শিমুলের ঘুম আসছে না। অস্থির লাগছে। খুউব। সকালে না জানি আবার খারাপ খবর আসে। কতদিন দেখে না লোকটাকে। সেই কতদিন আগে একবার এসেছিলো। মাথা নিচু করে থেকেছিলো। শিমুল কথা বলেনি। এই এক সমস্যা এখন। আসলে কথা বলতে ইচ্ছে করে না। কিন্তু চলে গেলে মনে হয় একটু তো কথা বলা যেতো। কুশল নেয়া যেত।
রাত পোনে বারোটায় শিমুলের মোবাইলে একটা মেসেজ এসেছে-“আমার জন্য দোয়া করো-রাব্বির হামহুমা কামা রাব্বা ইয়ানি সাগিরা!আমার একাউন্টে পাঁচ হাজার টাকা পাঠাও।” মেসেজটা পাওয়ার পর থেকেই শিমুলের অস্থিরতা শুরু হয়েছে। মা ঘুমিয়ে গেছেন। তাকে এখন ডেকে তুললে অযথা টেনশন করবেন। তাঁর ঘুমটাও নষ্ট করা হবে। বয়স হয়ে গেছে, এখন একবার ঘুম ভেঙে গেলে তা পুনরায় জোড়া লাগানো এত সহজ না। আর দুঃশ্চিন্তা ধরে গেলে ঘুম পালায় এ তো সবাই জানে।
সারা রাত ছটফট করে শিমুলের ঘুমটা লেগেও লাগলো না। ভোরের দিকে চোখ টেনে এলো। ঘুম থেকে জাগলো সকাল নয়টায়। বিছানায় শুয়েই ভাবছিলো শিমুল, “কোন খারাপ সংবাদ কি এসেছে?” কথাটা মনে হতেই কান পেতে বাড়ির আবহাওয়া বুঝার চেষ্টা করলো। না! সেরকম দুঃখী দুঃখী তো মনে হচ্ছে না একটুও। ও উঠে যায়। উঠে নিজের ঘর থেকে খাওয়ার ঘরে উঁকি দেয়। কিচেনে উঁকি দেয়। উঁকি দেয় মায়ের ঘরে।
মা শিমুলের চেহারা দেখেই আন্দাজ করে কিছু হয়েছে। “কিরে, রাতে ঘুমাস নাই? সারা রাতে জেগে ছিলিস?রাত জেগে তো চেহারা মলিন হয়ে থাকে, এত যে বলি বুঝতে চাস না!”
“আম্মা, আব্বা ফোন দিছিলো?”
“না! সে আবার আমাকে ফোন দেয় নাকি?”
“রাতে একটা মেসেজ আসছে!”
“কি লিখছে? কে দিছে?”
“আব্বার নাম্বার থেকে। রাব্বির হামহুমা কামা রাব্বা ইয়ানি সাগিরা পড়তে বলছে আর পাঁচ হাজার টাকা পাঠাতে বলছে ব্যাংক একাউন্টে! আব্বা কি অসুস্থ?”
“মোটেও অসুস্থ না! এসব হচ্ছে ভাঁওতাবাজি! অসুস্থতার কথা বলে টাকা চেয়েছে। রশুর দোকান থেকে এক হাজার টাকা বিকাশ করে দিয়ে আয়।”
“বিকাশে তো চায়নি আম্মা। ব্যাংকে দিতে বলছে।”
“হ! ওনার লাইগ্যা এখন ব্যাংকে যাবো। রিকশা ভাড়া দিয়া! আরেক জায়গায় সংসার পাতছে, আমাদেরকে কইয়া করছে এসব? এখন তাঁর সংসার খরচ আমরা ব্যয় করবো! ইয়ার্কি?”
