আজ রবিবার, তাই দিবার অফিস যাওয়ার তাড়া নেই। সাত সকালে বিছানা ছাড়তে হবেনা, শাওয়ারের ঠান্ডা জলের নীচে দাঁড়াতে হবেনা, মজাই মজা।শীত গ্রীষ্ম বলে কোন কথা নেই, ঠান্ডা জলে স্নান করতে দিবা ভয় পায়, ওর শরীর নাকি ঠান্ডা নিতে পারেনা। অবশ্য দিবাকে ঠান্ডা জলে স্নান করতে হয়না, সারা বছর বাথরুমে ঢুকবার আগেই মা হাঁড়ি ভর্তি গরম জল বালতির পাশে রেখে দেয়।হাঁড়ির জল যেন সহজে ঠান্ডা হয়ে না যায় তার জন্য হাঁড়ির মুখ ঢাকা দিয়ে রাখে। শুধু কি তাই, দিবার আরামের জন্য মা গরম জল রেডি রাখে, ধোয়া তোয়ালে সাবান শ্যাম্পু কন্ডিশনারের বোতল ঝুড়িতে রেখে দেয়। দিবা গায়ে লোশান মাখতে খুব আলসেমি করে, তাই দিবার জন্য গায়ে মাখার লোশান, চুলে মাখার জেল, মুখে মাখার ময়েশ্চারাইজার আলাদা ট্রেতে সাজানো থাকে। আলসেমি করার কোন উপায় থাকেনা, বাথরুম থেকেই দিবাকে সবকিছু হাতে পায়ে গায়ে চুলে মুখে নখে মেখে সেজেগুজে বের হয়ে আসতে হয়।
সাজুগুজুর এই পর্বটা দিবার অসহ্য লাগে, কিন্তু নামেনে উপায় থাকেনা। চোরা চোখ দিয়ে মা সংসারের প্রতিটি খুঁটিনাটি জিনিস দেখে ফেলে। অফিসে এত স্মার্টলি চলাফেরা করে যে মেয়ে, সেই মেয়ে কিনা বাড়িতে মায়ের চোখ ফাঁকি দিতে পারেনা!
ঘড়িতে সারা সপ্তাহের জন্য সকাল সাতটার অ্যালার্ম সেট করা, রবিবারেও সকাল সাতটায় ঘড়িটা টুঁই টুঁই করে ডাকতে শুরু করে। আজও ডেকেছিল, দিবা বিরক্ত হয়নি। এটা বরং ওর ভাল লাগে, একবার ঘুম ভেঙে গেলে পাশবালিশ বুকে জড়িয়ে ডান কাত থেকে বাম কাতে শুয়ে আরও কিছুক্ষণ ঘুমানো যায়। দ্বিতীয় ঘুম ভাঙার পর পাশবালিশ বুকে জড়িয়ে এপাশ ওপাশ করা যায়। এর সুখ অন্যরকম।
কিছুক্ষণ আগে দিবার দ্বিতীয় দফার ঘুম ভেঙেছে, এখন পাশবালিশ বুকে নিয়ে এপাশ ওপাশ করবে। বেলা বারোটা বাজার আগে যে কোন একসময় বিছানা ছাড়লেই হলো। বেলা বারোটা কেন, বিকেল চারটা বেজে গেলেও একমাত্র মা ছাড়া আর কেউ কিছু বলবেনা। মায়েরতো চোরা চোখ আছেই, সাথে 'লক্ষ্মী মেয়ে সাজার' বাতিকও আছে। মেয়েমানুষ বেলা বারোটার পর বিছানায় শুয়ে থাকলে নাকি সংসার থেকে লক্ষ্মী ঠাকরুন ঘটি বাটি কাঁখে নিয়ে চলে যান।
দিবা বলে, মেয়েমানুষ বেলা বারোটা পর্যন্ত ঘুমালে লক্ষ্মী ঠাকরুন চলে যান কেন? মেয়েরা কি লক্ষ্মী ঠাকরুনের সতীন লাগে?
মা ভয় পেয়ে লাল টুকটুকে জিভ একটু বের করে বলবে, এভাবে কথা বলিসনা দিবু! ছি ছি, কী অলুক্ষুণে কথাবার্তা। দেব দেবী নিয়ে মেয়েমানুষ ওভাবে কথা বললে চলে?
-মা, তোমার মুখে 'মেয়েমানুষ' শব্দটা শুনতে কেমন যেন কেঁচো কেঁচো টাইপ মনে হয়। মনে হয় মেয়ে মানুষ নয়, এতবড় এক কেঁচো, সবসময় মাটির ভেতর সেঁধিয়ে থাকে। মেয়েমানুষ আবার কি? মেয়ে বলা যায়না?
-ও একই কথা হলো। মেয়ে আর মেয়েমানুষে তফাত নেই।
-আলবাৎ তফাৎ আছে মা। মেয়ে শুনলে কত্ত আদুরে আদুরে লাগে, আরমেয়েমানুষ শুনলেই মনে হয় তুচ্ছ তাচ্ছিল্যে ভরা এক প্রাণী, ছিঃ, ইয়াক!
-আচ্ছা, ভুল হয়েছে। মেয়ে বলবো এখন থেকে। মেয়েদের বেলা পর্যন্ত বিছানায় শুয়ে থাকতে নেই।
-বুঝলাম মেয়েরা শুয়ে থাকলে লক্ষ্মী ঠাকরুনের গা কিড়মিড় করে, ছেলেমানুষ শুয়ে থাকলে লক্ষ্মী ঠাকরুন কি করেন? ছোটন যে অনেক বেলা পর্যন্ত ঘুমায়, কই ছোটনকে তো এভাবে ঘুম থেকে ডেকে তুলো না!
-জানিনা বাপু, অত তর্ক করতে পারিনা। মা ঠাকমার মুখে যা শুনেছি তাই মেনে এসেছি।
-তুমি মেনেছো বলে কি আমাকেও মানতে হবে এমন বোকা বোকা কথা?
-মানিস না, তোর যদি বিকেল পর্যন্ত শুয়ে থাকতে ইচ্ছে করে শুয়ে থাক। তবুও লক্ষ্মী দেবী নিয়ে অমন হেলা অশ্রদ্ধা করে কথা বলিসনা, ভয় লাগে।
-মা, ভয় লাগবে কেন? তুমি কি কোন অপরাধ করেছো? কিসের ভয়? তুমি সব সময় চেহারায় ' জাত গেলো জাত গেলো' টাইপ ভয় মেখে ঘুরে বেড়াও, কেন?
-মা রে, দেব দ্বিজে ভয় ভক্তি থাকা ভাল। লক্ষ্মী ঠাকরুনের সেবা করি, ভক্তি শ্রদ্ধা করি। তাতে সংসারের খারাপ কিছু্তো হয়নি। মা দিদিমাদের যা করতে দেখেছি, আমিও তাই করি। ভয়ে থাকি কথাটা ঠিক নয়, তোদের মত নাকে মুখে কথা বললেই কি খুব কেউকেটা হয়ে যেতাম!
দিবা চুপ করে যায়। মাকে কিছু বললেও লাভ হবেনা। মায়ের ব্রেন 'সংসার সুখের হয় রমণীর গুণে' নামক অর্ধ সত্য প্রবচন দিয়ে তৈরী। মায়ের মা, মানে দিবার দিদিমা একটা অদ্ভুত কাজ করতেন। উনার সবকটি মেয়েকে বিয়ের পর শ্বশুরবাড়িতে পাঠানোর সময়খুব দামী লাল মখমলের চারকোনা কাপড়েনিজের হাতে এমব্রয়ডারি করা, ' সংসার সুখের হয় রমণীর গুণে' সূচিকর্ম গয়নার বাক্সে ভরে দিতেন। মেয়ে বিয়ে ঠিক হলেই দিদিমা মেয়ের জন্য নিজের হাতে তৈরী করতেন সেই সূচিকর্মটি। দিবার মায়ের কাছেও আছে দিদিমার দেয়া উপহার, মা সেই মখমলের কাপড়ের টুকরোটি অনেক পয়সা খরচ করে ফ্রেম করিয়েছেন। সংসার সুখের এই মন্ত্রমুগ্ধ ফ্রেমখানি মা নিজের শিয়রের দিকের দেয়ালে টাঙিয়ে রেখেছেন। এই ব্রেন ওয়াশড মানুষের ব্রেনে অন্য কোন মন্ত্র ঢুকবেনা। দিবা একবার বলেছিল, " মা, তুমি কি জানো, দিদিমা অর্ধ সত্যি কথা লিখেছিল।"
শোনামাত্র মায়ের চোখ মুখ কেমন অন্ধকার হয়ে যায়, এক রত্তি মেয়ের মুখে নিজের মা সম্পর্কে এমন কথা শুনবে বলে মা প্রস্তুত ছিলনা। মা'কে দুঃখ দেয়ার জন্য দিবা কথাটা বলেনি। দিবা সত্যি কথাই বলেছে, ' সংসার সুখের হয় রমণীর গুণে'' এর পরের বাক্যটি হচ্ছে, 'গুণবান পতি যদি থাকে তার সনে'। দিদিমা শেষের কথাটা লিখেননি, হয়তো দিদিমা শেষের বাক্যটি জানতেননা। দিদিমার মা, তাঁর মা, তাঁরও মা--- মায়ের দল শুধু এটুকুই জানতো, 'সংসার সুখের হয় রমণীর গুণে'। তা উনারা পুরোটা জানতেননা, এটা মেনে নেয়া যায়। কিন্তু মা এ যুগের মা হয়েও কেন শেষের বাক্যটি মানতে রাজি নয়, সেটাই দিবা বুঝতে পারেনা। মা সবসময় কেমন 'লুতুপুতু' 'ভীতু ভীতু' 'লক্ষ্মী লক্ষ্মী' হয়ে থাকতে ভালোবাসে। হোয়াট ইজ দিস? কেন এভাবে চলবে?
