অরুণোদয়ের পথে

দেশপ্রেম (ডিসেম্বর ২০১১)

নাসির আহমেদ কাবুল
  • ২৭
  • 0
  • ৫২
একাত্তরের মধ্য শ্রাবণের এক গভীর রাত। আকাশে চাঁদ ছিলো সে রাতে। মেঘে ঢাকা পড়েছিল জ্যোৎস্নার পস্নাবন। একটু আগে এক পশলা বৃষ্টিতে মেঘের আসত্দর কিছুটা হালকা হলে চাঁদের মস্নান-মূক আলো ছড়িয়ে পড়ছিলো গ্রামের পথে। যে পথ ধরে কয়েকজন পিশাচ টর্চের তীব্র আলো ফেলে পথ চলছিল দানবের মতো। ওদের সবার হাতে রাইফেল, উন্মুক্ত বেয়নেট। ওদের পায়ের শব্দে ঝিঁঝিঁপোকা আর ব্যাঙগুলোর ডাকাডাকি থেমে গেলো আতঙ্কে। নিসত্দব্ধ ভূতুরে সে পরিবেশে রাজাকাররা অশস্নীল গালাগাল দিচ্ছিলো মুক্তিযোদ্ধাদের- যাঁরা এ দেশের স্বাধীনতার জন্যে মরণপণ লড়াইয়ে মেতে উঠেছে।
ভূতুরে অন্ধকার সে রাতে কয়েকজন রাজাকার হালদার বাড়ির দুয়ারে এসে দাঁড়ালো। বাড়ির সবাই তখন ঘুমিয়ে পরলেও নিশিকানত্দ হালদার জেগেছিলেন। সন্ধ্যায় তিনি স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্রের খবরে কালুরঘাট ব্রিজের পাশে মুক্তিযোদ্ধাদের সাফল্যের খবর শুনেছেন। এম আর আক্তার মুকুলের কণ্ঠে চরমপত্র শুনে অনেকটা উৎফুলস্নও তিনি। নিশিকানত্দ সিদ্ধানত্দ নিয়েছেন, দু'একদিনের মধ্যেই তার ছেলে শিবুকে মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণের জন্য পাঠাবেন। এসব উত্তেজনার মধ্যে ঘুম আসছিলো না তার। হঠাৎ ভারি বুটের শব্দে সচকিত হলেন তিনি। আতঙ্কিত হলেন।
'এই নিশিকানত্দ, দরজা খোল'।
নিশিকানত্দের ফঁ্যাসফেসে গলা থেকে বেরিয়ে এলো, 'কে?'
রাজাকার কমান্ডার সুফি ধমকে উঠলো 'তোর বাপ, শুয়োরের বাচ্চা।'
নিশিকানত্দ সুফির কণ্ঠ চিনতে পারলেন। দ্রম্নত শিবুকে মোটা পাতার হোগলার মুড়ে ঘরের এক কোণে দাঁড় করিয়ে দিলেন। মেয়ে সুবর্ণাকে তোষকে পেচিয়ে খাটের এক প্রানত্দে সরিয়ে রাখলেন। তারপর নিশিকানত্দ ও তার স্ত্রী বলির পাঠার মতো কাঁপতে লাগলেন।
রাজাকারদের রাইফেলের বাটের আঘাত ও লাথিতে কাঠের দরজা ভেঙ্গে ছিটকে পড়লো। ঘরে ঢুকে নিশিকানত্দের স্ত্রী রমলাকে নিশিকানত্দের সঙ্গে পিঠেপিঠি বেঁধে ফেলল রাজাকাররা।
রহমান রাজাকার হুংকার দিয়ে বলল, 'এই শুয়োরের বাচ্চা শিবু কই?'
'ও তো বাড়িতে নেই স্যার।'
একজন রাজাকার রাইফেলের বাট দিয়ে নিশিকানত্দের পেটে আঘাত করলো।
'বল শুয়োরের বাচ্চা শিবু কোথায়?' আবারও হুংকার দিলো রহমান।
'সত্যিই জানি না। বিকেলে বের হয়েছে, রাতে আর ফিরে আসেনি?'
'মুক্তিবাহিনীতে গেছে?'
'না, না মুক্তিবাহিনীতে যায়নি।'
'মিথ্যে বলছিস।'
'ভগবানের দোহাই...।'
রাজাকাররা নিশিকানত্দকে টেনে-হিঁচড়ে বাইরে নিয়ে গেলো। কয়েকটি কুকুর ঘেউ ঘেউ করে উঠলো।
কমান্ডার সুফি নিশিকানত্দের বুকে রাইফেল তাক করে বলল, 'বল, শিবু কোথায়?'
'বলছি তো, জানি না।'
'শিবু কোথায় বল, নইলে কুত্তার মতো গুলি করে মারবো।'
'ভগবানের দোহাই, আমাকে মারবেন না।'
'তাহলে বল, শিবু কোথায়?'
নিশিকানত্দে দুই চোখ বেয়ে পানি গড়িয়ে পড়লো। পরক্ষণেই শক্ত হলেন তিনি। প্রাণ গেলেও কিছুতেই শিবুর খোঁজ দেবেন না বলে প্রতিজ্ঞা করলেন। নিশিকানত্দ ভাবলো, ওদের হাত থেকে দেশকে মুক্ত করতে হলে শিবুর মতো ছেলেদের বেঁচে থাকতে হবে।
