ধুসর চিঠি-উজ্জ্বল স্মৃতি

দেশপ্রেম (ডিসেম্বর ২০১১)

atmkader
  • ১৯
  • 0
  • ৫৭
- ক্যম্পাস ছেড়ে গ্রামের বাড়ি চলে এসেছি প্রায় দু’মাস। বিদায়ের আগে বন্ধুদের সাথে ঠিকানা বিনিময় করেছি । কথা ছিল সবাই যোগাযোগ রাখবে । কেউ কথা রাখেনি । বেশ ক’জনকে লিখে ও সাড়া পাইনি । অনেকটা হতাশ দিন কাটছিল । এক দিন দুপুরে পুকুর পাড়ে হিজল ছায়ায় বসেছিলাম, পিয়ন একটা নীল খাম ধরিয়ে দিয়ে গেল । ছাত্রাবাস থেকে রিডাইরেক্ট হয়ে এসেছে । অপরিচিত হাতের লেখা । বেশ আগ্রহ নিয়ে খুললাম । সুন্দর হস্তাক্ষর । লিখেছে,
- প্রিয় বুলবুল,
- অনেক অনেক ধন্যবাদ আমাকে তোমার গল্পের নায়িকা করার জন্য । কি করে যে এমন নিখুঁতভাবে আমায় আঁকলে ! আমার গালের ছোট্ট তিলটি পর্যন্ত তোমার দৃষ্টি এড়ায়নি । অথচ তুমি কখনো আমাকে দেখনি । সম্ভাবনা ও ছিলনা । আমার বাস সিলেটে । আব্বু চাবাগানের ম্যামেজার । আর তুমি থাক পার্বত্য চট্টগ্রামে । সত্যই কি আমাদের সাক্ষাৎ হয়েছিল স্বপ্নে ! আম্মুতো তাই বলেন । আমি কিন্তু তোমার গল্পটি পড়ার আগে এ রকম স্বপ্ন কখনো দেখিনি । এখন অবশ্য রোজই দেখি ! স্বপ্নের সে সুন্দর দেশটিতে দিব্বি তোমার হাত ধরে ঘুরে বেড়াই , গল্পের মতো করে কথা বলি, তোমাকে সবখানে নিয়ে যাই, সবকিছু দেখাই । তা অমন সুন্দর দেশটি আদৌ কোথাও আছে কি ! যেখানে ভেদাভেদ নেই, ঘৃণা নেই, নেই হিংসা-বিবাদ ! আছে শুধু মায়া-মমতা,স্নেহ-প্রেম ! আমর বান্ধবী ‘মৌ’ যার কাছে তোমাদের বার্ষিকীটা পেয়েছি, কাপ্তাই স্কুলের ছাত্রী ছিল । তার আব্বু বদলি হয়ে সিলেট আসায় ‘মৌ’ আমাদের স্কুলে ভর্তি হয় । সে বলে, তুমি নাকি ডেঙগা ছেলে । আমার মত পিচ্চির সাথে নাকি বন্ধুত্ব করবেনা । অবশ্য আমি এখনো ছোট । সবে অষ্টম শ্রেণীতে উঠেছি । আমি কিন্তু খুব করে তোমাকে চাই । আমাকে বন্ধু করে নেবে ? নইলে ভিষণ কাঁদবো ! আম্মু বলেন, তুমি অবশ্যই ভাল ছেলে । লেখকরা নাকি খুবই ভাল হয় । তাই সাহস করে লিখলাম । আশা করি প্রতিলিপি পাব । শুভেচ্ছান্তে,
তোমার গল্পের ‘পিংকি’
- কলেজ বার্ষিকীতে একটা গল্প ছাপা হয়েছিল । কাকতালীয়ভাবে কল্পিত নায়িকার সাথে বাস্তবের ‘পিংকি’ মিলে গেছে । ছোট্ট মেয়েটাকে দূষ্টোমি করে লিখলাম, ‘নিতে পারি যদি কথা দাও যে কখনো দেখা করতে চাইবেনা । আমাদের অভিসার শুধু স্বপ্নেই সীমিত থাকবে’ ।
- পিংকির উত্তর এল খুব তাড়াতাড়ি । লিখেছে শর্তে সে রাজী যদিও আমাকে দেখার খুব ইচ্ছে তার । ভিষণ খুশি হবে যদি কথা দিই যে কখনো যোগাযোগ ছিন্ন করবোনা । সেই শুরু, ছিলছিলা বন্ধ হয়নি কখনো ।
- তারপর বহুদিন কেটে গেছে । চাকুরি নিয়ে দেশের আনাচে কানাচে ঘুরে শেষটায় কক্স বাজারে থিতু হয়েছি । বিয়ে করেছি, বৌয়ের কোলে বাচ্চা এসেছে । পিংকি ও স্কুল কলেজ ডিঙ্গিয়ে ভার্সিটির শেষ সোপানে । হলে থেকে পড়ছে । এখন লেখায় আগের আবেগ অনেকটা স্তিমিত, পরিপক্ষতার নিঠোল ছাপ পষ্ট । ব্যস্ততা বেড়েছে দুজনেরই । তবু ও আমরা পরস্পরের জন্য সময় বের করে নিই, লিখি নিয়মিত । সুন্দর কাটছিল দিন । এলো ’৭১ । বাংলার আকাশে শকুনিরা ডানা মেলল । সর্বত্র অশুভ কিছুর শংকা ।
