লুবনা রোজ দিনের মত আজকেও ব্রেকটাইমে টি-রুমের নির্দিষ্ট সীটটিতে বসে সবেমাত্র লাঞ্চ বক্স খুলেছে, মুখোমুখি দরজায় চোখ পড়তেই উলটো দিক থেকে জয়েস’কে ঢুকতে দেখলো। জয়েস এই স্টোরের কাস্টমার সার্ভিস ম্যানেজার। গোলগাল চেহারা, শরীর বাঁধুনী কেমন যেন ঢিলেঢালা ধরণের, সাদা চামড়া, সোনালী চুল, চোখে মোটা লেন্সের চশমা। চুলের কাট বার্বি ডলের মত, মুখে এক ধরণের হাসির ছোঁয়া লেগে থাকে। চাকরীর প্রথমদিকে জয়েসকে দেখলেই লুবনার খুব ভাল লাগতো। কেমন মায়াবী চেহারা, দেখলেই ছোট খালার মুখ মনে পড়ে যায়। ছোট খালার বয়সীই হবে হয়তো, টেনে টুনে পঞ্চাশ হবে হয়তো। লুবনার ছোট খালার মুখেও অনেক মায়া আছে। জয়েসকে দেখলে এখনও ভালো লাগে, তবে আগের মত স্বস্তি পাওয়া যায়না। লুবনা জানতো, জয়েসের চার ছেলেমেয়ে, নাতি নাতনিও আছে। নিজের পার্সে ছেলেমেয়েদের ছবি আছে, যখন তখন ছোট্ট নাতনীদের কাছ থেকে ফোন আসে, ফোন পেলেই জয়েসের হাসি মুখখানা আরও অনেক বেশী লাবন্যময় হয়ে উঠে।
জয়েসকে দেখে অস্বস্তি শুরু হয়েছে খুব বেশীদিন হয়নি। লুবনাদের ডিপার্টমেন্ট ম্যানেজারের নাম লরা, ইয়া বিশাল দেহ, সাদা চামড়া, মুখখানাতে পুরুষালী ছাপ থাকলেও চেহারা সুন্দর, পরিশ্রম করতে জানে, গলায় ছয় রঙা সূতার মালা, দেখে মনে হয় মাদুলী বাঁধা, কানে ছয়টি করে ফুটো আছে, ছয় ফুটোতেই ছয় রঙের রিং, লালচে স্ট্রেইট চুলগুলোকে ছয় রঙা রাবার ব্যান্ড দিয়ে পনি টেইল করে বেঁধে রাখে। কথাবার্তায় মেয়েলী কোমলতা নেই, খুব কমান্ডিং ভয়েসে কথা বলে অভ্যস্ত সে। লরা ম্যানেজার, মানে লুবনার বস, এমন পুরুষালী বসকে লুবনা ভয় পেত, প্রয়োজনের বাইরে কখনওই বসের সাথে কথা বলতে যেতো না। তাই লরার পরিবার সম্পর্কেও কিছু জানতোনা। একদিন খুব আলতো করে লরাকে জিজ্ঞেস করেছি, “লরা, তুমি কি বিবাহিত”? লুবনার এই প্রশ্নে লরা চমকে উঠেছিল, বলেছিল, “না, বিয়ে করার প্রশ্নই আসেনা”। লুবনা বুঝে পেলোনা, এই প্রশ্ন শুনে লরা কেন চমকে উঠলো। আমেরিকাতে এমন প্রশ্ন সবাই সবাইকে করে। প্রশ্ন নিয়ে লুবনা চিন্তিত ছিলনা, লরার চমকানো দেখে ও ভয় পেয়েছিল। ভেবেছিল, এই রে! কালকেই না জানি লুবনার চাকরীটা খোয়া যায়। নাহ! শেষ পর্যন্ত চাকরী খোয়া যায়নি, লরাও কিছু মনে রাখেনি। লরা কিছু মনে রাখেওনা। ওর মধ্যে মেয়েলী কুটকচাল নেই বললেই চলে।
অনেক আগে প্রায় প্রায় জয়েসকে লরার কাছে আসতে দেখা যেত, জয়েস আসলেই লুবনার সহকর্মীরা পরস্পর মুখ টিপে হাসতো। লুবনা ভেবে পেতোনা, এই দুজনকে একসাথে দেখে সবাই মুখ টিপে হাসে কেনো? ওদের দুজনকে দেখে তো বোন মনে হয়, বোনে বোনে দেখা সাক্ষাৎ হতেই পারে। এই নিয়ে অত হাসির কি থাকতে পারে! লুবনা ওর এক সহকর্মীকে জিজ্ঞেস করেছিল, “ওরা দুজন কি বোন”?
