লোড শেডিং শুরু হল। ব্যালকনিতে বসব বলে যেইনা দ্রুত পা বাড়িয়েছি দরজায় দাঁড়িয়ে থাকা আমার মিসেস আমাকে বাঁধা দিয়ে বললেন,
- বাব্বা, এত তাড়াহুড়ো করছ কেন ? একটু ধীরে এস। আর কোন রকম শব্দ করনা যেন।
কেন?
- ওখানে আমাদের এক বিশেষ ব্যতিক্রমধর্মী মেহমান আছে। সে খুব ভীতু এবং লাজুকও বটে। অবশ্য সে কেবল আমাদের মেহমান হয়েই আসেনি, এসেছে তার জীবণের গুরুত্বপূর্ণ প্রয়োজনে। তার প্রয়োজনটা শেষ না হওয়া অবধি এ ব্যালকনিটার ব্যবহার আপাতত একটু কম করলে ভাল হয়।
আমার মিসেসের হঠাৎ এরকম দার্শনিকের মত কথা শুনে ভড়কে গেলাম।
কী ব্যাপার, বলত ?
-এত ব্যস্ত হচ্ছ কেন ?
না, মানে , কে এসেছে ? আমার সেই লাজুক শ্যালিকা, না কি ? কৈ , দেখি।
আমার হাতটা খুব শক্ত করে ধরলেন তিনি।
- আরে না, তুমি ধীরে ধীরে একটু মাথাটা নীচু করে আমার সাথে এস, আমি বলছি ।
যো, হুকুম । কৈ , কাউকে দেখছি না তো? এমন ঢং কর না, তা আর বলার না। এমনিতেই গরমে গা জ্বলে যাচ্ছে, খামাখা তুমি আমাকে এরকম বোকা বানালে ?
- আস্তে কথা বল, আস্তে । উড়ে যাবে তো !
দুত্তরি, কি সব আবোল তাবোল বলছ, বলত ? তোমার কি মাথা খারাপ হয়ে গেছে ?
-আরে সাহেব, আমার মাথা ঠিকই আছে। অত উতলা হচ্ছ কেন ? সবুর কর। সবুরে মেওয়া ফলে। উহ! সখ কত ? লাজুক শ্যালিকাকে দেখার জন্য মনটা খুব আন চান করছে , না ?
ছি! আমাকে এই তোমার মূল্যায়ন ?
-এই যা ! সিরিয়াস হয়ে গেলে ? ঠাট্টা করছিলাম।
না, এরকম ঠাট্টা ভাল নয় । তা, কৈ , কে এসেছে, বললে না তো ?
আমার দু' চোখের পাতা তার হাতের তালু দিয়ে বন্ধ করে আমার ঘাড়টা একটু কাত করে বামে মোড় দিয়ে বলল, এবার তাকাও।
দুত্তরি, কৈ ?
-ঐ দেখ।
এ তো মনে হচ্ছে একটা পাখির বাসা।
-মনে হচ্ছে ? পাখিটাকে দেখছনা ? ঐ দেখো , ঠোট বের করে বসে আছে ।
হ্যা, তাই। এই বুঝি তোমার বিশেষ মেহমান ?
-জ্বি , হ্যা। ইনিই তিনি।
কি পাখি ?
-বুলবুলি ।
তো, এত যায়গা থাকতে ও এখানে এই দরজার কাছে একেবারে হাতের নাগালে বাসা বেধেছে ? পাখিটা খুব বোকা তো !
-তা বেশ বলেছ। সত্যিই ও খুব বোকা। শুরু থেকেই ও দেখে আসছে এখানে ওর ডিমে তা দিতে অসুবিধে হবে, তার পরো কেন যে এখানটাই ও বেছে নিল, বুঝলাম না। জান, প্রথমেই ওকে বাসা বাঁধতে দেখে আমি ইচ্ছে করে ঘন ঘন ব্যালকনিতে এসেছি, কাপড় নেড়েছি, কত রকম শব্দ করেছি, তাও সে শেষ পর্যন্ত বাসাটা বাঁধলই। ডিম পেড়েছে, এখন তা দিচ্ছে। আমার কি ধারনা জান ?
