চোখের আলোয় দেখেছিলেম!

অন্ধ (মার্চ ২০১৮)

রীতা রায় মিঠু
  • ১২
  • ১২
আজ কলিং বেল একবার টিপতেই শরিফা খালা দরজা খুলে দিল। অবাক হওয়ার ভঙ্গি করে অরুণা বলল, কী ব্যাপার খালা, আজ যে বেল টিপতেই দরজা খুলে দিলেন! আপনি কি দরজার পাশেই ছিলেন!

- আমি তো মাইনষের পায়ের আওয়াজ গুনতে জানি। তোমার পায়ের আওয়াজ গুনতে গুনতে যেই দরজার ধারে পৌঁছাইছি, অমনি তুমি বেল টিপছো। বলে খালাও হেসে ফেললো।
-ইস রে, পায়ের আওয়াজ গুনতে জানেন। তাহলে অন্যদিন বেল টিপে আমাকে এক ঘন্টা দাঁড়িয়ে থাকতে হয় কেন?
-বুড়া হইছিতো, মাঝে মাঝে গণনায় ভুল করি।
-উফ! কথা একদম রেডি থাকে।
- এই চাপার জোরেই তো টিকে আছি।

লিভিং রুমের পর্দা সরিয়ে অরুণাকে নিয়ে শরিফা বেগম বড় সোফাটায় বসলেন। এই সোফায় বসতে, কাউকে বসাতে পারলে শরিফা বেগমের খুব ভাল লাগে। কারণ সোফাটা তিনি নিজের টাকায় কিনেছেন। সোশাল সিকিউরিটি বাবদ সরকার থেকে যে টাকা পান, তার কিছু তুলে দেন মেয়ের হাতে, সংসার খরচের জন্য, বাকিটা জমিয়ে রাখেন। মেয়ের সংসারে থাকেন, এই বাড়ির সব কিছুই মেয়ে-মেয়ে জামাইয়ের। শরিফা বেগমের আত্মসম্মানবোধ খুব প্রবল। মেয়ের বাড়ি হলেই কি, নিজের সংসার তো নয়। একেবারে বিনে পয়সায় থাকতে সংকোচ হয়।

আমেরিকা আসার পর বড় ছেলের বাড়িতে কিছুদিন ছিলেন, সেখান থেকে ছেলে-ছেলে বউয়ের ঝাঁটা খেয়ে মেয়ের কাছে এসেছেন। উনার স্বামী মারা গেছেন দুই বছর আগে।
মেয়ে জামাই আমেরিকান সাহেব হলেও সে-ই শাশুড়িকে নিজেদের কাছে নিয়ে এসেছে। দেশে থাকতে তিনি জানতেন, আমেরিকায় বাপ মা বুড়া হইলে ওল্ড হোমে পাঠিয়ে দেয়, ছেলে মেয়েরা কেউ বাপ মায়ের খোঁজ খবর করেনা। তিনি নিজেও আমেরিকানদের গালি দিয়ে চৌদ্দ গুষ্টি উদ্ধার করেছেন। আজ যখন নিজের চার ছেলে মেয়ে থাকার পরেও আমেরিকান জামাই উনাকে নিজের বাড়িতে আশ্রয় দিয়েছে, তখন কোন মুখে তিনি আমেরিকানদের বদনাম করবেন।

কেনেডি এবং জিনিয়া দুজনেই চাকরি করে।শরিফা বেগমের খুব ইচ্ছে করে জামাই বাবাজির জন্য কিছু করতে। কিন্তু বাবাজির কোন কিছুর চাহিদা নেই, মাঝে মাঝে শরিফার হাতের ফিরনি, পোলাও খেয়ে ‘গ্রেট গ্রেট’ বলা ছাড়া।
জিনিয়া কিন্তু খুব হিসেবী, মা যে ওর বাড়িতে আছে, অন্য ভাই বোনেরা কেউ মায়ের দায়িত্ব নেয়নি, তা নিয়ে ভাই বোনদের খুব কথা শোনায়। মায়ের জন্য হাত খরচ পাঠাতে বলে। তাতে উনার মন খারাপ হয়, সংসারে উনার কোন অবদান নেই বলেই তাকে নিয়ে ছেলেমেয়েদের মধ্যে এই রশি টানাটানি।


অরুণা প্রায়ই আসে এই বাড়িতে, খুব কাছেই অরুণাদের বাড়ি। একদিন এক গ্রোসারি স্টোরে অরুণার সাথে শরিফা বেগমের পরিচয়। বাড়ি ফেরার পথ হারিয়ে গ্রোসারি স্টোরে তিনি বসেছিলেন, তখন অবশ্য উনার মাথায় গোলমাল চলছিল। মাঝে মাঝেই বাড়ি থেকে বেরিয়ে যেতেন, বাড়ি ফেরার পথ হারিয়ে ফেলতেন। আবার খুঁজে খুঁজে বাড়িতে ফিরেও আসতেন। সেদিন আর ফেরার রাস্তা খুঁজে পাচ্ছিলেননা, অরুণা নামের মেয়েটি উনাকে বাড়ি পৌঁছে দিয়েছিল।
বাড়িতে শরিফা বেগম একা থাকেন। একা থাকতে থাকতেই হয়তো ডিপ্রেশন, ডিপ্রেশান থেকে মাথায় গোলমাল। অরুণার সাথে পরিচয় হওয়ার পর থেকে শরিফা বেগমের মাথার গোলমালটাও অনেক কমে গেছে। অরুণার মা নেই, একমাত্র ছেলে রাতুল অন্য স্টেটে ইউনিভার্সিটিতে পড়ছে। বাড়িতে শুধু ওর স্বামী মনোময় আর অরুণা। মনোময় পেশায় ইঞ্জিনিয়ার, অনেক ভাল চাকরি করে, তাই অরুণার টাকা পয়সার অভাব নেই। মেয়েটা শরিফা বেগমকে খালা ডাকে। প্রায় প্রতিদিন অরুণা খালার বাড়ি চলে আসে, খালার সাথে গল্প গুজব করে। ভাল কিছু রান্না করলে খালার জন্য নিয়ে আসে।

- খালা, কাল বাড়িতে ফোন করে মেসেজ রেখেছিলেন। সরি খালা, কাল ডাক্তারের কাছে গেছিলাম তাই আসতে পারিনি।

- সরি কওনের কিছু নাই। তোমারে ফোন কইরা যখন পাই নাই, বুঝছি কোন কাজে ব্যস্ত। তাই মেসেজ রাখছিলাম। ডাক্তারের কাছে গেছিলা ক্যান?কার অসুখ, তোমার নাকি বাবাজীর?

-কারো অসুখ না। মেমোগ্রাম আর প্যাপসমিয়ার টেস্টের ডেট ছিল। কাল সারাদিনই ক্লিনিকে কেটেছে খালা। বাড়ি ফিরে এত টায়ার্ড ছিলাম যে ঘুমিয়ে পড়েছিলাম। সন্ধ্যার সময় ঘুম ভাঙ্গছে তখন ফোনে আপনার মিস কল দেখি। খালা, আপনি কী সুন্দর করে মেসেজ রেখেছেন, “মাইও, একবার আমগো বাসায় আইতে পারবা?”।

-তুমি তো অনেক দুষ্টু, আমার গলা নকল করতাছো। আমি তো তুমাগো মতন শুদ্ধ ভাষা কইতে পারিনা। কথা কইতে গেলে মাটির ভাষা আইয়া পড়ে।
-খালা, আপনার মাটির ভাষা শুনতে আমার এত্ত ভালো লাগে! মায়ের কথা মনে পড়ে যায়।


- কাইল কী কইছে ডাক্তার? সবকিছু ভাল আছে?

- ডাক্তার রিপোর্ট চেক করে দেখবে, সমস্যা পেলে ক্লিনিক থেকে আমাকে ফোন করে জানাবে।

-মাগো মা, এইসব শুনলে ডর করে। আমগো জিনিয়াও তো এইসব পরীক্ষা করতে যায়। আমারেও কয় যাইতে। আমি অর কথায় গাও করিনা,কী শরমের কথা কও তো। আমি বুইড়া মাগী, কবে কুনকালে পোলাপান বুকের দুধ খাইছে, সন তারিখ ভুইল্লা গেছি। অহন আমার বুক পরীক্ষা কইরা কি পাইব?