মা গজগজ করতে থাকেন রাগে। মুহুর্তের মধ্যে তেলেবেগুনে জ্বলে একেবারে অগ্নিমূর্তি ধারণ করেন। শিমুলের বুক থেকে পাষাণভার নেমে যায়। এটা যদি টাকা কামানোর ধান্দা হয় তবু ভালো। অসুস্থ হয়ে মরতে বসেছে এরকম খবর কোন সন্তানের কাছেই সুখকর নয়।
রাগে গজগজ করতে থাকলেও ফোনে কাকে যেন কল করেন শিমুলের আম্মা, “হ্যালো, শফিক, শোন তোমার দুলাভাই ফোন করছিলো। এখনই দুই হাজার টাকা বিকাশে পাঠাতে। কী বলে দরকার। তোমাকে আগামী সপ্তাহে দিয়া দেবো।”... “হ্যাঁ, জানোই তো। দেশে দেশে ঘুরে বেড়াবার বদ অভ্যাস তো তাঁর গেলো না!” ... “আচ্ছা, ঠিক আছে। কষ্ট করে একটু দিয়া যাইও।”
একটু পরে পাশের বাসা থেকে শফিক মামা আসে। শিমুলের মায়ের কাছে টাকা নেই। মাসের শেষ। ভাড়াটিয়ার বাড়ি ভাড়া দিতে এখনো দশ পনেরো দিন বাকী আছে। এখন ঐ লোক যে টাকা চেয়ে খবর দিয়েছে তাকে তো পাঠাতে হবে। তাই শফিক মামার কাছ থেকে ধার নেয়া হলো।
কিছুক্ষণ পরে শিমুলের আব্বা কল করলো শিমুলের নাম্বারে-
“হ্যালো, টাকাটা কি পাঠাইছো?”
“বিকাশ করা হচ্ছে! বাসায় টাকা নাই। ধার করা হইছে!”
“বিকাশ ক্যান? বিকাশে তো চার্জ দিতে হবে!” শিমুলের বাবার কণ্ঠে টাকা বেশি খরচ হওয়ার উৎকণ্ঠা!
“আর ব্যাংকে যেতে রিকশা ভাড়া লাগবে না? হেঁটে হেঁটে যাবো?” শিমুলও পালটা যুক্তি বসিয়ে দেয়।
“অ। আচ্ছা। ঠিক আছে। ভালো আছো তোমরা?”
“আছি।”
এবার বিরক্ত হয় শিমুল। ও কিংবা ওর মা কেমন আছে তা প্রথমে জিজ্ঞেস করেনি। প্রথমে টাকার ব্যাপারটা নিশ্চিত হয়ে নিয়েছে। তারপরে জানতে কেমন আছে?হাহ! এর নাম বাবা! টাকার প্রয়োজন হলেই বাবা ওদের সাথে যোগাযোগ করে। ওরা মা ছেলে কেমন থাকে তা জানতে কখনো ফোন দেয় না। খোঁজও নেয় না। তবু শিমুল বাবাকে ওর বিরক্তিটা বুঝতে দেয় না।
দুদিন পরে এক রাতে কান্নায় ঘুম ভেঙে গেলো শিমুলের। পাশাপাশি দুটি ঘরের একটিতে শিমুল একা শোয়। আর আরেকটায় ওর মা। পাশের ঘরে যেয়ে দ্রুত লাইট জ্বালালো। মা পেট চেপে ধরে কাঁদছে। মুখ চোখে যেন মৃত্যুর ছায়া। শিমুল একই সাথে অবাক এবং ভয় পেয়ে যায়! ওর মা তো কখনো কাঁদে না। আরও কত অসুখে পরে কখনো এরকম পাড়া মাথায় করে কান্নাকাটি অসম্ভব ব্যাপার! কাছাকাছি কে আছে ওদের? আত্মীয় কেউ নেই। বাবা তো থেকেও নেই। তবু এই মুহুর্তে মাকে কাঁদতে দেখে বাবার কথাই মনে পরে। “এত রাতে কি বাবা ফোন রিসভ করবে? তবু করে দেখি?” এই ভেবে কল দেয় ছেলে তার বাবাকে। রিং হয়েই যাচ্ছে, হয়েই যাচ্ছে, হয়েই যাচ্ছে, শেষ! না রিসিভ হয় না। ও পাশ থেকে কেউ সাড়া ফেলে না! বাবা তো এত রাত পর্যন্ত জাগে না। তাহলে ঘুমিয়ে গেছে। কিন্তু বাবা কিংবা মা কেউই তাদের ফোন সাইলেন্ট রাখে না। একথা মনে হতেই শিমুল আবারো কল দেয়। একে একে পাঁচবার কল করেও যখন রেসপন্স পায়না ওর হাত থেমে আসে। ফোন করা বাদ দিয়ে মায়ের কাছে গিয়ে বসে, “আম্মা, চলো হাসপাতালে নিয়া যাই।”
“এত রাতে হাসপাতালে যাবো? ভোর হোক, ফজরের নামাজটা পড়ে তারপরে না হয় যাই!”
