মিথিলা মাহবুব আবার আজকের পত্রিকার “রবিরশ্মি” পাতাটা খুলে চোখ বুলালো এবং নিজের অজান্তেই তার ঠোঁটে ফুটে উঠলো স্মিত হাসি। সেই হাসিতে মিশে আছে কিছুটা অহংকার এবং বেশ কিছুটা আত্মতৃপ্তি। রবিরশ্মি পাতার পুরোটা জুড়েই আজ মিথিলা নিজে। মিথিলার সাক্ষাৎকার-মিথিলার জন্ম, ছেলেবেলা, কৈশোর, পড়ালেখা, স্কুল-কলেজ-ইউনিভার্সিটি জীবন, মিথিলার কাজ, এখনকার সাংসারিক জীবন, প্রিয় খাবার, প্রিয় মুহূর্ত...সবকিছু সুন্দরভাবে বর্ণনা করা আছে। সাথে আছে মিথিলার পারিবারিক এলব্যাম থেকে নেয়া মিথিলার বিশেষ বিশেষ মুহূর্তের বেশকিছু অসাধারণ ছবি। বাড়তি পাওয়া হিসাবে আছে মিথিলার উপর লেখা ফিচার, যেখানে সাক্ষাৎকার গ্রহণকারী মিথিলার কাজের পাশাপাশি, মিথিলার সাজগোজ, ফ্যাশান সেন্স, লাইফ স্টাইল নিয়েও ভূয়সী প্রশংসা করেছে। মিথিলা অজানা পাঠকের দৃষ্টিতে রবিরশ্মি পাতাটা পড়ে মিথিলাকে চিনতে-জানতে চেস্টা করে। “না, সাংবাদিক মহিলা ভালোই লিখেছে বলতে হবে, আমিতো নিজেই আমার প্রেমে পড়ে যাচ্ছি!!!” এই পর্যন্ত ভেবে মিথিলা নিজেই কিঞ্চিৎ লজ্জা পেয়ে যায় এবং রবিরশ্মি পাতাটা ভাঁজ করে সরিয়ে রাখে। মিথিলা জানালা দিয়ে বাইরে তাকায়, সেই চিরোচেনা প্রচণ্ড জ্যাম আর প্রচণ্ড রোদ। কে বলবে এখন বিকাল ৪টা বাজে!?!?! মিথিলা অবশ্য গাড়ির ভিতরে রোদের তাপ তেমন টের পায় না। মিথিলার মোবাইলে এইসময় ফোন আসে,
“হ্যালো আপা?! আপনি কতদূর?! আপনি আসছেন তো?!” ওপর প্রান্ত থেকে উদ্বিগ্ন স্বর শোনা যায় তাহামিনা খানের। তাহামিনা খান “আমরাও পারি” নামক সংগঠনের সংগঠক। উনার সংস্থাটি দুঃস্থ নারী-শিশু নিয়ে কাজ করে এবং এরই মধ্যে ভালোরকম সুনাম কামিয়েছে।
“অবশ্যই আমি আসছি, এখনও ফ্লাইওভার পাড়ি দিতে পারি নাই যদিও, অনেক জ্যাম। তবে ৫ টার মধ্যেই পৌঁছে যাবো। মন্ত্রি ম্যাডামের কি খবর?! উনি আসছেন তো সময়মতো?!” মিথিলা প্রশ্ন করে।
“জি, উনি সময়মতই আসবেন, উনার সেক্রেটারির সাথে মাত্রই কথা হোলো। আসেন তাহলে আপা, দেখা হবে।” তাহামিনা খান লাইন কেটে দেয়।
মিথিলা মোবাইল রেখে চোখবন্ধ করে হেডরেস্টে তার মাথা রেখে আরাম করে বসে এবং একসময় ঘুমিয়ে পড়ে।
মিথিলার ঘুম ভাঙ্গে তার ড্রাইভার কামরুলের ডাকে, “ম্যাডাম, আয়া পরছি!!”
