অবন্তীর দাদীর বাসায় কে যেন প্রতি রাতেই বেল দিয়ে যায়। প্রায় শতবর্ষী দাদাকে সাথে নিয়ে পঁচাত্তর উর্ধ্বা বয়সী দাদী একাই থাকে। বয়সের ভারে কাবু নয়; ডায়াবেটিকস, হৃদ রোগ আর হাই প্রেশারের রোগী হলেও এখনও বেশ শক্ত সমর্থ্য আছে। ছেলেমেয়েরা সব এ বাড়িতেই থাকে তবে নিজ নিজ পরিবার নিয়ে সবাই আলাদা। রান্নার জন্য বুয়া আছে। সে দুপুরের পরে চলে যায়। অনেক বছর ধরেই দাদীর ঘুম পাতলা, প্রায় সারা রাতই জেগে থাকে। ছোট বাসা। ছেলেমেয়ে ভাড়াটিয়া মিলিয়ে দুই ইউনিটের চারতলা বাসা। পাঁচতলা করা হচ্ছে। নিজেরাই গেট খোলে, নিজেরাই তালা লাগিয়ে দেয়। এ কাজটা সবসময় করে তার ছোট ছেলে আকমল। রাতে ভাত খাওয়ার পরে প্রতিদিন হাঁটতে বের হয়। বারোটার মধ্যে রাস্তার পাশের প্রধান ফটক আর কেঁচি গেট সব লাগানো হয়ে যায়। সারা বাড়িতে শুধু নাতি নাতনীরা কেউ কেউ রাত জেগে থাকে কিন্তু অত রাতে এদের কেউ ঘর থেকে বেরোয় না তো মাঝ রাতে বেল বাজায় কে? এক তলায় দু’রকম ভাড়াটিয়া আছে তার একটা তো একটা কোচিং সেন্টার। রাস্তার দিকের ঘর ওটা। ক্লাস নেয়া হয়ে গেলে রাত আটটার দিকে চাবি জমা দিয়ে চলে যায়। আর পশ্চিম পাশে থাকে এক ভদ্রলোক। জুতার ব্যবসায়ী। সেই লোকের কোন প্রয়োজন পড়লে কি এত রাতে বাসায় কড়া নাড়বে? সে তো কখনো দোতলায় কড়া নাড়ে না। তার সাথে বাড়ি ভাড়ার যাবতীয় কথাবার্তা হয় মেজ ছেলে আজাদের সাথে। সিড়ি দিয়ে উঠে সোজা চার তলায় গিয়ে আজাদের সাথে কথা বলে নিচে নেমে বাসায় ঢুকে যায়। কোনদিকে তাকায় না পর্যন্ত। খুব ভদ্র মানুষ!
অবন্তীর বাবা আজমল আহমেদ থাকে দোতলায় বাবা-মায়ের ফ্লাটের পূর্ব পাশে। অবশ্য তার বাসায় থাকার কথা বলাটা কিছুটা ভুল। মাসের বেশিরভাগ সময়ে সে বাসাতে থাকেই না। কৃষির কন্সালটেন্সি চাকরীর জন্য তাকে প্রায়ই ঢাকার বাইরে গ্রামে গঞ্জে থাকতে হয়। খুব কম সময়ই সে ঢাকায় পরিবারের সাথে থাকে। পরিবার বলতে বউ আর একমাত্র মেয়ে অবন্তী। ফার্মেসীতে অনার্স ফাইনাল দিয়েছে। কিছুদিন পরে সেও একটা কোন চাকরীতে ঢুকে গেলে বাসায় দেখা যাবে শুধু অবন্তীর মা’কেই থাকতে হবে। মা-মেয়ে যে প্রায়ই একা থাকে এ খবর বোধহয় দুষ্টু লোকের কানে গেছে! নইলে এরকম অশান্তি শুরু কেন হঠাৎ করে?
