সকালে ঘুম ভেঙেই মৃদুলার প্রথম কাজ হচ্ছে বারান্দায় উঁকি দেয়া।ওর ঘুম ভাঙ্গে সাতটা থেকে সাড়ে সাতটার মধ্যে আর এই সময়টাতেই মর্নিং ওয়াক শেষে বারান্দায় বসে চা খান ওর বাবা,আজিজুর রহমান।সামনে থাকে খবরের কাগজ যার ভাঁজ তখনও খোলা হয়নি।বাবা চায়ে চুমুক দিতে দিতে অপেক্ষায় থাকেন কখন তাঁর আদরের কৌটা মেয়েটা ঘুম ভেঙে হরিণপায়ে ছুটে আসবে।এসেই বাবার গলা জড়িয়ে ধরে বলবে,তুমি পেপার পড়ে ফেলনি তো বাবা?রহমান সাহেব তখন মুচকি হেসে বলেন,নাহ চশমাটা খুঁজে পাচ্ছি না।একটু পড়ে শোনাবি মা?
বাবার চেয়ারের হাতলে বসে তখন পেপার পড়ে মৃদুলা।যখন থেকে পড়তে শিখেছে,রোজ সকালে বাবাকে পেপার পড়ে শোনানো হচ্ছে দিনের প্রথম কাজ।কখনও যদি দেখেছে পেপারের ভাঁজ খোলা,কেঁদেকেটে একাকার হয়েছে।সেই ছোট্ট মৃদুলা এখন ইউনিভার্সিটিতে পড়ে কিন্তু বাবার আদরের মেয়ের স্বভাব বদলায়নি একদম।
তবে সপ্তাহের একটা দিন এই রুটিনটা একটু বদলে যায়।শুক্রবার ভোরে ঘুম ভেঙে রোজ দিনের মত ছুটে এসে বারান্দায় উঁকি দিয়ে বাবাকে দেখতে পায়না মৃদুলা।ছোট্ট টেবিলটায় প্রতিদিনের মত পেপার থাকে,বারান্দা জুড়ে খোলা হাওয়ারা লুটোপুটি খায় কিন্তু বাবার চেয়ারটা খালি থাকে।তখনি মৃদুলা টের পায় যে দিনটা শুক্রবার।বাবাকে আজ বাসায় পাওয়া যাবে না।ছোটবেলায় যখন শুক্রবার সকালে বাবাকে খুঁজে খুঁজে হয়রান হত,তখন মায়ের কাছে জেনেছে শুক্রবারে নাকি বাবাকে ব্যবসার কাজে ঢাকার বাইরে যেতে হয়।
শুক্রবারে তাই মৃদুলা সময় কাটায় বারান্দা জুড়ে থাকা গাছগুলোর সঙ্গে।তেরতলার এই বারান্দাটা দারুণ সুন্দর।লম্বা,টানা বারান্দা জুড়ে নানা রকম ছোট ছোটগাছ,রেলিং জুড়ে মানিপ্ল্যান্ট,পাতাবাহার,বনসাই, কিছু দুর্লভ ক্যাকটাস আর উইন্ড চাইম দিয়ে বোঝাই।মৃদু বাতাসে সারাক্ষণই বারান্দাজুড়ে টুংটাং সুর বাজে।গাছের শখটা বাবার কাছ থেকেই পেয়েছে মৃদুলা।মৃদুলার ছোট্ট বেলাতে বাবা যত গল্প শোনাত তার বেশির ভাগ অংশ জুড়ে থাকত বাবার ছেলেবেলা যার পুরোটাই ভীষণ সবুজে ছাওয়া।বাবা যখন গল্পগুলো বলতেন তার চোখদুটো কি স্বপ্নিল হয়ে উঠত।