অজানা প্রশ্ন

বাবা (জুন ২০১২)

অবাস্তব
  • ১৬
  • ২৯
চিন্তা-ভাবনা আর অস্থিরতার মাঝে দিন অতিবাহিত করছিলাম। স্বস্তির নি:শ্বাস ফেলার মত সময়টুকুও খুঁজে পাচ্ছিলাম না। আর আদর, স্নেহ, ভালবাসা থেকে তো বঞ্চিত হয়েছি অনেক আগেই। মা বেঁচে থাকলে অবশ্য এমনটি নাও হতে পারতো। কিন্তু মা তো নেই! এটাই দুর্ভাগ্য। আজ থেকে প্রায় পাঁচ বছর আগে মাকে দেখেছি। এখনও ভালই মনে আছে মায়ের কথা। মায়ের চেহারাটা হয়ত ভুলেই যেতাম। কিন্তু ভুলি কেমন করে? পড়ার টেবিলের সামনেই যে মায়ের ছবি টাঙানো আছে। আমার মায়ের মতো মা আর একটিও নেই। তবে শুনেছি ছোট বেলায় না কি মা আমাকে মারতেন খুব। অবশ্য পড়ার জন্য মা কোনদিন আমাকে মারেন নি। পড়ার বেলায় আমি ছিলাম সেরাদের একজন। তখন বুঝতাম না বলেই দুষ্টামি করতাম। মাও সেই জন্য মারতেন। কিন্তু পরে দেখতাম মা আমাকে খুব আদর করছেন। মায়ের চোখ থেকে কয়েক ফোঁটা অশ্রুও ঝরত। এখন মায়ের আদর-শাসন কিছুই পাচ্ছি না। বাবার আদর-শাসন তো পাওয়ার কথা। কিন্তু কোথায় আমার বাবা? আর কোথায় আমি?
বাবার সাথে আমাদের সম্পর্কের কথা শুনে সবাই বাবাকে ঘৃণা করে। কিন্তু আমার মধ্যে সে রকম কোন প্রতিক্রিয়া হয় না। শুধু মনে প্রশ্ন জাগে। যার উত্তর দেবার ক্ষমতা আমার বাবারও নেই। বাবাকে খুব দেখার সাধ জাগে মাঝে মাঝে। মনে হয় বাবার সাথে ঘুরতে যাই, গল্প করি। কিন্তু নিয়তির নির্মম পরিহাসে আমার সাথে বাবার কোন সম্পর্ক নেই। আমি যেমন বাবার অভাব বুঝি, বাবারও বোঝা উচিৎ সন্তানের অভাব। কিন্তু তা আর হবে কেমন করে? আমার মতো আরো অনেক সন্তান আছে বাবার। আমার প্রতি বাবার আকর্ষণ থাকবেই বা কেন ? আমি এক হতভাগা মায়ের সন্তান। যার স্বামীর ঘরে যাওয়ার কোন সুযোগই হয়নি। যাবেই বা কি করে? বাবারও না কি নিজস্ব বাড়ি ছিল না। বাবার আশ্রয়স্থল ছিল আমার নানা বাড়িতেই। নানা বাড়িতে ঘর জামাই খেতাব নিয়ে থাকতেন বাবা। নানা না কি বাবাকে বাড়ি করে দিতেন। কিন্তু দুর্ভাগ্য আমার। সোনার সুখের বাড়িটা আমি পেলাম না। এর জন্য দায়ী আর কেউ নয়। আমার বাবা। আমি বুঝতে পারছি না মাকে কেন বাবা পছন্দ করে নাই। যারা বাবাকে মানুষের সমাজে ঠায় পাওয়ার ব্যবস্থা করে দিল। তাদেরকে অস্বীকার করে আমার বাবা আবার দূরে চলে গেলেন। বাবা আমাদের ফেলে কেন চলে গেলেন? কি ছিল আমার অপরাধ? না কি মায়ের অপরাধ? কিসের লোভে বাবা আবার বিয়ে করলেন?
ছি: ওসব ভাবতেই আমার বুক কেঁপে উঠে। এগুলো মনে পড়লেই বাবার প্রতি আমার ঘৃণা জন্মায়। এরপর আমার মা অনেক আদর যত্নে আমাকে বড় করেছেন। বুঝতে দেননি বাবার অভাব। মা যে এত ভালো আমি ভাবতেও পারি না। আমার মা বলতেন, "বাবা তোকে খুব বেশি লেখাপড়া করতে হবে। মানুষের মত মানুষ হতে হবে। বাবার পরিচয়ে নয় বরং নিজের পরিচয়েই তোকে বড় হতে হবে।"
আমি বলতাম, মা এটা কেমন করে সম্ভব? আমিও তাই চাই। তুমি আমাকে সেই পথে নিও মা। আমি তোমার সব কথা শুনবো।
মা বললেন, হ্যাঁ বাবা। আমি জানি তুই আমার সন্তান। আমার মনের মতই হবি। তোকে আমি অমানুষ হতে দেব না। তোর বাবাকে দেখাতে হবে তাঁর অনুপস্থিতিতে আমি তোকে মানুষের মাঝে বড় করে গড়ে তুলেছি।
তখন দেখলাম মায়ের চোখে কয়েক ফোঁটা অশ্রু। কিন্তু বুঝতে পারলাম না মা কাঁদছেন কেন? মনে করলাম আমার সুখের কথা চিন্তা করে। এখন আমি সব বুঝতে পারি। পৃথিবীর সমস্ত সুখ এনে দিলেও মেয়েরা সুখী হয় না। আর যদি স্বামী পাশে থাকে তবে তারা আর কিছুই চায় না।
