শেষ রাতের আন্তঃনগর এক্সপ্রেস ট্রেনটা শব্দের ঝড় তুলে তিব্র গতিতে এইমাত্র স্টেশন থ্রোপাশ করে গেল। দাম্ভিকতায় ধেয়ে আসা ট্রেনের ভরিক্কি যান্ত্রিক শব্দের রেশ টুকুন সুদুরে মিলিয়ে যেতে না যেতে রেল কলোনীর মসজিদ থেকে ফজরের আজান ধ্বণী কানটাকে আরো সজাগ করে তোলে। ঘুম থেকে জেগে ওঠে কাঞ্চিয়া। ক্লান্তিহীন দীর্ঘ রাতের অলসতা কাটিয়ে ঘর থেকে বাইরে বেড়িয়ে আসে। উঠোনে দাঁড়িয়ে উত্তর আকাশের দিকে মুখ তুলে তাকায়। করজোড়ে প্রজ্জ্বলিত ধ্রুব তারা’কে ভক্তিভরে প্রনাম করে। তারপর শুওরের বাচ্চাটাকে খেতে দিয়ে বাবার ঘরের দিকে দ্রুত পা বাড়ায়। এক্ষুনি কাজে বেড়িয়ে পড়তে হবে। নইলে রক্ষে নেই...দেরি হলে স্টেশনের বাবুদের হাতে নির্ঘাৎ গালমন্দ শুনতে হবে। ইতোমধ্যে গোটা হরিজন পাড়া জেগে উঠেছে শুওর গুলোর চিৎকারে। অথচ বাবার উঠার কোন নাম নিশানা নেই। বিরক্তি মাখা কন্ঠে দরজার ঝাপিটা ফাঁক করে ব্যাস্ততার সাথে ডাকতে থাকে বাবাকে। কিন্তু না বুড়ো শিরিশ ডোম অর্থাৎ কাঞ্চিয়ার বাবার কোনো সারা শব্দ নেই। কাপটি মেরে পড়ে আছে বুড়ো। একেতো শীতের ভোর তার উপর কাল রাতে একটু বেশী মাত্রায় তাড়ি খেয়ে ফেলেছিল। বেহুশ হয়ে পড়ে আছে বেচারী। কাঞ্চিয়ার ডাকাডাকিতে একবার শুধু নড়েচড়ে পাশ ফিরেছে মাত্র। নেশার ঘোর কাটেনি এখনো।
কাঞ্চিয়াও নাছোড় বান্দা বাবাকে যে উঠতেই হবে। না হলে আজ আর কজে যাওয়া হবে না। তিক্ত অভিজ্ঞতার জের ধরে এক অজানা আশঙ্কায় রাগ আর অভিমান মিশ্রিত বিরক্তি মাখা কন্ঠে একাএকা নীচু গলায় বকবক করতে থাকে।
t ইমনিতি ইস্টিশনের বাবুরা সারাক্ষণ আগুন হোয়ি থাকে....একটু দেরি হোলি বাবুগি গালমুন্দ শুনতি শুনতি কান ঝালাপালা করে...বাব্বা তার চোকতো না যেন আগুনির হাপর...নজরের তাপে চোকের দিকে তাকাতি ভয় করে।
t আগে অবশ্যি এরম ছিলনা বাবুডা। ইস্টিশনের মিষ্টি পানে মুখ টুকটুহে করে হেইসে হেইসে কতা কতো। এক আধদিন কাজে যাতি দেরি হলি মুচকি হেইসে কুশোল জানতি চাতো। কুনো কুনো দিন ভালবেইসে এক আদখান পানও খাতি দিতো। খুব ভাল মানুষ ছিল বাবুডা। বাবার সাথি তো ভীষণ ভাব ছিল। বাবা’রে তাড়ি আর খৈনি খাতি দিতো মাগনা। বাবার কাছে বাবুডা যেন সাক্ষাৎ দেবতা ছিল। আসলে মানুষের ভালমুন্দডা বাইরে থেকে বুজতি পারাডাও এক ধরনের বোহামীই কোতি হবি। না হলি এরম হবি ক্যান.................
