মানত!
এইতো বাড়ি খুঁজে পেয়েছি, হাঁ, এইতো গেটের দুই পাশে জেসমিনের লতা, বাহ, কি সুন্দর সাদা ফুলে ছেয়ে আছে, উম! কী মিষ্টি গন্ধ, মাম্মির শরীর থেকেও নাকি জেসমিনের গন্ধ বের হয়, পারু (পারিজাত) তো তাই বলেছিল---এমনটা ভাবতে ভাবতেই মেহেদী সুন্দর বাড়িটির দরজায় এসে দাঁড়ালো। কলিং বেলের সুইচ দেখা যাচ্ছেনা, মেহেদীর আর তর সইছেনা, কতক্ষণে মাম্মিকে দেখতে পাবে। দরজাটা এমন কেন, ঠিক যেন ওদের মুলতানের বাড়ির মত, আমেরিকাতে বাড়ির দরজা তো দেখতে এমন হয়না। মেহেদি দরজায় দুম দুম করে ধাক্কাতে লাগলো। চারপাশে আর কোন বাড়ি দেখা যাচ্ছেনা কেন, মাম্মিরা কী বাড়ি বদলেছে!
ভেতর থেকে দরজা খোলার আওয়াজ হতে মেহেদীর বুকে হালকা কাঁপুনি শুরু হলো, মাম্মি কী ওকে চিনতে পারবে? মাম্মি তো ওকে দেখেনি, পারিজাতের অ্যালবামের ছবিতে দেখেছে, সেই চেহারাতো আর নেই। দুই বছর জেলের অন্ধকার ঘরে থেকে চেহারা পুরো বদলে গেছে। গায়ের রঙ তামা হয়েছে, চামড়াগুলো কুঁচকে গেছে, দুই বছর আগে মাথা ভর্তি ঘন কালো চুল ছিল, সেই চুলগুলো এখন সাদা হয়ে গেছে, দেহের ওজন কমেছে, গাল মুখ ভেঙ্গে চুপসে গেছে, মাম্মি যদি ওকে চিনতে না পারে!
দরজা খুলে গেছে, মাম্মি দাঁড়িয়ে আছে, মাম্মি একইরকম আছে, একেবারে কবিতার মত স্বচ্ছ, দুই বছর আগে পারিজাতের অ্যালবামে মাম্মির ছবি দেখেছে, ফেসবুকে তো মাম্মির কত ছবি দেখেছে, ছবি দেখে মেহেদী সুন্দর সুন্দর কবিতার ছন্দে কমেন্ট লিখেছে, হায়! কোথায় চলে গেছে সেই দিন! যাক, যা চলে গেছে তা নিয়ে আফসোস করতে নেই, মাম্মী তো চলে যায়নি, চোখের সামনেই দাঁড়িয়ে আছে, মাম্মি একইরকম আছে দেখতে!
