আমাদের বাড়িতে বর্ষা কেউই পছন্দ করে না। বাবার ফ্যাক্টরিতে যেতে কষ্ট হয়, আমাকেও ভিজে ভিজে স্কুলে যেতে হয়। একমাত্র আমার ছোটবোনটা বৃষ্টি দেখলে খিলখিল করে হাসে।
আমাদের একটাই ছাতা, তাও কয়েক জায়গায় ফুটো, শিকগুলোর অবস্থাও খারাপ। প্রতিবার বর্ষা এলেই বাবা ছাতাটা মেরামতের চেষ্টা করেন। এমনও না যে ছাতা কেনার টাকা আমাদের নেই। কিন্তু যখনই ছাতা কেনার কথা হয়, আরও জরুরি কোন প্রয়োজন এসে উপস্থিত হয়। প্রতি বর্ষার শেষে বাবা বলেন এ বছর তো হল না, আগামী বর্ষায় ঠিকই হবে, বাবার জন্য ছাতা, আমার জন্য রেইনকোট। রেইনকোট- রেইনকোট আমার খুব পছন্দ। আমার স্কুলে অনেক ছেলেমেয়েই রেইনকোট পরে আসে। আমারও খুব ইচ্ছা করে রেইনকোট পরে স্কুলে যেতে। আমাদের ছাতাটা বাবা সকালে ফ্যাক্টরি যাবার সময় নিয়ে যান, বাবা প্রায়ই নিতে চান না- মা জোর করে দিয়ে দেন। বাবা বলেন, “আহা মিনু, রাসুটা কীভাবে যাবে স্কুলে?” মা কোন উত্তর দেন না, কোন উত্তর খুঁজে পান না। আমার তখন খুব কষ্ট হয়। বাবার জন্য, মার জন্য। আমি যখন বৃষ্টিতে কাকভেজা হয়ে স্কুলে যাই, ভীষণ লজ্জা করে আমার; মনে হয় সবাই তাকিয়ে আছে আমার দিকে। একদিন সুমি আমাকে জিজ্ঞেস করছিল, “কি রে একটা ছাতাও আনতে পারিস না গাধা?” সুমিকে খুব ভাল লাগে আমার। সুমির খুব সুন্দর একটা গেলাপি রেইনকোট আছে। তবে আমার সবচেয়ে পছন্দের হচ্ছে পলাশের নেভি ব্লু রঙের রেইনকোটটা। আমার খুব শখ এরকম একটা রেইনকোট আমিও পরব। মাঝে মাঝে বাবা মার উপর আমার খুব অভিমান হয়। কেন আমরা একটা রেইনকোট কিনতে পারিনা? বাবাকে কিছু বলতে পারিনা আমি, মার সাথে রাগ করি। যেদিনই আমাকে ভিজে ভিজে যেতে হয় সেদিনই রাগ করি। একদিন আমি রাগ করে ভাত খাইনি। মার শত ডাকাডাকিতেও না। রাতে যখন মা বাবাকে বলছিলেন আমার কথা আমার খুব লজ্জা করছিল, ভীষণ অপরাধী লাগছিল নিজেকে। শুয়ে শুয়ে বাবার মুখটা দেখছিলাম- কি নিরুপায় লোকটা! বাবা যখন আমার পাশে বসে মাথায় হাত বুলিয়ে দিচ্ছিলেন আমি ঘুমের ভান করে পড়েছিলাম। সেদিন সারারাত আমি কেঁদেছি। ক্লাস এইটে পড়া ছেলের কাঁদতে নেই, কিন্তু আমি যে চোখের পানি সামলাতে পারিনি।