গল্পগুলো শোনার সময় মৃদুলা দেখতে পেত বাবার পড়ার ঘরের জানালা থেকে দেখা বটগাছ যার তলায় বিকেলভর ডাংগুলি খেলছে বাবা,নদীর পাড়ের সেই গাছের পাশে বসা রথের মেলা থেকে বাঁশি কিনে বাজাতে বাজাতে বাড়ি ফিরছেবাবা,বটের ডাল থেকে নদীর পানিতে লাফিয়ে পড়ছে বাবা,নদীর পাড়ে বটগাছের মোটা শেকড়ে বসে গান গাইছে বাবা,বটের পাতা ছিঁড়ে সাদা কস বের করে বাঁশের কঞ্চির মাথায় লাগিয়ে ঝিঁঝিঁপোকা ধরছে বাবা,বৃষ্টির দিনে সব ছেলেদের সাথে কাঁদায় গড়াগড়ি খেয়ে ফুটবল খেলছে বাবা আর মন খারাপের সন্ধ্যায় বটতলায় বসে উদাসী বাতাসের গান শুনছে বাবা।বাবার মুখে গল্প শুনতে শুনতেই মৃদুলা ভেবে রেখেছিল বাবার জন্মদিনে সে বটের বনসাই উপহার দেবে।
কিন্তু খুব অবাক হয়ে মৃদুলা দেখল উপহারটা পেয়ে বাবা যতটা খুশি হবে ভেবেছিল,ততটা হল না।বরং মন খারাপ করে গাছটার দিকে তাকিয়ে রইল।মৃদুলা জিজ্ঞেস করেছে,কি হল বাবা?তুমি খুশি হওনি?
বাবা সেদিন বিষণ্ণ হেসে বলেছিলেন,অনেক খুশি হয়েছি মামনি।কিন্তু কি জানিস?গাছটার দিকে তাকিয়ে বারবার শুধু নিজেকেই দেখতে পাচ্ছি।কত বড় একটা বটগাছ হয়ে ডালপালা ছড়ানোর কথা ছিল আমার,অথচ ঠিক এই বনসাইটার মতই শুধু চেহারায় বটগাছ হয়ে দাঁড়িয়ে আছি।আমার নিজস্বতা,স্বকীয়তা বলে কিছু অবশিষ্ট নেই রে মা।নাগরিক জীবন আমাকে মহীরুহ হতে দেয়নি,বনসাই করে ফেলেছে।
সেই রাতে ঘুমাতে যাওয়ার সময় বাবার কাছে জেনেছিল মৃদুলা,মা পছন্দ করেন না বলেই কখনও গ্রামের বাড়িতে যায়না ওরা।মা ছোটবেলা থেকেই ঢাকায় বড় হয়েছে।বিশাল ধনী আর আধুনিক ফ্যামিলির মেয়ে বলে বাবার ঠিক আসল মানুষটাকে পছন্দ হয়নি মায়ের।ইউনিভার্সিটিতে পড়ার সময় যে সাদাসিধে গ্রামের মাটিতে বেড়ে ওঠা মানুষটাকে ভালবেসেছিলেন তিনি,বিয়ের পর সেই মানুষটাকেই নিজের মত করে শহুরে আর স্মার্ট করে তুলতে গিয়ে কবে যে আসল মানুষটাকে হারিয়ে ফেলেছেন সে খেয়াল রাখেননি।রহমান সাহেবের আত্মীয়দের কখনও ওদের ফ্ল্যাটে আসতে দেখেনি মৃদুলা।কারণ মা গ্রাম্য মানুষদের পছন্দ করেন না।মৃদুলা কতবার গরমের ছুটিতে বাবার গ্রামের বাড়ি,বটগাছ,নদী,ধানক্ষেত দেখতে চেয়েছে।মা কখনও যেতে দেয়নি।সেই চুপচাপ নিরব রাতে বাবার জন্য ভীষণ মায়া হয়েছিল মৃদুলার।মনে হয়েছিল,কোন জাদুর কাঠি ছুঁইয়ে যদি বাবাকে তার বটগাছের জীবনটা ফিরিয়ে দেয়া যেত!