ওমা! মাম্মি হাসছে, মাম্মি কাঁদছে, মাম্মি আমাকে চিনতে পেরেছে, মাম্মি সেই বিখ্যাত ‘মাম্মি’জ হিন্দীতে বলছে, “ বেটা, মেরা বেটা, মেরা মেহেদী, তুম চলা আয়া, হামকে সাথ মিলনে কে লিয়ে তুম চলা আয়া? আম্মি ক্যায়সা হ্যায়, আব্বাজি, শাহরুখ----- মেহেদী আর কিছুই শুনতে পেলো না, শুধু টের পেলো ও জেসমিন সুরভিত এক নারীর বুকে মাথা রেখে কাঁদছে, এই নারীর কাছে ফিরে আসবে বলেছিল সে, জেলের অন্ধকার ঘরে দিনগুলো যখন কাটতেই চাইতো না, তখন সে খুব বেশী করে মাম্মির কথা, পারিজাতের কথা কল্পনা করত। মাম্মি চিঠি লিখতো, চিঠিতে ‘মাম্মি’জ হিন্দী’তে লেখা থাকতো,
“বেটা, ক্যায়সি হ্যায় আপ, তুমকো দেখনা চাহতা হ্যায়, ম্যায় তো ভগবান কো হর রোজ পূজা করতা হ্যায়, ম্যায় তুমকো লিয়ে বহুত রোতি হ্যায়, ভগবান তো মেরা প্রার্থনা জরুর পুরা করেগা, একদিন তো তুমকো সাথ জরুর মিলেঙ্গি”।
মাম্মির হিন্দী ভাষা কেউ বুঝতে পারতোনা কিন্তু মেহেদী বুঝতে পারতো। মেহেদিও মাম্মীকে ঊর্দূতে লিখত, “ মাম্মি, তোমার ধর্ম, আমার ধর্ম, সব ধর্মেই ভালোবাসার কথা বলে, মায়ের কথা বলে, পুত্রের কথা বলে, জন্ম, মৃত্যু, পুণর্জন্মের কথা বলে”। মাম্মী জানতে চেয়েছিল ইসলাম ধর্মে পুণর্জন্মের কথা বলে কিনা! মেহেদী লিখেছিল, হিন্দুরা যেমন পূর্ব জন্ম বিশ্বাস করে, আমাদের ধর্মেও পূর্বজন্ম আছে, কিন্তু একটু অন্যভাবে। সেটা হচ্ছে আল্লাহ আমাদের দেহ তৈরী করার আগে আলাদা আলাদা স্পিরিট তৈরী করেন। পৃথিবীতে আসার আগে সকল স্পিরিটগুলো আরেকটা জগতে ঘুরাফেরা করে, সেখানে একজন আরেকজনের সাথে বাপ-মা-ভাই-বোনের মতই সম্পর্ক হয়, পৃথিবীতে আসার পরে কে কোথায় ছড়িয়ে যায়। কখনও যদি সেই স্পিরিট জগতের পরিচিত কারো সাথে দেখা হয়ে যায়, তাকে খুব আপন মনে হয়, অনেকদিনের চেনা মনে হয়, মনে হয়, কোথায় যেন দেখেছি। মাম্মি, তুমি নিশ্চয়ই সেই স্পিরিট ওয়ার্ল্ডে আমার মাম্মি ছিলে, নাহয় আন্টি, বড় বোন ছিলে, কে জানে, কিছু একটা ছিলে, তাই পাকিস্তানের মাটি ছেড়ে তোমাকে আমেরিকার মাটিতে খুঁজে পেয়েছি। আমার খুব ইচ্ছে হয়, পরের জন্মে যেন তোমার বেটা হয়ে, পারিজাতের ভাই হয়ে তোমার কোলে ঠাঁই পাই।
‘চটাস’ করে একটা আওয়াজ কানে আসতে মেহেদী চমকে উঠেছে, এদিক ওদিক তাকিয়ে শব্দের উৎস খুঁজতে যেয়ে ও নিজের কাছেই নিজে ধরা পরে গেছে। বেশ কিছুদিন বাদে আজ মাম্মির চিঠি এসেছে, মাম্মির চিঠি পড়ার পর মেহেদি আমেরিকা চলে গেছিল, এতক্ষণ নিউইয়র্কে মাম্মির বাড়িতে মাম্মীর বুকে মাথা রেখে কাঁদছিল, কখন ও ঘুপচি ঘরে ফিরে এলো! এই ঘুপচি অন্ধকার ঘরটায় সে নিজে ছাড়া ‘চটাস’ শব্দ করার আর তো কেউ নেই, আছে, মেহেদী ছাড়াও এই ঘুপচি ঘরে শ’খানেক মশা আছে, আর ঘরের বাইরে টুলে বসে আছে আদিল আব্বানি। আদিল আব্বানি পাহারাদার, মেহেদীকে দিনরাত চব্বিশ ঘন্টার মধ্যে বারো ঘন্টা পাহারা দেয়, বাকী বারো ঘন্টা পাহারা দেয় দরবেশ আলী। চটাশ শব্দটা কী আদিল করেছে? ওকে কী মশা কামড়েছে নাকি ও খেয়াল করেছে যে মেহেদী কাঁদছে! খেয়াল করলে বিপদ, জেলারের কাছে রিপোর্ট যাবে, জেলারের কাছে সব খুঁটিনাটি বিষয়েও রিপোর্ট যায়। মেহেদী কখন মাথা চুলকালো, কখন পা চুলকালো এসব রিপোর্টও যায়। জেলার সাব খুবই চিমসে স্বভাবের, মাঝে মাঝেই মেহেদীকে ডেকে এইসব ফালতু কথা নিয়ে রসিকতা করে। কান্নার রিপোর্ট জেলারের কাছে পৌঁছালে জেলার হয়তো জানতে চাইবে,” কাঁদছিলে কেন? মরতে ভয় পাও? নাকি গার্ল ফেরেনডের জন্য মন পোড়ায়!”
