- না, না, সরফরাজ সাহেব, আপনি যতই ওর হয়ে ওকালতি করেন না কেন, কোনভাবেই আমি তাকে এ দায়িত্ব দিতে পারিনা। আমার আবেগ প্রবণ হওয়া চলেনা। সব দিক বিবেচনা করেই আমাকে সিদ্ধান্ত নিতে হয়। কেননা এসব সিদ্ধান্তের পেছনে অনেকগুলো ফ্যাক্টর জড়িত রয়েছে ।
* কিন্তু স্যার, আমাদের ডিপার্টমেন্টের যেটা প্রকৃত উদ্দেশ্য তা কিন্তু কেবল মাহফুজ সাহেবকে দিয়েই সম্ভব। অন্য হাতগুলো কতবারইতো যাচাই করে দেখলেন। শেষ পর্যন্ত আপনাকে বা আমাকে হস্তক্ষেপ করেই তবে নিষ্পত্তি করতে হয়। কিন্তু মাহফুজ সাহেবকে দায়িত্ব দিলে এটা তো নিশ্চিত যে সে আমানতদারীর সাথে তার দায়িত্ব সম্পন্ন করবে। আপনাকে বা আমাকে কোন টেনশনই করতে হয়না।
- যা বলছি তাই করুন। আপনি কেন বুঝতে পারছেন না। ওপরে, নীচে সব দিকেই আমাকে নজর রেখে কাজ করতে হয়। নীচের বিড়ম্বনা যতটা না আমাকে বিচলিত করে, তার চেয়ে বেশী বিচলিত হই ওপরের কারণে। আমাকে তো এডমিনিস্ট্রেশনটাও দেখতে হবে। আপনিতো জানেন, তার সাথে সাবঅর্ডিনেট কেউই কাজ করতে চায় না। এখন বলুন, এটা ম্যানেজ করবেন কি ভাবে ? মানছি, he is very good officer, but he can’t survive current situation. So, leave it and go ahead.
* স্যার, আপনার নির্দেশের বাইরে আমার কিছু করার নেই বটে, তবে আমার মনে হয় বিষয়টা আর একটু ভেবে দেখলে ভাল হয়।
- মাহফুজ সাহেব কি প্রত্যাশী ? মানে সে কি আপনার কাছে এটি চেয়েছে?
*না, স্যার । উনার যা স্বভাব, তাতে উনি কোনদিনই মুখ ফুটে উনার কোন সুযোগ সুবিধার দাবী করবেন বলে মনে হয় না। আমি কেবল এসব কার্য বণ্টনের যে ক্রাইটেরিয়া রয়েছে , তার আলোকেই চিন্তা করছি। সিরিয়ালি তিনি অনেকবারই এসব প্রাপ্য ছিলেন। কিন্তু উনার কোন তদবির নাই দেখে কোনদিনই উনাকে দেয়া হয় নাই , আর উনার চাইবার স্বভাব নাই বলে উনাকে দেয়া হয় না। আমি স্যার অফিসের নৈতিকতার দিকটা বিবেচনায় আনতে আগ্রহী, তা ছাড়া আর কিছু নয় ।
- দেখুন, এরকম দৃষ্টিভঙ্গি নিয়ে আপনার মত আমিও কম ভাবিনি তার বিষয়টা। এখন যুগটা কোথায়- তাওতো আপনাকে ভাবতে হবে , তাই না ? বর্তমানে সমগ্র দুনিয়া জুড়ে চলছে কম্প্রোমাইজের খেলা। এখানে আমরা তার বাইরের ট্র্যাকে চলতে পারি না। তারতো কম্প্রোমাইজ করার কোন ক্যাপাসিটিই নেই। এজন্যই তো তাকে যখনই টিম লিডার মনোনীত করে পার্টি ফরম করেছি তখনই রুট লেভেল থেকে আপত্তি এসেছে । তার সাথে কোন সাবঅর্ডিনেট যেতে চায় না। এখন বলুন, আমার কী করার আছে। উনাকে আপনি বরং Quality Assurance Team এর প্রধান করে একটা কমিটি করতে পারেন। তাতেই বরং আমাদের মূল লক্ষ্য অর্জিত হবে।
* সে তো প্রতিবারই করা হচ্ছে। কিন্তু তাতে কি লাভ হচ্ছে ? গ্রাস-রুট থেকে যদি ফিড উঠে না আসে তাহলে Q A T করার প্রয়োজনীয়তা আর থাকে কোথায় ? আর তা ছাড়া বেচারাকে তার উপযুক্ত দায়িত্ব ও কর্তব্য থেকে যেমন আমাদেরকে দূরে রাখতে হচ্ছে। তেমনি অনেক সুযোগ সুবিধা থেকেও তাকে বঞ্চিত করা হচ্ছে। কত অযোগ্য লোক লাখ লাখ টাকার টি, এ, ডি এ পাচ্ছে, অথচ এরকম একজন যোগ্য লোককে আমরা বঞ্চিত করছি, কার স্বার্থে, বলতে পারেন স্যার ?