লুবনার প্রশ্ন শুনে সহকর্মী হাসতে হাসতে গড়িয়ে পড়ে, হাসি থামিয়ে বলে,
“ওরা দু’জন প্রেমিক-প্রেমিকা।“
লুবনা হেসে দিয়েছে, বলেছে, “ কি যা-তা বলো সব সময়”।
মেয়েটি বলে, “ লরা হচ্ছে প্রেমিক, জয়েস প্রেমিকা। তুমি কি কখনও লরাকে দেখেছো কোন ছেলের সাথে খাতির করে কথা বলতে? লরা মহিলা হলেও ও পুরুষ”।
এখানে ইয়াং ছেলেমেয়েরা এভাবেই কথা বলে। আমি মেয়েটিকে বললাম, “ কিন্তু আমি জানি জয়েস বিবাহিত, ওর চার ছেলেমেয়ে আছে”।
“আছে বলোনা, বলো ছিল। ওর স্বামীর সাথে ডিভোর্স হয়ে গেছে, ও এখন লরার সাথে প্রেম করে। এক বাড়ীতে থাকে”।
সেই থেকে জয়েসকে দেখলেই লুবনার খুব অস্বস্তি হয়, নারীতে নারীতে প্রেম, ছি ছি ছি! জয়েস স্বামীর ঘর ছেড়ে এই মাঝ বয়সে লরার বাড়ীতে উঠেছে, লরার সাথেই লীভ টুগেদার করছে, ভাবতেই কেমন ঘেন্না লাগে, এই থাকা তো আর রুমমেট বা সাবলেট হয়ে থাকা নয়, এ তো আরও অন্যকিছু। আসলে এরা কেউ পুরোপুরি সুস্থ নয়, এইজন্যই আমেরিকাতে সাইকিয়াট্রিস্টদের এত দাম।
লুবনাদের কোম্পাণীতে প্রতি দুই ঘন্টা কাজের ফাঁকে পনের মিনিটের বিরতি, এটাকে ওরা বলে টি-ব্রেক। নামেই টি-ব্রেক, এখানে কেউ চা খায় না, ওরা ভাবতেই পারেনা লুবনাদের দেশে চা গরম খায়, অরা তো এখানে বরফ শীতল চা খায়, অনেকটা কোক, পেপ্সীর মত করেই ‘আইসড টি’ খায়, চা গরম খেতে জানেনা বলেই টি-রুমে চায়ের কোন ব্যবস্থা নেই, কফি মেকারে শুধু কফি ফুটতে থাকে। লুবনা কফি খায়না, কফি খেলেই ওর ইউরিনারী ট্র্যাক ইনফেকশানের যন্ত্রণা ফিরে আসে। অনেক ছোটবেলা থেকেই লুবনার এই সমস্যা আছে, প্রায়ই শরীর কষে যায়, তলপেটে ব্যথা হয়, প্রস্রাবে জ্বালা-পোড়া হতে থাকে। এমন হলেই লুবনা বুঝে যায়, সামনের দিনগুলো খারাপ আসছে। ইনফেকশান হলে ওর শরীর কাহিল হয়ে পড়ে, প্রতি পাঁচ মিনিট পর পর বাথরুমে গিয়ে বসে থাকতে হয়, প্রস্রাবের বেগ হয়, কিন্তু প্রস্রাব হয়না। কি কষ্ট কি কষ্ট! দেশে থাকতে তো কত রকমের টোটকা চিকিৎসা চলতো। একটা চিকিৎসা ছিল মেহেদী পাতা ভেজানো পানি, প্রতিদিন শরবতের মত খেলেই হতো। আরেকটি ছিল রসুন আর কালোজি্রা বাটা। এদেশে তা পাবে কোথায়, কিছু হলেই ডাক্তারের কাছে ছোটো, কত পয়সা বেরিয়ে যায়। তাই লুবনা প্রিকশান হিসেবে কফি পান থেকে নিজেকে বিরত রাখতে চেষ্টা করে।
যেখানে বাঘের ভয়, সেখানে রাত হয়। জয়েস কফির কাপ হাতে এসে লুবনার পাশের চেয়ারেই বসলো। জয়েসের দিকে তাকিয়ে লুবনা শুকনো হাসি দিয়ে বললো, “কেমন আছো জয়েস”।
জয়েসওও মিষ্টি করে হাসি দিয়ে বললো, “আমি ভাল, তোমার খবর কি?”