ঘটনার শুরু কয়েক রাত আগে। আনুমানিক দেড়টা-দুটা হবে! অবন্তী নিজের বিছানায় শুয়ে গল্পের বই পড়ছিলো। কথাসাহিত্যিক হাসান আজিজুল হকের লেখা বই আগুনমুখা। আঞ্চলিক ভাষায় খটোমটো কথায় লেখা হলেও বইটা খুব টানছিলো ওকে। একটা গ্রামের মেয়ের নিজের ভাষায় জীবনকাহিনী। পড়তে ওর খুব ভালো লাগছিলো। গল্পের কাহিনীর সাথে ও একাত্ম হয়ে গিয়েছিলো। হঠাৎ একটা শব্দে চমকে উঠলো। ধুরুম! টঙ! বং! চমকে বই থেকে মুখ তুলে নিজের ঘরের দরজার দিকে তাকালো। মনে হলো রান্নাঘরে সিলভারের পাতিল পরে গেছে। ওর বিছানার ডান পাশ থেকে হাত চারেক জায়গা পরেই ওর ঘরের একমাত্র দরজাটা। তার সামনে দেড় হাত পরিমানের সামান্য একটু জায়গা ছেড়ে সামনের দিকে চল্লিশ সিএফটির ঘিয়ে রঙা নো-ফ্রস্ট ফ্রিজটা। অবন্তী বিছানায় উঠে বসলো। সেখান থেকে ডানে দরজার দিকে তাকিয়ে সোজা পশ্চিম বরাবরে ফ্রিজ তারপরে শোকেসটা এবং সেটা ছাড়িয়ে একেবারে বাইরের দরজার লুকিং গ্লাস পর্যন্ত গলা বাড়িয়ে দেখলো। অবন্তীর ঘর থেকে রান্নাঘরটা দেখা যায় না। ওটা ফ্রিজের গা ঘেঁষে ভেতর দিকে চলে গেছে উত্তর পাশে। খাবার ঘরে খাওয়ার শেষ হলে একটা সাত পাওয়ারের এনার্জি বাল্ব জ্বালানো থাকে। ওটা সারা রাত্রি ডিম লাইটেরও কাজ করে। মা শোয়ার সময় সেটা জ্বালিয়ে দিয়ে গেছে। এত রাতে রান্না ঘরে হাড়িপাতিল কার হাতের খোঁচায় পরবে? অবন্তী বইয়ের পাতা থেকে চোখ সরিয়ে মিনিট কয়েক একটানা ওর ঘরের দরজার দিকে চেয়ে থাকে। মা যদি রান্নাঘরে গিয়ে থাকে তাহলে অবশ্যই কথা বলতে বলতে বের হয়ে আসবে। ওর মায়ের তো একা একা কথা বলার অভ্যাস। যখন যা করছেন ভাবছেন তা জোরে জোরে বলে। যেমন এখনই অভ্যাসবশতঃ পরে যাওয়া হাড়ি পাতিলের উদ্দেশে মায়ের বলে ওঠার কথা- ‘পড়োস ক্যান? ভাত খাস না?’ আর অবন্তীর রুমের দিকে তাকিয়ে রাগী কণ্ঠে বিরক্ত মুখে বলার কথা-‘এখনো ঘুমাও নাই? চেহারার তো বারোটা বাজাচ্ছো রাত জেগে জেগে!’ এটা মায়ের কমন ডায়ালগ! কিন্তু না! যেটুক সময়ে মা এসব করবে বা বলবে তার চেয়ে বেশি সময় ধরে নিজের ঘরের দরজার দিকে তাকিয়ে থাকলো অবন্তী। অথচ মা’কে ফ্রিজের কোণা থেকে বের হয়ে আসতে দেখলো না। অর্থাৎ মা এদিকে আসেইনি।
রান্না ঘরের তুলনায় বাবা-মায়ের ঘরটাই ওর ঘরের কাছাকাছি। ঠিক ডান পাশের ঘরটাই। এ বাসায় পাশাপাশি দুটো শোবার ঘর। একটায় ও থাকে। আরেকটায় বাবা-মা। বাবা তো বাসায় নেই। মাকে ঘুম থেকে ডাকা উচিত কিনা বুঝতে পারছে না। রান্নাঘরে গিয়ে দেখে আসা উচিত। কিন্তু ওর ভয় লাগছে। এমনিতেও ও বেশি রাতে রান্নাঘরের দিকে যায় না। ও পুনরায় বইয়ের ভেতরে মনযোগ দিতে চাইলো। কিন্তু আর মন বসাতে পারলো না। মাঝে মাঝে রান্নাঘরের থাইয়ের জানালার লক লাগানো হয় না, চাপিয়ে রাখা হয়। চাপিয়ে রাখা জানালার পাল্লা টেনে খুলে নিশ্চয়ই বিড়াল ঢুকবে না! মনের অজান্তেই ওর গা ছম ছম করে উঠলো। হাড়িপাতিল পড়ার শব্দ পরিস্কার শুনলো ও। এত জোরে শব্দ হলো অথচ মা কেন শোয়া থেকে উঠে এলো না? অবন্তী কি তাহলে ভুল শুনলো? কিছুই বুঝলো না ব্যাপারটা। বইটা বন্ধ করে ও লাইট নিভিয়ে শুয়ে পরলো। চোখ প্রায় বুজেই এসেছিলো। বাম কাত হয়ে শুয়ে ছিলো। হঠাৎ মনে হলো বিছানার পাশে কী কেউ এসে দাঁড়িয়েছে? কথাটা ভাবতেই গা শিরশির করতে লাগলো। এখন যদি ওর দিকে উবু হয়ে এসে ওর