এরই মধ্যে বুড়ো শিরিশ ডোম ঘর থেকে কচ্ছপের মতো মাথা বের করে বাইরে আসবার চেষ্টা করে কিন্তু পারেনা। নেশার ঝুলে পেন্ডুলামের মতো দোল খেতে থাকে। ঘটনা বুঝে দৌড়ে গিয়ে কাঞ্চিয়া বাবাকে সহযোগিতা করে। ছোট শিশুর মতো আদোর মেশানো সুরে বাবাকে অভ্যর্থনা জানায়........................
t উটেচো ! এইতো সোনা মুহি বাবা আমার....এবার যাও চোহেমুহে পানি দিয়ে চাঙ্গা হয়ি নাওগে যাও…. আমি হাতের কাজ টুহুন সেইরে আসতিছি...............
টলটলায়মান অবস্থায় মুখে এক ধরনের অস্ফুট প্রলাপ বোকতে বোকতে শিরিশ ডোম কলতলার দিকে চলে যায়। বাবার শরীরের দুরাবস্থা দেখে বুকের গভীর থেকে চাপা ধরনের একটা কষ্টের নিশ্বাস বেড়িয়ে আসে কাঞ্চিয়ার। বুড়ো অবস্থায় বাবা আর আগের মতো নেশাভাং করে নিজেকে সামাল দিতে পারেনা। শারীরিক ভাবে সে অনেকটা দুর্বল হয়ে গেছে। ইদানীং এখানে ওখানে বেহুশ হয়ে পড়েও থাকে। কাঞ্চিয়া নিজের শরীরে ভর করে বাবাকে ঘরে এনে শুইয়ে দেয়। নেশাগ্রস্থ বাবাকে নিয়ে টানা হেচড়া করতে ওর ভাল লাগেনা। কখন যে কি হয়ে যায় বলাতো যায়না। তাই বাবাকে অমন করে নেশাভাং করতে দেখলে ভয় হয়।
ডোমের ঘরে জন্ম তাই আচরণের দিক থেকে নেশা’কে কখনো খাটো করে দেখেনা কাঞ্চিয়া। নেশা’টা ওদের পারিবারিক আচার আচরণে সন্মান জনক ভাবে স্বীকৃত। নিজেও ইচ্ছে মতো নেশাভাং করে। শুধু বাবার জন্য ওর যত ভাবনা....বয়স বিবেচনায় ইদানীং এ ব্যাপারে বাবা কোন নিয়ন্ত্রন রাখতে পারছেনা।
মায়ের অবর্তমানে বেচারা মানসিক ভাবে যে কষ্টের গ্লানি বয়ে বেড়ায় তাতে করে বাবার মুখের দিকে তাকালে ভীষণ মায়া হয় ওর। তাই মায়ের স্মৃতিটুকু ভুলে থাকবার জন্য নেশার মতো চিত্ত বিনোদন থেকে তাকে বঞ্চিত করতে চায়না। বাবার সংসার ছেড়ে মা চলে যাবার পর থেকে কত কষ্ট করে বেচারা ওকে কোলে পিঠে করে মানুষ করেছে। মেয়ে হয়ে সে কষ্টের ঋন কিছুটা হলেও শোধ করতে চায় কাঞ্চিয়া। তাই ভয় হয় বাবার যদি কিছু হয়ে যায়? আপন বলতে তো ঐ বাবাই একমাত্র ভরষা। মাতৃহীন পরিবারে মমতায় ঘেরা নিরাপত্তার নির্মল আশ্বাস ঐ বাবা। সুতরাং বাবাকে ছাড়া আজকের সমাজে মাথা উচু করে একা পথ চলা দুস্কর। এরই মধ্যে হাড়ে হাড়ে তা টের পেয়ে গেছে কাঞ্চিয়া।
মনে পড়ে সেদিন বাবাকে ছাড়া একাই কাজে এসেছিল। স্টেশনের পশ্চিম মাথায় রক্ষিত ডাক বাক্সটার উপর ঘাপটি মেরে বসে থাকে ছোটবাবু। বসে বসে সিগারেট খায় আর খুকখুক করে কাশতে থাকে বুড়োটা। কি গরম কি শীত আল্লাহর ত্রিশটা দিন কাক ভোরে উঠে ওখানেই এসে বসেন তিনি। কাঞ্চিয়া চাকরীতে আসার পর থেকে ছোটবাবুর ঐ একই নিয়োম দেখছে.....কোন ব্যাতিক্রম নেই তার।
সেদিন ঘুলিঅন্ধকার ভোরে কাঞ্চিয়া নিয়োমিত ছোটবাবু’কে ‘রামরাম’ জানিয়ে ১নং প্লাটফরমের কাজ শুরু করেছিল। ছোটবাবুও অভ্যাস মতো কাঞ্চিয়াকে দেখে প্লাটফরমের এমাথা থেকে ওমাথা পায়চারী শুরু করে দেন। চকিতে সেদিন কেমন যেন বন্য পশুর মতো নোংড়া ইতোর বলে মনে হয়েছিল ছোটবাবু’কে। প্রতিদিন বাবাকে সাথে নিয়ে কাজে আসে.....আজ একা পেয়ে কি বেইজ্জতি করতে চায় বুড়োটা ?!