-আমার কোন খবর নেই, কখনওই খবর থাকেনা। অনেক ধন্যবাদ আমার কুশল জানতে চেয়েছো বলে।
লুবনা খেয়াল করলো, জয়েস তার আই ফোনে কাউকে মেসেজ পাঠাচ্ছে। পাঁচ মিনিটের মধ্যেই লরা চলে এলো। লরা এসে লুবনাকে ‘হাই’ দিয়েই জয়েসের উল্টোদিকের চেয়ার টেনে বসে বেশ জোরে জোরে নিঃশ্বাস ফেলছিল। একেবারে ছেলেদের ভঙ্গীতে। লরার সব চালচলন ছেলেদের মত, কথা বার্তাও বলে পুরুষালী ভঙ্গীতে। লরা-জয়েস যুগলের মধ্যে লরা হচ্ছে পুরুষ, জয়েস নারী।
ওরা দু’জন খুব বেশীদিন হয়নি সংসার শুরু করেছে। এই সব সংবাদে লুবনা এখন আর বিচলিত হয়না, আগে হতো। ছেলে আর ছেলে, মেয়ে আর মেয়েতে গলা জড়াজড়ি করে হাঁটছে, হঠাৎ করে এ ওকে চুমু খাচ্ছে, নাহলে দুজনে হাত ধরাধরি করে হয়তো দাঁড়িয়ে কোন একটা জিনিস দেখছে, মাঝে মাঝেই একজন আরেকজনকে ‘হানি’ ডাকছে, আমেরিকার মাটিতে দাঁড়িয়ে এখন এগুলো খুব স্বাভাবিক দৃশ্য মনে হয়। যদিও লুবনার কাছে এদেরকে দেখলেই মনে হয় কতগুলো অপূর্নাঙ্গ মানুষ। ওদের জীবনটাই অসম্পূর্ণ, বড়ই কষ্টের জীবন ওদের। ওদেরকে দেখলেই লুবনার জহির মামুর কথা মনে পড়ে যায়। জহির মামু এখন কোথায় আছে কে জানে।
লুবনা খুব সাধারণ পরিবার থেকে এসেছে, যেখানে নিত্য কলহ লেগেই থাকতো। বাবা-মা, ভাই-বোন, পাড়া-প্রতিবেশীদের মধ্যে সারাদিন প্রতিটি ক্ষুদ্র জিনিস নিয়ে কাজিয়া, ঝগড়া, কাড়াকাড়ি নিত্য দিনের ব্যাপার ছিল। পাড়া-প্রতিবেশীদের মধ্যে মহিলারা তো ঝগড়া করতোই, মাঝে মাঝে দুই একজন পুরুষও এসে যোগ দিত সেই ঝগড়ায়। ঝগড়াগুলো তেমন বড় কোন বিষয় নিয়ে হতোনা, জল আনতে গিয়ে ঝগড়া, কে লাইন ভেঙ্গেছে, কে কার বালতী সরিয়ে দিয়েছে, আর নাহলে কার ছেলে কার মেয়েকে দেখে শিস বাজিয়েছে, এই সকল ছোটখাটো বিষয় নিয়ে ঝগড়া হতো।
লুবনারা বিরাট বড় বাড়ীতে ভাড়া থাকতো, সবগুলো টিনের চালা দেয়া ঘর, একসাথে লাইন ধরে এমাথা থেকে ওমাথা পর্যন্ত চলে গেছিল। কত বিচিত্র পেশার লোক ছিল ঐ ভাড়াবাড়ীতে। সবাই প্রতি সকালে যার যার কাজে চলে যেত, একজন মাত্র পুরুষ ছিল, যে ছেলেদের সাথে সঙ্গ না করে মহিলাদের সাথে সঙ্গ করতো। তাকে বাচ্চারা সকলেই জহির মামু বলে ডাকতো। জহির মামু দেখতে দারুণ সুন্দর ছিল, লম্বা-চওড়া, মেদহীন শরীর, মাথায় ঘন কালো চুল, চোখ দুটো কি যে মায়াবী ছিল, কিন্তু মামুর চালচলন ছিল মেয়েদের মত। কেমন করে হাত-পা নেড়ে নেড়ে কথা বলতো, কোমড় দুলিয়ে হাঁটতো, মহিলাদের পাশে বসে আড্ডাও দিত, কখনও কখনও ভাবীদের মাথার চুল আঁচড়ে দিয়ে বেনী করে দিত, কত ডিজাইনের বেনী যে করতে পারতো জহির মামু, আবার সময় সময় ভাবীদের সাথে গলা চড়িয়ে ঝগড়া করতো। জহির মামুকে আড়ালে লুবনার মা-খালারা ‘মাইগ্যা’ ডাকতো। জহির মামু অবশ্য বাচ্চাদেরকে খুব ভালোবাসতো, মায়েরা যেমন করে ভালোবাসে, ঠিক তেমন করে। লুবনা পড়ালেখায় ভালো ছিল, ক্লাসে ফার্স্ট হতো। ক্লাস এইটে তো টেলেন্টপুলে বৃত্তি পেয়ে সেই টিনের চালাঘরের সবাইকে তাক লাগিয়ে দিয়েছিল। জহির মামু লুবনাকে কাছে ডেকে মাথায় হাত দিয়ে অনেক আদর করেছিল, রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের ‘সোনার তরী’ উপহার দিয়েছিল।
লুবনা মেধাবী ছাত্রী হলেও লেখাপড়া বেশীদূর করতে পারেনি। বাবার চাকরীর মেয়াদ শেষ হয়ে যায়, পেনশানের টাকায় ওর মা লুবনার বিয়েটা আগে সেরে ফেলে। লুবনার স্বামী রেজাউল ডিভি লটারী পেয়েছিল, সেই সূত্রে ওরা আমেরিকায় আসে। লুবনার এক ছেলে, মায়ের মত মেধাবী হয়েছে। খুব ভাল রেজাল্ট করেছে। লুবনার মাঝে মাঝে খুব কষ্ট হয়, যদি বাবার চাকরীটা আরও পাঁচ বছর চলতো, লুবনা লেখাপড়া শেষ করতে পারতো। মাঝপথে থেমে যেতে হতোনা। এখানে এই কোম্পাণীতে ক্যাশিয়ারের চাকরীও করতে হতোনা। কি মূর্খদের সাথে ওর উঠাবসা, কেউ ওর নামটাও ঠিকমত উচ্চারণ করতে পারেনা, লুবনা কে বলে ‘লিউবনা’,অসহ্য লাগে।
পনের মিনিট শেষ, লুবনাকে কাজে ফিরে যেতে হবে। একটু সময় এদিক ওদিক হওয়ার জো নেই, চোখের সামনেই ‘লরা’ বসে আছে, লুবনার সামনে বসে বান্ধবীর সাথে পিরীত করতে পারছেনা বলেই বার বার হাত ঘড়ির দিকে তাকাচ্ছে, লুবনাকে বুঝিয়ে দিতে চাইছে টি ব্রেক পনের মিনিটের। লুবনা সবই বুঝে, কিন্তু ভাবে তা প্রকাশ করেনা। লরা চোখ তুলে এক মুহূর্ত লুবনাকে দেখলো, তারপরেই যেন হঠাৎ মনে পড়ে গেছে এই ভঙ্গীতে বললো,
“লিউবনা, তুমি কি এখন কাজে ফিরে যাচ্ছ?
