পৌষ মেলা

শীত (জানুয়ারী ২০১২)

খন্দকার আনিসুর রহমান জ্যোতি
  • ২৬
  • 0
  • ১৩৭
একেতো শীতের ভোর তার উপর রাত জাগা শরীর। বকেয়া ঘুমের আবেশ কেবল চোখ দুটোকে ভর করেছে। এরিমধ্যে ঝাকানাকা মার্কা রিং টনে মুঠো ফোনটা আচমকা বেজে ওঠে। মেজাজটা ভীষন খাট্টা হয়ে যায় মিশুকের। মুখে এক ধরনের বিরক্তি মাখা সংলাপ আওরিয়ে ঘুমের ঘোরেই হাতরাতে থাকে ওটাকে। ফোনটা তখনো স্বভাব শুলভ আচরনে ওর অসত্দিত্ব জানান দিয়ে চলেছে 'মুনি্ন বদনাম হুয়ি'....বালিশের তলায়। আগে বাম হাতের বুড়ো আঙ্গুল দিয়ে বাটন টিপে ওটার মৃত্যু নিশ্চিত করে নেয়। তারপর আমসত্দক লেপ মুড়ি দিয়ে হীমসুখ আবেশে ঘুমের রাজ্যে তলিয়ে যায় সমগ্র গ্রামীণ নেট ওয়ার্কের বাইরে। আরামে ভোঁস ভোঁস করে নাক ডেকে ঘুমাতে থাকে। বাইরে একটানা কনকনে শৈত প্রবাহ আর কুঁয়াশাবৃষ্টির একঘেয়েমীপনা। কেমন যেন ভেঁজা স্যাত স্যাতে ঘুমটি মারা পরিবেশে ছেয়ে আছে চারিদিক। আকাশ আর মাটি একাকার হয়ে গেছে কুঁয়াশার আবরনে। এ ধরনের অসস্থিকর পরিবেশ মোটেও কারো পছন্দের কারণ হতে পারে না।

এরিমধ্যে রাজশাহী গামি 'উত্তোরা এঙ্প্রেস' ডাউন মেল ট্রেনটা দ্রুত গতিতে চলে যাবার শব্দ কানে ভেসে আসতেই দৌড়ে গিয়ে জানালায় চোখ রাখে মোমিতা। প্রতি দিন ও এভাবেই জানালায় দাড়িয়ে ট্রেন দেখে। কিন্তু আজ দেখতে পায়না কিছুই, গাড় কুয়াশার চাঁদর ভেদ করে দৃষ্টি পৌছায়না ট্রেন অব্দি। শেষ পর্যনত্দ ট্রেনের শব্দ শুনেই তৃপ্ত হয়। কেননা ফিরতি এই ট্রেনেই আজ ওদের নওগাঁ যাবার কথা রয়েছে। কিন্তু সকাল থেকে মনটা বিষিয়ে আছে পরিবেশের বৈরিতা দেখে। সেই সাথে মিশুকের খাম খেয়ালীপনা ওকে আরো ভাবিয়ে তুলেছে। পুরো ফ্রি ষ্টাইলে এখনো সাহেব নাক ডেকে ঘুমাচ্ছেন। দেখে মনেই হয়না যে আজ উনার কোথাও বেরুবার তাড়া রয়েছে। কিন্তু মোমিতাও সহজে ছাড়বার পাত্রী নয়। শশুড় বাড়ি যাওয়া বলে কথা। বাবা নিজে এসে জামাই বাবাজিকে দাওয়াত করে গেছেন। পৌস মেলার আনন্দ সেলিব্রেট করার জন্যে। তাছাড়া বিয়ের পর এই প্রথম এক সাথে ঘটা করে বাপের বাড়ি যাওয়া।


