বালিশের পাশে রাখা মোবাইলে ‘মধুর আমার মায়ের হাসি চাঁদের মুখে ঝরে” রিং টোন বেজে উঠতেই আশাবরীর ঘুম ভেঙ্গে গেলো। চোখ খুলে ঘরের মধ্যে আলো আঁধারি দেখে প্রথমটায় বুঝে উঠতে পারলোনা, সময়টা কি ভোর নাকি সন্ধ্যা। ফোনটা নিতে নিতে রিং টোন থেমে গেলো। নিউইয়র্ক থেকে লহরী ফোন করেছিল।
বুকটায় এমন ফাঁকা লাগছে কেন, বাইরে আলো মরে এসেছে। আশাবরী বুঝতে পারলো, সকাল নয় সন্ধ্যা হয়ে এসেছে। দুপুরে আশাবরী কখনও ঘুমায়না, ছোটবেলার অভ্যেস, দুপুরে ঘুমালে বিকেলে যখন ঘুম ভাঙ্গে, আশাবরীর বুক ফাঁকা লাগে, মনে হয় জীবন থেকে অনেকটা সময় নিঃশব্দে চলে গেলো, ও কিছুই জানতে পারলোনা। কেউ কোথাও নেই, নিজেকে একা লাগে। বিছানার পাশে থাকা টেবিল ল্যাম্পএর সুইচ অন করে দিল।
তিন বেডরুমের অ্যাপার্টমেন্টের একটি মাত্র রুম এখন ব্যবহার করা হয়, বাকী রুমগুলো ফাঁকা পড়ে থাকে। অ্যাপার্টমেন্টটা একসময় খুব ছোট মনে হতো, ছেলেমেয়েরা দূরে চলে যাওয়ার পর আজকাল অ্যাপার্টমেন্ট খুব বড় আর ফাঁকা লাগে, স্বামী-স্ত্রীতে আর কতটুকু জায়গা লাগে!
চার ছেলেমেয়ে নিয়ে সংসার ছিল আশাবরীর, আজ চার ছেলেমেয়ের সকলেই বৃত্ত ভেঙ্গে বেরিয়ে গেছে, আরও বিশালত্বের খোঁজে। শূন্য খাঁচা আগলে রাখে আশাবরী আর তার স্বামী অসিতবরণ। পাখী খাঁচা ভেঙ্গে উড়ে যায় ফিরে আসার জন্য নয়, তবুও মা পাখীর মনে ক্ষীণ আশা, বাবা পাখির মনে ক্ষীণ আশা, বাচ্চা পাখিগুলো যদি কখনও নীড়ে ফিরে আসে!
আশাবরীর বুকটা আবার মুচড়ে উঠলো, সুরভীর সাথে একটু আগেই ফোনে কথা হলো, আশাবরীর বড় মেয়ে, বছর তিনেক আগে ডাক্তারী পাশ করেছে, ফ্লোরিডাতে থাকে, রেসিডেন্সি করছে। সুরভীর সাথে কথা বললেই আশাবরীর মন খারাপ হয়, মেয়ের কথায় বুকটায় অভিমান জন্মে। এ বছর রেসিডেন্সি শেষ হয়ে গেলেই সুরভী চাকরির জন্য অ্যাপ্লাই করতে পারবে। আশাবরীর খুব ইচ্ছে, সুরভী লুইজিয়ানাতে চলে আসুক, বাবা-মায়ের কাছাকাছি থাকুক। সংসারে ডাক্তার সন্তান থাকলে বাবা-মায়ের বুকে বল থাকে। সুরভী আসতে চায়না লুইজিয়ানাতে, এই মেয়েটা ছোটবেলা থেকেই অন্যরকম। সংসার, আত্মীয়-স্বজনের সাথে সম্পর্কের বন্ধন আলগা, যে কোন সময় বন্ধন খুলে গেলেও সুরভী টের পাবেনা। সুরভী খুব উচ্চাকাঙ্ক্ষী, ও ফ্লোরিডাতেই থাকবে নাহয় আরও কোন বড় স্টেটে যাবে। লুইজিয়ানা নাকি তেমন হাই প্রোফাইলদের জন্য নয়।
তবুও আশাবরী আজ সুরভীকে বলেছিল, “ মা রে, ডাক্তারি তো ডাক্তারি, রুগী সব দেশেই রুগী, তোর কাজ রুগীকে সেবাদান, তুই আমাদের এখানে চলে আয়। আমরা এখন একেবারে একা হয়ে গেছি।
-কেন, একা হবে কেন? ড্যাডি আছেনা?