প্রায় দুই বছর হয়ে গেলো, এই ঘরটাতে মেহেদী বন্দী হয়ে আছে, লোহার গারদের বাইরে চব্বিশ ঘন্টা পাহারায় থাকে কেউ না কেউ, ঘরটা এত ছোট, মেহেদী পা লম্বা করে বসতেও পারেনা, শুতেও পারেনা, মশারা মনের আনন্দে উড়ে বেড়ায়, চারদিকে স্যাঁতস্যাঁতে নোনা ধরা দেয়ালের গায়ে কিছু মশা বসে থাকে, কিছু মাকড়সা, ঘরের কোণায় তেলাপোকাও থাকে। মেহেদী তেলাপোকা সহ্য করতে পারেনা, তেলাপোকা দেখলেই গা সিরসির করে উঠে, কিন্তু এই ঘরটায় মশা, তেলাপোকা, মাকড়সার সাথেই ওকে বসবাস করতে হয়।
ঘরটার মধ্যে এত গরম, মেঝেটা পর্যন্ত যেন গরমে তেতে আছে। আজ সোমবার ছিল, আব্বা এসে দেখা করে গেছেন। আব্বাকে দেখে মেহেদীর চোখে পানি এসে গেছিল, কোনমতে চোখের পানি লুকিয়েছে। আব্বাকে চোখের পানি দেখানো যাবেনা, কোন অবস্থাতেই আব্বার সামনে ভেঙ্গে পড়া চলবেনা। আব্বা এখনও বিশ্বাস করেন, আল্লাহ মেহেদীকে এই কয়েদখানা থেকে মুক্তি দিবেন। প্রতি সোমবার পুত্রের সাথে ত্রিশ মিনিট সাক্ষাৎশেষে ফিরে যাওয়ার সময় মেহেদীর কপালে চুম্বন করেন, দোয়া দরুদ পড়ে ছেলের গায়ে ফুঁ দেন, এরপর বলেন, “ আল্লাহ মেহেরবান, দ্বীন দুনিয়ার মালিক আল্লাহ, বেটা, ভয় নেই, তোমার আম্মি সারা দিনরাত জায়নামাজে বসে থাকেন, ইবাদত বন্দেগী করেন, আল্লাহ তোমার আম্মির মোনাজাত কবুল করবেন ইনশাল্লাহ! তুমি তোমার আম্মির কোলে ফিরে যাবেই যাবে”।
আজও আব্বা একই কথা বলেছেন, তখনই মেহেদীর চোখ ফেটে পানি আসতে চেয়েছে। আব্বা জানেনা, এই জীবনে মেহেদীর আম্মির কোলে ফিরে যাওয়া হবেনা, ওরা মেহেদীকে হত্যা করবে।
গত সপ্তাহে আব্বা এসেছিলেন দুঃসংবাদ নিয়ে, মেহেদীকে লাহোর জেলে স্থানান্তর করার জন্য আদালতে যে পিটিশন জমা দেয়া হয়েছিল, বিচারক সেই আবেদন খারিজ করে দিয়েছেন। মুলতানের জেলেই মেহেদীকে থাকতে হবে মৃত্যুদন্ড কার্যকর হওয়ার আগে পর্যন্ত। মেহেদী এখন মৃত্যুর জন্য অপেক্ষা করছে। যদিও এখন পর্যন্ত ওর কেইস আদালতে উঠেনি, ওর বিরুদ্ধে বড় কোন অভিযোগ পাওয়া যায়নি, তবুও ওকে বিনা অপরাধে ব্লাসফেমী আইনে আটক করে রাখা হয়েছে। কোন আইনজীবী ওর হয়ে মামলা লড়তে চাইছেনা, যিনি লড়তে চেয়েছিলেন, তাঁকে মৌলবাদীরা হত্যা করেছে। মেহেদীর ইদানিং খুব ভয় করে, নিজের জন্য না, আম্মি আর আব্বার কথা ভেবে। ওর মৃত্যুসংবাদ উনারা কীভাবে সহ্য করবেন? লাহোর জেলে স্থানন্তর করার আবেদন বাতিল হয়ে যাওয়া মানেই ব্লাসফেমী আইনে যে কোনদিন ওকে মেরে ফেলা হবে, গত সপ্তাহেই একজনকে মেরে ফেলেছে।
