১
চায়ের কাপে ঝড় তোলা বোধ হয় একেই বলে। গত এক ঘণ্টা ধরে তুমুল বিতর্ক চলছে গতকালের ম্যাচে মেসির গোলটা হয়েছে কি হয়নি। প্রায় হাতাহাতি লাগে আর কি! আমি ইতালির সাপোর্টর, বসে বসে আগুনে ঘি ঢালছিলাম আর আলুর চপ আর পিঁয়াজু একটার পর একটা সাবাড় করছিলাম। চার নম্বর চায়ের কাপটা শেষ করে যেই না বার নাম্বার চপটা মুখে দিব, ওমা! হাওয়া! হাত খালি! তাকিয়ে দেখি হাসান মুখে একশ পাওয়ারের হাসি দিয়ে আমার চপটা চালান করে দিচ্ছে। আমি তাকাতেই বলল, আমার একটা নিয়েছিলি মনে নেই? শালা চামার একটা। এক সপ্তাহ আগের ঘটনা, ঠিকই মনে রেখেছে। তা রাখবেনা কেন, ওর দাদা করত তেজারতির কারবার। স্বভাব আর যাবে কোথায়! ওকে একটা ভেংচি কেটে জয়নালকে বললাম, “মামা আরেকটা চা দাও, চিনি বেশি।”
এদিকে ব্রাজিল আর্জেন্টিনা তর্ক থামার কোন লক্ষণ আপাতত দেখা যাচ্ছে না। এক চুমুকে চায়ের কাপটা করে ফেললাম। দেখি মিমু ভাই আমার দিকে তাকিয়ে আছে, আমি তাকাতেই বলল, “গরু”। “গরু এক চুমুকে গরম চা শেষ করে ফেলে তা তো জানতাম না মিমু ভাই”, দাঁত কেলিয়ে বললাম। “যা! ফুট শালা, কবে দেখি জিভটা পুড়ে হইছে কয়লা”। আমি কিছু না বলে হাসলাম, আমার হাসি দেখলে যে কারও মেজাজ খারাপ হতে বাধ্য। এমনিতেই কাল ব্রাজিল হেরে যাওয়ায় মিমু ভাইয়ের মেজাজ খারাপ, তার সাথে তর্ক না করাই নিরাপদ।
মিমু ভাই আরেকটা সিগারেট ধরিয়েছে। আজকের আড্ডার স্পন্সর রাহাত, কালকের আর্জেন্টিনা জেতার জন্য। কিন্তু তাই বলে ফ্রি খাওয়ায় মিমু ভাইয়ের কোন সংকোচ নেই। একটার পর একটা সমানে ঠেসে দিচ্ছে। মিমু ভাইয়ের ভালো নাম মৃন্ময়। এত সুন্দর নাম থাকতে কেন তাকে সবাই মিমু ডাকে কে জানে! মিমু ভাই দেখতেও অনেক সুন্দর, পাড়ার মেয়েরা তাকে খুব পছন্দ করে- কিছু হলেই মিমু। তবে এও জানি এসব মেয়েরা কেউই মিমু ভাইয়ের সাথে পাকাপাকিভাবে নিজেকে জড়াবে না। রাকা আপুও করেনি। রাকা আপুকে আমরা সবাই মিমু ভাবী ডাকতাম। কিন্তু বছর দুয়েক চুটিয়ে প্রেম করার পর রাকা আপু সুন্দর করে প্রবাসী ডাক্তার বিয়ে করে ফুড়ুৎ।
সে যাক! রাকা আপু এখন ইতিহাস, তাও মিমু ভাইয়ের। আমি যাচ্ছি এখন নিমপাড়ার দিকে। নিমপাড়ায় সাদা দোতলা বাড়িটা শিউলিদের। বিকেলে এ সময় শিউলি ছাদে আসে। ওই তো শিউলি! আমি প্রতিদিন আড্ডা ফাঁকি দিয়ে এখানে দাঁড়িয়ে থাকি, প্রতিদিন ভাবি আজ সে তাকাবে আমার দিকে। কিন্তু শিউলি কোনদিনই এদিকে তাকায় না। মেয়েদের নাকি অনেক দিকে চোখ থাকে, তাহলে শিউলি আমাকে দেখতে পায়না কেন? নাকি পায়? আমাকে উপেক্ষা করেই তার আনন্দ?
