সামনের সারির বাম দিকে বসা মেয়েটি অনেকক্ষণ হলো কিংশুকের দিকে তাকিয়ে আছে , মেয়েটির চোখ দুটোর দিকে বেশিক্ষণ তাকাতে পারছে না কিংশুক ।গভীর কালো চোখ আর এমন তীব্র চাহনি ও আগে কখনো দেখেছে কিনা মনে করতে চেষ্টা করলো । চোখ দুটো অপলক দৃষ্টিতে তাকিয়েই আছে কিংশুকের দিকে ।
এত সুন্দর চোখ কারো হয় ? ভাবতে ভাবতে লেকচার খাতায় কিংশুক চোখের ছবিও এঁকে ফেলল, আর তখনই দিলীপ স্যার তাঁর গম্ভীর কন্ঠে লেকচার শেষ করে কিংশুকের দিকে তাকিয়ে প্রশ্ন করলেন ............''শেষ বেঞ্চ , কালো শার্ট ....আজ কি পড়ানো হলো বল দেখি?''
ক্লাসের সবাই ওর দিকে তাকিয়ে আছে , কিন্তু কিংশুক কিছুতেই মনে করতে পারল না স্যার এতক্ষণ কি পড়াচ্ছিলেন । হটাত কোথায় যেন প্রচন্ড শব্দে কিছু ভেঙ্গে পড়ল , ক্লাসের সবাই হুরমুর করে বের হতে লাগলো , কিংশুকের চোখ খুজঁতে লাগলো সেই চোখ জোড়া, কিন্তু কোথায় গেল মেয়েটা ! ঘুম ভেঙ্গে গেল কিংশুকের , আর আজকেও ফজরের আজান শুনলো ও ।
আজ নিয়ে পর পর চার দিন প্রায় একই স্বপ্ন দেখে ঠিক এই সময়ে ঘুম ভাঙ্গে যাচ্ছে কিংশুকের । বিষয়টা নিয়ে কারো সাথে যে কথা বলবে সেটাও বলা যাচ্ছে না । বন্ধুরা সব যা বিচ্ছু , এই কথা জানলে আর এক মুহূর্ত শান্তিতে থাকতে দিবে না সেটা ভালই জানে কিংশুক।
কিন্তু এমন অদ্ভুত সুন্দর চোখের কোনো মেয়ে আগে কোথাও দেখেছে বলে তো মনে পরছে না , তাহলে স্বপ্নে কিভাবে এলো ?
আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিভাগে পড়ে ও, তৃতীয় বর্ষের শেষ দিকে এসে একি যন্ত্রণা শুরু হলো.... কিংশুক ভেবে পায় না ।বিশ বছরের জীবনে কখনো প্রেমে পরার কথা ভাবেও নাই , কাওকে সেভাবে ভালো লাগেও নাই , বন্ধুদের নানা রকম উপদেশ , হাসি ঠাট্টা উপেক্ষা করে এত দিন ভালই ছিল সে । কিন্তু এখন কিভাবে কি করবে , কোথায় খুঁজবে সেই চোখ ? চোখের প্রেমে পরে গেল নাকি সে...নিজের মনেই ভাবে কিংশুক , কিন্তু কার এই অপরূপ চোখজোড়া ?
স্বপ্নে শুধু চোখ দেখেছে কিন্তু চোখের মালিককে দেখেনি ,কতবার চেষ্টা করেছে স্বপ্ন মনে করার কিন্তু লাভ হয়নি , চোখদুটি শুধু মনে পরে আর কিছু না। কার চোখ হতে পারে , সুমনার নাকি জয়ার কিংশুকের ভাবনার এখন শুধু দুটি চোখ । ওদের ক্লাসের জয়ার চোখ বেশ সুন্দর , সিহাব তো গত বছর পিকনিক এ জয়ার চোখ নিয়ে একটা কবিতাই লিখে ফেলেছিল , আর তারপরই তো জয়ার সাথে সিহাবের সম্পর্কের শুরু ।
পড়াশোনা মাথায় উঠেছে , ভার্সিটি যেতে আসতে সারাক্ষণ কি যেন খুঁজে বেড়ায় ছেলেটা , খাবার টেবিল এ বসেও খাবারে মন থাকে না , আর ঘুম সেতো সোনার হরিণ , শুধু শেষ রাতে কিছুক্ষণের জন্য চোখের পাতা এক হয় আর তারপরই সেই স্বপ্ন দেখে ঘুম ভাঙ্গা, গত কিছু দিন এই হলো কিংশুকের রুটিন । স্বপ্নে দেখা এক জোড়া চোখ কিভাবে একজনকে এতটা এলোমেলো করে দিতে পারে ।
শেষ পর্যন্ত গতকাল রবিনকে প্রশ্নটা করেই ফেলল ..
কিংশুক: রবিন দেখতো কেও তাকিয়ে আছে কিনা ?
রবিন: কি বললি ? কে তাকিয়ে আছে?