-খালা, মেয়েদের জোয়ান বুড়া কোন বিষয় না। আমার এক ফুপু মারা গেছে ব্রেস্ট ক্যান্সারে। উনার বয়স হয়েছিল ৬৯ বছর।

-এমুন দুই একটা ঘটনা সবখানেই ঘটে। তাই বইলা আমি পচাত্তর বচ্ছইরা বুড়ি, আমার বুকের দুধে আছেডা কি শুনি? চামড়া কুচকাইয়া দলা অইয়া গেছে।

খালার এমন খোলামেলা কথা শুনে অরুণার অস্বস্তি হচ্ছিল। তবুও বলল,“ খালা, কিছু সমস্যা না থাকুক। একবার না হয় পরীক্ষা করিয়ে ফেলুন। জিনিয়া আপাও মনে শান্তি পাবে।

-নাগো মাইও, এক পাও কব্বরে দিয়া রাখছি, এহন আর এইতা কইরা কি অইব? আমার ডর করে। বুকের মাই ধইরা টানাটানি করব, ব্যথা পামু ত।।

-খালা, আপনার ব্রেস্ট ধরে কিছুই করবেনা নার্স। একটা মেশিনের সামনে আপনাকে দাঁড় করিয়ে নার্স আপনার ব্রেস্ট এক্স্রে ট্রের উপর রেখে অন্য একটা মেশিন দিয়ে হালকা চাপ দিয়ে পরীক্ষা করবে, ব্যথা পাবেন না।

-নাগো, শরম করে।

-খালা, নার্স তো মেয়ে। এদেশে ওরা ব্রেস্ট টেস্ট নিয়ে লজ্জা শরম করেনা। আমি নিয়ে যাব আপনাকে, পাশে দাঁড়িয়ে আপনার হাত ধরে থাকবো।

-এইডা তো গেলো বুক, আরেকটা কিয়ের কথা কইলা।

-প্যাপসমিয়ার টেস্ট। এটা নাহয় পরে করা যাবে।
-এইডাও কি বুকের পরীক্ষা?

মায়ের বয়সী এই বৃদ্ধার সাথে মেয়েলী সমস্যা নিয়ে কথা বলা কোন সমস্যা নয়, সমস্যা হচ্ছে মেমোগ্রাম করতেই যিনি শরমে মরে যাচ্ছেন, প্যাপসমিয়ার টেস্ট করার পদ্ধতি শুনলে না জানি বৃদ্ধা হার্ট ফেইল করে। অরুণাও জানতো না যে বুড়িদেরও ব্রেস্ট ক্যানসার, ইউটেরাস ক্যানসার হয়। মেমোগ্রাম করতে গিয়ে প্রতিবছর এক দুজন বুড়ি্র দেখা পায় যাদের ব্রেস্ট ক্যান্সার হয়েছে।

অরুণা বললো। “ খালা, প্যাপসমিয়ার টেস্ট বুকের পরীক্ষা নয়, জরায়ুর পরীক্ষা। এটা করলে জানা যায় মেয়েদের জরায়ু ঠিক আছে কিনা।“

-কী কও! নাউজুবিল্লাহ, জরায়ু, বুকের দুধ এগুলি মাইয়ালোকের শরমের জিনিস। নার্সেরা বেডি হইলেই কি, আমি বুড়ি হইলেই কি, বুড়ি বইলা কি নার্স বেডির সামনে লেংটা হইয়া ঘুরমু?

-আহ হা রে খালা, কিসব বলেন, শুনে আমারই লজ্জা লাগছে।

-তুমিই কও, হাতে পায়ে না অইয়া শরমের জিনিসে ক্যান ক্যানসার হইব? আসলে পরিক্ষা করার নামে সব টাকা খাওনের ধান্দা, বুঝলা? এইসব ইতং বিতং কথা কইয়া ডর দেখায় আমগোরে। তাইলেই দৌড়াইয়া যামু হাসপাতালে, আর ডাক্তাররা আমাগো গলা কাইট্টা এত্তবড় এক বিল পাঠাইব।

-হা হা হা! খালা, এদেশে এইসব টেস্ট ফ্রি। আপনার চিকিৎসাও তো ফ্রি।
-তুমি এত কথা শিখলা ক্যামনে?

- ইন্টারনেটের যুগ খালা, ইন্টারনেটে সব কিছু দেয়া আছে। গুগল মামুরে জিজ্ঞেস করলেই গুগল মামু এমনভাবে সব বুঝিয়ে বলে দেয় যে আমি তো আমি, অন্ধ কানার কাছেও সব কিছু দিনের আলোর মত স্পষ্ট হয়ে যায়।

তাছাড়া আমি তো ক্লিনিকে গিয়ে নার্সদের সাথে গল্প জুড়ে দেই। ওদের কাছ থেকেও অনেক গল্প শুনেছি। আমার কি মনে হয় জানেন খালা, মেয়েদের তো জরায়ুতে বাচ্চা হয়, দশ মাস থাকে বাচ্চা ঐখানে। বাচ্চাও তো একটা হয়না, কয়েকটা হয়। জরায়ুর উপর অনেক চাপ পড়ে তো, সেই থেকেই হয়তো ক্যান্সার ম্যান্সার হয়ে যায়। আর ব্রেস্ট ক্যান্সার? বারো মাস বাচ্চা বুকের দুধ খায়। বছর বছর বাচ্চা হলে, বাচ্চাকে বুকের দুধ খাওয়াতে দুধের উপর ধকল কি কম যায়, বলেন? অবশ্য ডাক্তাররা বলেন, যারা বাচ্চাকে বুকের দুখ খাওয়ায় তাদের নাকি ক্যান্সার হবার ভয় কম থাকে, যারা ব্রেস্ট ফিড করায় না তাদের ক্যান্সার হওয়ার ভয় বেশি থাকে।

-তাইলে আমার বুক পরিক্ষার দরকার নাই। আমার চাইর পোলা মাইয়ারে বছর ভইরা বুকের দুধ খাওয়াইছি। আর তুমার জড়ায়ু পরিক্ষার দরকার নাই, তুমার তো মোটে একটা সন্তান। তোমার জরায়ুতেও চাপ পরে নাই।
হ, কইতে পারো আমার জরায়ু পরীক্ষা করনের দরকার। এই জরায়ুর উপরে অনেক ধকল গেছে। দশ বার পেডে বাচ্চা আইছিল। তহনও বাজারে মায়া বড়ি আসে নাই, পেট থিকা এক বাচ্চা খালাস হইতে না হইতেই আরেকটা আইয়া পড়তো। চাইর সন্তান বাঁইচ্চা আছে, তিনডা ছডি ঘরেই মইরা গেছে। আরও তিনবার পোয়াতি হইছিলাম। তুমার খালুর তহন কান্দের উপরে সংসারের বিরাট বোঝা। ভাই বইন, মা বাপ, লগে নিজের চাইর পোলা মাইয়া। শেষে আমিই দাই ডাইক্কা তিনবার বাচ্চা নষ্ট করছি!

-খালা, বাচ্চা নষ্ট করার পর আপনার মন খারাপ হয়নি?

- ইচ্ছা কইরা তো বাচ্চা নষ্ট করি নাই। তহন জন্ম নিয়ন্ত্রণের জমানা আছিল না। সোয়ামী স্ত্রীর সম্পক্কটাই আছিল বিছনার মইদ্যে। সারাদিনে ত সোয়ামী ইস্তিরিতে দেখা অইতো না, তুমাগো মত ‘হানি, সুইটি’ কইব কখন? সোয়ামী বাইরে খাটতো, ইস্তিরি বাড়ির ভিতরে। দুইজনে দেখা অইত রাইতের বেলা বিছনায় গিয়া, সারাদিনের ভালোবাসা পিরীতি আইয়া ভর করতো রাইতের বিছনায়। কাজেই যা হওয়ার তাই হইত।

শরিফা বেগমের কথা শুনে অরুণার গায়ে কাঁটা দিয়ে উঠেছে। বৃদ্ধা এখন ঘোরের মধ্যে আছেন। চোখ দুটো ঘোলাটে দেখাচ্ছে, চোখের দুই কোণে জল চিক চিক করছে।

অরুণা বলল, খালা, তাহলে আপনার জন্য একটা এপয়েন্টমেন্ট করে ফেলি?