পাশবালিশটা বুকে জড়িয়ে দিবা বাম পাশ ফিরলো। ঘুম নেই চোখে, তবু বিছানা ছাড়তে মন চাইছেনা। বালিশের পাশে থাকা গ্যালাক্সি এইট প্লাস বিপ বিপ করে চলেছে, সারা রাতে কত মেসেজ এসে জমা হয়েছে!
ছুটির দিন বলেই কিনা, সারা বাড়ি শান্ত এখনও। রিংকি, ছোটনও মনে হয় ঘুম থেকে জাগেনি। বাবা নিশ্চয়ই বাথরুমে, নাহলে ময়ূর কন্ঠে বাবার গলার আওয়াজ শোনা যেত, "সুমি সুমি, আরেক কাপ চা হবে নাকি!"
বাবা যখন এমন আকুলি বিকুলি করে মায়ের নাম ধরে ডাকে,দিবা ফাজলামো করে গেয়ে ওঠে, " এপারে মুখর হলো কেকা ঐ, ওপারে নীরব কেন কুহু হায়"। সাথে সাথে বাবা হো হো করে হেসে ওঠে।
বাবাকে ময়ূরকনঠী বলার কারণ, বাবার গলার স্বর বেশি সুন্দর নয়। যদিও খুব পুরুষালী কন্ঠ তবে যত সোহাগ করেই কথা বলুক, বেশ কর্কশ শোনায়।
বাথরুমে ঢুকলে পাক্কা পঞ্চাশ মিনিট লেগে যায় বাবার। কিচেন থেকে মায়ের গলার আওয়াজ ভেসে আসছে, আন্না মাসির সাথে কথা বলছে।
মা বিছানা ছাড়ে সকলের আগে। মা এখনও পুরনো দিনের নিয়ম মেনে চলে, বিছানা ছেড়েই সব থেকে আগে রাতের শাড়ি, পেটিকোট, ব্লাউজ বদলে দিনের শাড়ি ব্লাউজ পরবে। মা বাংলাদেশের মেয়ে, বাংলাদেশে নাকি এটাই নিয়ম। বিয়ের পর বৌদেরকে রাতের পোশাক পরা অবস্থায় উনুন ছুঁতে নেই, তাতে স্বামীর অমঙ্গল, সংসারের অমঙ্গল হয়, সংসার থেকে লক্ষ্মী ঠাকরুনকে তাড়িয়ে অলক্ষ্মী প্রবেশ করে। তবুও ভাল মা'কে সাত সকালে চান করতে হয়না, দিদাতো নাকি ভোর সকালে উঠেই নদীতে গিয়ে চান করতো। দিদাদের বাড়ির কাছেই নাকি গঙ্গা নদী ছিল, উপস! ওটা গঙ্গা নয়, বুড়িগঙ্গা নদী। ভোরে উঠে পালকি চড়ে বুড়িগঙ্গার ঘাটে চলে যেত দিদা, শীতের ভোরে স্নান করে ভেজা কাপড় গায়ে লেপ্টে বাড়ি ফিরতো। এটাই নাকি মায়ের বাবার বাড়ির নিয়ম ছিল। বাঙ্গালদের ডিসগাস্টিং সব নিয়ম কানুন।
দিবা কল্পনাই করতে পারেনা, ওর বিয়ের পর শীতের সকালে লেপের ওম থেকে বেরিয়ে সবার আগে রাতের জামা বদলাতে হবে, নাহলে উনুন ছোঁয়া যাবেনা, এটা কোন কথা হলো? রাতে ঘুমায় স্বামী আর স্ত্রী দুজনেই, আর ঘুম থেকে উঠে শুধু স্ত্রীকে শীতের ভোরে কাঁপতে কাঁপতে নেংটু হতে হয়, গায়ে লেগে থাকা গরম কাপড় পালটে আলনায় রাখা ঠান্ডা কাপড় গায়ে চড়াতে হয়, পুরুষকে এর কিছুই করতে হয়না। স্বামী যে পাজামা পরে ঘুমায়, ঘুম থেকে উঠে সেই পাজামা পরা অবস্থাতেই বাজারে যায়, পত্রিকা পড়ে, চুক চুক করে চা খায়। কেন, নারী পুরুষে এমন বৈষম্য থাকবে কেন? কি না স্বামী একেকজনের, তার জন্য স্ত্রীদের আবার মঙ্গল চিন্তা! স্ত্রীদের মঙ্গলের জন্য স্বামীরা কি করে? নাকি স্ত্রীদের মঙ্গল চাইতে নেই? এজন্যই দিবা সিদ্ধান্ত নিয়েছে, এই জনমে ও বিয়ে করবেনা। এত ভালো একটা জব করছে, জব করেই স্বাধীনভাবে কাটিয়ে দিবে জীবন। মায়ের জীবনটা দেখে ও অনেক কিছু শিখেছে। মা কেবলই কানের কাছে ঘ্যান ঘ্যান করে, বিয়ে কর, বিয়ে কর। দিবার বিরক্ত লাগে। মা আগে এমন বিরক্তিকর ছিলনা।
মা এখন কিচেনে, তার পরানপ্রিয় স্বামীর জন্য চা জলখাবার বানাচ্ছেন। কাজের ফাঁকে ফাঁকে আন্না মাসীর সাথে আহ্লাদী কথাবার্তাও বলছে। সবই ‘সংসার সুখের হয় রমনীর গুণে” টাইপ কথাবার্তা। আন্না মাসীও বাংলাদেশের মেয়ে, আট দশ বছর হলো এদেশে চলে এসেছে। আন্না মাসী দিবাদের পাড়াতেই কয়েক বাড়িতে কাজ করে, মাসীর বর শেয়ালদা লাইনে ট্রেনে দাঁতের মাজন, কোমর মালিশের ওষুধ, আরও কি কি বিক্রী করে। আন্না মাসীদের নাকি বাংলাদেশে ঘরবাড়ি জায়গাজমি ছিল, ভালোই ছিল অবস্থা। কিন্তু ওদেশের মুসলমানদের ভয়ে নাকি এক রাতে ওরা চোরাই পথে বনগাঁ দিয়ে এদেশে ঢুকে যায়। এটা বিশ্বাসযোগ্য কোন কথা? এই একবিংশ শতাব্দিতে এমন ঘটবে কেন? কেন সংখ্যায় কম বলে একদল মানুষকে বাপ দাদার ভিটে মাটি ছেড়ে, প্রাণ হাতে নিয়ে অন্য দেশে মানবেতর জীবন যাপন করতে হবে? অথচ এমনটা ঘটছে, আন্না মাসিই তার প্রমাণ। ওদের নিজেদের একটা এলাকা তৈরী হয়েছে, নাম বাঙ্গাল পল্লী। ওদের একটা বিশাল গ্রুপ তৈরী হয়ে গেছে, সেই গ্রুপে সকলেই বাঙ্গাল। আশ্চর্য্যের কথা, আন্না মাসীদের গ্রুপে বেশ কিছু মুসলমান পরিবারও আছে।
আন্না মাসিকে দিবার খুব পছন্দ, খুব স্বাধীনচেতা মানুষ। মায়ের মত অমন লুতুপুতু টাইপ নয়। এটা খুব সহজ কথা নয়, নিজের দেশ, নিজ দেশের মাটি, ঘরবাড়ি ছেড়ে অন্য এক দেশে অচেনা পরিবেশে অন্য সকলের সাথে মিলে মিশে বেঁচে থাকার যুদ্ধ করা। এ যুদ্ধ ছাড়া আর কিছুই নয়। দিবা নিজেকে অমন পরিস্থিতিতে ফেলে ভেবেছে, মাথা এলোমেলো লাগে। অথচ আন্না মাসী কি সুন্দর মুখে হাসি মেখে এসব কষ্ট জয় করে চলেছে। মাসির কথায় বাঙ্গাল টান এখনও খুব স্পষ্ট রয়ে গেছে, তবে স্থান বিশেষে মাসি ভোল পালটে ফেলতে শিখে গেছে। দিবা যেহেতু পুরোপুরি কলকাত্তাই বাংলা বলে, মাসিও দিবার সাথে খেয়েচি-গিয়েচি করে কথা বলে। কিন্তু মায়ের সাথে যখন মাসি কিচেনে কথা বলে, প্রাণ খুলে 'খাইছিলাম, করমু, যামু' করে কথা বলে।
দিবা একদিন মাসীকে বলেছিল, “ ও মাসী, তোমরা নাহয় ওদেশের মুসলমানদের ভয়ে পালিয়ে এসেছো, তাহলে ওদেশের মুসলমানেরা কার ভয়ে এদেশে এসেছে?
আন্না মাসী বলেছিল, “ একেকজনের একেক সমস্যা। আসল সমস্যা হইল ক্ষিদা। বুঝলা? ক্ষিদার কাছে হিন্দু মুসলমান সবই এক। আমাগোর গ্রুপে যারা মুসলমান আছে, তারা আসলে দেশে কোন কাম কাজ খুজে পায়নি, সন্তান সন্ততি নিয়ে বাঁচতে লাগবো তো, ঠিক না?”
