রক্তের রং সবুজ ছিল

সবুজ (জুলাই ২০১২)

এস, এম, ইমদাদুল ইসলাম
  • ১৭
অনেক ধাক্কাধাক্কি করে শেষ পর্যন্ত থার্ড ক্লাসের একটা কামরায় উঠতে পেরেছি। অসংখ্য মানুষ একটা কামরায় ঠাসাঠাসি হয়ে চলেছি। যেমন করে হাঁস মুরগী খাঁচায় গাদাগাদি করে বাজারে আনা হয়। যাত্রীদের অবস্থা অনেকটা সেরকম। আমার জীবনে এই প্রথম এক নতুন অভিজ্ঞতা। অভ্যাসের সাথে একেবারেই বেমানান । রেল ভ্রমণ আমার জীবনে নতুন নয়। এটা আমার খুব প্রিয় একটা যানবাহন। তবে তা করেছি আব্বুর সংগে শীতাতপ নিয়ন্ত্রিত রিজার্ভ বার্থে । প্রশ্নবিদ্ধ চৌধুরী পরিবারের একমাত্র ধনীর দুলালী আমি। আমার বাবার এক হাতে সমগ্র পৃথিবী, অন্য হাতে আমি। ক'জন মেয়ের ভাগ্যে এমন সুখ জোটে ? আমার বাবার অনেক বড় স্বপ্ন । আমাকে এ্যাডিলাইড বিশ্ববিদ্যালয় থেকে এম বি এ করিয়ে আনবেন। তার বিশাল প্রতিষ্ঠানের দায়িত্ব তিনি আমার হাতে তুলে দিবেন । না চাইতেই তিনি আরো বিশাল রাজত্বের উত্তরাধীকারী একমাত্র রাজপুত্তুরের নিশ্চয়তা পেয়েছেন। আমার পিছে রূপমকে ঘুর ঘুর করতে দেখে প্রথম তিনি সহ্য করতে পারছিলেন না। কিন্তু এখন ? অনুকুল হাওয়া লেগেছে পালে । ষোল কলা পূর্ণ হতে চলেছে। হ্যা, আমি নীলা । আমার বিখ্যাত বাবার একমাত্র স্বপ্নের রাজ কন্যা। আজ সব কিছুর ইতি টেনে এসেছি। মিথ্যে আভিজাত্যের শিকল ছিড়ে বেরিয়ে এসেছি। চলেছি অজানার দেশে। আমি নতুন আবিষকৃত আমার 'আমি'কে খুঁজতে বেরিয়েছি।
মানুষের ভীড়ে এমনিতেই কামরায় কার্বনডাই-অঙ্াইডের পরিমাণ বেড়ে গিয়ে দম বন্ধ হয়ে আসছে। এরকম অবস্থায় আমার পাশেই কংকালসার এক বৃদ্ধ মেঝেতে হাটু ভাজ করে বসে বিড়ি টানছেন। নেকাবের উপর দিয়ে রুমাল চেপে ধরেছি। তবুও অস্বাভাবিক গন্ধ। অসহ্য লাগছে। তাকে দেখলে মনে হয় ঠিক যেন ল্যাবরেটরী রুমে রাখা কংকালটাতে প্রাণ বসিয়ে এখানে বসানো হয়েছে। সব মিলিয়ে আমার অবস্থা তখন আরো বেসামাল । কিন্তু সহ্য তো আমাকে করতেই হবে। বৃদ্ধ এই শরীর নিয়ে বিড়ি টানছেন আর মাঝে মাঝে এমনভাবে কাশছেন, দু'হাটুর মাঝে মাথা নুইয়ে পায়ের আংগুলের সংগে মিশে গিয়ে নিস্তেজ হয়ে পড়ছেন। ঠিক শুয়ো পোকার গায়ে আঘাত লাগলে যেমন পেচিয়ে গোল হয়ে জড় পদার্থের মত হয়ে যায়। কিন্তু কী অলৌকিক ব্যাপার ! আঘাত প্রাপ্ত শুয়ো পোকাটা কিছুক্ষণ পর আবার যেমন শরীর ছেড়ে চলতে থাকে তেমনি এই বৃদ্ধ আবার মাথা সোজা করে বিড়িতে লম্বা টান মারছেন। সে এক অদ্ভুত অভিজ্ঞতা আমার জীবনে । কিন্তু এভাবে আর কতক্ষণইবা থাকা যায় । ঘিন ঘিন করছে সমস্ত শরীর । অনেকক্ষণ পরে একটা সীট খালি হলে দপ করে বসে পড়লাম। যদিও আমার সাথে আরো কয়েকটা শরীর এসে উপচে পড়েছিল, কিন্তু ভাগ্যক্রমে সীটের উপর আমার শরীরের সংশ্লিষ্ট অংশ পুরোপরি বসে যাওয়ায় অন্যরা সরে যেতে বাধ্য হলেন। শ্বাসরুদ্ধকর এরকম এক অস্থির পরিস্থিতির সংগে জীবনে প্রথম মোকাবেলা করছি। এদিক সেদিক তাকিয়ে একটুখানি জানালার কিনারা খুঁজে ফিরছি । আমার পাশের আসনে জানালার পাশে বয়স্ক ভদ্রলোককে বললাম,
-আংক্ল, আমার শরীরটা একটু অসুস্থ্য । বমি বমি লাগছে। যদি আপনি একটু কষ্ট করে এদিকে বসেন, খুব কৃতজ্ঞ থাকব ।
বেচারা আমার কথা শুনে একটু ভ্রু-কুঞ্চিত করলেন। তার অস্বাভাবিক চাহনি দেখে মনে হল খুব বিব্রতকর অবস্থায় পড়লেন । তিনি আমার আপাদ-মস্তক খুব ভাল করে চেয়ে দেখে নিলেন । ঠিক যেন পাত্রের বাবা, পাত্রী দেখছেন। আমি তখন বোকার মত অন্য দিকে চেয়ে এ অস্বস্তিকর পরিবেশ থেকে আত্মরক্ষার চেষ্টা করলাম । গলা খাকরিয়ে আমার দৃষ্টি আকর্ষণ করলেন । ইচ্ছে হচ্ছিল না আর তাকাই ওদিকে। অনিচ্ছা স্বত্তেও একবার চোখ পড়ল। চশমাটা নাকের উপরে আর একটু ঠেলে অনেকটা মনের বিরুদ্ধেই উঠে দাঁড়ালেন এবং আমাকে জানালার পাশে বসার জন্য বললেন। আমি বললাম,
-থাক, আংক্ল, এখন আর আমার কষ্ট হচ্ছে না। আপনাকে কষ্ট করে উঠতে হবে না।
তেতুলে বিচির মত বড় বড় আঁকা বাঁকা দাঁতগুলো খিঁচিয়ে বলে উঠলেন,
নেও, আর ভদ্দোন্নকী দেকাতি অবে না, যাও ঐধারে যাইয়ে বস ।
-থাক না, আংক্ল , আপনাকে কষ্ট করতে হবে না।
চোখ বড় বড় করে আমার দিকে তাকিয়ে রেগে গিয়ে বললেন, যাও, ঐ ধারে ?