শিমুলের আর ঘুম হয় না। মায়ের পাশে বসে থাকে। কী করবে ভেবে পায় না। আজ যদি বাবা পাশে থাকতো মাকে কি তাহলে এতটা সময় কষ্ট সহ্য করে বসে থাকতে হতো!
বিপদ যখন আসে তখন যেমন মানুষের পায়ে শেকড় গজিয়ে যায়, মানুষ কিংকর্তব্যবিমুড় হয়ে যায়, তেমনি কি ঘড়ির বেলাতেও হয়? ঘড়ির কাঁটা যেন চলছে না। সময়ও পেরোয় না। অন্যদিন হলে ফুরুত করে ভোর হয়ে যেত। প্রতিদিনই তাই হয়। শিমুল ঘুমোতে চোখটা বন্ধ করে আর ভোরের আজানে ঘুমটা ভেঙে যায়! মনে হয়, এইতো মাত্র চোখটা বন্ধ করলাম, তখন বেজেছিলো রাত বারটা, আর এখন মসজিদে আজান হচ্ছে!
আজ আর ভোর আসে না! একটু করে সময় পেরিয়ে যাচ্ছে আর মায়ের মুখটাও যেন রঙ হারাচ্ছে। আর কিছুক্ষণ পরেই ফজরের আজান দেবে। এখন নিশ্চয়ই বাবা কল রিসিভ করবে! শিমুল আবারো কল দেয় ওর বাবার ফোনে। ফোনটা বেজেই যায়। বেজেই যায়। শিমুলের মা কোনরকমে উঠে তায়াম্মুম করে বসেই নামাজ আদায় করতে শুরু করে। আর ওদিকে শিমুলের রোখ চেপে যায়! কতগুলো কল দিলে ও পাশ থেকে ফোন রিসিভ না হয় দেখে ছাড়বে!
ফজরের নামাজ শেষ করে মা বলে, “পেট ব্যথাটা কমে গেছে, শিমু। এখন আমার ঘুম পাচ্ছে! একটু ঘুমিয়ে নেই। তুইও যা। বসে থাকিস না। ঘুমা গিয়ে!”
শিমুল তবু সরে না। কিছুক্ষণ মায়ের মাথায় হাত বুলিয়ে দেয়। মায়ের চোখ দুটো কিছুক্ষণ পরে বন্ধ হয়ে আসে। তবু শিমুল বসে থেকে মায়ের দিকে চেয়ে দেখতে থাকে। মায়ের চোখের কোণ বেয়ে জল গড়িয়ে পরছে। ও কিছু বলে না। চোখটা মুছিয়ে দিয়ে আর কিছু বলতে পারে না। সরে আসে নিজের ঘরে। বাবার প্রতি তীব্র অভিমান হয়! এই জন্যেই বাবার সাথে ওর কথা বলতে ইচ্ছে করে না! যখন আসে তখন তীব্র অভিমানগুলো জমাট বেঁধে রাগে রূপান্তরিত হয়। ও ওর বাবার মোবাইলে মুঠোবার্তা দেয়, “আমার মায়ের সাথে আপনার সংঘাত! আমি কি আপনার ঔরসের নই? তাহলে কেন একটু মনে পরে না? এতগুলা কল দিলাম, তাও নজরে আসে না! আম্মা মরে গেলে খুশী হন?”
