এক
.....................
রহিম মিয়াঁ তাড়াহুড়া করে বেরুতে গিয়ে দরজার চৌকাঠে ধাক্কা খেলো । মনে মনে বিরক্ত হলেও মুখে কিছু বলল না , আজ এম্নিতেই অনেক দেরি হয়েছে কাজে যেতে । স্কুল বন্ধ থাকায় দুলাল বায়না ধরেছে সেও যাবে বাবার কাজ দেখতে । এই মুহূর্তে ছেলের আব্দারের কাছে হেরে গেছে রহিমের পিতৃহৃদয় । দুলাল কে নাস্তা খাইয়ে তৈরি করতে গিয়ে দেরিটা হল । দুলালের সবুজ ফতুয়াটা খুঁজে পেতে অনেক সময় লাগলো, মরিয়ম কোথায় যে রাখে জামা কাপড় তা এক মাত্র ওই জানে । মরিয়ম হোটেলের মশলা বাটার কাজ করে , অনেক সকালে বেচারিকে বের হতে হয়।
ঘরের বাইরে পা দিয়েই প্রতিদিনের অভ্যাসে রহিম তাকালো সামনের পেয়ারা গাছটার দিকে । কি সুন্দর কচি সবুজ পাতায় গাছটা নিজেকে ভরে রেখেছে ! যতবার এই গাছটার দিকে চোখ পড়ে খনিকের জন্য রহিম চলে যায় তার গ্রামের বাড়ির ভিটায় । ঠিক এই রকম একটা গাছে সারাদিন কাটতো দুলালের মতো বয়সে । এই খানে সবুজের বড় অভাব ! সাধ্য থাকলে এমন হাজার হাজার পেয়ারা গাছে নিজের বাড়ি , উঠান ভরে দিতো সে। নিজের মনে লালন করা এই স্বপ্ন নিয়ে যখন রাস্তায় নামলো তখন বাজে প্রায় ১০টা , সকাল ৮টার পরপরই অন্যদিন কাজে বেরিয়ে পড়ে রহিম মিয়াঁ । আজ নির্ঘাত শেখের ঝাড়ি খেতে হবে , বয়সে ছোট হলে কি হবে মুনিবগিরি ভালই ফলায় শেখ । একটা দীর্ঘশ্বাস বেরিয়ে আসে ওর বুক হাল্কা করে ।
শন তলা কাঁচা বাজার , বছর তিনেক আগেও এখানে বেশ কয়েকটা বড় বড় মেহগুনি গাছ ছিল , রাস্তা বড় করার নামে গাছগুলো কাটা পড়লো ঠিকই কিন্তু রাস্তা আর বড় হল না । এই বাজারেই মাছ কাটার কাজ করে রহিম , আগে এই কাজ করার লোক তেমন খুঁজে পাওয়া যেত না , কিন্তু আজকাল বাজারে মাছ মুরগি কেটে দেবার আলাদা লোক থাকে । আজকালকার পয়সাওলা সাহেবরা বাসায় মাছ কাটার কষ্ট করতে চায় না , ১০ টাকা ২০ টাকার বিনিময়ে মাছ মুরগি কেটে বাসায় নিয়ে যায় । রহিম মিয়ার মতো মানুষ তাই কিছু একটা করে খেতে পারছে ।
দুই
...............
