শফিক সাহেবের বাম হাতের কব্জিতে দামী ঘড়ি আছে, হাতে ধরা স্যামসাং গ্যালাক্সীর হোম স্ক্রীনেও টাইম দেখাচ্ছে, তবুও শফিক সাহেব সময় দেখার জন্য ওয়েটিং রুমের দেয়ালে লটকে থাকা ঘড়িটার দিকে তাকালেন। মনে মনে হিসেব করলেন ঘড়িতে ঘন্টার কাঁটা আট ছুঁয়েছে, মিনিটের কাঁটা বারো ছুঁয়েছে, মানে আটটা বাজে। শফিক সাহেব হঠাৎ যেন চমকে উঠলেন, মন চলে গেলো কোন সুদূরে, মা রান্নাঘর থেকে ডাকতেন, “ খোকা, দেখতো আব্বা, ঘড়িতে কয়টা বাজে?”
শফিক তখন সবেমাত্র ঘড়ি চিনতে শুরু করেছে, খুব উৎসাহের সাথে বলতো, “ আম্মা, ছোট কাঁটা নাইন ছুঁইছে, আর বড়টা টুয়েলভ ছুঁইছে, তার মানে নয়টা বাজে, ঠিক কইছি আম্মা?”
-“হ আব্বা এক্কেবারে ঠিক কইছো”
শফিক সাহেবের আম্মা মারা গেছেন দুই বছর হয়ে গেলো, কিন্তু শফিক সাহেবের কাছে মনে হয় এই তো সেদিন। এই হসপিটালেই আম্মা ভর্তি হয়েছিলেন, স্ট্রোক করার পর পুরোপুরি অচেতন আম্মাকে হাসপাতালে আনা হয়েছিল, আম্মার চেতনা আর ফিরে আসেনি, হাসপাতালে আনার দ্বিতীয় দিনেই ডাক্তার আম্মাকে মৃত ঘোষণা করেন। আম্মা নেই, এটা ভাবলেই শফিক সাহেবের বুকের ভেতর শূন্যতা তৈরী হয়, কিছু ভালো লাগে না। কিন্তু এই মুহূর্তে মনে হচ্ছে আম্মা না থাকাতে ভালোই হয়েছে। বেঁচে থাকলে আম্মা কোনভাবেই টুটুলের বর্তমান অবস্থা সহ্য করতে পারতেন না, জোয়ান ছেলে, কী ঝলমলে স্বাস্থ্য, অথচ নিথর হয়ে পড়ে আছে আইসিইউর দুই নাম্বার বেডে। টুটুল বেঁচেই আছে নাকি মারা গেছে, বাইরে থেকে কিছুই বোঝা যায়না। লাইফ সাপোর্টে আছে, যান্ত্রিক উপায়ে শ্বাস-প্রশ্বাস টানছে।
টুটুল শফিক সাহেবের বড় বোনের ছেলে, মাত্র তিন মাস আগেই বিয়ে করেছে, বৌমার হাত থেকে মেহেদীর দাগ এখনও মুছেনি, চার দিন আগে মোটর সাইকেল চালিয়ে মানিকগঞ্জ থেকে ঢাকা ফিরছিল, পেছন থেকে ‘মায়ের দোয়া’ নামের এক লাইটেস গাড়ি টুটুলের মোটর সাইকেলটিকে ধাক্কা মারে। মোটর সাইকেলে টুটুলের আরও দুই বন্ধু ছিল, তিনজনই সাইকেল উলটে পড়ে যায়, শামীম ঘটনাস্থলেই মারা যায়, তৌহিদের বাম পা ফ্র্যাকচার হয়েছে, আর টুটুলের তলপেটের উপর দিয়ে লাইটেসের চাকা চলে যায়। তলপেট থেকে থাই পর্যন্ত থেঁতলে গেছে, প্রস্রাব-পায়খানার পথও থেঁতলে এমন হয়েছে যে আলাদা করা যাচ্ছে না। গত তিনদিনে ডাক্তাররা কম করে হলেও পাঁচ-ছটি সার্জারী করেছেন, আজ সকাল পর্যন্ত ডাক্তাররা তেমন কোন আশার আলো দেখতে পাননি। প্রচুর রক্তক্ষরণ হয়েছে, ডাক্তাররা তো এখানে কেটেছেন, ওখানে জোড়া দিয়েছেন, স্বাস্থ্যবান ছেলের হার্ট ফাংশান ভালো আছে, ব্লাড দেয়া হয়েছে যথেষ্ট, এখন টুটুলের জ্ঞান ফেরার অপেক্ষা করছেন সকলে।
শফিক সাহেব বুঝতে পারছেন না, টুটুলের জ্ঞান আদৌ ফিরবে কিনা, আর জ্ঞান ফিরলেও ও আবার আগের জীবন ফিরে পাবে কিনা। শফিক সাহেব চাইছেন, টুটুলকে সিঙ্গাপুর বা ব্যাংকক নিয়ে যেতে। আজ মূল সার্জনের সাথে কথা বলবেন। এইজন্যই উনি আজ খুব সকালে হসপিটালে চলে এসেছেন যাতে সার্জন ইসলামের সাক্ষাৎ পেতে পারেন।
