এ কোন সকাল!!

ভোর (মে ২০১৩)

রীতা রায় মিঠু
  • ১১
  • ২৮
এ কোন সকাল, রাতের চেয়েও অন্ধকার!

প্রিয় পারমিতা,
আশা করি ভাল আছিস। তোর চিঠির শেষ লাইনটি দিয়েই শুরু করি। তোর প্রতিটি চিঠি শেষ হয় আমার জন্য একটি উপদেশবাণীতে। বাণীটি হচ্ছে, বেশী রাত জাগা ভাল নয়, বিশেষ করে এই বয়সে। হা হা হা! তোর পরামর্শের প্রতি পূর্ণ শ্রদ্ধা রেখেই বলছি, আমার দ্বারা এটা সম্ভব হবে না। দুই একদিন চেষ্টাও করেছিলাম, রাত বারোটা বাজার আগেই বিছানায় গেছি, এপাশ –ওপাশ করেছি, ঘুম আসেনি, শেষ পর্যন্ত বিছানা ছেড়ে আমার প্রিয় চেয়ারে গিয়ে বসতেই মনটা ঝরঝরে আনন্দে ভরে গেছে। বিশ্বাস কর, রাত তিনটা বাজতেই আপনা আপনি ঘুমে চোখ জড়িয়ে এসেছে। ছোটবেলা থেকে রাত জেগে পড়াশোনা করা আমার অভ্যাস। হঠাৎ করে চাইলেই তো আর বদলানো যাবে না। আচ্ছা, তুই এখনও ভোরের আকাশ দেখিস? সেই যে হোস্টেলে থাকতে, আমরা সবাই যখন কাঁথা মুড়ি দিয়ে আরামে ঘুমাতাম, তুই ঘড়ির কাঁটায় পাঁচটা বাজতেই কাঁথা কম্বল ফেলে লাফিয়ে উঠে যেতি। এক দৌড়ে বারান্দায় চলে যেতিস, ফাঁকা বারান্দার রেলিং ধরে দাঁড়িয়ে থাকতিস সূর্য্যোদয় দেখার জন্য। বৃষ্টির দিনেও তুই একই কাজ করতিস। তখন বলতিস, বৃষ্টি ভেজা ভোর দেখি। আমরা তোকে নিয়ে কত হাসি ঠাট্টা করতাম, কিন্তু তুই তোর কাজ ঠিকই করে যেতিস।

আসলে আমি ছোটবেলা থেকেই ঘুমকাতুরে। সকাল সাতটার খবর শুরু না হওয়া পর্যন্ত আমি ঘুমাতাম। বাংলাদেশ বেতারে সাতটার খবর শুরু হতো, আমার ঘুম ভেঙে যেত। জানিস, খুব ছোটবেলায় অবশ্য ভোরে ঘুম ভেঙ্গে যেত, একটি দৃশ্য এখনও মনে পড়ে। আমরা থাকতাম একেবারে শীতলক্ষ্যা নদীর তীর ঘেঁষা বাড়ীতে। আমি আর ছোট বোন মোহনা ঘুমাতাম বাবা মায়ের মাঝখানে। মা’কে তো রোজ ভোর সকালেই উঠে যেতে হতো, সাত সকালে উঠে লাকড়ির চুলায় আগুন না দিলে সকাল আটটার মধ্যে ডাল আর ভাত রান্না করতে পারতেন না। বাবা তো সকালে ডাল ভাত খেয়ে অফিস যেতেন। মা বিছানা ছাড়ার কিছুক্ষণ পরেই মোহনা কী করে যেন টের পেয়ে যেত। নিজের ঘুম ভাঙ্গতো, আমার ঘুমও ভাঙ্গিয়ে দিত। প্রতি সকালে দুই বোন মিলে মশারীর ভেতরে থেকে সিনেমা দেখতাম। হ্যাঁ, ওটাকে আমরা সিনেমা বলতাম। আমাদের বাসার সামনেই ছিল বিশাল বড় মাঠ, তার সাথেই নদী। আমাদের জায়গাটার নামই ছিল ‘বন্দর’। ঘাটে জাহাজ ভীড়ে থাকতো, আর সাত সকালে মজুরেরা পাটের বোঝা মাথায় করে সেই জাহাজে তুলতো। ওরা মাঠে যা করতো, সেটার প্রতিচ্ছবি আমাদের মশারীর চালির মধ্যে দেখা যেত। আমরা দুই বোন মিলে সেই সিনেমা দেখতাম। বেশীক্ষণ চলতো না সিনেমা, রোদের আলো আসতেই সিনেমা বন্ধ হয়ে যেত।