'কিরে বলছিস না কেন? না বললে গুলি করে মারবো।' কমান্ডার হুংকার দিয়ে জিজ্ঞেস করলো।
'তাই করম্নন। তবু শিবু কোথায় বলতে পারবো না।'
'পারবি না?
'না।'
হঠাৎ নিশিকানত্দ কণ্ঠে এতো জোর কোথায় পেলেন ভাবতে পারলেন নিজেই।
রাজাকার ফরিদ আর সুযোগ দিলো না। নিশিকানত্দের তলপেটে প্রচন্ড জোড়ে লাথি মারলো। লুটিয়ে পড়লো নিশিকানত্দ। একটা গোঙানি দিয়ে স্থির হয়ে গেলো নিশিকানত্দের দেহ।
রাজাকাররা সুবর্ণার কথা জিজ্ঞেস করলে কিছুতেই মুখ খুললেন না রমলা।
রমলার চুলের মুঠি ধরে হেঁচকা টানে মেঝেতে ফেলে দিয়ে বুট জুতো দিয়ে গলা চেপে ধরলো রহমান রাজাকার। মুখ দিয়ে ফেনা বের হলো রমলার। রাজাকার রহমান হুংকার দিয়ে বলল, 'বল, সুবর্ণা কোথায়?'
'বাড়িতে নেই।'
'কোথায়?'
'ওর মাসীর বাড়ি।'
'মিথ্যে কথা। বিকেলেও দেখেছি ওকে।'
'মিথ্যে বলছি না।'
কথা বের করতে না পেরে বুট জুতো দিয়ে রমলার তলপেটে আঘাত করলো রাজাকার সুফি। ব্যথায় কঁকিয়ে উঠলো রমলা। তবুও সুবর্ণার কথা জানালো না সে।
রাজাকাররা টর্চের আলো ফেলে সারাঘর তন্ন তন্ন করে খুঁজলো সুবর্ণাকে।
তোষকের মধ্যে লুকিয়ে থাকা সুবর্ণা ভয়ে কাঁপতে লাগলো।
হঠাৎ রহমান রাজাকারের দৃষ্টি গেলো মোড়ানো তোষকের দিকে। তোষকের ভাঁজ খুলে সুবর্ণাকে পেলো তারা। উলস্নাসে ফেটে পড়লো রাজাকাররা।
কোন আকুতি শুনলো না পিশাচরা। মায়ের সামনে বিবস্ত্রা করলো সুবর্ণাকে। তারপর একে একে পাঁচজনে ধর্ষণ করলো ষোল বছরের কিশোরীকে। এক পর্যায়ে জ্ঞান হারিয়ে ফেললো সুবর্ণা।
মা দুই হাতে চোখ ঢাকলেন। মনে মনে বললেন, 'ভগবান মৃতু্য দাও, মৃতু্য দাও ভগবান!'
শিবু চোখে দেখলো না, তবে বাইরের সব কথাই তার কানে আসছিল। মায়ের আকুতি, বোনের আর্তনাদে পাথর হয়ে গেলো শিবু। একবার মনে করলো বের হয়ে এসে রাজাকারদের মুখোমুখি দাঁড়াবে সে। একা পাঁচজন রাজাকারের সঙ্গে পেরে উঠবে না ভেবে চোখ বুজে সবকিছু সহ্য করলো সে।
নিজেদের মধ্যে কথা বলাবলি করতে করতে রাজাকাররা চলে গেলে কিছুক্ষণ পর শিবু বের হয়ে এলো। মা রমলা শিবুকে জড়িয়ে ধরে কান্নায় ভেঙ্গে পড়লেন।
জ্ঞান ফিরে পাওয়ার পর সুবর্ণা তার মাকে জড়িয়ে ধরে থর থর করে কাঁদতে লাগলো। রমলা অনেকৰণ নির্বাক তাকিয়ে থাকলো সুবর্ণার দিকে। একদিকে স্বামীর লাশ অন্যদিকে মেয়ের দুর্দশায় হতবিহ্বল রমলা ছেলে শিবুকে বললেন, 'তোর বাবার শেষকৃত্য হবে না?'
'হবে মা।'
শিবু সংক্ষিপ্ত উত্তর দিয়ে ধীরে ধীরে বাবার লাশের পাশে গিয়ে দাঁড়ালো। হাঁটু গেড়ে বসে বাবার লাশ স্পর্শ করে বলল, 'তোমাকে যারা হত্যা করেছে, তার প্রতিশোধ আমি নেবোই, তুমি আমাকে আশীর্বাদ করো বাবা।'
সুবর্ণা এসে শিবুর পাশে দাঁড়ালো। ছোট বোনকে আদর করে বুকের মধ্যে টেনে নিলো শিবু। সাহস দিয়ে বলল, 'ভয় নেই, বাবার লাশের একটা ব্যবস্থা করে আমরা রাতেই পালিয়ে যাবো।'
মা বললেন, 'কোথায়?'
শিবু বলল, 'ভারতে।'
তোরা ভাই-বোন দু'জনে যা, আমি তোর বাবাকে ছেড়ে কোথাও যেতে পারবো না।
সেকি মা! তুমি এখানে থাকলে কিছুতেই বাঁচতে পারবে না।
ছেলের কথার উত্তর না দিয়ে স্বামীর লাশ জড়িয়ে ধরে ঝর ঝর কেঁদে ফেললেন রমলা। কাঁদতে কাঁদতে বললেন, 'তোমাকে ছেড়ে কিছুতেই প্রাণ ভয়ে পালাতে পারবো না আমি। আমি তোমার সাথেই থাকবো।'