-হ্যাঁ, আমার টি ব্রেক শেষ, ফিরে যাচ্ছি।
-কাইন্ডলী টেরেসাকে পাঠিয়ে দেবে?
-ঠিক আছে, গিয়ে ওকে বলবো।
টেরেসা উড, ২৩ বছর বয়সী সুন্দরী, গায়ের রঙ মোমের মত সাদা, ত্বক মসৃণ, চেহারা দেখে মনে হয় উড বংশের কোন এক পুরুষ জাপানী ছিল। এত সুন্দর দেখতে এই মেয়ে, কিন্তু সম্পূর্ণ মেয়ে নয়। মানে কখনও মেয়ে, কখনও মেয়ে নয়। যেমন এই যে লরা ওকে ডেকে পাঠালো, এখন ও মেয়ে নয়, আবার টেরেসা যখন হেড ম্যানেজার কোডি’কে দেখলেই দৌড়ে গিয়ে জড়িয়ে ধরে, তখন টেরেসাকে মেয়ে মনে হয়। মানে টেরেসা পূর্ণাঙ্গ নারী নয়। এদেশে এদেরকে ‘গে’ বা’লেসবিয়ান’ বলা হয়, ‘গে’ বা ‘লেসবিয়ান’ দেখলেই লুবনার মনে হয়, ওরা কেউ সম্পূর্ণ মানুষ নয়, মৎসকন্যারা যেমন অর্ধেক মানুষ আর অর্ধেক মাছ, এরাও তেমনি অর্ধেক মানুষ আর অর্ধেক, আর অর্ধেক কি? এখানে এসেই লুবনা ঠেকে যায়, বুঝতে পারেনা বাকী অর্ধেক কি?
টেরেসাকে যখন প্রথম দেখেছিল, লুবনার বুকের মধ্যে খুব সূক্ষ্ম ব্যথা বোধ হচ্ছিল। যে কোন সুন্দরী মেয়েকে দেখলেই লুবনার বুকে ব্যথা হয়, হতে পারে সূক্ষ্ম ঈর্ষাবোধ থেকেই এই যন্ত্রণা। টেরেসাকে দেখার পর লুবনার মনে হয়েছিল, এমন একটি মেয়েকে যদি পুত্রবধূ করা যেত, হোক সে আমেরিকান, ওর ছেলেও তো আর পুরোপুরি বাঙ্গালী নেই, আধা বাঙ্গালী আধা আমেরিকান হয়ে গেছে, কাজেই আমেরিকান মেয়ে বিয়ে করলেই ক্ষতি কি।
লুবনার ছেলের বয়স আগামী মাসে ২৬ পূর্ণ হবে। ইঞ্জিনিয়ারীং পাশ করে এখন চাকরী করছে। থাকে অনেক দূরে, ক্যালিফোর্ণিয়াতে। লুবনা চাইছে ছেলেকে বিয়ে দিয়ে সংসারী করে দিতে। অনেকবার ছেলের কাছে বিয়ের কথা তুলেছে, বিয়ের প্রসঙ্গ উঠলেই ছেলে কেন জানি মা’কে শুধু এড়িয়ে যায়। লুবনা ভাবে, বিয়ের কথায় ছেলে লজ্জা পায়, লুবনার স্বামী তো এসব ব্যাপারে কোন কথা বলেনা। সে নাকে মুখে পরিশ্রম করে শুধু পয়সা উপার্জন করে, কারণ তাকে প্রতি মাসে দেড় হাজার ডলার দেশে পাঠাতে হয়, তার পাঠানো টাকায় ওখানে ওদের বিশাল রাক্ষসের বংশ প্রতিপালিত হয়। শ্বশুরবাড়ীকে লুবনা মনে মনে ‘রাক্ষসের বংশ’ ডাকে। যতই দাও, সব পেটে চলে যায়। বোকা স্বামী বুঝেও বুঝেনা, পঁচিশ বছর আগেও যা পাঠাতো, এখনও তাই পাঠায়। লুবনা ভেবে পায়না, পঁচিশ বছরেও কি ওদের বাড়ীর হাল ধরার মত কেউ দাঁড়ায়নি।
শ্বশুরবাড়ীর প্রতি চরম বিতৃষ্ণা থেকেই লুবনার মনে হয়েছে, ছেলে যদি আমেরিকান বিয়ে করে, সেটাও দোষের কিছু হবেনা। নিজে স্বাধীনতা পেলামনা, ছেলেটা অন্তত স্বাধীনভাবে জীবন কাটাক। কোন পিছুটান থাকবেনা, জীবনের আনন্দ, বেঁচে থাকার আনন্দ যেন সে পূর্ণ মাত্রায় ভোগ করতে পারে, সেজন্যই ছেলের ইচ্ছের বিরুদ্ধে লুবনা কিছু করবেনা বলে ভেবে রেখেছে।