হন্ত দন্ত হয়ে সরে বসলাম । উনি এ পাশে এসে বসলেন । আর ফিরে তাকালাম না। জানালার সাথে হাতটা ঠেকিয়ে মাথা কাত করে তাকিয়ে আছি দূর দিগন্তে । শহরের আলোর ঝলকানী দূরে ফেলে এসেছি আরো অনেক আগেই। গভীর অন্ধকারের বুক চিরে রেল রাজা বীর দর্পে চলছে। ঝিগ--ঝাগ , ঝিগ--ঝাগ, ঝিগ--ঝাগ। যতদূর দৃষ্টি যায় তারার মত মিট মিট করে প্রদীপের আলো জ্বলছে আর নিভছে। অন্ধকারের যে এত রূপ তা আগে কখনো এমন করে দেখার সৌভাগ্য হয়নি। কিছুক্ষণ চলার পর হঠাৎ গতি মন্থর । মাথাটা আরো একটু বাইরে বের করে সামনে তাকিয়ে দেখলাম গোল একটা লাল বাতি জ্বলছে। বুঝলাম , স্টপ সিগনাল ।
রেল লাইনের ধার ঘেসে নানা রকম গাছ পালা । মৃদু বাতাসে দুলছে। ঘুটঘুটে অন্ধকারে বাতাসে বিরতিহীন সুরের ঝংকার । নানা রকম সুরের সংমিশ্রণ। ঝি ঝি পোকার ডাক ? হ্যা, ঝি ঝি পোকার ডাকই তো। এটা বাবার কাছে শুনেছি। আর গল্পে পড়েছি। শহরে এরকম সুর-ঝংকার শোনার সৌভাগ্য হয়নি। তো, সে সুরের তালে তালে গাছের পাতার দোল মিলে মিশে এক হয়ে এমন একটা পরিবেশ সৃষ্টি হয়েছে যে, গাছগুলোকে মনে হচ্ছে গল্পের পেতি্নর দল । মাথা দুলিয়ে দুলিয়ে নেচে গেয়ে আমার দিকে ছুটে আসছে। হঠাৎ যেন মনে হল একটা পুলিশ ভ্যান আমার খুব কাছে এসে পড়েছে এবং শেষ পর্যন্ত তাদের অভিযান সফল হয়েছে। আমার চোখের সামনে হ্যান্ডকাপ ঝুলিয়ে দোলাচ্ছে। আর দাঁত কেলিয়ে হাসছে। একটু চমকে উঠলাম । আবার সহজ হলাম । না, না, পুলিশ আমাকে খুঁজে পাবে না। কেউ তো জানেই না, আমার গন্তব্য কোথায় ?
এখন আর আমার বুক একটুও কাঁপছে না। যখন পর পর ছ'টা গুলি করেছি, তখনও কেন জানি না, আমার এতটুকু ভয় করে নি। কিন্তু লাশটা ফেলে রেখে যখন দরজা লক করে গেইটের বাইরে চলে এলাম, তখন থেকে আমার বেশ ভয় হচ্ছিল । শীতল হয়ে গিয়েছিলাম। নেকাব সহ একটা বোরকা কিনলাম । চট করে আবৃত করে নিলাম। অভ্যাস না থাকায় কষ্ট হচ্ছিল, কিন্তু উপায় নেই। এখন অবশ্য আর সেরকম ভয় করছে না। ইস্ ! রেলটা যদি পাখি হত , খুব ভাল হত। খুব দ্রুত আমার দাদীর কাছে চলে যেতাম । জানি না, দাদী আর বেঁচে আছেন কী না। কি জানি, কখন যে রেলটা আবার প্রাণ ফিরে পাবে। এসি বার্থে যখন ভ্রমণ করতাম তখন বাবার কোলে মাথা রেখে ঘুমের রাজ্যে চলে যেতাম । সময় কখন যে গড়িয়ে যেত, বুঝতেই পারতাম না। কিন্তু এখন যে আর সময়ের চাকাটা ঘুরতেই চাইছে না। থমকে গেছে।
দাদী নামের কোন সম্পর্ক যে পৃথিবীতে আছে এটাই আমি জানতাম না। মায়ের লেখা ডায়রীটা আমার হাতে না এলে সব থেকে যেত অজানা। আমি হতাম আমার বিখ্যাত বাবার স্বপ্নের রাজকন্যার পরিণত রূপায়ন। আবার মিথ্যার রাজত্ব, প্রবঞ্চনা, প্রহসনের জগত গড়ে উঠবে ! আমার দ্বারা আরো অবাঞ্চিত প্রজন্ম এ জমিনে সৃষ্টি হবে ! যারা হবে তাদের যুগের কল্পিত রাজপুত্তুর, রাজকন্যা ? না, না, যখন জেনেই গেছি সব, তখন তো আর তা হতে দেয়া চলে না। এখন অবশ্য মনের মধ্যে এতটুকু হলেও ভাল লাগছে- আমি সেই কুৎসিৎ প্রজন্মের আগমনের পথ রুদ্ধ করতে চলেছি। মা বেঁচে থাকতে আমাকে অনেক খিচুই বলতে চেয়েছিলেন, কিন্তু আমি তো তখন খুবই ছোট। অত ছোট বেলার কথা আসলে মনে করা কারো পক্ষেই সম্ভব না।
আমার পূর্ব পুরুষের যে পরিচয় আজ আমার জীবনে সত্য হয়ে দাঁড়িয়েছে তা জানার পর থেকে আমার প্রতিটা রক্ত কণিকায় সুনামী বয়ে যাচ্ছে। আমার সমস্ত শীরা উপশীরা সে বিষাক্ত ঢেউয়ে ছিন্নবিচ্ছিন্ন হয়ে গেছে। আমি আমার দিকে তাকাতে পারি না। ঘেন্নায় বমি আসে। বাবার সংগে নিজেকেও শেষ করে দিতে চেয়েছিলাম, কিন্তু কেন জানি না, ঐ মুহুর্তে দাদীর কথা মনে হল। মায়ের লেখা পড়ে মনে হল উনি হয়তো এখনো বেঁচে আছেন। দাদীকে খুব দরকার । নিশ্চই আরো অনেক ঘটনা দাদীর জীবনে রয়েছে । যার সবটুকু মা জানতেন না। আমাকে জানতেই হবে । সব কিছু। আমি একটা সত্যকে যতটুকু সাধ্য পরিপূর্ণরূপে দুনিয়াতে প্রতিষ্ঠিত করে আমার এ পংকিল জীবনের যবনিকা টানতে চাই।
রুপনগর গ্রামে আসতে পরদিন সকাল দশটা বেজে গেল । যতদূর দৃষ্টি যায় কেবল সবুজের ঢেউ। মাঝে মাঝে সবুজ জমিন থেকে কিছুটা পাহাড়ের মত উঁচুতে দু'একটা বসত বাড়ি ছাড়া তেমন কাউকেই দেখা যাচ্ছে না। অনেক দূরে দু'একজন কৃষককে জমিতে কাজ করতে দেখা যাচ্ছে। কোন দিকে যাই ? কিছুইতো আমার চেনা জানা নাই । শুধু জানা আছে দাদী আর বাবার নাম। কিন্তু কে চিনিয়ে দেবে ? কিছুদূর হেটে লোকালয় পাওয়া গেল। যাক, একটু স্বস্তি পেলাম। কিন্তু বিড়ম্বনাও কম পোহাতে হল না।
গ্রামের পথে আমার মত একজন তরুনীকে দেখে সংগত কারণেই অনেক কৌতুহলী নজর এড়াতে পারি নি। কেউ কিছু বলছেন না, তবে সবারই চোখ বলছে অনেক কথা । মুরুব্বী গোছের একজন বললেন,
মা, তোমার বাড়ি কোহানে ? কার বাড়ি যাবা ?