মিথিলা উঠে বসে, ভাগ্যিস তার গাড়ির টিনটেড কাঁচ...কেউ ঘুমন্ত অবস্থায় মিথিলাকে দেখে ফেলেনি এটাই বড় ব্যাপার। মিথিলা ঝটপট তার ব্যাগ থেকে চিরুনি-আয়না-কাজল-লিপগ্লস-কম্প্যাক্টটা বের করে। নিউইয়ার্ক থেকে কিনা এই আয়নাটা খুললেই আয়নার চারপাশে উজ্জ্বল আলো জলে উঠে। সেই আলোতেই মিথিলা নিজেকে কিছুটা সাজিয়ে নেয়......মিথিলার অভ্যাস আছে তাই খুব একটা কষ্ট হয় না এইকাজগুলো দ্রুত সূক্ষ্ম ভাবে করতে। মিথিলার এই সাজগোজের সময়টাতে ড্রাইভার কামরুল গাড়ির বাইরে যেয়ে অপেক্ষা করে। তাকে সেরকমই করতে বলা হয়েছে। মিথিলা সাজবে আর তার ড্রাইভার ব্যাকভিউ মিররে আড়চোখে তাকে দেখবে, এটা মিথিলার কাছে খুব একটা রুচিসম্মত বলে মনেহয়নি। মিথিলা সাজগোজ শেষ করামাত্র জানালার কাঁচে টোকা পড়ে, তাহামিনা খান আর উনার কিছু কর্মী, মিথিলাকে নিতে এসেছে। মিথিলা গাড়ি থেকে হাসিমুখে নেমে তার শাড়িটা ঠিকঠাক করলো, সাধারণ তাঁতের শাড়ি তার পরনে।
“আপা, আপনি এসেছেন! আপনার ড্রাইভারকে দেখে বুঝলাম! আপনার কথা আমরা সবসময়ি বলি, আপনার প্রশংসা আমরা সবসময়ি করি। ঠিক সমসয়মত সব অনুষ্ঠানে চলে আসেন আর কথা দিয়ে কথা রাখেন”, বিগলিত হাসি হেসে তাহামিনা খান এক নিঃশ্বাসে প্রশংসার ঝড় তোলে।
“ধন্যবাদ, তাহামিনা আপা। মন্ত্রি ম্যাডামের খবর কি?! উনি এসেছেন?! সময়তো হয়ে গেছে।”, মিথিলা তার আঁচলটা ঠিক করতে করতে জিজ্ঞাসা করে। শাড়িটার পিছন দিকে অনেক ভাঁজ পরে গেছে, তাঁতের শাড়ির এটাই সবচেয়ে বড় সমস্যা...অল্পতেই কুঁচকে যায়।
তাহামিনা খান কিছুটা বিব্রত হয়ে উত্তর দেয়, “বুঝতেই তো পারেন, মন্ত্রি বলে কথা!! উনার আসতে কিছু দেরী হবে। উনার সেক্রেটারি জানালো ৭টা নাকি বেজে যাবে!!”
মিথিলা, “আপা, মন্ত্রি কিন্তু না, পতিমন্ত্রি, মহিলা বিষয়ক পতিমন্ত্রি!! অবশ্য পতিমন্ত্রি বলেন অথবা উপমন্ত্রি বলেন অথবা মন্ত্রি বলেন, উনারা কেউই সময়মত আসেন না!! যাহোক আপা, আমাকে যত তাড়াতাড়ি সম্ভব ছেড়ে দিয়েন, আমার বাচ্চাটার আগামিকাল পরীক্ষা আর ওর বাবাও দেশে নেই।”
তাহামিনা খান উত্তর দেয়, “অবশ্যই আপা!! আপনার বক্তৃতার পরপরই আপনাকে ছেড়ে দিতে পারবো। আপনার কথা শোনার জন্যই সবাই অপেক্ষা করে আছে!! এখন ভিতরে চলেন।”
মিথিলা সবার সাথে মিলনায়তনের ভিতরে ঢুকে, উপস্থিতির পরিমাণ বেশভালো! মিথিলা খুশি হয়, আজকাল নারি অধিকার রক্ষায় মহিলাদের পাশাপাশি পুরুষরাও বেশ সচেতন হয়ে উঠেছে! আজকের সভার মূল আলোচ্য বিষয় “স্বাধিকার এবং আজকের নারিদের অবস্থান।” মিথিলা আজকের তিনজন বিশিষ্ট আলোচকের একজন। মিথিলাকে নিয়ে তাহামিনা খান একেবারে সামনের সারির সোফাতে নিয়ে অন্যান্য অতিথিদের সাথে বসালো। মিথিলা সবাইকে চিনে, এনারা সবাই নিজেদের অবস্থান থেকে সফলভাবে নারি উন্নয়নের কাজ করে যাচ্ছে। উনারা সবাই নিজেদের মধ্যে গল্প করছিলো, মিথিলা উনাদের সাথে যোগ দেয়। সাবিহা বেগম নারি পোশাকশ্রমিকদের নিয়ে কাজ করে, উনি মিথিলাকে উদ্দেশ্য করে বললো, “মিথিলা, আমার মেয়ে তোমার বড় একজন ফ্যান। আজকে সকালেই আমাকে বলতেছিল, মা মিথিলা অ্যান্টিকে আমাদের বাসায় আসতে বোলোতো মা!! এখন তুমি বলো তুমি কবে আমার বাসায় যাবে?!”