একদিন আমি স্বপ্নেও রেইনকোট দেখেছি। আমরা চারজন বেড়াতে গিয়েছি, আমাদের সবার গায়ে রেইনকোট। এমনকি আমাদের বাড়িটাও রেইনকোটে ঢাকা। আর সুমি আমার দিকে তাকিয়ে হাত নাড়ছে। সেদিন আমার মনটা খুব ভাল ছিল। আমার ধারণা ভাল করে লেখাপড়া করলে আমি ভাল চাকরি পাব, তখন আমাদের আর কোন দুঃখ থাকবেনা। আমি অনেক পড়ি, যতক্ষণ পারি পড়তে থাকি। বাবা কিন্তু আমার পড়াশোনা নিয়ে আমাকে কক্ষণও কিচ্ছু বলেন না। একদিন শুনেছিলাম বাবা মাকে বলছেন, “ফার্স্ট সেকেন্ড হয়ে আর কি হবে মিনু? আমি কী পেয়েছি?” বাবা বোর্ডে স্ট্যান্ড করা ছাত্র ছিলেন। সত্যিই তো বাবা কী পেয়েছেন? কিন্তু তবুও আমি পড়ি। কারণ আমি জানি বাবা খুশি হন।
আজ আমি খুব খুশি। আমি ক্লাস এইটে বৃত্তি পেয়েছি। শুনে বাবা-মা দুজনেই খুব কাঁদলেন, আমিও কাঁদলাম, শুধু আমার ছোট বোনটা খিলখিল করে হাসল। ও এখনও ঠিকমত পুরো বাক্য বলতে পারেনা, আধো আধো করে বলতে থাকে, মজা হবে! মজা হবে! কী মজার কথা বলে বুঝতে পারিনা।
আমি এককালীন কিছু টাকা পেয়েছি। চাইলেই এখন একটা রেইনকোট কিনতে পারি আমি, বাবার জন্যও কিনতে পারি। নেভি ব্লু একটা রেইনকোট আমার পছন্দও হয়, ঠিক পলাশেরটার মতো। কিন্তু কিনতে পারিনা আমি- আরও প্রয়োজনীয় কিছু জিনিসের কথা মনে পরে যায়। বাবার জন্য, মার জন্য, বোন বিন্তির জন্য।
আমি বাসায় ফিরছি, হাতে একটা প্যাকেট। তখনি বৃষ্টি নামে, ছুটে গিয়ে বাস স্ট্যান্ডের শেডের নিচে গিয়ে দাঁড়াই। এই প্রথম আমি প্রসন্ন মনে বৃষ্টি দেখছি। এই বর্ষায় তো হল না, আগামী বর্ষায় নিশ্চয়ই হবে।
(কারণে- অকারণে প্রায়ই বাবা-মার সাথে রাগ করি। মেজাজ ঠাণ্ডা হলে খুব অপরাধী লাগে নিজেকে। এই গল্পটা তাঁদের জন্য। নিজেদের অনেক সীমাবদ্ধতা সত্ত্বেও যারা আমাকে উপযুক্ত করে তুলেছেন।)
০১ ফেব্রুয়ারী - ২০১১
গল্প/কবিতা:
৭ টি
বিজ্ঞপ্তি
এই লেখাটি গল্পকবিতা কর্তৃপক্ষের আংশিক অথবা কোন সম্পাদনা ছাড়াই প্রকাশিত এবং গল্পকবিতা কর্তৃপক্ষ এই লেখার বিষয়বস্তু, মন্তব্য অথবা পরিণতির ব্যাপারে দায়ী থাকবে না। লেখকই সব দায়ভার বহন করতে বাধ্য থাকবে।
প্রতি মাসেই পুরস্কার
বিচারক ও পাঠকদের ভোটে সেরা ৩টি গল্প ও ৩টি কবিতা পুরস্কার পাবে।
লেখা প্রতিযোগিতায় আপনিও লিখুন
-
প্রথম পুরস্কার ১৫০০ টাকার
প্রাইজ বন্ড এবং সনদপত্র।
-
দ্বিতীয় পুরস্কার ১০০০ টাকার
প্রাইজ বন্ড এবং সনদপত্র।
-
তৃতীয় পুরস্কার সনদপত্র।
আগামী সংখ্যার বিষয়
লেখা জমা দেওয়ার শেষ তারিখ ২৫ নভেম্বর,২০২৪