আয়না মন

সরলতা (অক্টোবর ২০১২)

জ্যোতি হাসান
  • ২০
  • ৪৭
আগামিকাল শুক্রবার বাদ জুমা মলির বিয়ে। ছোটোখাটো ঘরোয়া অনুষ্ঠান, পাত্রপক্ষের দশ-বারোজন আর মলিদের খুবকাছের জনা বিশেক আত্মীয়স্বজন। আত্মীয়স্বজনের বাইরে রয়েছেন শুধু মলিদের বাড়িওয়ালা ফিরোজ সাহেব আর উনার স্ত্রী ডোরা। মলির বাবা, সামাদ সাহেবের অবশ্য তাদের দাওয়াত দেয়ার ইচ্ছা ছিলো না, কিন্তু দাওয়াত না দিয়ে উপায়তো নেই, উনাদের ছাদেই খাওয়ার সব আয়োজন করতে হয়েছে! তাছাড়া, বিয়েতে উনি সবচেয়ে দামি উপহারটি দিয়েছেন!! তাও বিল্ডিংয়ের অন্যান্য ভাড়াটিয়াদের দাওয়াত দেয়া সম্ভব হলো না এইবার। অনেকেই হয়তো মনে দুঃখ পাবে কিন্তু সামাদ সাহেবের হাত বাঁধা। এইটুকু আয়োজন করতেই তার ভালোরকম কষ্ট হয়েছে। ছেলের পিছনেই খরচ হয়েছে সত্তুরহাজার টাকা। ছেলের পাঞ্জাবী-পায়জামা-শার্ট-কোর্ট- প্যান্ট-জুতা-স্যান্ডেল, আংটি আর একটা ভালো ঘড়ি এই জিনিসগুলো কিনতেই এই টাকাগুলো খরচ হয়ে গেলো!! ছেলেপক্ষ যদিও কিছুই চায়নি তারপরও একটি ডাবল খাট, একটি কাঠের আলমারি, আর ড্রেসিং টেবিল আনা হয়েছে যা মলির সাথে দিয়ে দেয়া হবে। খাটটি দিয়েছেন বাড়িয়ালা ফিরোজ সাহেব, আলমারিটি দিয়েছেন মলির একমাত্র চাচা, আর ড্রেসিং টেবিলটি এসেছে মলির বড় খালার কাছ থেকে। সবমিলিয়ে সামাদ সাহেব ভালোই খুশি। মলির বিয়ে হয়ে গেলে পরের দুই মেয়ের বিয়েতে আর কোন সমস্যা হবে না।

এখন বিকাল, সামাদ সাহেব বারান্দায় বসে রাস্তার দিকে মনোযোগ দিয়ে তাকিয়ে আছেন। বিয়ে উপলক্ষ্যে অফিস থেকে দুইদিনের ছুটি নিয়েছেন সামাদ সাহেব। আজ ছুটির শেষদিন, আগামিকাল শুক্রবারের বন্ধ আর শনিবার সামাদ সাহেবর অফিস বন্ধ থাকে। সামাদ সাহেব তার অফিসেও কিছুই জানায়নি, কেননা তাহলে আরও দশজনের খাবারের ব্যবস্থা করতে হতো। তবে এটা ঠিক, অফিস থেকে বিয়েতে সবসময় ভালো উপহারই দেয়া হয়......একটা টিভি পাওয়াই যেতো! এটা নিয়ে সামাদ সাহেবের মনে কিঞ্চিৎ আফসোস কাজ করছে। বাড়িটা আজ চুপচাপ, সামাদ সাহেবের বেশ আরাম লাগছে! অন্যদিন এই সময় টিভির আওয়াজে কান পাতাই যায় না। সামাদ সাহেবর একমাত্র ছেলে মন্টু সারাক্ষণই শুধু টিভি দেখে!

এই সময়ে সামাদ সাহেবের স্ত্রী রেহানা বেগম বারান্দায় আসে, উনি মুখটা কিছুটা কাঁচুমাচু করে রেখেছে। সামাদ সাহেব উনার স্ত্রীর এই ভঙ্গিটার সাথে পরিচিত!! স্বামীর কাছে কিছু চাইবার থাকলেই উনি এরকম মুখভঙ্গি করে উনার কথাটি বলেন!

“শুনছেন, বাচ্চারা আজ সন্ধ্যায় একটু গায়ে হলুদের মতো অনুষ্ঠান করতে চায়। আপনাকে কিছু করতে হবে না, বাচ্চারাই সব করবে...” রেহানা বেগম উনার কথা শেষ করতে পারেন না।

“হলুদ-টলদ এগুলা হিন্দুয়ানী আচার আমার বাড়িতে চলবে না! তোমাকে আগেই বলেছি না?! এখন আবার তাহলে কথা উঠে কেন?!” সামাদ সাহেব ভালো করেই জানেন কিভাবে উনার স্ত্রীকে থামিয়ে দিতে হয়! “যাও, আমার জন্য এককাপ চা নিয়ে এসো...দুধ বেশী দিবে আর চিনি অল্প!” সামাদ সাহেব বাইরে রাস্তার দিকে তাকিয়ে ভাবনায় ডুবে যান!