বাবা যখন শুক্রবার রাতে বাসায় ফেরেন ততক্ষণে মৃদুলা ঘুমিয়ে পড়ে।পরদিন ভোরে যখন বাবার সাথে দেখা হয় তখন বাবার চেহারায় একটা অন্যরকম আলো দেখতে পায় ও।মনে হয়বাবাকে যেন কেউ নতুন জীবন দিয়েছে।এটা নিয়েও বাবার সাথে ঝগড়া হয়েছে মায়ের।মৃদুলা শুনে স্তব্ধ হয়ে গেছে যখন মা বলছিল,তুমি কি ভাব প্রতি শুক্রবারে তুমি কোথায় যাও কেউ জানেনা?লজ্জা করে না তোমার?মেয়ে বড় হয়েছে,এখন আমার প্রতি না হোক মেয়ের প্রতি ভালবাসার জন্য হলেও তো তোমার সৎ থাকা উচিত।ছিঃ।এই মানুষকে ভালবেসে বিয়ে করেছিলাম আমি!
বাবার গলায় যেন বরফ মেশানো।অনেকক্ষণ পর বলেছিল বাবা,না মালিহা।এই আমাকে তুমি বিয়ে করনি।যাকে বিয়ে করেছিলে,সেই আমাকে খুঁজতেই প্রতি শুক্রবারে যাই।
মৃদুলা মরে গেলেও বিশ্বাস করবে না যে বাবা কখনও খারাপ কিছু করতে পারে।আবার বাবা যেহেতু নিজ থেকে কিছু বলছে না,তাই বাবাকে ব্যাপারটা নিয়ে প্রশ্ন করতেও অস্বস্তি হচ্ছিলকিন্তু এক বিকেলে ইউনিভার্সিটি থেকে ফিরে মাকে চিৎকার করতে শুনল মৃদুলা।এবারও সেই একই বিষয়।এবারও বাবা নিশ্চুপ।ওকে দেখে থেমে গিয়েছিল মা।সেদিনই মৃদুলা ঠিক করে বাবার কাছে জানতে চাইবে সে।বাবাকে বন্ধু ভেবে ও যদি সব শেয়ার করতে পারে তবে বাবা কেন পারবেন না ওর সাথে নিজের কষ্ট শেয়ার করতে!রাতে শোবার আগে বাবা যখন রোজকার মতই মাথায় হাত বুলিয়ে দিচ্ছিল,তখনি মৃদুলা বলে,বাবা একটা কথা জিজ্ঞেস করব?প্রমিস কর রাগ করবে না।
মৃদুলা টের পায় ওর মাথায় আদর করতে থাকা বাবার হাত থেমে যায়।একটু চুপ থেকে বাবা বলেন,আমি জানি তুই কি জানতে চাস।প্রতি শুক্রবার কেন বাসায় থাকি না,তাই তো?কোথায় যাই,তোর মা যা বলে সেটাই সত্যি কিনা এটাই তো জিজ্ঞেস করবি?
মৃদুলা কি বলবে ভেবে পায়না।বাবাই একটু পরে বলেন,সামনের শুক্রবারে তুই নিজেই চল না আমার সাথে! দেখে আসবি তোর বাবাটা কোথায় যায়,কি করে।
বাবার কথা শুনে লাফিয়ে ওঠে ও,সত্যি আমাকে নিয়ে যাবে বাবা?
রহমান সাহেব মাথা নাড়েন।তারপর সেই ছোটবেলার মত মাথায় হাত বুলিয়ে মৃদুলার সবচেয়ে প্রিয় “দ্য গিভিং ট্রি” কবিতাটি শুনিয়ে ঘুম পারিয়ে দেন।আধো ঘুম,আধো জেগে থাকা অবস্থায় মৃদুলা ভাবে,শেল সিলভারস্টাইনের আপেল গাছটাই বোধহয় বাবার সেই বটগাছ।তাই হয়ত গাছটার প্রতি এত ভালবাসা বাবার!
