ছেলেটির আর্তনাদে ঘরে বসে থাকা যাচ্ছে না। কিন্তু ভাইয়া আমাকে কিছুতেই বাইরে যেতে দিচ্ছে না। কিছুক্ষন আগে শাসিয়ে গেছে “খবরদার তুই ঘর থেকে বের হবি না, যা করার আমরা করব।” আমিও সে কথা মেনে নিয়ে দাতমুখ খিচে ঘরে বসে আছি। ও ঘরে ছেলেটির চিৎকার প্রতিনিয়ত বেড়েই চলেছে। এখন মনে হচ্ছে একটি আহত কুকুর যেন পানির জন্য হাসপাস করে সর্ব শক্তি দিয়ে আর্তনাদ করছে। আমি হাতের টুকটাক কাজ সারছি। না জানি ভাইয়ারা কি করছে। এখানে আমরা এসেছি ১৫ দিন হল। এর আগে অন্য ক্যাম্পে ছিলাম। আমি এই ক্যাম্পের একমাত্র ডাক্তার ও নার্স। আহত মুক্তিযোদ্ধাদের সহায়তা ও চিকিতসার জন্য ভাইয়ারা প্রায় আমার কাছে ছুটে আসে। ফারুক আমার বড় ভাই। আমরা দু ভাই বোনই একই ক্যাম্পে থাকি। এ পর্যন্ত অনেক রুগী দেখেছি। আর কোন রুগী এলেই সবাই স্বসব্যস্ত হয়ে আমার কাছে ছুটে আসে। কিন্তু আজ একদম ব্যতিক্রম। অবশ্য ব্যতিক্রম হবার কারন আছে। আজ যাকে আমাদের ক্যাম্পে আহত অবস্থায় আনা হয়েছে সে আমাদের চরম শত্রু পাকিস্তানী হানাদার। আজ সকালে অপারেশন শেষে আহত অবস্থায় ভাইয়া ওকে আমাদের ক্যাম্পে নিয়ে আসে। ভাইয়া কিভাবে যে এতবড় রিস্ক নিল বুঝলাম না। আর একে কেনই বা এখানে আনা হয়েছে ভেবে আমি অবাক হচ্ছি। ভাইয়াকে কখনই আমি এতটা অবিবেচক হতে দেখিনি। ভাইয়ার নির্বুদ্ধিতায় আজ আমরা সবাই যদি বিপদে পড়ি তবে এই দেশের কাছে কি জবাব দেব। এত বড় ভুল সীদ্ধান্ত ভাইয়া কিভাবে নিল? খুট করে দরজায় শব্দ হল। ভাইয়াসহ সিরাজ ভাই নিয়াজ ভাই আমার ঘরে এল। ভাইয়া বলল, “শিউলী চল। একটা অপারেশন করতে হবে।” আমি খুবই বিস্মিত হয়েছি। ভাইয়া এ কি বলছে! গিয়াস ভাই আর নিয়াজ ভাই মুখ শক্ত করে দাঁড়িয়ে আছে। আমি কিছু বলতে যাব ওমনি সিরাজ ভাই বললেন, “তারাতারি চলো, অবস্থা খুব একটা ভালো না।” আমি চুপচাপ বেড়িয়ে গেলাম। ও ঘরে ঢুকে আর্তনাদে বিকৃত চেহাড়ার কুকড়ে থাকা লোকটির দিকে চাইতেই ঘেন্নায় আমার সারা শরীর শিউরে উঠল। আমাকে কিনা চিকিতসা করতে হবে আমাদেরই চরম শত্রুকে? ডাক্তার হয়েছি বলে আমার কি কোন বোধ শক্তি নেই? দেখলাম দরজায় ভাইয়ারা দাঁড়িয়ে আছে। আমাকে চোখের ইশড়ায় তাগাদা দিল তাড়াতাড়ি কাজ করার জন্য। আমি লোকটির দিকে মনযোগ দিলাম। ভাইয়া সাহায্য করতে এগিয়ে এল। গুলিটি ঠিক তাঁর বুকের নিচে পেটের উপরের দিকে এসে লেগেছে। প্রায় দু ঘন্টা পর আমি গুলিটি বের করতে সমর্থ হলাম। পাশে প্লেটে গুলিটি রাখতেই