তাকিয়ে আছি দোকানির দিকে । সে একমনে তার আপন কাজে ব্যস্ত
খুব দ্রুত হাতের চামচ নাড়িয়ে যাচ্ছে চা বানানোর বড় মগটায় । উড়ন্ত ধোঁয়া ভেসে বেড়াচ্ছে ছোট্ট এই দোকানটিতে , তাজা চা পাতার ঘ্রাণে ম ম ।
এক চুমুক চায়ের অপেক্ষায় অধীর হয়ে আছি । দীর্ঘ ৩ ঘণ্টা ধরে উঁচু নিচু মেঠো রাস্তার ধকল আমার এই ঢাকার পীচ ঢালা রাস্তায় অভ্যস্ত শরীর । সয়ে নেয়াটা কঠিন ।
‘লন খালা!
অবশেষে সুখী সুখী এক গ্রাম্য মুখ আমার দিকে ধূমায়িত চায়ের পেয়ালা এগিয়ে দিল ।
কাপে চুমুক দিলাম । এবং নিশ্চিত হলাম যে ঢাকার অভিজাত কোন হোটেলের এসির স্নিগ্ধতার মধ্যে বসেও আমি নির্ঘাত এই চায়ের কথা স্মরণ করব ।
আব্বু মাঝির সাথে কথা বলছেন । আমি তাকিয়ে আছি পানির দিকে । সবুজাভ গভীর স্রোত, ছোটো ছোটো কচুরিপানার দল ঢেউয়ের তালে তালে দুলছে । অদ্ভুত সুন্দর পানির ঘ্রাণ আর তাজা বাতাস আমার সব ক্লান্তি দূর করে দিল । আকাশটাও এত সুন্দর, নীল আর ঝকঝকে সাদা মেঘের সংমিশ্রণ । নদীর এপাড় আর ওপাড়ে নারকেল আর সুপুরি গাছের সারি । সবুজ রঙের ছড়াছড়ি । ঠিক এমন দম বন্ধ করা সুন্দরতার মাঝে নিজেকে ও অসম্ভব সুন্দর আর সবুজ মনে হল , মুহূর্তের জন্য ভুলে গেলাম আমার এখানে আসার সেই ‘উদ্দেশ্য’।
নৌকা যখন ঘাটে থামল, ততক্ষণে ছোটো খাটো একটা জটলা হয়ে আছে ছোটো ছোটো বাচ্চা আর গ্রামীণ মহিলাদের । খেয়াল করলাম যে মহিলারা প্রায় সবাই একই রঙের সাড়ি পরে আছে । এবং রঙটা হল গাড় সবুজ । আমি ভ্রু কুঁচকালাম, মানে কি ! আমার চোখের দৃষ্টিটাই কি সবুজ হয়ে গেলো ?
বাচ্চাগুলো ছটফট প্রজাপতির মতো । রোদে পোড়া শরীর । খালি গায় চুল এলো মেলো । সরল আর অবাক দৃষ্টি নিয়ে তাকিয়ে আছে আমাদের দিকে। মুখে হাসি নিয়ে ওদের দিকে হাত নাড়লাম। কিন্তু ওরা কেউ আমার মতো হাত নাড়ল না তবে অনেকে কিছুটা লজ্জিত ভঙ্গিতে হেসে দিল। এক জনের হাসি ছিল ফোকলা দাঁতের হাসি , নির্মল ।
মেজো চাচী আমার প্লেটে ছোটো ছোটো খলসা মাছ ভুনা তুলে দিচ্ছেন । মাছ দেখে মনে হল মরিচের সালাদ । বুঝতে পারছি মশলা বলতে শুধু টকটকে লাল মরিচ বাটা ব্যাবহার করা হয়েছে । আমি আড় চোখে বাবার দিকে তাকালাম , তিনি শিশুর মতো নিষ্পাপ হাসি দিলেন আমার উদ্দেশ্যে এবং খুব সহজ ভঙ্গীতে মাছ ভাতের লোকমা মুখে দিলেন । যেন উনার কোনও টেনশন নেই যে ওনার মেয়ে ঝাল কে আগুনের মতই ভয় পায় ।