অজানা আশঙ্কায় বুকটা কেপে উঠেছিল কাঞ্চিয়ার। আসলে ভাল না ছাই, ধারী ছুঁচো ওটা...সব সময় ছুঁত ছুঁত করে বেড়ায়। সেদিন থেকে কাঞ্চিয়া বুঝে ফেলে ছোটবাবুর ধানাই পানাই। প্রথম প্রথম তাড়ি আর খৈনী খাইয়ে বাবাকে হাত করবার চেষ্টা করেছিল। কিন্তু কাঞ্চিয়া বাবাকে নেশাভাং করতে বারণ করে দেয় ছোটবাবুর সাথে। ব্যাস সেই থেকে কাঞ্চিয়ার কাজের উপর খবরদারি আর তদারকির মাত্রাটা বেড়ে যায়। ইদানীং কাজে কামে এতটুকু ছুঁত পেলেই বেতন বন্ধ আর চাকরি নাশের হুমকি দেয়।
কাঞ্চিয়া যতটুকু পারে গা বাঁচিয়ে কাজ করার চেষ্টা করে। কারো সাথেও থাকেনা পাছেও থাকেনা। কাজ ফুরালে সোজা গিয়ে ওঠে হরিজন পাড়ায়। আপন সংসার নিয়ে মেতে থাকে। সংসারে এক বাবা আর ঐতো শুওরের বাচ্চাটা...............মায়ের কথা ওর মনে পড়েনা।
বাবার মুখে মায়ের কথা বহুবার শুনেছে। ভীষণ সুন্দরী ছিল ওর মা। বাবার মতে হরিজনদের ঘরে অমন সুন্দরী নাকি থাকতে নেই। কাঞ্চিয়ার মুখে মা ডাক না ফুটতেই বাবার সংসার ছেড়ে ধর্মান্তরিত হয়ে মুসলমান পরিবারের একজনের সাথে নতুন করে সংসার পাতে ওর মা। মাঝে মাঝে বাবার মুখে গল্প শুনে মনে হয়েছে মাকে বাবা আজো ভীষণ ভালবাসে। কিন্তু পরক্ষনেই পরিনতির বাস্তব দিকটা চিন্তা করে মায়ের সৌন্দর্যের প্রতি ঘেন্নায় শরীরটা রিরি করে উঠে।
‘মা’ চলে যাবার পর দ্বিতীয় বারের মতো বিয়ের প্রস্তাব নিয়ে অনেকেই বাবার কাছে এসেছিল...তবে বিয়ে সে করবেনা বলে সবাইকে সাফ সাফ জানিয়ে দেয়। এমনকি দুই ডজন শুওরের লোভ দেখিয়েও ওরা বাবাকে দ্বিতীয় বিয়েতে রাজি করাতে পারেনি। কারন একটাই মেয়ের মুখের দিকে তাকিয়ে পরিবারে অশান্তির মাত্রাটা আর বাড়াতে চায়নি শিরিশ ডোম। কথা গুলো কাঞ্চিয়া হরিজন পাড়ার বাসন্তি কাকির মুখে শুনেছে। মা হারা মেয়েটাকে সময়ে বাসন্তি কাকিই দেখাশুনা করে ওকে।
সবাই বলাবলি করে মেয়েটা ওর মা’য়ের গড়ন পেয়েছে। হরিজন পাড়ায় ও নাকি ক্লিওপেট্রা। ক্লিওপেট্রা কি সেকথা বোঝেনা কাঞ্চিয়া। শুধু এইটুকু বোঝে সুন্দরী মার্কা প্রশংসা করে লোকে ওকে নিয়ে মায়ের মতোই অন্য রকম চিন্তা ভাবনা করে। যা কিনা কাঞ্চিয়ার মোটেও সহ্য হয়না।
তাই মায়ের আচরণগত পরিনামের কথা ভেবে শুওরের বাচ্চাটাকে নিয়ে যতটুকু সম্ভব হরিজনদের মতোই থাকার চেষ্টা করে। কেননা সমাজে মায়ের কলঙ্কময় পরিনতি বারবার ওকে তাড়িত করে।