- করো যা ভাল মনে লয়। আমেরিকায় না আসলে কি জানতে পারতাম, মাইয়ালোকের জীবনেরও কত মূল্য আছে?

- কেন খালা, মেয়েদের জীবনের মূল্য জানতে আমেরিকায় আসতে হবে কেন? আমাদের দেশে কি মেয়েদের জীবনের মূল্য নেই?

-নাহ! আমাগো দেশে মাইয়ালোকের জীবনের কোন মূল্য নাই। পুরুষের কাছেও নাই, মাইয়ালোকের কাছেও নাই।

-খালা, আপনার কথা শুনলে মাঝে মাঝে আমার বোধ বুদ্ধিতে কাঁপন ধরে।
- শোন গো মাইও, জীবনের একটা পর্যায়ে পৌঁছাইলে বেবাক মাইয়ালোকেই একলা অইয়া যায়। তহন তারা জীবনের হিসাব নিকাশের খাতা লইয়া বসে। হিসাব মিলাইতে পারেনা, তয় বুঝতে পারে, তাগো জীবনডার কোনই দাম আছিল না বাজারে। জন্মের পরের থন মাইয়ারা জানে বাপ তার, ভাই তার, বিয়ার পরে সোয়ামী তার, পোলা মাইয়া তার, আসলে কেউই তার না গো। মাইয়ালোক জোয়ান থিকা বুড়া হয়, বুড়া বয়সে কোমর ভাইঙ্গা গুঁজা অইয়া যায়, আমগো দ্যাশে কোন বেডি জানে ‘কেলসিয়ামের’ অভাবে এইডা অয়?
-খালা, আপনি জানেন ক্যালসিয়ামের অভাবে যে মেয়েদের হাড়গোড় নরম হয়ে যায়, কোমর বাঁকা হয়ে যায়?
-হ, শিখছি গো মাইও, নিজের জেবন দিয়া শিখছি। আগে জানতামনা, আমেরিকায় আইসা জানছি। জিনিয়া কেলসিয়াম খায়, আমারেও খাইতে দিছে। আমি খাইনা, এত্ত বড় টেবলেট গলা দিয়া নামতে চায় না। জিনিয়া ধমকায়, কয় কোমর বেঁকা হইয়া গেলে ওল্ড হোমে পাঠায়ে দিব।
অনেক বড় একটা শ্বাস ছাড়লেন শরিফা বেগম। আনমনে বললেন, এত কিছু জানতে লেখাপড়া শিখতে হয়। আমি লেখাপড়া করার সুযোগ পাইলাম কই? বুদ্ধি ভাল আছিল, চউখ কান খোলা ছিল বইলা চইলা গেছি। যেটুকু জ্ঞান সঞ্চয় করছি, চারিপাশ দেইখা। আমেরিকা আসার পর চউক্ষের উপর থিকা পর্দা সইরা গেছে। জীবনের আরেক দিক যে আছে তা জাইনা ফেলছি। দেশে থাকলে তো জীবনের কত কিছুই জানা হইতো না, অন্ধকারেই থাইকা যাইতাম। সত্য কিনা কও।

-সব সত্য বলেছেন। তবে আপনারও দোষ আছে। জিনিয়া আপা বলার পরেও ক্যালসিয়াম খাচ্ছেন না, মেমোগ্রাম করাতে যাচ্ছেন না, এটা কি ভাল?

- বয়সকালে কেউ খাতির করলো না, এখন মরার বয়সে পৌঁছাইছি, এখন আমার খাতির! বুঝো নাই, এত খাতির করতাছে তার নিজের স্বার্থের কথা চিন্তা কইরা। ঘরে ফিরা তৈরী ভাত পায়, তৈরী চা পরোটা খাইয়া অফিসে যায়, মায় যদি কোমর বেঁকা হইয়া পইরা যায়, তাইলেতো সব বন্ধ হইয়া যাইব! হি হি হি হি

-খালা, এত কঠিন সত্য বইলেন না, তাহলে সংসারে সুখ পাবেন না। জীবন আপনার, যতদিন বাঁচেন, নিজের জন্য হলেও সুস্থ থাকুন। বুড়ো বয়সে পৌঁছে এখন যখন বুঝতে পেরেছেন নিজের জীবনের মূল্য, নিজের চোখের আলোয় দেখতে পাচ্ছেন নিজেকে, তাহলে আর অন্ধকারে থাকবেন কেন? নিজেকে কষ্ট দিবেন কেন?

দুই

খুব বিশ্রী ধরণের স্বপ্ন দেখে অরুণার ঘুম ভেঙেছে আজ। ও এমনিতেই ভীতু ধরণের, তার উপর দুস্বপ্ন দেখেছে। ভোরের স্বপ্ন নাকি সত্যি হয়, কিন্তু স্বপ্নটা যখন দেখেছে তখন ভোর নাকি গভীর রাত ছিল অরুণা জানে না। দুঃস্বপ্নের কথা কাউকে বলে দিলে নাকি ফাঁড়া কেটে যায়। কার কাছে বলবে দুঃস্বপ্নের কথাটা। রাতুলের বাবার কাছে বলার প্রশ্নই উঠেনা, তাহলে খালার কাছে? সব কথা কি সবার কাছে বলা যায়?
এখন ক’টা বাজে? জানালায় ভারী পর্দা ঝুলে থাকার কারণে বাইরে দিন বা রাত কিছু বুঝা যায়না। রাতুলের বাবা বিছানায় নেই! অরুণাকে কিছু না বলেই সে ভার্সিটিতে চলে গেলো! নাকি সে কাল রাতে বিছানায় আসেনি!
গত সন্ধ্যায় রাতুলের বাবার সাথে একটু ঝামেলা হয়েছিল ওর। খুব সাধারণ কথায় ওকে বিশ্রি কথা শুনিয়েছে মনোময়। মনোময়ের কাছে ধমক খেলে অরুণা শুধু চোখের জল ফেলে, মুখের উপর কিছু বলতে পারেনা। গত সন্ধ্যাতেও চোখের জল মুছতে মুছতে বিছানায় এসে শুয়েছিল, কখন ঘুমিয়ে গেছে টের পায়নি।


নাহ! মনোময় বাড়ির কোথাও নেই, রোজ দিনকার মত আজও সকাল সাড়ে সাতটায় নিশ্চয়ই বেরিয়ে গেছে। মনোময় কি ব্রেকফাস্ট করে বেরিয়েছে নাকি খালি মুখেই চলে গেছে!

কিচেনে এলো অরুণা, বাসন কোসন চারদিকে ছড়ানো, রাতের খাবারের জন্য যে তরকারির বাটিগুলো ফ্রিজ থেকে বের করে রেখেছিল কাল, সব তেমনই পড়ে আছে। বেসিনে অবশ্য পরিষ্কার, কোন থালা বাটি জমে নেই। মনোময় আজকাল কারো মুখাপেক্ষি হয়ে থাকতে চায় না। ঘরে গুচ্ছের প্লেট থাকার পরেও মনোময় ওয়ান টাইম প্লেট, ওয়ান টাইম বাটি, ওয়ান টাইম চামচ কিনে নিয়ে আসে। তার প্লেট গ্লাস অরুণা ধোবে, পরে রাতের বেলায় কোঁকাবে, “ ইস, দেশে থাকলে কত ভাল হতো। একজন হেল্পিং হ্যান্ড থাকতো, বাসন মাজা, কাপড় কাচা, মাছ মাংস কেটে দেয়ার কাজগুলো করে দিত। আমেরিকায় সব নিজেকে করতে হয়, সন্ধ্যে হতেই হাত পা গিঁটে গিঁটে ব্যথা করে”—এসব শুনতে রাজি নয় সে।
হ্যাঁ, অরুণা আজকাল এই ধরণের কথা বলে। বয়স বাড়ার সাথে সাথে শরীরের নানা জায়গায় ব্যথা বেদনা বাড়ছে, তাই ব্যথার কথা বলে। সে তো কথার ছলে বলে, মনোময়ের প্লেট বাটি গ্লাস ধুয়ে ওর হাত পা ব্যথা করে, এমন তো বলেনি।
অরুণা এখন এসব নিয়ে কিছুই বলে না। মনোময় ওয়ান টাইম প্লেটে খায়, অরুণা কর্নিং অয়ারের প্লেটে খায়। প্রথমদিকে শুধু একদিন বলেছে, “ দেখো তো, ওয়ান টাইম প্লেট গ্লাসের মত ওয়ান টাইম হাঁড়ি, কড়াই, ফ্রাইপ্যান, ক্রোকারিজ কিনতে পাওয়া যায় কিনা! তাহলে বাসন মাজার ঝামেলাই থাকবে না। ওয়ান টাইম হাঁড়ি কড়াইয়ে রান্না করব, রান্না শেষে তোমার প্লেট গ্লাসের মত হাঁড়ি কড়াইও গার্বেজ করে দেব।