ঘাড় মটকে দেয়? এটা মনে হতেই ও বাম কাত থেকে সোজা হয়ে চিত হয়ে শোয়। ডান কাত হয়ে দেখে কেউ নেই। মনের ভুল। ঘরের ভেতরে তেতুল রঙা লম্বা আলমারী। লম্বা লম্বা পর্দা। অন্ধকারে ভয় লাগে! খানিক পরেই বিছানার লাগোয়া জানালার বাইরে ধুপ ধুপ টুপ টুপ শব্দ হতে থাকে। জানালার খুব কাছেই রয়েছে কেউ! ভুত নাকি চোর! ভৌতিক সিনেমাগুলোতে যেমন দেখায়-শব্দের উৎস খুঁজতে জানালার পর্দা সরাতেই জানালার গ্লাসে বীভৎস মুখ উঁকি দেয় সে কথা মনে পরতেই অবন্তী আরও তীব্রভাবে চোখ বুঁজে ঘুমোবার চেষ্টা করতে থাকে। ভৌতিক যে কোন কিছু থেকে অবন্তী দূরেই থাকে; এসব ওর স্নায়ুতে সয় না! কতক্ষণ ঘুমিয়েছে বলতে পারবে না মনে হলো কেউ ওর নাম ধরে খুব জোরে ডাকছে-“অবন্তী! এই অবন্তী!” অন্ধকারে চোখ খুলে বিছানার সামনে একটা ছায়া দেখে “ও মা-গো!” বলে ধরমড়িয়ে উঠে বসলো। কয়েক সেকেন্ডেই বোধ ফিরে পেলো। ওহ মা! “অবন্তী, আমার ঘরে চোর আসছিলো! দেইখা যাও!” বলে ছুটে গেলো নিজের ঘরে। অবন্তীও মায়ের পিছন পিছন গিয়ে যা দেখলো তাতে একই সাথে অবাক এবং ভয়ে গা শিউরে উঠলো- “একী!” ও দেখলো মায়ের বিছানার সাথের লাগোয়া থাইয়ের গ্লাসের জানালার এক পাল্লা টেনে সরানো আর পর্দাটা ভাঁজ করে উঠিয়ে রাখা। আর মায়ের বালিশের পাশে এক হাত সমান একটা দু’ইঞ্চি চওড়া কাঠের টুকরা রাখা। মা ভয়ার্ত গলায় বললো-“অবন্তী, আমার মোবাইল ফোনটা নাই!”
অবন্তী মোবাইলের কথাটা যতটা ভাবছে তার চেয়ে বেশি ভাবছে- কাঠের টুকরাটা দিয়ে চোর যদি মায়ের মাথাটা ফাঁটিয়ে রেখে যেত ও কি সকালের আগে জানতে পারতো? ফজরের আজানের বেশি বাকী নেই। মা-মেয়ে দুজনে থম ধরে বসে আছে। এতক্ষণ চোরের কাণ্ডে অবন্তী ভুলে গিয়েছিলো! এখন বললো- “রাত দেড়টার দিকে রান্নাঘরে পাতিল পরে যাওয়ার শব্দ শুনলাম। তখনই চোর আসছিলো নাকি?”
মা শুনে অবাক হয়ে গেলো-“তাই নাকি? আমাকে ডাকো নাই কেন? তাইতো ভাবছি রান্নাঘরের জানালাটা এতখানি ফাঁক করা কেন? আমিতো ভাবছি-তুমি বোধহয় রান্নাঘরে পানি গরম করছিলা!” “এতো জোরে শব্দ হইলো আর তুমি শুনলা না তাই আমি ভাবছি বোধহয় মনের ভুল!”
তখন আর দুজনের কারোই ঘুম হলো না। মা-মেয়ে চা বানিয়ে খাবার টেবিলে খেতে বসলো। হঠাৎ অবন্তীর মনে হলো “চোরটা কি সিমটা এখনই বন্ধ করে দিয়েছে? ফোন করে দেখি তো!” নাম্বার ডায়াল করতেই ফোন বেজে উঠলো মায়ের ঘর থেকে। কাছে গিয়ে দেখে খাটের নিচে মোবাইলের লাইট জ্বলছে আর রিং বাজছে। “যাক মোবাইল তাহলে চোরে নিতে চেয়েও নিতে পারেনি! খাটের চিপায় পরে গিয়েছে!” মা-মেয়ে দুঃখ ভুলে হেসে উঠলো।
এর পরে অবন্তীর মা সবগুলো ঘরের জানালার লক ঠিক আছে কিনা দেখতে গিয়ে খেয়াল করলো বসার ঘরের জানালার একটা পাল্লা যেন কিছুটা ঢিলা। মনে হচ্ছে এটাকে খুব টানাটানি করা হয়েছিলো খোলার জন্য! বসার ঘরটা একেবারে চিপার মধ্যে বলে বাতাসের যাতায়াত কম। তাই জানালা একবার খোলা হলে বন্ধও খুব একটা করা হয় না। এ ঘরের ছোট ডিভানে শুধু নামাজ পড়া হয়। অবস্থা দেখে তো ভীষণ ভয় পেয়ে গেলো অবন্তীর মা! “এসবের মানে কি! এটা কি ছ্যাচড়া চোরের কান্ড নাকি ডাকাতি করার প্লান! কি আছে আমাদের? পয়সাওয়ালা না! শুধু বাড়ি ভাড়া দিয়ে কোথাও থাকতে হয় না এটাই শান্তি! এ ছাড়া গাড়ি নাই। সোনাদানা দিয়ে ঘর ভরা নেই। এমন বাসার উপরেও কারো চোখ পরে!”