টেরেসাকে দেখার সাথে সাথেই লুবনার মনে ছেলে বিয়ে করানোর তাগিদ মাথা চারা দিয়ে উঠেছিল। কিন্তু এই মেয়ে কি তার ছেলেকে বিয়ে করতে রাজী হবে? পরক্ষণেই মনে হয়, এই মেয়ের রূপ ছাড়া আর তো কিছু নেইও, স্কুল পাশ করার পর আর লেখাপড়া করেনি, এখানে সেখানে কাজ করে, যা আয় রোজগার হয় তা দিয়েই ফূর্তি করে। লুবনার ইঞ্জিনিয়ার ছেলেকে পেয়ে তো এই মেয়ের বর্তে যাওয়ার কথা। ওর একটা ছবি তুলে ছেলের কাছে পাঠিয়ে দিতে পারলে হতো।
লুবনা তখনও জানতোনা, টেরেসা লেসবিয়ান। পুত্রবধূ করার ইচ্ছেটুকু মনের মধ্যে রেখে খোঁজ খবর করতে শুরু করেছিল। একদিন মাইশা নামের এক তরুণী সহকর্মীকে জিজ্ঞেস করলো,
“মাইশা, তুমি কি আমাকে টেরেসার ফ্যামিলি সম্পর্কে কিছু তথ্য দিতে পারবে?”
মাইশা তো এই প্রশ্ন শুনে অবাক। এখানে তো কেউ কারো ফ্যামিলির তথ্য জানতে চায় না, লুবনা কেন জানতে চাইছে? মাইশা বললো, “টেরেসার ফ্যামিলি সম্পর্কে তেমন বেশী কিছু জানিনা, ওর বাবা একজন কাঠমিস্ত্রী, দ্বিতীয় বিয়ে করে সেই বউ নিয়ে সুখেই আছে। টেরেসার মা এই মুহূর্তে চতুর্থ স্বামীর ঘর করছে, আর টেরেসা আপাততঃ তিন নাম্বার বান্ধবীর সাথে আছে। হঠাৎ টেরেসার ফ্যামিলির কথা জানতে চাইছো কেন?”
লুবনা প্রথম খেয়াল করেনি মাইশার কথা, টেরেসা এই মুহূর্তে তার তিন নাম্বার বান্ধবীর সাথে আছে শুনে ভেবেছে, কোন মেয়ের সাথে বোধ হয় রুম শেয়ার করে থাকে।
তাই লুবনা বললো, -আমার ছেলের বিয়ের বয়স হয়েছে, ওর জন্য মেয়ে দেখছি, টেরেসা এত সুন্দরী, ভেবেছিলাম আমার ছেলের সাথে যদি বিয়ে দেয়া যায়।
লুবনার কথা শেষ না হতেই মাইশা হেসে ফেললো। বললো, “কি বলো তুমি? ও তো লেসবিয়ান।
-অ্যাঁ, টেরেসা লেসবিয়ান?
-তুমি কি জানতে না যে টেরেসা লেসবিয়ান? ও পুরোপুরি লেসবিয়ানও না। মাঝে মাঝে ওর ছেলে বন্ধুও থাকে। এই মেয়ে তো পুরা একটা চিজ। অনেক আগে ওর একজন ছেলে বন্ধু ছিল, কিন্তু সেই ছেলে বন্ধুর সাথে বেশীদিন থাকেনি। হঠাৎ করে ও মেয়ে বন্ধু খুঁজতে শুরু করে। এখনকার মেয়েটি ওর তিন নাম্বার গার্ল ফ্রেন্ড।
-গার্ল ফ্রেন্ড, সেটাও আবার তিন নাম্বার?
-হ্যাঁ, সেটাও তিন নাম্বার। মজার কথা শোন, সেদিন এক ছেলে এসেছিল, আমাদের রেজিস্টারে যখন চেক আউট করে, তখন বোধ হয় টেরেসাকে বলেছিল, ওর সাথে ডেটিং এ যেতে ইচ্ছুক কিনা। টেরেসা মুখের উপর বলে দিয়েছে, ও কোন ছেলের সাথে সম্পর্ক তৈরীতে ইচ্ছুক না। ছেলেটি বলেছে ‘কেন? সমস্যা কোথায়?’ তখন টেরেসা বলে, ছেলেরা আমার চাহিদা মেটাতে পারেনা।“
মাইশা এ পর্যন্ত বলতেই লুবনার কান মাথা গরম হয়ে উঠলো। মাইশাকে থামিয়ে দিল। বললো, “ সত্যি বলেছে এই কথা?