কি ধারনা ?
- আমার প্রতি ওর একটা বিশ্বাস জন্মেছিল । আমার এত বাঁধা স্বত্তেও সে বোধহয় কোন একটা আস্থার যায়গা খুঁজে পেয়েছে।!
রে, বাব্বা ! একেবারে পুরোদস্তুর দার্শনিকের মত কথা বলছ !
-থাক ! থাক! হয়েছে । তাহলেতো বলতেই হয়, প্রতিটা সন্তানের মা একজন বড় দার্শনিক, কি বল?
দারুন বলেছ গিন্নি ! তোমার এই এথিক্যাল টপিক্স আমার খুব ভাল লাগল। কিন্তু তোমার তিন ছেলে মেয়েকে সামলাবে কিভাবে ?
- শোন ওদের কাছে, কিভাবে সামলেছি ।
কিন্তু ছোট মেয়েটা ? সে তো এসব বুঝবে না, তাকে সামলাবে কি ভাবে ?
- সেও বোধহয় আমার ভাষাই বুঝেছে ।
খু---উ---ব ভাল । তা, তোমার নতুন মেহমান নিয়ে বেশ আনন্দেই আছ ?
- একটু কষ্ট পেয়েছি, জান ?
কেন ?
- প্রথম দিকে ওর একটা ডিম পড়ে ভেংগে গিয়েছে। তবে এখন যে কটা আছে তা নিয়েই ও তা দিচ্ছে। আমার যে কী ভাল লাগছে! বাচ্চা হবে, দেখব, খুব কাছে থেকে , ওরা কেমন করে বাচ্চাদের আদর করে।
আমার মিসেস একটা অবোধ বালিকার মত কথাগুলো বলছে, আর দুলছে। আমি অবাক হয়ে দু’টি মাকে দেখছি। বেশ কিছুক্ষণ মৌন থেকে ভাবছি, এই দুই মায়ের মধ্যে কোন ব্যবধান নেই। এদের মূল পরিচয় একটাই। এরা উভয়ই ”মা”। সৃষ্টির কী অপরূপ সৌন্দর্য ! ”মা” । একটা মাত্র শব্দ। অথচ কত গভীর তার আবেদন! কতনা বিশাল তার আয়তন! কতনা বিশাল তার অস্তিত্ব ! একটা মাত্র শব্দ সৃষ্টির এ বিশাল রাজত্ব ভরে দিয়েছে কতইনা বিচিত্র সৃষ্টিতে। তাইতো কবি এভাবে আবেগে উচ্ছসিত হয়ে বলে উঠেছিলেন, ” আজ সৃষ্টি সুখের উল্লাসে ” ।
- এই , কি ভাবছ ?
না, মানে ভাবছিলাম, দিনের বেলা যখন তোমরা কাপড় নাড়তে আস তখন ও কি করে?
- প্রায়ই উড়ে যায়। আমি এজন্য এখন এটার ব্যবহার একদম ছেড়েই দিয়েছি। পেছনের ব্যালকনিটা ব্যবহার করছি। তোমার ছেলেরা একটু বিরক্ত করেছে কিছুদিন, এখন আর করেনা।
ছোট ছেলেটা ৩য় শ্রেণীতে পড়ছে। বড়টা পড়ছে ৬ষ্ঠ শ্রেণীতে । বড়টা একটু লাজুক প্রকৃতির । কিন্তু ছোটটা একেবাবে কাঠখোট্টা । কোন কিছুতে সহসাই ছাড় দেয়না। একটু তর্ক বিতর্ক পছন্দ করে। সে তার মত করে তার ধারনার বিজয় অর্জন করতে স্বাচ্ছন্দ বোধ করে। আমি তার এ স্বভাবকে খুব পছন্দ করি। যুক্তি দিয়ে তাকে বোঝাবার চেষ্টা করি। বেশ এনজয় করি তার যে কোন বিতর্কে জড়ানোকে। সে তার বড় ভাইকে সেদিন বলছিল,
ভাইয়া, পাখিটাকে ধরবার জন্য না, আমার হাতটা এখনো সুড় সুড় করে। বড়টা সাথে সাথে প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করল,
- আমারও করে । কিন্তু --------
কিন্তু কি ? তুমি গতবার মেলা থেকে যে নজরুল জীবনী বইটা কিনেছিলে আমি তার পুরোটা পড়েছি। আমি জানি, কাজী নজরুল ইসলাম তার জীবণে কম পাখির বাসা ভেংগেছে, বল ?
