দুপুরে খাওয়া দাওয়ার পাট চুকে গেলে হাতে একখানা গল্পের বই নিয়ে বারান্দায় এসে বসা সুমনার অনেককালের অভ্যাস। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ার সময় রোকেয়া হলে থাকতো সুমনা। বাংলা অনার্সের ক্লাসগুলো বেশির ভাগ দুপুরের আগেই শেষ হয়ে যেত। সায়েন্স ডিপার্টমেন্টের ছাত্রীদের মত দুপুরের পর ল্যাবে যাওয়ার ঝামেলা ছিল না, ভাত ঘুম দেয়ার বদলে গল্পের বই নিয়ে বসতো ও। শেষ বিকেলে সুকান্ত আসতো, গেটের নানার কাছে স্লিপ পাঠাতো। স্লিপ হাতে মোমেনা খালা এসে হাজির হতো, “ও সুমনা খালা, খালু আইছে”। সুকান্তকে মোমেনা খালা শুরু থেকেই ‘খালু’ ডাকতো। সুমনা এখনও, বিয়ের এত বছর পরেও মাঝে মাঝে সুকান্তকে “ মোমেনা খালার খালু” বলে ডাকে।
গল্পের বই পড়ার অভ্যাস ওর খুব ছোটবেলা থেকেই। বাপের বাড়িতে ওদের বই পড়ার চল তিন পুরুষ ধরে। সুমনার হাতে গল্পের বই দেখলে মা বা বাবা কেউই মানা করতো না। বন্ধুদের অনেকেই পড়ার বইয়ের নীচে লুকিয়ে গল্পের বই পড়তো, শুনে সুমনা অবাক হয়ে যেত। কেন এমন হবে? পড়ার সময় পড়ার বই পড়া উচিত,অবসর সময়ে গল্পের বই। গল্পের বই পড়া তো খারাপ কাজ নয় যে লুকিয়ে পড়তে হবে!
বাপের বাড়িতে ওদের বারান্দাটা ভেতরের দিকে, পাশেই অনেক বড় বড় বিল্ডিং থাকায় বারান্দায় বসলে পাশের বাড়ির রান্নাঘরের জানালা, বাথরুমের জানালা থেকে সুমনাদের বারান্দার সবকিছু দেখা যেত। তাই সুমনা বারান্দায় খুব একটা যেতো না। দেখতে সুন্দরী ছিল বলে বারান্দায় দাঁড়ালেই পাশের বিল্ডিং থেকে নানা বয়েসী ছেলেদের ছাদের রেলিং ঘেঁষে দাঁড়াতে ইচ্ছে করতো, শিস দিয়ে “ ও চোখে চোখ পড়েছে যখনই” সুর তোলার অক্লান্ত চেষ্টা চলতো। কিশোরীবেলায় দুপুরে খেয়ে দেয়ে গল্পের বই হাতে সুমনা বিছানায় চলে যেতো, বালিশে আধশোয়া হয়ে গল্পের বই পড়তো, ঘুমিয়ে পড়তো।
সুকান্ত পেশায় ইঞ্জিনিয়ার, বুয়েট থেকে পাশ করেই সরকারী চাকরিতে জয়েন করে। প্রমোশন পেয়ে ও এখন অনেক উঁচু পোস্টে পৌঁছে গেছে। এক ছেলে, এক মেয়ে আর স্ত্রী সুমনাকে নিয়ে সুকান্তর সুখের সংসার।
সুকান্তর মধ্যে ছোট একটা সমস্যা আছে, ছোটবেলা থেকেই ও ভূত ভয় পায় এবং এর জন্য তাকে এই বয়সেও নিয়মিত ডাক্তারের প্রেসক্রিপশান মেনে চলতে হয়। প্রথম যেদিন সুকান্তর মুখে ভূত ভয় পাওয়ার কথা শুনেছিল সুমনা, ভেবেছিল সুকান্ত বুঝি ওর সাথে মজা করছে। ছেলেরা ভূতে ভয় পায়! তাও আবার ইঞ্জিনিয়ারিং পড়ছে যে ছেলে! এসএসসি, এইচএসসিতে বোর্ডে স্ট্যান্ড করা ছেলে! কী বলছে এসব? সুমনা মেয়ে হয়ে ভূত পেত্নী ভয় পায় না আর সুকান্ত ছেলে হয়ে ভয় পায়?
ধীরে ধীরে সুমনা বিশ্বাস করেছে, সুকান্ত ঠাট্টা করছেনা। ও আসলেই ভয় পায়। কখনও একা থাকতে চায় না। ঘর অন্ধকার করে ঘুমায় না। আজও সুমনাকে শোবার ঘরে খুব অল্প পাওয়ারের বাতি জ্বালিয়ে রাখতে হয়।
সুকান্ত যতবার যেখানেই বদলী হয়েছে, সুমনাকে সাথে যেতে হয়েছে। ছেলে মেয়ে দুটোর স্কুল পাল্টাতে হয়েছে প্রতিবার। সুমনা বিরক্ত হয়নি অবশ্য, কি আর এমন ক্ষতি হয় স্কুল পাল্টালে, সব জেলাতেই স্কুলে একই বই পড়ানো হয়। আসল হচ্ছে, ঘরে কে কতটুকু লেখাপড়া করে। ছেলে এবং মেয়ে দুজনেই লেখাপড়ায় খুব ভাল হয়েছে। শমিত এখন বুয়েটে থার্ড ইয়ার পড়ছে, সুস্মিতা ময়মনসিংহ মেডিক্যাল কলেজে সেকেন্ড ইয়ার।
সুকান্ত যে ঠিক ভূতের ভয় পায় তাও না। একা থাকলেই নাকি ও আশেপাশে আপনজনের কথা শুনতে পায়। যারা ঘরে নেই, তাদের কথা শুনতে পায়। একদিন একটা ঘটনা ঘটেছিল। তখন ওরা রাজশাহী থাকতো। এক বিকেলে সুকান্ত আর শমিতকে বাড়িতে রেখে সুমনা গেছিল সুস্মিতাকে নিয়ে গানের স্কুলে। শমিতের যাওয়ার কথা ছিল কিন্তু ওর শরীর খারাপ লাগছিল তাই ঘুমিয়ে পড়েছিল। গানের স্কুলে সুমনা অন্য মায়েদের সাথে গল্প করছিল, তখনই সুমনার ফোন বেজে ওঠে। মোবাইল ফোন তখন অতটা রমরমা হয়নি, তবে সুকান্ত একখানা মোবাইল ফোন কিনেছিল। যে যখন বাইরে যেত, মোবাইলটা সাথে নিয়ে যেত যেন প্রয়োজনে বাড়ির ফোনে কল দেয়া যায়।
ফোন পেয়ে ওর বুক ধ্বক করে উঠেছিল, শমিতের কি শরীর বেশি খারাপ হয়ে গেলো! উৎকন্ঠা নিয়ে হেলো বলতেই সুকান্তর ভয় পাওয়া কন্ঠস্বর, “ সুমনা, তুমি কোথায়”?