শফিক সাহেব গতকাল সারাদিন ওয়েটিং রুমে বসে কাটিয়েছেন, পরশুও ছিলেন, এ কয়দিন উনার কিছুই করার ছিল না, উনার নিজস্ব ব্যবসা আছে, ব্যবসা দেখাশোনা করার জন্য অবশ্য বিশ্বস্ত ম্যানেজার আছেন, শফিক সাহেব অফিসে না গেলেও কাজ বন্ধ হয়না। শফিক সাহেব দুইদিন ধরে বসে আছেন আপার কথা চিন্তা করে। তিন কন্যার পর আপার কোলে আসে টুটুল, সকলের নয়নের মণি, দুলাভাইয়ের মৃত্যুর পর টুটুলই সংসারের হাল ধরেছে, কী-ইবা বয়স তার, মোটর সাইকেল কি সে আজকে থেকে চালায়? বৌমার হাতের মেহেদীর দাগ এখনও শুকায়নি, আপাকে জানানো হয়নি যে টুটুলকে লাইফ সাপোর্টে রাখা হয়েছে। শফিক সাহেবই নিষেধ করেছেন সবাইকে, আপাকে যেন টুটুলের বর্তমান অবস্থার কথা জানানো না হয়, আপাকে শুধু বলা হয়েছে, টুটুলের ইনজুরীটা খুব বেশী বলে তাকে স্পেশ্যাল কেয়ার ইউনিটে রাখা হয়েছে। এই সময় রুগীর সাথে কাউকে দেখা করতে দেয়া হচ্ছেনা। ডাক্তাররা চাইছেন না, রুগীর সামনেই রুগীর আপনজনেরা কান্নাকাটি করুক, তাতে রুগীর মন দূর্বল হয়ে যেতে পারে। এইজন্যই শফিক সাহেব তিনদিন ধরে আইসিইউতে বসে থাকেন, আপা কিছুটা নিশ্চিন্ত আছে এই ভেবে যে খোকা যখন আছে তখন কোন ভয় নেই।
এই ক’দিন আইসিইউ ওয়েটিং রুমে কাটিয়ে শফিক সাহেবের অন্যরকম অভিজ্ঞতা হয়েছে। এই রুমটাতে সকলেই হতাশাগ্রস্ত, সকলের মনে ব্যথা অপরিসীম, কারো ব্যথা কারো চেয়ে কম নয়। এই রুমে কারো মুখে হাসি নেই, এই রুমে কারো গলার স্বর উঁচু নয়, শুধুমাত্র গতকাল এক মহিলা আইসিইউ’র দরজা দিয়ে বাইরে এসেই হাউ হাউ করে কান্নায় ভেঙ্গে পড়েছিল। সেই কান্না এতই তীব্র ছিল যে মহিলার সাথে আসা স্বজনেরা মহিলাকে জড়িয়ে ধরে খুব আস্তে আস্তে টেনে সরিয়ে নিয়ে গেছে।
আইসিইউ ওয়েটিং রুমের পরিবেশ একেবারে অন্যরকম। এখানে উপস্থিত কারো পেটে ক্ষিদে লাগে না, কারো চোখে ঘুম নেমে আসে না, কারো পানির পিপাসা হয় না, সকলেই লাল-নীল প্লাস্টিকের চেয়ারে গা এলিয়ে বসে থাকে, সকলের চোখ থাকে আইসিইউর প্রবেশ দ্বারে বসে থাকা ছেলেটির দিকে। এই ছেলেটির নাম জাবেদ। গত চারদিনের প্রতি দিন সকাল থেকে সন্ধ্যা পর্যন্ত ডিউটি করতে দেখা গেছে। ভীষণ মায়াবী চেহারা ছেলেটার, কথা বলে নীচু স্বরে, রুগীর নাম্বার ধরে স্বজনকে ডাকা ছাড়া, এবং ডাক্তারের নির্দেশানুযায়ী স্বজনদের কাছে তথ্য দেয়া ছাড়া আর কোন ক্ষমতা নেই। তবুও গতকাল বিকেলবেলা একজন আধুনিক চেহারার মাঝবয়সী তরুণী এসে ছেলেটির সাথে খুব চোটপাট দেখালো। ছেলেটির দোষ ছিল, সে ভিজিটিং আওয়ার শুরু হয়নি কারণ দেখিয়ে মাঝবয়সী তরুণীকে ভেতরে প্রবেশ করার জন্য দরজা খুলে দেয়নি। তরুণীর মনেও অনেক ব্যথা ছিল নিশ্চয়ই, তার অতি আপনার কোন জন আইসিইউতে মৃত্যুর সাথে পাঞ্জা লড়ছে, যে কোন মুহূর্তে দম বের হলেই তো সব ফুরিয়ে গেলো। এই ছেলেটি তো বুঝবেনা তরুণীর অন্তরে কী কষ্ট জমে আছে। তরুণী যখন রেগে মেগে বলেছিল,
“ ইউ স্কাউন্ড্রেল, আমি ভেতরে যাব, তুমি বাধা দেয়ার কে? ডাকো তোমার প্রফেসারকে, আমি কথা বলবো, তুমি দরজা খুলে দাও”।
ছেলেটা খুবই আমতা আমতা করে বলেছিল, “ ম্যাডাম, ভিজিটিং আওয়ারের আগে তো আমি গেট খুলবার পারুম না, আমার চাকরী চলে যাইব।
-ড্যাম ইয়োর চাকরী, আমার আব্বা মারা যাচ্ছে, আমি কতদূর থেকে এসেছি, আবার ফিরে যেতে হবে, আর তোমরা আমাকে নিয়ম শেখাচ্ছো?