ফিরতি মেল ট্রেনটা ১২টা ১৫ মিনিটে রাজশাহী থেকে ছেড়ে আসে। আর ১টা ১৫ মিনিটে আড়ানী স্টেশন থেকে ছেড়ে যায় পার্বতিপুরের দিকে। যাওয়া আসার মাঝে কেবল এটুকু সময়। এরমধ্যে গোছগাছ খাওয়া দাওয়া সেরে তৈরী হতে হয়। কিন্তু মিশুকের এ নিয়ে কোন চিনত্দা ভাবনা নেই যেন। দেখে দেখে ''আজ তোরই একদিন কি আমারই একদিন'' ধরনের ক্ষোভ মেশানো আত্ম বিশ্বাসের উপর ভর করে গজ গজ করে এগিয়ে যায় মিশুকের ঘরের দিকে। হ্যাঁচকা টানে লেপের ভেতরের সেই মামুন আজিজের হীমসুখ পরিবেশটাকে গুড়িয়ে দেয় মুহুর্তে। আচমকা হীমেল বাতাসের ছোয়া এসে লাগতেই শরীরটা যেন সিন সিন করে ওঠে মিশুকের। চোখ মেলে চার হাতপা টান টান করে হাই তুলে ঘুম পরীকে বিদায় জানাবার ব্যার্থ চেষ্টা চালায়। কিন্তু পারেনা, পরক্ষনেই অবলা ছোট্ট শিশুর মতো কুকরী মুকরী হয়ে আবারও ঘুমের কোলে ঢলে পড়ে। গালের মাঝ খানটায় তর্জনী ঠেকিয়ে শিঁয়রে দাড়িয়ে মিশুকের এসব ঘুম ঘুম কষ্টের পরিনতি অবাক চোখে পরখ করছিল মোমিতা। প্রথমটায় ভেবেছিল ওর বিহেপটা হয়তো মিশুকের ডিসফেভারেই যাবে। কিন্তু কি আশ্চযর্্য এহেন পরিস্থিতিতে মিশুকের যেইকার সেই অবস্থা!! ঘুম কষ্টের আবর্তে স্বামী ব্যাচারির এহেন দূরাবস্থা দেখে ভীষন মায়া হয় মোমিতার। পূর্বের রাগ ঝাল ক্ষোভ অভিমান সব ঝেড়ে ফেলে মমতাময়ী মায়ের আদোলে নিরবে মিশুকের পাশে গিয়ে শোয়। বুকে জড়িয়ে ভালোবাসার ছোয়া দিয়ে আনমনে ওর চুল গুলোয় আদর মাখাতে থাকে। হীমেল আবেশে মোমিতার উপস্থিতি এ সময় মিশুককে ভীষন ভাবে আকৃষ্ট করে। উষ্ণ আবেগে বুকের আরো কাছে টেনে নেয় মোমিতাকে। বাধা দেয় না মোমিতা, বরং আরো নিবিড় করে মিশূককে জড়িয়ে নেয় ভালোবাসার আদরে মাখা চাদোর দিয়ে। ভালোবাসার চলমান আবর্তে অতিত আর বর্তমানের মাঝে বন্দি হয় আরো কিছুটা অন্ধ সময়...এ ভাবে বেশ কিছুক্ষন...তার পর আরো কিছুটা সময় গড়িয়ে যায় অন্ধ আবেগের সীমানায়।

হঠাৎ নিরবতা ভেঙ্গে চোখ মেলে তাকায় মিশুক। প্রথমে মোমিতাকে তাগিদ দেয় ঝটপট উঠে পড়ার জন্য...। ঘন ঘন নিশ্বাসে হাপাতে থাকে আর বার বার ঘড়ির দিকে তাকাতে থাকে মিশুক। মুহুর্তে এক ধরনের ব্যাসত্দতার ছাপ যেন ফুটে উঠে ওর চোখে মুখে। ট্রেনের টাইমটায় ঘড়ির কাটা ছুই ছুই করছে। এরিমধ্যে বেরিয়ে পরতে না পারলে নির্ঘাৎ ট্রেন ফেল করবে। ওষুধে যে কাজ হয়েছে মোমিতা তা স্পষ্ট বুঝতে পারে। এবার ক্লানত্দ শরীরটাকে বিছানা থেকে টেনে তুলে সোজা গিয়ে আগে নাকটা মলে দেয় মিশুকের। তারপর এক ঝলক বিজয়ের হাসি হেসে মিশুককে তাড়াতাড়ি সেভটা সেরে নেয়ার তাগিদ দিয়ে সোজা বাথরুমে গিয়ে ঢোকে।