অবন্তীরা থাকে ভুতেরগলি মসজিদের পেছনে নর্থ রোডে। সকালে অবন্তীর মা যখন বাসার সবার সাথে রাতের বিষয়টা নিয়ে কথা বলছিলো তখন ফিরোজ ফুপা বলে গেলো–“এলাকায় নাইট গার্ড নাই তো কিছুদিন ধরে! স্কুলের পেছনের চিপা গলিতে আমিরুল ভাইয়ের বাসার দুই তলায় কয়েক দিন আগে ডাকাতি হইছে। আপনি তো একা থাকেন। সাবধানে থাকবেন! আর রাতে কোন সমস্যা হইলে ফোন কইরেন।”
সে রাতে শোবার সময় হলো। বাড়তি সতর্কতা হিসেবে আজ থেকে সব দরজা জানালার লক আটকে ঘুমাবে ঠিক করলো। ফিরোজ ফুপা বাথরুমের দরজার ছিটকিনিও লাগাতে বলে গেছে। আজকাল নাকি বাথরুমের জানালার কাছের ছোট ফ্যান খুলে বাচ্চা ঢুকিয়ে ডাকাতি করা হয়! এসব শুনে তো ওদের আতংক আরো বেড়েছে। ওদের বসার ঘরের কাঠের পাল্লার দরজাটা মাঝখানে স্ক্রু দিয়ে ভাঁজ করা। দরজাটা ইচ্ছে করেই ওরকম বানানো হয়েছিলো যাতে ঘরের মধ্যে যথেষ্ট জায়গা থাকে। মা মেয়ে আজ ঘরে একলা বলে ওরা ভাবলো এই ঘরের জানালার কপাট খোলার চেষ্টা হয়েছে তাই এই দরজাটা বন্ধ করে ঘুমালে কিছুটা নিরাপদ। চোর বা ডাকাত আর যাই হোক সে নিশ্চয়ই জানালার পাল্লা খুলে গ্রিল কেটে দরজা ভেঙ্গে রাতে ওদের ওপরে হামলা করতে পারবে না! রাতে শোবার আগে মা অবন্তীকে দরজা লাগাতে বলার পরে দেখা গেলো সেটা সোজা হচ্ছে না। দীর্ঘ ছয় বছরের ভাঁজ হয়ে থাকা। এত সহজে কি আর সোজা হবে? তাও শেষ পর্যন্ত সোজা করে ছিটকিনি লাগাতে গিয়ে দেখা গেলো ছিটকিনি আর লাগছে না। দরজার পাল্লা উপরের দিকে একপাশে বেড়ে লম্বা হয়ে গেছে। এটা এখন মিস্ত্রী ছাড়া ঠিক হবে না। কিন্তু অবন্তী দৌঁড়ে গিয়ে রান্নাঘর থেকে বটি নিয়ে এসে মা’কে বললো- “চোখ নিচু করে দরজাটা শক্ত করে ধরে দাঁড়াও তো!” মেয়ে দরজায় বটি ধরে শুরু করলো চাছা! ঘষো ঘষো ঘষো করে কয়েক মিনিটের চেষ্টায় দরজার উঁচু অংশটা চেঁছে সমান করে দিলো। তারপরে মা মেয়ে দুজনে টানাটানি করে বহু কষ্টে দরজার ছিটকিনিটা লাগাতে পারলো।
এর পর থেকে বসার ঘরের দরজাটা বেশিরভাগ সময়ে লাগানোই থাকে। ওখানে ঢুকতেও ভয় লাগে। অভিশপ্ত ঘরে পরিণত হয়েছে যেন। ও ঘরে গেলেই যেন বিপদ হবে।
এই ঘটনার পরে সারা বাড়িতেই আতংক ছড়িয়ে পরেছে। রাতে কে সিড়িঘরে হাঁটে? কে’ই বা বাসার চিপা দিয়ে বিল্ডিঙে চুরি করতে চেষ্টা করেছিলো? ওই চোরই কি বসার ঘরের জানালাটা ভাংতে চেয়েছিলো? সেই কি এসে রোজ বেল দেয়? সে কি একা নাকি দল বেঁধে আসে? ধীরে ধীরে একজন দুজন করে করে প্রায় রাতেই কেউ না কেউ সারা রাত নির্ঘুম কাটাতে থাকে এই বাড়িটায়। এতদিন ধরে এ বাসায় আছে এরকম কোন কান্ড তো আগে কখনো ঘটেনি।