শিউলিদের বাসায় গিয়ে ওর সাথে ভাব করব সে উপায় বা সাহস কোনটাই আমার নেই। শিউলি পড়ে কমার্সে, আমি সায়েন্সে- তবুও কলেজে গেলে ওকে দেখা যেত। শিউলি যেদিন আমাদের কলেজে ফার্স্ট ইয়ারে ভর্তি হল সেদিন কি যে ভালো লাগছিল আমার! খুব ভারিক্কি চাল নিয়ে বলেছিলাম, “তুমি সাদেক ভাইয়ের বোন না? ফার্স্ট ইয়ার? সাবজেক্ট কি?” তা ষোল বছরের মেয়ের ভাবের কমতি নেই। আধা মনোযোগ-আধা উপেক্ষা স্টাইলে বলল, “হ্যাঁ। কমার্স।” আমি গলার স্বরটা আরেকটু ভারি করে জানিয়ে দিলাম আমি সায়েন্সে পড়ি। “তাতে আমি থোড়াই কেয়ার করি” মার্কা একটা দৃষ্টি দিয়ে বলল, “ও।” এরপর আর কথা বলার সাহস হয়নি।
তাও যখন তখন টিফিন টাইমে, কি করিডোরে তার দেখা পাওয়া যেত। এখন আর সে উপায়ও নেই। টেস্ট হয়ে গিয়েছে, চার মাস পর এইচ এস সি। আরও দশ মিনিট দাঁড়িয়ে থাকলাম। শিউলি চলে যাচ্ছে। প্রতিদিন আমি এই দৃশ্য দেখি। সেই এক ভঙ্গি, সেই একই সূর্যাস্তের আলো। তবু ওর এই চলে যাওয়া দেখতে প্রতিদিন আমার নতুন করে কষ্ট হয়।
২
পনের মিনিট ধরে আপা চোখে কাজল দিচ্ছে। আপার চোখ ছোট, এই চোখকে সুন্দর দেখানো নিয়ে আপার চিন্তার অন্ত নেই। কাজল দেয়া শেষ হয়েছে। আরও পনের মিনিট শাড়ির আঁচলটা ঠিক করে আমার দিকে ফিরে বলল, “দেখতো রন্তু, কেমন দেখাচ্ছে?” “তোমাকে অপূর্ব সুন্দর লাগছে আপা”।
আপা খুশি হয়ে বলল, “ফাজলামি করছিস না তো? সত্যি করে বল না”।
একবার সুন্দর বলার এই বিপদ। বারবার বলতে হবে। মুখ ভেংচে বললাম, “তোমাকে শাঁকচুন্নির মত লাগছে। যাও এখন। জাহিদ ভাই দাঁড়িয়ে আছে”।
“ঈশ! আমি বুঝি জাহিদের জন্য সাজছি? ও আসবে কথা থেকে? আমি তো যাচ্ছি কণাদের বাড়ি।”
“হুম যাও, কণাদের বাড়িই যাও। এক কাজ করি, চল তোমাকে পৌঁছে দিয়ে আসি। কণাদির মা সব সময় মজার মজার খাবার রান্না করে।”
“সে কি! তুই যাবি কিভাবে! না না।” তারপর মুখটা করুণ করে বলল, “মা কে বলে দিবি না তো?”
“সেদিন যে বসে বসে ফুচকা খাচ্ছিলি জাহিদ ভাইয়ের সাথে বসে, মাকে বলেছি আমি?” আপার মুখটা আরও করুণ হয়ে গেল। আপাটা এত সরল! আপাকে মোটেই আমি ফুচকা খেতে দেখিনি। “মাকে বলিস না ভাইয়া, কেমন? তোকে নতুন ব্যাট কিনে দিব।” আপাটা আসলেই বোকা। আমি এমনিতেই বলতাম না, থাক বোনাস পেলে মন্দ কি! মুখটা ভাবুক করে বললাম, “ঠিইইইক আছে। দেখব ভেবে।” আপা লজ্জা লজ্জা মুখ করে চলে গেল। জাহিদ ভাই আর আপার কথাটা বাসায় উঠেছে গত সপ্তাহে। সব ঠিক থাকলে এ মাসেই পানচিনি হয়ে যাবার কথা।
একটু পর আমিও বেরিয়ে পড়লাম। জুওলজির প্যাঁচাল পড়ে মাথাটা গরম হয়ে গিয়েছে। কিছুক্ষণ একা একা হাঁটব আর একনজর শিউলিকে দেখে আসব।
“আরে রন্তু! এত দেরি কেন?”, বলেই আমার পিঠে একটা জোর থাবড়া দিল সুমন ভাই, মিমু ভাইয়ের জানে-জিগার দোস্ত। একেই বলে কপাল! আজ আড্ডায় যাবনা বলে জয়নালের দোকানের দিকে না গিয়ে পুকুরপাড়ে এলাম, আর আজকেই আড্ডা বসেছে পুকুর পাড়েই। আর উপায় নেই, বসতেই হবে আর নির্ঘাত শিউলিকে দেখা হবে না। এই পোড়া মফঃস্বলে কাউকে এড়িয়ে যাবার কোন উপায় নেই। আড়চোখে তাকিয়ে দেখলাম আজ শিউলির ভাই সাদেক। এ বছর খুলনা ভার্সিটিতে ভর্তি হয়েছে। ওর সাথে খাতির করে শিউলির কাছাকাছি যাবার একটা উপায় বের করেছিলাম, পাত্তাই দেয়নি আমাকে। ভাইবোন দুটোই এতভাব কোত্থেকে পায় কে জানে! সাদেককে দেখে আড্ডায় বসার ইচ্ছা আরও চলে গেল। রাহাত, হাসান, শিমুলও নেই। সুমন ভাইয়ের হাত থেকে ছুটে যাবার সম্ভাবনা অনেক কম, তবু একটা চেষ্টা করলাম, “না সুমন ভাই। আজ বসব না। পড়তে পড়তে মাথাটা গরম হয়ে গিয়েছিল তাই একটু হাঁটাহাঁটি করব।” “অ! ঠিক আছে, যা!”