-ম্যাডাম, আমার উপরে রাগ কইরেন না, আপনারে ঢুকতে দিলে ওয়েইটিং রুমে যারা বইসা আছে, তাদেরকেও ঢুকতে দিতে হইবো। আমার উপরে কড়া নিষেধ আছে।
সেই মাঝবয়সী তরুণী রাগে গরগর করতে করতে ওয়েইটিং রুম থেকে বেরিয়ে গেলো, শফিক সাহেবের মনটা খারাপ হয়ে গেলো। দুই বছর আগে আম্মাকে ভর্তি করা হয়েছিল এই হাসপাতালে, শফিক সাহেবের ব্যবসা প্রতিষ্ঠানে তখন অডিট চলছিল, ভিজিটিং আওয়ারে আসা সম্ভব হবেনা মনে করে শফিক সাহেব দুই ঘন্টা আগেই চলে এসেছিলেন, আম্মা তো ছিলেন কেবিনে, তাই অত কড়াকড়ি ছিল না। এবং সেটাই ছিল মুহূর্ত, মায়ের পাশে বসেছেন, দশ মিনিটের মধ্যেই আম্মা চলে গেলেন, এ যেন নিয়তি তাকে টেনে নিয়ে এসেছিল। এই যে আধুনিক তরুণী আব্বাকে দেখতে চাইলো, ভিজিটিং আওয়ার শুরু না হওয়ায় তাকে ভেতরে যেতে দেয়া হলো না, আল্লাহ না করুন, যদি তার আব্বা চলে যান, এই তরুণী নিজেকে কী করে সান্ত্বনা দিবে? সে তো ঠিকই এসেছিল এতপথ ঘুরে, নিয়মের বাধা ডিঙ্গাতে পারলো না। শফিক সাহেব মনে মনে প্রার্থণা করলেন, তরুণীর আব্বা যেন তরুণীর হাতের ছোঁয়া না নিয়ে চলে না যান। আইসিইউতে যারা আছে, তাদের সকলেরই ফিরে আসার সম্ভাবনা খুব কম!
শফিক সাহেবের চোখ আবার ওয়ালে লটকে থাকা ঘড়ির দিকে গেলো, ছোট কাঁটা ইলেভেন থেকে একটু সরেছে, বড় কাঁটা ফাইভে আছে, “ আম্মা, এগারোটা বাইজা পঁচিশ মিনিট হইছে, ঠিক কইছি না আম্মা?” “হ আব্বা, ঠিক কইছো”। ঠিক তখনই ওয়েইটিং রুমে ্বসা নির্লিপ্ত মানুষগুলোর মধ্যে মৃদু চাঞ্চল্য দেখা গেলো, যারা মাথা নীচু করে বসেছিল তাদের মাথা স্প্রিং্যের মত সোজা হয়ে গেলো, যারা দেয়ালে মাথা ঠেকিয়ে বসেছিল, তাদের পিঠ সোজা হয়ে গেলো এবং মৃদু গুঞ্জন শুরু হলো। একদল সুবেশধারী নরনারী পরিবেষ্টিত হয়ে যাকে ওয়েটিং রুমের দরজার মুখে যেতে দেখা গেলো, তাঁকেও আইসিইউর ওয়েটিং রুমে দেখা যাবে, এটি কারো ধারণাতে ছিল না। ছোটখাটো মানুষটিকে সকলেই চেনে, তার গান সকলে পছন্দ করে, বাংলাদেশের সঙ্গীত জগতের উজ্জ্বল তারকা শুভ্র সুন্দর! শুভ্র সুন্দর কেন এসেছে? দরজায় বসে থাকা ছেলেটিকে কেউ জিজ্ঞেস করলোনা ভেতরে ঢুকতে পারবে কিনা। আইসিইউ’র ভেতর থেকে দুজন সিনিয়র ডাক্তার বেরিয়ে এসে শুভ্র সুন্দরসহ সাথে আসা সুবেশধারীদের সবাইকে ভেতরে নিয়ে গেলেন। ওয়েইটিং রুমে বসা নারীদের মধ্যে একটু যেন প্রাণ ফিরে এলো, সকলেরই জিজ্ঞাসা,
“ শুভ্র সুন্দরের কে অসুস্থ? মনে হয় খুব আপনজন কেউ না। আপনজন হইলে কি আর এইখানে আসতো, চিকিৎসা করতে সিঙ্গাপুর, ব্যাংকক লইয়া যাইতো”।
শফিক সাহেবের মনে পড়ে গেলো, টুটুলকে সিঙ্গাপুর বা ব্যাংককে নেয়া যায় কিনা, এই নিয়ে বড় ডাক্তারের সাথে আজ কথা বলবে। এটা ভাবতে একটু খারাপও লাগছে, নিজের দেশের চিকিৎসা ব্যবস্থার উপর একটুও ভরসা করতে পারছেন না উনি, অথচ গতকালকেই নীলা দিদি কাঁদতে কাঁদতে বললেন, উনারা উনাদের মা’কে বেটার চিকিৎসার জন্য ভারতে নিয়ে যেতে চেয়েছিলেন, নীলা দিদির মা যেতে চাইলেন না। উনি দেশে থেকেই চিকিৎসা করাতে চেয়ে আজ মৃত্যুর সাথে পাঞ্জা লড়ছেন, লাইফ সাপোর্টে আছেন, নীলা দিদির ছোট বোন আসবে আগামীকাল, এরপর উনারা সিদ্ধান্ত নিবেন, মা’কে লাইফ সাপোর্টে রাখবেন নাকি লাইফ সাপোর্ট খুলে দিবেন। নীলা দিদির কথা মনে হতে শফিক সাহেব খুব বিষন্ন বোধ করলেন।
দুই
নীলা দিদির সাথে শফিক সাহবের পরিচয় হয়েছে মাত্র তিনদিন আগে। আজকের মত করেই ওয়েটিং রুমে চুপচাপ বসেছিলেন, ভাবছিলেন টুটুলের কিছু হয়ে গেলে আপাকে সামলাবেন কি করে! সেদিন ওয়েটিং রুমে অনেক মানুষ ছিল, কোন চেয়ার ফাঁকা ছিল না। শফিক সাহেবে উলটো দিকের দেয়ালের দিকে মুখ করে বসেছিলেন, প্রথমে লক্ষ্য করেননি কে আসে কে যায়দের দিকে, কিন্তু সালোয়ার-কামিজ পরিহিত এক তরুণীকে সরাসরি দরজায় বসে থাকা জাবেদের সাথে কথা বলতে দেখে উনি থমকালেন। তরুণীর কন্ঠস্বরে কিছু একটা ছিল, শফিক সাহেবের নজর তাই সেদিকেই আটকে গেলো। দুই মিনিটের মধ্যেই দরজা খুলে গেলো, তরুণী ভেতরে প্রবেশ করলো। অপেক্ষমান স্বজনদের মধ্যে গুঞ্জন শুরু হলো, একজন চ্যাংড়া টাইপের ছেলে জাবেদকে ঊদ্দেশ্য করে বলেই ফেললো,
“ মিয়া, আমরা সকাল থিকা বইসা আছি, আমগোরে ভিতরে যাইতে দিলা না, আর উনারে একেবারে স্বাগতম জানাইয়া ভিতরে ঢুকতে দিলা। এখন তোমার নিয়ম কই গেল?