এর পরের কয়েক রাত কোন কিছু না ঘটলেও ভয় ছাড়লো না। অবন্তী কিছুটা ভিতু ধাঁতের মেয়ে। সেদিন রাতের পরে অজানা আতংকে ওর ঘুম পাতলা হয়ে গেছে। রাতে এখন বলতে গেলে ঘুমই হয় না। রাতের ঘুম কি আর দিনের ঘুম দিয়ে পুষিয়ে নেয়া যায়? দিনে কত রকম শব্দ! দিনেও ঘরের মধ্যে একা থাকতে ভয় লাগে। বেশ কিছুদিন ধরে বাসা খালি রেখেও কোথাও যাওয়া হলো না। বাসা খালি রেখে বেরোলেই যেন অঘটন ঘটবে! বয়স্ক মানুষের মতন অবন্তীর হার্টেরও ব্রেক ফেইল হবার দশা! সামান্য শব্দেই আঁতকে ওঠে। রাত তিনটা-সাড়ে তিনটার দিকে দাদী এখন নিয়মিত অবন্তীর মাকে ফোন করে। কোনদিন হয়তো বলে-“দরজায় কে জানি বেল দিলো!” আবার কোন একদিন বলে-“বউমা, দেখো তো কে জানি নিচের গেটের তালা ভাংতে টানাটানি লাগাইছে!” আবার কোনদিন হয়তো বললো-“দরজার সামনে কে যেন হাঁটে!” এর পরে অবন্তীর মা আবার ফ্লাটের বাকীদের ফোন দিয়ে জাগিয়ে তোলে। ফোনে ফোনে সারা বাড়ি জেগে উঠে। আতংক অস্থিরতা কিছুতেই যাচ্ছে না। বরং দিন দিন বাড়ছে। এতদিনে টনক নড়লো ওদের চারতলা বাসার ছাদের উপরে পঞ্চম তলা তোলা হচ্ছে। ছাদে যাওয়ার এখন কোন গেট নেই। খোলাই থাকে। এতদিন ধরে এ বাসায় আছে। কোনদিন তো অঘটন হয়নি। এলাকায় সবাই ওদের চেনে। ভুতেরগলি থানার সাথে এলাকার ছোটখাট বিচার আচারের মেম্বার অবন্তীর চাচা। তার বাসায় চুরি করবে কার এমন বুকের পাটা! তাই নিশ্চিন্ত! চোর কি আর পাশের বিল্ডিং বেয়ে বেয়ে ছাদের উপরে দিয়ে আসবে? এমনই ভাবনা ছিলো সবার। কিন্তু এবার সবার ধারণা পালটে গেলো। সেই সাথে প্রায়ই ছাদের উপরে রড নড়াচড়ার শব্দ শোনা যায়। সকালে খবর পাওয়া যাচ্ছে-গুনে রাখার পরেও একটা ছোট রড নেই। একটা গ্রীল নেই। শুধু অঘটনের খবর! এর তো একটা সমাধান আসতে হবে! ভুতেরগলি থানাটা পাশের গলিতেই। নতুন হয়েছে। সেখানে গিয়ে একদিন অবন্তীর চাচা-ফুপা রিপোর্ট করে আসে-“এত কাছে থানা থাকতে আমাদের বাসায় প্রতি রাতে চোর আসে কি করে?” তার পরেও কোন অগ্রগতি নেই। এভাবে আরও কিছুদিন পেরিয়ে যায়।
ওদিকে প্রায় এক সপ্তাহ না ঘুমাতে না ঘুমাতে অবন্তী অতিষ্ট। ওর মতো এই বাসার চাচাতো-ফুপাতো ভাই-বোনও অস্থির। এর একটা বিহিত করতেই হবে। এভাবে আর চলছে না! ওরা নিজেরা ভয় না পেলেও প্রতি রাতেই যে একটা নাটক শুরু হয় সেটা বন্ধ না হলে তো আরামে ঘুমানো যাচ্ছে না। পড়াশুনারও ক্ষতি হচ্ছে। অবন্তীর চাচাতো-ফুপাতো সব ভাই বোন মিলিয়ে মোট আটজন- সায়েম, নায়েম, সুচি, ইশরাক, ইশমা, তুরীন, তামিম। এদের মধ্যে অবন্তী বাদে সবচেয়ে বড় ইশরাক অনার্স প্রথম বর্ষে আর সবচেয়ে ছোট তুরীন ক্লাস এইটের ছাত্র। সবাই মিলে একটা আলোচনায় বসলো। বড়দের মতো বড়রা কাজ করুক। ওরাও নিজেরা গোয়েন্দাগিরি করবে কিভাবে চোরের সমস্যা সমাধান করা যায়। কে এই চোর? এত আরামে কিভাবে একটা বাসার ভেতরে ঢুকে শয়তানী করার সাহস পায়? বাচ্চারা প্রায় প্রত্যেকেই রাত দু’টা তিনটা পর্যন্ত জেগে থাকতে পারে। তাছাড়া এই ক’দিনে ঘুম তো এমনিতেই