পশ্চাৎ প্রান্ত— থেকে যতটুকু অবলোকন করা যায়, তাতে যে কেউই এই বর্ণনাটুকু অবলীলায় দিতে পারবে। বিশাল কেশরাজি, লম্বা-স্লিম দেহ বিন্যাস, সুডৌল নিতম্ব, সব মিলিয়ে সমাজে চলনসই তথা বিধাতার রাজ্যে আশীর্বাদ স্বরূপ। মেয়েটি শনির আখরা বাজারের মধ্যে দিয়ে ধীর গতিতে হাঁটছে। তার উদ্দেশ্য কেউ জানে না। তবুও ক্ষণিকের জন্য থেমে গেল বাজারের ব্যস্ততা। দৃষ্টি সবার একই দিকে বহমান। কয়েক মিনিট পরেই সবার দৃষ্টি থেমে গেল মনন টেলিকমের দরজায়। স্তব্ধতা ভেঙে শুর“ হল বাজারের ব্য¯—তা। দরজা ঠেলে ভেতরে ঢোকে মেয়েটি। পাবলিক টেলিফোনের দোকানে আর সবার মত একটি টেলিফোন নম্বর এগিয়ে দেয় প্রোপাইটর মিন্টুর দিকে। কার্ডটি হাতে নিয়ে মিন্টু সহাস্যে বলে,
: আপনি দাঁড়িয়ে আছেন কেন, বসুন না।
মেয়েটি বলে, Please আমার নম্বরটা একটু তাড়াতাড়ি দেখুন।
এতসময় পর মেয়েলী কণ্ঠের মাধুর্যতা যখন মিন্টুর কর্ণগোচর হল, ক্ষণকাল দেরি না করেই আপাদমস্তক পর্যবেক্ষণ করে মেয়েটির চেহারায় স্থির হল মিন্টুর দৃষ্টি। মেয়েটির চেহারা অবলোকন করে নিজের চোখকেই অবিশ্বাস করতে হল মিন্টুর। বিধাতার রাজ্যে এমন সৃষ্টি অপ্রতুল। মিন্টুর এই চাহনিতে মেয়েটি একটু ইতস্তত বোধ করল। মেয়েটি বলে,
: আমার কার্ডটা দিন, অন্য জায়গায় দেখি।
মেয়েটির কথায় সম্বিত ফিরে পেয়ে ফোনের লাইন দিল মিন্টু। কথা শেষ হলে ‘কত মিনিট হয়েছে, তার বিল কত?’ সব বুঝিয়ে দিল মিন্টু। মেয়েটি মুগ্ধ হয়ে শুনছে মিন্টুর কথা। তার কথায় আলাদা একটা কৌশল খুঁজে পায় মেয়েটি। ওর খুব ভাল লাগে। মিন্টুকে উদ্দেশ্য করে মেয়েটি বলে,
: আপনার কথাগুলো আমার খুব ভাল লেগেছে।
: ধন্যবাদ।
শুধু ধন্যবাদ দিয়েই শেষ করল। একবার ভাবে মেয়েটিকে বলবে তার সবকিছুই ওর ভাল লেগেছে। কিন্তু সে সাহস বোধ করি এখনো সঞ্চয় হয়নি। টাকাটা দিয়ে চলে গেল মেয়েটি। তার প্রস্থানের দিকে তাকিয়ে থাকতে ভুল করে নাই মিন্টু।
মেয়েটি চলে গেছে প্রায় আধ ঘন্টা আগে। এখনো মিন্টুর দৃষ্টি উ™£াš—। এর মধ্যে অবশ্য বেশ কয়েকজন কাস্টমার এসেছিল। ফিরিয়ে দিয়েছে তাদের। কিন্তু কেন? কিসের ছোঁয়ায়? নিজেও বুঝতে পারে না মিন্টু।
প্রায় এক সপ্তাহ পর আবার ফিরে এল কয়েক মূহুর্তের জন্য বাজারের ¯—ব্ধতা। মিন্টুর দোকানে যেন সুবাতাস বইল সেদিন। প্রথমেই কুশল বিনিময় হল। দু’জনেই ভাল। তারপর ............।
তারপর বহু¶ণ কেটে গেল। কোন কথা হল না দু’জনার মধ্যে। কাস্টমারদের ভীড় কমে গেলে মিন্টু মেয়েটির দিকে তাকিয়ে বলল,
: আপনার নম্বরটা চষবধংব.