মনটা বেশী মাত্রায় বিষিয়ে গেলে তাড়ি খেয়ে শুওরের বাচ্চাটাকে বুকে জড়িয়ে পড়ে থাকে ঘরে। হরিজন পাড়ার বাইরের কুৎসিত জগৎটাকে সে ভুলে থাকতে চায়। কিন্তু জীবিকার তাগিদে ওকে বাইরের গন্ডিতে পা রাখতেই হয়। সবাই ওদের নিকৃষ্ট নীচুজাত বলে ঘেন্না করে অথচ উঁচুজাতের মানুষ গুলো কেন যে ওকে শুওরের মতো খাবলে খেতে চায় তার অর্থ খুঁজে পায়না কাঞ্চিয়া।
তাই বাবা বিহনে ভবিষ্যত একাকিত্বের মর্ম বেদনায় সঙ্কিত থাকে সব সময়। বর্তমানের কথা ভেবে বাবার অবর্তমানে ভবিষ্যতের জন্য তাই শুওরের বাচ্চাটাকে সে মানুষ করার ব্রতি নেয়। কেননা মানুষের চেয়ে শুওরের বাচ্চাকে বিশ্বাস করা ওর কাছে অনেক সহজ বলে মনে হয়। ইতোমধ্যে শুওরের বাচ্চাটাকে বেশ কিছু অনুশীলন শিখিয়ে ফেলেছে। নাম ধরে ডাক দিলে ঘোঁৎ ঘোঁৎ শব্দ করে বিদ্যুৎ গতিতে দৌড়ে কাঞ্চিয়ার পাশে এসে দাঁড়ায়। ঘ্রান শুকে শত্রুকে সনাক্ত করতে পারে। প্রয়োজনে কামড়ে দিতেও ছাড়েনা। হরিজন পাড়ার অন্য আর সব শুওর গুলোর মতো নোংড়ামি করেনা। কাঞ্চিয়া ওকে নিজের মনের মতো করে মানুষ করছে।
আদোর করে শুওরটার নাম রেখেছে ‘পল্টুয়া’। সারাক্ষন কাঞ্চিয়ার পায়ে পায়ে ঘুড়ে বেড়ায়। একদন্ড না দেখলে চেচিয়ে বাড়ি মাথায় তোলে খবিশের বাচ্চাটা। তাই এখন থেকে কাঞ্চিয়া যেখানে যায় ‘পল্টুয়া’কে সঙ্গে নিয়ে যায়। বন্য শুওর’কে মানুষ করে সে মানুষ রুপী পশুদের মুখোমুখি ওকে দাড় করাতে চায়।
সাতপাঁচ ভাবতে ভাবতে বাবার হাকডাকে হঠাৎ সম্ভিত ফিরে পায়। চায়ের মগ আর ঝাটা হাতে শিরিশ ডোম রাস্তায় দাড়িয়ে উপর্যুপরি মেয়েকে ডাকতে থাকে................. হাতের কাজ শেষ করতে করতে কাঞ্চিয়া চেচিয়ে বাবাকে আশ্বস্ত করে................................. t বাবাগো তুমি পা তুলো এই আমি এলাম বলে......................... তারপর এক হাতে ঝাটা অন্য হাতে শুওরের বাচ্চাটা নিয়ে বাবার পিছু পিছু দুগ্গা দুগ্গা বলে কাজে বেড়িয়ে পড়ে।
স্টেশনে পৌছে জেনে যায় ডাউন মেল ট্রেনটা প্রায় দুইঘন্টা লেট। লেট ট্রেনের যাত্রিদের দেখে যেন হাফ ছেড়ে বাঁচে কাঞ্চিয়া। ‘পল্টুয়া’কে আবুলের চায়ের ষ্টলের সামনে বসিয়ে একটা পারুটি আর চা দিতে বলে। আবুল নিত্যকার মতো ‘পল্টুয়া’র নির্দ্ধারিত গামলায় চায়ে পারুটি ভিজিয়ে দেয়। ‘পল্টুয়া’ আপন মনে খেতে থাকে। এর ফাঁকে বাবাকে সাথে নিয়ে চট জলদী কাজে নেমে পড়ে কাঞ্চিয়া।
দু’হাতে সমানে ঝাটা চালিয়ে ১নং প্লাটফরমের কাজ সেরে সবে ২নং প্লাটফরমের কাজে হাত দিতে যাবে এমন সময় ছোটবাবু অকর্ষাৎ সামনে এসে দাড়ায়.....হেয়ালী ঢঙে সরাসরি প্রশ্ন করে...................