মিথিলা হেসে বলে,“অবশ্যই একদিন আপনার বাসায় যাবো, আপনার বাসায় যেতে কি আমার এ্যাপয়নমেন্ট নেয়া লাগবে নাকি?!” এরই মধ্যে বেশকিছু উৎসাহি ভক্ত এসে মিথিলার সাথে ছবি তোলার বায়না ধরেছে, ভক্তদের মধ্যে কিশোরী এবং তরুণীদের সংখ্যাই বেশী। মিথিলা হাসিমুখে ভক্তদের আবদার পূরণ করে মিথিলা আবার ফিরে এসে সবার সাথে যোগ দেয়।
বিশিষ্ট আইনজীবী ব্যারিস্টার তৌহিদা ইসলাম, মিথিলাকে বলে, “মিথিলা, তুমিতো দেখছি খুবই পপুলার সবার কাছে!! আমরাতো একই পথের অনেক পুরানো পথিক, কিন্তু আমাদের কারো কাছে অটোগ্রাফ নিতে অথবা ফোটোগ্রাফ তুলতে কেউ আসে না। ওদের কথা বাদ দাও, আজ পর্যন্ত কোন পত্রিকায় আমার একক সাক্ষাৎকার ছাপা হয়নি পর্যন্ত!! আর সেখান তোমার জন্য সিনেমার নায়িকাদের মতো বরাদ্ধ হলো পুরো একটি পাতা!!” উনার কণ্ঠে লুকানো ক্ষোভ আর ঈর্ষা মিথিলা ঠিকই টের পায়।
মিথিলা বুঝতে পারে, সাফল্য সবসময় মধুর নয় আর তৌহিদা আপার মতো সিনিয়র একজন আইনজীবীর থেকে এরকম ব্যবহার কল্পনা করা যায় না। পরিস্থিতি সামলাতে এগিয়ে এলেন সাবিহা বেগম, “ঠিক বলেছেন তৌহিদা আপা! মিথিলা এখন দেশবাসির খুব প্রিয়পাত্রি!! বিশেষ করে নরসিংদীর ওই কেসটার পরের থেকে! আমাদের উচিৎ মিথিলার এই জনপ্রিয়তাকে কাজে লাগিয়ে আমাদের অন্দোলনকে আরও সামনে এগিয়ে নিয়ে যাওয়া!!”
এখন কিছু না বললে খারাপ দেখায়, তাই মিথিলা বলে উঠে, “মন্ত্রি ম্যাডাম এখনও আসছে না কেন?! সাতটা তো প্রায় বাজতে চললো! তাহামিনা আপাও যে কোথায় গেলো?!”
সাবিহা বেগম আবার কথা শুরু করে, “মিথিলা তোমার শাড়িটা খুব সুন্দর হয়েছে। তোমার শাড়ির পছন্দ খুব ভালো। আমার মেয়েতো আগে জিনস আর টপস ছাড়া কিছুই পড়তো না। তোমাকে দেখে এখন শুধু তাঁতের শাড়ী কিনে এবং আর ক্লাশে, পার্টিতে সব জায়গায় তাঁতের শাড়ি পরে। এই শাড়িটা কথা থেকে কিনেছো?! তোমার নিশ্চয়ই নিজস্ব একজন ডিজাইনার আছে, সেই সব শাড়ি তোমাকে ডিজাইন করে দেয়, তাই না?!”