-কেন, কী হয়েছে? আমি গানের স্কুলে এখনও। আর কুড়ি মিনিট পরেই ক্লাস শেষ হয়ে যাবে।
-সুমনা, তুমি কি ঘরে কিছু ফেলে গেছিলে? সেটা নিতে এসেছিলে কিছুক্ষণ আগে?
-আমি? না তো! কেন কি হয়েছে?
-সুমনা, তুমি চলে আসো। আমার ভয় করছে। একটু আগেই দরজা খোলার শব্দ পেয়েছি, ভেবেছি তোমরা চলে এসেছো। ফ্রিজের দরজা খোলার শব্দ হলো, গ্লাস টেবিলে রাখার শব্দ পেয়ে আমি তোমাকে ডাকছিলাম আমাকে এক গ্লাস জল দেয়ার জন্য। তুমি বুয়ার সাথে কথা বলছিলে। জল আনতে দেরী হচ্ছে দেখে আমি তোমাকে আরও কয়েকবার ডেকেছি। তুমি সাড়া দিচ্ছিলে না দেখে কিচেনে গিয়ে দেখি তুমি নেই। এখন তো তুমি বলছো, তুমি আসোনি! তাহলে কে কথা বলছিল?
-তুমি ভয় পেয়োনা। যাও, শমীর পাশে বসে থাকো, ওর গায়ে হাত রাখো, ভয় কেটে যাবে। আমি আসছি। তুমি ঠিকই দরজা খোলার শব্দ শুনেছো, পাশের বাড়ির মলির মায়ের অফিস থেকে ফেরার সময় এখন। মলির মা নিশ্চয়ই তার কিচেনে এসেছিল। ওদের কিচেন তো আমাদের ঘরের পাশে।
-উফ! বাঁচলাম। তাই হবে, আমার হাত পা ঠান্ডা হয়ে গেছে ভয়ে!
সেদিন সুমনা খুবই চিন্তায় পড়ে গেছিল। সুকান্তকে মিথ্যে বলেছে ও, যেদিন গানের ক্লাস থাকে, মলির মা অফিস থেকে সরাসরি গানের স্কুলে চলে আসে। মলিকে তুলে নিয়ে একসাথে বাড়ি ফিরে। এসব মেয়েলি সংবাদ সুকান্ত জানে না। মলির মা সুমনার চেয়ার থেকে কয়েক চেয়ার দূরেই বসে ছিল। সুমনা এসেই মলির মা’কে ওখানে দেখেছে।
সুমনা সুকান্তর এই ভয়ের ব্যাপারটাকে সিরিয়াসলি নিয়েছিল। তখন থেকেই সুমান্ত ডাক্তারের বিধান মেনে চলার চেষ্টা করে যাচ্ছে। আগের চেয়ে এখন সুকান্ত ভাল থাকলেও আজও মাঝে মাঝে আপনজনের কথা নাকি শুনতে পায়, তবে আগের মত ভয় পায় না।
ডাঃ হকের একটা কথা সুমনা আর সুকান্তর খুব মনে ধরেছিল। উনি বলেছিলেন, “ভূত বলে কিছু নেই। এটা বিজ্ঞানের খেলা, মানুষের কথা প্রতিনিয়ত রেকর্ডেড হচ্ছে এই পৃথিবীর মাটিতে, বাতাসে এমনকি প্রতিটি বাড়ির আনাচে কানাচে। বাতাসে মিলিয়ন, বিলিয়ন, ট্রিলিয়ন কথামালা বেজে চলেছে। এই যে আমরা এখন কথা বলছি, কথাগুলো সবই প্রকৃতিতে রেকর্ডেড হয়ে যাচ্ছে। এই কথাগুলো কিন্তু সবসময় বাজছে বাতাসে, আমরা শুনতে পাচ্ছিনা। কারণ আমাদের এন্টেনার শক্তি কম। খুব অল্প মানুষের ব্রেনের এন্টেনা খুবই পাওয়ারফুল। তাদের এন্টেনাতে মাঝে মাঝে রেকর্ডেড কথাগুলো ধরা পড়ে, তখনই সে অনুপস্থিত মানুষের কথা শুনতে পায়। সুকান্ত বাবু, আপনি ভাগ্যবান। আপনার ব্রেনে একটা হাই পাওয়ার এন্টেনা আছে, তাই আপনি প্রকৃতিতে বাজতে থাকা ট্রিলিয়ন ট্রিলিয়ন কথামালার এক দুই টুকরো শুনতে পান। এটা মোটেই কোন ভৌতিক ব্যাপার নয়”।
দুই
এই বাড়িতে প্রায় সাত বছর কেটে গেছে! এখন আর সেই আগের মত তিন বছর পর পর বদলি হতে হয় না। পাঁচতলা এই বাড়ির দোতলায় থাকে ওরা। এই বাড়ির বারান্দাটা সুমনার খুবই প্রিয়, একেবারে রাস্তার উপর বারান্দা। বারান্দায় দাঁড়িয়ে উপরের দিকে তাকালে সম্পূর্ণ আকাশ দেখা যায়, নীচের দিকে তাকালে চওড়া রাস্তা দেখা যায়। এই বাড়ির বারান্দা ঘেঁষে কোন বিল্ডিং নেই বলে সুমনা নিশ্চিন্তে বারান্দায় বসতে পারে, কিছুক্ষণ দাঁড়াতে পারে।
আজও বারান্দার রেলিং ঘেঁষে পেতে রাখা আরাম চেয়ারে হেলান দিয়ে সুনীলের ‘অর্ধেক জীবন’ পড়ছিল সুমনা। অনেকক্ষণ বইয়ের দিকে তাকিয়ে থাকলে আজকাল চোখ টন টন করে। মনে হচ্ছে খুব শীঘ্রই চশমা লাগবে। চোখ টনটন করছিল বলে ‘অর্ধেক জীবনে’র খোলা পাতায় বুক মার্কার দিয়ে সুমনা রাস্তার দিকে চোখ রাখলো। বিকেল হলেই পাড়ার ছেলেমেয়েরা দল বেঁধে পাশের পার্কে যায় খেলাধূলা করতে, বয়স্করা যায় হাঁটতে। আজকাল মহিলারাও যায় পার্কে। মহিলাদের কে কেমন শাড়ি পরলো, সালোয়ার কামিজ পরলো তা দেখতে ভালো লাগে ওর। আজকাল অবশ্য মহিলাদের প্রায় সবাই হিজাব পরে, আপাদমস্তক ঢাকা সউদি বোরকা পরে পার্কে যায়। সুমনার মন খারাপ লাগে এতকালের চেনা মুখগুলো আর দেখা যায় না বলে।
