাই তার চোখ তুমি দেখ অহর্নিশ মানুষে, গাছে, পানিতে, ঝড়োবাতাসে ভেসে বেড়ানো শুকনো পাতায়।'
_' কিন্তু ঘটনা যদি সত্যিও হয় ; তা তুমি জানো কিভাবে ?'
_'কারন, আমি আঙ্গুরীর প্রেতাত্মা। সে জীবিত নেই। '
_' সেটা কিভাবে সম্ভব ?'
_' তার উত্তর তুমি নিজেই দিয়েছো ।'
_' কখন ? কিভাবে ?'
_' বলেছো আমার চোখ মৃত,অনন্যার চোখ মৃত। '
_' তা' হলে তুমি আঙ্গুরীর চোখ নিয়ে আসতে !'
_' এটা আঙ্গুরীরই চোখ। মৃত বলে তুমি চিনতে পারছো না।'
_' বলছো আঙ্গুরী মৃত, আবার তার মৃত চোখ নিয়েই তুমি আমার ঘরে , কেন ?
_' এটা তোমার নিয়তি ?'
_' আর তোমার নিয়তি ?'
_' এই হাসপাতালে থাকা।'
_' তারপর ?
_' হযতো সুস্থ হব ,নয়তো নয় ।'
_' তা' হলে অনন্যা হয়ে এই স্বল্প সময়ের জন্য তোমার আসার দরকার কি ছিল ?'
_' তোমাকে জানানোর জন্য।'
_' লাভ কি?'
_' ক্ষতিই বা কি। একটি নতুন বিষয়ে অভিজ্ঞতা হল । '
_' এটা কেউ বিশ্বাস করবে না।'
_' তার পরও আত্মার জগতে মানুষের জোড় বাঁধার বিষয়াটি তোমার জানা থাকলো।'
_' ডাক্তার বলেছেন , তুমি সুস্থ হয়ে উঠছো।' প্রসঙ্গ পাল্টাবার জন্য আমি বলি । কিন্তু অনন্যা আবার সেই প্রসংগেই ফিরে আসে ; বলে,
_'এতে তোমার লাভ নেই , দেরী হয়ে যাবে।
_' কিসের দেরী ?
-' তোমাকে আরো দীর্ঘ পথ পাড়ি দিতে হবে। জানতে হবে অনেক। কেন পৃথিবীর সব চোখের দৃষ্টি এক হয় , জানো ? কারন সবচোখেই ভর করে পৃথিবীর মায়া।'
_' তোমার কি মায়া নেই ?'
_' আমি অনেক উপর থেকে দেখি। আমার চোখের আলোয় ধুষর পৃথিবী। এখানে মানুষের জীবনের যা কিছু , সবই তার অজ্ঞতার ফসল '
_' সব মানুষই অজ্ঞ ?'
_' সবাই । অজ্ঞতাই মানুষের নিত্যসঙ্গী। এ অজ্ঞতা নিজেকে জানার অজ্ঞতা। মানুষ নিজেই জানে না সে কে। তাই তার চোখে ভ্রমের দৃষ্টি ,মায়ার ছোয়া, অসহায়ত্বের চাহনী। তুমি সেই অজ্ঞ দৃষ্টিই দেখেছো আঙ্গুরীর চোখের ইশারায়।'
_' তোমার কথা কঠিন ঠেকছে। '
_' সহজ মনে হবে যদি নিজেকে চিনতে পারো। তুমি নিজেকে জানার চেষ্টা যদি না কর ,তবে কঠিন লাগবেই । নিজের অস্তিত্ত নিজেকেই খুঁজে নিতে হয়। প্রত্যেকটি মানুষকে পৃথক ভাবে খুঁজে বের করতে হবে তার আত্ম পরিচয়। '
_'তা হলে বলোতো আমি কে ?'
_' তুমি এক দুর্ধর্ষ আত্মা। তোমাকে পৃথিবীতে পাঠাবার আগেই জাগতিক জীবনের চিত্র দেখানো হয়েছে। পার্থিব জীবন বেছে নিতে তোমাকে বাধ্য করা হয়নি। পৃথিবীতে এলে সব স্মৃতি ভুলে যাবে, তাও তোমাকে বলা হয়েছে। তুমি বললে নেব। সব মানুষই বললো এ জীবন নেব। পৃথিবীতে এসে সব ভুলে গেল সবাই , অথচ তাদের সব অঙ্গীকার নামা অবিকল রয়ে গেছে আত্মার জগতে। তুমি এদেরই একজন।
-' কিন্তু তুমি যে ঠিক বলছো ,তার প্রমান কি?