- তোর বাবার সাথে আমার এখন সারাদিনে দুইটা কথাও হয়না। তুই তো জানিস তোর বাবা চিরকাল চুপচাপ, এখন একেবারেই চুপ করে থাকে। বাঁশরি ছিল তাই আমার সময় কেটে যেত, বাঁশরিও চলে গেলো ডর্মে, এখানে কোন বাঙ্গালীও নেই, আমি কী নিয়ে বাঁচি বল।
-মা, ড্যাডির সাথে তোমার মানসিক দূরত্ব তৈরী হয়ে গেছে অনেক আগেই, তখন আমরা কাছে ছিলাম তাই তোমরা নিজেদের সময় দাওনি। এখন তোমরা নিজেদের সময় দাও, আবার কাছাকাছি আসো। নিজেদের সম্পর্ক ঠিক করে নাও।
-সুরভী, আমাদের সম্পর্ক নিয়ে তোকে মাথা না ঘামালেও চলবে, আমাদের সম্পর্ক বত্রিশ বছরের, বাকী যে ক’বছর বাঁচবো সম্পর্ক মজবুত থাকবে। বাবা-মায়ের সাথে তোর সম্পর্ক কেমন, সেটা নিয়ে মাথা ঘামা। খুব লায়েক হয়ে গেছিস তাইনা? আমাদের মত স্বামী-স্ত্রী হতে তোদের সাত বার জন্ম নিতে হবে।
-মা, তুমি রেগে যাচ্ছো, এখন ফোন রেখে দেই। তোমার শরীর ভাল না, রাগারাগি তোমার জন্য খারাপ।
আজ শুক্রবার, বাঁশরি আসবে হোস্টেল থেকে। মেয়েটা কত তাড়াতাড়ি কোল ছেড়ে চলে গেলো। আর ফিরবেনা এই ঘরে। সম্রাট, সুরভী, লহরী ঠিক এমন করেই ঘর ছেড়েছিল, আর ঘরে ফিরেনি। বাঁশরি ইলেভেন্থ গ্রেডে পড়ে, বাড়ির কাছেই ওর হোস্টেল, হলে হবে কি, শুক্রবার বিকেল ছাড়া বাড়ি আসার নিয়ম নেই। শুক্রবার বিকেলে আসে, রবিবার দুপুরে ফিরে যায়। এরপর আশাবরী একা হয়ে যায়, ওর স্বামী অসিতবরণ এমনিতেই শান্ত, এখন থাকে নীরব।
একাকীত্বে আশাবরীর ভীষণ ভয়, ছোটবেলায় ভুতে খুব ভয় ছিল, কখনও একা থাকতে চাইতোনা। সন্ধ্যে হতে না হতেই আশাবরী দৌড়ে গিয়ে প্রতি ঘরে লাইট জ্বালিয়ে দিত। আশাবরীদের ছিল হিসেবের সংসার, বাবা স্কুলের শিক্ষক ছিলেন, সাথে কয়েকটা টিউশনি করতেন, মাপা পয়সায় সংসার চালাতে মা’কে হিমশিম খেতে হতো। ইলেকট্রিসিটি বিল অনেক বেশী উঠবে বলে মা হয়তো বকা দিত, কিন্তু আশাবরী লাইট নেভাতো না। বলতো, “ মা, অন্ধকারে ভুত আসে, আমার ডর করে”।
আশাবরীর মা বলতেন, “গরীবের মাইয়ার মনে এত ডর থাকলে চলেনা, গরীবের সাহসই সম্বল। কারেন্টের বিল বেশী আসবো, আমি কই থিকা বাড়তি টাকা জোগামু? ভুত বইলা কিছু নাই, মনে মনে ‘রাম রাম’ জপ করবি, ভুত আইতোনা”।
আশাবরী মনে মনে ‘রাম রাম’ জপ করতো, ভুতের ভয় একটু কমে আসতো। কিন্তু রাম নামে ভুতের ভয় কমলেই কি, একাকীত্বের ভয় কমতোনা। বিকেলে ঘুম থেকে উঠলেই কান্না পেতো, মনে হতো, “আমি যতক্ষণ ঘুমায়ে ছিলাম, এই সময়টা আর ফিরে আসবেনা, আমি চলে যাওয়া সময়টা দেখতেই পেলামনা”।
আশাবরীর কথা শুনে ওর মা বলতো, “ তোর মাথায় কি পোকা আছে? নাকি সত্যই তোরে ভুতে ধরছে? দুপুরবেলায় সব বাড়িতেই পোলা মাইয়া লইয়া মায়েরা ঘুমায়, শরীরের বিশ্রাম হয় তাতে। ঘুম ভাইঙ্গা কেউ ত কয়না, সময় গেলো গিয়া, আমি দেখতে পারলামনা। পোলারা দুপুরে না ঘুমাইলেও চলে, মাইয়াগো ঘুমের দরকার। ঘুমাইলে মাইয়াগো চেহারায় সুশ্রী ধরা থাকে। সুখী মনে হয় দেখতে।
আশাবরীর মা, বাবা কেউ বেঁচে নেই। আশাবরীকে আদর করার কেউ নেই, মা বলতো, যতটুকু সুখ বাবা-মায়ের ঘরেই করতে। বাবা-মায়ের ঘরে আশাবরী অনেক সুখ করেছে। চার ছেলে এক মেয়ের টানাটানির সংসারে বাবা-মা মেয়েকে কষ্ট পেতে দিতেননা। মেয়েদের কপাল পাতা দিয়ে ঢাকা থাকে, মা জানতেননা তার মেয়ের কপালে কি আছে। তাই মেয়েকে আদর ভালোবাসা একটু বেশী দিতেন। ইলেকট্রিসিটি বিল বেশী দিলেও মা আশাবরীকে অন্ধকারে রাখেননি। টাকায় কুলোতোনা, তবুও বাবা আশাবরীর জন্য বাজার থেকে পটল কিনতো, নারকেল কিনতো, চিংড়ি মাছ কিনতো।
মা’কে বলত, “ আশা পটলের ভিতরে নাইরকোল, চিংড়ির পুর খাইতে ভালোবাসে, সস্তায় পাইলাম পটল, তাই কিনা আনলাম। ঘি গরম মশলা দিয়া রান্দো, কাঁচামরিচ দিতে ভুইল্লা যাইওনা। ঝাল নাহইলে ত আশার মন ভরে না, আশা এত ঝাল খায় ক্যামনে?”