তাড়াহুড়োর মাঝে কুঁয়াশার অন্ধকার ভেদ করে অনেক কষ্টে ওদের রিঙ্াটা ষ্টেশনে এসে পৌছায় অবশেষে। রিঙ্া থেকে নেমেই আগে ট্রেনের খবরটা জেনে নেয় মিশুক। ট্রেনটা প্রায় এ ঘন্টা বিলম্বে চলছে জেনে কিছুটা সস্থির খুঁজে পায় মনে। তাড়া হুড়োর ধকলটা কাটিয়ে উঠতে পেরে এবার ওয়েটিং রুমে বসে আয়েশ করে একটা সিগারেট ধরায়। শুত শুত করে সিগারেটে দুটো শুকটান দিয়ে পরিতৃপ্তির ধুঁয়া ছাড়তে ছাড়তে মোমিতার দিকে তাকায় ভাবাবেগে । মোমিতাও সাড়া দেয় চিরাচরিত মিষ্টি হেসে। কিন্তু হাসির গভীরতায় কিছিুটা ঘাটতি লক্ষ্য করে মিশুক। শীতে মোমিতার রক্ত রাঙ্গা ঠোট জোড়া কেমন যেন বিবর্ন কালচে নীল হয়ে গেছে। এরচে আরো অনেক সুন্দর করে হাসতে জানে মোমিতা। তাই কায়দা করে ইশারায় আবার লিফ জেলটা ঘোষে নিতে বলে ঠোঁটে। ওয়েটিং রুমে মধ্যবয়সি মহিলাটা অনেকক্ষন ধরেই পুরোনো স্টাইলে ওদের প্রণয় লীলার সিকোয়েন্স গুলো কৌশলে হৃদয়ঙ্গোম করছিল,আর মুখটিপে হাসছিল ওর বুড়ো বরের দিকে তাকিয়ে। বুড়োটাও যেন একটা মিচকী শয়তান চোখ বন্ধ করে থাকতে থাকতে মিটমিট করে তাকা মোমিতার দিকে। এটা মিশুক না বুঝলেও মোমিতা ঠিকি বুঝতে পেরেছে। তাই বউকে নিয়ে এমূহুর্তে মিশুকের এতটা পাগলামীপনা মোমিতা এড়িয়ে যাওয়ার চেষ্টা করে। তাই শালের চাঁদরটা দিয়ে চোখ মুখ ঢেকে ওয়েটিং রুমের শীতাতুর অলস দৃষ্টি গুলো আড়াল করার প্রয়াশ চালায় মোমিতা।


কিন্তু মিশুকের এখানেও আপত্তি।'নেকাবী' স্টাইলে বিদেশী ভুতুড়ে কালচার কখনো মেনে নিতে পাড়ে না সে। বলে বাঙ্গালী ললনার সরূপটা যদি নেকাবে ঢাকাই পড়ে যায় তবে তো আর সেখানে বাঙ্গালীর নিজস্বতা বলে কিছু থাকে না। বঙ্গ ললনা বলে কথা, আকর্ষনীয় এবং মার্জিত রুপের সমাহার। মোহনীয় শাড়ীর ভাঁজে ভাঁজে সুচারু রুপের কারুকাজ। তাই সে নেকাবের ঘোর বিরোধী। সারাক্ষন শুধু বউয়ের রূপ সুন্দর্য নিয়ে মেতে থাকতে চায়। মিশুকের এহেন বউ পাগলামীপনাটা এখন আর মন্দ লাগেনা মোমিতার। ইদানিং তাই রুপ চর্চায় মিশুকের ভালোলাগা বিষয় গুলোকে মূল্যায়ন করে। কিন্তু এতো গুলো মানুষের ভিড়ে মিশুকের চাহিদার বিষয় বস্তু হতে এমুহুর্তে ওর ভীষন লজ্জা করছে। সুতরাং একেতো শীতের তাড়না তার উপর চক্ষু লজ্জার হাত থেকে নিজেকে আড়াল করার ছলে চাঁদরে মুখচোখ ঢেকে জুবু থুবু হয়ে বসে থাকে। যদিও ভয়ে ভয়ে একবার শুধু আঁড় চোখে মিশুকের সাথে ভাব বিনিময় করতে চেয়েছে। কিন্তু ভাগ্যিস চোখা চোখি হয়নি না হলে ওর চোখের জবাব দিতে গিয়ে আবারও লজ্জায় পড়তে হতো মোমিতাকে। কেননা মহিলার সাথে ওয়েটিং রুমের আরো অনেকেই এখন ওদের দিকে ঢ্যাব ঢ্যাব করে তাকিয়ে আছে।