কেন হঠাৎ করে তোকে এই সাত সকালের গল্প বললাম, জানিস? অনেক কাল পর আজ খুব ভোরে আমার ঘুম ভেঙ্গে গেছে। এখানে তো আর মশারীর কারবার নেই, তবুও আমি মশারী টাঙিয়ে ঘুমাই। বাইরের জানালার নেটের ফাঁক গলে আবছা আলো আসছিল, বুকটা কেমন যেনো ছ্যাঁত করে উঠলো। মায়ের কথা মনে পড়লো, ছোটবেলার কথা মনে পড়লো, ছোট বোনটার কথা মনে পড়লো, শীতলক্ষ্যা নদীর কথা মনে পড়লো, আজ শুধু অতীতের কথাই মনে পড়লো। ছোট বোনটাকে দেখিনা কত বছর হয়ে গেল। এখান থেকে অস্ট্রেলিয়া যাওয়া যায়, তবে মোহনার হাজব্যান্ড আমাকে পছন্দ করে না। আমি ইচ্ছে করলেই মোহনার জন্য এয়ার টিকেট পাঠাতে পারি, কিন্তু এটা কবীর করতে দেবে না। কবীর বলে, এটা করলে নাকি মোহনার হাজব্যান্ড মাইন্ড করবে। যাক গিয়ে, সবাই মাইন্ড করুক, মূল কথা হচ্ছে দুই বোনের দেখা সাক্ষাৎ নেই। মনটা খারাপ নিয়েই বিছানা ছেড়েছি। বাইরের বারান্দায় বের হতেই চোখে পড়ল পাশের বাসার বুড়ী পেগী সিম্পসনকে। হাসপাতালে যাচ্ছে, অপারেশান হবে। আমার দিকে চোখ পড়তেই বুড়ী সারা গাল ছড়িয়ে হাসি দিল। আমিও আমার ডান হাত উঁচু করে তার হাসির জবাব দিলাম।

পেগী সিম্পসনের গল্পটা তোকে বলি। এই ভদ্রমহিলার বয়স ৬৮ পূর্ণ হবে আগামী সেপ্টেমবার মাসে। কিন্তু তাকে দেখে মনে হয় বয়স আশির কাছাকাছি। গালের চামড়া কুচকে গেছে, মাথার চুল সাদা শোনপাপড়ির মত, একটু কুঁজো হয়ে হাঁটে। পেগীর সাথে আমার প্রথম পরিচয় হয়েছিল ওয়ালমার্ট সুপার সেন্টারে। গত পঁচিশ বছর যাবৎ সে ওয়ালমার্ট সুপার সেন্টারে ক্যাশিয়ার পদে চাকুরী করছে। প্রথম দিন তার ক্যাশ রেজিস্টারে গেছি চেক আউট করতে। বুড়ীকে দেখে মুগ্ধ চোখে তাকিয়ে থাকলাম কিছুক্ষণ। পেগীর মত এমন সুন্দরী মেমসাব মিসিসিপি শহরে দেখিনি। পাঁচ বছর আগের কথা, তখন পেগী এমন বুড়িয়ে যায় নি, ঝা চকচকে সাজগোজ করে থাকতো। চোখে কাজল, মাশকারা, আইশ্যাডো তো ছিলই, গালে থাকতো লালিমা, ঠোঁটে থাকতো গাঢ় লালের প্রলেপ, আর শোনপাপড়ির মত চুলগুলো দেখে মনে হতো পার্লার থেকে সেট করিয়ে এনেছে। তার মুখের প্রতিটি অংশ সৃষ্টিকর্তা হাতে প্রচুর সময় নিয়ে বানিয়েছেন। বাধ্য হয়ে বলেই ফেললাম,

“তুমি এত সুন্দর দেখতে, না জানি যৌবনে কেমন ছিলে!”