আমি ভরসা পেলাম ।
-জি্ব , খাদিজা বেগমকে চেনেন ? উনার বাড়ি যাব ।
খাদিজা ? ( মাথা চুলকালেন ) খাদিজা বেগম নামে তো এ গিরামে কেউ নাই । উনি কি অয় তোমার ?
-আমার দাদী ।
তোমার দাদার নাম কি ?
-আমি জানি না। শুধু দাদীর নাম জানি ।
হায়রে, কী জামানায় আইসে পড়ছি রে আল্লা ! এহন আর মান্ষি দাদার নাম মনে অরতি পারে না। ও, মা, তয় তোমার বাপের নাম কি ?
-খলিলুর রহমান । খলিল ।
দেখতে দেখতে আবাল-বৃদ্ধ-বনিতা ভীড় জমে গেল। কৌতুহলী অনেকের ভীড়ে একজনের দিকে তাকিয়ে বললেন,
অ, মোকছেদ, আমি তো চিনতি পারতিছি ন্যা । খলিল কিডারে ? আমাগে গিরামে খাদিজার ছাওয়াল খলিল কিডা , চিনিস ?
ঘুরে ঘুরে আমাকে এমনভাবে দেখছে, মনে হচ্ছে আমি চিড়িখানায় আনীত কোন দুর্লভ প্রাণী। কেউ কেউ খুব উস্ খুস্ করছে- নেকাবের ভেতরের বসত্তটাকে পরিপূর্ণভাবে দেখবার জন্য।
মোকছেদ খুব দ্রুত বলে উঠল । সেই কানী বুড়ি ? খোদেজা নাম ?
ও , খোদেজা ? উনি তোমার দাদী ? তা উনার সে কুলাংগার ছাওয়ালের নাম তো কালু । তুমি যে কইলে খলিল ?
-হ্যা, দাদী উনাকে কালু বলে ডাকতেন। কোথায় আমার দাদীর বাড়ি ?
মুখ ঘুরিয়ে খুব জোরে মাটিতে থু - থু ফেললেন, আমার দিকে এবার একটু অন্য নজরে তাকালেন ।
মোকছেদ, অরে বুড়ির কাছে নিয়ে যা। তয়, মা বড় দেরী অইরে আইছ। বুড়িতো তোমার বাপের জন্যি কানতি কানতি কানা অইয়ে গেছে। এহন বিছ্যানে পইড়ে থাহে। দেহ, তুমারে চিনথি পারে কি না।
কৌতুহলী সবার মধ্যে কালুকে যারা চেনেন তারা আমার দিকে আর একটু বাঁকা চোখে চেয়ে কেউবা থু থু ফেলতে ফেলতে , কেউবা মুখ ঝামটা দিয়ে প্রস্থান করলেন । সেটাইতো স্বভাবিক । সংগত কারণেই এ আচরণে আমার যেভাবে রিএ্যাক্ট করার কথা, আমি তা করতে পারছি না। বরং আমার বাবার নাম শুনে এদের এ আচরণ তাকে খুন করার যৌক্তিকতাই ইংগিত দিচ্ছে। সবার ঘৃণায় আমি বরং ভেতরে ভেতরে অনেক ভরসা পাচ্ছি । যে সব বাচ্চারা আমাকে নতুন দেখছে তাদের চোখগুলো তখনো আমাকে ঘিরে অনেক প্রশ্ন খঁূজে ফিরছিল। আমি বোকার মত ওদের দিকে তাকিয়ে নিজেকে নতুনরূপে আবিষ্কার করছি।
কয়েকজন যুবক কালু মিয়া নামের লোকটাকে তার মেয়ের সামনে অবজ্ঞাসূচক কথা বলাটা পছন্দ করেনাই। বোধ করি একটু হিরো হবার সাধ জেগেছিল মনে । বাবাকে কুলাংগার বলায় আমি কতটা চটে যাই তার জন্য অপেক্ষা করছিল । কিন্তু আমাকে নির্লিপ্ত দেখে তারা তাদের প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করতে পারছিল না । কিছুটা ভয়ও তারা পাচ্ছিল। আমাকে হয়তো বড় মাপের কোন ক্যাডার মনে করছে তারা। যারা অন্ধকারে কাজ করে তারা সাধারণত হঠাৎ চটে যায় না। তবে সাহস করে একজন বলল, আপনার বাবাকে কুলাংগার বলল, আপনি কিছু বললেন না যে ?
-তাই বুঝি ? খুব লেগেছে আপনার ? আপনি যখন শুনলেন, তখন কেন প্রতিবাদ করলেন না ?