তবুও ভালো যে বিকট শব্দে হুইসেল বাজিয়ে এই মাত্র ট্রেনটা এসে প্লাটফরম ঘেঁসে দাড়িয়েছে। ট্রেনটার উপস্থিতিতে হঠাৎ করে ষ্টেশনের ব্যাসত্দতা বেড়ে যায়। ভারি হয়ে যায় ষ্টেশনটার আকাশ বাতাস একটা ভাড়িক্কি যান্ত্রিক শব্দে । সবাই ব্যতি ব্যসত্দ হয়ে ট্রেনে উঠার জন্য প্রস্তুত হচ্ছে। লাগেজ গুছিয়ে মোমিতাও মিশুকের হাত ধরে ঝট পট উঠে পড়ে ট্রেনে। কিছুক্ষন পর ট্রেনটা চলতে শুরু করে, মোমিতার মনের
গহীনে গুমরানো আবেগটা যেন এবার খলখলিয়ে হেসে উঠে। বাবার বাড়ি যাওয়ার ক্ষেত্রে নারী মনের বহিঃপ্রকাশ এটা, ভীষন উৎফুল্ল দেখাচ্ছে মোমিতাকে। সুন্দরী বউটার এ ধরনের হাসি খুসি ভরা মুখটা দেখার জন্য সব সময় কাঙ্গাল হয়ে থাকে মিশুক । বাইরে কুঁয়াশার ধোঁয়াশা ভেদ করে বিভিন্ন ধরনের শাব্দিক ছন্দে এগিয়ে চলেছে ট্রেনটা। সেই সাথে মিশুকের মাথায়ও নানান ধরনের চিনত্দা চেতনার আবেশ খেলতে থাকে সমান তালে। নতুন বউকে নিয়ে শালা শালীদের সাথে পৌস মেলার আনন্দ ভাগাভাগী করা। উফ্স এ যেন এক নতুন অনুভুতি নতুন অভিজ্ঞতা, বিষয়টা ভাবতেই ভীষন ভালো লাগছে মিশুকের।

আত্রাই উপজেলার জামগ্রামের সেই প্রসিদ্ধ পৌষ মেলার কথা ইতিপুর্বেই মোমিতা ওকে শুনিয়ে রেখেছে। ভীষন আনন্দ হয় নাকি সেই পৌষ পার্বনের মেলাকে ঘিরে। বাঙ্গালী সংস্কৃতির এই মিলন মেলাটি আজ আর হিন্দু ধর্মাবোলম্বিদের একক কোন আচার অনুষ্ঠান নয়। এই অঞ্চলের সকল ধর্মের মানুষের কাছে খুবই আনন্দের পার্বন এই পৌষ মেলা। তারা যে কোন ধর্মীয় উৎসবের চেয়ে এই পৌষ মেলাকেই বেশী প্রাধান্য দিয়ে থাকে। তাইতো বছর ঘুরে পৌষ এলেই কনকনে শীতের কষ্ট ভুলে গিয়ে সবাই আনন্দ উৎসবে মেতে ওঠে। প্রতিটা পরিবারে ঘটা করে মেয়ে জামাই আর আত্মীয় স্বজনদের দাওয়াত করে নিয়ে আসা হয়।মিষ্টি পায়েশ পিঠা পুলি আর হরেক রকমের সব খাওয়া দাওয়ার ধুম পরে যায় পাড়ায় পাড়ায়।

জামগ্রামের এই পৌষ মেলার আরো একটা ঐতিহ্যবাহী বৈশিষ্ঠের কথা মিশুক মোমিতার মুখে শুনেছে। তা হলো বড় বড় মাছ পাওয়া যায় এই পৌষ মেলায়। তিন/চার বছরের পুষে রাখা সব মাছ, ৫কেজি/১০কেজি/এমন কি ১৫/২০কেজি ওজনের মাছও সময়ে পাওয়া যায় এই জামগ্রামের পৌষ মেলায়। রিতি অনুসারে জামাই বাবাজিকে শশুর বাবা মেলা দেখার জন্য পরবী দিয়ে থাকেন। কিন্তু মজার ব্যাপার হলো গ্রামের কোন জামাই সেই মেলা থেকে কত বড় মাছ কিনে বাড়িতে ফিরলো, এটাই হলো দেখার বিষয়। জামাইদের মাছ কেনার এক ধরনের প্রতিযোগিতাও বলা চলে একে। এর পর মেলা থেকে জামাই বাবাজির কিনে আনা মাছটা কুটে ধুয়ে,নিকট আত্মিয় এবং পাড়া প্রতিবেশীর বাড়ি বাড়ি জামাইয়ের বরাত দিয়ে আনন্দ বিলিয়ে দেয়া নেয়ার রেয়াজ, এ অঞ্চলে চলে আসছে সেই বহু কাল ধরে। বিশেষ করে নওগাঁ জেলার আত্রাই রানীনগর এবং নওগাঁ সদর উপজেলা এলাকায় পৌষ মেলার আনন্দ ঘন উপাখ্যান লেখকের নিজস্ব অভিজ্ঞতার ফসল। যাই হোক মিশুকের জীবনে এই প্রথম এ ধরনের একটি ঐতিহ্যবাহী পৌষ মেলায় আসার অভিজ্ঞতা হতে চলেছে। সেই কারনে মোমিতা ওকে বার বার মেলা কেন্দ্রিক আচার অনুষ্ঠানের রিতি নীতি গুলো আগে থেকেই শিখিয়ে পড়িয়ে রেখেছে। যাতে করে সবচে বড় মাছটা কিনে এনে স্বীয় যোগ্যতাকে প্রমান করে সন্মানের আসনে বসতে পারে মিশুক। না হলে মোমিতা ওর আত্মিয় সজন এবং পাড়া প্রতিবেশিদের কাছে ছোট হয়ে যাবে।