চিকেনের বাটি দেখলো অরুণা, একদিক থেকে কিছু ঝোল কম দেখা যাচ্ছে। যাক বাবা, মনোময় কাল রাতে খেয়েছে। আচ্ছা, ও যে একা একা খেলো, অরুণা যে খেলো না, সেটা খোঁজ নিলো না? ও কি পারতো মনোময়কে রেখে একা একা খেয়ে নিতে? একটু কথা কাটাকটি হয়েছে বলে একা খাওয়া দাওয়া করলো, আলাদা বিছানায় ঘুমালো, সকাল হতেই অরুণাকে কিছু না বলেই বেরিয়ে পড়লো! এমন কিছু ঝগড়াও হয়নি ওদের মধ্যে! যা বলার তাতো মনোময়ই বলেছে একতরফা, তাহলে?
ঘটনা তেমন কিছুই না, গতকাল সকালে শরিফা খালাকে নিয়ে অরুণার ডাক্তারের কাছে যাওয়ার কথা ছিল। মনোময় তা জানতো। হসপিটালে রওনা দেয়ার আগে অরুণা খেয়াল করলো, ওর ব্যাগে ড্রাইভিং লাইসেন্সটা নেই। সারা বাড়ি আতিপাতি করে খুঁজেও লাইসেন্স পাওয়া গেলো না। অগত্যা লাইসেন্স ছাড়াই ওর গাড়িতে খালাকে হসপিটালে নিয়ে গেছিলো। ঘরে ফিরে আরেকবার আতিপাতি করে খুঁজলো লাইসেন্সটা যদি কোথাও পড়ে গিয়ে থাকে, কিন্তু পাওয়া গেলো না।
সন্ধ্যায় মনোময়কে বলেছিল, “ জানো, আমার ড্রাইভিং লাইসেন্সটা পাওয়া যাচ্ছে না।
-হোয়াট! লাইসেন্স পাওয়া যাচ্ছেনা মানে কি?।
- কি হয়েছে শোন, আমি তো ড্রাইভিং লাইসেন্স, ক্রেডিট কার্ড, গাড়ির চাবি, খুচরো ডলার একটা পাউচে রাখি। খুচরো পয়সা জমে পাউচটা ভারী হয়ে যাচ্ছিল তাই পাউচ থেকে সব বের করে বিছানায় রেখে বাথরুমে গেছি। ওমা, বাথরুম থেকে বেরিয়ে দেখি সব আছে শুধু লাইসেন্স নেই। সারা বাড়ি খুঁজলাম, কোথাও নেই। পরে লাইসেন্স খোঁজা বাদ দিয়ে খালাকে নিয়ে হসপিটালে চলে গেছি।
- কি বললে?? তুমি ড্রাইভার’স লাইসেন্স ছাড়া গাড়ি চালিয়েছো? কি সর্বনাশ। তুমিতো আমাকে পাগল না করে ছাড়বেনা।

-তোমাকে পাগল করবো কেন?

-আলবাত করবে। রাস্তায় যদি পুলিশ ধরতো, লাইসেন্স ছাড়া গাড়ি চালালে যে বিশাল অংকের জরিমানা হয়, ক্ষেত্র বিশেষে জেল হয়, জানো না? তার উপর বয়স্ক একজন মানুষকে সাথে নিয়েছো।

-আমি কি ইচ্ছে করে লাইসেন্স ছাড়া গাড়ি চালিয়েছি? আজ এপয়েন্টমেন্ট মিস করলে আরেক এপয়েন্টমেন্ট পেতে কত দেরী হতো!

-আমার কথা হচ্ছে, দরকারি জিনিস তুমি হারাবে কেন?

-আরে, এত অল্পতেই তুমি রেগে যাচ্ছো কেন?
-রাগবো না মানে, তুমি সব সময় দরকারি জিনিস হারিয়ে ফেলো। আমার এখন এসব আর সহ্য হয়না।
- আচ্ছা, তুমি একটু ওদের অফিসে ফোন করে দেখবে, যদি আরেকটা নতুন লাইসেন্স করা যায়!
-তুমি ফোন করো।
-আমার ভয় লাগে ওদের সাথে কথা বলতে। তুমি একটু দাওনা আমার এই উপকারটা করে।

-আমি পারবোনা। আমার কাছে এসব অন্যায় আবদার করবে না। আর কত? সারাটা জীবন সবই আমাকে করে দিতে হবে? কেন, নিজে পারোনা কিছু করতে?
-কি বলছো এসব? তোমাকে সব করতে হয়? বাজার সদাই, ব্যাংক, বিল দেয়া, পোস্টাফিসে যাওয়া সব কাজ তো আমি করি। ঘরেও হালকা ভারী সব কাজই তো আমি করি। তোমাকে কি কিছু করতে দেই? একটা ফোন করতে অনুরোধ করেছি, তাইতেই এত রেগে গেছো? তুমি ছাড়া আর কাকেই বলবো বলো?

-বেশ করেছি রেগেছি। কিচ্ছু করতে হবে না তোমাকে। আমার জন্য কিছুই করতে হবেনা। আমার থালা বাসন ধুতে হয়না, আমার জামা প্যান্ট ধুতে হয় না, ভাত তরকারিও রাঁধতে হবে না। ব্যাংক পোস্টাপিসের কাজও করতে হবেনা। তোমার ক্যাচ ক্যাচ, ভ্যাজ ভ্যাজ সহ্য হয় না। আজকাল অসহ্য লাগে তোমার কথাবার্তা। আমি অ্যালুফ থাকতে চাই, আমি এখন একা থাকতে চাই। নাহলে আমি পাগল হয়ে যাব।
-কী বলছো এসব? আমার কথাবার্তা অসহ্য লাগে? আমি তোমার পাশে কয় মিনিট থাকি? তোমার সাথে কয়টা কথা বলি? তুমি তো অ্যালুফই থাকো। তুমি থাকো তোমার জগত নিয়ে, সেই জগতে আমি কোথায়?
-হ্যাঁ, আমি আমার জগত নিয়েই থাকতে চাই, বললাম যে, আমি একদম একা থাকতে চাই।
-এত বড় কথাটা আমায় বললে? ‘একদম একা’ থাকতে চাওয়ার মানে কি হয়? একদম একা থাকতে পারবে যদি আমার মৃত্যু হয়। মৃত্যু তো আমার হাতে নেই, তাইনা? একমাত্র আত্মহত্যা করা ছাড়া মরতেও পারবো না। তোমাকে একদম একা থাকার সুযোগ কিভাবে দেয়া যায় বলো! বোবা হয়ে থাকবো, সে উপায়ও নেই। কাশি দিলেও তুমি শুনে ফেলবে, হাঁচি দিলেও শুনবে। মরতে ভয় লাগে আমার, আত্মহত্যা করতেও ভয় লাগবে। নাহলে তোমাকে ‘একদম একা’ থাকতে দেয়ার জন্য আত্মহত্যা করতাম। কী করবে বলো, আমার মৃত্যু পর্যন্ত তোমাকে অপেক্ষা করতে হবে!

কাল সন্ধ্যার কথাগুলো মনে পড়ে খুব কষ্ট হচ্ছে অরুণার। টেবিলে সাজানো খাবারগুলো যেমনটা তেমনই আছে। একটা রাতই তো, একটা মাত্র রাত বরের উপর রাগ করে অরুণা একটু আগেই বিছানায় শুয়ে পড়েছিল, বেখেয়ালে ঘুমিয়ে পড়েছিল তাই কিচেনে আসতে পারেনি। তাই বলে মনোময় খাবারের বাটিগুলো তুলে রাখবে না? কাল যে এত একা থাকার জন্য চেঁচালো, এখন যদি আমি মরে যাই, মনোময় রান্না-খাওয়া করবে না? একা হয়ে বাতাস খাবে? বাইরে থেকেও যদি খাবার কিনে নিয়ে আসে, সেই খাবার গরম করতে হবেনা? খাবারের খালি প্যাকেটগুলোও তো ফেলতে হবে! একা থাকার শখ বেরিয়ে যাবে!