বাবারে! বুড়ী যখন মুখ খুললো, তখন বুঝা গেল তার ব্যক্তিত্বের প্রখরতা। সে শুধু বলেছিল,
“দেখতে সুন্দর হলে কী হবে, এই কপালটা সুন্দর না। আমার চেহারা একটু খারাপ হয়েও যদি বিনিময়ে ভাগ্যটা সুন্দর হতো, তাহলে আমার উপকার হতো”।

প্রথম পরিচয়েই এমন কঠিন সত্য শোনার জন্য প্রস্তুত ছিলাম না, তাই হে হে হাসি দিয়ে চলে এসেছিলাম। এরপর তো টি-ব্রেক, লাঞ্চ ব্রেক, রেস্টরুম সহ সর্বত্রই পেগীর সাথে দেখা হতো। মাঝে মাঝেই তাকে দীর্ঘ সময়ের জন্য অনুপস্থিত দেখতাম। তার বন্ধুদের মুখে শুনতাম, পেগী হসপিটালে। কয়দিন পরেই দেখতাম সেজেগুজে পেগী উপস্থিত। টি ব্রেকে কফির মাগে চুমুক দেয় আর হাতের কুরুশ কাঁটায় নানা ডিজাইন তোলে। যা সুন্দর ওর হাতের কাজ, কী আর বলবো। কত জন তার কাছে সেলাইয়ের অর্ডার দেয়, সে এগুলো সব করে। অথচ তার বেশ-ভূষা, চাল-চলন দেখে মনে হয় না যে সে অতিরিক্ত পয়সা রোজগারের জন্য এই ধরণের টুকিটাকী কাজ করে। আসলে সময় কাটানোর জন্যই এত পরিশ্রম। ধীরে ধীরে পেগীর সাথে আমার বেশ খাতির হয়ে যায়। জানতে পারি, ওর স্বামী মারা গেছে ছয় বছর আগে, দুই মেয়ে এক ছেলের মধ্যে একটি মেয়ে মারা গেছে অনেক আগে, আরেক মেয়ে দূরে কোথায় যেন থাকে। মাকে দেখতেও আসে না। ছেলেটা অবশ্য ওর সাথেই থাকে, তবে এটা নিয়ে পেগীর মনে কোন স্ফূর্তি বা আহ্লাদ নেই।

আমরা গত চার বছর ধরে পেগীর প্রতিবেশী। ওর বাড়ীটা অনেক পুরানো হয়ে গেছে, কিন্তু পেগী খুব যত্ন করে। ছেলেটা একাই থাকে মায়ের সাথে, প্রতি উইক এন্ডে নাতিরা আসে বাবার সাথে সাক্ষাতের জন্য। নাতিরা এলে পেগী খুব একটা খুশীও হয় না, বেজারও হয় না। কেমন যেন ওদের ব্যাপার স্যাপারগুলো। সেদিন টি রুমে বসে অনেকেই গল্প করছিল। পেগীও ছিল সেখানে, বললো,

“আগামী তিন দিনের মধ্যে হাসপাতাল যেতে হবে। বিরাট অপারেশান। এবার খুব ভয় করছে। অপারেশানের ধকল সইতে পারলে হয়!”

বললাম,“পেগী,গত বছরই তো স্কিন গ্রাফটিং করালে, আবার কিসের অপারেশান”?