মিথিলা জোরে হেসে ফেলে উত্তর দেয়, “সাবিহা আপা, কি যে বলেন? আমি ডিজাইনার পাবো কোথায়?! এই শাড়িটা কিনেছি নরসিংদীর একটা বাজার থেকে। যখন নরসিংদীর কেসটা শেষ করে ফিরছিলাম তখন হঠাৎ করেই বাজারের একটা দোকানে ঝুলানো এই শাড়িটা চোখে পড়ে। আমি গাড়ি থামিয়ে নেমে কিনে নেই। দাম বললে বিশ্বাস করবেন না, মাত্র চারশো টাকা!!”
সবাই এটা শুনে অবিশ্বাসের দৃষ্টিতে শাড়িটার দিকে তাকায়, হাল্কা আকাশি তার ভিতর ছোট ছোট নীল ফুল...খুবি চমৎকার ডিজাইন!! এরই মধ্যে খবর আসে, মন্ত্রি ম্যাডাম চলে এসেছেন, মিলনায়তনের ভিতরে বেশ চাঞ্চল্য দেখা দেয়। ঘাপটি মেরে চুপচাপ বসে থাকা সাংবাদিকেরাও দৌঁড়িয়ে গেটের কাছে এগিয়ে যায়।
ব্যারিস্টার তৌহিদা ইসলাম সেদিকে লক্ষ্য না করে মিথিলাকে প্রশ্ন করে, “মিথিলা দোকানের নামটা কি মনে আছে?! আমাকে দিতে পারবে?! আর তোমার অন্যান্য শাড়িগুলো কথা থেকে কিনো?! তোমার প্রত্যেকটা শাড়িই খুব সুন্দর!!”
মিথিলা তৌহিদা ইসলামের একটু আগের ব্যবহারটা ভুলতে পারে না, তাই একটু ঘুড়িয়ে উত্তর দেয়,“আপা, আমারতো তেমন কোন নির্দিষ্ট দোকান নেই, যখন যেখানে যে শাড়ি ভালো লাগে, সেটাই কিনে নেই! না আপা, সেই দোকানটার নাম মনে নেই, বাজারের রাস্তার পাশের ছোট একটা দোকান...”
ইতিমধ্যে, মন্ত্রি ম্যাডাম মিলনায়তনের ভিতরে ঢুকে পড়েছে, উনার সামনে সাংবাদিকদের হুড়াহুড়ি, আর তাহামিনা খান ম্যাডামের পাশে পাশে হাঁটছে। মন্ত্রি ম্যাডাম সরাসরি এসে মঞ্চে উনার আসন গ্রহন করে, তখন ঘড়িতে ৭টা পুরোপুরি বাজেনি। মন্ত্রি ম্যাডামের উনার পাশের চেয়ারে বসতে মিথিলাকে ইশারা করে। মিথিলা কারোদিকে দৃষ্টি না দিয়ে মন্ত্রির পাশের চেয়ারে যেয়ে বসে।
“আসসালামু আলাইকুম ম্যাডাম! আপনি কেমন আছেন?!” মিথিলা স্মিত হেসে মন্ত্রির কুশল জিজ্ঞাসা করে।
“ওয়ালাইকুম আসসালাম, মিথিলা! আমি ভালো আছি। তোমার সাথে আমার অনেক কথা জমে আছে। আজ তোমাকে এতো তাড়াতাড়ি ছাড়ছি না” মন্ত্রি ম্যাডাম মিথিলাকে যেন আশ্বস্ত করে।
যথারীতি তাদের আলোচনা শুরু হয়, নির্ধারিত সময়ের প্রায় দুঘণ্টা পরে শুরু হবার কারনে দর্শক-শ্রোতাদের সংখ্যাও অনেক কমে গেছে। অনেকটা ঘরোয়াভাবেই তাই আলোচনা চলে, মন্ত্রিকে কাছে পেয়ে সবাই সবার সমস্যাগুলো খোলাখুলি মন্ত্রির সাথে আলোচনা করে। ঘড়িতে তখন ৯টার বেশী বাজে, মিথিলা বাড়ি ফিরার জন্য উসখুস করছে। মন্ত্রি ম্যাডামকে না বলে মিথিলা উঠতে পারছে না, অথচ বাড়ি ফেরা মিথিলার একান্ত দরকার। মিথিলা সাহস করে মন্ত্রিকে বলেই ফেলল, “ম্যাডাম, আমাকে আজ ছেড়ে দেন, বাচ্চাটা বাসায় একা আর ওর আগামিকাল পরীক্ষা।”