না, মানে আপনর বাবাকে----- আর আপনি কিছু বললেন না তাই---
-ও, তার মানে আমার সাপোর্ট ছাড়া আপনার কোন সাহসই হল না। তো ? মিঃ বীর পুরুষ । কী আর করা , যান, নিজ কাজে মন দিন। আর একটা কথা শুনুন, আমি যতদূর জানি , গ্রামের মুরুব্বীজনেরা তাদের সন্তানদের উপর রেগে গেলে বা অভিমান হলে এধরনের শব্দ ব্যবহার করে থাকেন। যিনি বলেছেন, তিনিতো আমার বাবার বাবা- আই মিন, দাদুর মতই , তাই না ? আমার বাবা এ গ্রামের মানুষ, অথচ তিনি কোনদিন গ্রামে আসতেন না। তো, উনার এতে অভিমান হতেই পারে । তা এতে রিএ্যাক্ট করার কি আছে ?
যুবকটা লজ্জায় সংকুচিত হয়ে গেল। আর একটা কথা না বলে বিদেয় হল । মোকছেদ নামের লোকটা আমাকে দাদী বাড়ি পর্যন্ত এগিয়ে দেয়ায় তাকে ধন্যবাদ জানিয়ে বিদেয় দিলাম ।
খেজুর পাতার ছাউনি আর শুকনো কলাপাতার বেড়া বেষ্টিত জরাজীর্ণ ছোট্ট একটা ছাপড়ার ভেতর শতচ্ছিন্ন কাথা জড়িয়ে একটা নিথর , নিস্তেজ দেহ পড়ে আছে। রেলে দেখা সেই কংকালসার মানুষটার মত। ঘরের ভেতরের দিকে মাথা। বাইরের দিকটাতে পা। পাশে একজন লোক বসার মত সামান্য কিছু স্পেস আছে। কিছুক্ষণ মৌণ হয়ে দাঁড়িয়ে আছি দাদীর পায়ের কাছে। অতবড় একজন এলিট, তথাকথিত সমাজসেবী, দানবীর, প্রভাবশালী এবং গৌরবময় আভিজাত্যের প্রতীক খলিলুর রহমান চৌধুরীর গর্ভধারিনী মা। এই তার অবস্থা ! এই মাকে তিনি তাদের গ্রামের সবচেয়ে প্রভাবশালী অভিজাত চৌধুরী বাড়ির কাজের বুয়া বলে পরিচয় দিয়ে দারোয়ান দিয়ে গলা ধাক্কা মেরে বের করে দিয়েছিলেন ? চোখের সাগর উথলে উঠছে। বুকের ভেতর বয়ে চলেছে সাইক্লোন । রক্তের কণায় কণায় বয়ে যাচ্ছে সুনামী । মুখে ফুটছে না কোন ভাষা। আবেগে, উচ্ছাসে জড়িয়ে যাচ্ছে সব । এভাবে অনেক্ষণ কেটে গেল । যখন চেতন হল, দেখি অসংখ্য মহিলারা ভীড় করে আমাকে দেখছেন। একজন দাদীর কানের কাছে মুখ লাগিয়ে বলছেন,
অ --বুড়ি মা, দেহ, তোমার নাতীন আইছে । দেহ দি, উইঠে কি এট্টু বসতি পার বা নে ?
নিথর দেহটা হালকা একটু নড়ে উঠল। অনেক কথার মাঝে নাতীন শব্দটা হয়তো তাকে কিছুটা জীবন্ত হতে সাহায্য করল । অতি কষ্টে কন্ঠ দিয়ে স্বর বের হতে চাইছে।
এরকম অবস্থায় আমি নিজেকে সামলে নিয়ে বললাম,
-প্লীজ, আপনারা উনাকে জোর করে উঠাবেন না। উনি যেখানে আছেন, থাক । আমি উনার মাথার কাছে যেয়ে বসছি । আপনারা একটু সরে আসেন। আচ্ছা, এখান থেকে ভাল ডাক্তারখানা কত দূর ?
আরে, মা । সে অনেক দূর । তয় আমাগে পাশের গিরামে একজন ডাকথার আছে , তারে ডাইহে আনা যাবেনে। তুমি আগে আত মুখ ধুইয়ে চাইরডে খাইয়ে নেও। তুমার দাদীর তো কেউ নাই। আমরা পাশের বাড়ি থাহি। নিজিরা যা খাই, তারতে তুমার দাদীরে খাওয়াই । কি অরব, বাইচে যহন আছে , তারে তো আর না খাইয়ে মাইর্যা ফেলাতি পারি না। তুমি আইছ মা, খুব বাল অউছে, যদি বুড়িরে এট্টু বাঁচানো যায় ।
-প্লীজ , কাউকে একটু পাঠিয়ে দিন না । আমি টাকা দিচ্ছি।
টাহা লাগবেনানে মা। ও ছাদেক, অছেকরে ভ্যান নিয়ে ডাক্তাররে আনতি যাতি ক' । তাগেদা যা ।
ছাদেক বিদ্যুত গতিতে দৌড়ে চলে গেল।
এতক্ষণ পর আমার কথা শুনে খেলা ফেলে কৌতুহলী বাচ্চারাও দৌঁড়ে এসে ভীড় জমালো।
এ, সবাই আয়, আয় -- দেইহে যা, এহন কথা কচ্ছে ।
অনেক্ষণ নিরবে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে বাচ্চারা আমাকে একটা নির্জীব জড় পদার্থের মত মনে করেছিল।
-মনে অয়, বোবা, কথা কথি পারে না।
ফট করে আর একজন বলল,
এই , না, বোবা না। জলু দাদাবাইর সাথে কথা কথি শুনছি ।
-তা' লি পাগলী অতি পারে । দূ---উ---র , চল যাই, খেলি ।
ওরা আগন্তক সম্পর্কে কৌতুহল দমন করতে না পারার স্নায়ুচাপে ক্লান্ত হয়ে আশে পাশেই খেলায় মেতে ছিল।
আমি দাদীর মাথার কাছে যেয়ে বসলাম । একজন আমাকে একটা পরিস্কার চাদর এনে বিছিয়ে দিতে চাইলেন। আমি ইশারায় তাকে থামিয়ে দিলাম । আরো কিছুক্ষণ দাদীকে দেখছিলাম। মুখের চামড়ার ভাজগুলোর ফাঁকে ফাঁকে তার অপরূপ রূপের যাদু দেখছিলাম। কত রূপ ছিল আমার দাদীর ! এ জন্যই বাবার চেহারাও--- । আর এদের দুজনের জিনগুলোকে মিঙ্্ড করে সৃষ্টি কর্তা অনেক উন্নত মানের ডিজাইন করে আমাকে সাজিয়ে পাঠিয়েছেন রূপমদের মত মানুষদের বিভ্রান্ত করার জন্য? যেমন বিভ্রান্ত হয়েছিলেন আমার মা ? অতি কষ্টে আবেগকে দমন করলাম ।
দাদী, দাদী, আমি তোমার কালুর মেয়ে । চেয়ে দেখ ।
দাদী এবার আর একটু প্রাণ ফিরে পেলেন বলেই মনে হল । আমি আর একটু পাশে ঘেষে বসলাম । নিভু নিভু দুটো চোখ। কোটর থেকে বের হতেই পারছে না। অতি কষ্টে একটু তাকালেন । কিন্তু দৃষ্টি তো নেই । কোনরকম হাতটা উঠাতে চেষ্টা করলে আমি ধরে আমার মাথার উপর রাখলাম । কন্ঠ থেকে হাল্কা আওয়াজ এল । কিডা রে --- কালূ ?