দুলাল বাবার মাছ কাটা দেখতে খুব পছন্দ করে , কি সুন্দর ফট ফট করে বাবা বড় বড় রুই, ইলিশ, বোয়াল কেটে ফেলে দেখতেও ভালো লাগে । দুলাল আগে কোন মাছই চিনত না , বাবার সাথে বার দুয়েক এসে অনেক মাছ চিনেছে । আজ প্রায় ঘণ্টা দুয়েক হল দুলাল বসে বসে বাবার মাছ কাটা দেখছে । আজ দুলাল কথাও বলছে বেশি , যেই মাছ ই কাটছে রহিম মিয়াঁ দুলাল সে মাছের টেঁস কেমন জানতে চাইছে ......।।বাবাও তার যৌবনের স্মৃতি হাতড়ে ছেলের প্রশ্নের উত্তর দিয়ে যাচ্ছে ।
এক সাহেব বেশ বড় একটা রুই মাছ কাটতে দিয়েছেন , তিন কেজির বেশি ওজন । একটু দূরে দাড়িয়ে তিনি দুলাল আর রহিম মিয়ার কথা শুনছেন ।''বাবা রুই মাছ কি অনেক টেঁস ?'' দুলালের প্রশ্নের উত্তরে রহিম মিয়াঁ শুধু মাথা নাড়াল , ছেলে কে ভালো মন্দ কিছুই খাওয়াতে পারেনা অভাবের সংসারে । '' জানো বাবা আমাদের কেলাশের বাবু কাল গল্প করিছে রুই মাছের মাথার , ওর বাবায় রুই মাছ আনলে ওরা মাথা দিয়ে কি যেন একটা রান্না করি খায় । রহিম উত্তরে '' বাজান আমারে কাজ করিতে দেও, কাজের সমায় কথা কলে সমেস্যা হয়।''
'' আচ্ছা কথা কবনা'' ......দুলাল বলে ঠিকই কিন্তু বেশিক্ষণ চুপ থাকা ওর স্বভাবে নাই । আচ্ছা বাবা তুমি কি এত্ত বড় রুই মাছ কোন দিন খাইছ? ............নারে বাপ আমরা গরিব মানুষ এতো বড় মাছ কই পামু ।
'
''মায় কি কোন দিন খাইছে বাবা ''.........দুলালের প্রশ্ন থামেনা । পাশে দাঁড়ানো সাহেব অনেক ক্ষণ দুলালের মুখের দিকে তাকিয়ে থেকে কি যেন ভাবলেন । দুলালের গায়ের ফতুয়ার দিকে গভীর দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইলেন । জায়গায় জায়গায় রঙ জ্বলে গেছে ফতুয়ার তবু বেশ লাগছে ছেলেটিকে । মাছ কাটা শেষ হলে রহিম মিয়াঁ ব্যাগে মাছের টুকরাগুলো ভরে দেয় , সাহেব আগেই বলেছিলেন মাথাটা আলাদা ব্যাগে ভরে দিতে , রহিম মিয়াঁ সেই মতই আলাদা একটা ব্যাগে মাথাটা ভরে দিল । সাহেব মাছ কাটার জন্য ২০টা টাকা দিলেন ।রহিম মিয়াঁ মনে মনে খুশি হয় , সবাই একটা মাছের জন্য ২০ টাকা দিতে চায় না ।
দুলাল আবারও প্রশ্নকরে '' বাবা আমারে একদিন বড় একটা রুই মাছ খাওয়াবা "। খাওয়াব বাজান , হাতে টাকা হলিই খাওয়াব।
''মাছের মাথা কিন্তু আমারে দেওয়া লাগবি ।'' আচ্ছা তুমি মাছের মাথা খাবা আর কেউ খাবি না ............এই কথা বলতে গিয়ে রহিম মিয়ার চোখে সামান্য জ্বলুনি হয় , ''ছোড মানুষ, কত কিছুই না জানি খাতি মন চায় '' । একটা দীর্ঘশ্বাস বেরিয়ে আসে ভিতর থেকে । বুক চিরে বেরিয়ে আসা এই দীর্ঘশ্বাসগুলই বাঁচিয়ে রাখে সমাজের এই মানুষগুলোকে ।
তিন
............
'' এই ছেলে তোমার নাম কি? ''
সেই সাহেব আবার আসিছে কেন ,বুঝতে পারে না বাবা -ছেলে ।
''আমার নাম মহাম্মদ দুলাল হসেন ''
'' বাহ খুব ভালো, স্কুলে পড়ো ?''