যথারিতি ট্রেনটা এগিয়ে চলেছে আপন গতিতে নির্দ্দিস্ট গনত্দব্যে। এদিকে ট্রেনের গতির সাথে পাল্লা দিয়ে শীতের তিব্রতাও যেন ক্রমেই বেড়ে চলেছে। প্রথমটায় বুঝতে পারেনি, শৈত প্রবাহটা যেন মোমিতাকে ক্রমেই পেয়ে বসেছে । ভীষন অসস্থিকর হীমবাহ, ভেবেছিল ট্রেনে উঠলেই হয়তো শীতের হাত থেকে কিছুটা হলেও রেহাই পাবে। কিন্তু একি আসত্দে আসত্দে যেন বেড়েই চলেছে সেই কনকনে শীতের কষ্টকর বাতাসের গতি। মোমিতার কষ্টকে মিশুক মোটেও সহ্য করতে পারেনা। কম্পার্টমেন্টে বাতাসটা ঢুকছে কি করে নিজের কাছে প্রশ্ন করে কোন উত্তর খুজে পায় না। মুহুর্তে ব্যাসত্দ হয়ে সিট থেকে ওঠে পড়ে মিশুক। কিছুটা সামনে এগিয়ে বিষয়টা পরিস্কার হয়ে যায় ওর কাছে। অবাক চোখে তাকিয়ে থাকে কম্পার্টমেন্টের ভাঙ্গা জানালার গ্ল্যাস গুলোর দুরোবস্থা দেখে। হুহু করে উদোম জানালা দিয়ে ঢুকছে বাইরের কনকনে বেপরোয়া হীমেল বাতাস। আরো কিছুটা এগিয়ে যায় মিশুক উৎসুক দৃষ্টিতে তাকায় চারিদিক।সহসা শীত কষ্টের স্বকরুন এক বাসত্দব দৃশ্যপট ভেসে উঠে ওর চোখের সামনে। জুবু থুবু হয়ে যে যার সাধ্যমতো শীত বস্ত্র জড়িয়ে শীতকে জয় করবার ব্যার্থ প্রয়াশ চালাচ্ছে যাত্রীরা। হুহু করে ঢুকছে হীমেল বাতাস আর থরথর করে কাঁপছে মানুষ। হায়রে মানুষের কষ্ট!! দৃশ্যপট পাল্টে কষ্টের তাড়নায় আঁতকে ওঠে মিশুক, তড়িত ফিরে আসে মোমিতার কাছে। কোন সরকার ভালো আর কোন রেল মন্ত্রীর পদত্যাগ করা উচিৎ এ প্রশ্নের জবাব খুঁজতে চায়না ও। এখন শূধুই দুঃসময় হীমবাহকে জয় করে বেঁচে থাকার তীব্র লড়াই চালিয়ে যেতে হবে। না হলে নির্ঘাৎ হাইপোথার্মিয়ার কবলে পড়তে হবে ওদের। মুহুর্তে আবার মনে পরে যায় মামুন আজিজের সেই হীমসুখ আবেশের কথা। কাল বিলম্ব না করে নিজের চাদোরটা দিয়ে ভালো করে জড়িয়ে নেয় মোমিতাকে। মোমিতাও সেই আগের মতোই বাধা দেয় না, কেননা শীতের কামড়ে লজ্জার মাথাটা ওযে অনেক আগেই খেয়ে বসে আছে। তাই এমুহুর্তে মিশুকের শরীরের উষ্ণতা ওকে ভীষন ভাবে আশাবাদী করে তোলে। অকুলে যেন কুল খুঁজে পায় মোমিতা।