‘খাও মা, খালের মাছ । বরফ দেয়া না । তোমার দাদা ধরছে বেইনগার বেলা, খুব স্বাদ ।
চাচী বললেন ।
আমি আড়ষ্ট হাতে ভাত মুখে দিলাম। তীব্র ঝালের ধাক্কা সামলে নেবার জন্য প্রস্তুত। কানে বাবার মৃদু হাসির আওয়াজ এলো ।
তবে ভাত খাওয়া শেষ হতেই আমার ঝালের কষ্ট উবে গেলো । সত্যি এই স্বাদ ভুলে যাবার নয় । মোটা লাল চালের ভাত । এত সুস্বাদু সুমিষ্ট, না খেলে বুঝার উপায় নেই । এমন ভাতের সাথে ঝাল, তিতা যাই হোক না কেন তা অমৃত । আর আমিতো খেলাম চাচীর ভাষ্য মতে, খেত হতে তুলে আনা লাল আলু , আধা পাকা টমেটো দিয়ে ডিম ভুনা । টমেটো দিয়ে আমার ভাই এর ধরা খলসে মাছ । গাছ থেকে ছিঁড়ে আনা সিম আলু আর খেতের বেগুন দিতে মাখা ঝোল তরকারী । টমেটো দিয়ে ডাল । সাথে ঠাণ্ডা আর কিছুটা লবণাক্ত পানি, অন্য রকম স্বাদ এই পানির এটা কোনও ফলের সরবতের চেয়ে কম সুস্বাদু নয় ।
তাই ওনার কথা মেনে নিলাম, সত্যি মনে থাকবে বহুদিন চাচীর হাতের এই রান্না ।
বাবা আমার চাচাত ভাই আর চাচীর সাথে কিছুক্ষণ কথা বলে নিলেন । আমি এই ফাঁকে ক্যামেরা দিয়ে নদী আর গাছ গাছালির কিছু ছবি তুললাম , বাচ্চাদের ছবি তুললাম । মহিলাদের ও তুলতে চাইলাম তবে ওনারা শাড়ির আঁচলে মুখ ঢাকার চেষ্টা করছেন দেখে আর তুললাম না । অত্যন্ত লাজুক আর ভীরু দৃষ্টি নিয়ে তারা আমার দিকে তাকিয়েছিল, আমি দীর্ঘ নিঃশ্বাস নিলাম, হায় ! আর কতকাল পরে আমাদের গ্রামীণ মেয়েরা চিবুক উঁচিয়ে কথা বলবে আর হাসবে আর প্রতীবাদ করা শিখবে ? ওদের আচরণ আমাকে কিছুক্ষণের জন্য অন্ধকার করে দিল ।
অবশেষে যখন দাদার বাড়িতে পৌঁছুলাম ততক্ষণে রোদের তাপ কমে এসেছে। আমি ক্লান্ত এবং তৃষ্ণার্ত , সেই সকাল দশ টায় দাদা বাড়ির উদ্দেশ্যে রওনা দিয়েছিলাম আর ঠিক এই মুহূর্তে ঘড়িতে সময় ঠিক ৪টা । এর মধ্যে মেজো চাচার বাড়িতে কিছু সময়ের জন্য থেমেছি, ভাত খেয়েছি ।
সন্ধ্যা ৭ টা ।
নদীর চরে একটা হেলে পরা শিরীষ গাছের নুয়ে পরা ডালে বসে আছি। জায়গাটা অন্ধকার , নদীর পানি ছুঁয়ে বয়ে আসা ঠাণ্ডা বাতাস ভীষণ ভাবে সজীব করে দিচ্ছে । কিছুক্ষণ পর পর ইঞ্জিন চালিত নৌকার শব্দ পাচ্ছি সেই সাথে ঢেউ আছড়ে পড়ার মৃদু ছল ছল আওয়াজ ।
‘আপু ঘরে যাই চল।
পাশে বসা চাচাতো বোন রাবেয়া বলে উঠল ।
‘ না, আর একটু পর’
‘আবার যাবা কাকাদের ঘরে ?