সামাদ সাহেবের কথাঃ শেষ আমার পর্যন্ত মলি মার বিয়ে হচ্ছে সেটাই বড় কথা! শুকুরআলহামদুলিল্লাহ!! সব মিলিয়ে মলির মার জন্য প্রায় পঞ্চাশটির উপরে ঘর আনা হয়েছিলো! কিন্তু একজনও মলিকে বউ করে নিতে চায়নি! মেয়েটা আমার জন্ম থেকেই হতভাগী! শুধু বাপের মতো কালো গায়ের রঙ হলে কথা ছিলো, কিন্তু মলি চেহারাটাও পেয়েছে বাপের! এই নিয়ে মলি স্কুলে কম কথা শুনেনি! মলির সাথে কেউ বন্ধুত্ব করতে চাইতো না! মেয়েটা আমার সারা জীবন বন্ধু ছাড়াই একা একা কাটালো! তার উপর, মলি পড়াশোনাতেও তেমন ভালো ছিলো না ...অনেক কষ্টে কলেজ পাড়ি দিয়েছে। আজকালকার ছেলে-ছোকড়ারা কম পড়ালেখা জানা মেয়ে বিয়ে করতে চায় না! সবমিলিয়ে আমার বিরাট দুশ্চিন্তার কারণ ছিলো মলি। আল্লাহ্‌ চাহেত আগামিকাল এই দুশ্চিন্তার শেষ হবে! তবে, আমি জানি আমার মলি মার ভালোই হবে, কেননা ও মায়ের মতোই বেশ সহজ-সরল আর বোকা। আর বোকারা বেশ ভালো বউ হয়, মলির মা যেমনটি একেবারে একজন আদর্শ গৃহিণী!! মলি এই বিয়েতে তেমন খুশি নয়, সেটা আমি ভালোই বুঝতে পারছি কিন্তু বিয়ের পর মলি মার অবশ্যই ভালো হবে কেননা ছেলেটা সৎ! বয়স একটু বেশী, দেখতে-শুনতে তেমন কিছু না কিন্তু খুবই বৈষয়িক! এখন কোনোমতে আগামিকাল ওর বিয়েটা হয়ে যাক, পরের দুইমেয়ের বিয়ে ঝড়ের বেগে দিয়ে দেয়া যাবে!! পরের মেয়েগুলো বুদ্ধি পেয়েছে বাপের আর রং-রূপ পেয়েছে মায়ের তাই ওদের নিয়ে খুব একটা চিন্তা না করলেও চলে!! আমি খুব ভালো করেই জানি, এই বাড়ির কেউ আমাকে দেখতে পারে না, সবাই আমাকে যমের মতোই ভয় পায় কিন্তু একটা সংসার চালাতে গেলে এরকম কঠোর না হলে চলে!?! সংসারের কর্তা হিসাবে আমি শতভাগ সফল কেননা আমার সংসারে এককাপ চাও আমাকে না জিগ্যেস করে বানানো হয় না!!

রেহানা বেগমের কথাঃ মলি কাল চলে যাচ্ছে! মেয়েটা আমার ভারী লক্ষ্মী আর সরলসোজা! আজ পর্যন্ত কোন যন্ত্রণাই দেয়নি! খুব ভালো হতো যদি আরও ভালো কোন ছেলে পাওয়া যেতো মলির জন্য! এই ছেলেটাকে, আসলে ছেলে বলা উচিৎ হচ্ছে না! এই লোকটাকে আমার নিজেরি পছন্দ হয়নি! বড় বুবুতো ছেলেটাকে দেখে খুব খারাপ একটা কথা বললেন, বললেন “মাগির দালালের মতো দেখতে”! বুবুর মুখে কিছুই আটকায় না, কিন্তু বুবু কথাটা সত্যি বলেছেন। পুরাই চালবাজের মতো লাগে দেখতে! মা হিসাবে আমি ব্যর্থ, মলির বিয়েটা আটকাতে পারলাম না! এটাও আমার ভাগ্য!! আমিতো দেখতে সুন্দরী ছিলাম, কিন্তু মলির বাবার মতো কুৎসিত, লোভী, স্বার্থপর, আর পাষণ্ড মানুষের সাথে ভাগ্যচক্রে আমার বিয়ে হোল!! এই লোক সারাজীবনই আমাকে জালিয়ে আসছে! বলা ঠিক না কিন্তু একটা সাপকে আমি যতোটা ঘৃণা করি মলির বাবাকে তার থেকে বেশী ঘৃণা করি! তার কাছে এখন হলুদ হিন্দুদের কাজ-কারবার অথচ উনার নিজের বিয়েতে কিন্তু ধুমধাম করেই হলুদ হয়েছিলো! মলির দিকে তাকানো যাচ্ছে না! আহারে আমার মেয়েটা!! দোয়া করি আমার থেকে হাজারগুণে বেশী সৌভাগ্যবতী হ তুই!!