-'আমার চোখ। কারন আমার এই মৃত চোখের কোন ব্যাখ্যা তুমি দিতে পারবে না। পারবে কি? বল।'
_যদি বলি তোমার চোখ অস্বাভাবিক , রোগাক্রান্ত।
_' তাতে সত্যিটি মিথ্যে হয়ে গেল না। আমি আবারও বলছি স্বাভাবিক চোখ মায়া ছাড়া কিছুই নির্দেশ করে না। মৃত চোখ মায়ার বন্ধন ছিড়ে চলে যায়।
_' যদি বলি তোমার সমস্যা মস্তিস্কে।'
_' তাতেও এ চোখে দেখা সত্য মিথ্যা হয় না। আর মস্তিস্কের স্নায়ু ,নিউরন গুলো কেবল জীবিত চোখেই সিগন্যাল দিতে পারে ; মৃত-পাথর চোখে নয়। '
_' অনন্যা অনেক হয়েছে। আমরা বোধ হয় এ আলাপ থামাতে পারি। '
_' এটা তখনই থামবে যখন আমার চোখে আসবে স্বাভাবিক দৃষ্টি। আর তুুমি দেখবে আমার হীমশীতল মৃত চোখের আলোয় আত্মার জগত।'
অনন্যার সেই ছিল শেষ কথা। তারপর হাসপাতালের বেডে তাকে যখন মৃত অবস্থায় পাই, সে ছিল অবিশ্বাস্য ভাবে স্বাভাবিক দৃষ্টির মানুষ। আমি নিজ হাতে তার চোখের পাতাটি ঢেকে দেই। অনন্যার চলে যাওয়ার পর আমার মধ্যে কি পরিবর্তন হয়েছে আমি জানি না। তবে লোকজন আমাকে দেখলেই বলে , আহা ! বউয়ের শোকে বেচারা পাগল হয়ে গেছে। সংসারে কোন মন নেই , ছেলে-মেয়ের কোন খোঁজ-খবর নেই। তারা যে ভুল বলে এমন নয়। আজকাল আমার সন্তান আর অন্যের সন্তানের মধ্যে কোন পার্থক্য করতে পারি না আমি। পৃথিবীর বুকে প্রত্যেকটি মানুষই পৃথক পৃথক মানুষ। প্রত্যেকের পরীক্ষা আর হিসেব -নিকেষের অঙ্গীকারনামায় রয়েছে তার বৃদ্ধাঙ্গুলীর পৃথক ছাপ। তারপরও মানুষ কেন স্ত্রী, সন্তান, সংসারের জন্য গলদঘর্ম। চুরি , ডাকাতি , দুনীতি করে কার সম্পদ কে কার জন্য জমা করে ? এসব ব্যার্থ বেসাতি দেখে অনন্যার মত বলতে ইচ্ছে করে,'সব মানুষ অজ্ঞ। সে নিজেই জানে না সে কে ?' রবীন্দ্রনাথের পোষ্টমাষ্টারের কথা পৃথিবীতে কে কাহার,' পাগলা মেহের এর সেই প্রলাপ , ' সব ঝুট হ্যায় , তফাৎ যাও'। আর ধুষর মৃত চোখের অনন্যার জীবন দর্শন, 'সব মানুষই অজ্ঞ'_ এতো একই কথা।। অনন্যা নিজের জীবন বিসর্জন দিয়ে আমাকে নতুন জীবনের সন্ধান দিয়ে গেছে। আশে পাশের মানুষ এখন আমাকে দেখলেই এমনভাবে তাকায়, যেভাবে আমি একসময় অনন্যার দিকে তাকাতাম।
একদিন কৌতুহল জাগে , অনন্যার দেয়া নতুন জীবনে আমার বাহ্যিক চেহারা কেমন? মানুষ কি দেখে আমার ভিতর ? একটি জীর্ন আধ ভাঙ্গা আয়না তুলে নেই । প্রলেপ ওঠা আয়নায় সম্পুর্ন চেহারা দেখা যায় না। শুধু চোখ দুটি চোখে পড়ে । চমকে উঠি আমি । এতো আমার মৃত স্ত্রী অনন্যার চোখ, যে চোখের দিকে আমি কতবার প্রকাশ্যে-গোপনে তাকিয়েছি। এতো সেই মৃত চোখ , সৃষ্টিকর্তার দেয়া প্রথম চোখ, মাতৃগর্ভে ভ্রুণ হওয়ার আগের চোখ।