দিবা হেসে বলেছে, “ বিলকুল ঠিক। বেঁচে থাকতেই হবে, আমাদের যত সংগ্রাম, সবই বাঁচার সংগ্রাম। মরার সংগ্রাম কেউ করেনা, তাইনা গো মাসী”?
-তোমার মাথায় ছিট আছে দিবা দিদি। এইসব কী কও? মরার লাইগা সংগ্রাম করব কেডা?”
দুই
মায়ের নেকু নেকু কথার টুকরো টাকরা কানে এসে লাগছে। দিবার ইচ্ছে করছেনা বিছানা ছাড়তে। কি হবে বিছানা ছেড়ে, বিছানা ছাড়া মানেই বাথরুমে যাও, বাসি কাপড়চোপর পালটে দাঁত ব্রাশ করে মুখ ধুয়ে খাবার টেবিলে গিয়ে বসো। সেখানে বাবাও থাকবে, রিংকি আর ছোটনও থাকবে। মা সবাইকে খাবার পরিবেশন করবে, বাবার থালা সুন্দর করে সাজিয়ে থালা বাবার হাতে তুলে দিবে। মায়ের কাজকর্ম দেখে কেউই বুঝতে পারবেনা গতরাতে বাবা আর মায়ের মধ্যে কী কুৎসিত ঝগড়া হয়েছে।
ঝগড়া হয় দুজনের মধ্যে, কিন্তু বাবা আর মায়ের ব্যাপারটা হয় একতরফা। বাবার হিস হিস কন্ঠ শোনা যায় শুধু, মায়ের কথা শোনা যায় কি যায়না।
এমনিতে দিনের আলোয় কিন্তু মা খুব কলকল করে কথা বলে, গলার স্বরও একেবারে নীচু নয়। এই যেমন এখন কিচেনে কথা বলছে, নীচু স্বরে বললে কি কথাগুলো দিবার কানে আসতো?
কাল রাতেদরজায় কান লাগিয়ে সব কথা শোনার চেষ্টা করেছিল দিবা। একবার ইচ্ছে করছিল দরজাটা আস্তে করে খুলে দিতে, আর লুকিয়ে দেখা নয়, বাবা মা ঝগড়া করছে, তাদের অসভ্য মেয়ে তা দেখছে। কিন্তু তা হবার নয়, মা এখন প্রাইভেসী মেইন্টেইন করতে শিখেছে। শোবার সময় দরজা ভেতর থেকে লক করে দেয়।
দিবার একটা বদ অভ্যাস আছে, আড়ি পেতে শোনা। ওর ধারণা, এই পৃথিবীতে সকলেই সকলের সাথে অভিনয় করছে। এমনকি নিজের সাথেও নিজে অভিনয় করছে।ওর ধারণা, ওর মাও অভিনয় করে। দিবা এই শৃঙ্খল ভেঙ্গে বেরিয়ে আসতে চায়। ও বিশ্বাস করে, অভিনয় করে বেঁচে থাকা অনেক পরিশ্রমের কাজ।তবু কেন সবাই অভিনয় করে?ওর ধারণা সত্যি নাকি পুরোটাই মিথ্যে, তা যাচাই করার জন্যই অন্যের কথা আড়ি পেতে শোনার চেষ্টা করতো সে।
বাবা মায়ের শোবার ঘরের দরজায় কান পেতে রাখার দারুণ বুদ্ধিটা দিবাকে প্রথম দিয়েছিল অথৈ। অথৈ দিবার স্কুল জীবনের বন্ধু। ওরা তখন ক্লাস টেনে পড়ে, দিবা তখনও মেয়েদের বাচ্চা হওয়ার কার্যকারণ সম্পর্কে স্পষ্ট ধারণা পায়নি। দিবা জানতো, মেয়েদের বিয়ে হলেই বাচ্চা হয়, বিয়ের সাথে বাচ্চা হওয়ার একটা সম্পর্ক আছে। অথৈ ওকে সব বলে দিয়েছে, বাচ্চা হওয়ার সাথে বিয়ে হওয়ার সম্পর্ক নেই। একটি ছেলে আর একটি মেয়ে সেক্স করলে তবেই বাচ্চা হয়। অথৈ অনেক কিছু জানতো, কি করে সব জানতো তা কখনও দিবাকে বলতোনা। অথৈ একদিন বলেছে, “ জানোতো, সেক্স করলেই বাচ্চা হয়, কথাটা ঠিক নয় মনে হয়। আমার বাবা মা প্রায় রাতেই সেক্স করে, কই মায়েরতো কোন বাচ্চা হয়না। আমিই মায়ের একমাত্র সন্তান”।
অথৈর মুখে এসব কথা শুনলে দিবার মুখ কান লাল হয়ে যেত, শরীর ঝিম ঝিম করতো আবার এসব শুনতে ভালোও লাগতো। অথৈ বলেছিল, ওর বাবা মা যে ঘরে ঘুমায়, সেই ঘরে নীল বাতি জ্বলে, দরজা ভেজানো থাকে। অথৈ ঘুমায় পাশের ঘরে, একদিন অথৈয়ের মাথায় বুদ্ধি এলো, বাবা মায়ের ঘরের দরজা একটু ঠেলতেই ওটা খুলে গেলো। তখনই যা দেখার দেখে ফেললো। অথৈয়ের মা নাকি অথৈকে সে রাতে অনেক জোরে চড় মেরেছিল, “ তুই কেন দরজায় টোকা না দিয়েই ঘরে ঢুকলি?” মায়ের হাতে চড় খেয়েছে বলেই অথৈয়ের খুব রাগ হয়েছে, এজন্যই দিবার কাছে সব কথা বলে দিয়েছে।ছেলেমানুষী করার দিনগুলো কোথায় হারিয়ে গেছে!
দিবা শুয়ে শুয়েই হাত পা ছুঁড়ে ছুঁড়ে আড়মোড়া ভাঙ্গলো, হাঁটু ভাঁজ করে সাইকেল চালালো, দুই হাত ক্রিস ক্রস করে হালকা ব্যায়াম করলো। এবার বিছানা থেকে নেমে সোজা চলে গেলো বাথরুমে। কমোডের ফ্ল্যাশ টানা হলো, এবার দাঁত ব্রাশ। আয়নায় নিজেকে একটু ভাল করে দেখলো। চোখের নীচটা যেন একটু কালচে দেখাচ্ছে, দিবার মন খারাপ হয়ে গেলো, ও খুব রূপ সচেতন। চোখের নীচে কালি খুব বিশ্রী লাগে, নিশ্চয়ই কাল বেশী রাত জাগার কারণে হয়েছে এটা। ভাল হয়েছে, উচিত শিক্ষা পেয়েছে, দরজায় কান পেতে মা বাবার ঝগড়া শোনার শাস্তি। দিবা এমনিতেই সুন্দরী, মায়ের রূপ পেয়েছে। রিংকি পেয়েছে বাবার গায়ের রঙ, বেশ চাপা।
দিবাকে রিংকি একটু হিংসেই করে। দিবা মায়ের রূপ পেয়েছে কিন্তু বাবার সাথে বেশী ভাব ওর, রিংকি বাবার রূপ পেয়েছে কিন্তু মায়ের সাথে বেশী ভাব ওর, সারাক্ষণ মায়ের গায়ে লেপ্টে থাকে। মাস্টার্স ফাইনালের ছাত্রী রিংকি, তবুও মায়ের সাথে খুকীদের মত আহ্লাদ করে। এসব ঢং দেখলে দিবার গা জ্বলে যায়। এই নিয়ে কিছু বললেই বেঁধে যায় ঝগড়া।
দুই বোন ছোটবেলা থেকেই ঝগড়া করে, রিংকির স্বভাবে বাঙ্গালেপনা আছে, এমনিতে শান্ত কিন্তু কথা বলে কেমন যেনো ক্যাট ক্যাট করে। ঝগড়া লাগলেই দিবা ওকে বলবে ‘বাঙাল কোথাকার, বাঙালদের মত ক্যাট ক্যাট করে সারাক্ষণ”, তখন দেখা যায় রিংকির রূপ।
বাড়ি মাথায় তুলে চেঁচায়, “ আমিতো বাঙালই, আমি বাঙালের মেয়ে হিসেবে গর্ব বোধ করি, তোমার মত ক্যালকেশিয়ান হয়ে বাঁচতে চাইনা, তোমার মুখে মধু অন্তরে বিষ। ইলিশ মাছ খাওয়ার সময়তো মনে থাকেনা বাঙালদের মাছ খাচ্ছো, তখন দেখি ইলিশের কোলের টুকরো সবার আগে নিয়ে নাও। বেহায়া কোথাকার, আমি তো মরে গেলেও তোমাদের কুচো চিংড়ি খাবোনা, আমার আছে পদ্মার ইলিশ”।
দিবার মায়ের নাম অপরাজিতা, যদিও এই বাড়িতে কেউই মা’কে অপরাজিতা নামে ডাকেনা। 'সুমি' নামটা বাবার দেয়া। একমাত্র বাবাই মা'কে সুমি নামে ডাকে। ছোটবেলায় দিবা জানতো, ওর মায়ের নাম সুমি। দিবা মা'কে 'সুমি মা' সুমিমা' বলে ডাকতো।
অনেক পরে, অনেক অনেক পরে দিবা জেনেছে, তার মায়ের নাম অপরাজিতা। এত সুন্দর একটা নাম থাকতে বাবা কেন মা'কে আলাদা করে 'সুমি' নাম দিয়েছিল? মা কি কখনও বাবাকে অন্য নামে ডেকেছে? দিবাকে যদি বিয়ের পর ওর বর অন্য নামে ডাকে, দিবা কি মেনে নিবে? অসম্ভব, জন্মের পর যে নাম দিয়ে একটি মেয়ে ঘরে বাইরে স্কুলে কলেজে পরিচিত, বিয়ের পর এক রাতেই তার নাম বদলে যাবে? মা কেন প্রতিবাদ করেনি?