পরের শুক্রবারটা আসে অনেক দেরিতে।অন্তত মৃদুলার তাই মনে হয়।পুরো সপ্তাহ জুড়ে ও অপেক্ষায় থেকেছে এই দিনটার জন্য।বাবা যখন ওকে কাকডাকা ভোরে ঘুম থেকে জাগিয়ে রেডি হতে বলেন,মৃদুলার মনে হয় এত চমৎকার ভোর আগে কখনও দেখেনি ও।
তখনও সূর্য ওঠেনি।ভোরের নরম আলোয় আজন্ম চেনা শহরটাকে কি মায়াময় লাগছে!জীবনে প্রথমবারের মত নৌকায় বসে নদীর পানিকে রাঙিয়ে দিয়ে সূর্য উঠতে দেখল মৃদুলা।একটা সময় অবাক হয়ে ও দেখল চারপাশে শুধু সবুজ আর সবুজ,চোখ জুড়িয়ে দেয়া সবুজ।কি নিঝুম নিস্তব্ধ চারপাশ।গাড়ির হর্ন বাজছে না,বিজবিজ করে এসি চলছে না,একটু পর পর ফোন বাজছে না কারণ বাবা নৌকায় উঠেই নিজের আর মৃদুলার ফোন অফ করে দিয়েছেন আর সবচেয়ে যেটা মুগ্ধ করল মৃদুলাকে সেটা তার বাবা।চোখ বুজে বসে থাকা বাবাকে কি অসম্ভব সুদর্শন দেখাচ্ছে!বাবাকে দেখে সব সময়ই ওর বন্ধুরা বলেছে,”তোর বাবাটা যা হ্যান্ডসাম না!”কিন্তু আজকের মত এত পবিত্র আর সুদর্শন কখনও লাগেনি বাবাকে!সেই মুহূর্তে মৃদুলা হঠাৎ করেই টের পেল,শুক্রবারের বাবা এত সুদর্শন আর আলোকিত কারণ এই বাবাকে কোন খোলস পরিয়ে রাখা হয়নি।মানুষের নিজস্বতার চেয়ে সুন্দর আর কিছুই হয় না।
হঠাৎ ঝাঁকুনি খেয়ে ঘোর ভাঙে মৃদুলার।নৌকা পাড়ে এসে থেমেছে।বাবার হাত ধরে নামতে গিয়ে ওর চোখ আটকে গেল নদীর পাড় জুড়ে সগর্বে দাঁড়িয়ে থাকা বটগাছটার দিকে।সেই বটগাছ! নদীর আরেক পাড়ে তাকিয়ে দেখল দিগন্তজুড়ে থাকা ধানক্ষেত।মাটিতে পা রেখেই মৃদুলার মনে হল একেই বুঝি শেকড়ের কাছে ফেরা বলে।
পায়ে পায়ে হেঁটে বট গাছটার পাশে এসে দাঁড়াল মৃদুলা।তাকিয়ে দেখল বাবার চোখে পানি।এই অপার্থিব সৌন্দর্য আর নীরবতার মাঝে এর চেয়ে পবিত্র আর কিছুই হতে পারত না।বাবা চোখ মুছতে মুছতে বলল,আমার শৈশবটা আমার মেয়েকে দেখাতে পেরে কি যে ভাল লাগছে আমার!চল তোর দাদু বাড়িতে অপেক্ষা করে আছে।
বাবার পিছু পিছু হাঁটছিল মৃদুলা।এত সবুজ আর সজীবতা চারপাশে!একটু পর পর গাছের আড়ালে হারিয়ে যাচ্ছিল বাবা।তাকে দেখে মৃদুলার মনে পড়ল বাবার ভীষণ প্রিয় কবি রবার্ট ফ্রস্টের একটা কবিতার কিছু লাইন,
“The woods are lovely, dark and deep.
But I have promises to keep,
And miles to go before I sleep,
And miles to go before I sleep”।
মনে মনে ঠিক করে রাখল মৃদুলা,মাকেও একবার এখানে নিয়ে আসতে হবে।ওর মনে হলপ্রকৃতির এই সৌন্দর্য আর বিশালতার এত কাছাকাছি এলে মানুষের মনে লুকিয়ে থাকা সন্দেহ,ঘৃণা আর অহংকারের মত ভাইরাসগুলো মরে যাবে।নিজের ঠিক সত্যিকারের মানুষটাকে দেখতে হলে নিজের শেকড়ের কাছে,সবুজের কাছে ফিরে যাওয়ার চেয়ে ভাল আর কি হতে পারে?
(গল্পে ব্যবহৃত কবিতার লাইনঃরবার্ট ফ্রস্টের “Stopping By Woods On A Snowy Evening”
কবিতার শেষ চার লাইন)