মন্ত্রি কিছুটা ভ্রু কুঁচকিয়ে বলে, “বাচ্চাটা বাসায় একা মানে কি মিথিলা?! বাচ্চাকে কারো কাছে রেখে আসতে পারলা না?! আর তোমার সাথে আমি কথাইতো বলতে পারলাম না।”
“আসলে ম্যাডাম পুরোপুরি একা না, আমার মা আছে, আমার বাচ্চার সাথে......” মিথিলা বুঝাতে চেষ্টা করে।
মন্ত্রি মিথিলাকে তার কথা শেষ করতে দেয় না, “তাহলে তো হলোই, আর বাচ্চারা নানি-দাদির কাছে ভালোই থাকে। এখন তোমার কথা বলো, নরসিংদীর মেয়েটার কি খবর?! প্রধানমন্ত্রি নিজে আমাকে খোঁজ নিতে বলেছিলো।”
মিথিলা আশেপাশে তাকিয়ে দেখে, সবাই তাদের ঘিরে বসে আছে আর সবাই মিথিলার দিকে তাকিয়ে আছে। নিশ্চয়ই আশেপাশে সাংবাদিকেরাও আছে। মিথিলা বলে, “ম্যাডাম, আপনাকে পরে ফোনে সবখুলে বলি?!”
মন্ত্রি বুঝতে পারে মিথিলার ইতস্ততঃ ভাব, তাই উনার সাথের লোকদের দেকে বলে, “অনেক রাত হয়েছে, অনুষ্ঠান শেষ...যাদের কাজ নেই তাদের চলে যেতে বলো।”
বিশাল মিলনায়তনে তখন খুব বেশী হলে ১০-১২ জন। মিথিলা মন্ত্রিকে জানায়, “ম্যাডাম, মেয়েটা তো সেফ হোমে আছে আর নিয়মিত ওর কাউন্সেলিং চলছে। আপনাদের সাহায্যও নিয়েই তো ধর্ষকদের ধরা গেলো, এখন মামলা চলছে। তবে আশার কথা ধর্ষকদের এখনো জামিন হয়নি।”
মন্ত্রি এইটুকু শুনে নিয়ে বলে, “সব তোমার জন্যই সম্ভব হয়েছে মিথিলা! দেশের আনাচে-কানাচের খবর রাখা সম্ভব না আমাদের পক্ষে। তোমাদের মতো কিছু সাহসী মানুষ আছে, যাদের জন্য আমরা জানতে পারি সমাজের এইসব অনাচারের কথা তা নইলে এই মেয়েটাকেও হয়তোবা হারাতে হতো!”
এইসব কথা বলতে বলতে কখন যে ঘড়ির কাঁটা রাত ১১টা ছুঁইছুঁই করছে, সেটা কেউ খেয়াল করে না। মন্ত্রির সেক্রেটারি মন্ত্রির কানে কানে অনেক রাত হয়ে গেছে, এটাই হয়তোবা বলে কেননা, তারপরেই মন্ত্রি বলেন, “চলো উঠা যাক, সরি, তোমাদের সবার দেরী করিয়ে দিলাম। মাঝে মাঝে আড্ডা মারতে ইচ্ছা করে। আজকে তো আড্ডাই দিলাম, কি বলো?!” মন্ত্রির কথায় সবাই হেসে উঠে। তাহামিনা খান বলেন, “আমাদের খুব ভালো লাগলো ম্যাডাম আপনার সাথে এভাবে কথা বলতে পেরে। আবার আপনাকে কবে এরকম ফ্রি পাবো, কে জানে?!”