“আমি অপারেশানের উপরেই বেঁচে আছি। প্রথম হার্টে বাইপাস সার্জারী হলো, এরপর ধরা পড়লো স্কিন ক্যান্সার, অপারেশান হলো। এরপর পায়ে ব্লাড ক্লট, অপারেশান হলো। এবারও হার্টে অপারেশান হবে, পাঁচটা ব্লক ধরা পড়েছে। একেকটি অপারেশান হওয়ার আগে ভাবি, আমি কী আর কখনও ভোরের আকাশ দেখবো, অথবা নীল সমুদ্র! এবারও তাই মনে হচ্ছে, তোমরা সবাই আমার জন্য প্রে করো। যেন আবার ঘুম ভেঙ্গে নতুন ঝকঝকে সকাল দেখতে পাই”।

আজ আমার ঘুমটা অত ভোরে ভাঙ্গলো কেন, সেটা নিয়েই ভাবছি। ভালই হয়েছে, পেগী গেল, ওকে হাত তুলে ‘গুড লাক’ জানাতে পারলাম। এবার আমারও একটু দুঃশ্চিন্তা হচ্ছে ওকে নিয়ে। বলতে ভুলে গেছি, পেগী এখন আর সাজে না। দেখে খারাপ লাগে, কষ্ট পাই মনে।মনে প্রাণেই চাইছি, পেগী যেন অপারেশানের ধকল সামলে উঠতে পারে। নতুন সকাল দেখার শখ, তাই যেন হয়—আমেন!

পারমিতা, ভালো থাকিস। এখন রাত বাজে পৌণে তিনটা। এবার ঘুমাতে যাব। তোর বোধ হয় জাগার সময় হয়ে এলো। হা হা হা! আমরা প্রাণের সই, অথচ দুজনে বিপরীত সময়ে ঘুমাই, বিপরীত সময়ে জাগি। পারমিতা, একটা মজার কথা বলে শেষ করি, আমার তো ভোরের বেলা ঘুম ভাঙ্গে না, ব্যাপারটি বাগানের পাখীগুলো খেয়াল করেছে। ওরা রাত বারোটা বাজতেই আমার জানালার কাছে এসে কিচির মিচির করতে থাকে। বিশ্বাস হচ্ছে না? সেটা তোমার ব্যাপার। বিশ্বাস না হলে চলে আয় মিসিসিপিতে। আমার বাগানের পাখীরা তাদের পারমিতা মাসীকে চেনে। ওরা তোকেও গান শোনাবে। ভাল থাকিস। গুডডিমনিকে আমার আদর দিস।

মানসী





প্রিয় মানসী,

তোর চিঠি পেয়েছি গত পরশু। সাধারণতঃ আমি চিঠির উত্তর দিতে দেরী করি না, এবার কিছু বিলম্ব হয়ে গেলো। তুই যে সকালে মিস পেগী সিম্পসনকে গুড লাক জানালি, সেই একই সকালে আমি আমার এক দিদির ষোড়শী কন্যাকে ‘গুড বাই’ জানিয়েছি। গুড বাই মানে গুড বাই, চিরদিনের জন্য বিদায়! মনের সাথে বোঝাপড়া করতে করতেই দু’দিন পার হয়ে গেছে, এখনও বোঝাপড়া শেষ হলো না।
মানসী, দিদির মেয়েটা মারা গেলো গলায় ওড়না পেঁচিয়ে। আমি এখনও ধাতস্থ হতে পারছি না। ঠিকমত গুছিয়ে লিখতেও পারছি না। জানতে চেয়েছিস আমি এখনও ভোরের আকাশ দেখতে সাত সকালেই বিছানা ছাড়ি কিনা! হ্যাঁ, গত পরশু সকাল পর্যন্ত একই নিয়মে ঘুম থেকে উঠেছি, সেই আগের মতই ভোর পাঁচটায়। যথারীতি বাইরের ব্যালকনীতে দাঁড়িয়েছি, ভোরের লালচে আকাশ দেখেছি, বুক ভরে বাতাস নিয়েছি, এরপর ঘরে ঢুকে চুলায় চায়ের কেটলী চাপিয়েছি। ঠিক ঐ মুহূর্তেই বেড রুমে আমার মোবাইলটা বেজে উঠে। তোর দাদার ঘুম ভেঙ্গে যাওয়ার আগেই এক দৌড়ে গিয়ে ফোনটা নিয়ে আসি। হ্যালো বলতেই শুনি অনামিকার কান্নায় জড়ানো কন্ঠস্বর। স্বাভাবিকভাবেই ধরে নিয়েছি, মা বোধ হয় আর নেই। কিন্তু ব্যাপারটা তা নয়, হেঁচকী তুলতে তুলতে অনামিকা বললো,

“ফুলদিদি, অহং সুইসাইড করেছে”!