ও কিছুটা অবাক স্বরে জানতে চাইল
‘হুম’
আমি নদীর ঘ্রাণ মাখা বাতাস বুক ভরে নিলাম , কিছুক্ষণ আগে আমার দাদার ঘরের ঠিক পাশের ঘর আব্বুর চাচার ঘরে গিয়েছিলাম । ঘর অন্ধকার ছিল কারণ ঘরের এক মাত্র বাসিন্দা আব্বুর চাচী উনি কলপাড় গিয়েছেন পানি আনতে ।
তাই এখানে নদীর পাড়ে বসে অপেক্ষা করছি তার ফিরে আসার, কারণ ওনার সাথে দেখা করাটাই আমার মূল উদ্দেশ্য, কিছু কথা বলতে চাই তার সাথে , তবে জানি সব কিছুই একটু কঠিন হবে আমার জন্য কারণ ব্যাপারটা শুধু এই জন্য নয় যে আমি অনেক দিন পরে গ্রামে এসেছি এবং সকলের কুশলাদি জানতে চাইছি। ব্যাপারটি বেদনা বিধুর ও স্পর্শকাতর।
এইবার দাদু বাড়ির আসার মুল কারণ এখানে । নার্ভাস লাগছে । বুঝতে পারছি আমি কতটা ব্যাকুল হয়ে আছি । আর তা কেনই বা নয় । অনেক দিন ধরে অপেক্ষায় আছি ঠিক এই মুহূর্তটার । দীর্ঘ নিঃশ্বাস নিলাম । আমাকে পারতেই হবে । আবেগের লাগাম টেনে নিলাম ।
কিছুক্ষণ পর...
হারিকেনের ম্লান আলোতে আমি দেখছি এক বৃদ্ধার মুখ । ঠিক ৫ বছর আগে উনি কতটা আলাদা ছিলেন তা স্মরণ করা আমার জন্য খুব কঠিন নয়। তার চোখের সেই ধারালো আর আগুন জড়ানো দৃষ্টিটা নেই , চামড়ার উজ্জ্বলতা নেই ।
মাথা নিচু করে সুপারি কাটছেন। চোখ থেকে অশ্রু ধারা নেমে আসছে ।
আমার নিজের চোখ ও সিক্ত । হৃদয় অশান্ত মনের মাঝে পুরনো স্মৃতির গুলো বার বার ভেসে উঠছিল ।
‘তুমি কও আল্লাহ্ আমারে মাফ করবো ?
ওনার স্বরে তীব্র অনুশোচনা। চোখ না তুলেই প্রশ্ন করলেন । আমি প্রচণ্ড অবাক হয়ে গেলাম , এই ধরনের কথা উনি বলবেন এটা আমার চিন্তার বাহিরে ছিল ।
একজন বদরাগী বেপরোয়া আর ধারালো মুখো মহিলা হিসেবে যে পরিচিত সবার কাছে তিনি এভাবে আমাকে এই কথা বলবেন সেটা মেনে নেয়া মুশকিল । কিছু বলতে পারলাম না আমার স্বর আঁটকে আছে ।
‘ আইজ প্রায় ৪ বছর হইতে চলল তোমার কাক্কু জেইল । আমার সোনার ধন , আমার মাণিক । আন্ধার জেইল , চান্দের আলো নাই সূর্যের আলো নাই । ওঃরে আমার দুলাল রে , কেমনে থাকো তুই ওই জাহান্নামে!
