দুপুরে সবে একটু ঘুমিয়েছে অপর্ণা। তখনই কলিং বেল-এর শব্দ।
উফ, এই ভর দুপুরে আবার কে এল। আর ভাল লাগেনা। নিজের মনেই কথাগুলো বলল অপর্ণা।
তারপর দরজা খুলে বাইরে বেরিয়ে এল ও। দেখে একজন মহিলা। পড়নে ছেঁড়া শারী। কোলে আবার একটি বছর দুইয়ের বাচ্চা মেয়ে। দেখেই মনে হল নিশ্চয়ই কোন কিছু চাইতে এসেছে। এদের আর কাজ কি। ভাবে এখানে সবাই বুঝি টাকা-র গাছ নিয়ে বসে
আছে। চাইলেই টাকা বেরিয়ে আসবে মুঠো মুঠো।
-কি চাই?
বেশ বিরক্তি ভরা গলায় জিজ্ঞেস করল অপর্ণা।
-আমি সোনারপুর বস্তি থেকে এসেছি।
আগন্তুক মহিলা উত্তর দিল।
-আমি তো জিজ্ঞেস করিনি কোথা থেকে এসেছ। আমি জিজ্ঞেস করেছি কি চাই এখানে।
-পরশু রাতে আমাদের বস্তি তে আগুন লেগেছিল। তাই টাকা, খাবার সংগ্রহে এখানে এসেছি।
-সাথে এটি কে?
-এ আমার ছোট মেয়ে।
-ওহ, ছোট। এর আগে কজন আছে?
-আমার চার মেয়ে।
-চারটে মেয়ে কে খাওয়ানোর, পড়ানোর ক্ষমতা আছে? আবার মেয়েদের খেতে দিতে পারনা বলে লোকের বাড়ি গিয়ে ভিক্ষা করো। সত্যি, তোমাদের লজ্জাও করেনা। কি কাজ করো?
-আমি বাড়ি বাড়ি রান্নার কাজ করি, দিদি।
-মেয়েদের পড়াও? নাকি কয়েকদিন পরেই বিয়ে দিয়ে দেবে, আর ওরাও ভিক্ষে করবে পেটের দায়ে।
-বড় আর মেজো মেয়ে পাঠশালায় পড়ে। বাকিরা খুব ছোট।
-কিভাবে আগুন লাগল? কাগজে তো কোন খবর দেখিনি। তোমার কথা আমি কিভাবে বিশ্বাস করব বল?
-এক জনের ঘরে স্টোভ ফেটে। আমি মিথ্যে বলছি না দিদি। এই আমার মেয়ের মাথায় হাত দিয়ে বলছি।
-সে তোমরা অনেক কিছু বলতে পার টাকা পাবার জন্য। তা আগুন লেগে কেউ মারা গেছে নাকি?
-না, তবে বেশ কিছু ঘর পুড়ে গেছে।
-তোমার বর কি করে? তোমাদের সরকার থেকে সাহায্য দেয়নি?
-ও একটা দোকানে কাজ করে। সরকার বলেছে কিছু দেবে, কিন্তু কবে পাব জানিনা। ওরা তো বলে অনেক কিছুই, কিন্তু দেয় কোথায়।
-তো চাই কি? শুধু টাকা আর খাবার?
-যা পারবেন। আজ সকাল থেকে কিছু খাইনি। মেয়ে টার খুব খিদে পেয়েছে।
-আর তোমার? তোমার খিদে পায়না? নিজের টা বলনা কেন?
অসময়ে ঘুম ভাঙিয়ে দেবার জন্য প্রথমে রাগ হলেও, বাচ্চা টাকে দেখে, মায়া হল অপর্ণার। যদিও ও জানে বাচ্চাদের সাথে আনা সহজে ভিক্ষা পাবার একটা চাল।
-আসো ভেতরে আসো।
আগন্তুক মহিলা বাচ্চা টাকে সাথে নিয়ে ভেতরে আসল।
-কি হল দাঁড়িয়ে রইলে কেন? ওখানে বস।
বসার ঘরের বড় সোফা টাকে দেখিয়ে বলল অপর্ণা। মহিলা সোফা তে বসল বাচ্চা টাকে কোলে নিয়ে।
অপর্ণা বলল,
-তুমি যে এই ভর দুপুরে এলে, এই সময়ে কি ঘরে খাবার থাকে? সকাল থেকে কজনের বাড়ি গেছো? কেউ খাবার দেয়নি?