রাস্তার দিকে তাকিয়ে থাকতে থাকতেই একজনকে দেখে সুমনা চমকে উঠলো! আরে, ও কে যাচ্ছে! নীতু না? একজন যুবকের সাথে হেঁটে যাচ্ছে, হয়তো পার্কের সামনে গিয়ে রিকশা নেবে। নীতু তো? তেমনই লম্বাটে গড়ন, কোমর ছাড়ানো লম্বা বিনুনি, দারুণ সুন্দর সিল্কের শাড়ি পরেছে। পেছন থেকে পুরো দেখা না গেলেও পাশের ছেলেটির সাথে যখনই ঘাড় ঘুরিয়ে কথা বলছে, তাতেই সুমনার মনে হচ্ছে, ও নীতু। কিন্তু নীতু এখানে আসবেই বা কেন? এখানে ওর কে থাকে? ওকে সুমনা দেখেছিল রাজশাহীতে থাকার সময়। বড় বোন মিতুর বাড়িতে মাত্র এক মাসের জন্য বেড়াতে এসেছিল! বিশেষ কারণে নীতুকে হাওয়া বদলের জন্য ঢাকা থেকে রাজশাহী পাঠানো হয়েছিল। সুমনার সাথে খুব ভাব হয়েছিল! এরপর বছর দশ হয়ে গেছে সুমনারা রাজশাহী ছেড়েছে। আচ্ছা, নীতু এখন কেমন আছে? ও কি আজও পুতুলকে দেখতে পায়?
তিন
সুকান্ত যে বছর রাজশাহী বদলী হলো, তার তিন বছর আগে ইকবাল মাহমুদ সাহেব রাজশাহী স্থায়ী পোস্টিং পেয়েছেন। রাজশাহীতে ইকবাল মাহমুদ সাহেবের পৈতৃক নিবাস। সরকারী চাকরিতে এত সহজে নিজের জেলা শহরে পোস্টিং পাওয়া যায়না। ইকবাল মাহমুদ সাহেবের খুঁটির জোর আছে, তাই তিনি স্থায়ী পোস্টিং পেয়ে গেছেন। পৈতৃক বাড়ি থাকলেও ইকবাল সাহেব সরকারী কোয়ার্টারেই থাকতেন। একই কম্পাউন্ডে পাশাপাশি বিল্ডিং্যে সুকান্ত তার ফ্যামিলি নিয়ে থাকতো।
ইকবাল মাহমুদের স্ত্রীর নাম মিতু, খুবই সুন্দরী এবং স্মার্ট। সুমনা নিজেও সুন্দরী কম নয়, তবে মিতু যেন একটু বেশিই সুন্দরী ছিল। সুমনা আর মিতুতে খুব ভাল সম্পর্ক গড়ে উঠে। দোতলার বারান্দায় দাঁড়িয়ে দুই সখিতে দিনে রাতে কত যে গল্প চলতো। মিতুর বাপের বাড়ি ঢাকায়, মাঝে মাঝে মিতু যখন ঢাকা যেত, ইকবাল সাহেব সুমনাদের সাথেই ডিনার করতো।
এভাবেই দুই বছর পেরিয়ে যায়। একদিন সুমনা জানতে পারে, ঢাকা থেকে মিতুর মা বাবা আর ছোট বোন আসছে। বাবা মা আসছে, মিতুর ভারী খুশি হওয়ার কথা, কিন্তু মিতুর মন খারাপ ছিল। কারণ বাবা মা আনন্দ ভ্রমণে আসছেনা। মিতুর ছোট বোনের নাকি শরীর খুব খারাপ, হাওয়া বদলের জন্য ছোট মেয়েকে নিয়ে উনারা বড় মেয়ের কাছে বেড়াতে আসছে।
মিতুর বাবা মা বোন এলো, বারান্দায় দাঁড়িয়ে সুমনা সব দেখছিল। মিতু সুন্দরী, কিন্তু মিতুর বোন তো একেবারে ডানাকাটা পরীর মত দেখতে। গায়ের রঙ গোলাপী, তার মধ্যে পরেছিল হালকা গোলাপি রঙের সালোয়ার কামিজ। চারদিকটাই সেদিন গোলাপি হয়ে উঠেছিল!
মাত্র সাত দিনেই মিতুর বোন নীতু সুমনার ভক্ত হয়ে গেলো। সুমনাকে ও বৌদি ডাকলো, বৌদির সব কিছুই ওর ভালো লাগে। বৌদি কথা বলে সুন্দর করে, বৌদি দারুণ রবীন্দ্র সঙ্গিত গায়, বৌদির হাতের রান্না অতি চমৎকার আর দেখতে বৌদি একেবারে দেবী প্রতিমার মত! যতরকম ভাল বিশেষণ জানা ছিল, তার সবগুলোই সুমনার পেছনে খরচ করে ফেললো নীতু। নীতুকেও সুমনার খুব মনে ধরে গেলো। এত সুন্দরী, অথচ এতটুকু অহঙ্কার নেই, মাটির মত নরম মন। এমন সুন্দরী মেয়ের কী অসুখ হতে পারে! প্রেমঘটিত কোন সমস্যা নয়তো? সুমনার সাথে মিতুর এত ভাল সম্পর্ক অথচ বোনের অসুখ নিয়ে একটা কথাও সুমনার সাথে বলেনি। নীতু প্রতিদিন সুমনাদের ঘরে চলে আসতো, সুমনার বিশাল বইয়ের সংগ্রহ দেখে অবাক হয়ে যেত।
পনেরো দিনের মাথায় সুমনার সাথে বসে চা খাওয়ার এক ফাঁকে নীতু বলল, “বৌদি, আমার মনে হয়, আমি বেশীদিন বাঁচবো না।
-কী সব আজেবাজে কথা বলছো নীতু?