মেসেজটা দেয়ার পরে শিমুলের আবার ভয় লাগতে শুরু করে। হাজার হোক বাবা তো! তার সাথে তো আর যেমন খুশী ব্যবহার করা যায় না। আর মায়ের কানে গেলে তো আস্ত রাখবে না। মা বাবার বিষয়ে যতই রিয়েক্ট করুন শিমুলকে কখনো বিরুপ হতে দেয় না। বিরুপ হতে দেখলেই শিমুলের উপরে চড়াও হন, “বাবা তো! তুই কখনো বাবার সাথে খারাপ ব্যবহার করবি না! বাবার ভালোবাসা তো পেলিই না, বাবার বদ দোয়া পাওয়ার দরকার নেই।”
শিমুল বাবাকে সব সময় একই রকমই দেখলো। কখনো কি মানুষ চেঞ্জ হয়না?
তখন শিমুল হাই স্কুলের ছাত্র। রংপুর কামালকাছনায় বাসা। বাসার সাথেই স্কুল আর বাবার অফিসটাও কাছাকাছি। তখন দূরন্ত বয়স। যা দেখে তাতেই বন্ধুদের সাথে হেসে গড়াগড়ি করার অভ্যাস। মফস্বল টাউনের স্কুলগুলোতে ছাত্ররা যেন প্রতিদিন এক একটি সিনেমা নিয়ে হাজির হয়। ওমুকের বোন ভেগে গেছে ওমুকের সাথে। ওমুকে সিগারেট ফুঁকতে গিয়ে কানমলা খেয়েছে। এরকম আরও হাজার রকমের গল্প। উঠতি বয়সের সব মুখরোচক কাহিনী। বুঝো বা না বুঝো সবকিছুতেই হাহা হিহি করো। এরকম একদিন সকালে কোন ক্লাসটা নিয়ে স্যার মাত্র চলে গিয়েছেন। আরেক ক্লাস শুরু হওয়ার ঘন্টা তখনো বাজেনি। হঠাত একটা খবরে সবার মধ্যে চাপা উত্তেজনা! শিমুলের সাথে সেদিন কেউই আন্তরিক হচ্ছে না। সবাই কিছুটা ছাড়াছাড়াভাবে দূরে সরে সরে এক বা একাধিক আড্ডা আর ফিসফিস করছে! কার যেন ফিসফিসানী কিছুটা উচ্চস্বরে ভেসে এলো, “ওর বাবা বিয়ে করেছে!” প্রতিদিনকার স্বাভাবিক হাস্যরসের অংশ হিসেবে প্রথমে শিমুল হেসে উঠেছিলো। কিন্তু হাসিটা মুছে গিয়েছিলো খুব দ্রুতই। যখন ও শুনলো সেই বাবাটা এই মফস্বল শহরের কেরানী শ্রেণির সন্তানদের নয়। বাবাটা ওর নিজের। নিজের বাবা! শিক্ষিত বংশের শিক্ষিত একটা লোক হয়ে সে কীভাবে একটা বউ থাকতে, একটা আদরের সন্তান থাকতে আরেকটা বিয়ে করতে পারে! শিমুলের ছোট আত্মাটা ঐ খবরটা শুনে যেন ছিঁড়ে ফালাফালা হয়ে যাচ্ছিলো। কি অপমান! কি ব্যঙ্গ! কি নিষ্টুর একটা খবর! এতদিন এইসব খবরের হাসিঠাট্টার ও ছিলো একটা স্বাধীন অংশ। আজ সেই ঘটনাটাই