এত দু:খের মধ্যে থেকেও আমি ছিলাম সুখী। আমার ছিল না কোন অভাব কিংবা না পাওয়ার বেদনা। মনে হতো পৃথিবীর সমস্ত সুখ এসে আমার হাতে ধরা দিয়েছে। কারণ নানা বাড়ির সবাই আমাকে খুব আদর স্নেহ করতেন। কোনদিন আমাকে বুঝতে দেননি বাবার অভাব। ক্রমে ক্রমে আমি প্রাইমারী শেষ করে হাই স্কুলে পদার্পণ করেছি। মামাদের ছেলে-মেয়েদের সাথে একত্রে পড়তাম, খেলতাম, এমন কি স্কুলেও যেতাম। যেদিন ওরা কেউ স্কুলে যেত না, আমিও সেদিন স্কুলে যেতাম না।
জীবনের প্রতিটি পদক্ষেপে আমার জয়ের ধারা কেউ ঠেকাতে পারছিল না। এই জন্য সবার সাথে সাথে আমারও আনন্দ কম ধরতো না। কিন্তু ভাগ্যের হাতে বন্দি আনন্দের সীমাকে বাধার জন্য প্রকৃতি সর্বাগ্রে এগিয়ে আসল। অন্ধকার মেঘে ছেয়ে গেল আমার আকাশ। চরম দু:খের পাহাড় নেমে এলো আমার চলার পথে। ফুলের মতো নিষ্পাপ জীবন হল কণ্টকাকীর্ণ। মেট্রিক পরীক্ষা দেওয়ার আগেই দেখলাম মায়ের মৃত্যু। লেখাপড়ায় অনেক অগ্রসর হলেও আমার বয়স অতটা হয়নি তখনও। তাই বুঝতে পারলাম না পিতা-মাতা না থাকার কষ্ট। আসলে না বললেই নয়। নানার আদর স্নেহের মধ্যে থেকে বুঝতে পারিনি মায়ের অভাব। শুধু বুঝেছিলাম মা বলে ডাকার মতো আমার আর কেউ রইল না। অনেক দু:খে কষ্টে মনের মধ্যে যন্ত্রণা নিয়ে চালিয়ে গেলাম আমার লেখাপড়া। মাঝে মাঝে মনে হতো লেখাপড়া করে আর কি হবে? মা নেই, বাবা নেই। আমি একা। লেখাপড়া দিয়ে কি করব আমি? কিন্তু নানার উৎসাহে পড়তে হয়েছিল।
একদিন মেট্রিক পরীক্ষা দিলাম। পাশও করলাম খুব ভাল রেজাল্ট নিয়ে। গ্রামের মানুষের মুখে মুখে শুনলাম আমার প্রশংসা। তখন আমি জীবনকে খুব ভালবাসতে শিখলাম। যখনই আমার জীবনের কথা কল্পরাজ্যে স্থান লাভ করে, আমি তখনই দেখতে পাই একটা লাশ এসে দাঁড়ায় আমার কল্পরাজ্যে। আমি বুঝতে পারি না সে আমাকে কেন বিরক্ত করে? কি চায়? আমার পৃথিবীকে বাধা দিয়ে তার কি লাভ? চোখের কোণে মনের অজান্তে নানা প্রশ্ন খেলে যায় আমার হৃদয় থেকে। চোখ হতে কয়েক ফোঁটা পানিও ঝরে যায়। শুধু ভাবনা চিন্তা আমার মাথার মধ্যে উঁকি-ঝুঁকি মারতে থাকে। আমি আমার নিজেকেই বোঝাতে পারি না। শুধু ঘৃণা করতে থাকি একজন মানুষকে।
আমার সেই ঘৃণিত বাবাকে পেলেই প্রশ্ন করব? আমার মনের সেই অজানা প্রশ্ন। যা কোন দিন করতে পারেনি মা। আমার সুখের জন্যই মা হয়ত বাবাকে বলতে পারেনি তার মনের ক্ষোভ। কিন্তু আমাকে তো বলতেই হবে। অথচ আমি যখনই বাবার মুখোমুখি হব, তখনই সামনে আসে সেই লাশ। তা মাড়িয়ে যাওয়া কিছুতেই আমার দ্বারা সম্ভব নয়। তাই তো হতে পারতাম না বাবার মুখোমুখি। প্রশ্ন করতে পারতাম না বাবাকে। কিন্তু কেন? কেন? কেন?
এর উত্তর দেবার ক্ষমতা আমি হারিয়েছিলাম সেই ইন্টার পাশের আগেই। হঠাৎ করেই নানার মৃত্যু আমাকে এতই আহত করল যে, এর বেদনা আমাকে ধ্বংসের পর্বত লীলায় রূপান্তরিত করল। আমার জীবনকে আবার অনিশ্চিতের মধ্যে ফেলে দিল। ভালবাসা জীবন থেকে মুছে গেল চিরতরে। অন্ধকারের চরম পর্যায়ে নিক্ষেপিত হল আমার জীবন। জীবনকে ফুলের মত করে সাজাতে আমি সম্পূর্ণরূপে ব্যর্থ হলাম। সকলের চেষ্টায় যদিও কিছুটা অগ্রসর হয়েছি। তবে আমি মনের কাছে মোটেও সন্তোষজনক নই। জীবনটা চালাতে হবে, তাই চালিয়ে যাচ্ছি।