হাতের সরতা ছেড়ে উনি আঁচল দিয়ে মুখ ঢাকলেন । শীর্ণ কাঁধ কেঁপে কেঁপে উঠছে।
কাঁদছেন ।
আমি ওনার কাঁধে হাত রাখলাম । পিঠে হাত বুলিয়ে সান্ত্বনা দিচ্ছি । তবে কোনও কথা বললাম না । জানি কোনও রকম সান্ত্বনা তাঁর এই কষ্ট লাঘব করবেনা । আমার চোখের অশ্রু ও অবাধ । আটকানোর চেষ্টা করছিনা ।
‘দাদী , আমাকে বলেন কি হয়েছিল সেদিন ।
শান্ত স্বরে বললাম । ওনার এই অনুতপ্ততা আমাকে এই কথা বলার সাহস দিলো । ভেবে ছিলাম দাদীকে শুধু একবার চোখে দেখে নেবো , ওনার বর্তমান অবস্থা দেখে নেবো । তবে ভাবতে পারি নাই যে এই প্রশ্ন করার সুযোগ টা পেয়ে যাবো ।
হয়তো আমার কথায় উনি কিছু উপলব্ধি করলেন । শান্ত হলেন । আঁচলে চোখ মুছে নিলেন। ছোটো বেলা থেকেইএই মহিলাকে আমি চিনি , জানি উনি প্রচণ্ড রকম শক্ত আর আত্মনির্ভরশীল একজন মানুষ । অল্প বয়সে বিধবা হয়েছেন । কিন্তু স্বামীর ঘর ছেড়ে কোথাও যাননি, এক মাত্র শিশু পুত্রকে নিয়ে থেকে গেছেন স্বামীর ঘরে , জয় করেছেন জীবনের বিভিন্ন যুদ্ধ । সন্তানের মুখের দিকে তাকিয়ে পার করেছেন দীর্ঘ সময় । গ্রামের সবাই জানে তিনি কি অসম্ভব ভালবাসেন তার ছেলেকে । আজকে তার সেই নাড়ির ধন কারাগারে বন্দী জীবন কাটাচ্ছে । আর তিনি এই অন্ধকার ঘরে একা একা কেঁদে কেঁদে সৃষ্টিকর্তার ক্ষমা চাইছেন। কি দুঃখজনক এই বাস্তবতা ।
অথচ ঠিক পাঁচ বছর আগে আমি এই ঘরে এসেছিলাম । এই ঘর তখন অন্য রকম ছিল । আলোকিত ছিল কিছু মানুষের পদচারণয় , যাদের চোখে দেখেছিলাম ঝলমলে এক আগমনী ভবিষ্যৎ বার্তা , এবং অফুরন্ত স্বপ্নের রঙধনু।
কিন্তু আজ সেই মানুষ দুটি নেই , আলো নেই , সব কিছু নিথর আর ধ্বংস প্রাপ্ত ।
চোখ বন্ধ করলাম
সুখী আর হাসি মাখা একটা মুখ আমার হৃদয় ভেসে উঠলো । কি আন্তরিক কি অসাধারণ সেই ছিল সেই মানুষটি । চিন্তা করতেই আমার বুকে আগুনের উত্তাপ পেলাম যে সেই মানুষটি কি নির্মম ভাবে মৃত্যু বরন করেছেন, তিনি এই বৃদ্ধা মহিলার একমাত্র পুত্র বঁধু সম্পর্কে আমার কাকার স্ত্রী ।
যাকে আমি খুব একটা দেখিনি অথবা তার সাথে তেমন কোন কাছের সম্পর্কও ছিলনা তবে যতটুকু দেখেছি তাতেই তিনি আমার হৃদয় জয় করে নিয়েছিলেন । কাকার মুখ টাও ভেসে উঠলো। প্রত্যয়ী সুন্দর একজন মানুষ । কিন্তু এখন পড়ে আছেন অনেক দূরে ভোগ করছেন তার শাস্তি প্রাপ্য । আমি কিছু বলতে চাইলাম , কিন্তু গলা শুকিয়ে কাঠ । অনেক দিনের মনের আটকে রাখা কষ্ট , ক্ষোভ আর হতাশা আমাকে নিথর করে দিয়েছে ।
‘সেদিন বউ এর ভাই আসার কথা ; ।