গত সপ্তাহে আব্বা এসেছিলেন খালি হাতে, তার আগের কয়েকটি সপ্তাহেও খালি হাতেই এসেছিলেন। প্রতি সোমবার আব্বা আসেন, মেহেদী অপেক্ষা করে কখন আব্বা উনার কোটের গোপন পকেটে হাত দিবেন এবং ইতি উতি তাকিয়ে ছেলের কপালে চুম্বন করার ফাঁকে টুপ করে একটি খাম ছেলের হাতে গুঁজে দিবেন। এই খামটি মেহেদীর খুব প্রিয়, আমেরিকা থেকে আসে, মাম্মি আর পারিজাতের চিঠি থাকে খামের ভেতর। এক মাস আগে মাম্মির কাছ থেকে চিঠি এসেছিল, মেহেদী সেই চিঠির উত্তর দিতে পারেনি। এইজন্যই বোধ হয় মাম্মি গত তিন চার সপ্তাহে আর কোন চিঠি পাঠাননি।
জেলের এই অন্ধকার ঘরে মেহেদীর দিন-রাত কাটতে চায়না, ছয় মাস আগে জেলার সাহেব বরাবর আবেদন করেছিল যেন তাকে বই পড়ার অনুমতি দেয়া হয়, কবিতা লিখার অনুমতি দেয়া হয়। সে উচ্চশিক্ষিত ছেলে, এটা ভেবেই হয়তো জেলার সাহেব কিছু ইসলামিক বই আর খাতা কলম ব্যবহার করার অনুমতি দিয়েছে। ও চেয়েছিল কীটস, শেলী, শেকসপিয়ারের বই, আর ওকে দেওয়া হয়েছে ইসলামিক বই, ইসলামিক বই হাতে পেয়ে মেহেদী একটু হেসেছিল তবে অখুশী হয়নি, হোক ধর্মীয় বই তবুতো বই, একা ঘরে এই বইগুলো তার বন্ধু। বইগুলো মেহেদীর হাতে আসবার আগে জেলারের অফিস ঘুরে আসে। শুধু বইগুলোই নয়, লেখালেখির পর ওর খাতাও চলে যায় জেলার সাহেবের কাছে। ও খাতায় যা কিছুই লিখেনা কেন, জেলার সাহেব সেই খাতা দেখতে চাইবেনই, কবিতা বুঝুক আর না বুঝুক, জেলার সাহেব হুঁ হাঁ করে খাতা আবার ফিরিয়ে দেয়।
এত কড়াকড়ির মধ্যে থেকেও পাহারাদারের চোখ এড়িয়ে খুব সন্তর্পনে, কবিতা লেখার ছল করে মেহেদি তার মাম্মীর কাছে দুই একটা চিঠি লিখেছিল, সেখানে অবশ্য উল্লেখ করেছিল লেখালেখির সীমাবদ্ধতার কথা। কথায় বলে দেয়ালেরও কান আছে, আর মেহেদী ভাবে, দরজার ওপাশে ঘুমে ঢুলতে থাকা আদিল আব্বানীরও আরেকটা চোখ আছে, খাতা থেকে চিঠি ছিঁড়ে ফেলা অথবা আব্বার জেবের পকেটে চিঠি পাচার করার ব্যাপার আদিল আব্বানির নজর এড়ায়না। সে বোধ হয় কিছু সন্দেহ করেছে, ইদানিং মেহেদীর খাতা প্রতিদিন চেক করা হয়, খাতার পাতা গুনে দেখা হয়, মাম্মির কাছে চিঠি লিখে পাতা ছিঁড়ে রাখার উপায় নেই, এত কড়াকড়ির মধ্যে মাম্মিকে কী করে চিঠির উত্তর লিখবে?