t কিরে আজ যে বড় দেরি করে কাজে এলি......শরীর টরীর খারাপ ?....নাকি তাড়ি খেয়ে মাড়ি আটকে পড়ে ছিলি.....সারা রাত.......? প্রশ্নের ধরন দেখে সহসা কোন উত্তর খুজে পায়না কাঞ্চিয়া। নিশ্চুপ দেখে ছোটবাবু আবারও প্রাসঙ্গিক প্রশ্নের বাণ ছুড়ে দেয়........................... t কিরে কথার উত্তর দিচ্ছিসনা যে..........?
মৌনতা ভেঙ্গে পুঞ্জিভূত ক্ষোভটাকে এবার প্রকাশ করতে চায় কাঞ্চিয়া...নির্ভয়ে ছোটবাবুর মুখের দিকে না তাকিয়ে মাথাটা নীচু করে উত্তর দেয়...........................
t দেহেন বাবু আমরা হলামগে ছুটো জাতের মানুষ....তাড়ি খেয়ে পড়ে থাকি নাহয় শুওরের গলা ধরে শুয়ে থাকি তাতি আপনার কি....? আপনাগি মতো ভদ্দর নোকদের ওসব নোংড়ামী দেখলি চলে...? সরেনদি বাবু আপনি আমার সামনেথে সরেন....আমারে কাজ করতি দেন..................................... কাঞ্চিয়ার মুখে সোজা সাপটা কথা শুনে প্রথমটায় ছোটবাবু কিছুটা ঘাবড়ে যায়...পরক্ষনেই নিজেকে সামলে নিয়ে তোষামদের সুরে আবার কাঞ্চিয়ার মনোযোগ আকর্ষণ করে .......................
t সুন্দরী মেয়েদের মুখে এরকম চ্যাটাং চ্যাটাং কথা মানায়না বুজেছিস ? কিসে একটু ভদ্র টদ্র হবি নাতো আজীবন সেই ডোমের মতই রয়ে গেলি...জানিস তো বাবুদের মুখে মুখে কথা বলতে নেই...ভদ্র হ বুজেছিস ভদ্র হ.....কথা গুলো বলতে বলতে কাঞ্চিয়ার আরো কাছাকাছি হতে চান....কিন্তু অদুরে হঠাৎ শিরিশ ডোমের প্রতি দৃষ্টি পড়ে যাওয়ায় বুড়ো’কে দেখে আতকে উঠেন ছোটবাবু....নিরাশ হয়ে এবার তাচ্ছিল্যের সুরে কাঞ্চিয়ার সামনে গিয়ে আবার বলতে থাকেন..........................
t তাইতো বলি এতো দেমাগ কিসের.... তা বুড়ো বাপটাকে আর কত ভাজবি?.....বেচারা সুন্দরী বউটার শোকে এমনিতেই শুকিয়ে টোষ্ট হয়ে গেছে.....এবার একটু ক্ষান্তদে দিকিনি....যে কয়দিন বাঁচে ভালমন্দ খাইয়ে বুড়োটাকে শান্তিতে থাকতে দে। তাছাড়া বুড়োটার বদলে তোকে চাকরী দেয়া হয়েছে....শুধু শুধু ঘাটের মরা’কে সঙ্গে এনে কষ্ট দিস কেন বুঝিনা। দেরি করে কাজে এসেছিস....কিসে বাবুদের একটু খাতির টাতির করবি তা নয়তো মুখে মুখে শুধু তক্ক করিস..........................