-হ্যাঁ, সত্যি বলেছে, ও তো মুখের উপর কথা বলে। তাছাড়া তোমার তো জানা উচিৎ ছিল, ওর হাতের উল্কীতেই তো লেখা আছে, “আমি লেসবিয়ান’।
-ছি ছি, কেমন নির্লজ্জের মত মুখের উপর বলে দিতে পারলো, ছেলেরা আমার চাহিদা মেটাতে পারেনা! মাই গড! এমন কথা শোনার আগে আমার কান দুটো কেন বধীর হয়ে গেলোনা!
লুবনার কথা বলার ভঙ্গী দেখে মাইশা হেসে ফেললো। সাথে যোগ করলো, “খেয়াল করোনি আমাদের ম্যানেজার লরা’র সাথে টেরেসার কত ভাব! লরাও তো লেসবিয়ান। লরার গলায় দেখোনা ছয় রঙা সূতার মালা।
-এই ছয় রঙ কি লেসবিয়ানের চিহ্ন?
-শুধু লেসবিয়ান কেন, যে কোন সমকামীদের চিহ্ন। আমি ছয় রঙের মানে জানিনা, কিন্তু এট আওদের চিহ্ন। ওরা একসাথে থাকতে ভালোবাসে বলেই সঙ্গী খোঁজে। সবাই তো আর টেরেসার মত মাইক বাজিয়ে বলেনা, “ আমি লেসবিয়ান’ শরীরের যে কোন একজায়গায় ছয় রঙার চিহ্ন থাকা মানেই-------
-আচ্ছা মাইশা, টেরেসা না হয় ইয়াং, যা ইচ্ছে করতে পারে কিন্তু জয়েস তো বুড়ী হয়ে গেছে, তার উপর জয়েসের চারটি ছেলেমেয়ে আছে, জয়েস কি বুঝে লেসবিয়ানের খাতায় নাম লিখালো? লেসবিয়ান কি চাইলেই হওয়া যায়?
-লিউবনা, শোন, আমেরিকাতে ক্রেজী মানুষের সংখ্যা বেড়ে যাচ্ছে। সবাই অ্যাডভেঞ্চার করতে ভালোবাসে। আমার মনে হয় গে আর লেসবিয়ান হয়ে যাওয়াটাও অ্যাডভেঞ্চার করার মত ব্যাপার। জয়েসের স্বামীর সাথে বনাবনি হচ্ছিলনা বলে সে স্বামীকে ডিভোর্স দিয়ে আমাদের লরা’র কাছে চলে আসে। তবে লরা কিন্তু আসলেই লেসবিয়ান। ও কোন পুরুষের প্রতি আগ্রহ দেখায়না। ও খালি ওর টাইপ মেয়েদের খোঁজে। দেখবে, আমাদের সাথে গরম সুরে কথা বললেও টেরেসার সাথে কেমন ন্যাকা সুরে কথা বলে।
-মাইশা, কিছু মনে করোনা, একটা কথা বলি, আমেরিকানরা কেউ পুরোপুরি সুস্থ নয়।
- এভাবে বলোনা, আমিও আমেরিকান, তুমিও আমেরিকান, আমরা তো সুস্থ, তবে ওদের সংখ্যা বাড়ছে। তুমি বলছো, ওরা সুস্থ নয়, কিন্তু এমনওতো হতে পারে ওরা অনেক বেশী সুস্থ। তুমি আমি অনেক কথা, অনেক ইচ্ছে মনে চেপে রাখি, সাহসে কুলায়না বলে প্রকাশ করিনা, এভাবে আমাদের মনের কত আশাই অপূর্ণ থেকে যায়, মনে কষ্ট নিয়ে ঘুরে বেড়াই, এটাও তো সুস্থতা নয়, তাইনা?
-মাইশা, আমার কথাতেই ফিরে এলে, তার মানে আমেরিকাতে কেউই পুরোপুরি সুস্থ নয়। হা হা হা!তোমার কথা থেকে বলি, হতে পারে, আমরা অনেক কথা মনে চেপে রাখি, সমাজের ভয়ে প্রকাশ করিনা, তাই বলে নারী-পুরুষের সম্পর্কের শাশ্বত সুন্দর রূপটিকে এভাবে অবহেলা ভরে প্রত্যাখ্যান করে ‘আমরা সমকামী’ নামের অস্বাভাবিক সম্পর্ক নিয়ে আন্দোলন করা, না, মানতে পারছিনা। স্বামী-স্ত্রীতে বনাবনি হয়না, ডিভোর্স নাও, অথবা পৃথক থাকো, তা না করে -------এইজন্যই টেরেসাকে এখন আর সুন্দর মনে হয়না, জয়েসকে দেখে এখন আমার আর ভালো লাগেনা। “
টেরেসাকে পুত্রবধূ হিসেবে পাওয়া গেলোনা বলে লুবনার মন খারাপ হয়ে গেল। হঠাৎ করেই যেন লুবনার চোখে টেরেসা ভিলেন হয়ে উঠলো। এখন টেরেসাকে আর সুন্দরী মনে হয়না, কেমন নির্লজ্জ মনে হয়। আচ্ছা, ওকে কি বলা যায়, মেয়ে না ছেলে? পুরোপুরি লেসবিয়ানও বলা যাবেনা। কারণ রেজিনা নামের আরেক সহকর্মীর কাছ থেকে জানতে পেরেছে, টেরেসা নাকি বলেছে, ও একই সাথে ক্যারেন নামের এক মেয়ে, এবং জর্ডান নামের এক ছেলের সাথে ডেট করছে। ওকে যে ‘ট্র্যানসজেন্ডার’ বলা যাবে, সেটাও সম্ভব না। ওর সারা গায়ের জায়গায় জায়গায় বাহারী ছয় রঙের উল্কী করা আছে, সেখানে চাইনীজ সাইনে বলা আছে, ‘আমি লেসবিয়ান’। এই ধরণের মেয়েকে কি কখনও পূর্ন মানবী বলা যায়?