- ২৪ মার্চ চিঠি পেলাম পিংকির । লিখেছে সিলেঠ থেকে । খারাপ কিছুর আশংকা করছিলেন আব্বু-আম্মু । তাই আব্বু নিজে এসে হল থেকে নিয়ে গেছেন । সিলেঠে খুব একা লাগছে তার । আমাকে দেখার ইচ্ছেটাও নাকি দিন দিন প্রবল হচ্ছে । স্বেচ্ছায় শর্ত তুলে না নিলে ‘লোঠা কম্বল’ নিয়ে এক দিন ঠিকই বৌইয়ের দরজায় হাজির হবে, ইত্যাদি । চিঠি পড়ে মিতু (বৌ) আর আমি হাসি । মিতু বলে, চলনা সপ্তাহ খানেক ছুটি নিয়ে পাগলটাকে একটা সারপ্রাইজ দিয়ে আসি । আমি বলি, দেশের পরিস্থিতি তো ক্রমে আগুন হয়ে উঠছে । কি হয় আল্লাহ জানে । এ অবস্থায় যাওয়া কিছুতেই ঠিক হবেনা ।
- সন্ধ্যায় একটু বের হই, হাঁটাহাঁটি করি । মিতু আর বাবু ও সাথে থাকে । সেদিন ও বেরুলাম । হাঁটছি আর টুক টাক কথা বলছি । পেছন থেকে কেউ ডাকলো নাম ধরে । ফিরে দেখি মঈন । ডাক্তার । আমার কলেজ জীবনের বন্ধু, এই শহরেরই ছেলে । বিয়েথা করেনি আজো । মাকে নিয়ে থাকে চট্টগ্রামের মেহেদি বাগে । কুশলাদি জানার পর শহরের অবস্থা জানতে চাইলাম । এক কথায় বলল, ভালনা । বাংগালী-বিহারি দাঙ্গা হয়েছে কয়েক স্থানে, সাদা পোষাকে আর্মি বিহারিদের সাথে নেমেছে । শেরশাহ কলোনী জ্বালিয়ে দে’য়া হয়েছে । ‘বাবর’ আর ‘সোয়াত’ থেকে আরমস-অ্যামুনেশন আনলোড করছে আরমিরা । প্রতিবাদে ফেটে পড়ছে মানুষ । নিরীহরা বৌ-বাচ্চা গ্রামের বাড়িতে পাঠিয়ে দিচ্ছে । মঈন ও মাকে এখানে রেখে যেতে এসেছে ।
- ২৬ শে আগুন ছড়িয়ে পড়ে গোটা বাংলা দেশে । বাংলা দেশের সব ঘরে, সব হৃদয়ে ।
- যুদ্ধে যুদ্ধে কেটে যায় নয় মাস । হায়েনারা পরাস্ত হয় একদিন । দুমড়ানো মোচড়ানো এক চিলতে বাংলা দেশ রক্তের টিপ নিয়ে শির উঁচু করে দাঁড়ায় ।
- প্রাথমিক আনন্দ-উচ্ছাস-শোক কাটিয়ে মানুষ বাস্তবতার মুখোমুখি হয় । ছোট চাচা ফিরে আসেননি । মেঝ ভাই বাম পা’টা রেখে এসেছে । নীনা ভাবীকে তুলে নিয়ে গেছিল, এখন পাগল, বার বার খালি গোসল করেন । আমি কিছুটা ভাগ্যবান । কন্ঠ নালীর বাম পাশে ঘাড়ে আলতো ঠোঁটে চুমু এঁকে পালিয়ে গেছে চঞ্ছলা বুলেট কন্যা ।
- মাকে শান্তনা দিয়ে এক দিন ফিরে আসি কর্মস্থলে। এরই মাঝে পিংকির সিলেটের ঠিকানায় দুটো চিঠি ছেড়ে উত্তরের অপেক্ষা করছি ।
- উত্তর কিন্তু আসেনা আর । অশুভ কিছুর আশংকায় হৃদয় কেঁপে উঠে । অস্থির হয়ে উঠি । কি করি ! কি করি ! কি করে খোঁজ পাই ! অপেক্ষার প্রহর প্রতিদিন দীর্ঘ হতে থাকে ।
- খোঁজ অবশ্য আসে একদিন । একটি নীল খাম । লিখেছেন বাগানের বর্তমান ম্যানেজার । আমাদের চিঠি গুলো তার হাতে পড়েছিল । তিনি লিখেছেন, পিংকিরা স্বপরিবারে নিহত হয়েছেন । পিংকি অবশ্য আত্মহত্যা করেছিল । একেবারে সুস্থ মস্তিস্কে । সিদ্ধান্ত সম্ভবতঃ আগেই নেয়া ছিল । দরজায় বুটের লাথি পড়তেই পিংকি জানালা খুলে পরিস্কার ঊর্দুতে জানতে চেয়েছিল তাদের কমন্ডার কে ! মেজর কাছে এলে কাঁধে লাগানো ষ্টার দেখে সম্ভবতঃ নিঃশ্চিত হয়েছিল । তারপর শুধু দুটি শব্দ গুরুম গুরুম । প্রথমটা মেজরের খুলিতে আর দ্বিতিয়টা তার নিজের । পিংকির টেবিলে একটি অসমাপ্ত চিঠি পড়েছিল । আমাকে লেখা । ম্যানেজার সাহেব সেটিও পাঠিয়ে দিয়েছেন ।