-সকালে শুধু টাকা আর জামা চেয়েছি। এখন খাবার চাইলাম।
-দেখো আমি ভাল করে তোমার কথা যাচাই না করে টাকা দেবনা। তবে খাবার আর জামা কাপড় দিচ্ছি।
-কিছু টাকা পেলে খুব ভাল হত দিদি।
-বেশ তো, তুমি বেশি করে খাবার নিয়ে যাও। আর তোমার মেয়েদের দেবার মত তো কোন জামা আমার কাছে নেই। তবে কিছু শাড়ী দিতে পারি তোমার জন্য। এখানে একটু বস। আমি কিছু খাবার নিয়ে আসছি।
ওদের কে বসিয়ে রেখে অপর্ণা রান্না ঘরে গেল। ফ্রিজে রাখা সকালের দুধ টা গরম করল। রাতের জন্য রাখা খাবার গুলো গরম করে নিয়ে এল। বসার ঘরে এসে দেখল বাচ্চা টা ঘুমিয়ে পরেছে।
-তোমার মেয়ে তো ঘুমিয়ে পরেছে, ওর জন্য দুধ টা এনেছি। ওকে দিয়ে দাও। আর এই খাবার গুলো তুমি খেয়ে নাও। আচ্ছা, তোমার নাম টা কি?
-আমার নাম করবী, দিদি।
-তোমরা খেয়ে নাও। আমি দেখি কিছু পুরনো শাড়ী যদি থাকে, নিয়ে আসি তোমার জন্য।
বসার ঘর থেকে উঠে নিজের শোবার ঘরে এল অপর্ণা। আলমারি খুলে কিছু প্যাকেট বার করল। ওর অনেক পুরনো না পরা শাড়ী আছে ওতে। প্যাকেট গুলো নিয়ে বসার ঘরে ফিরে এল ও। এসে দেখল বাচ্চা মেয়েটা তখনও ঘুমোচ্ছে। করবী খাবার গুলো গোগ্রাসে
খাচ্ছে। ওর খাওয়া দেখে মনে হল সত্যি সে সকাল থেকে অভুক্ত।
-তোমার মেয়ে যে খেলনা, ঘুমিয়ে পরল।
-ওতো উঠছে না দিদি।
-তুমি দুধ টা বরং নিয়ে যেও। আমি বোতলে ঢেলে দিচ্ছি।
-আপনার মত মানুষ হয়না দিদি।
-এই প্যাকেট-এ কিছু শাড়ী আছে। তোমার জন্য এনেছি। আমার অনেক দিনের পুরনো শাড়ী। ঘরে পরেই থাকে। তুমি বরং নিয়ে যাও। পরতে পারবে।
-সত্যি দিদি, সকাল থেকে কেউ আপনার মত করেনি।
-তোমার বিপদ দেখে তোমায় আজ সাহায্য করলাম, তাই বলে আবার রোজ রোজ সাহায্য চাইতে এসনা যেন।
-কি যে বলেন দিদি।
-কি আর বলব বল। যারা তোমাদের উপকার করে, তাদেরই তো তোমরা ঘাড় মটকাও। যখন তখন এটা চাই ওটা চাই করো।
-দিদি, আপনি এই বাড়িতে একা থাকেন?
-হ্যাঁ, একাই থাকি। আসলে তোমরা মাঝে মাঝে এমন কাণ্ড কর যে কেউ চাইলেও আর তোমাদের উপকার করেনা। এর জন্য তোমরাই দায়ী। যাক গে সেসব কথা।
প্যাকেট থেকে ৩টে শাড়ী বার করল অপর্ণা। হলুদ আর বেগুনী রঙের দুটো শাড়ী এগিয়ে দিল করবী-র দিকে।
-এই নাও এই দুটো শাড়ী রাখো। এ দুটো তোমায় দিলাম।
-এতো অনেক দামী শাড়ী দিদি। আপনি তো বেশি পড়েনওনি মনে হচ্ছে। আর ওই নীল শাড়ী টাও খুব সুন্দর দিদি। ওটা তো একদম নতুন দেখছি। পড়েননি কখনও?
-না গো। আসলে এই শাড়ী টার একটা ইতিহাস আছে। যে শাড়ী টা এত যত্ন করে দিল, সেই যখন আর রইল না, তখন সেটা আর পরি কি করে। তাই এটা এভাবেই রয়ে গেছে বছরের পর বছর। এটার বয়স কত জান? ২০ বছর।
-একটা কথা জিজ্ঞেস করব দিদি, যদি কিছু মনে না করেন।
-কি জিজ্ঞেস করবে? এই শাড়ী টার ইতিহাস তো? কি হয়েছিল, কেন শাড়ী টা পরিনি, তাইনা?