কে যে মায়ের নাম রেখেছিল অপরাজিতা, জীবনযুদ্ধে পরাজিত এক নারীর নাম ‘অপরাজিতা’, কেমন লাগে ভাবতে! মা তো পরাজিতই, সারাক্ষণ মুখে তেলতেলে হাসি লাগিয়ে রেখে সকলের অন্যায় অত্যাচার মেনে নেয়। দিবা কি কিছু বুঝেনা? বাবাকে দিবা প্রাণের চেয়েও বেশী ভালোবাসে, তাই বলে কি, বাবা যে মায়ের সাথে মাঝে মাঝেই অন্যায় আচরণ করে তা কি দিবা জানেনা? সমস্যা হচ্ছে, দিবা যদি বাবাকে বকা দিতে যায়, মা তখন প্রতিবাদ করে উঠে। “ দিবা, বাবার সাথে এভাবে কথা বলিস কেন?”
এখানেও মায়ের সতর্কতা, নাজানি উনার পরানের পতিদেব দিবার কথা শুনে এমনই কষ্ট পাবেন যে এখানেই হার্ট অ্যাটাক করে মারা যাবে!
দিবা বলে, “ বাবা কেন অন্যায়ভাবে তোমাকে বকবে”
মা বলবে, “ বাবা গুরুজন, সংসারের প্রধান, ভুল হলে একটু আধটু বকতেই পারে। তাই বলে তুই মেয়ে হয়ে বাবাকে বকবি?”
মা এমনই, শক্তের ভক্ত। পরিবারে বাবা আর দিবা হচ্ছে গুন্ডা টাইপের, মা রিংকি একেবারেই নরম স্বভাবের। ভাইটা তো কোন সাতেও নেই, পাঁচেও নেই।
দিবা আর রিংকির ঝগড়ার সময়ও মা দিবাকে খুশী করার তালে থাকে। সব সময় রিংকিকে বকে, “ রিংকি, তুই থাম, দিদির সাথে এভাবে কথা কইস ক্যান? দিদি বয়সে বড়, তুই ক্যাট ক্যাট করে কথা কস বলেইতো দিদি তোরে শাসন করে। সুন্দর কইরা কথা কইলে শুনতেও ভাল লাগে”।
দিবা অবাক হয়ে যায়, মায়ের বকা খেয়ে কিন্তু রিংকি চুপ হয়ে যায়, রিংকিটা মাকে খুব ভালোবাসে। মা বোধ হয় জীবনে এই একজন বন্ধু পেয়েছে।
বাবার সাথে দিবার গলাগলি সম্পর্ক হলেও ওর যত আবদার, যত দাবী সব মায়ের কাছে। মায়ের কাছে যা চাওয়া যায়, মা তা জোগার করে দিবেই দিবে। “বন্ধুর সাথে ওখানে যাব, টাকা দাও” মা টাকা দিয়ে দিবে। “কার সাথে যাচ্ছিস” জিজ্ঞেস করবেনা, শুধু বলবে, “ সাবধানে যাবি, সাবধানে থাকবি। দেখিস, আজকাল চারদিকে কত কিছু ঘটছে, খুব বেশী দূরে যাবিনা। রাত করিসনা, আজকাল ট্রেনেও নাকি মেয়েরা নিরাপদ নয়”।
দিবা বুঝে যায় মা কি বলতে চাইছে, দিবা সাথে সাথে বলবে, “ মা, ভয় পেয়োনা, আমাকে কেউ রেপ করতে পারবেনা। আমার পাজামার দড়িতে টান দেয়ার আগেই ওদের জায়গা বরাবর লাথ মারবো, রেপ করার রস বের করে দেবো”।
মেয়ের মুখ থেকে এমন কথা শুনে মায়ের সারা মুখ লজ্জায় রাঙা হয়ে যায়, মাকে তখন কী যে সুন্দর লাগে! মায়ের মুখ দেখে দিবার মায়া লাগে, এই মানুষটাকে একমাত্র রিংকি ছাড়া আর সকলেই হেনস্থা করে। দিবা নিজেই কি কম হেনস্থা করে? তবে দিবার হেনস্থা করার ব্যাপারটা মায়ের ভালোর জন্যে। মাকে খুঁচিয়ে খুঁচিয়ে দিবা জাগাতে চায়, প্রতিবাদী করে তুলতে চায়। এজন্যই অমন করে খোঁচা মারে মা’কে, তবুও যদি মা একটিবার জ্বলে ওঠে।
অনেকদিন পর দিবার মনে হলো, মাথায় তেল দেয়ার কথা। চুলগুলো কেমন ড্রাই দেখাচ্ছে। গত সপ্তাহে চুলে কালার করিয়েছিল, সে কারণেই চুল ড্রাই হয়ে গেছে। এটা দিবার কথা নয়, দিবার সর্বজান্তা মায়ের কথা। চুল কাটা, চুল দাই করা যেহেতু মা পছন্দ করেনা তাই চুল ড্রাই হওয়া মানেই চুল ডাই করার ফল।
মা দিবার মাথার চুলে বিলি কেটে তেল মাখাচ্ছিল, আরামে দিবার চোখ বন্ধ হয়ে আসছিল। মা এত সুন্দর করে চুলে তেল মেখে দেয়, দিবা চুলে তেল দেয়া পছন্দ করেনা, শুধু মায়ের হাতের বিলি খাওয়ার লোভে মাঝে মাঝে তেলের শিশি নিয়ে মায়ের কাছে হাজির হয়। মায়ের সাথে দিবা বন্ধুর মত কথা বলে। মা এত সরল, সব কথার উত্তর দেয়। মাঝে মাঝে মায়ের কথা শুনে দিবা ভেতরে ভেতরে কেঁপে ওঠে। সরল মনের মানুষটা খুব সহজভাবে সাংঘাতিক নির্মোহ কথাগুলো বলে দেয়, মনে হয় যেন কোন দার্শনিকের মুখ থেকে কথাগুলো বের হচ্ছে। চুলে তেল দেয়ার সময় দিবা মাকে কত কথা জিজ্ঞেস করে। আজও জিজ্ঞেস করলো, “ মা, তুমি কি জীবনে সুখী?
-সুখীই তো
-সুখীইতো আবার কি? ইয়েস অর নো বলো।
-সুখী
-তুমি কি সুখী অসুখীর মধ্যে তফাত বুঝো?
-হয়তো বুঝি, হয়তো বুঝিনা।
-আবার হয়তো, নয়তো করছো? ইয়েস অর নো বলো।
-বুঝিনা
-তাহলে কেন বললে, তুমি সুখী?