ছোট বাবুর কথা গুলো শুনে কাঞ্চিয়া আর স্থির থাকতে পারেনা বুক ফেটে কান্না আসে....বাবা আর মা’কে নিয়ে ছোট বাবুর কটাক্ষ ওর কোমল মনটাকে ভেঙ্গে গুড়িয়ে দেয়... ছোটবাবুর ইঙ্গিত বুঝতে কষ্ট হয়না কাঞ্চিয়ার।
মায়ের কলঙ্কের কারণে সৌন্দর্যকে কখনো নিজের সাথে মেলাতে চায়নি কাঞ্চিয়া। কেবল জন্মধাত্রী মা বলে সবার অলক্ষ্যে শেষ রাতের ধ্রুব তারাকে মা ভেবে মনে মনে প্রতিদিন শুধু প্রনাম করে এসেছে। তবে ডোম পরিবারে সুন্দরী মায়ের গর্ভে সুন্দরী হয়ে জন্ম নেয়া ওর অপরাধ কিনা কিছুতেই তা ভেবে পায়না................
ছোটবাবুর কথার জের ধরে কতকটা প্রতিবাদী হয়ে ওঠে কাঞ্চিয়া। ক্ষোভে দুঃক্ষে ভেতরের না বলা কথা গুলো ছোটবাবু’কে তিব্র ভাষায় জানিয়ে দিতে চায়...........................
t দেহেন বাবু আপনারে আজ একক্ষান কতা ছাপ ছাপ কোতি চাই....ওসব ভদ্দরনোক টদ্দরনোক হওয়ার কোন সখ আমার নেই বুজিছেন......এবং তা কুনো দিন হতিও চাইনা । ডোমের ঘরে জন্ম আমাগি আমরা ডোম হয়েই থাকতি চাই। আর শুনেন....ওসব সুন্দরী মার্কা পটাশ মেইরে আমারে পটাটি পারবেন নানে কলাম.......ডোমের মেয়েরে সুন্দরী কচ্ছেন না ? আবার তারে ভদ্দরনোক সাজতিও কচ্ছেন....? ইয়ারকি মারার আর জাগা পাচ্ছেন না তাইনা ?.....ডোমের মেয়েরে কচ্ছেন ভদ্দরনোক সাজতি.......আচ্ছা আপনার ঘরে কি মা বোন নেই......? যানতো আপনি আপনার কাজ করেনগে যান......আর আমারে কাজ করতি দেন...সরেনদি আপনে আমার সামনেথে সরেন না হলি কলাম.....................................
সঙ্গে সঙ্গে কাঞ্চিয়ার মুখের কথা কেড়ে নিয়ে ছোটবাবুও মেজাজ চড়িয়ে বলে উঠেন..... না হলে......না হলে কি হবে শুনি....? খুব বেড়েছিস বলে মনে হচ্ছে.....মুখে দেখছি কিছুই আটকায়না....বলি ছোট মুখে বড় কথা...?!! ছোট বাবুর নির্লজ্জপণা দেখে রাগে ক্ষোভে কাপতে কাপতে আবুলের ষ্টলের দিকে তাকিয়ে এবার রাগতঃ কন্ঠে চেচিয়ে শুওরের বাচ্চটার মনোযোগ আকর্ষন করে কাঞ্চিয়া.............................
t আরে ঐ শুওরের বাচ্চা....চা রুটি খাওয়া হয়নি তোর....জন্মের খাওয়া খাচ্চিস মনে হচ্চে..............? ইতোমধ্যে চা’রুটি সাবার করে বসে বসে গামলা চাটছিল ‘পল্টুয়া’..... কাঞ্চিয়ার ডাক শুনে কান দুটো সজাগ করে ফিরে তাকায় ওর দিকে । তারপর ঘোৎ ঘোৎ শব্দ করে দ্রুত দৌড়ে গিয়ে পাশে দাঁড়ায়। ‘পল্টুয়া’র আগমনে কাঞ্চিয়া অনেকটা আশ্বস্ত হয় এবং পুনরায় আনমনে নিজের কাজ করতে থাকে।
শুওরের বাচ্চাটাকে এভাবে দৌড়ে কাঞ্চিয়ার কাছে আসতে দেখে প্রথমতঃ ভীষণ অবাক হয় ছোটবাবু পরক্ষণে ইতোর খবিশটাকে দেখে ঘৃণায় নাক সিটকে নিজের পবিত্রতা রক্ষার খাতিরে কিছুটা সরে দাঁড়ায়।