ইদানিং কেবলই মনের গভীরে ঘুমিয়ে থাকা ব্যথাগুলো দীর্ঘ নিঃশ্বাস হয়ে বেরিয়ে আসে। সবই ব্যথা নয়, আনন্দময় নিঃশ্বাসও বের হয়, আর আনন্দময় দিন ফিরে আসবেনা ভেবে আনন্দময় নিঃশ্বাসটাও বিষাদময় হয়ে যায়।
দুই
বাঁশরী বোর্ডিং স্কুলে চলে যাওয়ার পর থেকেই আশাবরী ভীষণভাবে একা হয়ে পড়েছে। ঘরে অসিতবরণ ছাড়া আর কেউ নেই, আশে পাশে একঘর বাঙ্গালীও নেই যাদের সাথে একটু আধটু আড্ডা দেয়া যায়। ওদের ছোট শহর থেকে প্রায় পঞ্চাশ মাইল দূরের শহর বেটন রুজে আছে প্রায় তের চৌদ্দটি বাঙ্গালী পরিবার, তাদের সাথেও আশাবরীদের দেখা সাক্ষাৎ হয় বছরে দুই তিনবার, ঈদ বা পূজোর অনুষ্ঠানে। এই ধরণের দেখা সাক্ষাতে সাধারণতঃ ‘হাই, হেলো’ জাতীয় কথা চলে, আর চলে নতুন শাড়ি-গয়না দেখানোর উৎসাহ। আশাবরীর স্টকে নতুন শাড়ি নেই, গয়না থাকার প্রশ্নই আসেনা। আশাবরীরা আমেরিকায় অনেক বছর কাটানোর পরেও ব্যাংকে তেমন কিছু জমা হয়নি, সন্তান মানুষ করা ছাড়াও ওদের উপর অনেক দায়িত্ব, দেশে নিয়মিত টাকা পাঠাতে হয়। তাই আশাবরী বাঙ্গালী আসরে তেমনভাবে জমাতে পারেনা, অন্যেরাও আশাবরীকে ‘হাই হেলো’র বাইরে বলার মত আর কোন কথা খুঁজে পায়না। আশাবরীর খারাপ লাগে, সবই বুঝে, কিন্তু কাউকে বুঝতে দেয়না।
আশাবরী- অসিতবরণের চার ছেলেমেয়ে, সকলের বড় ছেলে সম্রাট, এরপর তিনটি মেয়ে সুরভী, লহরী, বাঁশরী। ওরা আমেরিকা এসেছে সতেরো বছর আগে, তখনও বাঁশরীর জন্ম হয়নি। বাঁশরীর জন্ম ওদের আমেরিকা আসার দুই বছর পরে, বাঁশরীর বয়স এখন পনেরো।
আমেরিকা আসার আগে ওরা দুজনেই কলেজে অধ্যাপনা করতো। অসিতবরণ গণিতের অধ্যাপক ছিলেন, আশাবরী পড়াতো বাংলা। দুজনের আয়ে সংসার মোটামুটি ভালো চলতো। সংসার জীবনের প্রথম দিকটা খুব কষ্টে কেটেছে ওদের, অসিতবরণ বাড়ির বড় ছেলে, বাড়িতে এত্ত ঝামেলা, সবার টাকা দরকার, টাকা দেয়ার মানুষ বলতে তখন অসিতবরণ। কি যে কঠিন দিন পার করেছে আশাবরী, তবুও মুখ কালো করেনি, স্বামীর সাথে রাগ করেনি।
যে কলেজে অসিতবরণ অধ্যাপনা করতো, একই কলেজে আশাবরী মানবিক বিভাগের ছাত্রী ছিল, কী করে যেন দুজন অসম বয়সী নর-নারীর নিজেদের মধ্যে মন বিনিময় হয়ে যায়। দু বছরের মধ্যে বিয়ে, বিয়ের পর আশাবরী অনার্স, মাস্টার্স শেষ করে, বি সি এস পরীক্ষা দেয়, কলেজে অধ্যাপনা করার চাকরি পেয়ে যায়। ততদিনে কোল জুড়ে চলে আসে সম্রাট, এরপর একে একে সুরভী, লহরী। এর মধ্যেও অসিতবরণ ছোট দু বোনকে বিয়ে দেয়, এক ভাইকে সুইডেন পাঠিয়ে দেয় লেখাপড়ার জন্য। এরপর আশাবরীকে না জানিয়ে ডিবি লটারির জন্য অ্যাপ্লাই করেছিল, কপালে লেগে গেছে। আর কোনদিকে না তাকিয়ে স্ত্রী, তিন বাচ্চা নিয়ে আমেরিকা পাড়ি জমায়, আসার আগে টাকাপয়সা কিছু বাবার নামে ফিক্সড করে দিয়ে আসে।
আমেরিকা আসার পর ওরা প্রথমেই লুইজিয়ানাতে চলে আসে, এখানে অসিতবরণের স্কুল জীবনের বন্ধু ডঃ কামাল ছিলেন। কামাল সাহেবই কিছু একটা উপায়ে অসিতবরণকে ্কমিউনিটি কলেজে অ্যাসিসট্যান্ট প্রফেসর হিসেবে চাকরির ব্যবস্থা করে দেয়। আশাবরীও একটি এলিমেন্টারি স্কুলে কাজ করেছে, সিয়ার্সে কাজ করেছে, এখনও কাজ করছে। স্বামী স্ত্রি মিলে প্রচন্ড পরিশ্রম করেছে, আমেরিকা আসার পর আশাবরী যে কাজটি গুরুত্বের সাথে করেছে তা হলো, ছেলেমেয়েগুলোকে খুব যত্ন করে পড়িয়েছে। প্রথম তিন সন্তানই দারুণ রেজাল্ট করেছে, আজ ওদের তিনজনই আশাবরী থেকে দূরের স্টেটে চলে গেছে। তিনজনের মধ্যে লহরী খুব বুদ্ধিমতি মেয়ে, বাপ-মায়ের খোঁজ নেয়, ছোটবোন বাঁশরির খোঁজ নেয়। আজও একটু আগে আশাবরীর ঘুম ভাঙ্গলো লহরীর ফোনের রিং শুনে। সম্রাট একটু আলাভোলা ধরণের, সাতেও থাকেনা পাঁচেওনা। এম বি এ শেষ করে সিটি ব্যাংকে চাকরি পেয়ে নর্থ ক্যারোলাইনাতে চলে গেছে। কী খায়, কীভাবে চলে কে জানে!