প্রথমে বুঝতে পারিনি, কী বলছে ও। কার কথা বলছে! অহং টা আবার কে? এটা তো কোনভাবেই সম্ভব হতে পারে না। আমাদের চেনাশোনার মধ্যে একটিই ‘অহং’ আছে, তার বয়স মাত্র ষোল বছর, ও কেন মারা যাবে? অহং এর তো কোন দুঃখ থাকার কথা না, বিশাল ধনী বাবা-মায়ের সন্তান। দুঃখ-দারিদ্র্যের সাথে পরিচয় নেই। ধনীর দুলালীদের মতই রূপ, ধনীর দুলালীদের মতই আহ্লাদী, কাজেই অহং কেন সুইসাইড করবে! এরপর অনামিকা কিছুটা ধাতস্থ হয়ে আমাকে কনফার্ম করলো যে আমাদের ‘অহং’ এর কথাই ও বলেছে। অনামিকা অবশ্য ডিটেইলস জানতো না, শুধু জেনেছে, আগের রাতে বাড়ীতে অনেক হই হুল্লোড়, নাচ-গান চলেছে রাত দেড়টা পর্যন্ত, বড়লোকদের বাড়ীতে যেমন চলে। এরপর যে যার মত ঘরের দরজা লক করে ঘুমিয়ে গেছে। পরদিন সকালে সবাই দেরী করে ঘুম থেকে উঠেছে। অহং বাড়ীর ছোট মেয়ে, তার উপর আহলাদী, বেলা বারোটার আগে ঘুম থেকে জাগবে না, সবাই জানে। দুপুর দেড়টা বাজতেও যখন মেয়ে দরজা খুলেনি, বাইরে থেকে দরজা ভেঙ্গে ঢুকে দেখে অহং বিছানায় নেই, সিলিং ফ্যান থেকে ঝুলছে।

অনামিকা আমাদের সকালে ফোন করেছে, তখন ঢাকায় সন্ধ্যে। আমাদের দিদিকে সিডেটিভ দিয়ে অচেতন করে রাখা হয়েছে, আর পুলিশি ঝামেলা মিটিয়ে অহংকে শ্মশানে নিয়ে দাহ করা হয়ে গেছে। ওর মা জানতেও পারে নি, কোথা দিয়ে, কখন অহংকে সবাই নিয়ে চলে গেছে। মানসী, সংবাদটা পাওয়ার পর থেকে আমার মাথাটা শূণ্য হয়ে আছে। বার বার গুড্ডির দিকে তাকাই, অহং এর চেয়ে তিন বছরের ছোট, কে জানে, ওর মনে কোন অভিমান বাসা বাঁধছে! কে জানে, দিদির মত আমার কপালেও কী অপেক্ষা করছে! অহংদের বাড়ীতে কোন অভাব ছিল না, না চাইতেই সব পেত, তারপরেও অহং কোন না পাওয়ার বেদনা থেকে অভিমান করলো? মায়ের চোখের মনি ছিল, সব কাজ নিজে নিজে করতো, কিন্তু ভাত খাওয়ার সময় হলেই মায়ের ডাক পড়তো। ওর মা খুব আউটগোয়িং পারসন, কিন্তু মেয়ের খাওয়ার সময় ঠিকই হাজির থাকতো। তারপরেও অহংএর মনে অভিমান জমেছিল, সে তুলনায় গুড্ডি তো কিছুই পায় না। ওর অভিমান তাহলে কোন পর্যায়ে পৌঁছাবে বল!