ছেলেটি বলল, “ স্যারের অনুমতি আছে, এক নাম্বার বেডের পেশেন্টের মেয়েকে যেন ভেতরে ঢুকতে দেয়া হয়।“
-ক্যান, এক নাম্বার বেডের পেশেন্টের মেয়ে কি প্রধানমন্ত্রীর আত্মীয় লাগে?
-ভাই, আ্মার উপর রাগ করেন কেন, আমি ত চাকরী করি। আমার উপরে যা অর্ডার থাকে সেইটা পালন করি। আমার কি খুব ভাল লাগে আপনাদের দরজার বাইরে বসাইয়া রাখতে? আমার মা-বাপ আছে না? আমি ত বুঝি আপনাগো কষ্ট। এই আপা আইজই আমেরিকা থিকা আইছে, উনার আম্মার অপারেশান হইছে কাইল রাতে, মেশিনে রাখছে, স্যার আগেই অনুমতি দিয়ে রাখছে উনার জন্য, দশ মিনিট থাকতে পারবো, দশ মিনিট পরে ভিতরের ডাক্তাররাই আপাকে বাইরে পাঠায়ে দিবে।
সত্যি সত্যিই একটু পরেই তরুণীকে আইসিইউ’র ভেতর থেকে বেরিয়ে আসতে দেখা গেলো। তরুণী খুব সুন্দর করে জাবেদকে ধন্যবাদ জানিয়ে ওয়ালে লটকে থাকা ঘড়িটার নীচেই দাঁড়ালো। তরুণীর সাথে যে ভদ্রলোক এসেছেন, চেহারায় মিল দেখে বুঝা যায় উনারা সম্পর্কে ভাই বোন। ভাই অবশ্য ভেতরে যায়নি, বোন আসার পর খুব আগ্রহ নিয়ে জিজ্ঞেস করলো, “নীলা, মা’কে কেমন দেখলি? মায়ের জ্ঞান ফিরেছে? তোরে চিনতে পারছে?
নীলা নামের তরুণী দুই ঠোঁট চেপে রেখে শুধু মাথা ঝুঁকিয়ে হ্যাঁ বললো।
শফিক সাহেব একমনে নীলা আর সেই ভদ্রলোকের দিকে তাকিয়ে রইলেন। ভদ্রলোক মুখ শুকনো করে দাঁড়িয়ে রইলেন, আর তরুণীটি সমস্ত শক্তি দিয়ে ঠোঁট দুটোকে চেপে রাখতে চাইছে, এর মধ্যেই তার দুই চোখ যেন আর বাধা মানতে চাইলোনা, ঝর ঝর করে পানি পড়তে লাগলো। তরুণী হাতের তালু দিয়ে বাচ্চা মেয়েদের মত করে একবার এই চোখ আরেকবার ঐ চোখ মুছতে শুরু করলো।
শফিক সাহেবের মনটা মুচড়ে উঠলো, উনি আশেপাশে তাকিয়ে দেখলেন একটা ফাঁকা চেয়ার পাওয়া যায় কিনা। না, কোন চেয়ার ফাঁকা নেই, উনি নিজে উঠে চেয়ারটি নীলাকে দিতে পারেন বসার জন্য, কিন্তু উনার নিজের সমস্যা আছে, বেশীক্ষণ দাঁড়িয়ে থাকতে পারেন না। তবুও শফিক সাহেব উঠে দাঁড়ালেন, এগিয়ে গেলেন নীলা নামের তরুণীর দিকে, খুব নরম স্বরে বললেন,
“ আপু, আমার নাম শফিক, আপনি এখানে আসুন, এই চেয়ারটায় বসুন, এভাবে কাঁদবেন না, আপনার মা নিশ্চয়ই সুস্থ হয়ে উঠবেন”।
নীলা হাতের উল্টোপিঠে চোখের জল মুছতে মুছতে শফিক সাহেবের দেখিয়ে দেয়া চেয়ারে বসেই আবার ঝট করে দাঁড়িয়ে গেলো, কান্নামিশ্রিত কন্ঠে বলল, “ ভাই, আপনি বসুন, আমি বত্রিশ ঘন্টা প্লেন জার্নি করে এসেছি, সারাক্ষণ তো বসেই ছিলাম, আপনি বসুন”।
এমন এক পরিস্থিতিতে পাশের চেয়ারে বসে থাকা এক বয়স্ক নারী উনার নাতনীকে কোলে তুলে নিয়ে নাতনীর চেয়ারটা নীলার দিকে এগিয়ে দিয়ে বলল, “ আম্মা, তুমি বসো, কতক্ষণ দাঁড়ায়ে থাকবা?