তিন
আজ রবিবার, বিকেলেই বাঁশরী ডর্মে ফিরে যাবে। আশাবরীর আজ কিছু রান্না করতে ইচ্ছে করছেনা। ওদের বাসা থেকে পাঁচ মাইল দূরে একটা চায়নীজ রেস্টুরেন্ট আছে, ছেলেমেয়েরা যখন ছোট ছিল, ওখানে অনেকবার গিয়েছে। আমেরিকায় চায়নীজ রেস্টুরেন্টগুলোতে বাফে সিস্টেম চালু আছে, প্রচুর খাবার থাকে, মোটামুটি সস্তা দামেই যার যত খুশী খাও। স্বল্প আয়ের মানুষদের কাছে খুব প্রিয় চাইনীজ রেস্টুরেন্টগুলো।
অনেকদিন ওরা রেস্টুরেন্টে খায়নি, আজ খুব সুন্দর পরিপাটি করে সাজলো আশাবরী, অসিতবরণ অবশ্য গায়ের শার্ট না বদলিয়েই বের হলো। অসিতবরণকে ইদানিং খুব বুড়ো দেখায়, আশাবরীকে আগে ঝলমলে সুন্দর লাগতো, এখন চেহারায় ম্যাড়ম্যাড়ে ছাপ পড়ে যাচ্ছে। আজকেও বাইরে থেকে পরিপাটি দেখালেও মনের ভেতরটা একেবারেই নিস্তেজ হয়ে আছে। আশাবরীর ইচ্ছে করেনা তিন ছেলেমেয়েকে বাদ দিয়ে বাইরে কোথাও খেতে, কিন্তু বাঁশরিটা ঠকে যাচ্ছে, এই দিনগুলো, এই বয়সটা আর ফিরে আসবেনা ওর জীবনে। আশাবরী বেঁচে থাকবেনা, কিন্তু বাঁশরি একা নিরলে বসে আজকের দিনগুলোর কথা ভাববে, মন খারাপ করবে। আশাবরীর এই কন্যাটি খুব ধীর স্থির, স্বল্পভাষী, খুব গভীর চিন্তায় মগ্ন থাকে। বাঁশরির সাথে কথা বললে ও এমন সব দামী কথা বলে, অনেক কিছু শেখা যায়।
বোর্ডিং স্কুলে ওর মৌখিক ইন্টারভিউর সময় দুই বুড়ি টিচার নাকি ওর কথাবার্তা শুনে বলেছিল, “ বানশরি, তুমি এত ছোট বয়সেই এমন গভীর চিন্তা করো কী করে? পরিবারে আর কে তোমার মত কোন একটি বিষয় নিয়ে এমন গভীরভাবে ভাবে?”
বাঁশরী নাকি বলেছিল,” আমি নিজে বুঝতে পারিনা আমি কিভাবে ভাবি, তবে আরও অনেকেই বলেছে, আমি নাকি অনেক ভেবে চিনতে কথা বলি। আমি জানি, আমার মা এমনিতে খুব হাসিখুশী হই চই করলেও কথা বলে অনেক গভীর থেকে। হয়তো আমি মায়ের চরিত্রের এই দিক পেয়েছি”।
বাঁশরীর মুখে নিজ সম্পর্কে এমন মূল্যায়ণ শুনে আশাবরী মনে মনে খুব খুশী হয়েছিল। প্রথম তিন সন্তানের একজনও তাদের মা’কে বুঝে উঠতে না পারলেও সবশেষ সন্তানটি মা’কে ঠিক বুঝতে পেরেছে। বাঁশরির জন্য বুকটা ফাঁকা লাগে আজকাল, বাঁশরী যতখানি মেয়ে, তার চেয়েও অনেক বেশী ‘মা’। আশাবরীর মা মারা গেছেন বেশ কয়েক বছর আগে, তখন বাঁশরী ছিল ছোট। মায়ের মৃত্যুর পর সেই আট বছরের বাঁশরীই ধীরে ধীরে আশাবরীর অন্তরের কাছাকাছি চলে আসতে শুরু করলো। সেই ছোট থেকেই ও মায়ের সুখ দুঃখগুলো বুঝবার চেষ্টা করতো। আর আজকাল বাঁশরি মায়ের স্বাস্থ্য নিয়ে ভাবে, খাওয়া নিয়ে ভাবে, অসুখ নিয়ে ভাবে!