-দাদী, আমি তোমার কালুর মেয়ে । আমার নাম নীলা । তুমি শুনতে পাচ্ছ ?
কালু কোহানে ? কালু আসি নেই ?
ডুকরে কেঁদে উঠলাম ।
এই হল মা । এই হল মা জাতির চরিত্র । ওরকম একটা কুসন্তানের জন্যও যে মায়ের নাড়িতে টান দেয়, তাকে বুকে টেনে নেবার জন্য মৃতু্য শয্যায়ও যে মা প্রতীক্ষায় থাকেন, তা কেন এসব কুলাংগাররা বুঝতে পারে না ? কেন তাদের মিথ্যে আভিজাত্যের রং সং দেখাতে যেয়ে গর্ভধারিনীকে কাজের বুয়া বানিয়ে রাখে ? হে খোদা, এ তোমার কেমন বিচার ?
-দাদী, আমাকে তুমি ছুঁয়ে দেখ ।
দুর্বল হাতটা দিয়ে আমাকে তার বুকে টেনে নিলেন। আমি দাদীর বুকে মাথা রেখে অঝরে বুক ভাসিয়ে দিলাম । আজ কতকালের জ্বালা এক সাগর পানিতে ভিজে শীতল হল ।
সান্তনা দিয়ে মায়ের মত একজন বললেন, মা, আগে চাইরডে খাইয়ে নেও। না অলি তো অসুস্থ্য অইয়ে পড়বানে। তুমি অসুস্থ্য অলি তুমার দাদীরে সুস্থ্য অরবেনে কিডা ?
আর একজন মহিলা চাপা কান্না বিজড়িত কন্ঠে বললেন,
ছোটন , এহন অ'রে খাতি কইসনে । অ'রে কান্তি দে। কাইন্দে বুকটা খালি অলি তার পরে ও খাতি পারবেনে ।

ইউনিয়ন পরিষদের স্যাটেলাইট ক্লিনিকে সরকারী ডাক্তাররা তাদের ইচ্ছার বিরুদ্ধেই মাসের কয়েকটা দিন থাকেন। ভাগ্য ভাল তাকে পাওয়া গেল। অছেক খুব দ্রুত ভ্যান চালিয়ে এক রকম জোর করেই ধরে আনল। সদ্য পাশ করা ডাক্তার । নতুন এসেছেন চাকরীর খাতিরে। জয়েন না করলে চাকরী বাঁচে না, তাই । নাহলে এ অজ পাড়া গায়ে থাকতে কার মন চায় ? মনের বিরুদ্ধেই তার এখানে আসা। রোগীকে দেখলেন। নিরবে একটা ইনজেকশন দিলেন। বললেন,
-দেখুন, যখন শুনেছি উনার বয়স আশি বা নব্বই তখনই আমি কিছু ব্যবস্থা পত্র নিয়ে এসেছি। এ বয়সে যতদিন বেঁচে থাকবেন তাতে এসব ওষুধে তেমন কোন কাজ হবে না। কিছুটা আরাম বোধ করবেন । তবে আরো ভাল কমফোর্টবল রাখতে চাইলে উনাকে কোন ভাল উন্নতমানের ক্লিনিকে ভর্তি করাতে হবে। এ ছাড়া উনার জন্য আমাদের চিকিৎসা ব্যবস্থায় আর কোন পথ নেই।
আপনার ফি ?
-সরকারী ডাক্তার । নো ফি । থ্যাংকস ।
কিন্তু সে তো সরকারী চিকিৎসালয়ে । এখানে তো ----
-কী আর করা, এটাতো ডিউটি টাইম । আমরা অনুমোদন পাই বিকাল ৫ টার পর । নিজের চেম্বারে। অতএব, চলি । আর হ্যা, খুব দ্রুতই উনাকে নিয়ে যেতে পারলে ভাল হয় ।
অনেক ধন্যবাদ । আমি আজই উনাকে নিয়ে যাব।
দ্রুতই সিদ্ধান্ত নিয়ে নিলাম। রাত আটটায় ফিরতি ট্রেন। ক্ষণিকের অতিথি হয়ে এখানে এসে গ্রামের অনেক ভালবাসায় সিক্ত হলাম। সে এক অন্য রকম অনুভূতি। শহরে কোন মূল্যে এরকম অকৃত্রিম ভালবাসা পাওয়া সম্ভব না। আমার জীবনে এত আনন্দ আর কোনদিন আসেনি। লোভ হচ্ছে খুব। বেঁচে থাকার স্বাদ জাগছে। নিজের জীবনটাকে এদের মাঝে বিলিয়ে দিয়ে মানবতার ঝান্ডা হাতে বড় কোন দায়িত্ব নেবার ইচ্ছা জাগছে। এখানকার প্রতিটি চরিত্রের মধ্যে লুকানো রয়েছে অফুরন্ত নিঃস্বার্থ ভালবাসা। কিন্তু ভাবছি, এমনই গ্রামের আলো বাতাসে যার জন্ম হয় সে এত জঘন্ন হয় কীভাবে ?
ভ্যান চালক অছেক একটা টাকাও নিতে চাইল না। জোর করে তার জামার পকেটে পাঁচশ' টাকার একটা নোট ঢুকিয়ে দিলে সে লজ্জায় নুইয়ে পড়ল ।
অনেকগুলো অশ্রুসিক্ত নয়ন আমাকে নতুন জীবনের পথে যাবার জন্য বিদেয় দিল।
স্কয়্যার হাসপাতালে ভর্তি করালাম। আমার একাউন্টে ২ কোটি টাকা ফিঙ্ড ডিপোজিট করা আছে। কিন্তু সেটা ভাংগাতে গেলেই যদি পুলিশের হাতে ধরা পড়ি , তাহলে দাদীর চিকিৎসার কি হবে ? কোন কিছু ভাববার সময় নেই । যা হয় হবে।
বোরকা আর নেকাব আমাকে অনেকটা হেল্প করছে। আর ব্যাংক একাউন্ট এর বিষয় বাবা ছাড়া আর কেউ জানে না, তাই বোধ হয় সহজে পার পেলাম । গ্রামের ইয়ং ডাক্তার যা বলেছেন, এরাও একই কথাই বলছেন। তবে বিভিন্ন রকম টেষ্ট রেজাল্ট অনুসারে ব্যবস্থা নিতে পারায় দাদীকে কিছুটা সতেজ করে তোলা সম্ভব হয়েছে। এটাই আমার জন্য যথেষ্ট। চোখে কর্ণিয়া সংযোজন করলে কোন কাজ হবে কী না সে পরীক্ষার ফলাফল আজ এসে গেছে। হতাশ । না, আর রিকভারী করা সম্ভব না ।
-দাদী, তুমি বলত, আমি দেখতে কার মত হয়েছি ?