- সুখ জিনিসটা হচ্ছে মনে মনে। যে যেভাবে বুঝে।
-বুঝিনি, ভালো করে বুঝিয়ে বলো।
- শোন তাহলে বলি, ঢাকার বাড়িতে আমরা তিন বোন, সাথে কাকাতো মাসতুতো বোন মিলিয়ে আরও চারজন একসাথে বড় হয়েছি। বাবা, কাকা মিলিয়ে আমরা একান্নবর্তি পরিবার ছিলাম। আর আমার খুব প্রিয় ছোট মাসীর শ্বশুরবাড়িও ছিল আমাদের বাড়ির কাছাকাছি। এজন্যই আমরা ভাই বোন সকলেই নিজেদের মধ্যে আপন পর ভেদাভেদ করতামনা।
আমাদের বংশ ছিল রূপের বংশ, ভাই বোন সকলেই সুন্দর দেখতে। বোনদের মধ্যে আমিই ছিলাম কম সুন্দর, বাকী বোনদের সকলেই ডাকসাঁইটে সুন্দরী ছিল। আমি ছিলাম সকলের ছোট, আমার দুই বছরের বড় ছিল ছোট মাসীর মেয়ে আশা। আমাতে আর আশাতে ছিল দারুণ বন্ধুত্ব।
আমাদের মা, কাকীমা, মাসীমা, জেঠাইমাদের মাঝেও ভীষণ সদ্ভাব ছিল। কাছাকাছি বাড়িতেই সকলে থাকতো, বিকেলে তাদের পানের আসর বসতো, সেখানে তাদের সুখ দুঃখের আলাপ আলোচনা হতো। মা মাসী, কাকীদের কারো সাথেই কারো মনোমালিন্য হতোনা, বিকেলের আসরে সবার পান খাওয়া মুখ দেখলেই মনে হতো, মানুষগুলো কী সুখী। মা মাসীদের সকলেই কিন্তু ভাল ঘরের মেয়ে, বিয়েও হয়েছে ভালো পরিবারে। ভাত কাপড়ের অভাব নেই, দামী জামা কাপড়ের অভাব নেই। আমার দিদিদের সকলের বিয়েও হয়েছে বনেদী বাড়িতে। আমাদের বাবা কাকারা পাকিস্তান আমলেই কলিকাতায় জায়গা জমি কিনে বাড়ি করে রেখেছিলেন। পূজোর সময় মা কাকীমারা সবাই একসাথে কলিকাতা আসতো পূজোর বাজার করতে। পূজো উপলক্ষে বিবাহিতা কন্যাদের বাড়িতে উপহারের ডালি পাঠিয়ে কন্যাদের নেমন্তন্ন করা হতো। ঢাকার বাড়িতে অনেক বড় করে দুর্গাপূজো হতো, পূজোর সময় আমাদের বাড়িতে বিশাল জাঁকজমক। দিদিরা আসতো শ্বশুরবাড়ি থেকে, দাদাদের শ্বশুরবাড়ি থেকেও আত্মীয়স্বজন আসতো। এলাহী কান্ড। দেশ স্বাধীনের পরেও অনেক বছর আমাদের ঢাকার বাড়িতে পূজো হতো।
দিদিদের সকলেরই বনেদী বাড়িতে বিয়ে হয়েছে, বনেদী বাড়িতে দিদিরা ছিল খাঁচায় বন্দী ময়না পাখীর মত। পাখীর মালিকের ইচ্ছেয় তারা কথা বলতো, গান শোনাতো। খাঁচার মালিক খুশী হয়ে পাখীর জন্য সোনার মালা, সোনার দুল, পায়ে সোনার শেকল বানিয়ে দিত। পাখীর গায়ে মখমলের জামা, মসলিনের ঘাঘরা পরিয়ে খাঁচা থেকে বাইরে বের করতো।
সোনার শেকল পরা পায়ে ময়না খুব বেশীদূর যেতে পারতোনা, উড়তেও পারতোনা। এঘর ওঘর হেঁটে বেড়াতো, পাখীর মালিক মুগ্ধ নয়নে প্রাণের পাখীর ঘোরাফেরা দেখতো। ময়নাগুলো শেকল পায়ে এমনই অভ্যস্ত হয়ে গেছিলো যে সোনার শেকল পরা পা নিয়ে গর্ব বোধ করতো। পূজোর সময় বাপের বাড়িতে এসেও বাইরে বেরোতে চাইতোনা, ঘরের চারপাশেই সোনার শেকলের রিন রিন আওয়াজ তুলে হেঁটে বেড়াতো। দিদিদের কেউ আমাদের সাথে বাইরে বেরোতে চাইতোনা, আমাদের তাতে খুব রাগ হতো। আমি আর আশা তখন বিয়ের বাকী, সুন্দরী দিদিদের সাথে ঘুরবো, জামাইবাবুরা আমাদের নিয়ে একটু আনন্দ ফূর্তি করবে তা নয়, তারা বনেদী বাড়ির চাল দেখাতেই ভালোবাসতো। আমার আর আশার মনে হতো, দিদিদের কত কষ্ট, বাপের বাড়িতে এসেও হাত পা খুলে চলতে পারেনা, ছোট বোন দুটোকে নিয়ে একটু মন খুলে ঘুরাঘুরিও করার উপায় নেই।
আশা আমায় বলতো, “ অপরাজিতা, আমি মরে গেলেও এমন জমিদার বাড়ির বউ হবোনা। কী অসুখী জীবন ওদের, খাঁচায় বন্দী পাখীর মত। আমি ডাল ভাত খাব, তবুও মুক্ত জীবন চাই”।
আমি বলতাম, “ তুই ভাবছিস ওদের খাঁচার জীবন, কিন্তু দিদিদের এটাতেই সুখ, দ্যাখ, দিদিরা কেউ তোর আমার কথা ভাবছেনা, নিজেরা নিজেরাই শাড়ি গয়নার ডিজাইন নিয়ে আলাপে মশগুল, কার স্বামী কবে কখন কত ভরি সোনা দিয়ে হাতের বাউটি বানিয়ে দিল, সীতাহার বানিয়ে দিল এই নিয়েই ওরা মত্ত। ওরা কিন্তু এই খাঁচার জীবনেই সুখী। দিদিরা পতির সুখের জন্য যা যা করা দরকার তাই করছে। তোর মাসী, মানে আমার মা দুই দিদিকে লাল মখমল কাপড়ে 'সংসার সুখের হয় রমণীর গুণে' মন্ত্র লিখে গয়নার বাক্সে দিয়ে দিয়েছে না? এজন্যই ওরা সুখের সংসার করছে।
-বড় মাসী তোর বিয়েতেও অমন বাণী উপহার দিবে।
-আমার মা শুধু আমার বিয়েতে কেন, তোর বিয়েতেও দিবে। তুই আর আমি কি আলাদা?
-আমি দিদিদের মত পায়ে শেকল দেয়া পরিবারে বিয়ে করলে তো! আমি বিয়ে করব একেবারে আধুনিক মনের কোন ছেলেকে।
-তুই নিজে নিজে বিয়ে করবি? মাসী মেসোর পছন্দে বিয়ে করবিনা?
-মা বাবার পছন্দের ছেলে বিয়ে করলে কপাল যে দিদিদের মত হবে। “
দিদিদের প্রতি আমাদের দুবোনের অভিমান এত তীব্র ছিল। তবুও পূজো শেষে দিদিরা যখন শ্বশুরবাড়িতে রওনা হতো, তার দুই দিন আগে থেকেই বাড়িতে বিদায়ের সুর বেজে উঠতো। আমি আর আশা মুখ কালো করে ফেলতাম, তবুওতো দিদিরা ছিল, চারদিকে আনন্দ ছিল। দিদিরা এমনিতেই সুন্দরী, তার উপর দামী শাড়িতে গয়নায় কেমন ঝলমলে দেখাতো, মা কাকীমারা দিদিদের সুখ দেখেই সুখী ছিল। দিদিরা চলে গেলে বাড়িতে আনন্দ কমে যাবে, এই চিন্তাতেই অস্থির হয়ে পড়তাম।
ধীরে ধীরে দিদির শ্বশুরবাড়ির সকলেই বাড়ি ঘর বিক্রী করে ইন্ডিয়াতে চলে গেলো। আমাদের বাড়িতে দুর্গাপূজোর সময় আর তেমন হই হই আসর জমতোনা। যদিও প্রতি বছর আমরা কলিকাতা বেড়াতে আসতাম, তখন দিদিদের বাড়িতেও যেতাম। কিন্তু তাতে আগের সেই সুখ পেতামনা। এরমধ্যেই আশার জন্য বিয়ের প্রস্তাব আসতে শুরু করলো। সেই একই রকম বনেদী বাড়ি থেকে প্রস্তাব আসে, গুরুজনেরা ঠিকুজি কোষ্ঠী মিলিয়ে দেখে। আমি আশাকে বলি, “ আশামণি, এবার তোর পালা, সোনার শেকল পায়ে পরে খাঁচার ভেতর বসে একটার পর একটা সুখের গান গাইবি”।
আশা কিছু বলেনা। আশাদের বাড়ি আমাদের বাড়ির কাছাকাছি হলেও আমি আর আশা ঘুমাতাম এক খাটে। কখনও আমাদের বাড়িতে, কখনও ছোট মাসীর বাড়িতে।
সেদিন আশা আমাদের বাড়িতে ঘুমিয়েছিল, সকালে ঘুম থেকে উঠে দেখি, আশা পাশে নেই। আমাকে না ডেকেই ও উঠে গেলো? ভেবেছি অনেক বেলা হয়ে গেছে। আমাদের বাড়িতে বেশী বেলা পর্যন্ত ঘুমানোর নিয়ম নেই। লাফ দিয়ে বিছানা থেকে নেমেই মেঝেতে ভাঁজ করা একখানা কাগজ পেয়ে থমকেছি। আমাদের বাড়িতে যেখানে সেখানে জিনিস পড়ে থাকার নিয়ম নেই, মেঝে সব সময় ঝকঝকে চকচকে থাকে। ভাঁজ করা কাগজ এলো কোথা থেকে? কাগজের ভাঁজ খুলে দেখি, আশার চিঠি, আমাকে লেখা। ও চলে গেছে বাড়ি ছেড়ে, সেলিম ভাইয়ের হাত ধরে। কলেজে আশা ছাত্র ইউনিয়নের নেত্রী ছিল, সেলিম ভাইও ছাত্রইউনিয়ন করতো। সেলিম ভাই ঢাকা ইউনিভারসিটিতে মাস্টার্সের ছাত্র তখন, কখন আশার সাথে মন দেয়া নেয়া হয়েছে কে জানে!
এই ঘটনায় ছোট মাসীর বাড়িতে অঘটন ঘটে গেলো। আমি সেদিন ছোট মাসীর মুখের দিকে তাকিয়ে হতভম্ব হয়ে গেছিলাম। এমন সুন্দরী মাসীর ঠোঁটের কোণে রক্তের দাগ, দুই গালে চোখের জল শুকিয়ে আছে। মাসির চেহারাটা এমনিতে দেখলে মনে হবে, সবসময় হাসছে। সেদিন মনে হলোনা। আমার মাথার ভেতর সব এলোমেলো হয়ে গেলো। মাসির এমন অবস্থা হলো কি করে?
মেসোকে জিজ্ঞেস করলাম, “ মেসোমশায়, মাসির ঠোঁট কাটলো কি করে?”
মেসো কোন উত্তর দিলেন না।
মাসিই বলল, “ অপরাজিতা, তুই আর আসিসনা। তোর মেসোর ধারণা, আশার প্রেমের কথা তুই জানতি, ইচ্ছে করেই গোপন রেখেছিস। তোর সাথে আশার এত ভাব, তোর সাথে ঘুমাতে যাওয়ার কথা বলে আশা আমাদের বাড়ি থেকে যেতো, সেখানে কি করতো কেউতো জানতামনা। কাল রাতেও তোর সাথে ঘুমাবে বলেই গেলো, সেখান থেকে চলে গেলো। তোদের বাড়িতে কেউই দেখলোনা আশা এত সকালে বেরিয়ে গেলো? দিদিতো অনেক সকালেই ঘুম থেকে জাগে, দিদিও দেখলোনা?”