টুং করে শব্দ হয়ার সাথে সাথে লোকটি যেন একটু কেপে উঠল। ভাইয়ারা ব্যন্ডেজ করতে লেগে গেল। আমি হাত মুখ ধুতে বের হয়ে গেলাম। বিকেল বেলা একবার চেকাপ করতে ও ঘরে গিয়ে দেখি ছেলেটি চোখ মেলে চেয়ে আছে। আমি পালস চেকাপ করতে ওর হাত ধরতেই অন্য হাত দিয়ে আমকে চেপে ধরল। আমি চমকে উঠে ভয়ার্ত চোথে তাকাতেই দেখলাম যাকে আমি বিকৃত চেহাড়ার একটি লোক বলে ভেবেছিলাম সে প্রচন্ড মায়ায় জড়ানো চোখের একটি যুবক। একমুহুর্ত যেন আমি ওর চোখে হাড়িয়ে গিয়েছি। ততক্ষনাতই বুঝলাম আমি তো ভুল করছি। এ তো মায়া নয়, মায়াজাল। আমাদের জন্য চরম দুর্দিনের একমাত্র কারন তো এরাই। আমাকে অবাক করে দিয়ে ছেলেটি কথা বলে উঠল। “ডাক্তার আমার শরীরের ভিতর থেকে যে গুলিটি বের করেছেন ওটা কি ফেলে দিয়েছেন?” আরে এতো দিব্যি বাংলা বলছে। ততক্ষনাত আমি বেডের পাশের টেবিলে রাখা প্লেটটা দেখলাম গুলিটা এখনো ওখানেই আছে। আমি হাতটি ছাড়িয়ে নিয়ে বললাম, “কেন?” ছেলেটির চোখ চকচক করে উঠল। বলল, “ওটা আমাকে দিন প্লিজ।” আমি চুপ করে রইলাম। ছেলেটা আবারও বলল, “কৈ? আমাকে দিন না ওটা।” খুব অবাক হলাম, কেন সে এটা চাচ্ছে? এটা দিয়ে সে কি করবে? “ওটা আপনার কি দরকার?” “আমি আপনাকে বোঝাতে পারব না, ওতা আমার কতটা আপন। আপনাকে আমি বোঝাতে পারবো না।” “আপন। ও জিনিস আবার কারো আপন হয় নাকি?” “আপনাকে কি করে বোঝাই? এটা আমার মায়ের দেয়া প্রথম ও শেষ উপহার।” “মায়ের দেয়া মানে? এটা আপনি কি বলছেন?” “বললে আপনি বিশ্বাস করবেন না। আমি জানি আমি আর বেশিক্ষন বাচতে পারব না।প্লিজ আমাকে ওটা দিন।” “আগে আমাকে বলুন।” ছেলেটি কিছুক্ষন আমার দিকে চেয়ে তারপর বলা শুরু করল। “আমার বাবা পাকিস্তান সেনাবাহীনীতে চাকুরী করে। আমার জন্মের আগে বাংলাদেশে একটা ট্যুরে আসেন। এখানে এসে তিনি আমার মাকে বিয়ে করেন। বাবা মাকে নিয়ে পাকিস্তান চলে যান। আমার যখন আঁট বছর মা তখন মারা যান। বাবার আদর কি তা কখনো বুঝি নি। তারপর সৎ মায়ের সংসার। বাবা একরকম জোর করেই আমাকে আর্মীতে দিয়ে দেন। আর নিতান্ত দ্বায়িত্বের খাতিরে আমি বাংলাদেশে এসেছি যুদ্ধ করতে। কিন্তু এখানে এসে যেন আমি আম্র মায়ের গায়ের গন্ধ পেয়েছি। যেন আমার মাকে পেয়েছি। আমার মন কিছুতেই যুদ্ধে সায় দেয় না। একজনের সাথে কথা বলে মুক্তিযুদ্ধা কোমান্ডার গফুরের ঠিকানা নেই। তারপর দিন গুনি কবে পালাবো। কবে মাকে বাচাতে যুদ্ধ করব। বিশ্বাস করুন আমি একটা গুলিও বালাতে পারি নি।