গেছে! সবাই মিলে ঠিক করলো প্রতি রাতেই ওরা বাসার চিপা গলিতে লক্ষ্য রাখবে। ইশরাকের বন্ধুর বাবার মুরগীর খামার আছে। ও সেখান থেকে গিয়ে মুরগীর বিষ্ঠা যোগাড় করে আনলো। তারপরে সেগুলোর সাথে কাঁচা মরিচ বেঁটে মেশালো। তার সাথে শুকনা মরিচের গুড়াও। সেগুলো চিপাগলির দেয়ালের উপরে ছড়িয়ে ছিটিয়ে স্প্রে করে দিলো। কোন কোন জায়গায় রান্নার পোড়া তেলও ঢাললো। মনে হয় না খুব দক্ষ চোরের কান্ড! নইলে মোবাইল চুরি করতে গিয়ে কাঠের টুকরা ফেলে আসে? চোর যদি খালি পায়ে আসে আর দেয়াল ধরে ধরে উঠে তাহলে ওর হাত জ্বালাপোড়া করতে আর পিছলে পরে যেতে বাধ্য। শুধু এই নয় ছাদের কাছের সিড়িতে আর ইটের রেলিঙেও চোর ধরার জন্য তেল ঢেলে রাখলো। ইট সুরকীর কাজ চলছে, উপরের সিড়ি প্রায় নোংরাই থাকে বলে অত উপরের সিড়িতে বুয়াও ঝাড়ু দিতে যায় না। তাই জেনে যাবার ভয় নেই। সন্দেহভাজন হিসেবে তাকেও তো বাদ দেয়া যায় না। যদিও ওরা বুয়াকে প্রথম টার্গেট হিসেবে ধরেনি। সত্যি সত্যি চোর আসলে সে অবশ্যই পিছলে পরবে। ব্যবস্থা নিয়ে এ বাসার সবাইকে জানিয়ে রাখলো-“আমরা একটা একস্পেরিমেন্ট করছি! তোমরা কয়েকদিন ছাদে যেন কেউযেও না! ওদিকে গেলে আছাড় খাওয়ার সম্ভাবনা আছে।” সন্দেহভাজন হিসেবে ওরা একটা পয়েন্ট ধরেছে। তবে নিশ্চিত না হয়ে তো কিছু বলা যায় না। তাছাড়া দেয়ালেরও কান আছে। তাই বেশি লোক না জানাই ভালো। সবার সাথে অবন্তীও একমত। মাকে অবশ্য একবার বলেছিলো-“মা, আমার মনে হয় নিচতলায়...” মা তো পুরোটা শুনতেই চায় নি! আগেই হই হই করে ওকে থামিয়ে দিয়েছে। এখন দেখা যাক ওদের অনুমান ঠিক হয় কিনা!
দুই রাত পেরিয়ে গেলো তেমন কিছুই ঘটলো না। চোরের পাত্তা পাওয়া গেলো না। কেউ বেল দিলো না। কেউ সিড়ি ঘরে হাঁটলো না। তৃতীয় রাতে সন্ধার দিকে সায়েম একবার গিয়ে পুনরায় তেল ঢেলে এসেছে যাতে আগের রাতে শুকিয়ে থাকলেও চোর পালাতে না পারে।
ভাগ্যটা প্রসন্ন! সেদিন রাতেই ঘটলো কাণ্ডটা। সায়েম আর নায়েম তখন জেগে ছিলো। হঠাৎ ধুরুম শব্দে কিছু পরলো। প্রায় সাথে সাথেই পিছলে যাওয়ার শব্দ। পরতে পরতে এসে চারতলার বাইরের দরজার কাছেই ধুরুম করে পরলো। শব্দটা বেশ জোরেই হয়েছে। শব্দ পেয়ে সব ভাই-বোন সতর্ক হয়ে গেছে। বড়রাও জেগে উঠেছে। চারতলা ও তিন তলার বাসার দরজা এক সাথে খুলে গেলো। দরজা খোলার শব্দে দুদ্দাড় দৌঁড়াদৌঁড়ি শুরু হলো। পিছলে পরেছে যারা তাদের একজন গেলো নিচের দিকে। দোতলা পর্যন্ত যাওয়ার আগেই ইশরাক আর ওর বাবা গিয়ে ওটাকে আটকালো। কিছুক্ষণের মধ্যেই চারতলা থেকে ঘাড় ধরে টেনে আরও দুটো ছেলেকে টেনে নামালো আকমল চাচা। হিড় হিড় করে টেনে একেবারে নিচ তলার পূর্ব পাশের বাসার দরজার কাছে গিয়ে থামলো। যেখানে ভাড়াটিয়া মুহিদুল সাহেব থাকে। জুতার ব্যবসায়ী!