দাদীর স্বর আমার চিন্তার লাগাম টানল … বাস্তবে ফিরে এলাম … আগ্রহ আর ব্যাকুলতা নিয়ে তাকিয়ে আছি উনার আলো আঁধারে ঘেরা মুখটার দিকে, এই সময় টুকুর অপেক্ষায় ছিলাম চাইছিলাম দাদীর মুখ থেকে সেই মর্মান্তিক ঘটনাটা শুনি ।
‘সকাল থেকে ঘর বাড়ি ঝাড়া লেপা করতেছেল মাইয়াডা… কি কি রানবে সেই কথা বার বার জানতে চায় আমার কাছে , খুশির তুফান ওর চোখে মুখে ... মা মরা মেয়ে, চাইর ভাইয়ের সবার ছোট , ভাইগো চক্ষের মনি ছিল ও ... কিন্তু আমার ঘাড় তখন শয়তানের কু মন্ত্রণায় ভারী । ওর এইসব আনন্দ আর হাসি মুখ বিষের মত লাগতেছিল।কোন সময়ই ওরে আমি ভালো পাইতাম না, জানিনা কেন আমার কপালে দুঃখ আছে এই হের লাইগাই বুঝি।
ও কইল,
‘আম্মা , পোলাউয়ের চাউল দেন । পোলাউভাত রান্দি ।
‘নাহ !‘আইজ অই চাউল চাইস না , ভাত রান ।
আমি ওর কতায় একবারে কানে না লইয়া কইলাম,
আমার উত্তরে ও মুখ টা বেজার করলো । বির বির করে কিছু কইল।
আমি সাথে সাথে গোসসা আর গাইল শুরু করলাম ওরে , যেন এই সুযোগ এর লাইগা বইসা ছিলাম। মুখে যা আইল তাই কইলাম । কত যে কত শরীর আগুন ধরানো কথা কইলাম তা জানিনা । ও কোন জবাব দিলনা ,শুধু কান্দন শুরু করলো । ওর সুন্দর মুখটায় কষ্টের আন্ধার ঘোনায় আইল । আমি তাতে দমলাম না ... তোমার কাক্কু ঘরে আসার সাথে সাথে তারে দুনিয়ার কথা শুনাইলাম, কইলাম তর বউ দিন দিন বেয়াদ্দব হইতেছে , কথা কইলে গোসসা করে , মুখ ঝামটি মারে
সে তো চিরদিন একই রকম , কোন রকম কথা বাত্রা ছাড়াই বউরে ধইরা মাইর শুরু করলো। আমি চুপ করে না দেহার ভান করলাম , ঠাস ঠাস থাপ্পড় আর গাইলের আওয়াজ শুনতেছি।
‘অই জানোয়ার মাইরা ফেলবি তুই বউ ডারে ? ঘরের ভেতর বইসা আমি মাজাবাই এর গলার আওয়াজ শুইনা । তেলেবাগুনে জইল্লা উঠলাম ।
কিছু কইতে জামু এইসময় হটাত বউয়ের একটা গোঙরানি শুনলাম । আর সাতে সাতে মনে হইল বস্তার মত কিছু একটা পরছে । জানিনা কেন , তয় মনডার মইদ্দে কেমন যেন কইরা উঠলো , হুশ উঠলো। তাই পইরা মইরা তোমার কাকীর ঘরডায় গেলাম ।
ওরে আল্লাহ্! যাইয়া দেহি বউ আমার মাডিতে পইরা রইছে । হাত দিয়া পেট চাইপা ধরা । আমার শরীর কাইপা উঠলো ।
‘ওরে বাজান ছাইরা দে এহন’! তোমার কাক্কুরে ধাক্কা দিয়া সরাইয়া কইলাম ।