-ঠিক, তুই ঠিকই বলেছিস। কিন্তু তাই বলে তিনি কি জীবণে বড় হন নি ? কেন যে মা বাবা আমাদের এত সুখের ইচ্ছেটাকে পূরণ করতে এভাবে বাঁধা দিচ্ছেন, বুঝি না। পৃথিবীতে কি বুলবুলি পাখি এই একটাই জন্মেছে ? আর কি নেই ? এটার বাচ্চা না হলে কি এখানেই এদের বিলুপ্তি ঘটবে ? নাহ ! এটা মানা যায় না। আমাদেরও তো মনের ইচ্ছার স্বাধীনতা ভোগ করতে ইচ্ছে করে ।
অতএব, দু’ভাই একমত হল। আজ বাবা অফিস থেকে ফিরলে তাঁকে ধরতে হবে ।
যথা ইচ্ছা তথা কাজ। আমি বাসায় ফিরে ফ্রেশ হয়ে যখন বিশ্রাম নিচ্ছিলাম, দু’ভাই একসাথে আমার পাশে বসল। ছোটটা শুরু করল,
আচ্ছা, বাবা, একটা কথা বলি, রাগ করবে না তো ?
-বল, তবে রাগ করার মত কিছু না বললে ভাল হয়, না কি ?
একটু রাগ তোমার হবে বোধহয়, তবুও বলতে ইচ্ছে করছে, বলি ?
-বল ।
তুমি ছোট বেলায় পাখির বাসা ভাংগ নি ? পাখি ধরনি ?
- ও আচ্ছা, বুঝতে পেরেছি, এই কথা ?
এই তো , তুমি শুনবে না। দেখলে , এ জন্যই বলছিলাম---
-না, না, বল , তুমি সব কথা বল, আমি শুনব।
তাহলে আমাকে আগে শেষ করতে দেবে, তার পরে তুমি তোমার যা খুশী তাই বলবে।
-ঠিক আছে, স্বাধীন ভাবেই বল।
তাহলে আমি যেটা বলছিলাম সেটার উত্তর দাও, সংক্ষেপে , হ্যা অথবা না। বাসা ভেংগে পাখি ধরনি ?
-হ্যা ।
কতবার ?
- যখন বুঝতাম না, তখন অনেকবারই। কিন্তু একদিন মা বলেছিলেন, এটা অনেক বড় অন্যায় এবং অপরাধও বটে, তার পর থেকে আর করিনি ।
তো ? আমরা তো ধরতে চাচ্ছি মাত্র একবার । আর এটাকে মারতে চাইছি না, ধরে আবার ছেড়ে দেব। কিন্তু তোমরা আমাদের কেন তা করতে দিচ্ছ না ?
বড়টা লাজুক। কথা তেমন বলেনা। সুযোগ পেয়ে কাজী নজরুলের ছেলেবেলার কথাটা আমাকে মনে করিয়ে দিল । যেন অনেকটা রেফারেন্স হিসেবে তাদের পক্ষে সমর্থন জোরালো হয় ।
-আর কোন প্রশ্ন ?
না।
-তাহলে এবার আমি তোমাদের দাবীটা না মানার স্বপক্ষে কিছু কথা বলি ?