হয়, জানি তো। তুই তোর বাপের চেয়েও সুন্দর ।
-না দাদী, আমি তোমার চেয়ে বেশী সুন্দর না, তুমি আমার চেয়েও বেশী সুন্দর ।
একটা দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে দাদী ডুকরে কেঁদে উঠল। এ রূপই তো আমাগে জীবন শ্যাষ অইরে দেছে রে বু---- ।
-দাদী, এভাবে কেঁদ না। আমি জানি ।
না, তুই কিছু জানিষ না। শোন ।
-হ্যা, দাদী , তোমার সব কথা শুনব বলেইতো আমি এখনো বেঁচে আছি। তবে তুমি এভাবে তোমার বুকে প্রেসার দিয়ে কথা না বলে আস্তে আস্তে সব কথা আমাকে বল ।
আমার বাপ মানষির জমি বর্গা নিয়া চাষাবাদ অরত। মা আর আমাগে দুই বাই বুন নিয়্যা এই গিরামে সুহি শান্তিতি ছিলাম। গাংগে সব জমি জিরাত ভাইংগা গেলি আমরা অভাবে পইড়ে গেলাম। বাইডা কলেরায় মইরে গেল। সে শোগে আমার মা বাপ দুইজনই দুনিয়াত্থে চইলে যাইয়্যা আমারে এল্লা ফেলাইয়্যা গেল। ঐ চৌদরী(চেীধুরী) আমারে তাগে শহরের বাড়ি নিয়্যা গেল। তাগে বাড়ির কাজ কাম অরতাম। সব শ্যাষ অরল আমার এই চেহারা। তার চোখ পড়ল আমার দিক। আমারে চাকরী দিবার নাম অইরে আনল তার বাগান বাড়ি। সেহানে সে মদ খাইয়ে মাতলামী অরত , আর আমারে-- । (বলেই আবেগে খত খত করে কে দিলেন) খালি কি তাই ? ওই (হা-- ?) বাচ্চারে তার চামচারা আরো মদ গিলাইয়্যা বিউশ অইর্যা থুইয়্যা পেত্তেকদিন ওরা কয়জনে মিল্যা আমারে শিয়েল , কুইত্তার মত ছিইড়ে খাইছে। আর এই হানেই তোর বাপের জন্ম । তুই এসব শুইন্যা সইজ্য অরতি পারবি নি ?
-সহ্য করব বলেইতো বেঁচে আছি দাদী, তুমি বল।
এত কানলি, বুক ব্যাথা অয়ে যাবে নে। থাক--
-না, দাদী । আমি আর কাঁদব না, তুমি সব কিছু বল । আমি অনেক কিছু জানি। মা যা কিছু জানতো. সব কথা বলে গেছে আমাকে। কিছু জানতে বাকী আছে, তোমার কাছে সব শুনব বলেই তো আমি --- তুমি বল ।
তোর বাপ যে কোন কুইত্তার জন্ম তা আমি বুঝতি পারি নাই । অনেক কষ্টে একদিন তোর বাপরে নিয়্যা পলাইয়্যা গেলাম যশোর। এট্টা বস্তিতি থাকতাম । ইচ্ছে ছেল সব ভুইলে তোর বাপরে লেহা ফড়া শিহেব। এক ক্লাস ফড়ছেল। কিন্তু জাউরা রক্ত । ঘরে থাহে না। অর চেহারা এত সুন্দর ! যে দ্যাহে সে কয়, এরহম এট্টা ছাওয়াল বস্তিতি ? কার ছাওয়াল ? অর চেহারার জন্যি আমারে কত মানষি যে দেখতি আইছে তার হিসেব নাই । আমি অর মুুহির দিক চাইয়্যা পড়লি চেহারাডা যহন দেহি তহন চৌদরীর মুকখান বাইসে ওঠে। ঘিন্নায় বমি আসে।
-চৌধুরী কি বেঁচে আছে ?
-না। শুনছি বছর তিনিক আগে না কি সে মইরে গেছে। তয় তার আওলাদ, বইনেদ, নাতী পুতারা অনেক বড় নামী দামী মানুষ অইছে। ঢাহায় থাহে, বিদ্যাশে থাহে । চৌদরীর খুলনার যে বাড়িডায় আমারে নেছেল । সেহানেই ওরা পেত্তেক বছর নাকি ঈদীর নামাজের সুমায় আসে।
শোন তোর বাপের কথা । সে যহন সেয়না অল। আমারে না কইয়ে ঢাহায় গেল। শুনলাম সেহানে ও টোং দোহানে পান বিড়ি বেইচে খায়। বাল টাহা কামাই অরে।
তার পরের টুকু আমি জানি দাদী । বাবা অনেক কৌশলে কিছু চটকদারী কথা রপ্ত করেছিল। নিজেকে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় থেকে এম এ পাশ বলে চালিয়ে দিয়েছিল। ঢাকায় এসেছেন চাকরীর জন্য। ব্যাস, এই তার পরিচয় ? আমার বাবার চেহারা দেখে আমার মা পাগোল হয়ে গিয়েছিল। অত বড় একজন আর্মী অফিসারের মেয়ে , ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ত আমার মা। সেই মা এত বোকা হল কী করে , তা আমার বুঝে আসে না। আমার নানাভাই বলেছিল, সব খোঁজ নিয়ে তার পরে সিদ্ধান্ত নিতে। কিন্তু মা পাগলামী করল। আমার নানা অবশ্য পরে যখন সব জানতে পেরেছিল তখন আমার বয়স তিন মাস। আমার বাবা তার পর কি কি করেছে তাতো তুমি জান না দাদী । আমার মা সব লিখে রেখেছেন এ ডায়রীতে। তার অনেক লোভ ছিল টাকা আর নারীর প্রতি। মার হাতে যখন সব ধরা পড়ে গেল তখন মায়ের মুখ বন্ধ করতেই বাবা মাকে গলা টিপে মারতে চেয়েছিল। সেই থেকে মা প্যারালাইজ্ড আর বধির হয়ে গেল। বহুদিন বিছানায় পড়ে থেকেছে আমার মা। আমাকে ইশারা ইংগিতে অনেক কিছু বলতে চেয়েছেন। আমি খুব ছোট। কিছু বুঝতাম না। আমাকে এ ডায়রীটা খুব গোপনে দেখাতেন। আর বলতেন বড় হয়ে এটা পড়তে। কেউ যেন না জানে। এর পর মা মারা গেলেন। আমিও শৈশব