তিন

অরুণা বলল, " খালা জানেন, এ এক আশ্চয্য ব্যাপার। যখন বয়স কম ছিল, তখন আপনজনের যে আচরণে কষ্ট পাইনি, এখন আপনজনের কাছ থেকে সেই একই ব্যবহার পেলে মনে কষ্ট পাই। মাঝে মাঝে খুব অপমান লাগে "
শরীফা বেগম চোখ সরু করে অরুণার মুখের দিকে তাকালেন। পাশে রাখা প্লাস্টিকের কাপের ঢাকা সরিয়ে পুচ করে পানের পিক ফেলে কাপের মুখ ঢেকে কাপটা আগের জায়গায় রাখলেন। বাঁ হাতের তালুতে ঠোঁটের দুই পাশে লেগে থাকা পানের রস মুছলেন।
অরুণার চেনা দৃশ্য। যখনই এই বাড়িতে আসে, দুই তিন ঘন্টার আগে খালা ওকে ছাড়েনা। এই দুই তিন ঘন্টায় খালা এই কাপটার মধ্যে কতবার যে পানের পিক ফেলে! নি:সঙ্গ এই বৃদ্ধার জন্য বুকের মধ্যে ও ভীষণ মমতা বোধ করে। খালার ছেলে মেয়ে সবই আছে, তবুও খালা অসহায়। গত বছর পূজোর বাজার করতে গিয়ে খালার জন্য খুব সুন্দর একটা পিকদান কিনেছিল অরুণা ।উপহার পেয়ে খালা কী যে খুশি হয়েছিল! অরুণাকে বুকে জড়িয়ে অনেক আদর করেছিল। পিকদানটা খালা ব্যবহার করেনা, মেয়ের ভয়ে লুকিয়ে রেখেছে। মেয়ে দেখে ফেললে খুব রাগ করবে, মা'কে হ্যাংলা বলবে।


শরীফা বেগম অরুণার পিঠে হাত রেখে নরম স্বরে বললেন, " মাগো, জামাই বাবাজী কিছু কইছে? "
অরুণা তাকিয়ে আছে দেয়ালে টাঙানো পেইন্টিংটার দিকে! চোখ না সরিয়েই বলল, " না খালা, কেউ কিছু বলেনি। এমনিই মনে হলো, তাই বললাম"।
শরীফা বেগম বললেন, " মাগো, তোমার বয়স আমারও আছিল একদিন। আমার কাছে কিছু লুকাইতে পারবা না। মাথাডা আউলা ঝাউলা কি এমতে এমতেই অইছে? তয় কথা কি জানো, তোমার মত মাইয়াগো সারা জীবন সইয়া যাইতে হয়। হইতা আমার মাইয়াগো মত, জামাই বাবাজী পত্থম দিন থিকাই মেনি বিড়াল হইয়া থাকত।

শরীফা বেগমের কথা শুনে অরুণা হেসে ফেললো।
“ খালা, আপনি তো আমার সাথে গাড়িতে চড়ে এদিক সেদিক বেড়িয়েছেন। আপনার কি কখনও মনে হয়েছে যে আমি গাড়ি একসিডেন্ট করার মত গাড়ি চালাই? আমার গাড়িতে চড়লে কি আপনার ভয় লাগে? আমাকে কি খুব ফালতু ড্রাইভার মনে হয়?
-কী যে কও তুমি! মাইয়ালোকে গাড়ি চালাইতে পারে হেইডাইত জানতাম না। আমেরিকা আইসা দেহি বেবাক মাইয়া গাড়ি চালায়। আমগো জিনিয়াতো হের সাহেব জামাইর ট্রাক চালায়।
-খালা,এই ধরেন, কোন একদিন ভুল করে ড্রাইভিং লাইসেন্সটা বাড়িতে ফেলে এসেছি, গাড়ি চালাচ্ছি, পুলিশে ধরলে কি আপনার মনে হয়, আমাকে জেলে ঢুকাবে?

-কি যে কও, এমুন সোনার পিত্তিমার মত চেহারা দেখলে পুলিশের বুক কাঁইপা উঠবো। পুলিশ তোমার হাতে কড়া পরাইবো কি, ভুল কইরা হে নিজের হাতে কড়া পরাইবো। হি হি হি। বুঝলা কি কইছি?

-ধেৎ খালা, সব সময় খালি ঠাট্টা করেন। আমি যা জিজ্ঞেস করেছি তার কথা বলেন।

-অরু মা, কি হইছে? জামাই কি কিছু কইছে? তুমি যে আমারে লইয়া এহানে সেহানে ঘুরো বেড়াও, বাবাজি কি রাগ করছে?

-না গো খালা, আপনাকে আমি একটু সঙ্গ দেই, তাতে সে খুশিই হয়। আপনি বয়স্ক মানুষ, আপনাকে একটু সঙ্গ দেই, এর বেশি কিছুতো করিনা। গতকাল আমি আপনাকে হসপিটালে নিয়ে গেলাম, আমার সাথে ড্রাইভিং লাইসেন্স ছিলনা। লাইসেন্সটা বিছানার উপর রেখে বাথরুমে গেছিলাম, এসে দেখি নেই। লাইসেন্স ছাড়া আপনাকে নিয়ে গাড়ি চালিয়েছি, ও খুব রাগ করেছে।

-বিছানা থিকা লাইসেন্স হারায় ফেলছো, এমন আজগুবি কথা শুইনা বাবাজী রাগ করবোনা কি তুমারে কোলে লইয়া নাচব?

-খালা, জীবনের অনেকটা সময় আপনার জামাই বাবাজি আমাকে সত্যি সত্যি কোলে নিয়েই নাচতো। তখন ভাবতাম আমার মত এমন ভাগ্যবতি মেয়ে খুব কম আছে। বাপের বাড়ি গিয়ে বৌদিদের কাছে স্বামীর প্রশংসা করতাম। বান্ধবীদের স্বামীরা বদমেজাজী, ওরা যদি ওদের দুঃখের কথা বলতো, আমি খুব গর্বের সাথে নিজের স্বামীর প্রশংসা করতাম। এখন মনে হয়, খুব বোকামি করতাম। বান্ধবীরা যেখানে স্বামীর অত্যাচারে দিশেহারা, আমার তখন উচিত হয়নি নিজের স্বামীর প্রশংসা করা। বান্ধবীরা নিশ্চয়ই মনে মনে হিংসে করেছে, আক্ষেপ করেছে, অভিশাপ দিয়েছে।
বলে অরুণা কাঁদতে শুরু করলো। অরুণাকেএর আগে কখনও এভাবে কাঁদতে দেখেননি শরীফা বেগম।
একটু পরেই অরুণা চোখের জল মুছে সহজ হয়ে বসলো, “ সরি খালা, মনটা ভাল লাগছে না।

-কি হইছে আমারে খুইল্লা কও তো
এরপর অরুণা গত সন্ধ্যার ঘটনা থেকে শুরু করে ভোর রাতে দুঃস্বপ্ন দেখা, কিচেনে গিয়ে সব এলোমেলো দেখার কথা খুলে বলল।
শরিফা বেগম বড় করে শ্বাস ফেললেন, বললেন, “শোন গো মাইও, একখান হাচা কথা কই। সোয়ামী আর ইস্তিরির সম্পক্কে প্রেম মহব্বত বইলা কিছু থাহে না। সোয়ামী আর ইস্তিরির সম্পক্কটা হইতাছে অভ্যাসের মত। এই যেমুন ধরো গিয়া, ডাইল আর ভাতের কথাই যদি ধরি। বাঙ্গালীগো সামনে যতই পোলাও কোর্মা সাজাইয়া দাও, পিজা বার্গার দেও, পত্থম পত্থম চাকুম চুকুম কইরা খাইব। দুই দিন পরেই ডাইল ভাত খাওনের লাগি বাঙ্গালির পরান আই ডাই করব। সোয়ামি আর ইস্তিরির ব্যাপারটাও তেমুনই। সোয়ামী বেডায় যতই বাইরে ঘরে সুন্দরী মাইয়ার লগে রাসলীলা করুক না ক্যান, জ্বর আইলে, ঠ্যাং ব্যথা করলে, মাথার চুল টাননের দরকার হইলে তখন আর সখী দিয়া কাম হয়না, বিছনায় পইরা ইস্তিরির খোঁজই করে।