: জ্বী না। আজ কোন নম্বরে ফোন করতে আসিনি।
: কেন? ফোন করবেন না?
: ঝড়ৎৎু. সত্যি কথা বলতে কি, গতদিনে আপনাকে, মানে আপনার কথা আমার খুব ভাল লেগেছে। তাই ভাবছি আপনার সাথে একটু গল্প করি। কিন্তু আপনি যে ব্য¯— ......!
: তাতে কি হয়েছে? আমার কোন আপত্তি নাই। আপনি বসতে পারেন।
: ধন্যবাদ।
মিন্টুর সবচেয়ে কাছের চেয়ারটিতে বসে মেয়েটি। চুপচাপই কেটে যায় ¶ণকাল। দু’জনকেই খুব চিšি—ত মনে হয়। মাঝে মাঝে ওরা একে অন্যের দিকে তাকায় আবার লজ্জাবনত হয়ে নিরবতা পালন করে। মিন্টু নিজেকে কাপুর“ষের আড়াল থেকে মুক্ত করার জন্য বলল,
: কি ব্যাপার, গল্প করতে এসেছেন। অথচ চুপ হয়ে গেলেন যে?
মেয়েটি মুচকি হেসে বলল,
: ভাবছিলাম কিভাবে শুর“ করি। আসলে এর আগে কখনো এ রকম পরিস্থিতির মোকাবেলা করতে হয়নি তো তাই।
: কি করে হবে? মানুষের জীবনের প্রতিটি অধ্যায় হচ্ছে ইতিহাস। এখানে বিজ্ঞান, গণিত কিংবা দর্শনের অ¯ি—ত্ব পাবেন না। যদিও ইতিহাস রচিত হয় অতীতকে স্মরণ করতে। কিন্তু জীবন ইতিহাসের প্রতিটি অ¶র বিন্যাস হয় বর্তমানকে নিয়ে। যেখানে অতীত বা ভবিষ্যতের আঁচড় থাকে না।
: আমি কি আপনার সাথে বন্ধুত্ব করতে পারি?
: কেন নয়?
: তাহলে যে বন্ধুর সাথে ‘আপনি’ সম্বন্ধ বলা যাবে না।
: কেন?
: এতে বন্ধুত্বের মর্যাদা নষ্ট হয়।
: বাহ্! আপনি তো ...........।
মেয়েটি মাঝপথেই থামিয়ে দেয় মিন্টুকে। তারপর বলে,
: উহু, তুমি তো।
দু’জনেই হাসতে থাকে। ওদের একান্ত হাসিতে বেশ কয়েকজন কাস্টমার হয়ত ফিরে গেছে। ওদিকে খেয়াল নেই মিন্টুর। তা থাকবেই বা কেন? বিধাতার অপূর্ব সৃষ্টির কাছে আজ বন্দি মিন্টু।
ওদের আলাপ চারিতার মাঝে পরিচয় পর্বটা বের হয়ে আসে। মেয়েটির নাম জেসমিন। ঠিক সুরভিত ফুলের মতই। বাবা চাকুরি সূত্রে পাকিস্তানে আছে। অবশ্য বর্তমানে তিনি ঐ দেশের নাগরিক। জেসমিনকেও নিয়ে যেতে চেয়েছিলেন। কিন্তু লেখাপড়ার জন্য ওর থেকে যাওয়া বাংলাদেশে। লেখাপড়া শেষ করেই পাড়ি জমাতে চেয়েছিল বাবা-মার কাছে। কিন্তু এখন মনে হচ্ছে ওর বোধ হয় বাবা-মার সাথে থাকা হবে না। বাংলাদেশই ওর আপন হয়ে গেছে। হয়ত খুঁজে পেয়েছে সেই কাঙ্ক্ষিত ঠিকানা। যেখানে থাকা যায় বাবা-মাকে ছাড়া।
জেসমিনের ঠিকানা খুঁজে পাওয়ার বিষয়টিতে একটু ¯—ম্ভিত হয়ে গেল মিন্টু। বিস্মিত হয়েই জিজ্ঞাসা করল,
: কোন ঠিকানা খুঁজে পেলে?