আজ ফিরে যাওয়ার কালে আব্বা যখন মেহেদীর কপাল চুম্বন করছিলেন, আব্বা একটু বেশীই ঝুঁকে এসেছিলেন, চোখের পানি মুছবেন বলে জেবের পকেট থেকে রুমাল বের করার ফাঁকেই ভাঁজ করা ছোট খাম মেহেদীর হাতের মুঠোয় চালান করে দিয়েছিলেন। সাথে সাথে মেহেদীর শরীর টান টান হয়ে উঠে, চকিতে দেখে নেয় আদিল আব্বানীকে, উদাস নয়নে সিলিং এর দিকে তাকিয়ে আছে। কোমড়ের কাছটায় খুব চুলকোচ্ছে, খাম ধরা হাতটি ঢুকে যায় পায়জামার কোমড়ের অংশে, কোমড় চুলকায় আর চিঠির খাম গোঁজা হয়ে যায়। আব্বা বিদায় নেবার পর অন্ধকার স্যাঁতস্যাঁতে ঘরে মেহেদীকে ঢুকিয়ে আদিল আব্বানী ঝন ঝন শব্দে গারদের দরজা বন্ধ করে আংটায় তালা ঝুলিয়ে দেয়।
দুই.
মেহেদী, বেটা আমার, কেমন আছো? আজ আর হিন্দী লিখতে ইচ্ছে করছেনা, ভুলভাল হিন্দী পড়ে তুমি হয়তো মাম্মিটাকে বোকা ভাবো। অবশ্য মাম্মিরা বোকা হয়ে থাকে, তাদের বেটা বেটিরা হয় মহা চালাক। তুমিও আমার মহা চালাক বেটা। মহাচালাক নাহলে কী কেউ পারে অমন ধুমসো পাহারাদারের চোখ ফাঁকী দিয়ে তার মাম্মির কাছে চিঠি লিখতে? আহারে! আদিল আব্বানীকে আমার একটু দেখতে ইচ্ছে করছে, এ তোমাকে পাহারা দিবে কী, একেই তো পাহারা দেয়া দরকার, কাজ ফেলে সে শুধু নাক ডাকিয়ে ঘুমায়, আর সেই ফাঁকে দাগী আসামী তার মাম্মির কাছে কত সুন্দর সুন্দর চিঠি লিখে ফেলে। বেটারা আসামীকে বন্দী করে রেখেছে, আর আসামী কিনা তার মাম্মির কাছে ফিরে যাওয়ার জন্য ফন্দি আঁটছে!
বেটা আমার, তোমার চিঠির কোথাও কোন কষ্টের কথা লেখা থাকেনা, শুধুই মজার মজার কথা, ভার্জিনিয়ার সুন্দর দিনগুলোর কথা, মাম্মির হাতে তৈরী রসমালাই, বিরিয়ানীর স্বাদের কথা, লেখা থাকে ইউনিভার্সিটির বন্ধুদের কথা, শশাংক, জয়া, পারিজাত, মঙ্গলা, অভি, বারসাতের কথা, জয়ার গাড়িতে চড়ে কত রাস্তা ঘুরেছো, সেসব অভিজ্ঞতার কথা। আমি জানি, তুমি খুব কষ্টে আছো, খুব কষ্টকে ভুলে থাকার একটি দারুণ উপায় হচ্ছে সুন্দর অতীত নিয়ে নাড়াচাড়া করা, তাইনা?