একটাও না। কেউ বিশ্বাস করবে না জানি। আমি পালাই। কমান্ডার গফুরের উদ্দেশ্যে রওনা হই। পথে একটা গোলাগুলির মুখে পড়ে যাই। গুলি লাগে আমার গায়ে। তারপর এরা আমাকে এখানে নিয়ে আসে। আমি জানি এরা আমাকে বাচাতে চাইলেও বাচাতে পারবে না। মৃত্যুকে ভউ পাই না। মায়ের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করার চেয়ে মরে যাওয়া ভাল।” আমি হতভম্ভ হয়ে কথা গুলো শুনছিলাম। নিজের কানকে বিশাস করতে পারছি না। উঠে ভাইয়াদের কাছে যাব এমন সময় উনি আবার আমাকে ডাকলেন, “প্লিজ প্লিজ। আমার হাতে গুলিটা দিয়ে যান।” আমি কাঁপা হাতে প্লেট থেকে গুলিটা নিলাম। ছেলেটি হাত বাড়িয়েই আছে। ওর হাতে গুলিটা দিতেই হাত গুটিয়ে বুকের উপর রাখল। আমি ছুটে ঘর থেকে বের হয়ে গেলাম। এখনি ভাইয়ার সাথে কথা বলতে হবে। ভাইয়াকে পেলাম না। সিরাজ ভাইকে পেয়ে ভাইয়ার কথা জানতে চাইলাম। শুনলাম আমাদের কমান্ডার সাহেব এসেছে তাঁর সাথেই ভাইয়ারা মিটিং করছে। আমার মুখ শুকিয়ে গেল। বুঝলাম আলোচনার বিষয়বস্তু কি হতে পারে। নিয়ম অনুযায়ী ঘাতককে হত্যা করা হবে। ভাইয়ারা জানতেও পারবে না।
সন্ধ্যা বেলা দুটো গুলির শব্দে চেতনা ভাঙ্গল। ধীর পায়ে ক্যাম্পের পাশের বাগানে গিয়ে দেখলাম ছেলেটার লাশ নিথর হয়ে পড়ে আছে। কিন্তু চোখে মুখে যেন একটা আনন্দের ঝলক। ওর ডান হাতটি তখনো মুঠ করে ধরা। মুঠের ভিতর সেই গুলিটি।
আপনার ভালো লাগা ও মন্দ লাগা জানিয়ে লেখককে অনুপ্রানিত করুন
জালাল উদ্দিন মুহম্মদ
আহা কি সুন্দর গল্প ! জীবন্ত ও সতেজ অনুভূতি। গল্পের কথা ও কাহিনি হৃদয়ে নাড়া দেয় অবলীলায়। ভাষা শৈলী ও গতিময়তা অপূর্ব। অভিনন্দন লিয়া ফেরদৌস। শুভকামনা রইলো।
মামুন ম. আজিজ
ভিন্নতা খুঁজতে খুঁজতে মিশ্র জাত স্বদেশী এবং বিদেশী সৈন্যের উপস্থিত ঘটানোর চেষ্টাকে সাধুবাদ দিবনা, তবে গল্প লেকার স্টাইল ভালো হয়েছে বলব। আমাদের মুক্তিযুদ্ধে পাকিস্তানী সৈন্যদলের অধিকাংশ এতই বন্য আচরণ করেছে যে কারনে তাদের দুএকটা বিচ্ছিন্ন গুনকীতর্ন করার প্রয়োজনীয়তা আমি দেখিনা। ...আমার দেশৈর সোনার মুক্তিযোদ্ধাদের গুনকীতর্নের সামান্যতমও তো ্জাও করতে পারলাম না রে বোন।
ভাই আপনাকে অনেক ধন্যবাদ। যাদের জন্য আমি এই স্বাধীন দেশে বসে লিখতে পারছি, যারা আমাকে লেখার স্বাধীনতা দিয়েছে মাত্র কয়েকটি শব্দে তাদের গুনকীর্তন করার স্পর্ধা আমার নেই। গল্পটিকে অন্যভাবে না নিয়ে একে একটি সামান্য গল্প হিসেবেই দেখুন না।আর এখানে অন্য একদিক দিয়ে দেখলে আপনি দেখতে পাবেন যে এখানে যুদ্ধকালীন সময়ে যোদ্ধাদের মানবসেবা ও মানবিকতার ব্যাপারটি খুব স্পষ্ট ভাইয়া। ধন্যবাদ