শীতের কষ্ট যে এতটা তীব্র আর অসহ্য কষ্টের কারণ হতে পারে এ ধরনের অভিজ্ঞতা এটাই প্রথম ওর জীবনে। দুর্ভাগ্য ক্রমে আজ ওরা পরিস্থিতির শিকার হয়ে গ্যাছে। সংগত কারনে শীতে গরীব মানুষের দুর্দশার কথাটা যেন ওর মনের গভীরে অতিরিক্ত কষ্টের কারণ হয়ে দাড়িয়েছে। ভাবতে ভাবতে হঠাৎ দৃষ্টিটা স্থির হয়ে যায় মেঝেতে বসা ৩/৪ বছরের ছোট্ট মেয়েটার উপর। মায়ের সাথে এসেছে ইন্ডিয়ান চিনির খ্যাপ মারতে। অতিশয় গরীব না হলে এহেন দুঃসাধ্য কাজের ঝুকি নেয়ার ক্ষমতা কজনেরই বা থাকে। কচি কচি হাত দুটো মুঠো পাকিয়ে তাতে বুক আর থুতনী ঠেকিয়ে থরথর করে কাঁপছে ছোট্ট অবুঝ মেয়েটা। শীত কষ্টের কামড়ে সর্বাঙ্গ ব্যাথায় নীল হয়ে গ্যাছে ওর। ছোট্ট মাসুম ঠোঁট দুটো দিয়ে অবিরাম কষ্টের গতিকে নিয়ন্ত্রন করার ব্যার্থ চেষ্টা করে চলেছে । অর্ধনগ্ন মেয়েটার পড়নে কেবল একটি মাত্র ফ্রগ, তার উপর পুরানো ঝিরঝিরে একহাতি বহরের ছেড়া ময়লা একটা চাদোর জড়ানো। এতোক্ষন নিবিষ্ঠ মনে গরীব মেয়েটার নির্দ্ধারিত কষ্টের পরিনতি দেখছিল মোমিতা।হঠাৎ ওর ব্যাথাতুর মনের গহীন থেকে গলিত কষ্টের নির্যাশ টুকু দ'ুচোখে অশ্রু হয়ে গড়িয়ে পড়তেই সম্ভিত ফিরে পায়। মিশুকের জড়ানো চাদোর দিয়ে অশ্রু মুছে নিতেই মিশুকও এসময় মোমিতার কষ্টের অংশীদার হতে চায় বোবা দুষ্টির বিনিময়ে। কারণ বাসত্দব কষ্টের মুখোমুখি সব দেখে শুনে আজ মিশুকের মনটাও ভীষন...ভীষন রকমের খারাপ হয়ে গ্যাছে।



ট্রেনটা এই মাত্র আত্রাই ষ্টেশনে এসে দাড়িয়েছে। সামনে আর একটা মাত্র ষ্টেশন,তার পরই ওদের কাংখিত গনত্দব্য। শাহাগোলা ষ্টেশনে ওদের রিসিভ করার জন্য কাজিনরা সবাই অপেক্ষমান। কিন্তু লেট ট্রেনের কারনে শীতে ওদেরও যে কষ্টের সীমা ফুরিয়ে এসেছে এটা বলার অপেক্ষা রাখে না। তাই নিজের কষ্টের সাথে সবার কষ্টকে ভাগাভাগি করে নিতে চায় মোমিতা ভালোবাসা দিয়ে। কেননা জীবনে কষ্ট থাকবেই কষ্ট চিরনত্দন, কিন্তু তবুও আশায় বুক বাধে মানুষ, কারণ দুঃখ কষ্টের দোলাচলে আনন্দকে জয় করাই যে তার স্বভাব। তাই বাবার বাড়ির আঙ্গিনায় পা রাখার আনন্দে আন্দোলিত হয়ে মিশুককে লাগেজ গুছিয়ে নমার জন্য প্রস্তুত হতে বলে। মিশুক ইতোমধ্যেই মানষিক ভাবে প্রস্তুত হয়ে আছে।