অহং এর খবর জানার পরে কিছুক্ষণ ভোঁতা লেগে বসেছিলাম। ঘন্টাখানেক পরে ফেসবুকে ঢুকলাম। ফেসবুকে ঢুকেই দেখি ভাঙ্গা দালানের ছবিতে সয়লাব হয়ে আছে আমার ওয়াল। খবর পড়ে জানতে পেলাম সাভারের রানা প্লাজার ভবন ধ্বসের সংবাদ। আমার সকালটা শুরু হয়েছিল খুব খারাপভাবে। ওটা ছিল খারাপের দ্বিতীয় অধ্যায়। চট করে মনে করার চেষ্টা করলাম, সাভারের রানা প্লাজার গার্মেন্টস ফ্যাকটরীতে কে কাজ করে! আমার সেই বুয়াটা। মনে আছে তোর, ছোট্টখাটো এক মহিলা, যাকে নিয়ে আমি আর তুই খুব মজা করেছিলাম। কত আনন্দময়ী ছিল লুৎফা বুয়া! আমরা আমেরিকা চলে আসার আগে পরিচিত বন্ধুর গার্মেন্টস ফ্যাকটরীতে ওর একটা চাকুরীর ব্যবস্থা করে দিয়েছিলাম। এখানে এসে শুনেছি, ঐ চাকুরী ছেড়ে সে সাভারের গার্মেন্টস ফ্যাকটরিতে কাজ নিয়েছে। গতবার যখন গেলাম, আমার সাথে দেখা করে গেল। বললো, সে ভালই আছে। আমিও খুব খুশী হয়েছি বুয়ার এমন আত্মবিশ্বাস দেখে। আজকে ভবন ধ্বসের সংবাদ পড়ার পর সাথে সাথেই ফোন দিলাম আমার এক বন্ধু শিখাকে। এই শিখাই আমাকে বুয়ার সন্ধান দিয়েছিল। শিখা জানিয়েছে, বুয়া তখনও বাড়ী ফিরেনি। ঘন্টা দুই পরে আবার ফোন করলাম শিখাকে, বুয়া নাকি সেদিন কাজে যেতে চায় নি, পাড়ার বখাটেগুলো ধমকিয়ে পাঠিয়েছে। শিখা জানালো, বুয়াকে না পেলেও বুয়ার মেয়েকে অক্ষত অবস্থায় পাওয়া গেছে। আর বুয়াকে পাওয়া গেছে দুই দিন পর। সংজ্ঞাহীন অবস্থায় এনাম মেডিক্যাল ক্লিনিকে ভর্তি করানো হয়েছে।

মানসী, বুয়া হচ্ছে আমার নিজস্ব একটা গৌরব। বুয়াকে আমি লেখা পড়া শিখিয়েছি, হাতে ধরে সেলাই শিখিয়েছি। গার্মেন্টস ফ্যাকটরীতে ঢুকিয়ে দিয়েছি। বুয়া তার রোজগারের পয়সায় দেশে জমি কিনেছে, ছেলেটাকে কলেজে পড়াচ্ছে। বুয়ার স্বামী হচ্ছে অলস টাইপ। কোন কাজ করে না। বুয়ার পয়সায় খায়।

আমার মনটা খুব খারাপ। কত ঘটনা ঘটে গেল। মেহেদীর কথা খুব মনে পড়ে। ওর সাথে ইহজীবনে আর দেখা হবে না। অহং এর সাথে সারাজীবনের বিচ্ছেদ হয়ে গেল। বুয়াটার কপালে কী আছে কে জানে! তোর মিসেস পেগী তো আগামী সকালের অপেক্ষায় আছে, কিন্তু আমার বুয়া কী এর মানে বুঝতে পারছে? চেতনাহীন অবস্থায় পড়ে আছে সে। মানুষ কত ভয়ানক হতে পারে!! সাভারের রানা প্লাজা এর প্রমান। চিঠিটা গুছিয়ে লেখা হলো না। মনটা খুব বিক্ষিপ্ত। বেলা এগারোটায় ঘুম থেকে উঠলে তুই মধ্যগগনে সূর্য্য দেখতে পাবি। কিন্তু আমি কাল থেকে আবার ভোরের আকাশ দেখবো।