কিছুক্ষণ পরে থানা থেকে পুলিশ ডেকে আনা হলো। তিনটা ছেলেকেই থানায় নিয়ে যাওয়ার সময় থানার অফিসার এক তলার ভাড়াটিয়া মুহিদুল সাহেবকেও সাথে যেতে বললো। ভদ্রলোক বলে উঠলো-“আমাকে কেন?” পুলিশ অফিসার বললো-“আসুন। কিছু ফর্মালিটিস আছে!” অগত্যা তাকে সাথে যেতেই হলো। এ বাসা থেকে অবন্তীর আকমল চাচা আর আজাদ চাচাও সাথে গেলো।
সবাই মিলে থানায় চলে যাবার পরে বাসার অন্য সবাই মিলে অবন্তীদের ঘরে বসলো। আর কিছুক্ষণ পড়েই ফজরের আজান দিবে। কিভাবে কি হলো ইশরাক, সায়েম, নায়েম, অবন্তীরা এক যোগে উত্তেজিত স্বরে বর্ণনা করতে লাগলো। বাড়ির অভিভাবকদের বললো-“তোমরা তো ছোটদের কথাকে পাত্তাই দিতে চাওনা। আমরা আগেই ধারণা করেছিলাম। এতদিন এই বাসায় কোন অঘটন ঘটেনি। এই ভাড়াটিয়া আসার পর থেকেই চোরের আনাগোনা। আগেই বুঝেছিলাম-এদের মধ্যেই কোন গন্ডগোল আছে! পরে টার্গেট করলাম! দেখলা তো কিভাবে খেল খতম করলাম!”
কিন্তু অবন্তীরা জানতো না এর চেয়েও বড় খবর ওদের জন্য অপেক্ষা করছে! ওরা ভেবেছিলো এক তলার ছেলেগুলো বোধহয় ছিচকে চোর অথবা খুব বেশি হলে হেরোইনখোর। সন্দেহের তীরটা ওদের দিকেই গিয়েছিলো। তাই হাতে নাতে ধরার জন্যে সিড়িতে তেল ঢেলে রাখার বুদ্ধি করেছিলো।
ঘন্টাখানেক পরে চাচা বাসায় ফিরলে শুনা গেলো সেই চাঞ্চল্যকর খবর! নিচতলার ভাড়াটিয়া মুহিদুল নামের লোকটা সাধারণ ভাড়াটিয়া নয়। ওর নামে কতগুলা কেস আগে থেকেই ছিলো। অফিসার ওর চেহারা দেখেই ইচ্ছে করেই রুটিন চেক আপের কথা বলে থানায় নিয়ে যায়। ওর সাথে সাবলেট হিসেবে থাকা ছেলেগুলো মোটেও ছিচকে চোর বা হেরোইনসেবী নয়। এদের ডাকাতির প্ল্যান ছিলো। বেশ কিছুদিন ধরেই এরা এই এলাকায় আস্তানা গাঁড়ে। খোঁজ নিয়ে জেনেছিলো এই একমাত্র এই বাসাটাতেই নিরাপত্তার জন্য তেমন কোন শক্ত ব্যবস্থা নেই। আর এ বাসার প্রতিটা ঘরেই মাত্র একজন শক্ত সমর্থ পুরুষ। তার উপরে দোতলায় পুরুষ মানুষ বলতে গেলে নেইই। ভাড়াটিয়া হিসেবে উঠলেও সুযোগের অপেক্ষায় ছিলো।
আগেই অবন্তীদের প্লান শুনে বড়রা টাসকি খেয়েছিলো! থানার খবরটা শুনে হার্ট ফেল করার অবস্থা! আল্লাহ জোর বাঁচা বাঁচিয়ে দিয়েছে! বাবারে বাবা! মুখ দেখে লোক চেনা যায়?