ট্রেনটার গতি এখন অনেকটাই কমে গ্যাছে, হয়তো আর ২/১ মিনিটের মধ্যে প্ল্যাটফরম ঘেঁসে দারাবে। একপা দুপা করে ওরা গেটের দিকে এগুতে থাকে। হঠাৎ এরিমধ্যে ঘটে যায় ঘটনাটা। পিছন ফিরে মিশুক দেখতে পায় ...অশ্রু ভেজা চোখে মোমিতা ওর দামী কাশ্মিরী শালটা শীতে কম্পোমান অর্ধনগ্ন সেই ছোট্ট মেয়েটার গায়ে জড়িয়ে দিয়ে ওকে বুকে টেনে আদোর করছে। ছোট্ট মেয়েটাও মোমিতার মুখের দিকে কৃতজ্ঞতার দৃষ্টিতে তাকিয়ে থেকে আনন্দের হাসি হাসছে। উহঃ সে কি বিশ্ময়কর আনন্দঘন উপভোগ্য দৃশ্য। না দেখলে বোঝাই যাবে না, ঠিক যেন টেলিভিশনের কোন এক বিশিষ্ট ব্যাক্তির ভিডিও ফুটেজের মতো। মোমিতার এই ধরনের মহত কর্মকান্ড দেখে মিশুকও কম খুশি হয়না। ভিডিও না করতে পারলেও মোমিতার এই মহৎ কর্মকান্ডের দৃশ্যপট আর্কাইভ হয়ে থাকবে চিরদিন ওর মনের সেলুলয়েডে। গর্বে মিশুকের বুকের ছাতিটা আরো খানিকটা ফুলে উঠে। এ ভাবে সবাই যদি গরীব মানুষের দিকে এগিয়ে আসতো তবে অসহায় গরীব মানুষ গুলোৰ শীত কষ্টের পরিমান কিছুটা হলেও কমে যেতো। সাথে সাথে ওর কাছে এটাও পরিস্কার হয়ে যায় যে মানুষের রুপ কেবল সুন্দর্যেই সীমাবদ্ধ নয়। রূপ গুনের দ্বৈত মিলনে সুন্দর্যের বহিঃপ্রকাশ ঘটে। মনে মনে ধারণা হয় মোমিতার মতো বউ পাওয়াটাও যেন ভাগ্যের ব্যাপার। এমন দৃশ্যের অবতারনায় কম্পার্টমেন্টের যাত্রীরাও সবাই মোমিতার এহেন কার্যকলাপ দেখে শীতের কষ্টকে খানিকটা হলেও ভুলে গিয়ে এক অকৃর্তিম খুশির আনন্দে ভাসতে থাকে। ট্রেনটা ষ্টেশনে এসে থামতেই মোমিতাও অপার আনন্দে মিশুককে সাথে নিয়ে গা ভাসিয়ে দেয় পৌষ মেলায় আমন্ত্রিত সব কাজিনদের সাথে আনন্দ ভাগা ভাগি করে নিতে।
আপনার ভালো লাগা ও মন্দ লাগা জানিয়ে লেখককে অনুপ্রানিত করুন
প্রজ্ঞা মৌসুমী গল্পের গতি আর লেখনী দুটোই চমৎকার। পৌষ মেলা, শহরের ট্রেডিশন নিয়ে অনেক কিছু জানলাম; জেনে আমারতো ইচ্ছে করছিল ছুট দেই। "মামুন আজিজের হীমসুখ"রেফারেন্সটা পুরোপুরি বুঝলাম না। আজিজ ভাইয়ের কোন কবিতা থিম নাকি? 'বকেয়া ঘুম' শব্দদুটো পছন্দ হলো...এরকম আরো কিছু উপমা। "বিহেভ" "ডিসফেভার" যেমন গতানুগতিক আমাদের মনে করিয়ে দিল, পরে কিন্তু 'লেইট' এর বদলে 'বিলম্ব'শুনে হাসলাম। শেষটা দারূণ হয়েছে। অবশ্য "শীতের কষ্ট যে এতটা তীব্র আর অসহ্য কষ্টের কারণ হতে পারে এ ধরনের অভিজ্ঞতা এটাই প্রথম ওর জীবনে" পড়ে ভাবছিলাম ও বাংলাদেশের নাগরিকতো। তাও অভিজ্ঞতাটাতো এবার হলো। মিশুকের কাছে মহৎ বলে মনে হচ্ছে। আমি বলছিলাম এটা গর্ববোধ করার মত কোন কাজ না। খুব স্বাভাবিক একটা কাজ। অন্যকে সাহায্য করা, মায়া দেখানো, এগুলা আমাদের জন্য খুব সাধারণ আর স্বাভাবিক একটা কাজ হওয়া উচিত। অথচ তটাই স্বার্থপর হয়ে পড়ছি ছোটখাটো এইসব কাজ এখন মহত্ত্বের পর্যায়ে চলে গেছে। সব মিলিয়ে চমতকার গল্প। আপনার জন্য শুভকামনা।
ভালো লাগেনি ২৪ জানুয়ারী, ২০১২
মোহাম্মদ ওয়াহিদ হুসাইন ...................চমৎকার গল্পটা পুরো পড়লাম, ভাল লাগল। শুভেচ্ছা
ভালো লাগেনি ২৪ জানুয়ারী, ২০১২
মামুন ম. আজিজ ভাষার দখল আছে জ্যিতি ভাইজানের জব্বর। তারই আরেক স্পষ্ট প্রমান। গল্পের কাহিনী তে নতুতন্ব কমকিন্তু বর্ননা সেটা পুষিয়ে দিযেছে। ...মামুন আজিজের হীমসুখ...উপমা হঠাৎ নিজের নাম মনে করিযে দিল..কিঞ্চিৎ লজ্জাবোধ জাগল। ধন্যবাদ।
ভালো লাগেনি ২৩ জানুয়ারী, ২০১২
মিজানুর রহমান রানা গল্প বেশ গতিশীল ও প্রাণবন্ত, তবে বানানভুলগুলো দেখে নিতে হবে। গল্পকারকে আমার সালাম ও শুভেচ্ছা।
ভালো লাগেনি ২২ জানুয়ারী, ২০১২
মো. ইকবাল হোসেন অেনক ভাল লাগল,In future অােরা ভাল অাশা করি .........
ভালো লাগেনি ১৮ জানুয়ারী, ২০১২
নিরব নিশাচর যেমন আপনার কবিতা, তেমন আপনার গল্প.. আপনার প্রতি কৌতুহল দিন দিন বাড়ছে..
ভালো লাগেনি ১৭ জানুয়ারী, ২০১২
এফ, আই , জুয়েল # গতিশীল ভাবনার বেশ বড় একটি গল্প ।----৫
ভালো লাগেনি ১৫ জানুয়ারী, ২০১২
হোসেন মোশাররফ ভাল লাগল আপনার গল্পটি......
খন্দকার আনিসুর রহমান জ্যোতি আক্তারুজ্জামান ভাই আপনার কমেন্টর জন্য অশেষ ধন্যবাদ। আপনার কথা রাখার চেষ্টা করবো। তবে প্রতি মাসে একটা করে গল্প লিখা কি সম্ভব বলেন ? আমার বাপ জীবনেও এত অল্প সময়ে গল্প লিখিনি, তাই হয়তো গ্যাপ পরতেও পারে। কারন আপনিতো জানেন ভালো কিছু লিখতে হলে অনেক সময়ের দরকার। যাই হোক ভালো থাকবেন চেষ্টায় রইলাম বাকী আল্লার ইচ্ছা। আর ও হ্যা জামাই হিসেবে শশুড় বাড়িতে এবারও পৌষ মেলার দাওয়াত পেয়েছি আসুন না সবাই মিলে মজা করা যাবে।
খন্দকার আনিসুর রহমান জ্যোতি আশা এবং লুতফুল বারি পান্না ভাই সুন্দর কমেন্টের জন্য অশেষ ধন্যবাদ পৌষ মেলায় আমন্ত্রন রইল....আসবেন কিন্তু.......