যোদ্ধারা কিছুটা নিষ্ঠুর না হলে যুদ্ধ হয়না। সে যাক। গতবছর মেহেরজান নামে একটা সিনেমা করেছিল রুবাইয়্যাত নামে একটি তরুণী মুক্তিযুদ্ধ ভিত্তিক মুভি করে এই পাকিস্তানি এক সৈন্যকে হিরো বানিয়ে যা সমালোচনায় পড়ে গেলো, মনে পড়ে। আমাদের মানসিকতা নেগেটিভকে পজিটিভে নেবার মত এখনও উন্নত হয়নি। কারন আমরা পজিটিভকে এখনও পজিটিভ করে ভাবার সুযোগই পাইনি। ...গল্প তোমার ভাল হয়েছে।
আহমেদ সাবের
সুন্দর গল্প। লেখিকা একটু চেষ্টা করলে (ছেলেটা সম্পর্কে সবাইকে জানালে) গল্পের সমাপ্তি অন্যরকম হতে পারত। মুক্তিযোদ্ধারাওতো মানুষ, রবোট নয়। লেখা হিসেবে একটা অসাধারন গল্প।
স্বাধীন
প্রথম দিকে পড়তে পড়তে একটা মায়াজালে আটকে থাকলাম আর মনে মনে এ গল্পের লেখকের জন্য একটা ধন্যবাদ মনে একে রাখলাম। শেষটায় এসে সে ধন্যবাদটা কর্পূরের মতো উড়ে গেল। যদি মেরে ফেলাই হবে তাহলে কেন ক্যাম্পে এনে শুশ্রূষা? একি তবে ছেলেটার প্রতি সহমর্মীতা জাগিয়ে মুক্তিবাহিনীর উপর বিরক্তি উদ্রেকের জন্য? আসলে গল্পতো গল্পই, তাই না! তারপরও কিছু কথা আছে, থাকে, থেকে যায়..........
আপনাকে ধন্যবাদ। এখানে আপনি বিরক্তি উদ্রেগ্রের কি দেখলেন আমিও বুঝি নি।
ছেলেটার আসল সত্য শুধু মেয়েটাই জানতে পেরেছিল। আর যারা ওকে ক্যাম্পে নিয়ে এসেছিল তারা প্রথমদিকে ডাক্তার মেয়েটিকে বের হতে দেয় নি। কিন্তু মানবিকতার খাতিরে পরে ওর চিকিত্সা করানো হয়। কিন্তু ঘাতক তো ঘাতকই। কমান্ডার ব্যাপারটি মেনে নেয়নি। যেহেতু সে ছেলেটিকে হানাদার হিসেবে দেখেছে। ওদের কাছে খবরটা মেয়েটি পৌছাতে পারে নি তার আগেই নিয়মানুসারে ঘাতক কে মেরে ফেলা হয়েছে।
আপনাকে ধন্যবাদ ভাইয়া। এখানে শেষের দিকের দু একটা লাইন কোথায় হাওয়া হয়ে গেছে আমি নিজেও জানি না।
এই লেখাটি গল্পকবিতা কর্তৃপক্ষের আংশিক অথবা কোন সম্পাদনা ছাড়াই প্রকাশিত এবং গল্পকবিতা কর্তৃপক্ষ এই লেখার বিষয়বস্তু, মন্তব্য অথবা পরিণতির ব্যাপারে দায়ী থাকবে না। লেখকই সব দায়ভার বহন করতে বাধ্য থাকবে।
প্রতি মাসেই পুরস্কার
বিচারক ও পাঠকদের ভোটে সেরা ৩টি গল্প ও ৩টি কবিতা পুরস্কার পাবে।
লেখা প্রতিযোগিতায় আপনিও লিখুন
প্রথম পুরস্কার ১৫০০ টাকার
প্রাইজ বন্ড এবং সনদপত্র।
দ্বিতীয় পুরস্কার ১০০০ টাকার
প্রাইজ বন্ড এবং সনদপত্র।