'' জি ছার কেলাশ টুতে পরি ।''
'' বাহ বেশ ......বাসার আর কে আছে তোমার ?''
''বাসায় মায় আছে আর কেউ নাই ।''
''শোন তুমি এই ব্যাগটা রাখ ''..................সাহেবের কথাটা ঠিক বুঝতে পারল না রহিম মিয়াঁ ।
কেন ছার , আপনি নিবেন না ?
না আমরা রুই মাছে মাথা খাই না । তুমি এটা বাসায় নিয়ে যাও। তোমার ছেলেকে রান্না করে খেতে দিও।
কি কন ছার .........এতো বড় মাছের মাথা আপনি দিয়া দিবেন ? ''
'' হা রাখ ওটা '' বলে আর দাঁড়ালেন না মিজান সাহেব । আসন্ন বৃষ্টির আগের কালো আকাশ হয়ে গেল মনটা । নিজের ছেলের কথা মনে পড়েছে ঐ ছেলেটার কথা শুনে , ঠিক এই রকম সবুজ ফতুয়া মিতুলের ও ছিল একটা । মিতুল ও রুই মাছের মাথা খুব পছন্দ করতো । সামাজিক অবস্থান পার্থক্য রচনা করলেও কি একটা অদ্ভুত মিল থাকে মানুষের মাঝে ।
চার
.........।।
ও যাবার পর আর নিজেরা মাছের মাথা খান না । ছেলেটা ৮ বছর বয়সে হুট করেই চলে গেল ধরা ছোঁয়ার বাইরে । রিক্সায় যেতে যেতে মিজান মুহূর্তেই চলে গেলেন দুই বছর আগের সেই দিন্ টায় । গ্রামের বাড়ি বেড়াতে গিয়ে , ফিরে আসার দিন শেষ বারের মতো খেলতে গিয়ে বাড়ির পেছনের পুকুরে কিভাবে যে ছেলেটা পড়ে গেল, বাড়ি ভরতি এতো গুলো মানুষ কেউ জানলো না ।যখন অনেক খোঁজাখুজির পর পুকুরে সবুজ রংয়ের কি যেন একটা ভাসতে দেখল মতিন চাচা, ততোক্ষণে সব শেষ । ঝাপসা চোখে মিজান তাকিয়ে থাকে রাস্তার ছুটে চলা মানুষ আর গাড়ি আর গাছাপালার দিকে ।
খুশিতে দুলালের মুখে হাসি ঝলকে উঠলো , এক মুহূর্তে উবে গেল পুরাতন সবুজ ফতুয়ার বিবর্ণতা আর ছেলের মুখের দিকে তাকিয়ে ঝাপসা হয়ে উঠে রহিম মিয়ার চোখ ।
১৭ আগষ্ট - ২০১১
গল্প/কবিতা:
৪৮ টি
বিজ্ঞপ্তি
এই লেখাটি গল্পকবিতা কর্তৃপক্ষের আংশিক অথবা কোন সম্পাদনা ছাড়াই প্রকাশিত এবং গল্পকবিতা কর্তৃপক্ষ এই লেখার বিষয়বস্তু, মন্তব্য অথবা পরিণতির ব্যাপারে দায়ী থাকবে না। লেখকই সব দায়ভার বহন করতে বাধ্য থাকবে।
প্রতি মাসেই পুরস্কার
বিচারক ও পাঠকদের ভোটে সেরা ৩টি গল্প ও ৩টি কবিতা পুরস্কার পাবে।
লেখা প্রতিযোগিতায় আপনিও লিখুন
-
প্রথম পুরস্কার ১৫০০ টাকার
প্রাইজ বন্ড এবং সনদপত্র।
-
দ্বিতীয় পুরস্কার ১০০০ টাকার
প্রাইজ বন্ড এবং সনদপত্র।
-
তৃতীয় পুরস্কার সনদপত্র।
আগামী সংখ্যার বিষয়
লেখা জমা দেওয়ার শেষ তারিখ ২৫ ডিসেম্বর,২০২৪