-আজেবাজে নয়। মারা যাওয়ার আগে আমার কিছু গোপন কথা আপনার সাথে শেয়ার করতে চাই।
-গোপন কথা, প্রকাশ্য কথা সবই শেয়ার করতে পারো আমার সাথে, কিন্তু ‘মারা যাচ্ছি, বাঁচবো না’ জাতীয় বাজে কথা বলবেনা।
নীতু শুরু করলো, “ বৌদি, বাড়ির সবাই ধরে নিয়েছে, আমি খুব অসুস্থ। তাই আমাকে হাওয়া বদলের জন্য এখানে নিয়ে এসেছে। কেন নিয়ে এসেছে, আমি তো অসুস্থ নই। আমাকে এরা সবাই মিলে অসুস্থ বানিয়ে ফেলছে।
-তুমি অসুস্থ নও, এ তো খুশির কথা। তাহলে মারা যাওয়ার প্রশ্ন আসছে কেন নীতু?
-বৌদি, বিশ্বাস করেন, আমার শরীরে কোন অসুখ নেই। আমার শুধু একটাই সমস্যা, আমি খুব মনের কষ্টে ভুগছি। বাড়ির কেউ আমার কষ্টটা বুঝতে চায় না। আমার যা সমস্যা, বলতে গেলেই সবাই হল্লা চিল্লা করে বাড়ি মাথায় তুলে ফেলে। তাই আমি চুপ করে থাকি আজকাল। তাতেও সমস্যা, ওরা ভাবে, আমি পাগল হয়ে যাচ্ছি।
-কি কষ্ট? আমাকে বলা যায়?
-আপনাকে বলবো বলেই তো এলাম। আপনাকে প্রথম দিন থেকেই আমার অনেক আপনার জন মনে হয়েছে। আপাকেও অনেক ভালোবাসি, তবে আপনাকে দেখলে অনেক ভরসা পাই। আপনার মধ্যে মা মা গন্ধ আছে, আপনি বুঝবেন আমার কষ্ট।
সুমনা নীতুর ডান হাতে আলতো করে চাপ দিয়ে বলল, তুমি বলো। আমি মন দিয়ে শুনবো।
-আমি গত এক বছর যাবত আমার বাল্যকালের বন্ধু পুতুলকে দেখতে পাই। মৃত পুতুল আমার সাথে দেখা করতে আসে।
-মানে?
-মানে, যে বন্ধু কৈশোরে আত্মহত্যা করে মারা গেছে, তাকে দেখতে পাই। ওর নাম ছিল পুতুল। পুতুল প্রায়ই আমার কাছাকাছি এসে বসে থাকে। কথা বলে না, শুধু করুণ চোখে তাকিয়ে থাকে আমার দিকে।
-সে কি?? এমন কথা শুনলে তো বাড়ির লোক দুশ্চিন্তা করবেই।
-বৌদি, শুনেন আমার কথা। আমরা তখন কুমিল্লা থাকতাম, ক্লাস নাইনে পড়ি। আমার আব্বা অনেক ধনী হলেও আমি খেলাধূলা করতাম ধনী, গরীব সকল ছেলেমেয়ের সাথে। পুতুলরা ছিল খুবই গরীব। সেই পুতুলের সাথেই আমার বন্ধুত্ব ছিল আঠার মত। আম্মা একটু রাগারাগি করতো পুতুলের সাথে এত মেলামেশা করতাম বলে।
সারাদিন আমি আর পুতুল একসাথে পাড়াময় ঘুরে বেড়াই। ছোটবেলা থেকেই আমি একটু ডানপিটে স্বভাবের ছিলাম। গাছে উঠা, নৌকা বাওয়া, জাল ফেলা, বরসি দিয়ে মাছ মারা, ধান লাগানো সব করতাম। পুতুল ছিল আমার উলটো, খুব শান্ত স্বভাবের ছিল। আমি যা বলতাম তাই শুনতো। আমি ওকে বন্ধু ভাবলেও ওর মধ্যে একটু জড়তা ছিল। আমার মত বড়লোকের মেয়ে ওর সাথে এত খাতির করছি, ও কিছুটা জড়সড় হয়ে থাকতো। তবে আমার পাশে পাশেই থাকতো।
রঘু কাকাদের বাগান থেকে কাঁচা টক বরই চুড়ি করে নিয়ে এসেছিলাম এদিন। বিকেলে গুড় দিয়ে মেখে খাবো বলে। পুতুল আবার খুব ভাল আচার বানাতে পারতো। পুতুলদের বাসায় গুড় ছিল না বলে ও তার রুমালে বরইগুলো বেঁধে দিয়েছিলো আমি যেন বিকেলে গুড় দিয়ে মেখে দীঘির পাড়ে নিয়ে যাই। সেদিনই ঘটনা ঘটে। পুতুল আমার কাছে বরইয়ের পোঁটলা দিয়ে যখন ঘরে ফিরছিল, আসিফ আর হানিফ নামের দুই বদমাইশ ওকে ধর্ষণ করে। কোথায় ধর্ষণ করলো, কিভাবে করলো আমি জানি না। ছোট ছিলাম তো, তাই আমাকে এসব বাজে কথা নিয়ে কেউ কিছু জানায় নি। ধর্ষণের কথা জানাজানি হতেই তার সাথে মিলামিশা করা আমার জন্য নিষিদ্ধ হয়ে গেল।
আমাদের বাড়ির পাশেই ছিলো তাদের বাড়ি। পুতুলের কাছে আমাকে আর যেতে দেওয়া হল না। বরই আর মাখা হয়নি, খাওয়াও হয়নি। ঐ দিন ই ছিলো আমাদের শেষ দেখা। পুতুলের সাথে দেখাও হয়নি, কথাও হয়নি। পুতুলের রুমালটা এখনো আমার কাছে আছে। আপনাকে দেখাবো।
নীতুর চোখ দিয়ে অঝোর ধারায় জল গড়াচ্ছে। দেখে সুমনার নিজেরই চোখ ভিজে উঠেছে। ওর পিঠে হাত বুলিয়ে দিতে দিতে সুমনা বলল, -আজ থাক, আরেকদিন শুনবো।