বুকের ওপরে পাথর চেপে বসেছে। পরের ক্লাসগুলো কীভাবে কেটেছিলো জানে না শিমুল। বাসায় ফেরার পথে হেঁটে হেঁটে ও ফিরছিলো আর ভাবছিলো কোথায় যাবে? বাসায় গিয়ে কী দেখবে? বাসায় গিয়ে আরেকবার হোঁচট খেয়েছিলো। মায়ের হাস্যোজ্জ্বল তরুণীমুখটা যেন এক তুফানে বিধ্বস্ত হয়ে গেছে! তার মানে, খবরটা এখানেও পৌঁছে গেছে! এখন মা কি ওকে নিয়ে এই পরিবার ছেড়ে চলে যাবে? এই বাসা থেকে কি ওদেরকে তাড়িয়ে দেয়া হবে? না! তাড়িয়ে দেয়নি ওদেরকে কেউ। কিন্তু এক একটি অপমানকে গলা টিপে মেরে শিমুলের মা মিসেস পাপন চৌধুরী শিমুলকে সাথে নিয়েই আরও দশটি বছর সেখানে কাটিয়ে এসেছিলো। এক একটি দিন ছিলো যেন ছিলো পাথর চাপা। অন্ধকার। পাথরকুচির মত বেঁচে থাকা। সেই দিনগুলো মনে পরলে এখন এই বর্তমানে এসে অন্যের গল্প বলে মনে হয়। হাস্যকর মনে হয়!
মেসেজের টুংটাং শব্দে শিমুলের চিন্তাধারা অতীত থেকে বর্তমানে ফিরে আসে। যার কথা ভাবছিলো তারই মেসেজ। লিখেছে, “বাবা-মা কি কারও চিরকাল বেঁচে থাকে? মরণ থাকলে হবে। এটা নিয়ে ভাবনার কী আছে?”
কি অদ্ভূত কথা! কাঁচা বয়সের শিমুলের এরকম কথায় ভেতরে খুব আলোড়ন হয়। ও পালটা মেসেজ দেয়, “আপনি কি ভাবেন? সারাজীবন আপনি নিজেকে একজনের স্বামীই চিন্তা করে গেলেন। কখনো আপনি ভেবেছেন কি যে আপনি কারও বাবা?” মেসেজটা পাঠিয়ে দিয়ে বসে রইলো কিছুক্ষণ। আবার লিখতে বসলো, “সেই স্কুল লেভেল থেকে দেখে এলাম আপনি সবসময়েই ঘর ছাড়া! আমাদেরকে একা ফেলে রেখে আপনি কতদিন নেই নেই নেই। স্বামীছাড়া একজন তরুণী কীভাবে গ্রামে গঞ্জে থাকে, থাকতে পারে একটা শিশুপুত্রকে সাথে করে তা কখনো আমলে নিয়েছেন?” মেসেজটা সেন্ট করে দিয়ে আবার লিখতে থাকলো, “কখনো ভাবেননি একজন সন্তানের কাছে বাবার স্থানটা কোথায় থাকে! প্রতিটি সন্তান তার বাবা-মাকে ফেরেশতা তুল্য মনে করে। যাদের সম্পর্কে সে এক বিন্দু পরিমাণ নেগেটিভ কথা সহ্য করতে পারে না। আমার মাকে নিয়ে আপনার অনেক বিতৃষ্ণা। কিন্তু সে তো আপনার সন্তানের মা। আর মায়ের অসম্মান কোন সন্তানের কাছে মেনে নেয়া সম্ভব?”