-মাসী, তুমি আমা্দের দোষ দিচ্ছো কেন? আমরা ঘুম থেকে জেগে উঠে দেখি আশা ঘরে নেই।
-আমি দোষ দেইনি, আমি তোদেরকে দুষবো কেন, আমি দুষি আমার কপালকে। তোকে আসতে মানা করেছি, আসিস না। তোর মেসো চায় না তুই আর এবাড়িতে আয়।
মাসি একথা বলে সারতেও পারেনি, মেসো দৌড়ে এসে মাসির কোমরে লাথি মারতে শুরু করলো আর বলতে লাগলো, “ ইতর মহিলা, এখন আমার নামে নালিশ দিতাছিস, মাইয়া বাইন্দা রাখতে পারলিনা, এখন আমার নামে দোষ দেস, আইজ তোর একদিন কি আমার একদিন। তুই আমার সংসারের শনি। তোর বাপ আছিল কম্যুনিস্ট, হেই কম্যুনিস্ট বুইড়ার ধারা পাইছে আমার মাইয়া, কম্যুনিস্টগিরি ছুটাইতাছি।”।
আমি ছুটে মাসির গায়ে গিয়ে পড়লাম, মেসোর পা জড়িয়ে ধরলাম। বললাম, “ মেসোমশায়, আমার মাসির দোষ নেই, সব দোষ আমার। আমাকে মারুন, আমাকে মারুন। মাসি কিছু জানেনা, মাসি কিছু জানেনা”।
তখন বুঝলাম মাসির ঠোঁট কেটেছে কিভাবে। আহারে, আশা হয়তো ধারণাও করতে পারে নাই, তার বিপ্লবের মূল্য পরিশোধ করতে হচ্ছে তার মাকে। আমার কিছুই বিশ্বাস হচ্ছিলোনা, মাসী আর মেসোর সম্পর্ক খুব ভাল ছট। তবে মেসো খুব গোঁড়া হিন্দু ছিলেন, যেহেতু আমার দাদু ছিলেন কম্যুনিস্ট তাই দাদুর ছেলেমেয়েদের কেউই গোঁড়া হয়নি। আমার মাও গোঁড়া ছিলেননা, তাছাড়া আমার মা ছিলেন অনেক ব্যক্তিত্বময়ী। মায়ের সাথে আমার বাবা এমন আচরণ করে দেখুক, মা নিশ্চয়ই তাকে উচিত শিক্ষা দিয়ে দিবে। কিন্তু মাসিকে দেখে আমি হতভম্ব। আমার সামনে মাসির এমন অপমান, মাসির চোখে জল নেই।
মাসী বলল, “ অপরাজিতা, বাড়ি যা। যাকিছু দেখলি, সব মিথ্যা। এর কিছুই ঘটে নাই। দিদিকে কিছু বলবিনা। আমার মা নাই, দিদি আমার মা। দিদি সইতে পারবেনা আমার অপমান। বোনজামাইকে দিদি অনেক স্নেহ করে, এসব বলিসনা। তোর মেসোমশাইর দোষ নাই, একটা মাত্র মেয়ে, তারে নিয়া কত স্বপ্ন দেখছে। কত ভাল ভাল বাড়ি থেকে বিয়ের প্রস্তাব আসছিল, এখন কই থাকবে, কি খাবে। বাপের আদরে ছিল মাইয়া, এখন কোন বনে বাদাড়ে, মাঠে ঘাটে ঘুরবে। বাবার মন, উতলা হবেই। হাতের সামনে আমি ছাড়া আর কেউতো নাই, গায়ের জ্বালা মিটাবে কার উপর, আমাকে পাইছে, আমার উপরই সকল জ্বালা ঝাড়ছে।“
সেইদিন থেকে আমি এক লাফে অনেক বড় হয়ে গেলাম। আমার চিন্তার জগতেও বিরাট পরিবর্তন এলো। আমি রাতারাতি অনেক কিছু শিখে ফেললাম। বাড়ি ফিরে মাকে কিছুই বলি নাই। দুই তিনদিন পর কলেজে গিয়ে আশার বান্ধবীদের কাছ থেকে সেলিম ভাইয়ের ঠিকানা জোগার করলাম, একা একা ওদের বাড়ি চলে গেলাম। সেলিম ভাইদের বাড়িটা খুবই সাধারণ, আমার ছোট মাসির বাড়ির কাছে কিছুইনা।
-মা, এই তুমি, এই আজকের তুমি সেদিন এমন সাংঘাতিক এডভেঞ্চার করেছিলে, ভাবতে অবাক লাগে! তুমি একা একা আশা মাসীর বরের বাড়ি খুঁজে বের করে ফেললে?
-সাধারণ টিনের ঘর, আশাকে দেখে চমকে গেলাম। কী সুন্দর লাগছে আশাকে। তার মানে যে সুখের খোঁজে আশা বেরিয়েছিল, আশা সেই সুখ খুঁজে পেয়েছে। আশা আমার হাত ধরে ঘরে নিয়ে যেতে চাইলো। আমি গেলাম, অথচ আমার যাওয়া উচিত ছিলনা। আমি নিজের চোখে আশার মায়ের অপমান দেখেছি, আশার বাবার হাহাকার দেখেছি। তবুও গেলাম, আশা একটিবারও তার মায়ের কথা, বাবার কথা জানতে চাইলোনা। জানতে চাইলেও আমি মাসির অপমানের কথা কিছুই বলতামনা। কারণ আমি চেয়েছি, আশা সুখে থাকুক। এই জীবনে একজনও যদি সুখে থাকে, তাকে সুখে থাকতে দেয়া উচিত। আমি যদি বলে দিতাম, মাসির কথা, বাকী জীবন আশা মনে অপরাধবোধ নিয়ে কাটাতো। যার হাত ধরে পালিয়ে গেলো, তাকে দোষী করতো। ফলাফল কারো জন্যই শুভ হতোনা। এই ভাল, আশা সুখী হয়েছে, আশা সুখে থাকুক। মাসী আর যাই হোক, মেয়েটা সুখে আছে জানলে মনে মনে শান্তি পাবে। আমার কাজই হলো, আমার দুঃখী মাসিটার কাছে মেয়ের সুখের কথা বলা। একদিক ভেবে তো মাসি খুশী হবে!
এরপর আমাদের জীবনে সব উলট পালট হয়ে যায়। ছোট মাসী মেসো এমন বনেদি বাড়ি ঘর সম্পত্তি বিক্রি করে অর্ধেক টাকা মেসোর নিজের প্রতিষ্ঠিত স্কুল ফান্ডে দান করে বাকি টাকা নিয়ে কলকাতা চলে আসেন। স্কুলটা শুনেছি এখন দেশে বেশ নাম করেছে। আমার বাবাও এরপর আর ঢাকা থাকতে চাইলেননা। আশা নিজের আশা পূর্ণ করতে গিয়ে আমাদের সকলের আশা নিভিয়ে দিয়ে গেছিল। ঢাকার বাড়ি ছেড়ে কলকাতা আসার বিন্দুমাত্র ইচ্ছে আমার ছিলনা, তবুও আসতে হয়েছে।
-মা, আশা মাসি এখন কেমন আছে?
-কিভাবে বলবো?
-তুমি কথা ঘুরাচ্ছো কেন? তুমি কি জানোনা? রিংকু তোমায় কিছু বলেনি? তুমি বললেই আমি বিশ্বাস করবো?
-রিংকির খেয়ে দেয়ে কাজ নেই ঢাকা শহরে তার মায়ের হারিয়ে যাওয়া বোন কোথায় কেমন আছে তা খোঁজ করবে।
-মা, রিংকি কলকাতায় জন্ম হলেও বাঙ্গাল ছিল বরাবর। ফেসবুকে রিংকির বন্ধুদের প্রায় সকলেই বাংলাদেশের। রিংকি আশা মাসির সংবাদ জানে।
মায়ের মুখে কালো ছায়া দেখা গেলো, তার মানে ঘটনা মা জানে। আশা মাসির বর সেলিম মেসো কমিউনিস্ট পার্টি করেও কি করে যেন বাংলাদেশের প্রাইম মিনিস্টারের খুব পছন্দের মানুষ হয়ে ওঠেন।প্রাইম মিনিস্টার সেলিম মেসোকে নিজের কেবিনেটে মন্ত্রী বানিয়েছে, এদিকে ওদেশে এখন বেশির ভাগ মানুষ খুব ধর্মাশ্রয়ী হয়ে পড়ায় সেই মন্ত্রীকে হজ্জ্বে পাঠিয়ে গা থেকে কমিউনিস্টের চাদর ফেলে দিয়েছেন। একদা কম্যুনিস্ট সেলিম মেসো এখন হাজী সেলিম হয়ে গেছে। আর আশা মাসী পুরো শরীর বোরকা হিজাবে ঢেকে হাজী মাসি হয়ে গেছে। রিংকি সেদিন দিবাকে আশা মাসি আর সেলিম মেসোর এখনকার ছবি দেখিয়েছে। দিবা অবশ্য হিন্দু মুসলিমের ব্যাপার নিয়ে তেমন মাথা ঘামায়না। দিবা বলল, রিংকি আমাদের মেসো বাংলাদেশের মন্ত্রী! আরিব্বাস!কালই অফিসে গিয়ে সব্বাইকে বলব, আমি মন্ত্রীর ভাগ্নি। মন্ত্রীর ভাগ্নী বলে ঘ্যাম দেখাবো।
রিংকি অবশ্য খুব কনজারভেটিভ, সে কারু কাছে মুসলমান মাসির পরিচয় দিবেনা। রিংকি নিশ্চয়ই মাকেও ছবি দেখিয়েছে, মা দিবাকে কিছু বলেনি।
মা ফের বলল,-তাহলে তুইই বল, নিজের পরিবার, এত বড় বাড়ি, আরাম আয়েস পেছনে ফেলে যে মেয়ে অন্য ধর্মের সাধারণ এক পরিবারের ছেলের সাথে সুখে ঘর সংসার কাটাতে পারে, সেওতো নিজেকে সুখি দাবী করবে। তার সুখ আর আমার সুখ কখনওই মিলবেনা। নিজের চিরচেনা বাড়ি ঘর, নিজের শহর ফেলে এই দেশে পড়ে আছি। এটা কি সুখ? আবার আরেকভাবে চিন্তা করলে মনে হয় সুখেইতো আছি। আমাদের কাজের বৌ আন্নার মত অবস্থায় পড়লে কেমন হতো! আন্নাতো দেশ ছেড়ে আসার পর স্বামী সন্তান নিয়ে যুদ্ধ করে চলেছে। আমারতো তেমন হয়নি।
মা, তুমি কার মত হয়েছো?