রেস্টুরেন্টে ওরা তিনজনে প্রবেশ করলো, ভেতরে প্রচুর কাস্টমার, রবিবারের দুপুরে চায়নীজ রেস্টুরেন্টে ভীড় বেশ ভালোই হয়। আশেপাশে আফ্রিকান আমেরিকানদের বসতি, এত অল্প খরচে চায়নিজ রেস্টুরেন্টে ‘বাফে’তে এলাহী আয়োজন, কত রকমের ভাজাভুজি, ডিপ ফ্রাই, কত রকমের মাংস, আয়োজনের শেষ নেই। আশাবরী খুব গভীরভাবে লক্ষ্য করেছে, বাংলাদেশের মানুষের সাথে আফ্রিকান আমেরিকানদের স্বভাবে বেশ কিছু ক্ষেত্রে মিল আছে। বাঙ্গালীদের মত কালো্রাও ভীষণ পরিবারমুখী হয়। বাবা-মা, ভাই, বোন মিলে মিশে থাকার ঘটনা চোখের সামনেই দেখতে পায় আশাবরী, আবার খারাপ দিকেও মিল আছে যেমন উঁচু গলায় কথা বলা, ঝগড়া করা, কখনও চুলোচুলি করা, বাচ্চাদের দড়াম দড়াম করে পিটানি দেয়া, পাবলিক টয়লেটগুলো নোংরা করা, বাচ্চাগুলোর ট্যাঁ ট্যাঁ করা, বান্দরামি করা, বাচ্চাদের বান্দরামিতে মায়েদের প্রশ্রয় দেয়া।
ভেতরে ঢুকে অসিতবরণ বলল, “ চলো, আমরা ব্যালকনিতে গিয়ে বসি, ঘরের ভেতর ভীষণ সাফোকেটিং লাগে”।
ওরা তিনজনে ব্যালকনিতে চলে এলো, প্রথম টেবিলে বসতে যেতেই বাঁশরী বলল, “ মা, এখানে বসোনা, দেখো চেয়ারের পাশটায় নোংরা জমে আছে”।
আশাবরী দেখলো, সত্যিই চেয়ারের কোণে নোংরা জমে আছে। বাঁশরী খুব চুপচাপ হলে কী হয়, নজর খুব তীক্ষ্ম। বাঁশরিই একটি পরিচ্ছন্ন টেবিল পছন্দ করলো, তিনজনে আসন গ্রহণ করলো। ওয়েট্রেস এসে পানীয়ের অর্ডার নিয়ে গেলো, এরপর ওরা তিনজনেই চলে গেলো খাবার আনতে।
তিনজনেই খাচ্ছে, খেতে খেতেই আশাবরী বলল,
-বাঁশরি, একটা কথা বলি শোন, তুমি নিশ্চয়ই অনেক নামী দামী ইউনিভার্সিটিতে ভর্তি হওয়ার জন্য প্রিপারেশান নিচ্ছো। অবশ্যই তা করবে, এবং নামী ইউনিভার্সিটির পাশাপাশি নিজেদের স্টেট ইউনিভার্সিটিতেও এপ্লাই করবে।
-তুমি কি চাও আমি এখানেই পড়ি?
-আমি কি চাই তা দিয়ে তোমাদের জীবন চলার পথ আটকানোর অধিকার আমার নাই। তোমার দাদা, দিদিদের বেলায় চেয়েছিলাম ওরা অনেক বড় ইউনিভার্সিটিতে পড়ুক, জীবনে প্রতিষ্ঠিত হোক, আমি খুব প্রাউড ফিল করব। আমার অনেক বড় হওয়ার কথা ছিল, পরিবেশ এবং সুযোগ পাইনি বলে আটকে গেছি শুরুতেই। আমার বাচ্চাদের জীবনে সুযোগ তৈরী করে দিয়েছি, ওরা সে সুযোগের সদ্ব্যবহার করেছে। কিন্তু আজকাল মনে হয়, বিশাল বড় হতে গিয়ে ওরা আমাকে একা করে দিয়ে গেছে।
-তাহলে আমি কি করবো?
-হা হা হা হা! তুমিও তোমার মেধাকে কাজে লাগাবে, আমার জন্য ভাববেনা। আসলে কি জানো, যখন তোমার দাদা, দিদিরা একজন একজন করে আমাদের ছেড়ে যাচ্ছিলো, কেউ মন খারাপ করিনি, তখন ভাবতাম, একজন যাচ্ছে অন্যরাতো আছে। প্রথম সম্রাট গেলো, ভাবলাম সুরভী-লহরী-বাঁশরী আছে, যখন সুরভী যাবে থাকবে লহরী-বাঁশরী। যখন লহরী যাবে সম্রাট ততদিনে পাশ করে ভাল চাকরি নিয়ে আমাদের কাছাকাছি চলে আসবে। এভাবেই একজন একজন করে যাবে আবার অন্যজন আমাদের কাছে ফিরে আসবে।
-কিন্তু দাদা ত চলে গেছে নর্থ ক্যারোলাইনাতে, এলো না তো।
-কেউ আসবেনা মা, যে পাখী হারায় নীড় সুদূর আকাশে , সে কি আসে কভু ফিরে! ভাল স্কুলে পড়তে পাঠিয়েছি, ভালোর স্বাদ কেউ পেলে সে পরে আরও বেশী ভাল চায়। পোলাও কোর্মা খাওয়ার পর কেউ কি পোড়া রুটি খেতে চাইবে?
-মা, তুমি এমন সব কথা বলো।
-বাঁশরী, ওরা কেউ ফিরে আসবেনা। ওদের কাউকে কোনদিন বলিনি, আজ তোকে বলি, জীবন একটা, যার যার জীবন তার তার ঠিকই, তারপরেও আমরা কেউ নিজের চেষ্টায় হেঁটে হেঁটে পৃথিবীতে আসিনি। দু’জন মানুষ মিলে মিশে নতুন একজন মানুষকে তৈরী করে, পৃথিবীর আলোতে নিয়ে আসে। সেই দুজন মানুষকে বলা হয়, বাবা-মা। বাবা-মা অনেক শখ, আদর, ভালোবাসা, মমতা দিয়ে নতুন মানুষটিকে বড় করে, হাঁটতে চলতে শেখায়, ইনডিপেন্ডেন্ট বানিয়ে দেয়। ইন্ডিপেন্ডেন্ট হওয়ার পর, হাঁটতে চলতে শেখার পর যে মানুষ তার বাবা-মাকে ভুলে যায়, নিজের জীবনে বাবা মায়ের অবদান ভুলে যায়, তারা কোন অন্যায় করেনা কিন্তু বিরাট ভুল করে।
-অন্যায় নয় কেন?