দাহ হলো না নিশিকানত্দের। সে রাতে কোঁদাল দিয়ে গর্ত খুঁড়ে বাবার লাশ শুইয়ে দিলো শিবু। তারপর মাকে বলল, 'চলো মা, আমরা পালিয়ে যাই।'
'না, আমি যাবো না। তোরা যা। তোর বাবাকে ছেড়ে কিছুতেই যেতে পারবো না আমি।'
শিবু অনেক বোঝালো, লাভ হলো না। রমলাকে কিছুতেই তার সিদ্ধানত্দ থেকে বদলানো গেলো না।
দেখতে দেখতে পূর্ব দিগনত্দ লাল হয়ে উঠলো। গাছে গাছে পাখি ডেকে উঠে জানান দিলো, ভোর হয়ে এসেছে। অথচ শিবু কিছুতেই তার মাকে বোঝাতে পারছে না!
এরই মধ্যে রহমান রাজাকার আবার ফিরে এলো শিবুদের বাড়ি। শিবু দৌড়ে ঝোঁপের আড়ালে পালালো। পালাতে পারলো না সুবর্ণা। রাজাকার রহমান এসে সুবর্ণার হাত ধরলো। টেনে-হেঁচড়ে নিয়ে যেতে চাইলো সুবর্ণাকো। মা এসে রাজাকারদের পথ রোধ করে দাঁড়ালেন।
রহমান বলল, 'সরে যা বলছি।'
মা মিনতি করে বললেন, 'আমার মেয়েকে ছেড়ে দাও। দয়া করো।'
আড়াল থেকে সবই দেখলো শিবু। হাতের কাছে শুকনো একটি ডাল পেয়ে গেলো সে। হঠাৎ পিছন থেকে এসে রহমান রাজাকারের মাথায় আঘাত করলো শিবু। জ্ঞান হারিয়ে ফেললো রহমান। শিবু রহমানের হাত থেকে রাইফেলটা তুলে নিলো। পর পর দুটো গুলি করলো রহমান রাজাকারের বুকে।
কাঁধে রাইফেল আর ডান হাতে সুবর্ণা ও বাম হাতে মাকে নিয়ে দেঁৗড়াতে শুরম্ন করলো শিবু। সকালের তোজোদীপ্ত সূর্যের আলোয় দেশকে শত্রম্নমুক্ত করার প্রতিজ্ঞা উদ্ভাসিত হলো শিবু। এগিয়ে চললো সে সূর্যের পথ ধরে।
আপনার ভালো লাগা ও মন্দ লাগা জানিয়ে লেখককে অনুপ্রানিত করুন
মোঃ আক্তারুজ্জামান সুন্দর সাবলীলতায় লেখা গল্প| মুদ্রণ বিভ্রাটে কিছু কিছু শব্দ নষ্ট হয়ে গেছে| অভ্র ৫ ভার্সনে লিখতে পারেন এরকম হবে না|
প্রজাপতি মন ভালো লাগলো।
সূর্য শক্ত বুনটের মুক্তিযুদ্ধের সুন্দর এক খন্ড চিত্র।
সালেহ মাহমুদ খুব ভালো লাগলো, অসম্ভব ভালো একটি গল্প। মনে হয় মুক্তিযুদ্ধের একটি খন্ডচিত্রের বাস্তব চিত্র দেখলাম। ধন্যবাদ লেখককে।
আশা সুন্দর লেখা এবং প্রানবন্ত গল্প। শেষের দিকটায় গল্পটাকে জীবন্ত করে রাখলেন। শুভকামনা রেখে গেলাম লেখক মহোদয়ের জন্য।
তানভীর আহমেদ ঘটনাবহুল গতিময় গল্প। প্রাণবন্ত অবশ্যই। সংলাপগুলো শরীরের রক্তকে টগবগ করে ফুটিয়ে তোলে। তবে শেষখানটায় এশে একটু থমকাতে হলো। সাধারণ দৃষ্টিতে হয়ত ধরা পড়ার মতো নয়। তবে সচেতন পাঠকের চোখে পড়ার মতো। ষোল বছরের এক কিশোর যে কখনো আগ্নেআস্ত্র ছুঁয়েও দেখেনি, সে হঠাত করেই রাইফেল হাতে পেয়েই গুলি করার মতো কায়দাটি মুহূর্তের মধ্যেই আয়ত্ব করল কীভাবে। রাইফেলতো আর গুলি ছোড়ার জন্য সর্বদা প্রস্তুত রাখা হয় না। ছুড়তে হলে নিশ্চয়ই কোনো কিছুতে চাপ দিয়ে প্রস্তুত করে নিতে হয়। সেটা শিবুর জানার কথা না। তবে মোটের উপর গল্পটি খুব ভালো হয়েছে।
আবু ওয়াফা মোঃ মুফতি বেশ ভাল লাগল| যুক্তাক্ষরগুলো সঠিকভাবে না আসায় গতিতে টান পড়েছে|
মামুন ম. আজিজ আপনাকে স্বাগতম। নিয়মিত লিখবেন আশা করছি।
M.A.HALIM চমৎকার গণ্প খুব খুব ভালো লাগলো । বন্ধুর জন্য শুভ কামনা রইলো।
রুহুল আমীন রাজু মুক্তিযোদ্ধা মানেই সুর্য ........ভালো লাগলো .শুভ কামনা রইলো .