কিংশুক: আরে বাবা সেটাই তো দেখতে বলছি, দূর থেকে কোনো মেয়ে দেখছে কিনা একটু দেখনা দোস্ত ।
রবিন: কোনো মেয়ে? কে রে বলনা ? কাওকে বলবনা খোদার কসম ।
কিংশুক: রাখত তো তোর ফাজলামি , সত্যি করে বলনা কেও আমাকে দেখছে কিনা ।
রবিন: কি আমি তো কাওকে দেখছি না , কারো আসার কথা নাকি?
কিংশুক: না না সেরকম কিছু না , এমনি বলছিলাম ।
রবিন: এমনি বলছিলি মানে? আমি কি ঘাস খাই নাকি ? কেও তোকে দেখবে আর সেটা এমনি এমনি , এ আবার কেমন কথা ?
বলনা ভাই কে সেই দেবী যে তোর পাথর বুকে প্রেমের কলি ফুটাল?
কিংশুক : সত্যি বলছি রবিন কিছুই না , একটা স্বপ্ন , এক জোড়া চোখ এই আরকি ।
রবিন: কিংশুক তুই ব্যপারটা খুলে বলনা , আমাকে তো সব কথা বলিস , এটা আবার লুকাচ্ছিস কেন?
কিংশুক: লুকালাম কোথায় , এখনো বলার মত কিছু তো হয়ই নাই ।
রবিন: না বলার মত যেটুকু হয়েছে সেটাই বলনা শুনি , চাই তো আমি তোকে সাহায্যও করতে পারি ।
হুম , তাহলে তোকে খুলেই বলি .........কিংশুক গত কয়েক দিনের স্বপ্নের কথা রবিনকে বলল, শুনে রবিনের সেকি হাসি। যেন এমন আজব কথা এই জন্মে শুনে নাই ।
এই জন্যই বলতে চাচ্ছিলাম না .........মন খারাপ করে বলল কিংশুক । দোস্ত মন খারাপ করিস না , কি করতে হবে তাই বল রবিনের প্রশ্নের জবাবে কিছু বলতে পারে না কিংশুক । আচ্ছা রবিন তোর দেখা সব চেয়ে সুন্দর চোখ কার বলত ..জানতে চায় । কেন সুমনা, জয়া, ঝুমুর সবার চোখই তো সুন্দর জানায় রবিন । কিন্তু খবরদার ঝুমুরের দিকে তাকাবি না আগেই বলে দিলাম ...ঝুমুর শুধু আমার ....রবিনের কথায় হেসে উঠে কিংশুক ।
ঠিক আছে চল ক্লাসে যাই , এমনিতেই দেরী হয়ে গেছে অনেক । কলা ভবনের দ্বিতীয় তলায় ওদের ক্লাস হয় , ঠিক সিঁড়ির কাছে আসতেই কিংশুকের চোখ আটকে যায় সামনে দাঁড়ানো মেয়েটির দিকে । এই তো সেই চোখ , এত দিন যা স্বপ্নে দেখেছে সে।সবুজ জমিনে গোলাপী আর কমলার কাজ করা শাড়ী পরা মেয়েটি কি ওদের সাথেই পড়ে ? আগে তো দেখে নি কখনো !
রবিনকে চোখের ইশারায় বুঝিয়ে দেয় কিছু একটা , রবিন ও বড় বড় চোখ নিয়ে তাকিয়ে থাকে মেয়েটির দিকে ।কয়েক মুহূর্ত নাকি কয়েক ঘন্টা কেটে গেল জানে না কিংশুক .......শুধু আমতা আমতা করতে থাকে । হাত দুয়েক দূরে দাঁড়ানো মেয়েটিও যেন কি করবে বুঝতে না পেরে কিছুক্ষণের জন্য সিঁড়ির গোড়াতেই দাঁড়িয়ে থাকে ।হটাত মোবাইল ফোন এ একটা সুন্দর গানের সুরে ঘোর কাটে সবার । মেয়েটি এক পাশে সরে যায় ফোন রিসিভ করার জন্য, কিংশুক আর রবিন সিঁড়ির দিকে পা বাড়ায় ।
ক্লাসে বসেও আনমনা হয়ে আছে কিংশুক , আর রবিন বন্ধুদের কাছে এই নাটকীয় গল্পের কথা খুব আয়েশ করে বলতে শুরু করেছে , ঠিক এই সময় ৩০২ কোর্সের ক্লাস নিতে রুমে আসেন কিছুক্ষণ আগে দেখা মেয়েটি ।উনি কি তাহলে আমাদের টিচার ? প্রশ্নটা কিংশুকের মুখ ফসকে বেরিয়ে যায় অসাবধানে ।
'' কেও কিছু বলছ? '' মিষ্টি গলায় জানতে চান নতুন ম্যডাম ।আমি আজ থেকে তোমাদের ৩০২ কোর্স নেব , সবাই মনোযোগ দিবে আশা করছি ।
কিন্তু কিংশুক ম্যডাম কি পড়াচ্ছেন শুনতে পাচ্ছে না , ওর হাত চলছে দ্রুত , একটা ছবি আঁকতেই হবে এই চোখের , ছবিতে ধরে রাখতে হবে এই গভীর চাহনি। ছোট বেলায় শেখা ছবি আঁকা বিদ্যাটা কাজে লাগাতে কিংশুক মরিয়া হয়ে উঠে ।