-অন্যায় নয় কারণ তারা বাবা-মাকে বলেনি পৃথিবীতে নিয়ে আসতে, তারা বাবা-মাকে স্বপ্ন দেখায়নি, তাদের বড় করেছে বাবা-মা নিজের স্বপ্ন বাস্তবায়ন করতে। তাই বাচ্চারা বাবা-মাকে ভুলে গেলে অন্যায় করার চেয়েও যেটি বেশী করে, তা হচ্ছে ভুল করে। অন্যায় করলে অন্যায়ের প্রতিকার করা যায়, ভুল করলে প্রতিকার করা যায়না, ভুলের মাশুল গুনতে হয়।
বাঁশরি বলল, মা আগে ভাবতাম প্রিন্সটন ইউনিভারসিটি, কলম্বিয়াতে পড়তে যাব, এখন আর আগের মত ভাবিনা। এখন মনে হয় এল ইউ (লুজিয়ানা স্টেট ইউনিভারসিটি)তে পড়লেও সমস্যা নেই। তোমাদের কাছাকাছি যতদিন থাকা যায় ততই ভাল। তোমাদের বয়স হয়ে যাচ্ছে, তোমাদের সাথে কাউকে না কাউকে থাকতে হবে। তুমি ঠিক বলেছো, মন দিয়ে লেখাপড়া করলে যে কোন স্কুল থেকেই ভাল রেজাল্ট করা যায়।
-কিন্তু তোর অনেক শখ ছিল কলাম্বিয়াতে পড়ার, ইলেভেনথ, টুয়েলভথ গ্রেডে ভাল রেজাল্ট করলে, আর এসিটি/স্যাট স্কোর খুব ভাল পেলে কলম্বিয়াতে চান্স পাবি। তুই সেটি পারবি তা খুব ভাল জানি, আমাদের জন্য ভাবিসনা।
-মা আমার বন্ধু ক্রিসের বড় ভাই এল ইউ থেকে গ্র্যাজুয়েশান করেছে, এখন নাসাতে খুব ভাল পজিশনে আছে।
-তুইও নাসাতে ভাল পজিশনেই কাজ করবি। এক কাজ করিস, তোর পছন্দের ইউনিভারসিটিতেও অ্যাপ্লাই করিস, আমাদের স্টেটের ইউনিভারসিটিতেও অ্যাপ্লাই করিস। মনে কর, কলম্বিয়াতে চান্স পেলি, এল ইউ তেও চান্স পেলি, তখন কলম্বিয়া রেখে এল ইউতে পড়তে গেলে মনে কোন কষ্ট লাগবেনা। কারণ তুই কলম্বিয়াতে পড়ার যোগ্য তা প্রমাণ করতে পেরেছিস।
-মা, এত কিছু ভেবোনা।
-বাঁশরী, তুই আমাদের জন্য খুব ভাবিস, তাইনা?
-ভাববোনা কেন?
-কই, সুরভী, সম্রাট, লহরী তো ভাবেনা আমাদের কথা।
-মা, দাদা, সুরভী দিদি, লোরী দি সবাই ভাবে তোমাদের কথা। কিন্তু সবার ভাবনাতো একরকম হয়না। ওরা ঠিকই ভাবে ওদের মত করে। যদি তোমাদের কথা না ভাবতো তাহলে ওরা কি এত ভাল রেজাল্ট করতো? তোমরাই চেয়েছো, স্পেশ্যালি তুমি চেয়েছো, আমরা সবাই যেন দারুণ রেজাল্ট করি, তোমার কথা তো দাদা, সুরভী দিদি, লোরী দি শুনেছে, সবাই দারুণ রেজাল্ট করেছে, এখন আমিও শুনছি, তাহলে আমাদের দোষ কোথায়?
-আচ্ছা, তুইই বল, সুরভী কি পারেনা লুইজিয়ানাতে চলে আসতে? এখানে বুঝি হসপিটাল নেই? এখানে এসে ডাক্তারী করলে আমরা একসাথে থাকতে পারতাম। আর সম্রাটের কথা কি বলবো, এখানে সিটি ব্যাংকে চাকরি পেয়েও বড় সিটিতে থাকবে বলে চলে গেলো নর্থ ক্যারোলাইনাতে।
-মা, আচ্ছা তোমার কথা মত আমরা নাহয় আবার একসাথে থাকলাম, কিন্তু আমরা সবাই যার যার কাজে ব্যস্ত থাকবো, এক দুই ঘন্টার জন্য আড্ডাও দিতে পারবোনা, তখন আবার তুমিই বলবে, কাছে এসেই কি লাভ হলো যদি গল্প গুজব না করতে পারি।
-বেশী কথা বলিসনা, তবুওতো চোখের দেখা দেখবো।
-উলটো দিকেও ভেবে দেখো, দাদা আছে নর্থ ক্যারোলাইনাতে, সুরভী দিদি ফ্লোরিডাতে, লোরী দি চলে গেছে নিউইয়র্কে, আমাদের বেড়ানোর কতগুলো জায়গা হলো। তুমি বেড়াতে ভালোবাসো, বাপি গাড়ি চালায়না বলে কোথাও যাওয়া হয়না। এখন ওরা তিনজনেই বড়লোক হয়ে যাচ্ছে, প্রতি বছর একবার করে আমাদের জন্য প্লেনের টিকেট পাঠাবে। আমরা প্লেনে চড়ে সারা আমেরিকা ঘুরে বেড়াবো। মা, যখন আমরা গরীব ছিলাম তখন সবাই ছোট এক জায়গায় ক্রাউডেড ছিলাম, এখন আমরা একটু একটু করে বড়লোক হবো, অনেক বড় বড় জায়গায় থাকবো, অনেক ডলার রোজগার করবো, বাংলাদেশে তুমি গরীব মানুষকে হেল্প করতে পারবে, এটা কি ভালোনা?