বল ।
- দেখ, আমি যখন ধরেছি বা কাজী নজরুল ইসলাম যখন এরকম ধরতেন, তখন আমরা তা করতাম বনে জংগলে ঘুরে বেড়িয়ে , খেলার ছলে, মনের আনন্দে । বাবা, মা বা বড়দের চোখের আড়ালে। আমাদের সে খেলাটা যে ক্ষতিকর বা অন্যায় বা অপরাধের ছিল- এ কথাটা আমরা কারো মুখে কোনদিনই শুনিনি। কিন্তু দেখ, যখনই মায়ের মুখ থেকে শুনেছি এটা অন্যায় এবং অপরাধ, তখন থেকে আর এ কাজ করিনি। আর কাজী নজরুল ইসলামের তো বাবা মা কেউই ছিলনা। তাকে বোঝাবার মত অভিভাবকও তার ছিল না। কিন্তু তাকে আল্লাহই কি অসাধারণ জ্ঞান দান করেছেন ! এখন তোমরাই বল, তোমরা যদি এ পাখির বাসাটা আমাদের চোখের আড়ালে ভাংতে বা পাখিটাকে খেলার ছলে মেরেই ফেলতে আমাদের কিছু বলার ছিল না। কারণ আমরা জানতাম, তোমরা না জেনেই তা করেছ। আরো সবচে বড় কথা তোমাদের এ যুগের মত এত মিডিয়া তখন ছিলনা বলে আমরা জানতামই না যে এটা অপরাধ। কিন্তু এ যুগে তোমরা তো হরহামেশাই জানছো যে বন্য প্রাণী, পশু পাখি নিধন আইনত অপরাধ। এবার তোমরাই বল, জেনে শুনে কেন অন্যায় করতে চাচ্ছ ? ছোটটা জিহ্বা বের করে বলল, এই যা ! এ কথাতো মনেই ছিলনা। এইতো সেদিন টেলিভিষনে কথাটা শুনেছিলাম। দুই ভাই তখন লজ্জা পেল।
সরি, বাবা, আমাদের ভুল হয়ে গেছে।
-ঠিক আছে, ঠিক আছে। এটা তোমাদের ভুল না। প্রত্যেক মানুষের মধ্যেই নিষিদ্ধ কিছু আনন্দদায়ক কাজ করার জন্য একটা লুকানো প্রবৃত্তি প্রেরণা যোগায়। সৃষ্টির এটাই নিয়ম। এরকম ভুল শয়তানের ওয়াসওয়াসায় বিবি হাওয়া করেছিলেন। সে ভুলের কারণে কিন্তু আমরা এই পৃথিবীতে। মানুষের দায়িত্ব হচ্ছে সেই প্রবৃত্তিকে অনিচ্ছা স্বত্তেও দমন করা। একারণেই আমরা সৃষ্টির সেরা জীব। বুঝলে ?
এত গভীর তত্ব কথা বোঝার মত জ্ঞান তাদের হয়নি। তবে ওরা ঘাড় নেড়ে ওদের অবুঝ সমর্থন জানালো।
- আর একটা কথা। পাখিটা ডিমে তা দিচ্ছে। বার বার ব্যালকনিতে যেওনা। তাতে সে ভয় পেয়ে উড়ে যাবে । এতে ডিমগুলো নষ্ট হয়ে যাবে, বাচ্চা ফুটবেনা। পাখিটা তখন খুব কষ্ট পাবে । ঠিক কি না ?
আচ্ছা। আমরা অবশ্য এখন তেমন যাইনা। কিন্তু কোন প্রয়োজনে আস্তে, নিঃশ্বব্দে যাই, তার পরও সে উড়ে যায়, অথচ আম্মু গেলে উড়ে যায় না। কেন, বাবা ?
- তোমার আম্মুর প্রতি ওর একটা বিশ্বাস বা আস্থা জন্মেছে।
কেন ?
-এই কেন’র উত্তর আমার জানা নেই । এটা ঐ পাখিটাই জানে ।
প্রশ্নবোধক চিহ্নটার একটা অতৃপ্ত এবং অসমাপ্ত সমাধান নিয়ে দু’ভাই যার যার কাজে চলে গেল।