মলির কথাঃ আগামিকাল আমার বিয়ে!! এইদিনটির জন্য সব মেয়েরাই বোধহয় সারাজীবন অপেক্ষা করে থাকে!! মেয়ে থেকে নারীতে পরিণত হবার দিনটিকে ঘিরে সব মেয়ের কতোই না পরিকল্পনা থাকে!! কতোই না আয়োজন থাকে!! কিন্তু আমার কোন আয়োজন নেই, নেই কোন পরিকল্পনা!! ভুল বললাম একটা পরিকল্পনা কিন্তু আছে!! সেটা যথা সময়ে সবাই জানতে পারবে!! সবচেয়ে ভালো হতো সেই সময়টাতে বাবার চেহারাটা দেখা গেলে!! (বাবার চেহারাটা কল্পনা করে মলি নিজে নিজেই হেসে ফেলে!! আবার তৎক্ষণাৎ হাসি পুরাপুরি মুছেও ফেলে! তারপর আগামিকালের পরিকল্পনাটা আরেকবার ভেবে দেখে!) আগামিকাল সকাল এগারোটার দিকে আমি বাড়িয়ালা ফিরোজ সাহেবের গাড়িতে বিউটি পার্লারে রওনা দিবো! সংগে থাকবে আমার দুইবোন! পার্লারে যেয়ে সাজগোজ শুরু করার আগমুহূর্তেই মোবাইলে ফোন করার বাহানায় পার্লারের বাইরে বেরিয়ে সোজা ফিরোজ সাহেবের গাড়িতে উঠে বসবো! তারপর ফিরোজ সাহেবের প্ল্যান অনুসারেই সব হবে! উনার অন্য আরেকটি বাড়িতে আমার জন্য একটি পুরো ফ্ল্যাট বরাদ্দ আছে! আদর করে ফিরোজ সাহেব ওই ফ্ল্যাটটির নাম দিয়েছেন “মলি মহল”! সাজানো গোছানো ওই ফ্ল্যাটটিতে শুরু হবে আমার নতুন জীবন! মলি মহলের পর্দা থেকে শুরু করে বাথরুমের টাইলস্ সবকিছুই আমার পছন্দ অনুসারে কেনা হয়েছে! ওই বাড়িতে গেলে আমি নিঃশ্বাস নিতে পারি! আমার আবার বাঁচতে ইচ্ছা করে! আমি জানি না, ফিরোজ সাহেব আদৌ আমাকে বিয়ে করবেন কিনা?! যদিও উনি আমাকে কথা দিয়েছেন যে, যত তাড়াতাড়ি সম্ভব আমাকে বিয়ে করবেন কিন্তু পুরুষ মানুষকে এখন আমার ঘৃণা হয়!! উনাকে বিয়ে করে সারাজীবন উনার সাথে কাটাতে আমার খারাপই লাগবে!! আমি জানি উনি আমার শরীরের প্রেমে পড়েছেন! আমার রূপ নেই কিন্তু শরীর নিখুঁত! শরীরের এই সুবিধাটা আমি নিবো! এটা ছাড়া আমার আর কোন রাস্তাও নেই!! বাবার ঠিক করা লোকটাকে আমি কখনোই বিয়ে করবো না, মরে গেলেও না!! ওই লোকটা আরেকটা সামাদ সাহেব হবে সেটা আমি ভালোই বুঝতে পারছি!! আমাকে ফিরোজ সাহেব দেবীর আসনে বসিয়েছেন! আমি অবশ্যই উনার ভক্তি-ভালবাসা-লোভটাকে কাজে লাগাবো!! আত্মহত্যার থেকে এটা অনেক ভালো!! ভাবতেই ভালো লাগছে আমার মতো “সরল-সোজা” মেয়ের কাহিনী যখন সবাই জানতে পারবে তখন আমি “গোবেচারা মেয়ে” থেকে “ডাইনি মেয়ে” তে পরিণত হবো!! কুখ্যাত ভিলেন হয়ে যাবো সবার কাছে!! যারা আমাকে চিনতো না, আমার ছায়াও মারাতে ঘৃণা করতো, তারাও আমার খোঁজ করবে!! আচ্ছা, সামাদ সাহেব এইসব দেখার জন্য বেঁচে থাকবে তো??!!! ভয় একটাই, ফিরোজ সাহেব বলেছেন উনি কাউকেই কিছু জানতে দিবেন না, সবকিছু ধামাচাপা দিয়ে দিবেন!! এমন ব্যবস্থা করবেন যেন বাবা কোন পুলিশি ঝামেলায় না যায় আর খুব বেশী লোকজন না জানতে পারে কেননা বেশী লোকজন জানলে উনারই অসুবিধা!! ইস্, কি যে হয় আগামিকাল!!! বেচারি মার জন্য মায়া লাগছে কিন্তু সবকিছু ঠাণ্ডা হতেই আমি মাকে নিয়ে যেয়ে আমার মহলটা দেখাবো!!