-কার মত হবো আবার? বাবা মায়ের সন্তান বাবা মায়ের মতই হয়েছি।
-তা ঠিক নয় মা। দাদু দিদার তিন মেয়ে দুই ছেলে। বাবা মায়ের মতই যদি সন্তানেরা হবে তাহলে তোমাদের পাঁচ ভাইবোনের স্বভাব চরিত্র এক রকম হওয়ার কথা ছিল, তাইনা?
-তুই সব সময় তর্কে আমাকে হারিয়ে দিস।
-তর্কে হার জিতের ব্যাপার নয়, তুমিই বলো আমি ঠিক বলেছি কিনা
- তুইও ঠিক বলেছিস, আবার আমিও ঠিক বলেছি। এই যেমন ধর, আমরা তিন বোন তিন রকমের হলেই কি, আচার ব্যবহার, স্বভাব চরিত্র গঠনে যা কিছু শিক্ষা পেয়েছি মা বাবার কাছ থেকেই। বয়সের একটা পর্যায় পর্যন্ত আমরা সকলেই স্বভাব চরিত্রে এক রকম ছিলাম। এরপর সকলেই বড় হতে হতে কত বিচিত্র মানুষ দেখেছি, মানুষের বিচিত্র ব্যবহার দেখেছি, সেগুলো দেখে একেকজন একেকরকম হয়েছি। তুই আর রিংকির কথা ধর, ছোটনের কথা বাদই দিলাম। তুই হয়েছিস ভীষণ ডাকাবুকো স্বভাবের, রিংকি হয়েছে শান্ত। তোর মধ্যে মেয়েলী স্বভাবটাই নেই, কিন্তু রিংকির মধ্যে আছে।
-মেয়েলি স্বভাব কি মা? আমি কি তোমার খারাপ মেয়ে?
-না না, তুই আমার অনেক ভালো মেয়ে। মেয়েলি স্বভাব পাস নাই বলে আমি কিন্তু মনে মনে খুশি হয়েছি।
অপরাজিতা সরাসরি দিবার মুখের দিকে তাকালেন, চোখের পাতা ফেললেননা কয়েক সেকেন্ড। মায়ের এমন দৃষ্টিতে দিবা কেমন যেন একটু সংকুচিত হয়ে গেলো। মাকে কখনও কারো দিকেই এমন চোখ তুলে তাকাতে দেখেনি দিবা। অস্বস্তিতে পড়ে গেলো দিবা, জিজ্ঞেস করলো, “ অমন করে আমার মুখের দিকে তাকিয়ে আছো কেন? কি দেখছো অমন করে?
মেয়ের প্রশ্নে অপরাজিতা যেন সন্বিত ফিরে পেলেন, মৃদু কন্ঠে স্পষ্ট উচ্চারণে বললেন,
“ তুই কার মত হয়েছিস রে দিবা? আমার মতও হোস নি, তোর বাবার মতও হোস নি। তোর বাবা তার মাকে মাথায় তুলে রাখতো, আর তুই আমাকে দিনে রাতে কতবার মাটিতে ফেলিস। এত ঘেন্না কেন আমাকে? আমার উপর তোর এত রাগই বা কেন?
-তোমাকে ঘেন্না করব কেন মা? এই যে এইমাত্র বললে, মেয়েলি স্বভাব পাইনি বলে তুমি খুশি হয়েছো।
-খুশি? হ্যাঁ রে, খুশির চেয়েও অনেক বেশি স্বস্তি পেয়েছি। কিন্তু ভয় করে, আশাও কিন্তু তোর মত ডাকাবুকো ছিল, কিন্তু কি পরিণতি হলো ডাকাবুকো হয়ে! বুড়ো বয়সে এখন মাথা কান কপাল কাপড় পেঁচিয়ে ঢেকে পুরো মোল্লাবাড়ির বউ হয়ে গেলো। আর সেই সুদর্শন স্মার্ট কম্যুনিস্ট সেলিম ভাই হয়ে গেলো হাজী সা’ব । আশা কি এমন জীবন চেয়েছিল? আমিতো আশাকে জানি, আশা এমন জীবন চায়নি। যে সুখি আশাকে দেখেছিলাম সেলিম ভাইয়ের টিনের ঘরে, আজ অট্টালিকায় বাস করা আশাকে দেখে চিনতেই পারিনি। চেহারার কোথাও সুখের ছিটেফোঁটাও নেই।
মায়ের মুখে এমন কথা শুনবে দিবা কল্পনাও করেনি। বলল, তবে তোমার উপর আমার অনেক রাগ, এটা সত্যি।
-কেন, রাগ কেন?
-তোমার কর্মকান্ড দেখে। একেক সময় মনে হয় তুমি একজন ডাম্ব মহিলা, আত্মসম্মানবোধ নেই। এই যে বাবা তোমাকে এত বাজেভাবে ট্রিট করে তারপরেও তুমি বাবার প্রেমে গদগদ। আসলেই কি তুমি বাবার প্রেমে গদগদ নাকি সবই তোমার অভিনয়? এটাই বুঝে উঠতে পারিনা, তাই তোমার উপর রাগ।
-তোর কেন মনে হয় আমার আত্মসম্মানবোধ নেই?
-তুমিই বলো, তোমার আত্মসম্মানবোধ আছে কিনা? তোমাকে আমার বাবা অপমান করে, তোমাকে তোমার ভাই বোনেরা অপমান করে, তোমাকে আমার পিসীরা অপমান করে, রাগে আমার শরীর জ্বলে অথচ তুমি কিছুই গায়ে মাখোনা। এই মানুষগুলোর সাথে কেমন নেকু নেকু সুরে কথা বলো। তুমি একজন পাক্কা অভিনেত্রী।
-দিবা, তুইকেনবিয়েকরতেচাসনা?
-তোমার মত অভিনয় করে বাঁচতে পারবোনা মা। আমি জানি, তুমি চেহারায় যে সুখি ভাব করে থাকো , তোমার ভেতর অন্য রকম। সেখানে অন্য আরেক মানুষ কাঁদে, একটু সুখের জন্য কাঁদে। বাবা কি তোমাকে ভালো বাসে ? তুমিই বলো , বাবা কি তোমাকে ভালো বাসে? অথচ এই বাবার ভালোথাকা, বাবার সুখআর মনিশ্চিত করতে তুমি সারা দিন কত সময় ব্যয় করো।
-যদিবলি, এসবকরেইআমিসুখপাই।
-না, পাওনা। অভিনয়ইজ অভিনয়, দেয়ারই জনো সুখ।
-পাগলী! সবাইতো সুখী হতে চায়!যেযে ভাবে পারে, যে যেখান থেকে পারে সুখ খুঁজেবের করে, তাইনা? প্রয়োজনে অভিনয় করে, সমস্যা কি?
-সমস্যা আছে, অভিনয়ে সততা থাকেনা, সব টাইমে কি। যেখানে সততা নেই, সেখানে সুখ নেই।
-এত কঠিন কথা বলিসনা তো। এমন লাল টুকটুকে মেয়ের মুখে অমন কঠিন কথা শুনতে ভাল লাগেনা। শোন,আমাদের বিয়ের বেশ কিছুকাল পর আর দশটি আহ্লাদী বউয়ের মত আমিও গদ গদ কন্ঠে তোর বাবাকে জিজ্ঞেস করেছিলাম, " আচ্ছা, আমাকে পেয়ে তুমি কতখানি সুখী?"