আর কথা না বাড়িয়ে ভদ্রমহিলাকে ধন্যবাদ জানিয়ে নীলা নীল রঙের প্লাস্টিকের চেয়ারটাতে বসে পড়লো। ঘাড় ঘুরিয়ে দাদাকে দেখার চেষ্টা করলো, দাদাটা কেমন অসহায় ভঙ্গীতে একটু দূরে দাঁড়িয়ে আছে, দাদার অসহায় ভঙ্গীর দিকে তাকিয়েই নীলা আবার কাঁদতে শুরু করলো।
এবার শফিক সাহেব মুখ খুললেন, আপু, একটু আগে আপনাদের ভাইবোনের কথা শুনে আন্দাজ করেছি, আইসিইউতে আপনার আম্মা আছেন, আপনার আম্মা এক নাম্বার কক্ষে আছেন, আমার ভাগ্নে আছে ছয় নাম্বার কক্ষে, আইসিইউতে ঢুকেই নাক বরাবর যে বেডটি, সেখানে আম্মার ভাগ্নে পড়ে আছে, ওকেও লাইফ সাপোর্টে রাখা হয়েছে। আমার ভাগ্নে মায়ের একমাত্র ছেলে, মাত্র তিন মাস আগে বিয়ে করেছে, মোটর সাইকেল একসিডেন্টে কোমড় থেকে নীচের অংশ থেঁতলে গেছে, তিন দিন হয়ে গেলো জ্ঞান ফিরেনি।
-আহারে! সেই ছেলেটা আপনার ভাগ্নে? হ্যাঁ, মায়ের রুমে যাওয়ার পথেই চোখ বরাবর রুমে দেখলাম, একজন স্বাস্থ্যবান যুবক নিথর হয়ে শুয়ে আছে, সে আপনার ভাগ্নে?
-আমার একমাত্র ভাগ্নে, আমার আপাকে জানানো হয়নি ছেলের এই অবস্থার কথা। আমি তিনদিন ধরে এখানে বসে আছি, অপেক্ষায় আছি কখন টুটুলের জ্ঞান ফিরে আসে। ওর বউটা নিতান্ত বাচ্চা মেয়ে, হসপিটালে নিয়ে আসিনি, টুটুলের এই অবস্থা দেখে সহ্য করতে পারবেনা, যদি টুটুলের জ্ঞান ফিরে আসে, আমি নিজে গিয়ে বৌমাকে নিয়ে আসবো। বলতে বলতেই শফিক সাহেব এক মুহূর্ত থমকালেন, একটু হালকা হাসি দিয়ে বললেন, নিজের কথা বলে যাচ্ছি, আপনাকে জিজ্ঞেসই করা হলো না, আপনার মা’কে কেমন দেখে এলেন?
নীলা ততক্ষণে প্রাথমিক বিপর্যয় কাটিয়ে উঠেছে। মাত্র মিনিট পাঁচেক আগে পরিচয় হওয়া শফিক সাহেবকে মোটেও অপরিচিত মনে হচ্ছেনা। খুব অকপটেই নীলা বলল,
“ শফিক ভাই, সত্যি কথা হলো, আমার মা মারা যাচ্ছেন, আমার মা’টা মরে যাচ্ছে শফিক ভাই, আমার সাথে একটাও কথা না বলেই মা মরে যাচ্ছে, আমি মায়ের জন্য কত কিছু নিয়ে আসছিলাম, মা কিছুই খেতে পারছিলো না, এক ফোঁটা জল পর্যন্ত না, ফোনে মা’কে বলেওছিলাম, মা, তোমার জন্য এনফা মিল্ক নিয়ে আসবো, আমি ফোঁটা ফোঁটা করে তোমার মুখে দেবো, বমি হবে না, তোমার দেহে পুষ্টি হবে, তুমি ভালো হয়ে যাবে। কিন্তু কিছুই হলো না, মা’কে এই অবস্থায় দেখবো, আমি ধারণা করিনি। সারা শরীরে সুঁই ফুটানো, গলার ভেতর ইয়া মোটা নল ঢুকানো, দেহ এলিয়ে মা পড়ে আছে, আমি তো মা’কে এভাবে দেখবো ভাবিনি। মা বলে ডাকলাম, মা চমকে তাকিয়ে আমাকে দেখলো, হু হু করে কেঁদে উঠলো। শফিক ভাই, আমি তো মা’কে এই অবস্থায় দেখে স্তম্ভিত, চারদিকে এত নল ফিট করা, মায়ের কাছেও যেতে পারছিলাম না, মা আমাকে ইশারায় বলছিলেন, ব্যথা, ব্যথা। আমি মায়ের সামনে নিজেকে সামলে রেখেছি, মা’কে মিথ্যে সান্ত্বনা দিয়েছি, “মা, তুমি ভালো হয়ে যাবে, তোমার অপারেশান খুব ভালো হয়েছে”। মা আমার কথা বিশ্বাস করেছে মনে হলো, দুই চোখ বন্ধ করে ঘুমে তলিয়ে গেলো। আমি মায়ের সাথে শেষ মুহূর্তে মিথ্যে কথা বললাম।
-দিদিভাই, চোখের পানি মুছুন, সন্তানের কান্না মায়ের কষ্ট বাড়িয়ে দেয়, চোখের পানি মুছুন। একটু সময় নিন, এরপর যদি ইচ্ছে হয়, তবেই বলুন আপনার মায়ের কি হয়েছে?
-আমার মায়ের বয়স পঁচাত্তর বছর, অথচ মা’কে দেখে মনে হতো বয়স ষাটের কাছাকাছি। এত সুন্দর ছিল স্বাস্থ্য, শিক্ষক ছিলেন তো, ডিসিপ্লিনড লাইফ মেইনটেইন করেছেন। দেহে কোন রোগ বা উপসর্গ ছিলোনা। তিন মাস আগে আমি বাংলাদেশে এসে বেড়িয়ে গেছি, আমার সাথে মা কত জায়গায় বেড়াতে গেলো, মা’কে দিব্বি হাসিখুশী দেখেছি। শুধুমাত্র আমেরিকা ফিরে যাওয়ার আগে মা খুব বিষন্ন হয়ে গেলেন, একবার মুখ ফুটে বলেও ফেললেন, “ নীলা, তোর সাথে আমার আর কোনদিন দেখা হবে না”। এমন কথা মা প্রতিবার বলে, তাই আমি পাত্তা দেইনি। মা আবার বললেন, “ নীলা, আমার খুব ইচ্ছে ছিল এইবার তোর সাথে ডাক্তারের কাছে যাব, কিন্তু তুই এত বেশী বেড়ানোতে ব্যস্ত ছিলি যে ডাক্তারের কাছে নিয়ে যাওয়ার কথা বলতে লজ্জা করলো।“
-কী হয়েছিলো আপনার মায়ের?