মন্ত্রি হেসে গেটের দিকে এগোতে থাকে, মন্ত্রির একপাশে তাহামিনা খান আর আরেকপাশে মিথিলা। গাড়িতে উঠতে উঠতে মন্ত্রি মিথিলাকে উদ্দেশ্য করে বলে, “মিথিলা, তোমার শাড়িটার কথা বলা হয়নি, শাড়িটা খুব সুন্দর হয়েছে আর তোমাকে মানিয়েছে বেশ!! আসি তাহলে!”
মিথিলা হেসে হাত নেড়ে মন্ত্রি ম্যাডামকে বিদায় দেয়। তারপর সবার কাছ থেকে বিদায় নিয়ে গাড়িতে উঠে তখন রাত ১১টার কিছু বেশী বাজে। গাড়িতে উঠে নিজের মনেই মিথিলা বলে, “নাহ, অনেক দেরী হয়ে গেলো!” মিথিলা তার মাকে ফোন দেয়, তার ছেলের খোঁজ নেয়। ছেলে ইতিমধ্যে খেয়ে ঘুমিয়ে গেছে শুনে মিথিলা স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলে।
গাড়ির সীটে গা এলিয়ে দিয়ে গান শুনতে থাকে মিথিলা, নিচু আওয়াজে বাজতে থাকে মৌসুমি ভৌমিকের বিখ্যাত গান, “আমি শুনেছি সেদিন তুমি...”
মিথিলার গাড়ি তখন রমনা পার্কের পাশের দিয়ে যাচ্ছে, এলাকাটা ভালোই অন্ধকার। হঠাৎ মিথিলার চোখে পরে পার্কের পাশের ফুটপাত ধরে শাড়ি পড়া একটি মেয়ে দৌঁড়িয়ে যাচ্ছে, আর মেয়েটির পিছু নিয়েছে বেশকিছু লোক। মিথিলা তার ড্রাইভার কামরুলকে গাড়ি থামাতে বলে। কামরুল বলে, “ম্যাডাম গাড়ি থামামু, আশেপাশে কিন্তু কোন গাড়ি দেখি না, কোন লোকজনও নাই...”
মিথিলা রেগে উঠে, “আহঃ কামরুল, যা বলছি তাই করো। গাড়িটা আরেকটু আগে নিয়ে থামাও। দেখতে হবে ব্যাপারটা কি?!”
একটু এগিয়ে এসে গাড়ি থামায় কামরুল। মিথিলা গাড়ির দরজা খুলে নামে, মেয়েটা এখনও দৌঁড়ে আসছে আর লোকগুলো মেয়েটির পিছন পিছন আসছে যেন বাংলা ছায়াছবির কোন দৃশ্য। মিথিলা কিছুই ভাবতে পারে না। চিৎকার করে, হাত নাড়িয়ে মেয়েটিকে ডাকে, “এ্যাই মেয়ে, এদিকে এসো, তাড়াতাড়ি!!”
মেয়েটি দৌঁড়ে মিথিলার কাছে আসে, মিথিলা তাড়াতাড়ি মেয়েটিকে গাড়িতে ঢুকিয়ে দিয়ে নিজে উঠে পরে। কামরুল দ্রুত গাড়ি স্টার্ট দিয়ে গাড়ি ছুটায়। মিথিলার গাড়ি বাংলামটরে পৌঁছে, মিথিলা তখনো শান্ত হতে পারেনি। গাড়ির ভিতরের লাইট জালিয়ে মিথিলা মেয়েটিকে দেখে। মিথিলা নিজের ভুল বুঝতে পারে, মেয়েটি ভালো না...মেয়েটির সাজগোজ দেখে যে কেউই এটা বুঝতে পারবে। মেয়েটির বয়স সতেরো- আঠারো, গায়ের রঙ শ্যামলা তার মধ্যে দিয়েছে টকটকা লাল রঙের লিপিস্টিক, গালে গোলাপি রঙ, চোখের উপর সস্তা নীল রঙের পুরু প্রলেপ, চুলগুলো অবশ্য শ্যাম্পু করা। মিথিলার হতভম্ব ভাব দেখে মেয়েটি উচ্চস্বরে হেসে উঠে, “জি আপা, আপনি ঠিকই ভাবছেন, আমি একজন খারাপ মেয়ে! আপনাকে অনেক ধন্যবাদ, আমাকে সামনের সিগন্যালে নামিয়ে দিলেই হবে।”
ঘোর কাঁটতে মিথিলার কিছু সময় লাগে। কিছুটা ইতস্থতঃ করে মিথিলা বলে, “ইয়ে, তুমি চাইলে তোমাকে সাহায্য করতে পারি আমি। আমার নিজের একটি সংস্থা আছে......”