তোমার চিঠি পড়ি আর ভাবি, আচ্ছা পাকিস্তানী প্রশাসন এত বোকা কেন? কাকে ধরতে কাকে ধরেছে, কতগুলো মূর্খ, ধর্মান্ধদের অন্যায় আবদারকে সমর্থন দিতে গিয়ে নিজের দেশের এমন হীরের টুকরো ছেলেমেয়েদের কারাগারের অন্ধ ঘরে ফেলে রেখেছে।
তুমি লিখেছো, আমাকে দেখতে ইচ্ছে করে, জানতে চেয়েছো, হিন্দুধর্মে ‘মানত’ বলে কিছু আছে কিনা! জানিয়েছো, ইসলামে ‘মানত’ আছে এবং তুমি ‘মানত’ করেছো যেদিন আমার কাছে আসবে, আমাকে নিয়ে কাছাকাছি মন্দির এবং মসজিদে যাবে। উপাসনালয়ে যাওয়ার পূর্বে আমাকে নাকি একশ গোলাপজামুন বানাতে হবে, সেই গোলাপজামুন তুমি মন্দিরে আর মসজিদে আগত পূণ্যার্থীদের মাঝে বিতরণ করবে।
আমার বেটা, তোমার ‘মানতের’ কথাটুকু পড়ে আমার চোখে জল এসেছিল, মনে পড়ে গিয়েছিল ছোটবেলার কথা। ছোটবেলায় আমি কথায় কথায় খুব মানত করতাম। আগে বলে নেই, হ্যাঁ, হিন্দুরাও মানত করে, খুব বেশী মাত্রায় করে। আসলে ভারত, বাংলাদেশ, নেপাল, শ্রীলংকা, পাকিস্তানের মানুষেরাই খুব বেশী মানত করে থাকে। কারণ এই উপমহাদেশের মানুষগুলো যুগ যুগ ধরে আস্থার সংকটে ভুগছে, এই আস্থার সংকট তৈরী হয়েছে অর্থনৈতিক ভারসাম্যহীনতা থেকে, যতবেশী আস্থার সংকট, তত বেশী ধর্মীয় গোঁড়ামী, ভাগ্যের উপর নির্ভরতা তত বেশী মানত।
আমি অনেক কাল আগে মানত করতাম, তখন আমার জ্ঞান-বুদ্ধি, বিবেক বিবেচনা কম ছিল, অর্থনৈতিকভাবে সচ্ছল ছিলামনা, আস্থার সংকটে ভুগতাম, তাই কথায় কথায় ভগবানের কাছে ‘মানত’ করতাম। একবার কী হয়েছে বলি, আমার বয়স খুব বেশী হলে বারো হবে, মায়ের মুখে শুনেছি যে আমার বাবার নাকি বাহান্ন বছর বয়সে বিরাট ফাঁড়া ছিল, মানে মৃত্যু ফাঁড়া। আমি তো বাবাকে খুব ভালোবাসতাম তাই সেই ফাঁড়া কেটে যাওয়ার জন্য আমি মা কালীর কাছে জোড়া পাঁঠা বলি দেবো বলে মানত করেছিলেম।
একদিন আমার নানীর সাথে কালী মন্দিরে গেছি, একদল ভক্তকে দেখেছি পাঁঠা নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে। শুনলাম পাঁঠা বলি হবে, এটা শুনে আমি খুব উৎসাহী হয়ে পড়লাম, এক কোপে পাঠার দেহ থেকে মাথা আলাদা করে ফেলবে, কী না জানি বীরত্বের কাজ।