-ইউটেরাইন ক্যান্সার।
-এই বৃদ্ধ বয়সে?
-হ্যাঁ, পঁচাত্তর বছর বয়সে মা মারা যাচ্ছেন ইউটেরাস ক্যান্সারে, যে ইউটেরাসের ভেতর আমরা ভাইবোনেরা পালা করে দশ মাস থেকেছিলাম।
-ক্যানসার ধরা পড়লো কখন?
-আমি আমেরিকা ফিরে যাওয়ার ্দুই দিন আগে মা’কে নিয়ে ডাক্তারের কাছে গেছিলাম। ডাক্তার বললেন যে ইউটেরাসের অবস্থা খুবই খারাপ, বায়োপসী করা দরকার, উনি চাইলেন ইউটেরাসের টিস্যু কালেক্ট করে আমাদের হাতে দিবেন, আমরা যেন সেই স্যাম্পল উনার পরিচিত প্যাথলোজীতে নিয়ে পৌঁছে দেই, আমি ভাবলাম এমন অপরিচিত প্যাথলোজীতে আদৌ সঠিক রিপোর্ট আসে কিনা, তার ্ঠিক নেই, তাই মা’কে নিয়ে এই নামকরা হাসপাতালে চলে এসেছিলাম, এখানে গায়নোকলজিস্টের কাছে সবকথা খুলে বললাম, উনাকে অনুরোধ করলাম যদি উনি ইউটেরাসের টিস্যু কালেক্ট করে এই হসপিটালের প্যাথলোজীতে বায়োপসী করার অনুমতি দেন।
ডাক্তার আমার কথা পাত্তা না দিয়ে মা’কে একশ একটা টেস্ট করতে দিলেন। সেদিন ছয় ঘন্টা কাটাতে হয়েছিল এই হাসপাতালে, তবুও ইউটেরাসের টিস্যু বায়োপসী হলো না। মা সেদিন খুব মন খারাপ করেছিলেন, মা’কে সেদিন বাসায় পৌঁছে দিয়ে আমি আমেরিকার ফ্লাইটে উঠলাম, আমার সাথে মায়ের সেই শেষ দেখা, শেষ কথা। আমেরিকা ফিরে যাওয়ার পর মা আবারও সেই প্রথম ডাক্তারের কাছে গেলেন, প্রথম ডাক্তার মা’কে চিকিৎসা করতে রাজী হলেন না। মা একা একা ঢাকা আসতে পারবেনা, আবার দাদাকেও ইউটেরাসের সমস্যার কথা বলতে পারতেন না বলে ডাক্তারকে কাতর অনুরোধ করলেন।
ডাক্তার তখন আর বায়োপসীর কথা বললেন না, শুধু অপারেশানের তারিখ দিলেন। এবং নির্দিষ্ট দিনে পেট ওপেন করে ইউটেরাসটাকে কেটে নিয়ে এলেন। এরপর ইউটেরাসের টিস্যু পাঠালেন বায়োপসী করতে, রিপোর্ট সেকেন্ড স্টেজ ক্যানসার। অনকোলোজিস্টের কাছে মা’কে আমার দাদাই নিয়ে গেলো, কিন্তু মা ক্যানসার ভয় পেতো বলে মা’কে জানানো হলো, ইউটেরাসে ইনফেকশান হয়েছিল, সেই ইনফেকশান পুরোপুরি সারেনি, তাই অনকোলোজিস্ট রেডিও থেরাপীর জন্য ডেট দিয়েছে, মা খুব খুশী, আমরাও খুশী। রেডিও থেরাপী দিলেই মা সেরে উঠবে।
-উনাকে রেডিও থেরাপী দেয়া শুরু হয়েছিল?
-না, রেডিও থেরাপীর ডেট আসার আগেই মা ভয়ানক অসুস্থ হয়ে গেলেন, খাওয়া দাওয়া টোটালি বন্ধ হয়ে গেলো, জলও খেতে পারেনা, ব্লাডে সোডিয়াম লেভেল নামতে শুরু করলো, যেদিন রেডিও থেরাপী শুরু হওয়ার কথা, সেদিন সকাল থেকে মা অনবরত বমি করতে লাগলেন।
-উনাকে এখানে আনা হলো কবে?