এত সহজে ছাড়ান পাব ভাবিনি। বুঝলাম রসালো কোন গল্প হচ্ছিল আর আমাকে এখনও ছোটই ভাবে সবাই। ভীষণ অভিমান হল আমার। একবার বিষ দৃষ্টিতে সাদেক কে দেখে বাসার দিকে চললাম। মাগরিবের আজান পড়ে গেছে, শিউলি নিশ্চয়ই আর ছাদে নেই।
৩
কলেজে ফর্ম ফিলাপ করে ক্যান্টিনে আড্ডা হচ্ছিল। আমি রাহাত, হাসান, মিনহাজ, শিমুল আর তালগাছ মিজান। একের পর এক চায়ের কাপ শেষ করছিলাম আর মাঝে মাঝে দ্রুত চোখে শিউলিকে খুঁজছিলাম। মিনহাজ তার চাপাবাজি চালিয়ে যাচ্ছিল, “বুঝলি এই দেশে থাইকা লাভ নাই কোনও। আছেটা কি দেশে? মামা বলছে আমার পরীক্ষা শেষ হলেই আমারে আমেরিকা নেওয়ার ব্যবস্থা করব।” ওর কথার পিঠে আমরা কেউ কিছু বলিনা। মিনহাজ খুলনা এসেছে ছয় বছর আগে, এই ছয় বছরে ওর এই কথা কম করে হলেও ছয়শ আটান্নবার শুনেছি। আমেরিকা গিয়ে ও কি কি করবে, ওর বউ কেমন সুন্দরী হবে, ওর বাচ্চারা টকাটক ইংরেজি বলবে আর আমরা এখানে পড়ে পড়ে কেরানিগিরি করব আর মুদির দোকানে বসে বাজারের হিসাব করব- এই কাহিনী এতবার এতভাবে শুনেছি যে এখন শুনে না শোনার ভান করি। সত্যি বলতে কি মিনহাজের এসব রংচঙা গল্প না থাকলে জীবনটা অনেক পানসে হয়ে যেত।
এই সময় এল মুরগি মিজান- মিজানের স্বভাব বা চেহারা কোনটার সাথেই মুরগির কোনও মিল নেই। কথায় কথায় একদিন মুরগি মিলনের গল্প করছিল, এরপর কেমন করে জানি নিজেই মুরগি মিজান হয়ে যায়। মিজান এসেই কার কাছে কি সাজেশন আছে খোঁজ নেয়া শুরু করে দেয়।
“কিরে শিমুল্যা, তুই আছস কই?” আমেরিকার গল্প থামিয়ে হঠাৎ বলে উঠল মিনহাজ। এখানে আসার পর থেকেই শিমুল কোন কথা না বলে শুধু মোবাইল টিপে যাচ্ছে। তা হবেই বা না কেন, ইদানিং গার্লফ্রেন্ড জুটেছে শালার। প্রেমের বিষয়ে আমাদের মধ্যে শিমুল সবচেয়ে এক্সপার্ট- কলেজের এই দুই বছরেই তিনটা মেয়ের সাথে দেখলাম ওকে, আর আমি কিনা তিন বছর ধরে হাঁ করে ছাদের দিকে তাকিয়ে আছি।
মনে মনে নিজের কপালের দুরবস্থার কথা ভাবছি আর ঠিক সেই মুহূর্তে চোখাচোখি হল শিউলির সাথে, হাতে একটা কোকের বোতল। আমি হ্যাংলার মতো তাকিয়ে আছি আর আমাকে অবাক করে দিয়ে শিউলি হাত নাড়ল আমার দিকে তাকিয়ে। আর আমি? আমি সেই মুহূর্তে কি করছিলাম সেটা আর কিছুতেই মনে করতে পারছিনা। হঠাৎ মনে হল শিউলি আমাকে কিছু বলছে। তারপরই নিজেকে বলতে শুনলাম, “হ্যাঁ? কিছু বললে?”