- পিংকি লিখেছে--- প্রিয় বুলবুল, কেমন আছো ? বড় দেখতে ইচ্ছে করছে তোমাদের । আমরা ভাল নেই । যে কোন দিন আক্রান্ত হতে পারি । পালিয়ে যাবার জো নাই কোন । পাকিরা আছে সর্বত্র । আব্বু দমে গেছেন খুব । আম্মু অসুস্থ । সুগার বাড়ছে প্রতিদিন । সাড়াক্ষণ কাঁদেন । আগেভাগে আমাকে নিরাপদ স্থানে সড়িয়ে দেননি বলে আব্বুর সাথে রাগারাগি করেন । আমার শুধু একটাই দুঃখ—তোমার সাথে বুঝি দেখা আর হলোনা ! যদি মরি, দুঃখটা নিয়েই মরতে হবে ! হ্যাঁ মৃত্যুর কথা আজকাল খুব ভাবি । কত মেয়ে লাঞ্ছিতা হয়ে মরেছে পশু গুলার হাতে । আমি কিন্তু লাঞ্ছিতা হতে চাইনা – আল্লাহ চানতো হবোওনা । আব্বুর পিস্তলটা তাই সাথে রাখি সাড়ক্ষণ । যদি তেমন বুঝি, তাহলে--- বুঝতেই পারছ---মাথায় ঠেকিয়ে ট্রিগারে-------------------
- শেষ হয়নি বাক্যটা । তখনই হয়তো হায়েনারা এসে পড়েছিল । আর আমার বন্ধু পিংকি হারিয়ে গেল চিরতরে !
- পিংকির এই শেষ চিঠিটা আমাদের পারিবারিক এলবামে সংরক্ষিত আছে । প্রায় দেখি । কাগজের রং ধুসর হয়ে গেছে এখন । কিন্তু তার স্মৃতি আমাদের হৃদয়ে নক্ষত্রের মত উজ্জ্বল আজো । চিরকাল থাকবে ।
আপনার ভালো লাগা ও মন্দ লাগা জানিয়ে লেখককে অনুপ্রানিত করুন
সৌরভ শুভ (কৌশিক ) ধুসর চিঠি-উজ্জ্বল স্মৃতি ভালো-মন্দ লাগা মিশ্র অনুভুতি /
বিষণ্ন সুমন সূর্যকে আবারো ধন্যবাদ । গল্পকারকে নিয়মিত হতে অনুরোধ করছি ।
সূর্য এত বড় সময়ের ঘটনা ছোট গল্পের ছোট পরিসরে আনতে গিয়ে যে কতটা সমস্যা হয় সেটা আমি ভালই বুঝি, তাই ছোটখাট ত্রুটি বিচ্যুতি এড়িয়ে যাই (আমার গল্পেও এমন হয়ে থাকে) শেষটায় বেশ আবেগী হতে হয়। গল্পের আরো পাঠক পাওয়া উচিত ছিল।
প্রজাপতি মন অসাধারণ গল্প। পিংকির জন্য আমার গর্ব হচ্ছে। মরলে এভাবেই মরা উচিত।
নিলাঞ্জনা নীল কিছু বলার নেই...... কিছু কিছু লেখায় কমেন্ট করা যায়না...... অসাধারণ....! বা তার চেয়েও বেশি কিছু..........!!
খন্দকার আনিসুর রহমান জ্যোতি অসাধারন থিম। মুক্তি যুদ্ধ ভিত্তিক কাহিনীটি লেখকের পরিপক্ক হাতের ছোয়ায় একটি স্বার্থক গল্পের পরিপূর্নতা পেয়েছে। এ,টি,এম কাদের কে আমার প্রান ঢালা শুভেচ্ছা। সেই সাথে প্রিয়তে নিয়ে প্রান খুলে ভোট করলাম..................................
sakil আপনার লেখা ধুসর চিঠি দিয়ে এই সংখ্যার সকল লেখা পড়ে শেষ করলাম । আপনার লেখাটি বেশ ভাল হয়েছে । তবে পাঠক কম দেখে খারাপ লাগছে । আশা করি আগামিতে আরো গল্প পাব আপনার কাছ থেকে ।
আহমেদ সাবের বেশ সুন্দর গল্প। সুন্দর প্লট। সুন্দর বাক্য বিন্যাস। অনেক ভাল লাগল।
মিজানুর রহমান রানা কাগজের রং ধুসর হয়ে গেছে এখন । কিন্তু তার স্মৃতি আমাদের হৃদয়ে নক্ষত্রের মত উজ্জ্বল আজো । চিরকাল থাকবে ।--------------চমৎকার একটি গল্প। গল্পকারকে শুভেচ্ছা এই বিজয়ের মাসে।
M.A.HALIM বেশ সুন্দর গল্প। খুব ভালো লাগলো।