-চার দিন আগে। আমরা অবশ্য বুঝতে পারছিলাম না কেন মা এভাবে বমি করছে, আমি মা’কে ফোনে জিজ্ঞেস করলাম, মা আমি আসবো? মা বললেন, কী করবি এসে? মায়ের সাথে ঐ আমার শেষ কথা। মা’কে এখানে আনা হলো, তখনও মায়ের সমানে বমি হচ্ছে, পেট প্রতি ঘন্টায় এক সেঃমি করে ফুলে উঠছে, ডাক্তাররা কিছুই ধরতে পারছেন না, এমন সংবাদ শুনে দুইদিন আগে আমি প্লেনে উঠেছি, দুবাই থেমেছে প্লেন, একদিন পুরো কেটেছে দুবাই এয়ারপোর্টে, একদিনের সংবাদে টিকেট কেটেছিলাম, তাই কানেক্টিং ফ্লাইট পাইনি, সেটাই আমার জন্য ‘কাল’ হয়ে দাঁড়ায়। প্লেনে উঠার আগ মুহূর্তে আমার দাদার সাথে কথা হয়েছে, দাদা বলেছিল,
“ নীলা, তুই উতলা হোস না, মায়ের পেট ফুলে উঠা মনে হয় ধীর হয়ে আসছে, ডাক্তার বলেছেন তুই আসার পরে মায়ের পেট আবার ওপেন করবে”। শুনে আমার অস্থিরতা কমেছিল।
আমি আজ এয়ারপোর্টে পৌঁছে সরাসরি হসপিটালে আসতে চেয়েছিলাম। আমাকে এয়ারপোর্টে আনতে গিয়েছিলেন আমার ননদাই, উনি জানালেন গতরাতে মায়ের অপারেশান হয়ে গেছে, এবং পেট ওপেন করে ডাক্তাররা দেখেছেন, ক্যান্সার পেটের সর্বত্র ছড়িয়ে পড়েছে, কোলন পেঁচিয়ে পরিপাকতন্ত্র নাকি দলা মোচরা হয়ে গেছে।
-হায় আল্লাহ, আপনার মা’কে কেন ইন্ডিয়া নিয়ে গেলেন না? দিদিভাই, আপনি তো এসেছেন, ইন্ডিয়া নিয়ে যান, উনি ভাল হয়ে উঠবেন। এই আমাকে দেখেন, আমার কোলন ক্যান্সার হয়েছিল, বাংলাদেশে ডাক্তার আমাকে তিন মাস সময় বেঁধে দিয়েছিল, আমি শেষ চেষ্টা হিসেবে কলকাতা চলে গেলাম, সেখানে চিকিৎসা হলো, আজ পাঁচ বছরের উপর আমি বেঁচে আছি, একটাই সমস্যা, বেশীক্ষণ দাঁড়িয়ে থাকতে পারিনা।
-এখন মা’কে ঈশ্বর ছাড়া আর কেউ বাঁচাতে পারবে না। আমি দেখে এলাম, মায়ের কিন্তু প্রস্রাব বন্ধ, ক্যাথেটার শুকনো, মায়ের দেহে কোন নিউট্রিশান দেয়া হচ্ছেনা, গতকাল মায়ের অপারেশান করার আগে ডাক্তার ব্লাড দেয়ার কথা বলেননি, অপারেশান শেষ হওয়ার দুই ঘন্টা পর, একেবারে মাঝ রাতে দাদাকে বলেছে, সেই মুহূর্তে চার ব্যাগ রক্ত এনে দিতে। কারণ মায়ের ব্লাড প্রেশার একেবারে ফল করেছিল, তাই মা’কে লাইফ সাপোর্ট মেশিনে দেয়া হয়েছে। কই মাছের প্রাণ মায়ের, ওটিতে যাওয়ার আগে জানতেন আমি আজ সকালে এসে পৌঁছাবো, তাই আজ ভোরে উনার জ্ঞান ফিরে এসেছে। ডাক্তাররা সকলেই অবাক হয়ে গেছে। আমি গিয়ে যেইমাত্র ‘মা’ বলে ডাক দিলাম, বলেই নীলা দুই হাতের তালুতে চোখ মুছতে শুরু করলো।
নীলাকে চোখ মুছতে দেখলেই শফিক সাহেবের বুকে ব্যথা লাগে, মনে হয় যেন ছোট বোনটা কাঁদছে, ভাইয়ের কাছে আবদার করছে। অসহায় শফিক সাহেব বললেন,
“দিদিভাই, ভেঙ্গে পড়বেন না, ্সব কিছু উনার উপর ছেড়ে দিন, হয়তো মা ভাল হয়ে যাবেন।
-আমি তো বাচ্চা নই শফিক ভাই, ঐ যে এখানকার ডাক্তার মায়ের ইউটেরাসের বায়োপসি না করে কার্ডিওগ্রাম, কিডনি ফাংশানের টেস্ট করে ছেড়ে দিয়েছিল, ঢাকা এনে মা’কে দেখিয়েছি বলে ইগো দেখিয়ে প্রথম ডাক্তার বায়োপসী না করেই ইউটেরাসে ছুরী চালালেন, ব্যস, মায়ের মৃত্যুর দিন ধার্য্য হয়ে গেলো, তাতেই ক্যানসার ছড়িয়ে গেল। শফিক ভাই, মায়ের এই অবস্থার জন্য আজ আমার নিজেকে দায়ী মনে হচ্ছে। ডাক্তারের সেই প্রথম কথাতেই যদি বায়োপসীর কথা মেনে নিতাম, তাহলে তো অপারেশানের আগেই জেনে যেতাম ক্যান্সারের কথা। আমরা ভেবে চিনতে সিদ্ধান্ত নিতে পারতাম মায়ের চিকিৎসা কোথায় করাবো। তা তো হলো না, উলটো মা মরে যাচ্ছে, এবং মা মরে যাচ্ছে আমারই ভুল সিদ্ধান্তের কারণে।
তিন