কৈশোর পেরিয়ে গেলাম। কলেজে পা রাখলাম । মায়ের স্মৃতী ভুলে গেলাম। বাবা আমাকে মায়ের আদর বাবার স্নেহে বড় করে তুললেন। তিনি সমাজের একজন নাম করা লোক । অসাধারণ মিষ্টি তার আচার-ব্যবহার। সবাই তাকে খুব ভালবাসেন। সমাজসেবী দানবীর হিসেবে খুব নাম ছড়াল বাবার । এভাবেই সমাজের একজন উচ্চবিত্ত ধনীর দুলালী হিসেবে আমি বেড়ে উঠছিলাম। কিন্তু হঠাৎ আমার আলমীরা থেকে এই ডায়রীটা পড়ল। আমি এটা তুললাম। কয়েকটা পাতা পড়েই আমার মাথা ঘুরে গেল। মায়ের কথা মনে করার চেষ্টা করলাম। কিছূ মনে করতে পারলাম না। তবে ডায়রী পড়ে আমার জীবন পাল্টে গেল। তখন আমার মনের অবস্থা কী যে হতে লাগল, বুঝতেই পারছ। মায়ের লেখা সূত্র ধরে বাবার গোপন ব্যবসার খবর পেয়ে গেলাম। কত হাজার হাজার লাখ লাখ নারী দেহ পণ্য হিসেবে বিক্রি করেছে এই লোক , তার হিসেব কে রেখেছে ? পাশাপাশি তিনি বড় মাপের আন্তর্জাতিক মাদক ব্যবসায়ী। দেশের শাসন- ত্রাশন, আইন -কানুন, পত্র -পত্রিকা , বিবেক -বুদ্ধি - সব কিছুই মেরুদন্ড শক্ত করে চলে আমার বাবার টাকায় । বুঝলাম, এদেশের পচন ধরা শাসন ব্যবস্থা আমার বাবার মত একজন নরপশুকে শুধু লালনই করবে। সুবিচার করবে না। একদিন সুযোগ পেয়ে গেলাম। বাবা তার পিস্তলটাতে গুলি লোড করে বিছানায় রেখে ওয়াশরুমে গেলেন। পাশে একটা প্যাকেটে আরো কিছু গুলি রাখলেন। আমি কোথা থেকে যেন এক অদম্য শক্তি পেলাম । তখন আমার পরনে ছিল জিন্সের প্যান্ট । গুলির প্যাকেটটা পকেটে রাখলাম। পিস্তলটা হাতে নিয়ে ট্রিগারে আংগুল রেখে ওয়াশরুমের সামনেই রেডি থাকলাম । বাবা বের হবার সাথে সাথে তিনি কিছু বুঝে ওঠার আগেই ছয়টা গুলির সবটাই নিখুঁতভাবে একেবারে বুকের মধ্যখানেই বসিয়ে দিলাম। শুনেছি শয়তানের রক্তের রং নাকি সবুজ থাকে। বাবার বুক থেকে সবুজ রঙের রক্ত বের হতে দেখেছি বলে মনে হল।
দাদী ডুকরে কেঁদে বলে উঠল, অরে মাইরে ফেলাইছিস ?
-এর পরও কি বলবে তাকে মেরে আমি কোন ভুল করেছি ?
কি অইরে কব, বু ? ও যত খারাপ ওক, ও যে ছেল আমার নাড়ি কাটা ধন । আমার নাড়িতি যে কামড় মারে ।
-আমাকে তুমি ক্ষমা করে দিও দাদী। তুমি যতদিন বেঁচে আছ, আমি তোমার কাছেই থাকব। বল, আমাকে তুমি ক্ষমা করেছ ?
দাদী আমাকে জড়িয়ে ধরে কান্নায় ভেংগে পড়লেন ।
বেশ খানিকটা সুস্থ্য হয়ে উঠলে গ্রামে নিয়ে গেলাম। ঘরটা পাকা করে এটাস বাথরুম করে দিলাম । দাদীকে নিয়ে অনেক আনন্দে ঈদের দিনটা উপভোগ করলাম। এই দিনটার জন্য অপেক্ষা করছি। চৌধুরী বাড়িতে সবাই এ দিন মহানন্দ করছে। দাদীর কাছে শোনা তদের সবগুলো মুখ আমার চোখে ভাসছে। ওবাড়িতে হয়তোবা আমার মতই আরো কতগুলো অবাঞ্চিত জীবন সমাজের নামকরা অভিজাত বিত্তশালীর ঘরে নাম লিখিয়ে মহা সুখে আছে। ভাবতেই আমার রক্ত টগবগ করে উঠল। ঈদের পরদিনই দাদীর কাছে একজন সার্বক্ষণিক নার্স নিয়োগ করে কয়েকদিনের জন্য ঢাকায় যাব বলে বেরিয়ে পড়লাম । অনেক খোঁজ করে চৌধুরী বাড়িটা পেলাম। বেশ আলীশান বাড়ি। ভেতরে ঢুকতে দারোয়ান পরিচয় জানতে চাইলে আমি বললাম, আমি ওনাদের গ্রামের মেয়ে। ভেতরে যাবার অনুমোতি পেলাম। প্রথমেই যার সাথে চোখ পড়ল, তাকে দেখে আমি যেমন অবাক বিষ্ময়ে থমকে গেলাম, তেমনি সেও অবাক হয়ে দেখছে আমাকে।
কে তুমি ? আমার মতই চেহারা ? আমরা কি টুইন ?
আমার রক্তে আবার সুনামী বয়ে চলেছে। কোন কথার জবাব না দিয়ে মায়ের লেখা ডায়রীটা টেবিলে রেখে পিস্তলটা বের করে ওর বুকে পর পর কয়েকটা চালিয়ে দিলাম । কোন জারজ সন্তানকেই আর জারজ বৃদ্ধি করতে দেব না আমি। গুলির শব্দ আর মেয়েটার আর্তচিৎকার শুনে যারাই আসল প্রত্যেককেই আমি গুলি করে ফেলে দিলাম। আমি নিজেও আমার মাথায় ঠেকিয়ে নিজেকে শেষ করে দিব বলেই মারতে যেয়ে এক পর্যায়ে কয়েকজনের হাতে ধরা পড়ে গেলাম। ধস্তাধস্তিতে পড়ে গেলাম। গুলিটা আমার মাথায় বসাতে পারলাম না। আমি অযাচিতভাবে বেঁচে গেলাম ।
কি জানি কি কারণে মৃত্যুদন্ডটা না হয়ে বার বছরের জেল আমার জীবনটাকে জ্বালিয়ে পুড়িয়ে অংগার করে দিল। দাদীর কবরের পাশে আমার আর শোয়া হল না। অনেকদিন পর জানতে পারলাম কেইসটার পেছনে রূপমের হাত রয়েছে। খুব ঘেন্না লাগছে। এই ভেবে , রূপমও আমার মায়ের মত বোকা ?