“বললাম, আপনার প্রিপারেশন কেমন?”
“প্রিপারেশন? ও, হ্যাঁ, তা, এই তো চলছে, মোটামুটি।”
শিউলিটা তো বেশ পাকা! নায়িকাদের মত মুখ ভঙ্গি করে বলল,” মোটামুটি কেন? অনেক পড়াশোনা করছেন বোঝাই যাচ্ছে। গত এক সপ্তাহ পাত্তাই পাওয়া যাচ্ছে না।” গত এক সপ্তাহ শিউলিদের বাড়ির সামনে যাইনি, সাদেক যদি টের পায় এই ভেবে। শিউলি কি সেই কথাই বলছে? তবে কি? তবে কি? আমার হতভম্বের মত মুখটা দেখে শিউলি মুচকি হাসছে। “গেলাম, পড়াশোনা করেন ভালো করে। আবার একেবারে হাওয়া হয়ে যাবেন না।” আমি তখন আর কি বলব। আমার ভিতরে তখন পৃথিবীর সব সুর একসাথে বাজছে আর বাতাসে পাচ্ছিলাম শিউলি ফুলের গন্ধ!
৪
কাল বিকেল থেকে আপা কাঁদছে, কেঁদেই যাচ্ছে। কাল সারারাত আপা ঘুমায়নি। মার অনেক প্রশ্নেও কোন উত্তর দেয়নি আপা। দুপুরে ভাত খেতে বসে বলল, মা, আমি জাহিদকে বিয়ে করব না। মা বিষম খেলেন, আমি অবাক হয়ে আপার দিকে তাকালাম।আপার এমন স্পষ্ট স্বর, এমন দৃঢ় ভঙ্গি আমি কোনদিন দেখিনি। মা হতভম্ব গলায় বললেন, কী বললি তুই? এর মানে কী?” “মানে খুব সোজা মা। জাহিদকে আমি বিয়ে করব না। ওর মুখ আমি আর দেখতে চাই না।” “পানচিনি হয়ে গেছে। রন্তুর পরীক্ষাটা হয়ে গেলেই তোর বিয়ে। আর এ সময় এসব কী বলছিস কি তুই! আর কাল থেকে কাঁদছিসই বা কেন?” আপা সেই আগের ভঙ্গিতে বলল, “তোমার এত প্রশ্নের জবাব আমি দিব না মা, তুমি সহ্য করতে পারবেনা।” বলে শান্তভাবে ভাত খেতে লাগল।
আপা চুপ করে থাকলেও এক সময় সবাই বুঝতে পারল কী হয়েছে। কেউ আর এ নিয়ে কিছু বলল না আপাকে। আপার মধ্যে এমন একটা পরিবর্তন এসেছে যে বাবা, মা, দাদি কেউই আর আপার সাথে কথা বলতে সাহস পেত না। সেই চিরচেনা আপা কেমন করে যেন বদলে গেল। মাঝে মাঝে ইচ্ছা করত ওই জাহিদকে জন্মের মত একটা শিক্ষা দিয়ে আসি। এ ঘটনার পর বেশ ক’বার আপার সাথে দেখা করতে চেয়েছে, ক্ষমা চেয়েছে। কিন্তু যে আপা জাহিদ ভাইকে এত ভালবাসত আর ফিরেও তাকাল না তার দিকে। শুধু চুপচাপ বসে থাকত। আপাকে যেন আমি নতুন করে চিনলাম। সেই সহজ-সরল আপার মধ্যে এক আত্মাভিমানী নারী ছিল সেটা বুঝতেই পারিনি।
এরপরের ঘটনাগুলো অনেক দ্রুত ঘটে যায়। আপার বিয়ে ভেঙে যাওয়াতে ছোট্ট শহরে কথায় ছড়ায় কম না। আমার পরীক্ষা যেনতেনভাবে শেষ হয়। স্থানীয় চেয়ারম্যানের সাথে বিবাদ করে নানা ঝামেলায় জড়িয়ে বাবাও হাঁপিয়ে উঠেন। চেষ্টাচরিত্র করে বদলির ব্যবস্থা করে ফেলেন কুষ্টিয়ায়।
.............................................................................................
আজ এই শহরে আমার শেষ বিকেল, জয়নালের চায়ের দোকানে শেষ আড্ডা-হাসান, রাহাত, মিমু ভাই, সুমন ভাই, পুকুরপাড় আর শিউলি... শেষবারের মতো নিম পাড়ার সেই বাড়িটির দিকে তাকিয়ে থাকলাম। সূর্যাস্তের সেই আলোতে শিউলি তাকিয়ে ছিল আমার দিকে- মনে হল শিউলি ফুলের গন্ধে বাতাস ভরে উঠেছে।