জীবনের শুরু থেকেই কোনদিন দাদা বাড়ির মাটি স্পর্শ করিনি। নানার বাড়িকেই মনে করেছি দাদার বাড়ি। সারাটা জীবন নানাকে দাদা বলে ডেকেছি। কেউ জিজ্ঞাসা করলে বলেছি দাদার কথা। অর্থাৎ নানার কথা। কিন্তু বাবার নাম বলতেই সবাই জিজ্ঞাসা করে তোমার বাবার বাড়ি কোথায়? সেই মূহুর্তে আমার মনের মধ্যে আগুনের ফুলকি জ্বলে ওঠে। সইতে পারি না কোন মতেই। ঘৃণা করতে থাকি সেই মানবতার অমানুষকে। কিন্তু আমার ঘৃণার মাঝেই লাশটি এসে বাধা দেয়। আমি বলতে পারি না কিছুই। শুধু অপেক্ষা করে থাকি সেই দিনটির আশায়। যেদিন আমি প্রতিষ্ঠিত হব। একজন পূর্ণাঙ্গ মানুষ হব। ঠিক সে রকম একজন মানুষ, যেমনটি আমার মা চেয়েছিলেন।
আজ সেই দিন। সবে আমি বিশ বছরে পদার্পণ করেছি। তবে সম্পূর্ণ প্রতিষ্ঠিত হতে পারিনি। তবে আমার জ্ঞান বুদ্ধি পরিপূর্ণতায় রূপ নিয়েছে। এখন আমার সময় হয়েছে সব সমস্যার সমাধান করার। অথচ এই সময়ে কেউ কেউ হাতছানি দিয়ে ডাকছে ভালবাসার অধিকার নিয়ে। কেউ আবার ভালবেসে ফেলেছে আপন ভেবে। মনের গভীরে ঠায় দিয়েছে। কিন্তু আমি তো এই পৃথিবীর এক আত্মভোলা যাযাবর। আজ এখানে, তো কাল ওখানে। ঠিকানাবিহীন মানুষ আমি।
মায়ের মনের মতো হতে পেরেছি কি না জানি না। তবে বাবার মতো অমানুষ হইনি এটা বিশ্বাস করি। এখন আমি বাবার মুখোমুখি হতে চাই। যেতে চাই বাবার কাছে। না না সেখানে থাকতে নয়। বরং তাকে প্রশ্ন করতে।
আজ আমার মনে খুব আনন্দ হচ্ছিল। সুখের অনুভূতি কিছুটা হলেও পাচ্ছিলাম। হঠাৎ করেই মনটা ছটফট করে ওঠে। সমস্ত আনন্দ নস্যাৎ হয়ে যায়। চোখ হতে কয়েক ফোঁটা পানি বের হলো। জানি না মায়ের কথা মনে পড়েছিল কিনা? মুহূর্তের জন্যেও দেরি করতে পারলাম না। ছুটে চললাম সেই উদ্দেশ্যে। মায়ের লাশকে পারি দিয়েই চললাম বাবার মুখোমুখি হতে। মনে একটাই প্রশ্ন কী অপরাধ আমার? কী অপরাধ করেছিল আমার মা? কেন মৃত্যুর কথা শুনেও মাকে দেখতে আসলেন না তিনি?
নীল আকাশ যেন মেঘে অন্ধকার হয়ে গেছে। সূর্যটাও তার কিরণ বন্ধ করে ঢলে পড়েছে পশ্চিমাকাশে। হাজারো লোকের সমাগম ঐ শেখ বাড়ির সামনে। কারো চোখে অশ্রু নেই। সবার দৃষ্টি আমার দিকে। সামনে এগোলাম। কিছুদূর এগিয়ে পা থেমে গেল। বিশাল জমিনের উপর দাঁড়িয়ে থাকলাম কয়েক মিনিট। সামনে সবুজ ধানক্ষেতও নয়, কোন বিয়ের বাড়িও নয়, দেখলাম একটা লাশ। আমার বাবা! চোখ হতে অঝোর ধারায় লোনা জল বেরিয়ে পড়ল অজানা প্রশ্নের সন্ধানে।
আপনার ভালো লাগা ও মন্দ লাগা জানিয়ে লেখককে অনুপ্রানিত করুন
খন্দকার আনিসুর রহমান জ্যোতি valo likhechho choto golpo amoni valo........boro hole aro valo likhbe asha kori...........
মোহাম্মদ ওয়াহিদ হুসাইন .....................গল্পটা ভাল লাগল। শুভেচ্ছা রইল।
sraboni ahmed শেষটা ভাল লেগেছে। লিখতে থাকুন। আপনার জন্য রইল শুভ কামনা।
মিলন বনিক বিশ বছরের চড়াই উতরাই পেরিয়ে দাড়ানোর এক সুন্দর অনুভুতি..খুভ ভালো লাগলো..শেষটায় মনকে ভীষণ নারা দিয়েছে..
দিপা নূরী বেশ সুন্দর হয়েছে।
আহমেদ সাবের বেশ সুন্দর হয়েছে। গল্পের সমাপ্তিটা বেশ চমৎকার। গল্প-কবিতায় স্বাগতম।
মামুন ম. আজিজ স্বাগতম,.......বেশ লিখেছেন। ..
জাকিয়া জেসমিন যূথী বাস্তব জীবনের আবহমাখা করুণ কাহিনী। ভালো লিখেছেন।
অবাস্তব শহীদুল্লাহ / শামীম আরা / তানজির হোসেন / আরমান / শাকিল / মাসুক ............ সকলকে আমার প্রাণ ঢালা অভিনন্দন ও ধন্যবাদ |