কিন্তু কি আশ্চর্য শুওরের বাচ্চাটা সেই তখন থেকেই ছোটবাবুর চোখের দিকে বড় বড় চোখ করে তাকিয়ে গলার ভেতর একটা আক্রশ মুলক গড় গড় শব্দ করে বার বার ছোটবাবু’কে তেড়ে এসে কামড়ে দিতে চায়। কিন্তু প্রতিবারই কাঞ্চিয়ার বকা খেয়ে ‘পল্টুয়া’ মাঝ পথ থেকে বার বার ফিরে যায়। অবশেষে কাঞ্চিয়ার পায়ের কাছে বসে আগের মতোই ছোট বাবুর দিকে বড় বড় চোখে তাকিয়ে আক্রশে গড় গড়..গড় গড় করতে থাকে।
অবস্থার আকর্ষিক প্রেক্ষিত বিবেচনা করতে এবং পরিস্থিতি সামাল দিতে ছোটবাবু ভীষণ বিব্রত এবং অসস্থি বোধ করেন এ সময়। শুওরের বাচ্চাটার আক্রশ মুলক আচরণে মনে মনে খুব লজ্জা পান তিনি। বিষয়টা অনুধাবন করতে বা বুঝে উঠতে পারেন না সহজে। একটা ইতোর প্রাণীর কাছে নিজেকে খুব অসহায় বলে মনে হয় তার।
হতবিহবল ছোটবাবু বিষয়টা ভাল ভাবে পরোখ করার জন্য ভয়ে ভয়ে আবারও শুওরের বাচ্চাটার চোখের দিকে তাকায়। এবার রিতিমত আঁতকে উঠেন তিনি। শুওরটার চোখের কর্নিয়ায় যেন নিজের প্রতিচ্ছ্ববি দেখতে পান। ‘শুওরের বাচ্চাটা’কে মূহুর্তে যেন তার প্রতিপক্ষ বলে মনে হয়। ঘটনার আদ্যপান্ত বিবেচনা করে লজ্জায় ঘৃণায় সেখানে আর দাঁড়াতে ইচ্ছে হয়না ছোটবাবুর। শেষে ঘটনাস্থল থেকে সরে পরার জন্য ফন্দি খুঁজতে থাকেন। কিন্তু বিরুপ পরিস্থিতির কারণে সে সুযোগটিও যেন তার হয়ে উঠে না সহজে।
এমন সময় হঠাৎ ডাউন মেল ট্রেনটার খবর হয়ায় টংটং টংটং করে ট্রেনের ঘন্টা পড়ে যায়। যাত্রিরা যে যার মতো হৈ হুল্লোড় করে বিরম্বনার অবসান ঘটিয়ে যাত্রার উদ্দেশ্যে ব্যাস্ত হয়ে ছুটাছুটি করতে থাকে। সুযোগ বুঝে ছোটবাবুও কোন দিকে না তাকিয়ে মাথাটা নীচু করে ভদ্র লোকের মতো যাত্রিদের ভির ঠেলে সন্তর্পণে অফিসের দিকে পা বাড়ায়। ঝাটা হাতে কাঞ্চিয়া ছোটবাবুর পশ্চাৎ গমনের দৃশ্যটি মাথা উঁচু করে উপভোগ করতে থাকে। তারপর পল্টুয়া’র দিকে দৃষ্টি ফেরাতেই ওর শুস্ক ঠোঁট জোড়ার সন্ধিস্থল থেকে এক ফালি বিজয়ের হাঁসি সাফল্যের বারতা হয়ে শুওরের বাচ্চাটার চোখের গভীরে মিলিয়ে যায়।
আপনার ভালো লাগা ও মন্দ লাগা জানিয়ে লেখককে অনুপ্রানিত করুন
এই লেখাটি গল্পকবিতা কর্তৃপক্ষের আংশিক অথবা কোন সম্পাদনা ছাড়াই প্রকাশিত এবং গল্পকবিতা কর্তৃপক্ষ এই লেখার বিষয়বস্তু, মন্তব্য অথবা পরিণতির ব্যাপারে দায়ী থাকবে না। লেখকই সব দায়ভার বহন করতে বাধ্য থাকবে।
প্রতি মাসেই পুরস্কার
বিচারক ও পাঠকদের ভোটে সেরা ৩টি গল্প ও ৩টি কবিতা পুরস্কার পাবে।
লেখা প্রতিযোগিতায় আপনিও লিখুন
প্রথম পুরস্কার ১৫০০ টাকার
প্রাইজ বন্ড এবং সনদপত্র।
দ্বিতীয় পুরস্কার ১০০০ টাকার
প্রাইজ বন্ড এবং সনদপত্র।