পারমিতা


আপনার ভালো লাগা ও মন্দ লাগা জানিয়ে লেখককে অনুপ্রানিত করুন
এফ, আই , জুয়েল # হ্যা--- দিদি । পত্রের পরতে পরতে গল্পের কথামালা অসাধারন । আপনাকে ধন্যবাদ ।।
সূর্য কেমন করে যেন আমাদের লেখাগুলোতে দেশের টানাপোড়েণ স্বত:স্ফূর্তভাবেই চলে আসছে। দেখো দিদি পারমিতাও কেমন রানা প্লাজায় বুয়ার মাধ্যমে জড়িয়ে গেল। আসলে আমরা যারা কিছু করতে পারি না তাদের প্রেমটা বোধ হয় একটু বেশিই দেশের জন্য, মানুষের জন্য। আগের গুলোর ধারাবাহিকতায় এটাও মন ছুয়ে যাওয়া সুন্দর পত্র সাহিত্য। তোমার এ পত্রগুলো ভালো লাগা না লাগা নিয়ে আমার বলার কিছু থাকে না( মানে এক কথা বার বার বলতে ভালো লাগে না।) :-)
মিলন বনিক বরাবরের মতোই নিটল নিখুত বর্ণনা....পত্রালাপে গল্পের ধারাবাহিকতা খুব মুগ্ধ করে....খুব ভালো লাগলো...শুভ কামনা....সময় হলে আমার সভার ট্রাজেডি নিয়ে লেখা গল্পটা পরার অনুরোধ থাকলো...
মিলন, অনেক অনেক শুভকামনা তোমার জন্য! তোমার লেখা গল্প পড়লে শৈশবে ফিরে যাই। আমার ভালো লাগে। আমার লেখালেখির অভিজ্ঞতা নেই, গল্পকবিতাডটকম-এ আমার গল্প লেখার হাতে খড়ি। তোমাদের মত শুভাকাংক্ষীদের পাশে পেয়েছি বলে এখনও সাহস করে লিখার চেষ্টা করছি। ভালো থেকো।
মামুন ম. আজিজ চিঠি পাল্টা চিঠি.......এই যুগে চিঠি পড়তেই এক অন্য অনুভূতি হয়....বেশ লিখেছেন দিদি।
মামুন, তোমার মত ভাল লিখিয়ে যখন বলে, "বেশ লিখেছেন দিদি" ---মনে প্রশান্তি নেমে আসে! ভালো থেকো।
খন্দকার আনিসুর রহমান জ্যোতি চির চেনা সেই রিতা রিতা গন্ধটা গল্পের সারাটা অঙ্গ জুড়ে আবারো উপভোগ করলাম.......... সমুজ্বল সৌকর্যে ভাষাশৈলীর কারুকাজ মুগ্ধ করলো.......রিতাদি আপনাকে অনেক ধন্যবাদ..........
জ্যোতি দাদা, অনেক দেরী হয়ে গেলো উত্তর দিতে। শ্রমিকের জীবন, অবসর পাইই না। সারা গল্প জুড়ে রীতা রীতা গন্ধ পাওয়া যাচ্ছে!!!!! এতটা ভালোবাসা পাওয়ার মত অবস্থানে না আসতেই ভালোবাসা পেয়ে গেলাম, সৌভাগ্য আমার, মহানুভবতা আপনার!
এশরার লতিফ আপনার ঝঝরে সুন্দর লেখনী সব সময়ই ভালো লাগে। এবারও ব্যতিক্রম নয়। মৃত্যু এবং মৃত্যবোধ মনে হলো এবারের লেখার ড্রাইভিং ফোর্স । সেই থিম ধরে কতগুলো বিক্ষিপ্ত ঘটনাকে এক সূত্রে গেঁথেছেন। খুব ভালো লাগলো।
এশরার, আমার প্রিয় লেখক, এ মাসের প্রথম পুরষ্কার বিজয়ী লেখাটি পড়ে অভিভূত হয়েছি! এত ভাল লেখো কী করে? আরও কত বছর লিখলে তবেই তোমাদের মত সাবলীল ছন্দে গল্প লিখতে পারবো, কে জানে!
তাপসকিরণ রায় আপনার লেখা পত্রগল্প আমার খুব ভালো লাগে --এ গল্পটিও তার ব্যতিক্রম নয়।পড়তে সামান্য দেরী হলেও পড়েছি।লেখার সাবলীলতা ঠিক আগের মতই স্বচ্ছ ও সুন্দর।ধন্যবাদ।
আমার প্রিয় দাদা, অনেক ধন্যবাদ গো দাদা! কী এক ব্যস্ততার ভেতর দিয়ে সময় পার করছি, একেকসময় অস্থির লাগে! গত দুটি মাস আমি গল্পকবিতায় আসতেই পারছি না। দাদা, এরপরেও আমাকে ভুলে যেননি, আমাকে অবহেলায় ঠেলে দেননি, আমি কৃতজ্ঞ!
তানি হক বরাবরের মত ..এই পর্বটিও অসাধারণ লাগলো দিদি ,, বুয়াকে ঘিরে ..সাভারের ঘটনাটা ..ভিন্নমাত্রা যোগ হয়েছে ...আপনাকে অনেক অনেক ধন্যবাদ ও শুভেচ্ছা
ছোট এবং আদরের বোন তানি, আমি কী করে যেন অনিয়মিত হয়ে গেলাম সাহিত্য বাসরে, জানিনা! আমি খুব মিস করছি তোমাদের সবাইকে। তবে ফিরে আসবো, খুব শীগগীর, ততদিনে আমাকে ভুলে যেও না!
Lutful Bari Panna মুগ্ধ হলাম দিদি
লক্ষ্মী ছেলে পান্না, এত সুন্দর করে মুগ্ধতা প্রকাশ করে, হা হা হা হা!! ভালো থেকো!
সোহেল মাহামুদ (অতি ক্ষুদ্র একজন) গল্পটি ভাল লাগল। কিন্তু এর সাথে ''অন্নপূর্ণার সংসার'' এর গঠনগত মিল রয়েছে বলে মনে হচ্ছে।
অনেক ধন্যবাদ স্বপ্নবাজ, অন্নপূর্ণার সংসার' মুলতঃ 'পারমিতার চিঠি'র সিক্যুয়াল। তাই ওটার সাথে এই গল্পের ধারাবাহিকতা আছে।