গতকাল ছিল নীলার মায়ের জন্মদিন, নীলা দারুণ সুন্দর করে সেজে এসেছিল। শফিক সাহেবকে দেখামাত্র কাছে এগিয়ে গিয়ে খুব আপন গলায় বলেছিল, “শফিক ভাই, আজ মায়ের ৭৫ তম জন্মদিন, মা আমাকে এই সাজে দেখতে ভারী পছন্দ করতেন, এটাই তো মায়ের শেষ জন্মদিন, তাই মা’কে ঘটা করে জন্মদিনের শুভেচ্ছা জানাতে এসেছি। আজ আমি এক ফোঁটা চোখের জল ফেলবো না, আজ আপনাকে ক্যান্টিনে নিয়ে যাব, আমাদের দুই ভাইবোনের সাথে বসে এক কাপ কফি খাবেন। মা খুব খুশী হবেন, মা’কে বলবো আপনার কথা। আজ আমি একটুও কাঁদবোনা, আগামীকাল সকালে এখানে আসবো না, সকালে সোজা বাড়ি যাব, বাবা নাকি মা’কে একটু দেখতে চায়, আমি জানি, বাবা এই দৃশ্য সহ্য করতে পারবে না। বাবার সাথে কথা বলবো, বুঝিয়ে বলতে হবে মায়ের কষ্টের কথা, আগামীকাল সকালে আমার ছোট বোন এসে পৌঁছাবে, বাবাকে জিজ্ঞেস করবো মা’কে লাইফ সাপোর্ট মেশিন থেকে বের করে নিজের জন্মভূমিতে ফিরিয়ে নিয়ে যাওয়া উচিত কিনা। আর আগামীকাল আমি মন্দিরে যাব, মায়ের জন্য পূজো দেবো, আপনার ভাগ্নের জন্য পূজো দেবো। আপনার ভাগ্নে সুস্থ হয়ে উঠবে। পারলে তাকে এয়ারবাসে করে সিঙ্গাপুর বা ব্যাংকক নিয়ে যান। আমি ঠিক জানিনা, এখানে মায়ের চিকিৎসা হচ্ছে নাকি মায়ের দেহের উপর দিয়ে এক্সপেরিমেন্ট করা হচ্ছে। আমার মা ভীষণ কষ্ট পাচ্ছে, হার্ট খুব স্ট্রং বলেই মরে যেতে পারছে না। আমি আগামীকাল বিকেলে আসবো।
শফিক সাহেব ঠিক বেলা বারোটার সময় টুটুলের ডাক্তারের সাথে সাক্ষাৎ করলেন, ডাক্তারকে সরাসরি জিজ্ঞেস করলেন, এখানে টুটুলের সুস্থ হয়ে উঠার কোন সম্ভাবনা আছে কিনা। আদৌ জ্ঞান ফিরবে কিনা সেই সম্পর্কেও জানতে চাইলেন। ডাক্তার সাহেব কোন আশার বাণী শোনাতে পারলেন না। শফিক সাহেবকে অবশ্য বললেন, রুগীর কন্ডিশান একটু স্ট্যাবল হলে আপনারা চাইলে এয়ারবাসে করে সিঙ্গাপুর নিয়ে গেলে ভালো হবে। ডাক্তারের সাথে কথা শেষ করে শফিক সাহেব টুটুলকে এক নজর দেখার জন্য ওর বেডের দিকে এগিয়ে গেলেন। টুটুলকে দেখে ফিরে আসার সময় খেয়াল করলেন, এক নাম্বার রুমের দরজায় দুই তিনজন তরুণ ডাক্তার দাঁড়িয়ে নিজেদের মধ্যে কথা বলছে। শফিক সাহেবের মনে আছে, নীলা দিদির মা আছেন এক নাম্বার রুমে, নীলা দিদি আজ সকালে আসবেন না বলেছিলেন, বাবার সাথে দেখা করে বিকেলের দিকে আসবেন। শফিক সাহেব দুই পা এগিয়ে এক নাম্বার রুমের জানালার পাশে দাঁড়াতেই দেখতে পেলেন, নীলা দিদির মাকে বালিশে পিঠ ঠেকিয়ে বসিয়ে রাখা হয়েছে, মানুষটার দুটি হাত সিটের হাতলে দুই দিক থেকে বাঁধা, মুখের নল খুলে ফেলা হয়েছে, অসহায় মানুষটার পিঠ কুঁজো হয়ে আছে, স্পষ্ট স্বরে ‘ব্যথা ব্যথা’ বলে গোঙ্গাচ্ছে! তিন তরুণ ডাক্তারের অবশ্য সেদিকে দৃষ্টি নেই, নার্স মেয়েটিও চুপচাপ দাঁড়িয়ে আছে। শফিক সাহেবের বুক কেঁপে উঠলো, আগামীকাল নীলা দিদির ছোট বোন এসে পৌঁছাবে, আজ বাবার সাথে উনারা মায়ের লাইফ সাপোর্ট খুলবেন নাকি রাখবেন তাই নিয়ে নিজেরা কথা বয়লে সিদ্ধান্ত নিবেন, নীলা দিদি আর তার দাদা তো জানেনা তাদের মায়ের মুখ থেকে লাইফ সাপোর্ট মেশিন খুলে ফেলা হয়েছে, নীলা দিদি কালকেই বলেছিল, তার মনে হয়েছে এখানে তার মায়ের সঠিক চিকিৎসা হচ্ছেনা, বরং তাঁর উপর দিয়ে ডাক্তাররা এক্সপেরিমেন্ট চালাচ্ছেন। শফিক সাহেবের কাছে নীলার ফোন নাম্বার নেই, উনি ডাক্তারদের প্রশ্ন করলেন, উনারা নীলার মায়ের মুখ থেকে লাইফ সাপোর্ট খুলে ফেলেছেন কেন?
একজন ডাক্তার বললেন, এটি আমাদের এক ধরণের রুটিন কাজ, দেখছি লাইফ সাপোর্ট ছাড়া রুগী কতক্ষণ ভালো থাকেন।
-উনার ছেলে বা মেয়ে, কেউই তো আজ সকালে আসেনি, তারা তো বোধ হয় জানেনা।
-আমরা কি রুগীর ছেলেমেয়ের সাথে আলাপ করে চিকিৎসা করবো?
-না, তা করবেন না, তবে জানালে ভালো করতেন।
শফিক সাহেব আইসিইউ থেকে বেরিয়ে আসার সেই মুহূর্তেই সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেললেন, টুটুলকে এখানে রাখবেন না, সিঙ্গাপুরেই নিয়ে যাবেন, সাথে উনি যাবেন, আর যাবে টুটুলের বউ।