সমস্ত ঘটনা শুনে অবন্তীর দাদী বললো- “ব্যাচেলর ভাড়া দেয়ার সময় আমি কিন্তু মানা করছিলাম! আমার কথায় তো কান দেও নাই তখন! থাক! আর এ বাড়িতে ভাড়াটিয়া রাখতে হবে না। বরং কোচিং সেন্টারটাকে পূব পাশে দিয়ে দাও। আর রাস্তার পাশে একটা ফার্মেসী বানাও। ওখানে বাড়তি লোক রাখারও প্রয়োজন নেই। এ বাসার কলেজ পড়ুয়া নাতি-নাতনীরা সময় দিলেই হবে। বাড়ির ভেতর আর বাইরের লোক ঢুকাবা না! কার মনে কি আছে এতকিছু খুঁজে দেখার সময় কোথায়? যথেষ্ট শিক্ষা হইছে!”
অত বড় দূর্ঘটনা থেকে রক্ষা পেয়ে বাড়ির সকলে মুরুব্বীর এই উপদেশ আর ফেলতে পারলো না। দেরীতে হলেও একটা শুভ বুদ্ধির উদয় হলো। এতদিনে সকলে স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেললো।
চোর পালালে বুদ্ধি বাড়ে! এতদিন ধরে এলাকায় থাকা কোনদিন যখন কোন অঘটন ঘটেনি তো আজ ঘটবে কেন? এরকম হালকা ভাবনা থেকেই এরকম কঠিন বিপদে পরতে যাচ্ছিলো আহমেদ ফ্যামিলির মানুষগুলো। এর পরে উপরের ছাদের সাথে বাসার একটা মজবুত দরজা লাগানো হলো। প্রত্যেক ফ্লোরের প্রত্যেক জানালাকে রড দিয়ে মজবুত খাচা লাগিয়ে দেয়া হলো যাতে আর জানালা দিয়ে কেউ কিছু চুরি করতে বা জানালা ভাংতেও না পারে। বাইরের গেটের সাথে মূল ভবনের ভেতরে যেন আর কোনভাবেই চোর-ডাকাতে আক্রমণ করতে না পারে সেই ব্যবস্থাও নেয়া হলো।
ক্লাব থেকে এবার ভুতেরগলির প্রত্যেক গলির জন্য একজন করে নাইট গার্ড নিয়োগ দেয়া হলো। এলাকায় শান্তি ফিরে এলো।
আপনার ভালো লাগা ও মন্দ লাগা জানিয়ে লেখককে অনুপ্রানিত করুন
বশির আহমেদ
একটু এদিক সেদিক হাত বাড়ালেই বন্ধু মিলে তাই না ? গল্প পড়ে তাজ্জব হয়েছি লেখিকার বুদ্ধিমত্তা দেখে ্ অনেক ভাল লিখেছেন । শেস পর্যন্ত বুদ্ধির জোড়ে চোর ধরা পড়লো ্ অবন্তীদের এত ভীতু কি মানায় ? অবন্তীর এত বুদ্ধি তার চরিত্রটাকে আরও সাহসী করা উচিত । তাতে গল্পের কাহিনীর সাথে মানান সই হবে ।
একটা বিস্তারিত মন্তব্য লিখলাম। তারপরে মনে হলো- থাক! যার যেমন মনে হয়! চমৎকার মন্তব্য এবং বিশ্লেষনী বক্তব্যের জন্য ততোধিক কৃতজ্ঞতা। এভাবে গুড়োগুড়ো করে বললেই ভালো পাই। ভালো থাকবেন।
এই লেখাটি গল্পকবিতা কর্তৃপক্ষের আংশিক অথবা কোন সম্পাদনা ছাড়াই প্রকাশিত এবং গল্পকবিতা কর্তৃপক্ষ এই লেখার বিষয়বস্তু, মন্তব্য অথবা পরিণতির ব্যাপারে দায়ী থাকবে না। লেখকই সব দায়ভার বহন করতে বাধ্য থাকবে।
প্রতি মাসেই পুরস্কার
বিচারক ও পাঠকদের ভোটে সেরা ৩টি গল্প ও ৩টি কবিতা পুরস্কার পাবে।
লেখা প্রতিযোগিতায় আপনিও লিখুন
প্রথম পুরস্কার ১৫০০ টাকার
প্রাইজ বন্ড এবং সনদপত্র।
দ্বিতীয় পুরস্কার ১০০০ টাকার
প্রাইজ বন্ড এবং সনদপত্র।
তৃতীয় পুরস্কার সনদপত্র।
বিজ্ঞপ্তি
“জানুয়ারী ২০২৫” সংখ্যার জন্য গল্প/কবিতা প্রদানের সময় শেষ। আপনাদের পাঠানো গল্প/কবিতা গুলো রিভিউ হচ্ছে। ১ জানুয়ারী, ২০২৫ থেকে গল্প/কবিতা গুলো ভোটের জন্য উন্মুক্ত করা হবে এবং আগামি সংখ্যার বিষয় জানিয়ে দেয়া হবে।