দেখতে দেখতে এগিয়ে এলো আরেকটি ফেব্রুয়ারী, তার সাথেই এগিয়ে আসছে আমাদের পরম আকাংক্ষিত ‘অমর একুশে ফেব্রুয়ারী’। অমর একুশে শব্দটি আমার চেতনাতে আসে আমি যখন দশম শ্রেণীতে পড়ি। এর আগে প্রতিটি একুশে ফেব্রুয়ারীর সকালে স্কুলে যেতাম, সবার সাথে শহীদ মিনারে ফুল দিতাম, বাড়ী ফিরে আসতাম। কিনতু নবম শ্রেণীতে যখন পড়ি, তখন বিজয় দিবস উপলক্ষে আন্তঃস্কুল রচনা প্রতিযোগীতায় অংশগ্রহনের একটা ইচ্ছে জাগে মনে, সেই থেকে শুরু। আমি ঐ প্রতিযোগীতায় অংশগ্রহন করেছিলাম এবং অবাক হয়েছিলাম জীবনে প্রথমবারের মত কোন প্রতিযোগীতায় অংশ নিয়ে ‘প্রথম পুরস্কার’ জিততে পেরে। বিজয় দিবসের সন্ধ্যায় আমাদের পৌরসভার মিলনায়তনে অনেক বড় অনুষ্ঠান করে বিজয়ীদের হাতে পুরস্কার তুলে দেয়া হয়েছিল।
এই ধরনের প্রতিযোগীতা নিশচয়ই আগেও হতো, কিনতু আমার নজরে আসে অনেক পরে। তবে একবার প্রথম পুরস্কার পেয়ে আমার আগ্রহ বেড়ে যায়, অপেক্ষায় থাকি একুশে ফেব্রুয়ারী উপলক্ষে যে কোন প্রতিযোগীতায় অংশগ্রহনের জন্য। পেয়ে গেছিলাম সুযোগ, দশম শ্রেনীতে উঠেই একুশে ফেব্রুয়ারী উপলক্ষে আন্তঃস্কুল রচনা প্রতিযোগীতায় নাম দিয়ে দিলাম। যত বাংলা বই জোগাড় করে পড়তে শুরু করলাম, ধারনা নিতে শুরু করলাম একুশ সম্পর্কে। রচনা লিখে দেখাতে নিয়ে গেলাম আমাদের স্কুলের প্রধান শিক্ষয়িত্রী, বাংলাদেশ কমিউনিস্ট পার্টির নেত্রী মিসেস হেনা দাস (প্রয়াত)কে। প্রধান শিক্ষিকাকে আমরা ডাকতাম ‘বড় আপা’ বলে। বড় আপা আমাকে খুব স্নেহ করতেন, উনি অনেক যত্ন করে আমাকে বুঝিয়ে দিয়েছিলেন যেখানে যা বুঝানোর, উনার নিজের অভিজ্ঞতাও ছিল বৃটিশ বিরোধী আন্দোলন, মুক্তিযুদ্ধ সম্পর্কে। তাই আমি সরাসরি একজন রাজনীতিবিদের সাহচর্য্য পেয়ে রচনাটিকে দাঁড় করিয়ে ফেলেছিলাম। এবারেও আমি ‘প্রথম পুরস্কার’ পেলাম।
প্রথম পুরস্কার পাওয়াটা ঐ বয়সে অনেক বড় ব্যাপার ছিল, কিনতু রচনা লিখতে গিয়ে আমার ভেতর যে দেশপ্রেম বা ভাষাপ্রেমের একটা বোধ জাগ্রত হয়েছিল সেটাই আমার সারা জীবনের সঞ্চয় হয়ে গিয়েছিল। পরবর্তীতে আমি পত্রিকাতে বিভিন্ন কলামিস্টদের কলাম পড়তাম, স্বদেশী আন্দোলনের গল্প শুনতাম মায়ের কাছে, মুক্তিযুদ্ধের উপর রচিত যে কোন বই হাতে পেলেই পড়ে ফেলতাম। এভাবেই বাংলা ভাষার প্রতি আমার এক নাড়ির টান টের পেতে শুরু করি। উচ্চশিক্ষার্থে ইংরেজী পড়তে হয়েছে, সেটাও ভালোভাবে পড়তে পেরেছি শুধুমাত্র নিজের ভাষাটাকে আগে বুঝতে পেরেছি বলে। আমি বাংলা ভাষা ভালো রপ্ত করেছিলাম বলেই ইংরেজী শিখতে গিয়ে কোন অপরাধবোধ মনে জাগেনি। আমার সবসময় মনে হয়েছে নিজের সংস্কৃতি, নিজের ভাষাকে ঠিক রেখে অন্য যে কোন ভাষা শিখলে পরে নিজের ভাষার সাথে তুলনা করা যায়, আর অন্য ভাষার সাথে তুলনা করেই মাতৃভাষার মাধুর্য্যের শ্রেষ্ঠতা নির্নয় করা সম্ভবপর হয়।