পাঁঠাকে যুপকাষ্ঠে রাখা হলো, ব্রাহ্মণ ঠাকুর দেখলাম রামদা হাতে তৈরী, হঠাত কানে এলো, বাচ্চা এক শিশু যেন করুণ স্বরে ‘মা মা’ বলে চীৎকার করে কাঁদছে। তাকিয়ে দেখি, বাচ্চা শিশু তো নয়, পাঁঠাটা কাঁদছে। আমার সারা দেহ কেঁপে উঠলো, ইচ্ছে হলো পাঁঠাটাকে যুপকাষ্ঠ থেকে টেনে বের করে আনি, কিন্তু এটা তো করা সম্ভব ছিলনা। ধার্মিকের দল, আস্থাহীনের দল, নির্লিপ্তের দল আমাকে হয়তোবা দুই গালে দুটো চড় দিত, ঠিক যেমনি করে তোমাকে চড় দিয়ে কারাগারের অন্ধ ঘরে ফেলে রেখেছে। আমি ওখানেই দুই হাতে কান ঢেকে চোখ বন্ধ করে ফেললাম। মুহূর্তেই পাঁঠার কান্না বন্ধ হয়ে গেলো, তাকিয়ে দেখি পাঁঠার দেহ যুপকাষ্ঠের একদিকে পড়ে আছে, ধার্মিকের দল পাঁঠার মাথা থেকে রক্ত সংগ্রহ করছে কালী মায়ের চরণতলে দিবে বলে।
বাসায় ফিরে এসে মা’কে জানালাম, আমি মানতের পাঁঠা বলি দেবো না। মানত পূর্ণ হলে, বাবার ফাঁড়া কেটে গেলে জোড়া পাঁঠা কিনে মা কালীর নামে মাঠে ছেড়ে দেবো। অবোলা প্রাণীর প্রাণ হরণ করে কীসের ধর্ম? মেহেদী, সেই থেকে আমি মানত করা বন্ধ করে দিয়েছিলাম। আমার মানত পূর্ণ হয়েছিল, বাবার ফাঁড়া কেটে গিয়েছিল, জোড়া পাঁঠা কিনে মাঠে ছেড়ে দেয়া হয়েছিল, আমার বাবা এখনও বেঁচে আছেন। আমার মনে হয়েছে, পাঁঠা দুটোর মুক্ত প্রাণের বিনিময়েই বাবার ফাঁড়া কেটেছে।
আমি এই মাঝ বয়সে পৌঁছে আবার মানত করতে শুরু করেছি। কারণ এই মধ্য জীবনে পৌঁছে নতুন করে আস্থার সংকটে ভুগছি। চারদিকে এত অনাচার, অত্যাচার দেখেই বোধ হয় হতাশ হয়ে পড়েছি। কিছু কষ্ট নিওনা মনে, এই যে তোমাকে ধর্মান্ধ মৌলবাদীরা ধর্মের নামে মিথ্যে অভিযোগে ব্লাসফেমী আইনে বন্দী করেছে, তুমি বলো, মাম্মি হিসেবে আমার কী করা উচিত। আমেরিকা বসে থেকে আমি কী করবো, পাকিস্তানে গিয়েই বা আমি কী করবো, আমাকে তো মৌলবাদীরা একটা টোকা দিলেই মরে যাব। আমার তো কোন বড় বড় মানুষের সাথে পরিচয় নেই, হিউম্যান রাইটস নামে কত এন জিও গড়ে উঠেছে, তারা কার অধিকার রক্ষা করছে জানিনা। তোমার মত এমন সৃজনশীল তরুণকেই ওরা অন্ধকারাগার থেকে বের করে আনতে পারলোনা, মেরিডিথের শরণাপন্ন হয়েছিলাম, মেরিডিথ আমাকে জানিয়েছে, এই মুহূর্তে ওরা চুপে চুপে কাজ করতে চায়, কারণ পাকিস্তানের মৌলবাদীরা নাকি ভীষণরকম উগ্র, যে কোন সময় যে কোন খারাপ কিছু করে ফেলতে চেষ্টা করবে।
