সেই তো সেদিন,বাবজান-এর ঘাড়ে উঠে ভুঁইয়ের আইল ধরে ঘুরে ঘুরে বোশেখ মেলায়।
সে কি আনন্দ। ছোট হাতে হাটের লাল লিপিষ্টি ঠোঁটে মেখেছিল। পায়ে লাল টুকটুকে আলতা।
বাপ এনে দিয়েছিল রবিবারের হাট থেকে।
সাঁঝঘোরে বাজান ফিরলে,মা’বাড়ীর দরজায় বাতি ধরে দ্বারিয়ে। বাবজান ডাকলো,আমার কবিতা মা’কোথায় গেলিরে?
এই দিক আয় নারে মা। তোর জন্য দেখ কি এনেছি?……………………….
মেলায় সে কি আনন্দ,ঝাঁকে ঝাঁক রঙ্গিন বেলুন,বাঁশি বাজছে চারিদিকে,খেলনা ঢোলের বাজনা,তালপাতার বাঁশি। বাঁসের চিকন নলের বাঁশি, তাতে আবার লাল নীল কাগজ লাগানো। কবিতা এ সব দেখে,ওতো স্বপ্ন রাজ্যে ঘুরে বেড়ায়, মন আজ বরই চঞ্চল। সারা বেলা মেলায় অথচ মায়ের কথা মনেই নাই। বাজান তো অবাক,কিরে কবিতা,বেলা যে পরে এলো মা চল বাড়ী ফিরি। কবিতা বলে, সবেতো বিকেল বাবা,ঐ,ঐ তো চরকি ঘুরছে,উঠবো বাবা,নারে মা ভয় পাবি তো,তুই একটু বড় হও তারপর উঠবি।
এমনি সুখেই দিন যাচ্ছিলো,কবিতা,মা আর বাবা আলীর ছোট্ট সংসার। বর্গাচাষী আলী,গ্রামের মাহাতাব মোড়লের বর্গা জমি চাষ করে। মেয়ে বড় হবে,বড় বড় পাশ দিবে কবিতা,জেলা শহরে পড়বে। এমনি কত আশা আর স্বপ্ন বুনে আলী।
সবাইতো নাছর বান্দা,আলী’রে তোর আর বংশ রক্ষা হল না? আর একটা পুত্র সন্তান না হলে হয়? আলীর একই জবাব কবিতাই আমার ছেলে আমার মেয়ে,কবিতাই আমার সব।
শিউলি ঝরা ভোর। ঘড়ের টিনের চাল ছুঁয়ে শিশির পরে টপ টপ শব্দে।
এমনি ভোরে,কামলা বছিরের ডাক,আলী ভাই উঠ, ভুঁইয়ে যাবে না, ভোর য়ে হয়ে এলো। লেপের উম,কবিতার হাত নামিয়ে,বিছানা ছেড়ে উঠে পরে আলী,বাড়ীর শিউলিতলায় দাঁত মাজে আর শিউলি কুড়ায় চাদরের আঁচলে,কবিতার জন্য ডালায় রেখে, পূর্বের ভুঁইয়ে দিকে পা’বাড়ায় আলী।
আমন ধান উঠেছে,ধানের খড় পরিষ্কার,ভুঁইয়ে সেচ দিতে হবে,নতুন ধানের চারা লাগাতে হবে।
এমনি কাজের ফাঁকে ভুঁইয়ের আইলে বসে পরে আলী,বুকের পাঁজরে চিন চিনে ব্যথা,ব্যথা বাড়তে থাকে,ভুঁইয়ের আইলে শুয়ে পরে আলী,পাঁজা কোলা করে আলীর বাড়ীর উঠানে নিয়ে আসে কামলারা সব ধরা ধরি করে।
সাদা কাপড়ের ঢেকে দেয়া হয় আলীর শরীর,শোকের আহাজারিতে,ঢলে পরা বেলার উজ্জ্বল আলো ম্লান হতে থাকে।
সে,দিন মায়ের আঁচলে মুখ ঢেকে ডুকরে ডুকরে কেঁদেছিল কবিতা,আজও বাপের স্মৃতি ভুলতে পারে না কবিতা।
তাইতো রাত এলেই বাপের যত স্মৃতি কবিতার মনে হানা দেয়।
সন্ধ্যা হলেই কবিতা বর উদাস হয়। সাঁঝের মায়ার মত আচমকা সারা দিনের চঞ্চলতা ভুলে যায়। ছোট বেলার উঞ্চতা খুঁজে।
নদীর প্রসব বেদনায় জল যখন উতলায়, জোয়ার যৌবন। আরধ্য জ্যোস্না রাতের বাসর সাজায়।
জ্যোস্নার আলো মাখামাখি উচ্ছলতা,পুকুরের বদ্ধ জল ফিরে পায় যৌবন। এমনি স্বপ্নভুক রাতে ঘুম আসে না,
সদ্য যৌবনে পা রাখা কবিতার। ঘরের খিড়কি দিয়ে জ্যোস্নার ঝিক ঝিক আলো কবিতার চোখে পরে।
ঘড়ের আলো আঁধারে,ঘুম যেন পালিয়েছে আজ।
মাঘের শীত পেরিয়ে বসন্ত ফুরালো,আগামীকাল পহেলা বৈশাখ। বোশেখ মেলা,কয়েক গ্রাম পরে বসবে কাল। কবিতার মনে পরে যায়,বাবজানের সাথে সেই যে মেলায় ঘুরেছিল,মুখে তালপাতা বাঁশি। বেলুন বাঁশির আওয়াজে মাতো বিরক্ত হয়ে বলল,যা'তো উঠানে গিয়ে বাজা, আমার কানতো ধরে গেলরে মা--------এমনি বাবজানের স্মৃতির আগলে, আজ বন্দি কবিতা।
দখিনের খিড়কি তাই খোলা রেখেছে কবিতা জ্যোস্নার জন্য, জ্যোস্না এখন উর রাতের সাথি।