আমার ব্যক্তিগত জীবনে আমি অনেক বছর ধরেই প্রবাসে আছি। আমার সন্তানদেরকে অনেক ছোট বয়সে নিয়ে এসেছি। দেশে থাকতেই ওদেরকে আমি প্রতিটি জাতীয় দিবসে, দিবসের গুরুত্ব অনুযায়ী নির্ধারিত স্থানে নিয়ে যেতাম। যেমন একুশে ফেব্রুয়ারীতে শহীদ মিনারে, ছাব্বিশে মার্চে ও ষোলই ডিসেম্বারে স্মৃতিসৌধে, পহেলা বৈশাখে রমনা বটমূলে নিয়ে যেতাম। আমাদের তিন মেয়ের মধ্যে বড় মেয়েটি বাংলার সংস্কৃতি বুঝার মত বড় ছিল, কিনতু পরের দুই মেয়ে বিশেষ করে সবার ছোটটি একেবারে ছোট্ট ছিল যখন আমরা আমেরিকাতে চলে আসি। ছোট মেয়েটির তখন কথা শেখার বয়স, আমরা প্রথমেই এসেছিলাম ওয়েস্ট ভার্জিনিয়া নামের সুন্দর পাহাড় ঘেরা রাজ্যে। প্রকৃতি এখানে এত সুন্দর কিনতু কোন বাঙ্গালী পরিবার ছিলনা আমাদের আশেপাশে। একটি মাত্র বাঙ্গালী পরিবার ছিল, কিনতু তিরিশ বছর আমেরিকায় বাঙ্গালী বর্জিত পরিবেশে থেকে তারাও বাংলা প্রায় ভুলেই গিয়েছিল। আমি টের পেয়েছিলাম যে এখানে আমার মেয়েরা থাকলে বাংলা শিখতে পারবেনা। তাছাড়া দেশে থাকতেই দেখেছি, এক শ্রেনীর মানুষের ছেলেমেয়েরা বাংলায় কথা বলাকে খুবই অরুচীকর মনে করে, দেশে থেকেই তারা চিবিয়ে চিবিয়ে ইংরেজী বলাকেই বেশী আধুনিকতা মনে করে, বাংলা গান শোনাকে মনে করে ব্যাকডেটেড ব্যাপার, আর এইসব নানা কারনেই আমি খুব শঙ্কিত হয়ে পড়ি। ব্যাপারটাকে আমি খুবই সিরিয়াসলি নিয়েছিলাম। তাই আমি ঘরে বাংলা ছাড়া আর কিছুই বলা যাবেনা , এমন আইন করে দিয়েছিলাম। আমার ছোট্ট মেয়েটাকে আমি নিজে ঘরে বসে বাংলা শেখাতাম। অনেক কষ্ট হতো। বাচ্চাটাকে স্কুলে পাঠিয়ে পড়েছিলাম বিপদে। ইংরেজী একবর্ণও জানতোনা মেয়ে, বাংলাতে কথা বলতে পারতোনা স্কুলে, মেয়ের বাবাও চিন্তায় পড়ে গেছিল, কিনতু আমি আমার লক্ষ্য ঠিক রেখেছিলাম। ঘরে দুই একটা ইংরেজী শিখিয়ে দিয়ে তার বাংলা মানে বুঝিয়ে দিতাম। স্কুল থেকে নিত্য নতুন ইংরেজী শব্দ শিখে এসে ঘরে বলতো, সাথে সাথে তার বাংলা করতে বলতাম। ধীরে ধীরে মেয়ে বাংলা ইংরেজী মিলিয়ে কথা বলতে শুরু করে। আবার দেখেছি ইংরেজী বাক্যকে বাংলাতে অনুবাদ করে সেই অনুবাদিত বাংলাতে কথা বলতো। আমি হতাশ হইনি, তাকে তার মত করে বলতে দিতাম এবং পরে শুদ্ধ বাংলাটা বলে দিতাম।
আমার সেই ছোট্ট মেয়েটা এখন বেশ বড় হয়ে গেছে। আমরা এখন মিসিসিপি নদীর তীরে অবস্থিত রাজ্য মিসিসিপিতে থাকি। এখানেও বাঙ্গালী বলতে গেলে একেবারেই নেই, যতটা আছে নিউইয়র্ক, ফ্লোরিডা বা ক্যালিফোর্নিয়াতে। তারপরেও দুই বাংলা মিলিয়ে যে কিছু বাঙ্গালী পরিবার আছে, তারাই চেষ্টা করে একুশে ফেব্রুয়ারী উদযাপন করতে। আমার বড় দুই মেয়ে বাংলাকে খুব ভালোভাবে ধারন করেছে, তারা এখানে আমেরিকান