০৪ ডিসেম্বর - ২০১১ গল্প/কবিতা: ২ টি

বিজ্ঞপ্তি

এই লেখাটি গল্পকবিতা কর্তৃপক্ষের আংশিক অথবা কোন সম্পাদনা ছাড়াই প্রকাশিত এবং গল্পকবিতা কর্তৃপক্ষ এই লেখার বিষয়বস্তু, মন্তব্য অথবা পরিণতির ব্যাপারে দায়ী থাকবে না। লেখকই সব দায়ভার বহন করতে বাধ্য থাকবে।

প্রতি মাসেই পুরস্কার

বিচারক ও পাঠকদের ভোটে সেরা ৩টি গল্প ও ৩টি কবিতা পুরস্কার পাবে।

লেখা প্রতিযোগিতায় আপনিও লিখুন

  • প্রথম পুরস্কার ১৫০০ টাকার প্রাইজ বন্ড এবং সনদপত্র।
  • দ্বিতীয় পুরস্কার ১০০০ টাকার প্রাইজ বন্ড এবং সনদপত্র।
  • তৃতীয় পুরস্কার সনদপত্র।

আগামী সংখ্যার বিষয়

গল্পের বিষয় "স্থিতিশীলতা”
কবিতার বিষয় "স্থিতিশীলতা”
লেখা জমা দেওয়ার শেষ তারিখ ২৫ নভেম্বর,২০২৪