‘বেয়াদ্দব এর ঘরের বেয়াদ্দব আইজ তরে শিক্ষা দিয়া ছারমু, ময় মুরুব্বী মানস না! আম্মা আপনে যান দেহি ! হেয় আমারে সরায়া দেতে চাইল , রাগে ফোঁস ফোঁস কইরা দম ছারতেছে। আমি তার সার্ট ধইরা জোরে টান দিলাম । সরাইয়া দিলাম দূরে । তারপর মাটিতে পইরা থাকা বউয়ের ঘাড় ধইরা উঠানোর চেষ্টা করলাম । বুঝতে পারছিলাম যে পোলায় মাইর আমার বউয়ের পেটে বেকায়দায় লাগছে । বউয়ের ঠোঁট দিয়া রক্ত গড়াইতেছিল । মুখটা নীল ব্যথায় । আমার গা ধইরা উঠার চেষ্টা যখন করলো । বুঝলাম যে ওর একটু শক্তিও নাই । হটাত দেখলাম রক্ত ! দেখলাম ওর পায়ের নিচ দিয়া রক্তের জোল নামছে মাডির দিক। আর মনে হইল যেন নিচের দিক ডাইবা গেলাম । বুঝতে পারছিলাম সব্বনাশ অইতে বাকি নাই ।
তোমার কাক্কুরে চিল্লাইয়া ডাক দিলাম । মনে মনে আল্লাহ্র নাম লইছি আর ভয় কাঁপতেছি । কিন্তু আমার ডাকেও তোমার কাক্কু আহেনা । বারেন্দায় তখনো তাঁর হুমকি ধমকির আওয়াজ শুনি ।
এর মধ্যে মাজেদার মা হাজির । সমানে তার মুখে গালাগাল , আমার আর তোমার কাক্কুরে সমানে গাইলাইতেছিল । তয় আমি ওরে দেইখা যেন জানে পানি পাইলাম । দুই জনে বউরে ধইরা খাডে শোয়াইলাম । ওর চোখ বন্ধ আছিল , শরীর ছাড়া দেয়া ।
‘বুড়ি ! তরে আল্লাহ্ জাহান্নামে ফেলব ! জনমে তুই ঠিক অইবিনা । পোয়াতি বউ তর
এমনে মাইর খাওয়াইলি ! তগো মা পোলার কপালে আল্লাহ্ ঠাডা ফেলেনা ক্যান !
মাজেদার মা এইভাবে গাইল ঝারতেছেল । আমি কোন জবাব দেইনা । রক্ত বউয়ের শাড়ির উপর দিয়া বের হইতেছে দেইখা । মাজেদার মা আমারে জোরে ধাক্কা দিয়া দরজার দিক পাঠায় দিল
তোমার কাক্কুরে কইতে কইল ডাক্তার রে আনার কথা । নইলে কপালে শনি আছে সেই কথা ও কইল ।
আমি গেলাম তোমার কাক্কুর কাছে । কইলাম বউয়ের অবস্থা । সেও বুঝল । চেহারা তার বদলাইয়া গেল পলকে ।
‘এহুনি যাই !
কইয়া পাগলের লাহান ঘর থেকে বাইর অইয়া গেল । কিন্তু বইন গো ! যা আমার পাপের শাস্তি তাই অইল । আমার বউডা মইরা ই গেলো রে !’
দাদী আবার কান্নায় ভেঙে পড়লেন।
আমি নিথর হয়ে হয়ে রইলাম । কথা বলার ভাষা নেই ... নিঃশ্বাস নিতে কষ্ট মনে হল ... চোখে বেয়ে অশ্রু নামছে অজান্তে ।
এর পরের সেই মর্মান্তিক ঘটনা আমার জানা আছে । জানা আছে মাত্রাধিক রক্ত ক্ষরণ । গ্রামের অপ্রতুল আর দুর্বল চিকিৎসা ব্যবস্থার কাছে পরাজিত হয়ে অসহায় মৃত্যু বরন করেন আমার গর্ভবতী কাকী । কষ্ট আর ক্রোধের একটা ঠাণ্ডা জোয়ার আমার ভিতর বইছিল । কি বলা যায় অথবা কি বলা উচিত সেটা জানিনা । কিছুক্ষণ নীরব হয়ে থাকলাম । ঠোঁট কামড়ে নিজেকে কঠিন কিছু শব্দ বলা থেকে সংবরণ করলাম । কি আর হবে এখন যা হবার হয়েই গেছে । শুধু মাত্র আমার মনের আগুন হয়তো নিভে যাবে যদি