২৭ অক্টোবর - ২০১১ গল্প/কবিতা: ১১ টি

বিজ্ঞপ্তি

এই লেখাটি গল্পকবিতা কর্তৃপক্ষের আংশিক অথবা কোন সম্পাদনা ছাড়াই প্রকাশিত এবং গল্পকবিতা কর্তৃপক্ষ এই লেখার বিষয়বস্তু, মন্তব্য অথবা পরিণতির ব্যাপারে দায়ী থাকবে না। লেখকই সব দায়ভার বহন করতে বাধ্য থাকবে।

প্রতি মাসেই পুরস্কার

বিচারক ও পাঠকদের ভোটে সেরা ৩টি গল্প ও ৩টি কবিতা পুরস্কার পাবে।

লেখা প্রতিযোগিতায় আপনিও লিখুন

  • প্রথম পুরস্কার ১৫০০ টাকার প্রাইজ বন্ড এবং সনদপত্র।
  • দ্বিতীয় পুরস্কার ১০০০ টাকার প্রাইজ বন্ড এবং সনদপত্র।
  • তৃতীয় পুরস্কার সনদপত্র।

আগামী সংখ্যার বিষয়

গল্পের বিষয় "স্থিতিশীলতা”
কবিতার বিষয় "স্থিতিশীলতা”
লেখা জমা দেওয়ার শেষ তারিখ ২৫ নভেম্বর,২০২৪