মনে কোন দ্বিধা দ্ব›দ্ব না রেখে সোজাসুজি উত্তর দিল জেসমিন,
: আমার হৃদয়ের ঠিকানা।
: কোথায়?
: তোমার কাছে। বোকা কোথাকার, নিজেকে প্রশ্ন করেই দেখ না।
ভালবাসার হাসি মুখভঙ্গিতে রেখে দ্র“ত বেরিয়ে গেল জেসমিন। চিš—ার বলিরেখা দাগ কেটে গেল মিন্টুর চেহারায়। মূহুর্তের পর মূহুর্ত ভাবতে থাকে মিন্টু। “মেয়েটি কি আমাকে ভালবাসার ইঙ্গিত দিল? কিন্তু আমি তো ওকে ভালবাসতে পারবো না। ওকে ঠকানো আমার ঠিক হবে না। মেয়েটিকে সবকিছু জানানো দরকার। নইলে ও বড় কষ্ট পাবে।”
রিসিভারটা হাতে নিতেই বিদ্যুৎ চলে গেল। বিরক্ত হয়ে রিসিভারটা রেখে ড্রয়ার থেকে ম্যাচ আর মোম বের করে মিন্টু। ম্যাচে আগুন জ্বালাতেই এক অপরূপ চেহারা ভেসে ওঠে মিন্টুর চোখের সামনে।
মিন্টু অবাক দৃষ্টিতে বলে,
ঃ তুমি এখানে? এইমাত্র তো বাসায় গেলে।
ঃ জ্বী না। হোস্টেলে ফিরতে ভাল লাগছিল না। তাই ফিরে এলাম। ভাবছি তোমার বাসায় থাকব। অবশ্য যদি তোমার আপত্তি না থাকে।
ঃ আপত্তি নাই। তবে তোমাকে একটা কথা বলতে চাই।
ঃ আমতা, আমতা করছো কেন? বল।
ঃ না জেসমিন, আমি খুব সিরিয়াস।
ঃ থাক্, থাক্ আর বলতে হবে না। তুমি কি বলবে আমি জানি। আমাকে ভালবাসার কথা বলবে। আমি আগেই বুঝে নিয়েছি।
ঃ না।
মিন্টুর না শব্দটি যেন এটম বোমার মত শব্দ করে ফাটল জেসমিনের কানে। ¶ণকাল চুপ থেকে ছোট একটি শব্দ বের হল জেসমিনের মুখ থেকে ‘কেন’।
মিন্টু আত্মবিশ্বাসের সাথে বলে,
ঃ কারণ আমি বিবাহিত।
ঃ আমি বিশ্বাস করি না।
ঃ সেটা তোমার নিজ¯^ ব্যাপার।
কিন্তু এটাই ধ্র“ব সত্য। এই বলে পকেট থেকে একটা ছবি বের করে মিন্টু বলল-
ঃ এই দেখো আমার ছেলের ছবি।
জেসমিন চিৎকার দিয়ে বলল,
ঃ তবুও আমি বিশ্বাস করি না। আমি তোমাকে ভালবাসি। তোমাকেই চাই।
জেসমিনের চোখের জল থামানোর ব্যবস্থা মিন্টুর জানা নেই। তবুও ওকে সাš—¡না দেবার জন্য নিয়ে যায় বাড়িতে। পরিচয় করিয়ে দেয় মিন্টুর স্ত্রীর সাথে। দেখে মিন্টুর পকেটের সেই ছবির ছেলেটি বিছানায় ঘুমিয়ে আছে। এত কিছুর পরেও বিশ্বাস করতে চায় না জেসমিন। ফিরে আসে কষ্টের বিছানায়।