সংস্কৃতির সমান্তরালে বাংলাকে এগিয়ে নিয়ে যাচ্ছে। যার যার শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে তারা নিজেরাই সাংস্কৃতিক সম্পাদকের পদ অলংকৃত করে আছে এবং এই সুযোগে প্রতিটি অনুষ্ঠানেই তারা বাংলা নাচ, গান বা কবিতা আবৃত্তির ব্যবস্থা রাখে। আমার মেয়েরা যে কলেজে পড়ে, সেখানে তারাই একমাত্র বাঙ্গালী, কিনতু প্রতিবার কলেজের বার্ষিক অনুষ্ঠানে আমেরিকান ছেলেমেয়েদেরকে দিয়ে বাংলা গানের সাথে নাচ করিয়ে যাচ্ছে এবং তাদের এই উদ্যোগ বহুল প্রশংসিত হচ্ছে। আমার এক মেয়ের সুপারিশে এই পর্যন্ত তিন আমেরিকান ছাত্রী স্টাডি এবরড প্রোগ্রামে বাংলাদেশকে নির্বাচন করেছে এবং তারা বাংলাদেশে খুব ভালো আছে এমন খবর পাঠিয়েছে। আমার ছোট মেয়েটি, যে খুব কঠিন সময়ের ভেতর দিয়ে বড় হয়েছে, এই কিশোরী বেলায় সে এখন স্পষ্ট উচ্চারনে বাংলা কবিতা আবৃত্তি করে, একুশের অনুষ্ঠানে। আমার ভালো লাগে যখন দেখি আমার মেয়েটা এখন আর অনুবাদিত বাংলা বলেনা। সে বাংলা পড়তে শিখেছে, কিনতু চর্চ্চার অভাবে মাঝে মাঝেই ভুলে যায়, তখন আমি তাকে শাস্তিস্বরূপ অনলাইনে বাংলা পত্রিকা বের করে এক প্যারা করে পড়তে দেই। আমার ঘরে খাওয়া দাওয়া হয় বাংগালী কায়দায় এবং সম্পূর্ন বাঙ্গালী খাবার খাই আমরা। বাংলার সাথে অন্য কালচারের বিরোধ নেই বলে অন্য নানাদেশী খাবারও খাই আমরা, পোশাক পরি বাঙ্গালী কায়দায়, আবার আমেরিকায় থাকি বলে ওয়েস্টার্ণ পোশাকেও আমরা সমান স্বাচ্ছন্দ্য বোধ করি।
আমি আমার জীবনের এই পর্যায়ে এসে নানারকমভাবে বিশ্লেষন করে দেখেছি, আমি আমার দেশের প্রতি, আমার ভাষার প্রতি, আমার সংস্কৃতির প্রতি কোন অবিচার করিনি। জীবনের প্রয়োজনে দেশ ছেড়ে বিদেশে পড়ে আছি, কিনতু দেশকে ধারন করে আছি আমার প্রতিদিনের চলনে, বলনে, জ্ঞান চর্চ্চায়, সন্তান পরিচর্যায়, অতিথি আপ্যায়নে, সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানের মাধ্যমে। শুধুই কি আমি, আরও অনেকেই হয়তো আমার মত করে চেষ্টা করে যাচ্ছেন, বড় আকারে না হলে তা প্রকাশিত হয়না। ষাট বছর পার হয়ে গেলো ভাষার জন্য প্রান উৎসর্গ করেছিলেন সালাম, রফিক, শফিক, বরকত, জব্বারের মত তরুনেরা। আজ আমরা কথা বলছি বাংলায়। আমরা প্রতি বছর একুশে ফেব্রুয়ারী সাড়ম্বরে পালন করেই ক্ষান্ত হইনি, একুশে কে ছড়িয়ে দিয়েছি বিশ্ব দরবারে। আধু্নিক যুগের কিছু তরুনের ঐকান্তিক প্রচেষ্টায় একুশে ফেব্রুয়ারী আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস হিসেবে স্বীকৃতি পেয়েছে, এটা ভাবলেই মনে হয়, এই ছেলেগুলোর মত করে যদি সবাই একুশের চেতনাকে মনের গহীনে লালন করে, এবং দৈনন্দিন জীবনে চর্চ্চা করে, তাহলেই একুশের সার্থকতা, তাহলেই বাঙ্গালী হয়ে জন্মানোর সার্থকতা।