আয়নায় মন দেখা পর্ব এখানেই শেষ!! ভালো হতো যদি ফিরোজ সাহেবের মনের কিছু খবর এখানে দেয়া যেতো!! কিন্তু কিছু কিছু মানুষ আয়নাকে মন দেখায় না, তারা নিজেদেরকে বেশ ভালো করেই আড়াল করে রাখে!! শুধু আশা করা যায়, মলি নামের চিরদুঃখি, “সরল-সোজা”, আর জেদি মেয়েটির জীবন ভালো হোক, সুন্দর হোক!!
আপনার ভালো লাগা ও মন্দ লাগা জানিয়ে লেখককে অনুপ্রানিত করুন
জ্যোতি হাসান সবাইকে অনেক অনেক ধন্যবাদ!!! :) অনেকদিন পর আসলাম, সবার মন্তব্য পড়ে মনটা ভালো হয়ে গেল! :) সবাই শুভকামনা জানবেন!!! :)
খন্দকার আনিসুর রহমান জ্যোতি অনেক ভাল লাগল ...........কিছু কিছু মানুষ আয়নাকে মন দেখায় না, তারা নিজেদেরকে বেশ ভালো করেই আড়াল করে রাখে!!.....আয়না মন শিরনাম যথাযথ হয়েছে..........জ্যোতি হাসান শুভকামনা আপনার জন্য.................
মিলন বনিক হাসান ভাই...অপূর্ব সুন্দর একটা গল্প...আয়নার সাথে মানের বিশ্লেষনটা ভালো ভাবে ফুটে উটেছে...
তানি হক নামের সাথে চমত্কার মানান সই একটি গল্প ..ভিন্নরকম উপস্থাপনা ...সব মিলিয়ে অনেক সুন্দর একটি কাহিনী ...সুভেচ্ছা ও ধন্যবাদ জানাই...
সূর্য চরিত্র বিশ্লেষণ অনেক জটিল ব্যাপার। সারা জীবন একসাথে থেকেও পাশের লোকটিকে চেনা হয়ে ওঠে না। ব্যতিক্রমী উপস্থাপনা, সুন্দর গল্প।
ফারজানা মনি অনেক অনেক ভাল লাগল ।
রবিউল ইসলাম অনেক ভাল লাগল ।
জালাল উদ্দিন মুহম্মদ অনেক সুন্দর ! অনেক অনেক ভাল লাগল ।
সামিউল hoq আবার এখন পড়লাম গল্পটা! খুবই সুন্দর, কাছের মানুষেরাই সম্ভবত সবচেয়ে বেশি কষ্ট দেয়.... মেয়েটার আর হিরো হওই হলো না :(

১৪ অক্টোবর - ২০১১ গল্প/কবিতা: ১৬ টি

বিজ্ঞপ্তি

এই লেখাটি গল্পকবিতা কর্তৃপক্ষের আংশিক অথবা কোন সম্পাদনা ছাড়াই প্রকাশিত এবং গল্পকবিতা কর্তৃপক্ষ এই লেখার বিষয়বস্তু, মন্তব্য অথবা পরিণতির ব্যাপারে দায়ী থাকবে না। লেখকই সব দায়ভার বহন করতে বাধ্য থাকবে।

প্রতি মাসেই পুরস্কার

বিচারক ও পাঠকদের ভোটে সেরা ৩টি গল্প ও ৩টি কবিতা পুরস্কার পাবে।

লেখা প্রতিযোগিতায় আপনিও লিখুন

  • প্রথম পুরস্কার ১৫০০ টাকার প্রাইজ বন্ড এবং সনদপত্র।
  • দ্বিতীয় পুরস্কার ১০০০ টাকার প্রাইজ বন্ড এবং সনদপত্র।
  • তৃতীয় পুরস্কার সনদপত্র।

আগামী সংখ্যার বিষয়

গল্পের বিষয় "স্থিতিশীলতা”
কবিতার বিষয় "স্থিতিশীলতা”
লেখা জমা দেওয়ার শেষ তারিখ ২৫ নভেম্বর,২০২৪