আপনার ভালো লাগা ও মন্দ লাগা জানিয়ে লেখককে অনুপ্রানিত করুন
আবু ওয়াফা মোঃ মুফতি সুন্দর সাবলীল, ভালো লাগলো|
সূর্য চমৎকার লিখেছেন। বাস্তবে না হোক অন্যায়ের প্রতিশোধ আমরা গল্পে নিতেই পারি। রূপমের চরত্রটা প্রস্ফুটিত হয়নি তাই শেষ দিকটায় ওকে আনার দরকার ছিল না।
বহুদিন এরকম পিপাসা নিয়ে আপনাদের মন্তব্যগুলো পড়তাম । আজ আপনি আমার কাংখিত সমালোচনামূলক মন্তব্য করে সেই পিপাসার কিছুটা নিবারণ করলেন, আপনার কাছে আমি ভীষন কৃতজ্ঞ । অনেক ধন্যবাদ ।
আহমেদ সাবের সুন্দর কাহিনী। সাবলীল লেখা। বিষয়বহির্ভূত হলেও গল্পটা বেশ উপভোগ করলাম।
আপনাকে অনেক ধন্যবাদ ।
মোহাম্মদ ওয়াহিদ হুসাইন ................চমতকার একটা কাহিনী, পুরোটুকু পড়লাম, ভালই। শুভেচ্ছা রইল।
আপনাকে অসংখ্য ধন্যবাদ ।
স্বাধীন গল্পটা বড় বলে পাঠক হয়তো কম। আমার কাছে অনেক ভাল লাগল।
অনেক কষ্ট করে পড়েছেন, অনেক অনেক ধন্যবাদ ।
মিলন বনিক সত্যিই অসাধারণ একটা গল্প..হয়ত বিষয়বহির্ভূত বলে পাঠক কম..কিন্তু এত সুন্দর একটা গল্প পরে না দেখলে আরো বড় ভুল করতাম...আর একেবারে শেষের দিকের গোলাগুলির বিষয়টা অতি নাটকীয় মনে হলো..নিখুত, নিটোল বর্ণনা..
আপনার মতামতমূলক মন্তব্য খুব ভাল লাগল । আপনাকে অনেক ধন্যবাদ ।
সিয়াম সোহানূর পরিচ্ছন্ন গল্প। গ্রামীন বাস্তব চালচিত্র ফুটে উঠোছে অসাধারণ শিল্প কুশলতায় । আঞ্চলিক ভাষার ব্যবহারটাও সাবলীল । আসলে যা দুরন্ত , গতিশীল তাই সবুজ ---- । অভিনন্দন ও শুভকামনা ইমদাদুল ইসলাম ভাই। ।
আপনার মূল্যবান মন্তব্যের জন্য ধন্যবাদ ।
susmita সবুজ সংখ্যার জন্য মানানসই না হলেও মডারেশন গল্পটা দিয়ে ভুল করেননি।তা না হলে চমৎকার একটা লেখা মিস হয়ে যেত!
এস, এম, ইমদাদুল ইসলাম নিলাঞ্জনা নীল আপনাকে অসংখ্য ধন্যবাদ । তবে আপনার মাধ্যমে সকল পাঠকদের কাছে আমার বিনীত আরজ , এই গল্পটা এই সংখ্যায় প্রচার না করার জন্য মডারেশনকে অনুরোধ করেছিলাম। আসলে গল্পটা ঠিক "সবুজ" শিরোনামের সাথে মানানসই নয়। তাড়াহুড়ো করে এর নামকরণ একটা দিয়েই ছেড়ে দিয়েছিলাম। পরে ভাল করে রিভিউ করে দেখি এটার নামকরণ হবে "দায়মুক্তি" । যাহোক, মডারেশন আমার অনুরোধ রাখেন নি। এটা আমার দুর্ভাগ্য । পাঠকদের কাছে ক্ষমা চেয়ে নিচ্ছি । এ সংখ্যার শিরোনামে সবুজ নিয়ে অনেক সুন্দর সুন্দর লেখা এসেছে । পড়ে আনন্দ পাব । তবে আমার গল্পটা যারা পড়বেন, তারা এটিকে ঠিক সবুজ এর সংখ্যায় বিবেচনা করবেন না প্লীজ । আবারো ধন্যবাদ ।

২৯ অক্টোবর - ২০১১ গল্প/কবিতা: ৪৪ টি

বিজ্ঞপ্তি

এই লেখাটি গল্পকবিতা কর্তৃপক্ষের আংশিক অথবা কোন সম্পাদনা ছাড়াই প্রকাশিত এবং গল্পকবিতা কর্তৃপক্ষ এই লেখার বিষয়বস্তু, মন্তব্য অথবা পরিণতির ব্যাপারে দায়ী থাকবে না। লেখকই সব দায়ভার বহন করতে বাধ্য থাকবে।

প্রতি মাসেই পুরস্কার

বিচারক ও পাঠকদের ভোটে সেরা ৩টি গল্প ও ৩টি কবিতা পুরস্কার পাবে।

লেখা প্রতিযোগিতায় আপনিও লিখুন

  • প্রথম পুরস্কার ১৫০০ টাকার প্রাইজ বন্ড এবং সনদপত্র।
  • দ্বিতীয় পুরস্কার ১০০০ টাকার প্রাইজ বন্ড এবং সনদপত্র।
  • তৃতীয় পুরস্কার সনদপত্র।

বিজ্ঞপ্তি

“মে ২০২৪” সংখ্যার জন্য গল্প/কবিতা প্রদানের সময় শেষ। আপনাদের পাঠানো গল্প/কবিতা গুলো রিভিউ হচ্ছে। ১ মে, ২০২৪ থেকে গল্প/কবিতা গুলো ভোটের জন্য উন্মুক্ত করা হবে এবং আগামি সংখ্যার বিষয় জানিয়ে দেয়া হবে।

প্রতিযোগিতার নিয়মাবলী