-কী জানি, এভাবে তো ভাবিনি।
-মা, কালকে থেকে তোমার মন খারাপ। এখানে তোমাদের রিলেটিভ কেউ থাকেনা, তোমাদের বাঙ্গালী বন্ধু নেই, আমরা চার ভাইবোনই তোমাদের আপন মানুষ। তুমি তো্মার ছেলেমেয়ের সাথে মন খারাপ করলে তুমিও কষ্ট পাবে, আমরাও কষ্ট পাব। তার চেয়ে আসো, আমরা মিলে মিশে থাকি। কারো সাথে রাগ করোনা।
পাঁচ
রেস্টুরেন্ট থেকে বেরিয়ে ওরা আর কোথাও গেলোনা। আট বছর আগেও ছবিটা ছিল অন্যরকম। তখন আশাবরীর তিন বেডরুমের অ্যাপার্টমেন্টে ছয়জন মানুষ ছিল, চারদিকে ছেলেমেয়ের কলকলানি, ভাই বোনের খুনসুটি ঝগড়া, বালিশ নিয়ে টানাটানি, কম্বল নিয়ে কাড়াকাড়ি, আশাবরীর ধমক---আহা, তখন সংসারে মাপা পয়সা, মাপা পয়সা দিয়েই ওরা সুখের সংসার গড়েছিল। মাসে একবার ওরা আসতো এই রেস্টুরেন্টে, পাঁচ ডলারে যত খুশী খাও, সম্রাট খেতো দুই তিন প্লেট। খাওয়া শেষে দেয়া হতো ফরচুন টেলার কুপন, সকলে অধীর আগ্রহে অপেক্ষা করতো কার কুপনে কী লেখা আছে তা পড়ার জন্য।
কুপনে কারো ভাগ্যে হয়তো লেখা আছে, “ তুমি খুব তাড়াতাড়ি শুভ সংবাদ শুনবে”, একবার আশাবরীর কুপনে লেখা ছিল, “ বসন্ত তোমার দ্বারে”। এই নিয়ে সম্রাট আর লহরী কি হাসাহাসি।
বাবাকে বলেছে, “ বাবা, সাবধান হয়ে যাও, তুমি আরেকটু সাজু করে থাকো, নাহলে মা কিন্তু অন্য কারো সাথে প্রেম করতে শুরু করবে”।
অসিতবরণ মুখ মুচকে হাসতো। রেস্টুরেন্ট থেকে বেরিয়ে ওরা সরাসরি বাসায় ফিরতোনা, চলে যেত একটু দূরের একটি রিসর্টে। সেখানে একটি ড্যাম আছে, এত সুন্দর সেই রিসর্টটি। ছয়জনে বেশ অনেকক্ষণ রিসর্টের ফাঁকা জায়গায় দাঁড়িয়ে চারদিকের শোভা দেখতো, ভাইবোনগুলো কত স্বপ্নের কথা বলতো। ওখানে একটা দামী রেস্টুরেন্ট আছে, জলের উপর রেস্টুরেন্ট, সুরভী বলেছিল, বড় হয়ে ভালো চাকরি যখন করবে তখন বাবা-মাকে নিয়ে দামী দামী রেস্টুরেন্টে খেতে যাবে।
লহরী গাল ফুলিয়েছিল, “ আমাদের খাওয়াবেনা?”
সুরভী বলেছিল, “ কষ্ট করে আমি বড় হবো, তোমাকে খাওয়াবো কেন? তুমিও বড় হও, কে না করেছে?
আশাবরীর ভালো লাগেনি সুরভীর কথা, মেয়েকে বলেছিল, “ বিদেশ বিভুঁইয়ে তোদের আপনার জন আর কেউ নেই। ভাই বোনে যদি সম্পর্ক এমন ‘যার যার তার তার’ হয়, আমাদের মৃত্যুর পর তো তোদের নিজেদের মধ্যে সম্পর্কই থাকবেনা।“
লহরী বলেছিল, “ আমি যখন চাকরি করবো তখন তোমাদের সবাইকে নিয়ে রেস্টুরেন্টে খাব, আমি অত হিংসা করবোনা।“
সম্রাট কিছুই বলতোনা, হয়তো তখন থেকেই মনে মনে দূরে চলে যাওয়ার জন্য মন তৈরী করছিলো।
এসব হাসি খুনসুটি শেষে ওরা ফিরে আসতো ডোনাট ফ্যাক্টরিতে, বাঁশরী ছিল ডোনাটের পাগল, চকোলেট গ্লেজড ডোনাট। কারো পেটেই ক্ষিদে থাকতোনা তবুও প্রত্যেকের জন্য একটি করে ডোনাট কেনা হতো, সাথে ফ্রেঞ্চ ভ্যানিলা কফি। কী যে আনন্দময় দিন কেটেছে।
আজ অনেকদিন পর গাড়িতে উঠে আশাবরী বলল, “ চলো, আজ আমরা ট্যানামেরি রিসর্টে যাই, অনেক বছর পার হয়ে গেছে ওখানে যাইনি।“
অন্যসময় অসিতবরণ আপত্তি করতো, আজও আপত্তি করবে ধরে নিয়েছিল আশাবরী, কিন্তু অসিতবরণ গাড়ি রিসর্টের পথেই ঘুরালো। রবিবারের দুপুর হলেও চারদিকে গাড়ি ছুটছে। কিছুদূর যেতেই গাড়ি গিয়ে পড়লো নিরিবিলি রাস্তায়। চারদিকে সবুজের সমারোহ, গতরাতে ঝুম বৃষ্টি হয়েছে, গাছের পাতাগুলো একেবারে ধুয়ে মুছে পরিষ্কার। গাছ গাছালির ফাঁকে ফাঁকে দেখা যায় ছোট ছোট জলাশয়, আরেকটু এগোলেই দেখা যাবে মিসিসিপি নদী। পথের দৃশ্য দেখে আশাবরীর বুকটা মুচড়ে উঠলো, আপনমনে গেয়ে উঠলো,
“সেই শান্ত ছায়ায় ঘেরা, কৃষ্ণকলির দিনগুলি যদি থাকতো
এই অলস বেলায় যদি একটি ডাহুক, আনমনে আজও ডাকতো”।
অসিতবরণ গাড়ি চালাতে চালাতেই একটু চমকে উঠলো, যৌবনে আশাবরী খুব ভালো গাইতো। অনেককাল আর গান করে না, তবুও কন্ঠ একটুও বদলায়নি। পাঁচ লাইন গেয়েই আশাবরী থেমে গেছে , অসিতবরণ বলল, “ গানটা শেষ করো”।
গাড়ি ড্যামে পৌঁছে গেছে, আশাবরী গাড়ি থেকে নামতে চাইলোনা। বাঁশরীকে বলল, “ বাবুয়া, ওই যে দ্যাখ ব্রীজের গায়ে লেখা 800 FEET, আমি যেন এটাকে কী বলেছিলাম?