কিছুক্ষণ ধরে শিমুলের ভেতরে তোলপাড় হতে থাকে। সমস্ত অতীতটা সামনে চলে আসে। যে বিচ্ছিন্ন বিক্ষুব্ধ অতীতকে ও মনে করতে চায় না। সব যেন দৃশ্যের পরে দৃশ্য ফ্ল্যাশব্যাক হয়ে সামনে প্রজেক্টরে প্রদর্শিত হতে থাকে। অন্তর গুড়িয়ে যেতে থাকে পুনরায়। আর দশটা বাবার মত কি পারতো না শিমুলের জীবনে একটা দারুন বাবা থাকতে? যে বাবা শুধু ওদের নিয়ে ভাবতো, ওদের নিয়ে স্বপ্ন দেখতো, শুধু ওদের মা ছেলেকে নিয়ে মেতে থাকতো।
কিছুক্ষণ পরে, বাবার মোবাইল থেকে একটি ক্ষুদে বার্তা আসে, “আমি ঘামছি! প্রেশার বেড়ে গেছে!”
শিমুলের এ কথায় কোন পজিটিভ প্রতিক্রিয়া আসে না। ওও পালটা জবাব দিতে লেখে, “আপনি তো সারাজীবনেই আমাদেরকে ছেড়ে দূরে দূরে থেকেছেন! তো আজ কী এমন হলো যে আপনার প্রেশার বেড়ে যায়? আপনি তো জানেনই যে আপনার হাই প্রেশার। হাই স্যালারিতে নিজে আলাদা চাকরি করছেন। যাকে সংগী করেছেন সে তো বিলাসযাপন করে না তাহলে অত টাকা কী করেন? নিজের চিকিৎসায় ব্যয় করছেন না কেন? প্রেশারের রোগীকে প্রেশারের ট্যাবলেট নিয়মিত খেতে হবে, এ কথা বলার কেউ আপনার পাশে নেই বুঝি?”
সারা রাত মেসেজে মেসেজে চললো বাপ ছেলের কথোপকথন। প্রায় ভোরের দিকে ঘুম জড়িয়ে এসেছিলো। সেই ঘুম ভাংলো সকাল দশটায়। মুঠোফোনটা নেড়ে লাইট অন করে দেখলো কোন নতুন বার্তা এসেছে কিনা। আসেনি দেখে সে আবার দুঃশ্চিন্তায় জড়িয়ে গেলো, “রাতে কিছু হলো না তো!”
সকালে ঘুম দেরীতে ভাঙ্গায় উঠেই মায়ের ঘরে গেলো, “তোমার শরীর কেমন আম্মা? চলো হাসপাতালে যাই।”
মা বললো, “শরীর ঠিক আছে। হাসপাতালে যেতে হবে না। আরও দুদিন দেখি!”
এর পরে কয়েকদিন আর কোন খবর নেই। কেমন আছে তা তো কখনো জানায়ই না। শুধু নিজের টাকার প্রয়োজন হলেই আগের স্ত্রীকে কল করবে। একদিন ভোর বেলায় ফজরের আজান হয়ে গেছে। শিমুল আধো ঘুম, আধো জাগরনে। কে যেন ডাকছে, “শিমুল, বাবা আমার। আমার অনেক পাপ। আমাকে ক্ষমা করিস। আমি চললাম!” কে ডাকলো? শিমুলের ঘুম ছুটে গেছে। উঠে বসলো। ঘর অন্ধকার। জানালাটা হাট করে খোলা। পর্দা উড়ছে জোরছে। ঝড় আসবে। আকাশেও গুরুম গুরুম গর্জন চলছে। শিমুলের কানে বাজছে এখনো কথাগুলো। খুব কাছে, কানের কাছেই যেন বলছিলো, “আমি চললাম!” কে কোথায় চললো? একদম শিমুলের বাবার কণ্ঠস্বর!
তারপরে দুঘন্টা পরে এলো সেই সংবাদ। দুঃসংবাদটা! মানুষটা চলে গেছে! এই বিশ্ব চরাচর ছেড়ে। না ফেরার দেশে। সংবাদটা জানিয়েছে শিমুলের বাবার দ্বিতীয় সংসারের কর্ত্রী। একেবারে বাড়ি বয়ে এসে উপস্থিত। শিমুলের বাবা নাকি বলে গেছে, “আমার কিছু হয়ে গেলে ঐ সংসারে গিয়ে উঠো! দয়াময়ী পাপন, কখনো কাউকে ফেলে দেয় না!”