-খালা, আপনি আমার কথা বুঝেননি। আমার স্বামী বাইরে কোন সুন্দরীর পিছে ঘুরেনা, ঘরের সুন্দরীর প্রতিও মোহ নেই। সে এখন একদম একা থাকতে চায়। গত রাতে সে একা একা ভাত খেলো, আমাকে একটাবার ডাক দিলো না। খালা, কষ্টে অপমানে আমার বুক ফেটে যাচ্ছে। দুটো ভাত বড় নয়, যার ভরসায় নিজের আত্মীয় পরিজন ছেড়ে এই ভিনদেশে একদম একা জীবন কাটাচ্ছি, সেই কিনা আমাকে বলছে, সে আমার কাছ থেকে আলগা থাকতে চায়! আমায় ফেলে সে দিব্যি খেয়ে ফেললো! এত বছর মায়ার সংসার তৈরী করেছিলাম খালা, মায়ার জাল আজ ছিঁড়ে গেছে!

-আমি ত সেই কথাই কইছি। এত বড় কথাডা কইলো জামাই বাবাজী তোমারে, হের পরেও তো রাইতের বেলা তোমার রান্দা ভাতই খাইছে। সোয়ামীরা এমুনই। বউ তাগো কাছে পুরান লাগে, বউ থিকা সইরা সইরা থাকতে মন চায়। কিন্তু খাওনের সময় বউর রান্দা ভাত খাইব, বউর হাতে পাতা বিছনায় ঘুমাইবো। অন্যে বিছনা পাতলে চলতো না। বউ ছাড়া আর কেউ বুঝতো না সাহেবের ঘাড়ের তলে কুন বালিশ লাগব, সাহেবের বিছনার চাদ্দর টান টান থাকতে হইব, কোলবালিশ ডাইনদিকে থাকতে হইব। এগুলি জানে ইস্তিরি। এইডাই হইল সোয়ামিগো খাসলত। মাইনা লইতে পারলে তুমি সুখি, মানতে না পারলে তুমি দুঃখি।বুঝলা?

-খালা, আমি এতকাল রাতুলের বাবার জন্য যা কিছু করেছি, ভালো বেসেই করেছি। এই যে রাতুলের বাবা কাগজের প্লেটে বাটিতে খায়, মনে মনে খুব অপমান লাগে তবুও তার প্রতি ভালোবাসা কমেনা। তাই বলে একদম একা থাকতে চাইবে?
- মন খারাপ কইরোনা, ইস্তিরি সারা জীবনভর সোয়ামির সুখ স্বাচ্ছন্দ্যের জন্য জীবনপাত করে বইলাই সোয়ামীগো এত দাপট। মাঝে মইদ্দে ইস্তিরির লাইগা ছুনু পাউডার কিনা লইয়া আহে, মন চাইলে ইস্তিরিরে লইয়া বছরে এক দুইডা সিনেমা দেখে, বোকা মাইয়ালোক ভাবে, সোয়ামি তারে খুব ভালোবাসা দেখাইছে। ভালবাইসা এগুলি করেনা, অভ্যাস থিকা করে। আর ইস্তিরিও যে খুব ভালবাইসা সোয়ামীর ঠ্যাং টিপা দেয়, হেইডাও না। সোয়ামী তিন বেলা ভাত দেয়, পিন্দনের কাপড় দেয়, হেইর বিনিময়ে ইস্তিরি সোয়ামীরে এই সার্ভিসটুক দেয়। হা হা হা হা! গত রাইতে সোয়ামী একলা থাকতে চাইছে, আইজ রাইতেই দেখবা তোমার আঁচল দিয়া মুখ ঢাইকা শুইব।

-না খালা, রাতুলের বাবার গত রাতের কথাগুলো আমার বুকের ভেতরে শেলের মত বিঁধেছে। এই কথাগুলো সে বলার সুযোগ খুঁজছিল, বলতে পারছিলনা। গতকাল বলে দিল।

-জামাই বাবাজিরে আমার খুব ভালা লাগে, ঠান্ডা সুস্থির মানুষ, কত বড় চাকরি করে। মাঝে মাঝে সবতেরই ইট্টু আট্টু ঊনিশ বিশ হয়।

-খালা, আমিও তাকে তেমনই জেনেছি। সে শান্ত ভদ্র মায়াবী একজন মানুষ। মাঝে মাঝে রাগ সকলেরই হতে পারে, সেটা বড় কথা নয়। সেও আমার সাথে মাঝে মাঝে রাগ করতো। সমস্যা হচ্ছে, যেসব কারণে সে রেগে উঠে, কারণগুলো মোটেও রেগে ওঠার মত নয়। অনেকবার এমন হয়েছে, তার মনমত কথা না হলেই সে খুব রেগে যায়, রেগে গেলে মুখে যা আসে তাই বলে দেয়।
আগে আমি তাকে খুব ভয় পেতাম তাই তার রাগের সময় চুপ করে থাকতাম। কিন্তু মনে মনে বুঝার চেষ্টা করতাম, কেন সে রাগ করলো! ইদানিং বুঝতে পারছি সে কেন রাগ করে। আসলে সে নিজেকে সুপিরিয়র হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করতে চায়। যদি তার মনে হয় কোন বিষয়ে আমি তার থেকে একটু বেশি বুঝে ফেলেছি, অথবা বেশি জানি, সে তখনই রেগে ওঠে। আমিও যে কিছু বিষয়ে তার চেয়ে বেশি জানতে পারি বা বুঝতে পারি, এটাই সে মানতে পারেনা। কথা হচ্ছে, আমি তো তাকে এমনিতেই সুপিরিয়র ভাবি, সুপিরিয়রের মর্যাদা দেই। তবুও তার মনে একটা কমপ্লেক্স কাজ করে, সে ভাবে, আমি বুঝি তাকে যতখানি সুপিরিয়র ভাবার ততখানি ভাবিনা।
-কী কও এইসব?
-হ্যাঁ খালা, অনেক বছর আগের এক ঘটনা বলি। কাউকে বলিনি, আপনাকেই আজ বলছি। আমি একটা স্কুলে চাকরির দরখাস্ত পাঠাবো। আমার সার্টিফিকেটগুলো খুঁজে পাচ্ছিলাম না। রাতুলের বাবাকে বললাম, “শুনছো, আমার সার্টিফিকেটগুলো পাচ্ছিনা। তুমি কি জানো, ওগুলো কোথায়?”
-আমি কি করে জানবো তোমার সার্টিফিকেট কোথায়?
-তুমি তো সব কাগজপত্র গুছিয়ে রাখো।
-আমি আমার কাগজপত্র গুছিয়েই রাখি, আমি তো তোমার মত অগোছালো নই।
-আমিও অগোছালো নই, আমি যেখানে দরকারি জিনিস রাখি সেখানে সার্টিফিকেটগুলো নেই। আমার যতদূর মনে পড়ছে, সেবার কানাডা যাওয়ার ব্যাপারে কথা হচ্ছিল, আমার সার্টিফিকেটের ফটোকপি করার জন্য তুমি চেয়ে নিয়েছিলে, আর আমাকে দাওনি। তুমি কি একটু দেখবে তোমার ড্রয়ার, যদি সেখানে থাকে।

জানেন খালা, এই কথা বলার সাথে সাথে সে চোখ মুখ লাল করে আমার দিকে তেড়ে এসে বলল, “এক চড় দিয়ে তোমার এই গালের দাঁত ঐ গালে নিয়ে যাব। ভাবো কি নিজেকে? মুখে যা খুশি এলো, বলে দিলেই হলো?“
আমি প্রথমে বিশ্বাস করতে পারিনি , ভেবেছি শয়তানি করছে। সে তেমন রেগেই বলছে, তোমার সার্টিফিকেট দিয়ে আমার কাজ কি? ফাজলামি করো আমার সাথে?