- দেখুন, সরফরাজ সাহেব, আপনি এখানে আসার আগে থেকেই মাহফুজ সাহেবকে নিয়ে আমি কাজ করে আসছি। তাকে আপনি যেভাবে ফিল করছেন, আপনি ভেবেছেন, আমি কি সেভাবে তাকে নিয়ে ভাবিনি ? এখানকার এ্যাসোসিয়েশনের চাপ আমি একেবারেই পাত্তা দিতাম না। তাকে দিয়ে আমি ১০০% রাষ্ট্রীয় স্বার্থ রক্ষার ব্রত নিয়েছিলাম। কিন্তু, এ নিয়ে কত জঘন্য অবস্থার মুখোমুখি আমাকে হতে হয়েছে, তা কি জানেন আপনি ? স্বয়ং রাষ্ট্রপ্রধানের দপ্তর থেকে আমাকে হুমকি প্রদান করা হয়েছে। আর তার আর্থিক বিষয়টা তো ? দেখেন, প্রতি মাসে কতগুলো সারপ্রাইজ ভিজিট আমি তাকে দিয়ে করিয়ে আনি । যেটা আমার করার কথা, আমার বিবেক নাড়া দেয় বলেই কিন্তু সে কাজটা আমি তাকে দিয়ে করাই। আর আমি নিশ্চিত যে, আমি যে কাজটা করতে চেয়েছি- তা মাজহফুজ সাহেব খুবই আমানতদারীর সাথে করেছেন। আমি আরো ভেবে রেখেছি, এবার বড় সাহেবকে বলে ওকে দু’ চারটা মিশন ট্যুর প্রোগ্রাম দিব।
* আপনার সে মহানুভবতা আছে, এ ব্যাপারে স্যার আমার বিন্দু মাত্র সন্দেহ নেই। আমাদের সবার মুখ রক্ষা হল, মাহফুজ সাহেবের স্বার্থও দেখলেন কিন্তু এ অভাগা রাষ্ট্র যে আর্থিক ক্ষতি থেকে মুক্তি পাচ্ছে না, আমার ভাবনা সেখানে। আমরা কত অসহায় ! স্যার, এটা ভাবতে গেলে খুবই খারাপ লাগে ।
- কী করবেন, যাদের দায়িত্ব সে ভাবনার, তারাই যদি তা না ভাবেন, আমরা ভেবে কী করতে পারি, বলুন। আপনি আমি যেটা চাই, আসলে সেটা ঐ উনাদেরকেই চাইতে হবে, নাহলে যতকাল এরকম কম্প্রোমাইজের নীতির কাছে সবাই আত্মসমর্পণ করে চলবে ততকাল আমার আপনার স্বপ্ন স্বপ্নই থেকে যাবে। অতএব , যান, যেভাবে করতে বলছি সেভাবে করে নিয়ে আসুন।
* এজন্য মাঝে মাঝে মনে হয়, যদি আমার ফ্যামিলি পিছুটান না থাকতো, তবে এ চাকরী থেকে ইস্তফা দিয়ে চলে যেতাম। ভাল লাগেনা, এরকম আত্মসমর্পণের চাকরী করতে মন কোনভাবেই সাড়া দেয় না।
- কী আর করবেন ! আমাদেরও হাত পা বাধা।
****
সরফরাজ সাহেব মাহফুজ সাহেবকে তার কক্ষে ডাকলেন । তার মহানুভবতার কথা তাকে জানালেন, কিন্তু তার ভেতরে কোন প্রতিক্রিয়াই দেখা গেল না। কেননা এসব অতি পূরণ ঘটনা । তার চাকরী জীবনের শুরু থেকেই এসব ঘটে আসছে । সুতরাং সরফরাজ সাহেব , তরুণ মানুষ । নতুন চাকরী । নীতি নৈতিকতাকে তিনিও খুব প্রাধান্য দিতে পছন্দ করেন । তাই মাহফুজ সাহেব গোপনে কেবল তার মঙ্গলের জন্য দোয়াই করেন ।
-আচ্ছা, আপনার কি কিছুই বলবার নেই ?