মৃত্যুর আগে যাকে কখনো সম্মান দেয়নি তাকে এক অস্পৃশ্য রমণীর কাছে মহিমাময় করে রেখে গেছে সে মানুষটা! এসব ছল চাতুরীতে কান দেয় না পাপন, শিমুলের মা। কোনভাবে চারদিন পেরোতেই তাকে চলে যেতে বলেছে, “যে চুলোয় নিয়ে এতদিন তোমাকে রেখেছিলো সেই চুলোতেই ফিরে যাও। এ আমার পৈত্রিক ভিটা নয়। এখানে পাঁচটা আমার সমাজের লোক সাথে করে আমি বেঁচে ছিলাম। আমি এখানে ছিলাম তোমাদের ছাড়াই। এতদিন বেঁচেছি, আগামীতেও পারবো!” শিমুলের কঠোর সিদ্ধান্তের মায়ের কাছে ঐ দ্বিতীয়া পক্ষের আর ঠাঁই হয়নি।
মৃত্যু বড় রহস্যময়তা রেখে গেলো শিমুলের কাছে। কীভাবে এক পশলা বৃষ্টির মত কানের কাছে ছুঁয়ে দিয়ে গিয়েছিলো মৃত্যু সংবাদটা। সে এক রহস্যময় গভীর ব্যাপার। শিমুলের এক রাতের সেই কথাগুলোই কী বাবার হৃদয়ে বিবেকের জাগরণ তুলেছিলো? কে জানে! এ প্রশ্নের জবাব যে দিতে পারতো সে তো হারিয়ে গেছে! আগে তবু নাই মামার চেয়ে কানা মামা ছিলো। এখন তাও নেই। বাবাহীনতার এই দায় যেন নিজেরই। যে সারাজীবন কষ্টই দিয়ে গেলো সেই চলে গেলো অভিমানে সন্তানকে পিতৃমৃত্যুর দায়ে দায়ী করে। এ দায় থেকে তার মুক্তি কোথায়!
১৭ অক্টোবর - ২০১১
গল্প/কবিতা:
৪৪ টি
বিজ্ঞপ্তি
এই লেখাটি গল্পকবিতা কর্তৃপক্ষের আংশিক অথবা কোন সম্পাদনা ছাড়াই প্রকাশিত এবং গল্পকবিতা কর্তৃপক্ষ এই লেখার বিষয়বস্তু, মন্তব্য অথবা পরিণতির ব্যাপারে দায়ী থাকবে না। লেখকই সব দায়ভার বহন করতে বাধ্য থাকবে।
প্রতি মাসেই পুরস্কার
বিচারক ও পাঠকদের ভোটে সেরা ৩টি গল্প ও ৩টি কবিতা পুরস্কার পাবে।
লেখা প্রতিযোগিতায় আপনিও লিখুন
-
প্রথম পুরস্কার ১৫০০ টাকার
প্রাইজ বন্ড এবং সনদপত্র।
-
দ্বিতীয় পুরস্কার ১০০০ টাকার
প্রাইজ বন্ড এবং সনদপত্র।
-
তৃতীয় পুরস্কার সনদপত্র।
বিজ্ঞপ্তি
“জানুয়ারী ২০২৫” সংখ্যার জন্য গল্প/কবিতা প্রদানের সময় শেষ। আপনাদের পাঠানো গল্প/কবিতা গুলো রিভিউ হচ্ছে। ১ জানুয়ারী, ২০২৫ থেকে গল্প/কবিতা গুলো ভোটের জন্য উন্মুক্ত করা হবে এবং আগামি সংখ্যার বিষয় জানিয়ে দেয়া হবে।
প্রতিযোগিতার নিয়মাবলী