আমি শুধু অবাক হয়ে বললাম, তুমি আমাকে চড় দিবে বললে, যাহ! এটা হতে পারে? তুমি কি ঠাট্টা করে বলেছো?

সে আর কিছু না বলে অন্য রুমে চলে গেছিলো। সেই দৃশ্যটা আজও আমার মনে আছে। জানেন খালা, আমার সার্টিফিকেটগুলো পরে তার ড্রয়ারেই পাওয়া গেছিলো। সে আমাকে সরিও বলেনি, যদি সরি বলতো তাহলে সেদিনের এই অপমানটা বুকে পুষে রাখতাম না।
এমন আরও অনেক ঘটনা আছে, কত দিন বলেছে, “ তোমাকে মুক্তি দিয়ে দিতে চাই। তোমার সাথে আমার বনবেনা। তুমি তোমার মত থাকো, আমি আমার মত”। এগুলো শুনেছি, একা কেঁদেছি, আবার রাতের বেলা স্বামীর কোমল হাত শরীর স্পর্শ করতেই সব অভিমান ভুলে গেছি।

- মাইও গো, কি কইতাম! আমি তো আমেরিকায় না আইলে জানতেই পারতাম না আমারও আলাদা একটা জীবন আছে, সেই জীবনের আলাদা সুখ আছে, আলাদা দুঃখ আছে! দেশে মাইয়ারা সংসারে টিকে থাকে কেমনে জানো? আল্লাহ মাইয়াগো রে দুই চোখ দেন ঠিকই, দৃষ্টি শক্তি দেন না বইলা মাইয়ারা বোবা কালা আন্ধা ধেন্দা হইয়া নিগ্রহের সংসারে টিকা থাকে। আমেরিকায় অইলে কত সংসার ভাইঙ্গা যাইত!
-
- -খালা, সংসার ভেঙ্গে যাওয়া কি ভাল?
- -চোখ বন্ধ কইরা সোয়ামির কুকীর্তি, সোয়ামীর অত্যাচার সহ্য করার চাইতে সংসার ভাইঙ্গা যাওয়া ভাল। তোমার খালুর লগে যদি আমেরিকায় সংসার শুরু করতাম, হেই সংসার ভাঙ্গতোই ভাঙ্গতো।
- কি যে বলেন খালা।
- -অরুণা, সাতাইশ বছর আগের ঘটনা। তোমার খালু হজ্জ্বে যাইতে চায়। আমগো ধর্মে আছে, সংসারের সকল দায় দায়িত্ব ভালোভাবে সম্পন্ন করার পর তুমি হজ্জ্ব করতে যাইবা। হজ্জ্ব করতে যাওয়ার সময় কোন পিছুটান, কোন ঋণ রাইখা যাইতে পারবা না। স্বামী স্তিরি একসাথে যাইতে পারলে ভাল। কিন্তু আমাদের তখন এত পয়সাও নাই, আমারও ধর্মে কর্মে তেমুন মনোযোগ আছিল না। আমি সদা সত্য কথা কই, সৎ পথে চলি, মানুষের ক্ষতি করিনা এইটাই আমার ধর্ম। কিন্তু তোমার খালুর খুব হজ্জ্ব করার শখ, তারেই হজ্জ্ব করতে পাঠাইলাম।
- হজ্জ্ব কইরা ফিরলো তোমার খালু এক মাস পরে। তার মুখ দেখেই আমি খুশি। সেই দিন বিকালে সে আমারে কয়, “ জসিমের মা, তুমি গেলা না। কত দেশ থিকা যে মানুষ আসছে, সবাইর সাথে বউ আছে। তাগো দিকে দেখি আর মন খালি তোমারে পাইতে চায়। খুব কষ্ট পাইছি।
- -কী কন এইসব? পবিত্র কাবাশরিফের কাছে গিয়াও আপনার চউখ ছিল বেডিগো দিকে, মন চাইছিল আমারে পাইতে?
- তোমার খালু হজ্জ্বে যাওয়ার আগেই কিন্তু আমাগো বিছানা আলাদা কইরা ফেলছিলাম। কারণ আমাদের মধ্যে ভালোবাসা ছিলনা, কিন্তু তার খুব খায়েশ ছিল। ভালোবাসা ছাড়া স্বামী স্ত্রীর মধ্যে মিলন ঘটলে সেই মিলন খুবই কষ্টের হয়। তুমি এখনও ছোট, তুমি বুঝবা না। আরও বয়স হইলে বুঝবা। আমারও খুব কষ্ট হইতো, অপমানও লাগতো। ভালোবাসার কথা ছাড়া, আদর সোহাগের কথা ছাড়া সেক্স করে পশু পাখি, কারণ তারা বোবা। মানুষ করবে কেন?
- এইজন্যই হজ্জ্বে যাওয়ার আগে থেকেই তারে মানসিকভাবে আল্লাহর সেবায় নিয়োজিত করার চিন্তা কইরা বিছানা আলাদ করছিলাম। সেই মানুষ হজ্জ্ব থিকা ফিরা এই কি শুনাইলো। ঐখানেই যদি শেষ হইত ঘটনা, তাইলে কিছু মনে করতাম না। কিন্তু রাইতের বেলা সে নিজের বিছানা ছাইড়া আমার বিছানায় আইছে এবং আমার উপরে হামলে পড়ছে। তারে আটকাইতে পারি নাই। নিজের শরীরটারে মনে হইছিল একটা মাংসের দলা, আর তারে মনে হইছিল ক্ষুধার্ত নেকড়ে। চউখ দিয়া ঝর ঝর কইরা পানি পড়তেছিল। সব শেষে তোমার খালুরে কইলাম, এই শেষ। আর কোনদিন আমার বিছানায় আসবা না।” সে আমার দিকে হা কইরা তাকাইয়া ছিল, সত্যই আর আমার কাছে আসে নাই।
- শরিফা বেগমের মুখের দিকে তাকিয়ে অরুণার ভয় করতে লাগলো। দুই চোখ লাল টকটকে, শ্বাস নিচ্ছেন অনেক দ্রুত। অরুণা বলল, “ ও খালা, আপনি শান্ত হোন। খালা, আমি আপনার জন্য জল নিয়ে আসছি। একটু জল খান। খালা, আমি তো আপনার মন খারাপ করিয়ে দিলাম।

-দূর পাগল, সেসব কথা কি মনে ধরে রাখছিলাম? তখন তো আর দশটা মাইয়ার মত আমিও ছিলাম সংসার প্রেমে অন্ধ। সংসার ভালোবাসছি বইলাই তো তোমার খালুর সাথে সংসার করে গেছি আরও ২৩ বছর। ভালোবাসায় কমতি ছিলনা আমার, ভালোবাসছি তারে আগের মতই, সেবাও করছি মৃত্যুর আগ পর্যন্ত। শুধু তার প্রতি আর শ্রদ্ধা ছিল না। তুমি মন খারাপ কইরোনা, জামাই বাবাজি একা থাকতে চায়, তারে একা থাকতে দাও।

-খালা, তারে একা থাকতে দেয়া মানে আমার আরও বেশি একা হয়ে যাওয়া। সে ছাড়া আমার আপনার জন কে আছে বলেন? তাকেই যদি পাশে না পাই, প্রেমে ভালোবাসায় কাছে টানতে না পারি, এই বিদেশ বিভুঁইয়ে আমি বাঁচি কেমন করে?
-বাঁচবা, বাঁচবা। আমেরিকায় আছো, আমেরিকার মাইয়া গো মতো বাঁচো। সোয়ামীর রাগ পাত্তা দিবা না। খাইতে ডাকবা, ‘আমি পরে খাব’ কইলে তুমি তারে দুইবার সাধবা না। তুমি একা খেয়ে উঠবা। ছয় মাস পর দেখবা তোমার সোয়ামীর চউক্ষের থিকা ‘দেশি’পর্দা সইরা যাইব, সেও তখন জীবনটারে আমেরিকান আলোয় দেখতে পাইব। আমেরিকান সাহেব গো মতো সেও তখন তোমার সাথে সমানে সমান জীবন কাটানোর চেষ্টা করবো। নিজের চোখে দেখা গল্প কইলাম।