আশাবরীকে অবাক করে দিয়ে বাঁশরী বলল, “ তুমি 800 FEET কে পড়েছিলে BOO FEET”।
-তোর মনে আছে? কেন 800 কে BOO বলেছিলাম?
-তখন 8 লেখা হয়েছিল অন্যরকম করে, B এর মত দেখাচ্ছিল। তুমি যখন ‘বু ফিট’ বলেছিলে, আমি বলেছিলাম, মা এটাতো BOO না, এটা হচ্ছে 800”
-বাবিয়া, তুই কত ছোট ছিলি, তোর মনে আছে সেই কথা?
-আমার সব কথা মনে আছে মা, আমি একদিন লোরি’দির সাথে রাগ করে ঐখানে গিয়ে বসেছিলাম, গালে হাত দিয়ে। আমাকে নিয়ে সবাই হাসছিল, তখন তুমি আমার কাছে এসে বলেছিলে, “ রাগ করেনা রাগীনি, রাঙা মাথায় চিরুণী, বর আসবে এখনি, নিয়ে যাবে তখনি। শীগগীর চলে আয় আমার কোলে”।
আশাবরীর চোখ ফেটে জল আসতে চাইলো, কেউ কিছু মনে রাখেনা কথাটি সত্যি নয়, বাঁশরী সব মনে রেখেছে। আশাবরী বলল, “ বাঁশরী, তোর ভাল লাগছে এখানে?”
-ভাল লাগছে, আবার খারাপ লাগছে। আগে মজা ছিল, আমরা সবাই ছিলাম। এখন কেউ নেই, তোমার অনেক মন খারাপ, বাবারও মন খারাপ। মা, আমাদেরকে লেখাপড়া করতে বলো কেন? লেখাপড়া ভাল করেছে বলেই তো দিদি-দাদা অনেক দূরে চলে গেছে, আমিও চলে যাব। তোমরা একা হয়ে গেছো।
-হা হা হা! দারুণ কথা বলেছিস, আমারও এখন মনে হয় লেখাপড়া বেশী করার বিপদ আছে, সবাই দূরে চলে যায়। তুই যে আমার কলিজার টুকরা, তুইও চলে যাবি।
-মা, এটাই সিস্টেম। তুমি আর বাবাওতো তোমাদের বাবা-মাকে ছেড়ে চলে এসেছো। দাদু-দিদা তোমাদের জন্য মন খারাপ করেছে না? তোমরা কি তাই বলে ফিরে গেছো? কিন্তু তোমরা এখানে চলে এসেছো বলেই দেশে সবাইকে হেল্প করতে পারছো। সবার তো হেল্পটাই দরকার, কাছে থেকে যদি হেল্প না করতে পারতে তাহলে লাভ হতোনা। তখন দাদু দিদাও বলতো, তোমাদের বিদেশ চলে আসতে।
-বাঁশরী, তুই এত ছোট বয়সে এমন গভীর কথা বলিস কী করে? তোর সাথে তো আমরা কেউই সিরিয়াস বিষয়ে কখনও কথা বলিনা, তুই কার কাছ থেকে শিখলি?
-মা, সেদিন ইন্টারভিউতে একজন আমাকে জিজ্ঞেস করেছিল সেইম কথা, আমি নাকি অনেক গভীর চিন্তা করে কথা বলি। কার কাছ থেকে পেয়েছি এই ক্যারেকটারিসটিক? আমি তোমার কথা বলেছি।
-আমার কথা বলেছিস? আমি কি গভীর চিন্তা করে কথা বলি?
-হ্যাঁ, তুমি অনেক কথা বলো ঠিক, তবে তোমার কথাগুলো অন্যরকম, আর কেউ ওভাবে বলেনা।
চল্লিশ মিনিট পেরিয়ে গেছে, বাঁশরিকে হোস্টেলে ফিরতে হবে। এখন বাড়ি না ফিরলে ওর দেরী হয়ে যাবে। অসিতবরণ গাড়িতে স্টার্ট দিল, আজ মা মেয়ের গল্পে অসিতবরণ কোন টুঁ শব্দ করেনি। অসিতবরণ বলে কম, শোনে বেশী।
গাড়ি চলছে কালো রাস্তা ধরে , দুই পাশে সবুজের সমারোহ, আশাবরীর চোখ জুড়িয়ে যায়। শিলিগুড়ির কথা মনে পড়ে, কিশোরগঞ্জ যাওয়ার কথা মনে পড়ে, সুনামগঞ্জ যাওয়ার কথা মনে পড়ে, সাভার যাওয়ার কথা মনে পড়ে, সব সুন্দর স্নিগ্ধ স্থানের কথা মনে পড়ে।
বাঁশরি আঙ্গুল তুলে দেখালো, “ মা ঐ যে দেখো পুকুর দেখা যায়, গাছের ফাঁক দিয়ে, বাংলাদেশের মত দেখতে, তাইনা?
বাড়ির কাছেই এত সুন্দর জায়গা, অথচ চার বছর পর আসা হলো। আশাবরী আপনমনে গেয়ে উঠলো
“বাড়ির কাছে আরশীনগর, সেথা এক পড়শী বসত করে, আমি একদিনওনা দেখিলাম তারে।“