নীতু থামলো না, বলতে লাগলো। “ আপারা তখন খুলনা থাকে। পুতুলের ঘটনার কয়েকদিনের মধ্যে আমাকে মা খুলনা বড় আপার বাসায় পাঠিয়ে দিল যাতে পুতুলের সাথে আমি আর মিলামিশা না করতে পারি। খুলনায় আমাকে স্কুলে ভর্তিও করে দেওয়া হয়। একদিন শুনলাম, পুতুল মারা গেছে। পুতুল মারা গেছে কথাটা শোনার সাথে সাথে আমি নাকি অজ্ঞান হয়ে যাই। তারপরে আমি আর কিছু মনে করতে পারিনা। শুনেছি আমি অনেকদিন অসুস্হ্ ছিলাম। সেই বছর আর ক্লাস টেনে উঠা হয়নি। এরপর ধীরে ধীরে আবার সব স্বাভাবিক হয়ে যায়।
বৌদি আমি ক'দিন থেকে যে কথাটা আপনাকে বলতে চাইছি এখন সেটা বলবো। এই কথাটা আমি কাউকে বলতে পারছিনা। কথাটা হলো, আমি পুতুল কে দেখতে পাই। আমি ভাবি, আমার চোখের ভুল। আসলে ভুল নয়। ভুল একবার হয়, বার বার হয় না। পর পর কয়েকদিন ঘটনাটা ঘটেছে। আমার যে খুব আনন্দ হয় পুতুলকে দেখে, তা কিন্তু নয়। একজন মৃত মানুষকে দেখা আনন্দময় ঘটনা হতে পারেনা।
কিছুদিন আগে কুমিল্লা থেকে চাচাতো ভাই, ভাবী, বাচ্চারা এসেছিলো আমাদের বাসায়। প্রায় এক সপ্তাহ থেকে গেল। দুনিয়ার জায়গা বেড়ালাম। ভাবলাম আর দেখবো না পুতুলকে এত মানুষদের মাঝে। কিন্তু তারপরেও ব্যাপারটা ঘটেছে। এখানে এসেছি, এখানেও পুতুল আসে। দুলাভাই অবশ্য ছোটবেলার এই কাহিনী কিছুই জানে না। দুলাভাই যদি এখন এই ব্যাপারটা শুনে, সাথে সাথে মা, বাবাকে খবর দেবে। তাঁরা ঢাকা থেকে উড়ে চলে আসবে। আমাকে ঢাকা নিয়ে যাবে। আবার ডাক্তার, ঘুমের ঔষধ। কি করবো বৌদি? আমার খুব ভয় করে। কেন এমন হচ্ছে।
-পুতুল এসে কী করে?
- কিছুই করেনা, আমাকে কিছু বলেও না। শুধু আমার কাজকর্ম দেখে। যেমন ধরেন বাসায় মেহমান, আমি রান্না করছি, হঠাৎ তাকিয়ে দেখলাম পুতুল মনযোগ দিয়ে আমি কি রান্না করছি চুপ করে দেখছে। আবার বারান্দায় কাপড় তুলছি, দেখছি পুতুল বারান্দার এককোণে দাঁড়িয়ে চুপচাপ নীচে তাকিয়ে আছে। আমার সাথে কোন কথা বলেনা। সেদিনও আপার বারান্দায় ও দাঁড়িয়ে ছিল। আমার এখন খুব কান্না পায়। ভয় লাগে, পুতুল কি আমাকে নিয়ে যেতে চায় বৌদি?
-ভয় পেয়ো না, মন খারাপ করো না, বিজ্ঞান যদি সত্যি হয় তাহলে চোখের ভুল। আর যদি চোখের ভুলই হয় তাতেও ক্ষতি নেই, চোখের ভুল দেখলেইবা! তবুও প্রিয় বন্ধুকে দেখছ, এটাই বা কম কি?
-মাঝখানে আমি খুবই অসুস্থ হয়ে গিয়েছিলাম। তখন বড় আপা, মেজ আপা, ভাইয়া ভাবী, আমার খালা ফুফু সব্বাই ঢাকা আমাদের বাড়ি চলে এসেছিলো আমাকে দেখতে। বৌদি, সে অনেক কাহিনী। আমি যতখানি অসুস্থ ছিলাম, তার চেয়ে অসুস্থ আমাকে সব্বাই মিলে বানিয়ে ফেলেছিল। হা হা হা হা! আমি পুতুলকে দেখি, এই কথা তো মা কারো কাছে বলতে পারে না। খালি বলে, নীতু ভূতের ভয় পেয়ে অসুস্থ হয়ে গেছে। লাভ কিছুই হয় নাই, উলটা বাড়ি ভর্তি মেহমান, এদের খানা দানার আয়োজন করতে করতে বিরক্ত হয়ে আমাদের কাজের বুয়াটাই চলে গেছে! হা হা হা!
- এভাবে হাসছো কেন নীতু?
-ভয় পাচ্ছেন বৌদি, ভয় নেই, এখন আমি পাগল নই। সত্যি সত্যি হাসছি মেহমানদের কান্ড কারখানার কথা মনে করে।
-নীতু, তুমি কি একদিন তোমার আম্মা, আপাদের একত্র করে সব বলতে পারবে? তুমি বলবে, ওরা তোমার সাথে অন্যায় করেছিল, গরীব হলেও পুতুল ছিল তোমার প্রাণের বন্ধু। বন্ধুর দূর্দিনে তুমি যদি পাশে থাকতে পারতে, হয়তো পুতুল মারা যেতো না। ওরা তোমাকে বন্ধুর কাছ থেকে দূরে সরিয়ে দিয়ে ভুল করেছে।
-আপনার মতো কেউ কখনো এমন করে বুঝিয়ে বলেনি আমাকে। আমার অনেক সৌভাগ্য আপনার মতো মানুষের সাথে আমার পরিচয় হয়েছে। আমার প্রেমিকের নাম শফিক।
-তোমার প্রেমিকের কথাতো বলোনি!