আপনার ভালো লাগা ও মন্দ লাগা জানিয়ে লেখককে অনুপ্রানিত করুন
মোঃ নুরেআলম সিদ্দিকী এত বড় গল্প, পড়তে নিশ্চয় সময় লাগে দিদি। তাই ভাগ ভাগ করে অনেকদিন পড়ে আজ মন্তব্য করতে আসলাম। গল্প আমার কাছে অসাধারণ লেগেছে, প্রকাশ করার মত ভাষা নেই.....।। গল্পের গভীরতা আর ভাব দেখলে এমনেই কারো মন কেঁড়ে যাবে। অনেক অনেক শুভকামনা রইল দিদি, ভালো থাকুন.....
মোহাম্মদ বাপ্পি আপনার জন্য শুভ কামনা রইল ..
প্রজ্ঞা মৌসুমী গল্প যতটুকু, তার থেকেও বেশি বাস্তবতা। সংসারের দোলাচল, ঘোর, নিজেরে হেলাফেলা করার চিরাচরিত অভ্যাস। সবটাই ভালো লাগা। তবে আমেরিকাকে একটু সুপিরিয়র করা হলো। তুলনায় হয়তো ভালো তবে আদর্শ কি? আমার মতো আমার পাশের দরজার বিয়ে না করা লাভ বার্ডস হৈহুল্লোড় করা সেই মেয়ের চোখেও কি জল গড়ায় না এতটুকু! সেখানের মেয়েরা যে আরও বেশি ছাড়ে। ড্রাইভ/ হুটপাট স্বাধীনতা এসবও তো বিনিময়। ভোগ/ পণ্য হওয়ার বিনিময়। এটুকু জানি শুধুমাত্র আমেরিকান বলে আমার বান্ধবী ঠকে যাওয়ায় পিছিয়ে নেই। আত্নমর্যাদা খুইয়ে যাওয়ায় পিছিয়ে নেই। সংসার ভাঙা / টিকে রাখা দুটোই যেন জোর হতে গিয়ে দূর্বলতা হয়ে গেছে। মধ্যস্থ থাকা আমরা যারা না পারি আমেরিকান মেয়ে হতে, না পারি সতী সাবিত্রী হতে ভোগি বোধে
একদম ঠিক বলেছো। আমেরিকাকে সুপিরিয়র করার আমি কেউ নই। যা কিছু কথা হয়েছে , ভিন্ন বয়সী দুই নারীর মধ্যে। নারী চরিত্রে যিনি জীবনটাকে দেখেছেন বেশি, দুই গোলার্ধে থেকেই তিনি তার জীবনটাকে দেখেছেন, তাঁর কাছে মনে হয়েছে আমেরিকায় নিজ জীবনের সিদ্ধান্ত নিজে নেয়া যায়। বয়সে তরুণী নারীটির কিন্তু জীবন সম্পর্কে অভিজ্ঞতা সম্পূর্ণ হয়নি। এমনকি সে তার স্বামীর আচরণে ওঠা নামা হওয়ার কারণও বুঝে উঠতে পারেনি। জীবনের অনেক বিষয়েই তার স্বচ্ছ ধারণা নেই যা শরিফা বেগমের আছে। আমেরিকাকে সুপিরিয়র ভেবে নয়, একেবারে বিপরীত আমেরিকান সংস্কৃতি দেখে, নিজের দেশি মেয়ে, আমেরিকান জামাই, সবকিছু দেখেই চোখের উপর থেকে এক পর্দা সরে গেছে।
’আমেরিকার মাইয়া গো মতো বাঁচো’ এই লাইনটা এত ভাবাল যে কতকিছু লিখে ফেললাম। যদিও নিজ জীবনের সিদ্ধান্ত সব জায়গায় নেয়া যায় বা নেয়ার জোর থাকা দরকার। এও সত্যি আমেরিকার স্বাধীনতা স্বস্তিকর। সিরিয়ার এক বৃদ্ধাকে দেখেছিলাম। হাতঘড়ির খুব শখ ছিল বেচারার। এই সামান্য শখও পূরণ হয়নি নিজের দেশে নারী বলে। আমেরিকায় দুটো তিনটে ঘড়ি পড়ে থাকত। সে যাক গল্পটা পড়তে গিয়ে ভেবেছি- এত গভীর ভাবনার লেখা, যে সে লেখক নয়। কোথাও পড়লাম উপন্যাসের অংশ। উপন্যাসটা পড়ার তৃষ্ণা থেকে গেল। অনেক শুভকামনা দিদি
মোঃ মোখলেছুর রহমান দিদি ভাল আছেন আশা করি।শরিফা খালা ও অরুণার মাধ্যমে পারিবারিক সম্পর্ক,সমাজিক অবস্থা, মনস্তাত্বিক জটিলতা নানা বিষয়ে বুনন অসাধারন।
সাদিক ইসলাম অনেক দুঃখিত ভুলে কমেন্টটা এডিট করতে ডিলিট হয়ে গেল। শুভ কামনা। গল্প কবিতায় বেশ কিছু নারী লেখিকা সেলিনা আপু সহ খুব ভালো লিখেন। তাদের জন্য শ্রদ্ধা আর শুভ কামনা।
সালসাবিলা নকি বেশ কয়েক জায়গায় চোখ থেকে টপটপ করে পানি পড়েছে। কমেন্টটা যখন লিখছি তখন... কী কঠিন সত্য! কিন্তু আসলেই সত্য। মেনে নিতে না চাইলেও... বুকের ভেতর চাপা কষ্টগুলো বের হয়ে আসছে। আমার প্রশংসা করার মতো কোন শব্দ বা ভাষা নেই। শুধু এই বোনের অকৃত্রিম শ্রদ্ধা জানবেন দিদি
প্রিয় বোন সালসাবিলা, চোখের পানিটুকুই সত্যি, বাকি সব মায়া। ভালো থেকো বোন।
ধন্যবাদ। আমার জায়গায় কমেন্ট করতে পারছিনা। সময় পেলে গল্পে আসবেন।
সেলিনা ইসলাম থিম গল্প বলার ভঙ্গি অসাধারণ লাগলো। একদিকে যেমন মেয়েলি জটিল শারীরিক সমস্যায় একজন অন্ধ বিশ্বাস নিয়ে আছে। তেমনই আরেকজন আধুনিক হয়েও সংসার আর ভালবসায় অন্ধ হয়ে আছে। চরিত্রগুলো নিখুঁতভাবে ফুটিয়ে তুলেছো দিদি। খুব ভালো লাগল। শুভকামনা নিরন্তর।
কত কাল পর দিদিকে মনে পড়লো! একটা উপন্যাস লেখার ইচ্ছে আছে, তারই মাঝের অংশ দিয়ে এই গল্প সাজিয়েছি। তুমি 'অন্ধত্বের' দিকটা ঠিকই বুঝতে পেরেছো,'অন্ধ' বিষয়ে আমার গল্প লেখা সার্থক হয়েছে।

১৯ জানুয়ারী - ২০১২ গল্প/কবিতা: ৬৫ টি

বিজ্ঞপ্তি

এই লেখাটি গল্পকবিতা কর্তৃপক্ষের আংশিক অথবা কোন সম্পাদনা ছাড়াই প্রকাশিত এবং গল্পকবিতা কর্তৃপক্ষ এই লেখার বিষয়বস্তু, মন্তব্য অথবা পরিণতির ব্যাপারে দায়ী থাকবে না। লেখকই সব দায়ভার বহন করতে বাধ্য থাকবে।

প্রতি মাসেই পুরস্কার

বিচারক ও পাঠকদের ভোটে সেরা ৩টি গল্প ও ৩টি কবিতা পুরস্কার পাবে।

লেখা প্রতিযোগিতায় আপনিও লিখুন

  • প্রথম পুরস্কার ১৫০০ টাকার প্রাইজ বন্ড এবং সনদপত্র।
  • দ্বিতীয় পুরস্কার ১০০০ টাকার প্রাইজ বন্ড এবং সনদপত্র।
  • তৃতীয় পুরস্কার সনদপত্র।

আগামী সংখ্যার বিষয়

গল্পের বিষয় "অবহেলা”
কবিতার বিষয় "অবহেলা”
লেখা জমা দেওয়ার শেষ তারিখ ২৫ এপ্রিল,২০২৪