সে উত্তর দিয়েছিল, " ৭০% সুখী"।
উত্তর শুনে আমার মাথায় আকাশ ভেঙ্গে পড়েছিল, দুই চোখে জলের বন্যা, ৭০% সুখী মানে? ৯৯% নয় কেন? আমার কান্না দেখে বেচারার মাথায় ঘরের ছাদ ভেঙ্গে পড়েছে।
-সে বলে, জীবনে কেউই ১০০% সুখী হয়না।যারা বলে ১০০% সুখী, তারা মিথ্যে বলে।৭০% সুখি হওয়া মানে তো বিশাল ব্যাপার।
দুজনের জীবনের শুরুতেএমন সত্যবাদী মানুষকে পাশে নিয়ে অসুখী হওয়ার কোন কারণ নেই।কাজেই আমিও সুখেই ছিলাম। হ্যাঁ, সত্যবাদী হলেও তারও কিছু কিছু ভুল, শুদ্ধ হতো,আজওহয়। ভাল-মন্দআগেও ছিল আজও আছে। আমি ভালো টুকুকে নিয়ে সুখী, মন্দটুকু নিয়ে দুঃখী কিন্তু অসুখী নই। দুঃখী আর অসুখী সমার্থক নয়
-কিন্তু তুমি তো সেই কম বয়সে জীবনে ১০০% সুখী হতে চেয়েছিলে, বাবা কি পারতোনা তোমাকে বলতে, হ্যাঁ আমি খুব সুখি? কেন বলতে গেলো৭০%। কম বয়সী সুন্দরী বউটার সাথে একটু না হয় অভিনয়ই করতো! তুমি তো জীবন ভর অভিনয় করছো।
-এইমাত্র তুই যে বললি, অভিনয় করার মধ্যে সততা থাকেনা, সততা না থাকলে সুখ থাকেনা? আবার বাবাকে বলছিস কেন অভিনয় করলো না?
-উফমা, তুমি ডেঞ্জারাস, তুমি আমার মত টেটু মেয়ের কথার ভুল ধরে ফেলেছো !
- এটা সত্যি,আমিও ভাবতাম জীবনে ১০০% সুখী হওয়ার কথা।দিদিদের দেখেছি কেমন সুখ সুখ চেহারা নিয়ে বাপের বাড়ি আসতো, আশাকে কয়েক মিনিটের জন্য দেখেছি সেলিম ভাইয়ের বাসায় সুখ উপচেপড়া চেহারায়, আমি তো খুব লক্ষ্মী মেয়ে ছিলাম, ধরেই নিয়েছি আমি হবো সবচে বেশি সুখি।
আমার ভাগ্য ভাল, জীবনের শুরুতেই আমার স্বামী চরম সত্যি কথাটা বলে দিয়েছিলেন
ঐ অল্প বয়সে এমন কঠিন সত্যি শুনে আঁতকে উঠেছিলামতবে, এটাই ভাল হয়েছিল।
১০০% সুখ পাবোনা জেনে ছোট ছোট সুখ গুলোকেই হৃদয়ে জমা করেছিলাম। তাই দিয়েই তো এখন পর্যন্ত তোদের মাঝে থেকে হাসি, সাজগোজ করি, রান্নাবান্না করি। সকালে জল গরম করে, স্নানের যাবতীয় সরঞ্জাম রেডি করে তোর জন্য বাথরুমে সাজিয়ে রাখি যেন তোর কষ্ট না হয়। তোর বাবা কে সেবা যত্ন করে আমার উপর এতটাই নির্ভরশীল করে ফেলেছি যে আমার প্রতি প্রেম না থাকলেও বাধ্যতামূলক সম্পর্কের নির্ভরশীলতা রয়েগেছে।
-বাধ্যতামূলক সম্পর্ক? এটা কেমন?
-এর আরেক নাম ভালোবাসা। আমাদের মধ্যে এখন আর প্রেমনেই, পরিবর্তে তৈরী হয়েছে ভালো বাসার সম্পর্ক।
প্রেম নেই কেন?
-প্রেম ছিল, প্রথম বয়সে। এরপর প্রেম হালকা হয়ে সেখানে ভালোবাসা গভীর হয়ে উঠেছে। বলতেপারিস, আমার নেকুনেকু অভিনয় দিয়ে যাপিত জীবনের অভ্যাসেই আনমনে আমাদের অজান্তে এই বাধ্যতামূলক সম্পর্কতা তৈরী হয়ে গেছে। এই বাধ্যতামূলক সম্পর্কের কারণেই আমরা কেউ কাউকে ছেড়ে যাবনা এই যে তোর বাবা আমার সাথে মাঝে মাঝেই খারাপ ব্যবহার করে, বাধ্যতামূলক সম্পর্কে ফাটল ধরবে ভয়ে আমি তোর বাবার খারাপ ব্যবহার মুখবুজে হজম করেফেলি। আমিও যদি পালটা জবাব দিতাম,তাহলে আমাদের বাড়িতেও পাশের বাড়ির নীলু কাকী মাদের মত রোজ রাতে থালা বাসন ছোঁড়ার আওয়াজ পাওয়া যেতো, রাতভর আমার করুণ সুরের বিলাপ শোনা যেত।
তুই রাত জেগে দরজায় কান পেতে বুড়ো বাপমায়ের দাম্পত্য কথা শুনিস,আমি সবই টেরপাই ।কিছুবলিনা, বললেই লজ্জা পেয়ে যাবি। তোকে লজ্জায় ফেলতে চাইনা, কিন্তু চাই তুই কান পেতে ঝগড়া শোন। ধীরে ধীরে হয়তো বিয়ে নামক ব্যাপারটায় তোর ভয় কমে যাবে। তোর বাবা যখন একতরফা আমায় বকে,আমি চুপ থাকি বলে ভাবিস মায়ের মেরুদন্ড নেই, মা কিছু বলেনা। আসলে আমিও বলি, অন্য কোন দিন, অন্য কোন সময়ে বলি যখন সব কিছু আমার নিয়ন্ত্রণে থাকে। তখন তোর বাবাও শোনে, কিছু বলেনা। এ ভাবেই আটাশ বছর পেরিয়ে এলাম। আসল কথা হচ্ছে, টাইমিং। টাইমিং ঠিক থাকলে সব সংসারেই সুখ থাকে, সব স্বামী স্ত্রীই সুখে থাকে। টাইমিং ব্যাপারটা যারা বুঝেনা, তাদের সংসারের গল্প অন্যরকম হয়।আমি যখন টাইমিং বুঝে এতটা পথ আসতে পেরেছি, খুব বেশি কঠিন নয় স্বামী স্ত্রীতে সংসার করার গল্প।
-মা, আজ তোমাকে অন্যরূপে আবিষ্কার করলাম। আমার এতদিনের আড়ি পেতে তোমাদের ঝগড়া মানে, বাবার একতরফা দূর্ব্যবহার, তোমার চোরা সময়ে বাবাকে টাইট দেয়ার কাহিনী জেনে আমার বুক থেকে পাষাণ নেমে গেছে। এতদিন ভাবতাম, সংসারে তুমি অত্যাচারিত, নিগৃহীত। আজ বুঝতে পারছি, সংসারে অত্যাচারিতও টাইমিং ঠিক রেখে ছেলেমেয়ের চোখের আড়ালে অত্যাচারীর ভূমিকায় নামে। তুমিও তাহলে বাবাকে ছাড় দাওনা। হা হা! কী মজা , মাই নেকু নেকু মাম্মি রক্স, লাভ ইউ মা লাভ ইউ। আমি যদি কোনদিন বিয়ে করি, যদিও আমার বর আমার সাথে খারাপ ব্যবহার করার সাহসই পাবেনা, তারপরেও তার সাথে যখন আমি খারাপ ব্যবহার করবো আমার বাবুসোনাদের চোখের আড়ালে গিয়ে করব। যেন আমার বাবুসোনারা বাবার দুরবস্থার কথা ভেবে চোখের জল ফেলে আকুল না হয়!
-তুই বড্ড ফাজিল। আমি তোর বাবাকে অত্যাচার করিনা। বরকে বাচ্চাদের আড়ালে অত্যাচার করিস, তবুও বিয়ে কর। যেদিন বরকে অত্যাচার করবি, আগে থাকতেই আমাকে বলে রাখিস। তুই যেমনি আমাদের ঘরের দরজায় কান পেতে শুনিস বাবা মায়ের ঝগড়া, আমিও তোর মেয়েকে বলে দেবো তোদের দরজায় কান পেতে রাখতে। ওর বাবা যদি উঃ মাগো বলে, সাথে সাথে যেন মেয়ে দরজা ভেঙ্গে ঘরে ঢুকে বাবার গলা জড়িয়ে বসে থাকে।
-মা, শোন, আমাকে একটু সেলাই শিখিয়ে দিও। দিদিমা তোমাদের বোনেদের সবাইকে নিজে হাতে ‘ সংসার সুখের হয় রমণীর গুণে’ এমব্রয়ডারি করে মখমলের টুকরো বিছানা বালিশের সাথে দিয়ে দিয়েছিল, আমিও সেলাই শিখে মসলিনের কাপড়ে এমব্রয়ডারি করবো,‘ সংসার সুখের হয় রমণীর গুণে, গুণবান পতি যদি থাকে তার সনে’। তিন টুকরো মসলিনে সূচিকর্ম করবো। একটা আমার, একটা রিংকির, আরেকটা ছোটনের বউয়ের জন্য। আমরা মসলিন কাপড়ের সূচিকর্মটি দামী ফ্রেমে বাঁধাবো, এরপর আমাদের যার যার শোবার ঘরের দেয়ালে এমনভাবে ঝুলাবো যেন দিবা রাত্রি স্বামী স্ত্রী দুজনের চোখেই তাহা ভাসতে থাকে। কেমন আইডিয়া বলো!
মা তুমি আমার চিন্তার জগতটাই বদলে দিলে আজ। তোমার অপরাজিতা নাম সার্থক হয়েছে। সংসার গল্পে তুমি জিতে গেছো। সংসার গল্প রচনা করে আমিও জিততে চাই। তোমার মত করে নয়, তোমার গন্ধ গায়ে মেখে আমি আমার মত করে সংসারের গল্প সৃষ্টি করব।
অপরাজিতা দিবাকে বুকে টেনে নিল, নাক ডুবিয়ে দিল দিবার শ্যাম্পু করা চুলের মাঝে।