-প্রেমিকের কথা কী আর বলবো। আপনাকে শফিকের কথা বলিনি, কিন্তু শফিকের সাথে প্রতিদিন আপনাকে নিয়ে কথা বলি। শফিক হাসে আর আমার গল্প মনযোগ দিয়ে শুনে। আপনি খুব ভালো বৌদি, আপনি অনেক বোঝেন।আপনাকে সব বলা যায়। আপনি অনেক ভালোবাসতে পারেন, অনেক স্নেহ দিয়ে কথা বলতে পারেন। আমি মুগ্ধ। আমি আপনার জন্য পাগল। আমরা তো মুসলিম। তারপরেও আমি আল্লাহকে বলি 'আল্লাহ পরজন্ম বলে যদি সত্যিই কিছু থাকে, আমাকে তুমি সুমনা বৌদির মেয়ে কিংবা বোন করে দিও। শফিক সব শোনে আর হাসে।
--হা হা হা! হিন্দু মুসলিম কিছু নয় গো। মরলে সবাই এক পথে যায়। তবে কেউ আবার ফিরে আসে কিনা কেউ জানেনা, তেমনি কেউ যে একেবারেই আসেনা তাও কেউ বলতে পারেনা। পৃথিবীতে অনেক রহস্য আছে। জাতিস্মর বলে একটা কথা আছেনা? যদি তা সত্যি হয়, তাহলে তুমি আমার কন্যা হয়ে নাহলে বোন হয়ে এসে জানিও, তুমি যে আগের জন্মে নীতু ছিলে, আমি সুমনা বৌদি ছিলাম।
- আচ্ছা বৌদি, তাহলে কি পুতুল যে আসে, তা সত্যি?
-আমি জানিনা। ঐ যে বললাম পৃথিবীতে অনেক রহস্য আছে! পুতুল মিথ্যে না বলে বরং বলি, তোমার বিশ্বাস। তোমার কাছে তোমার বিশ্বাসটাই সত্য। বিশ্বাসে পাপ নেই যদি তা অন্যের ক্ষতির কারণ না হয়। শুধু নিজের বিবেক দিয়ে বুঝার চেষ্টা করবে। ভয় পেয়োনা, মনে করো, পুতুলের মাধ্যমে তুমি তোমার হারিয়ে যাওয়া কৈশোরকে দেখছ।
মাস ফুরিয়ে যেতেই নীতু আবার ঢাকা ফিরে যায়। ততদিনে ও অনেকটাই সহজ এবং শান্ত হয়ে গেছে। মিতু জানতে পারেনি নীতু সব কথা সুমনাকে বলে গেছে। একদিন নীতু সুমনাকে ফোন করে বলল, “ বৌদি, আমি পেরেছি। মা ,আপাদের ঐ কথাটা বলেছি। তোমরা পুতুলের সাথে আমাকে দেখা না করতে দিয়ে অনেক বড় অন্যায় করেছো। শুধু একটা কথা বলি, পুতুলের এক দূরসম্পর্কের ভাই তাকে ধর্ষণ করে। তোমরা কেউ সেই ধর্ষকদের জুতাপেটা করোনি, পুতুলকে একঘরে করে দিয়েছো, তাতেই পুতুল মানসিক ভারসাম্য হারিয়ে অসুস্হ হয়ে মারা যায়। তোমরা সবাই পুতুলের মৃত্যুর জন্য দায়ী। পুতুলও তোমাদের ক্ষমা করেনি, আমিও করবো না।
মা অবাক হয়ে চোখ গোল, গোল করে বলছে, এত বছর পরে এসব কি বলছিস? আমি বলেছি, হ্যাঁ, সেজন্যই পুতুল আমার কাছে এসে মুখ কালো করে দাঁড়িয়ে থাকে। মা বলে, সর্বনাশ! এতদিন কেন আমাকে এসব বলোনি?......... ইত্যাদি, ইত্যাদি। হা হা হা! বৌদি, এখন আমার হাতে, কোমরে, গলায় তাবিজ।মা দিয়েছেন। হি হি হি, তবে ওরা জানেনা আমি তাবিজ খুলে ফেলেছি। কারণ আমি পুতুল কে দেখতে চাই। আপনার কথাগুলো শোনার পর থেকে আমি আর ওকে ভয় পাইনা। এত বছর পর আমি কেন পুতুলকে দেখতে পেলাম? ও কেন আমার কাছে এলো? আমাকে কি বলতে চায়?