১৭ অক্টোবর - ২০১১ গল্প/কবিতা: ২ টি

বিজ্ঞপ্তি

এই লেখাটি গল্পকবিতা কর্তৃপক্ষের আংশিক অথবা কোন সম্পাদনা ছাড়াই প্রকাশিত এবং গল্পকবিতা কর্তৃপক্ষ এই লেখার বিষয়বস্তু, মন্তব্য অথবা পরিণতির ব্যাপারে দায়ী থাকবে না। লেখকই সব দায়ভার বহন করতে বাধ্য থাকবে।

প্রতি মাসেই পুরস্কার

বিচারক ও পাঠকদের ভোটে সেরা ৩টি গল্প ও ৩টি কবিতা পুরস্কার পাবে।

লেখা প্রতিযোগিতায় আপনিও লিখুন

  • প্রথম পুরস্কার ১৫০০ টাকার প্রাইজ বন্ড এবং সনদপত্র।
  • দ্বিতীয় পুরস্কার ১০০০ টাকার প্রাইজ বন্ড এবং সনদপত্র।
  • তৃতীয় পুরস্কার সনদপত্র।

আগামী সংখ্যার বিষয়

গল্পের বিষয় "স্থিতিশীলতা”
কবিতার বিষয় "স্থিতিশীলতা”
লেখা জমা দেওয়ার শেষ তারিখ ২৫ নভেম্বর,২০২৪