মেহেদী, বেটা আমার, নিরুপায় আমি তাই ঘুরে ফিরে ভগবানের শরণাপন্ন হয়েছি। আমি তোমার মুক্তির জন্য মানত করেছি। কী মানত করেছি তা বলবোনা, তবে অবশ্যই কোন প্রাণী হত্যা নয়। অবোলা প্রাণীকে হত্যা করে তোমাকে মুক্ত করতে চাইনা। আমি প্রতিদিন প্রার্থণায় বসি, কল্পনাতেই তোমার কপালে ভগবানের আশীর্বাদ ছুঁইয়ে দেই। প্রতি মাসের একটি শনি বা মঙ্গলবার দেবী বিপদনাশিনী মায়ের পূজো করি যেন প্রিয়জনের বিপদ কেটে যায়, সেখানে তোমার নামে মোমবাতি জ্বেলে দেই।
কেন জানিনা, ইদানিং আমার মনে এক ধরণের স্বস্তি, আস্থা, বিশ্বাস, আশা জেগে উঠছে। আমার মন বলছে, ভগবান আমার মানত পূর্ণ করবেন। মন যদি স্বচ্ছ হয়, ইচ্ছে যদি সৎ হয়, ভগবান বা আল্লাহ তাঁর সন্তানের আশা পূর্ণ করেন। অনেকে বলে, ঈশ্বর বা আল্লাহর কোন অস্তিত্ব নেই, সেদিনও স্টিফেন হকিং বলেছেন, মৃত্যুর পরে নাকি আর কিছু নেই, স্বর্গ-নরক নাকি ফেইরী টেইল, কেউ বলে আল্লাহ বড়, কেউ বলে ভগবান বড়! কে বেশী সুপিরিয়র, এই নিয়ে কত হানাহানি, খুনোখুনি। খুনোখুনি করে যে জয়ী হয়, জানিনা তাকে ভগবান বা আল্লাহ কী পুরস্কার দেন।
তবে আমাকে কিন্তু ঈশ্বর ঠিকই পুরস্কার দেন। আমি তো এক সৃষ্টিকর্তায় বিশ্বাস করি, তিনি নিখিল বিশ্বের অধিপতি, তাঁর এক নাম ভগবান, এক নাম আল্লাহ, কেউ আদর করে ডাকে গড। কারো বিশ্বাসের সাথে আমার বৈরীতা নেই, আমি সর্বত্র, সবকিছুতেই ঈশ্বরকে খুঁজি। কারো ক্ষতি চাইনা, সকলের মঙ্গল চাই, আমি বিশ্বাস করি ঈশ্বরের দেখা পেতে হলে পাহাড় জঙ্গলে না ছুটে গেলেও চলে, অন্তরে সততা, মননে শুদ্ধতা, মনের কোমলতাই ঈশ্বর দর্শনের মূল শর্ত। আমি ইদানিং খুব চেষ্টা করছি ঈশ্বরের দেখা পেতে, কেন জানো? তোমার মুক্তির জন্য, আমি ঈশ্বরের দেখা পেলে মনের সকল সংকীর্ণতাকে তাঁর সামনে বিসর্জন দেবো, মনের সকল শুদ্ধতা, সততা, ভালোবাসা, মমতা, প্রেম, স্নেহকে একত্র করে ঈশ্বরের চরণে নিবেদন করে তোমার মুক্তি চাইবো। তুমি মুক্ত হয়ে তোমার আম্মির বুকে মাথা রাখবে, আম্মির জ্বলে যাওয়া অন্তর শীতল হবে, তুমি আব্বার কাঁধে হাত রাখবে, আব্বার কুঁজো হয়ে যাওয়া দেহ সোজা হবে, শাহরুখকে বুকে জড়িয়ে ধরবে, ও গ্লানিমুক্ত হয়ে যাবে। এরপর তুমি আমার কাছে আসবে।
তুমি আসার পর আমরা দুজনে মিলে গোলাপজামুন তৈরী করবো, মাম্মি আর বেটা একত্রে কাছাকাছি মন্দিরে যাব, মসজিদে যাব। মাম্মি আর বেটার মানত পূর্ণ করবো মন্দির-মসজিদে আগত পূণ্যার্থীদের মিষ্টিমুখ করিয়ে। তুমি চলে এসো মেহেদী, আমি অপেক্ষায় থাকবো।
মাম্মি