এখন পুতুলের কথা কারো সাথে বলতে পারিনা বৌদি। ওর কথা তুললেই সবাই রাগ করে। বলে চুপ কর পোড়ামুখী। আমি চুপ করে থাকি। আপনার কথাগুলো শুনে অনেক শান্তিতে আছি। আল্লাহ আপনয়ার ভালো করুক বৌদি। ইদানিং আমার শরীরটা খুব খারাপ লাগে, রাতে ঘুম হয় না তো। আপা দুলাভাই মা বাবা কাউকেই শরীর খারাপের কথা বলিনা। বললেই ওরা বলবে, পুতুলের কথা ভেবে ভেবে শরীর খারাপ করছি। বৌদি, আমি আসলে পুতুলকে দোষের ভাগী করতে চাইনা।
পুতুলের কথা আর কারো সাথে বলতে হবে না। তুমি পুতুলকে দেখে দেখে যখন অভ্যস্ত হয়ে যাবে, তখন পুতুলকে আর দেখবে না। মা বোন সেদিন অন্যায় করেছিল বিনা অপরাধে পুতুলেরঅকাছ থেকে তোমাকে সরিয়ে নিয়ে। তুমি বুঝতে পারোনি ছোট ছিলে বলে। আজ যেহেতু বুঝতে পেরেছো ওটা অন্যায় ছিল তোমাদের দুই বন্ধুর প্রতি, তাই আজ এত বছর পরে হলেও তুমি প্রতিবাদ করছো। অন্যায়ের প্রতিবাদ করলেই মন থেকে ভয় চলে যায়,
বিশ্রাম নাও এখন।
আবার একদিন নীতুর ফোন, -বৌদি ক'দিন থেকে আমার আকাশ-পাতাল জ্বর। কিছুদিন পুতুল আসেনি, এখন আবার আসছে নিয়মিত। আমার দিকে করুণ চোখে তাকিয়ে থাকে, আমাকে মাথায় হাত বুলিয়ে দিতে চায়। কিন্তু কাছে আসতে লজ্জা পায়।
-কি আশ্চর্য, আজ সন্ধ্যায় আমি তোমার কথা ভাবছিলাম। আমার ছোটবেলার বান্ধবী লন্ডনে থাকে, পেশায় সাইকিয়াট্রিস্ট। আগামী মাসে দেশে আসছে দুই মাসের জন্য। সুকান্তর ব্যাপারে ওর সাথে কথা বলবো। ভাবছিলাম, তোমার নাম না বলেই ওকে তোমার ঘটনা বলব।
পুতুলকে যদি আবার দেখো, ইগনোর করবে। যেন পুতুল রোজই আসে, এ আর নতুন কি,
এমন ভাববে। আর ভাববে, পুতুল তোমার মনের গভীরে লুকিয়ে থাকা ছেলেবেলা, অসুখ হলে সবারই ছেলেবেলার কথা মনে পড়ে, তোমারও তাই মনে পড়ছে।
।
-বৌদি, আপনার কথা শুনে খুব কান্না আসছে। এত ভাল কেন আপনি? কই, আমার মা বা আপাদের কেউ তো আমাকে এভাবে বুঝিয়ে বলেনি। এই যে দেখেন, আমার চোখ থেকে টপ টপ করে পানি পড়ছে।
দেখো কান্ডো, ফোনের ওপাশে তোমাকে দেখব কেমন করে? আমি কি পুতুল যে যখন মন চাইবে তোমার কাছে হাজির হবো?
-যাহ! বৌদি, আপনিও আমাকে পুতুল নিয়ে খোঁচা দিচ্ছেন? আপনিই যে বলেন, পুতুল ভূত নয়, আমার বিশ্বাস!
-হ্যাঁ, ঠিকই বলি। পুতুল ভুত নয়, ওটা তোমার হারিয়ে যাওয়া বিশ্বাস। পুতুল ছিল তোমার বাল্যকালের প্রাণের সখী, একেবারে নিঃশ্বাসে বিশ্বাসে জড়িয়ে ছিল। ওর দূর্ভাগ্যজনক মৃত্যুতে তোমার এতটাই কষ্ট হয়েছিল যে তুমি সবার উপর থেকে বিশ্বাস হারিয়ে ফেলেছিলে, কিন্তু মন থেকে পুতুল হারিয়ে যায়নি। এখন হারানো জিনিস মাঝে মাঝে ফিরে পেলে যেমন আনন্দ হয়, পুতুলকে দেখেও তোমার তেমন আনন্দ হয়। আসলে পুতুল আসে কিনা জানিনা তবে এটা বুঝি, তোমার মনের গভীরে থাকা পুতুল নামের বিশ্বাসটা চোখের সামনে এসে হাজির হয়।
-বৌদি, আপনার কথাগুলো বিশ্বাস করতে ইচ্ছে করে, কিন্তু ভয় হয়, আপনার কথাগুলো বিশ্বাস করলে পুতুল মিথ্যে হয়ে যাবে।
-আবারও বলছি, পুতুল কেউ নয়, এ তোমার অপূর্ণ কৈশোর যা তোমার থেকে ছিনিয়ে নেয়া হয়েছিল। তুমি যদি সুস্থ হয়ে উঠতে চাও, তাহলে নিজের মনকে এভাবেই বুঝাতে শুরু করো, দেখবে পুতুল আর আসবে না। সাইকিয়াট্রিস্টরা ভাল বলতে পারবেন এসব বিষয়ে। আমি তো প্রচুর গল্পের বই পড়ি, সে অভিজ্ঞতা থেকেই তোমাকে এই কথাগুলো বলতে পারছি। আসলে পুতুলের জন্য তোমার মনের অনেক গভীরে আক্ষেপ ছিল। মেয়েটা রেপড হওয়ার পর স্বাভাবিক কারণেই তোমার ফ্যামিলি তোমাকে এসব বাজে ঘটনার জের থেকে দূরে সরিয়ে রাখতে চেয়েছিলেন। ওর মৃত্যুর আগে ওকে শেষ দেখা দেখতে পাওনি বলেই তোমার ধারণা হয়েছিল ওর স্বাভাবিক মৃত্যু হয়নি। সমাজে কলংকের ভয়ে হয়তো ওকে ওর মা বাবা দিনরাত বকাবকি করেছে, মারধোর করেছে, ঘরে আটকে রেখেছে, দুঃখে আর অপমানে পুতুল হয়তো আত্মহত্যা করেছে।
-পুতুল আত্মহত্যাই করেছে, ওকে সবাই মিলে মেরে ফেলেছে বৌদি।