মিথিলাকে তার কথা শেষ করতে না দিয়ে মেয়েটি বলে উঠে, “না আপা, আমি ভালোই আছি। আপনার সাহায্যের কোন দরকার নেই আমার...আরেকটূ সামনেই আমি নামবো”
মিথিলা মেয়েটিকে প্রশ্ন করে, “তুমি বলছো তুমি ভালোই আছ, তাহলে ওই লোকগুলো কে, তোমাকে তাড়াই বা করছিলো কেন?!”
মেয়েটি আবারো উচ্চস্বরে হেসে উঠে, “লোকগুলো আমার কাস্টোমার। বুঝলেন না, আমি একা মানুষ আর ওরা পাঁচজন তাই আমি দৌঁড়াচ্ছিলাম। আমাদের মতো মানুষেরও তো আপা ইজ্জত আছে, কি বলেন?! গাড়িটা থামাতে বলেন, আমি নামবো!!”
মিথিলা যেন ঘোরের ভিতরে আছে, ড্রাইভারকে উদ্দেশ্য করে ভোঁতা গলায় বলে, “কামরুল গাড়িটা সাইড করে থামাও।”
মেয়েটা দরজা খুলে গাড়ির বাইরে একপা রাখে। মিথিলা বলে উঠে, “একটা জিনিস লক্ষ্য করেছ?! তোমার শাড়ি আর আমার শাড়ি কিন্তু পুরোপুরি একরকম। আর এই শাড়ির সাথে লাল ব্লাউজ কখনো পরবে না, সাদা অথবা নীল রঙয়ের ব্লাউজ পরবে। তাহলে দেখবে তোমাকে আরও সুন্দর দেখাবে!!”
মেয়েটি কিছুক্ষণ হতভম্ব হয়ে তাকিয়ে থাকে তারপর হিস্টেরিয়াগ্রস্থ রোগীর মতো উচ্চস্বরে হেসে উঠে। আশেপাশের অন্ধকার কোণগুলোও যেন মেয়েটির হাসি শুনে নড়েচড়ে বসে!! মেয়েটি হাসতে হাসতেই ওই অন্ধকারে হারিয়ে যায়।
মিথিলার ঘোর ভাংলো ওর নিজের এপার্টমেন্টে ঢুকে। কখন গাড়ি থেকে নেমে লিফটে উঠেছে এবং লিফট থেকে নেমেছে মিথিলা বলতে পারবে না। মিথিলা বেডরুমে ঢুকে শাড়ি ছাড়লো, তারপর ঢিলা কাপ্তান পরে বেডরুমে থেকে বেরিয়ে এলো, দুহাতে তার শাড়িটা ভাঁজ করে ধরা। ড্রাইভার কামরুল তখন গাড়ির চাবি আর কাগজপাতি দিতে এসেছে। মাথা নিচু করে খাওয়ার টেবিলের উপর চাবি রাখে কামরুল, “ম্যাডাম এই যে চাবি আর বুলুবুক!!”
মিথিলা তার চিরাচরিত মালিকস্বরূপ কণ্ঠে বলে উঠে, “কামরুল এই শাড়িটা নিয়ে যাও, তোমাদের বস্তির কাউকে দিয়ে দিও। আর কাল সকালেই গাড়ি নিয়ে যাবে, সোফার জন্য নতুন কাভার কিনতে হবে। পুরাতন কাভারগুলো সকালে এসেই খুলে ফেলে দিবে, ঠিক আছে?!”