লুবনা মাঝে মাঝেই ভাবে,কি উদ্ভট দেশ এই আমেরিকা, কি উদ্ভট মানুষ এখানে। গণতন্ত্রের নামে কি স্বেচ্ছাচারীতা! বাক স্বাধীনতার নামে যাহা ইচ্ছে তাই বলে যায়, যাহা ইচ্ছে তাই করে যায়। এদেশেই সম্ভব, এদেশে সমকামীরা প্রেম করে, প্রেম ছুটেও যায়, আবার নতুন প্রেমিক খুঁজে নেয়। ওরা বিয়েও করতে চায়, বিয়ের দাবী তুলে সংসদে বিল আনে, বিল পাস করায়। ওদের সংখ্যা কি দ্রুতহারে বেড়ে চলেছে, আমেরিকার ভোটের রাজনীতিতে ওরা এখন বিশাল ফ্যাকটর হয়ে দাঁড়িয়েছে!
লুবনা খুব দ্রুত টিফিন খাওয়া শেষ করে ফেললো, উঠতে হবে। এই দুই অসম্পূর্ণ মানবীর সামনে আর বেশীক্ষণ বসে থাকা নিরাপদ নয়। কে জানে, কখন ওদের ভুত লুবনার কাঁধে এসে ভর করবে! বলা তো যায়না, এই দেশে অ্যাডভেঞ্চার করার নামে এরা যে কত উদ্ভট কাজ করে।
লজ্জা শরম বলেও তো একটা ব্যাপার থাকে। যা সুস্থ, যা স্বাভাবিক, সেটিই তো হওয়া উচিত। বাংলাদেশে কি ‘সমকামীদের প্রেম’ বলে কোন বিষয় আছে? খোলামেলা এমন দাবী কেউ কখনও করতে পারবে? আবার জহির মামুর কথা মনে পড়ে গেলো। মহা ধুমধামে জহির মামুর বিয়ে খেয়েছিল লুবনা। বরযাত্রী গেলো, মামুর পাশে বসে এক থালায় ‘জামাই খানা’ খেলো, বৌভাত খেলো মহা আনন্দের সাথে, এরপর ফিরা যাত্রায় নতুন মামী বাপের বাড়ী গেল, আর ফিরে এলোনা। নতুন মামীর বাপের বাড়ী থেকে জহির মামুর বিরুদ্ধে মামলা ঠোকা হলো, ডিভোর্সের মামলা। এই ঘটনার পর থেকে মামু খুব নীরব হয়ে থাকতো, পাড়ার ভাবী-বৌদিদের সাথে আর গল্পও করতোনা, ঝগড়াও করতোনা। একদিন মামু তার বিছানাপাটি, সংসার তুলে অন্য জায়গায় চলে গেলো।
লুবনা বড় হয়ে শুনেছে, জহির মামু পুরুষ হলেও তার পুরুষত্ব ছিলনা। উনার আব্বা-আম্মা জোর করেই উনার বিয়ে দিয়েছিলেন, কিন্তু বিয়ের রাতেই নতুন মামী জেনে যায় তার স্বামী পূর্নাঙ্গ পুরুষ নয়। তবে ঐ বাড়ীর মহিলারা খুব নিষ্ঠুর ছিল, জহির মামুর এই শারীরিক অসম্পূর্ণতাকে ঝগড়ার হাতিয়ার বানাতো। ঝগড়া লাগলেই যে কোন উছিলায় ‘মাইগ্যা জহির’ এর কথা তুলতো। কবে ‘মাইগ্যা জহির’ কোন ভাবীর কাছে কি কানকথা লাগিয়েছে, কবে ‘মাইগ্যা জহির’ কোন ভাবীর ছোট ছেলেকে তার সাথে শুতে বলেছে, এই সমস্ত নোংরা কথা শুনে শুনে হারিয়ে যাওয়া জহির মামুর জন্য লুবনার কষ্ট হতো। এখন ভাবছে, জহির মামুকে যদি আমেরিকা নিয়ে আসা যেত, তাহলে--------------।