বেশ কয়েকদিন হয়ে গেল। রূপসী কাউকে দেখা যায় না মনন টেলিকমে। সেদিন সকালবেলা। সূর্যটা খুব তাড়াতাড়ি এসেছিল পূর্বগগনে। নীলিমাকে বিসর্জন দিয়ে রক্তবর্ণ ধারণ করেছে আকাশ। বাতাসে মৃদু সুবাসিত জেসমিনের গন্ধ। বেহাগ সুরে তানপুরার শব্দ ভেসে আসছে বাতাসে। পাখিদের কোলাহল থেমে গেছে সেই সন্ধ্যে বেলায়। গতরাতে কোন ডাহুক ডাকেনি। শুধু মৃত্যু ভয়ে উড়াউড়ি করেছে তেলাপোকার দল। বিবর্ণ নারীমূর্তি ঝড়ের বেগে পদার্পণ করল মনন টেলিকমে। পরনে সাদা পোশাক মাথায় কালো হ্যাট। প্রেতাত্মা ভেবে ভয় পেলেও দোষের হবে না।
সবেগে মনন টেলিকমের দরজা লাগিয়ে দিল মূর্তিরূপী জেসমিন। এহেন অবস্থায় কিছুটা ভয়ই পেয়ে গেল মিন্টু। কোন কথা নেই, শব্দ নেই। শিশুর মত ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কাঁদছে জেসমিন। ওর কান্না দেখে থমকে গেছে পৃথিবী। মূহুর্তের জন্য থেমে গেছে বাতাস। কষ্টের নীল আসমান থেকে অঝোর ধারায় বর্ষিত হচ্ছে বৃষ্টি।
মিন্টু কথা বলতে চায়লে ওকে থামিয়ে দেয় জেসমিন। তারপর বলতে শুর“ করে ওর না বলা কথা।
ঃ আজ তোমাকে আমি কিছুই বলতে দেব না। আমি বলব আর তুমি শুনবে। আমার জীবনে ভালবাসা হয়ে তুমি এসেছিলে, থাকবে। এ দেশে আমার আপন মানুষ একজনই ছিল সে তুমি। আমার মনে হচ্ছে সেই তুমি হারিয়ে গেছো। তাই তো আমি বিধবার শাড়ি পরেছি। আজীবন থাকবো এই বেশে। যাতে তোমাকে কখনো না ভুলি। আমার বুকে অনেক কষ্ট। আমি এই কষ্টকে লালন করেই চলে যাচ্ছি। আমার আর লেখাপড়ার ইচ্ছা নাই। কারণ যে দেশে তুমি আছো সে দেশে থেকে আমি বাঁচতে পারবো না। তাই তো বাবা-মার কাছে পাকি¯—ানে চলে যাচ্ছি। যদি কখনো আমার কথা মনে হয় তবে তোমার সš—ানের দিকে চেয়ে আমাকে ভুলে যেও। বিদায় বন্ধু। বিদায়।
২২ নভেম্বর - ২০১১
গল্প/কবিতা:
২৬ টি
বিজ্ঞপ্তি
এই লেখাটি গল্পকবিতা কর্তৃপক্ষের আংশিক অথবা কোন সম্পাদনা ছাড়াই প্রকাশিত এবং গল্পকবিতা কর্তৃপক্ষ এই লেখার বিষয়বস্তু, মন্তব্য অথবা পরিণতির ব্যাপারে দায়ী থাকবে না। লেখকই সব দায়ভার বহন করতে বাধ্য থাকবে।
প্রতি মাসেই পুরস্কার
বিচারক ও পাঠকদের ভোটে সেরা ৩টি গল্প ও ৩টি কবিতা পুরস্কার পাবে।
লেখা প্রতিযোগিতায় আপনিও লিখুন
-
প্রথম পুরস্কার ১৫০০ টাকার
প্রাইজ বন্ড এবং সনদপত্র।
-
দ্বিতীয় পুরস্কার ১০০০ টাকার
প্রাইজ বন্ড এবং সনদপত্র।
-
তৃতীয় পুরস্কার সনদপত্র।
আগামী সংখ্যার বিষয়
লেখা জমা দেওয়ার শেষ তারিখ ২৫ ডিসেম্বর,২০২৪