-হ্যাঁ মানে...
-সে অনেক পুরনো কথা। ১২ই জানুয়ারী, আমার জন্মদিন। দিন টা ছিল ২০ বছর আগের এক ১২ই জানুয়ারী। সেদিন আমি ভোর বেলা শিলিগুড়ি থেকে কলকাতা ফিরি। আগের দিন সকালে আমার বন্ধু সৌমিত্র ফোন করল। বলল ও একটা কি জিনিস কিনেছে
আমার জন্য, জিনিস টা কি বললনা। ও চিরকাল এমনই ছিল। সবাই কে চমকে দিতে খুব ভালবাসত। ভোর বেলা ট্রেন এসে পৌঁছল শিয়ালদহ স্টেশনে। তখনও অল্প শীত ছিল কলকাতায়। স্টেশনের বাইরে এসে একটা ট্যাক্সি নিয়ে বাড়ি ফিরলাম। বিকেলে বাড়িতে
কিছু বন্ধুদের আসার কথা ছিল। শাড়ী টা ছিল জন্মদিনের সন্ধ্যায় সৌমিত্রর দেওয়া উপহার। নীল রঙ আমার খুব প্রিয় সেটা ও খুব ভাল করে জানত। রাতে ফেরার সময় যে বাসে ও উঠেছিল, কেস্টপুরের কাছে সেটা ব্রেক হারিয়ে পাশের খালে পড়ে যায়। যাত্রী দের
মধ্যে কেউ বাঁচেনি। সকালে খবর পেলাম ওর ভাই অপূর্ব-র থেকে। তখনই ছুটলাম ওর বাড়ি। তারপর শেষ হয়ে গেল সবকিছু, আমার সব থেকে কাছের সেই বন্ধুটা।
পুরনো কথা বলতে বলতে চোখের কোনা অশ্রু সিক্ত হয়ে উঠল অপর্ণার। এর মধ্যে করবীর মেয়ের ঘুম ভেঙ্গে গেছে।
-করবী, তুমি বস। আমি ওর জন্য দুধ টা গরম করে আনি।
বলে বসার ঘর থেকে উঠে এল অপর্ণা।
বাচ্চা টাকে খাইয়ে করবী উঠে পরল। টিফিন বক্স-এ করে অপর্ণা কিছু খাবার দিয়ে দিল, আর সাথে তিনটে শাড়ী।
নীল শাড়ী টা দেখে করবী বলল,
-এটা আমায় দিলেন কেন দিদি?
-এটা তোমার যখন ভাল লেগেছে নিয়ে যাও। শুধু দুঃখের স্মৃতি বহন করে চলেছে এই শাড়ী টা সেই ২০ বছর আগের দিন টা থেকে। কয়েক মাস হল আমার ক্যানসার ধরা পরেছে। বেশী দিন বাঁচবনা। তুমি এটা নিয়ে যাও। শাড়ী টা তো বাঁচুক। আমার প্রিয় বন্ধুর
দেওয়া প্রিয় উপহার টা আজ না হ্য় আমি কারোকে উপহার দিলাম। অপর্ণার দেওয়া জিনিস গুলো নিয়ে বাইরে বেরিয়ে এল করবী।
০৯ জানুয়ারী - ২০১২
গল্প/কবিতা:
২০ টি
বিজ্ঞপ্তি
এই লেখাটি গল্পকবিতা কর্তৃপক্ষের আংশিক অথবা কোন সম্পাদনা ছাড়াই প্রকাশিত এবং গল্পকবিতা কর্তৃপক্ষ এই লেখার বিষয়বস্তু, মন্তব্য অথবা পরিণতির ব্যাপারে দায়ী থাকবে না। লেখকই সব দায়ভার বহন করতে বাধ্য থাকবে।
প্রতি মাসেই পুরস্কার
বিচারক ও পাঠকদের ভোটে সেরা ৩টি গল্প ও ৩টি কবিতা পুরস্কার পাবে।
লেখা প্রতিযোগিতায় আপনিও লিখুন
-
প্রথম পুরস্কার ১৫০০ টাকার
প্রাইজ বন্ড এবং সনদপত্র।
-
দ্বিতীয় পুরস্কার ১০০০ টাকার
প্রাইজ বন্ড এবং সনদপত্র।
-
তৃতীয় পুরস্কার সনদপত্র।
আগামী সংখ্যার বিষয়
লেখা জমা দেওয়ার শেষ তারিখ ২৫ ডিসেম্বর,২০২৪