না, স্যার ।
-আপনার কোন প্রতিক্রিয়া হয় না ?
একটা কথা বলব স্যার ?
-বলেন ।
সৌদি আরব মহানবী(সঃ) এর পুণ্যভূমি। কি বুনিয়াদ রচিত হয়েছিল সেখানে ? আর এখন কি হচ্ছে সেখানে ? মার্কিন মুলুকের সবচেয়ে ঘনিষ্ঠ মিত্রদের মধ্যে অন্যতম প্রধান মিত্র এই সৌদি আরব। কিন্তু প্রবাদ আছে আমেরিকা যার ঘনিষ্ঠ বন্ধু তার দ্বিতীয় কোন শত্রুর প্রয়োজন হয় না। আর আমাদের মুসলমান ব্যক্তি, পরিবার, সমাজ, রাষ্ট্রনায়করা সবাই ভুলেই গেছেন, মুহররম মাসের দশ তারিখে হোসাইন (রা.) সপরিবারে জীবন দিয়ে আমাদেরকে কোন শিক্ষা দিয়ে গিয়েছিলেন ? তিনি কেন কম্প্রোমাইজ করেন নি? তিনি কম্প্রোমাইজ করলে তার সামনে ছিল অগাধ ক্ষমতা পাবার সম্ভবনা, সুখ সম্রাজ্য, ভোগ বিলাসী অপার জীবন । তিনি কেন সেদিন কম্প্রোমাইজ করেন নি ? অথচ আজ সব ভুলে গেছি আমরা ! আজ কি নির্লজ্জভাবে কম্প্রোমাইজ নামক শান্তি রক্ষার কাজে ব্যস্ত হয়ে পড়েছে মুসলিম রাষ্ট্রগুলো ! এসব এলোমেলো চিন্তা ভাবনা যখন করি, তখন খুবই বিড়ম্বনায় পড়ি । আর ভাবি, আমার মত একজন ছা পোষা কর্মকর্তার এ জগতের কাছে কীই বা চাইবার আছে ? স্যার, বর্তমান জামানার যা হাল, তাতে আমার মত মূর্খের কোন আক্ষেপ তো করা চলেই না, বরং যতটা পারা যায় ন্যস্ত দায়িত্ব ও কর্তব্য সাধ্যমত সমাধা করে নিজের জবাব দিহিতার স্থানটাকে ঠিক রাখা যায় কি না, সেটা ভেবেই অস্থির হয়ে যাই । দোয়া করবেন স্যার, আমার জীবনে যেন কোনদিন কোন অন্যায়ের সাথে কম্প্রোমাইজের দরকার না হয়, তাহলে হয়তো সেদনি চাকরীটা ছেড়ে দেয়া ছাড়া আমার আর কোন উপায় থাকবে না ।
সরফরাজ সাহেব পলকহীনভাবে কিছুক্ষণ তার দিকে চেয়ে থাকলেন । আর কোন কথাই তিনি সেদিন বলতে পারলেন না।