১৯ জানুয়ারী - ২০১২ গল্প/কবিতা: ৬৫ টি

বিজ্ঞপ্তি

এই লেখাটি গল্পকবিতা কর্তৃপক্ষের আংশিক অথবা কোন সম্পাদনা ছাড়াই প্রকাশিত এবং গল্পকবিতা কর্তৃপক্ষ এই লেখার বিষয়বস্তু, মন্তব্য অথবা পরিণতির ব্যাপারে দায়ী থাকবে না। লেখকই সব দায়ভার বহন করতে বাধ্য থাকবে।

প্রতি মাসেই পুরস্কার

বিচারক ও পাঠকদের ভোটে সেরা ৩টি গল্প ও ৩টি কবিতা পুরস্কার পাবে।

লেখা প্রতিযোগিতায় আপনিও লিখুন

  • প্রথম পুরস্কার ১৫০০ টাকার প্রাইজ বন্ড এবং সনদপত্র।
  • দ্বিতীয় পুরস্কার ১০০০ টাকার প্রাইজ বন্ড এবং সনদপত্র।
  • তৃতীয় পুরস্কার সনদপত্র।

আগামী সংখ্যার বিষয়

গল্পের বিষয় "স্থিতিশীলতা”
কবিতার বিষয় "স্থিতিশীলতা”
লেখা জমা দেওয়ার শেষ তারিখ ২৫ নভেম্বর,২০২৪