১০ অক্টোবর - ২০১১ গল্প/কবিতা: ৫২ টি

বিজ্ঞপ্তি

এই লেখাটি গল্পকবিতা কর্তৃপক্ষের আংশিক অথবা কোন সম্পাদনা ছাড়াই প্রকাশিত এবং গল্পকবিতা কর্তৃপক্ষ এই লেখার বিষয়বস্তু, মন্তব্য অথবা পরিণতির ব্যাপারে দায়ী থাকবে না। লেখকই সব দায়ভার বহন করতে বাধ্য থাকবে।

প্রতি মাসেই পুরস্কার

বিচারক ও পাঠকদের ভোটে সেরা ৩টি গল্প ও ৩টি কবিতা পুরস্কার পাবে।

লেখা প্রতিযোগিতায় আপনিও লিখুন

  • প্রথম পুরস্কার ১৫০০ টাকার প্রাইজ বন্ড এবং সনদপত্র।
  • দ্বিতীয় পুরস্কার ১০০০ টাকার প্রাইজ বন্ড এবং সনদপত্র।
  • তৃতীয় পুরস্কার সনদপত্র।

আগামী সংখ্যার বিষয়

গল্পের বিষয় "নগ্নতা”
কবিতার বিষয় "নগ্নতা”
লেখা জমা দেওয়ার শেষ তারিখ ২৫ মে,২০২৪