চিৎকার করে মনের ভাব প্রকাশ করি আর এই মুহূর্তয়ে সেই মানুষটি যে একটি একজন , মানুষ একটি পরিবার এবং অবশ্যই তার নিজের ও ধ্বংসের মূল আসামী । তিনি দুর্বল ভীত , আর অপরাধী হয়ে আকুল হয়ে কাঁদছেন নিজেকে অভিশাপ আর দোষারোপ করছেন ... আমার উনাকে কিছু বলার প্রয়োজন আছে বলে মনে করছিনা বাস্তবতা আর পরিণতি উনার সকল ভুলের মাসুল কড়ায় গণ্ডায় আদায় করে নিচ্ছে ।
আহা ... কি নিদারুণ বাস্তবতা । এই ঘরে একটা ছোট্ট শিশুর এখন হেঁটে বেড়ানোর কথা ... তার মুখে কথার ফুলঝুরি ফোটার কথা ... দাদী দাদী বলে দাদীর কোল জুড়ে ভালবাসার ঢেউ উঠানোর কথা । কিন্তু বাস্তব হল এই যে এখন এই ঘর অন্ধকার । এখানে কোন আলো নেই ভবিষ্যৎ স্বপ্ন নেই , নেই কোন স্বপ্ন বরং অভিশাপ প্রাপ্ত ভূতুরে এক দুঃস্বপ্ন এর মত এই ঘরটি এখন ।
শুধু এই ঘর নয় । আশে পাশের সমস্ত মানুষ গুলোও হয়তো এই নিদারুণ বেদনার ভাগীদার । একটি পাপ, একটি দুর্ঘটনা একটি হিংস্রতা ... সবার জন্য বেদনার কারণ ।
বাড়ি ফিরে আসার পথে আমার চোখ বেয়ে কান্নার ঢল । আহা ... এমনটি হবার কথা ছিলোনা ।
কিন্তু হয়েই চলছে ... পরিবার থেকে পরিবার গ্রাম থেকে গ্রাম শহর থেকে শহর ...কোথাও না কোথাও এইভাবে কত কাকীরা কত মা বোন আর স্ত্রীরা এই নির্যাতনের শিকার হচ্ছেন । প্রাণ হারাচ্ছেন ... কেউ কেউ বেঁচে আছেন কিন্তু হয়তো প্রতিনিয়ত এই সব হিংস্র মানসিকতার স্বীকার হচ্ছেন । হয়ত কোথাও শাশুড়িরাও নির্যাতিত হচ্ছেন। আর এইসবের জন্য আমারা সবাই কোন না কোন ভাবে কম বেশি দায়ী । আমাদের উদাসীনতা ... অজ্ঞতা আর অসতর্কতা সহ আরও অনেক রকম সমস্যা এর মূল কারণ ।
আমি চোখের অশ্রু মুছে নিলাম । নিজের সাথে প্রতিজ্ঞা বধ্য হলাম । আমি বেঁচে থাকতে আমার পরিবারে কখনো কোন ভাবেই এই অপরাধ কে মেনে নেব না । এবং এর বিস্তার রোধের জন্য আমার যতটুকু শক্তি আর সাহস প্রয়োজন তা আমি প্রয়োগ করতে পিছু পা হবোনা । পরিবার থেকেই এর সূত্র শুরু হয় আর পরিবার থেকেই শুরু হয় পতন। আমি চাইনা আমার পরিবার ও এর মধ্যে পতিত হোক । চাইনা কোন পরিবারই স্বীকার হোক এই বর্বরতার । আমাদের পরিবার , সমাজ দেশ আর পৃথিবীর প্রতিটি জনপদের মানুষ গুলোর মনুষ্যত্ব ফিরে আসুক জেগে উঠুক ,পতিত আর ধ্বংসপ্রাপ্ত হবার আগেই ।
অন্ধকার আর অভিশপ্ত সেই বাড়িকে পেছনে রেখে আমি সামনে আগালাম। আমার সম্মুখে আমি অন্ধকার নয় আলো চাই । হিংস্র জানোয়ার নয়, মানুষ চাই ... নিরাপত্তা, শ্রদ্ধা আর ভালোবাসা চাই ।