লুবনার স্বামী পাশের রুমে গভীর ঘুমে অচেতন, নাক ডাকার আওয়াজ আসছে। লুবনার চোখে ঘুম নেই, হাতের সামনেই রাখা আছে এক গ্লাস পানি আর হালকা নীল রঙের পনের বিশটি ছোট দানার ট্যাবলেট। কি সুন্দর নীল রঙ। লুবনার খুব ডিপ্রেশান গেছিল গত একটি বছর। তখন ঘুম হতোনা, ডাক্তার খুব লো ডোজে স্লিপীং পিল দিয়েছিল। লুবনা এক দুটো খেয়েছিল, আর খায়নি, কারণ একেক দিন লুবনা এত বেশী ঘুমাতো যে কাজের সময় পেরিয়ে গেলেও ঘুম ভাঙ্গতোনা, তাই কাজে যেতে দেরী হতো, লেট মার্ক হয়ে যেতো। কিন্তু ট্যাবলেট ভর্তি ওষুধের শিশিটা রয়ে গেছিল। পয়সার কেনা জিনিস, হাতে ধরে ফেলতেও পারেনি। আজ সেটা কাজে লাগবে। আজ লুবনার পূর্ণ ঘুম দরকার। এমন ঘুম যে কাজে যাওয়ার সময় পেরিয়ে গেলেও ক্ষতি নেই, লেট মার্ক হওয়ার কিছু থাকবেনা, মানুষই থাকবেনা, তার আবার লেট মার্ক কি! পানির গ্লাস থেকে এক চুমুক পানি খেয়ে লুবনা ভাবলো, “আচ্ছা, আমার বয়স কত! মাত্র চুয়াল্লিশ বছর, আমার কি জীবনের সমস্ত কাজ শেষ হয়ে গেছে? আমার কি এখনই পূর্ণ ঘুমে ঢলে পড়ার সময় হয়ে গেছে? আমি কি কোন কাজ অসম্পূর্ণ রেখে যাচ্ছি? গতরাতেও তো আমার চিন্তা চেতনা জুড়ে ছিল সংসার আর ছেলে। এখন কেন মনে হচ্ছে, আমার জন্য কিছুই থেমে ছিলনা, আমার জন্য কিছুই থেমে থাকবেনা। আমি না থাকলেও আমার স্বামী কাজ করবে, বাড়ীতে পনেরোশো ডলার পাঠাবে, আমি না থাকলেও আমার ছেলে ঠিকই চাকরী করবে, পুরুষ স্ত্রী নিয়ে সংসার করবে। হ্যাঁ, পুরুষ স্ত্রী নিয়েই সংসার করবে, কারণ এটা বাংলাদেশ না, এখানে কেউ ওর গায়ে পাথর ছুঁড়ে মারবেনা, কেউ ওকে ‘মাইগ্যা’ বলে গালি দিবেনা, ও একজন অসম্পূর্ণ মানব হয়েও জীবনের আনন্দ পুরোপুরি ভোগ করবে, আমার অসম্পূর্ণ ছেলে সুখে থাকবে, এটুকু জানাই তো আমার জীবনের পূর্ণতা। কাজেই আমি ঘুমাতেই পারি, পূর্ণ ঘুম, পূর্ণ বিশ্রাম।
একটি মাত্র চিঠি, একটি মাত্র চিঠিতেই লুবনার জীবনটা আজ এলোমেলো হয়ে গেছে। চিঠি এসেছে ক্যালিফোর্ণিয়া থেকে। লম্বা লম্বা পাঁচ লাইনে লেখা চিঠি,
“মা, ছেলে বাংলায় চিঠি লিখছে দেখে অবাক হয়েছো, তাইনা? আমি তো তোমার অবাক ছেলে, সবসময় তোমাকে অবাক করতে ভালোবাসি। তোমাকে অবাক করে দেবো বলে বাংলা শিখেছি। মা, আগামী রবিবার আমি জর্জকে বিয়ে করতে যাচ্ছি। অবাক হয়েছো জানি, কিন্তু আমাদের জন্য দোয়া করতে ভুলে যেওনা”।
ছেলের চিঠিটি সরু করে ভাঁজ করে মাল্টিভিটামিন ট্যাবলেটের সাইজ করে পানি দিয়ে গিলে ফেললো। এবার ঘুমাতে যেতে হবে। আরেকটি ছোট্ট কিন্তু খুবই জরুরী কাজ বাকী আছে, ঘুমুতে যাওয়ার আগমুহূর্তে একটি সাদা কাগজে লুবনা লিখলো,
“আমি অনেক দিন আরামে ঘুমাইনি, আজ হঠাৎই যেন আমার খুব আরামে ঘুমাতে ইচ্ছে করল। আমার এই হঠাৎ ইচ্ছের কথা কাউকেই জানাইনি, কারণ এমন ইচ্ছের কথা জানার পরে কেউ আমাকে ঘুমাতে দিতে চাইতোনা। তাই আমি সকলকে না জানিয়ে, কারো ঘুম না ভাঙ্গিয়ে চুপচাপ ঘুমাতে গেলাম। সবার জন্যই আমার দোয়া থাকলো, জগতের সকলেই সুখে থাকুক”।
লুবনা