-যাহ! তাই কি হয়! আত্মহত্যা ভাবলেও পুতুল আর ফিরবেনা, স্বাভাবিক মৃত্যু ভাবলেও ফিরবেনা। তবে স্বাভাবিক মৃত্যু হয়েছে বিশ্বাস করতে পারলে দেখবে তোমার মনের ভেতর জমে থাকা কষ্টগুলো হালকা হয়ে আসবে। তাছাড়া পুতুলের স্বাভাবিক মৃত্যু হওয়ার অনেক কারণ ছিল। প্রথমত ওরা গরীব ছিল, খাওয়া দাওয়া ভাল জুটতোনা, হয়তো দেহে কোন অসুখ ছিল, হয়তো হার্ট দূর্বল ছিল। এমনিতেই রোগা ভোগা, তার উপর রেপড হয়েছে। বাচ্চা মানুষ, ধর্ষণে দেহে আর মনে অনেক আঘাত লাগে। আমাদের দেশে ধর্ষণের কষ্টের চেয়েও বড় কষ্ট সমাজ। সমাজ ওদের পরিবারকে একঘরে করে দিয়েছে। একঘরে হওয়া যে কী কষ্টের! গরীব বাপ হয়তো কাজে গেলে কাজ পায়নি, মা কারো কাছে কোন সাহায্য পায়নি! সেই কষ্ট পুতুলের দূর্বল হার্ট নিতে পারেনি, তাই হার্ট ফেল করে মারা গেছে।
-বৌদি, আমি খুব কাঁদছি। আমি খুব অসুস্থ বোধ করছি। আমি আজ বুঝতে পারছি, কতটা ভালোবাসতাম পুতুলকে।
-শান্ত হও নীতু। তুমি অসুস্থ হলে তোমার মা বাবা দুশ্চিন্তায় পড়বেন। সবাই অন্যায় করেছে পুতুলের সাথে, কিন্তু তুমি তো অন্যায় করোনি। তুমি ওর জন্য বুক ভর্তি ভালোবাসা জমিয়ে রেখেছো। কজনের ভাগ্যে এটা জোটে বলো! পুতুল অসময়ে পৃথিবী ছেড়ে চলে গেছে, কিন্তু তোমার হৃদয়ের আসনে আজও বসে আছে। স্বর্গ বলে যদি কিছু থেকে থাকে, পুতুল নিশ্চয়ই স্বর্গে আছে। স্বর্গে ও আনন্দে আছে। ওখান থেকে ও নিশ্চয়ই তোমার ভালোবাসা টের পায়। আল্লাহ তোমার পাশে আছেন, আল্লাহর উপিস্থিতি অনুভব করার চেষ্টা করবে।
-তোমার কোন ক্ষতি হবে না, তোমার কাজ তুমি করে যাও ভাল মানুষের পরাজয় নেই।
-পুতুল কে মনে করার আর সময়ই পাইনা। আমি ওকে ভুলে গেছি তাই কি সে আমাকে মনে করে দিতে আসে? গত কাল বিকেলে আমার রুম ঝাড় দিচ্ছিলাম, দেখি জানালার পাশে আমার দিকে মুখ ফিরিয়ে পুতুল দাঁড়িয়ে আছে। আমি দেখেই চোখ বন্ধ করে চিৎকার দিয়েছি। আম্মা বলে কি হইছে? আমি বললাম ভয় পেয়েছি। আম্মা খুব রাগ করলো। বলে দিনদুপুরে ভয় পাও কেন? এটা কেমন কথা? তোমার জন্য বাড়ির বাচ্চারাও ভীতু হবে। খবরদার আর এমন ন্যাকামো করবে না। অসহ্য লাগে, এরপর কোন ছেলে তোমাকে বিয়েও করবে না।
-যে যাই বলুক, তুমি কিচ্ছু ভাববেনা। মনকে বুঝাবে, তুমি কারো ক্ষতি করছো না। পুতুল ভুত নয়, তোমার হারিয়ে যাওয়া ছেলেবেলা। আমি ঢাকা আসবো বান্ধবীর সাথে দেখা করতে। তোমাকে সাথে করে নিয়ে যাব, কেমন? ততদিন একটু নির্ভয়ে থাকো?
-বৌদি, তাই হবে।
চার
ঐ তো ওরা আবার এদিকেই আসছে। নাহ! এ নীতু নয়, পেছন থেকে আর সাইড থেকে দেখতে নীতুর আদল আসে, মুখখানায় নীতুর সাথে কোন মিল নেই। কী আশ্চর্য্য, এত বছর বাদে কেন একটি মেয়েকে পেছন থেকে দেখে নীতুর কথা মনে এলো! নীতু এখন কেমন আছে! ওর ভয়টা কেটেছে? কে জানে! নীতুর সাথে সুমনার যোগাযোগ বন্ধ হয়ে গেছিলো, শেষের দিকে মিতু সুমনাকে এড়িয়ে চলতো। কে জানে, হয়তো ওরা ভেবেছে, সুমনার সাথে নীতুর সম্পর্ক থাকলে ওর জন্য ক্ষতি হবে!
সুমনা বুকটায় একটু চাপ অনুভব করলো, সুকান্তর ভয় আজও কাটেনি। অনেক চিকিৎসা হয়েছে, এখনও ওষুধের উপর আছে। এমনিতে কিছু বুঝা যায় না, তবে সুকান্তকে একা বাড়িতে রেখে ও কোথাও যেতে পারবে না। গতকালও সুকান্ত বলছিল, পাশের রুমে ওর মায়ের কন্ঠ শুনতে পেয়েছে। মা সুকান্তকে ডেকে কিছু বলছেন। অথচ সুমনার শাশুড়ি এখন দেশে নেই, তীর্থ করতে কাশী গেছেন।
আজকাল সুমনার মাঝে মাঝে হতাশ লাগে। ও ভেবেছিল, চিকিৎসায় এই সমস্যা সেরে উঠবে। সুকান্ত নিজেও চেষ্টা করে এই সমস্যা থেকে বেরিয়ে আসতে। কিন্তু বেরোতে পারছে না। ডাক্তাররা অবশ্য বলেন, ঠিক হয়ে যাবে। কিন্তু সুমনা জানে, এ আর ঠিক হবেনা। ওর মনের জোর কমে যাচ্ছে। কাউকেই ও বলতে পারেনা যে আজকাল ওর নিজেরই ভয় ভয় করে।
মনের দিক থেকে সুমনা খুবই শক্ত টাইপের মেয়ে হলেও একজন ভীতু মানুষের সাথে এত বছর থাকতে থাকতে মাঝে মাঝে দূর্বল হয়ে পড়ে। মনের জোর ফিরিয়ে আনতে ও ডাক্তার হকের কথাগুলো মনে মনে আওড়ায়। আজও সুমনা মনকে প্রবোধ দিল, হ্যাঁ, বিজ্ঞানই সত্যি। বিজ্ঞান যা বলে তাই সত্যি। তাহলে নীতুর কি হবে? নীতু কি আজও পুতুলকে দেখে? নীতু তো পুতুলকে চোখের সামনে দেখতে পেতো। নাহ! ওটা ছিল নীতুর বিভ্রম। কিন্তু তারপরও, ভয় তো ভয়ই, বিজ্ঞান যদি সবই ঠিকঠাক বলতে পারে তাহলে আজও কেন সুকান্ত ভয় পায়! সুকান্ত নিজে বিজ্ঞান জেনেও কেন ভয় পায়! কত রহস্য যে লুকিয়ে আছে এই জগৎ সংসারে!