নির্লিপ্ত অন্তঃক্ষরণ

দেশপ্রেম (ডিসেম্বর ২০১১)

Dr. Zayed Bin Zakir (Shawon)
  • ৬২
  • ৮০
‘ঝালমুড়ি খাবি? চল ঝালমুড়ি খাই’। অনেকটা আবদারের সাথে বলল রিপন। ওর অনুরোধটা ফেলে দেয়া গেল না। ভার্সিটিতে ক্লাসের পরে একটা সেমিনার শেষ করে ক্যাম্পাস দিয়ে আমরা অলস ভাবে হাঁটছিলাম। আর তখন এই প্রস্তাব করে। ঠিক তখনই ঘরে যেতে মন চাইছিল না আমাদের কারোরই।
-চল যাই। তোর কথা শুনে আমার জিহ্বায় পানি চলে এসেছে। বেশি করে ঝাল দেয়া! কি বলিস রিপন?
-আমার আপত্তি নেই। তবে আমি বেশী ঝাল খাব না। বলেই মুচকি মুচকি হাসে। ভাল কথা, তুই কি পরশুদিন বাসায় থাকবি?
-কেন রে? হুম! তেমন কোন কাজ আছে বলে তো মনে হয় না।
-ঠিক আছে। তাহলে তোর বাসায় আসতে পারি আমি।
-আয় না। বলার কি আছে? ফোন দিয়ে চলে আসিস।

কথা বলতে বলতে গেটের কাছে চলে আসি আমরা। ওখানে ওদের বহুদিনের পরিচিত মুখ সিরাজ মামা ঝাল মুড়ি বানায়। সাথে থাকে তার অ্যাসিস্ট্যান্ট খোকন। বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র ছাত্রীদের কাছে সিরাজ মামার ঝালমুড়ি অনেক জনপ্রিয়। সবার কাছেই এই মাঝবয়সী লোকটা সিরাজ মামা হিসাবেই পরিচিত। আজ গেটে গিয়ে দেখলাম সিরাজ মামা নেই। তার অ্যাসিস্ট্যান্ট একাই আছে। ‘কিরে পাইলট! কেমন চলে দিনকাল’? খোকনকে রিপন ঠাট্টা করে পাইলট ডাকে।
-হ ওস্তাদ ভালা আছি। আপনি কেমুন আছেন?
-আমিও ভাল। দেখি আমাদের দুইজনের লাইগা দুইটা ‘ইসপিশাল’ বানা দেখি। খোকনকে নকল করে রিপন বলে।

ভীষণ আমুদে আমার এই বন্ধু। সারাক্ষণ আনন্দে মাতিয়ে রাখতে পারে। মাঝে মাঝে খুব আশ্চর্য লাগে ওকে দেখলে। ওর মনে কন কষ্ট থাকলেও কাউকে বুঝতে দেয় না। আমরা মন দিয়ে খোকনের ‘ইসপিশাল’ ঝালমুড়ি বানানো দেখতে থাকি। রিপনের নজর হঠাৎ পড়ে মুড়ির বস্তার পাশে রাখা একটা পুরানো ডায়রি’র উপরে। কালো মলাটের উপরে ধুলোর আস্তরণ পড়ে কেমন যেন বিবর্ণ হয়ে গেছে। মুড়ির বস্তার পাশ থেকে রিপন ডায়রিটা টেনে বের করে আনে। অল্প কিছু পাতা আছে। রিপন এমন ভাবে দেখতে থাকে যেন এর মধ্যে কোন মহামূল্যবান জিনিস রয়ে গেছে।

-কি দেখিস এমন করে?
-একটা ডায়রি।
-তা তো দেখতেই পাচ্ছি। এভাবে দেখার কি আছে?
-দেখ না অনেক পুরানো।
-তো কি হল রে বাবা?
-ভাল করে দেখ, এই ডায়রি’র সালটা। বলে রিপন ডায়রিটা আমার হাতে দিয়ে দেয়।
-তাকিয়ে আমিও একটু অবাক হলাম। ১৯৭১ সাল লেখা। হাতে নিয়েই কেমন যেন একটু গা ছমছমে অনুভূতি হল।
-তুই এইটা কই পাইলি রে পাইলট? খোকনের উদ্দেশ্যে প্রশ্ন করে রিপন।
-জানি না বস। মামু আনছিল কবে জানি। বলেই খোকন আবার মুড়ি নিয়ে ব্যস্ত হয়ে গেল।
-খোকন শোন। তোর মামু আসলে বলিস যে আমি ডায়রিটা নিয়ে গেছি। আমার একটু লাগবে।
-আইচ্ছা লইয়া যান। মামুরে কমুনে যে রিপন ভাইজান নিয়া গেছে।

আমি আলগোছে পাতা উল্টালাম কিছু। অনেক আগের গুটি গুটি করে লেখা। নীল রঙের ফাউন্টেন পেন দিয়ে লেখা কারো দিন পঞ্জিকা হবে হয়ত। আমি তেমন কোন আগ্রহ বোধ করলাম না। গল্প উপন্যাস পড়ার প্রতি আমার আগ্রহ তেমন কোনদিনই ছিল না। এইজন্য রিপন আমাকে নিরামিষ বলে। অন্যদিকে রিপন হল বইয়ের পোকা। আমরা স্বভাবে উলটা হলেও বন্ধুত্বে কোন কমতি নেই। রিপন আমার হাত থেকে ডায়রিটা নিয়ে নিলো। দাঁড়া আমি পড়ে দেখি আগে। এরপর তুই পড়িস। আমি বললাম, ‘মাফ চাই বাবা। তুই পড়। মজার কিছু থাকলে তুই আমাকে বলিস’। ততক্ষণে মুড়ি বানানো হয়ে গেছে। দুইটা কাগজের ঠোঙ্গায় আমরা মুড়ি নিয়ে রাস্তার পাশে দাঁড়িয়ে মুড়ি খেতে থাকি। এমন সময় আর একটু হলেই দুর্ঘটনা ঘটে যাচ্ছিল। সামান্য একটুর জন্য, গাছের উপর বসা কাক এর নির্গত বিষ্ঠা পতন থেকে বেচে গেলাম। না হলে আমার পুরা দিনটাই গেছিল। রিপনের হাসাহাসিতে জীবন অতিষ্ঠ হয়ে যেত। কি রে কাউয়ার আশীর্বাদ থেকে বঞ্চিত হয়ে গেলি তুই, বলেই অট্টহাসিতে ফেটে পড়ে। রাগ করতে গিয়েও পারলাম না। ওর সাথে হাসিতে যোগ দিলাম।

দুইদিন পরে রিপন সকাল বেলা আমার ঘরে এসে হাজির। ঘুমিয়ে ছিলাম। আমাকে বিছানা থেকে টেনে উঠালো। ওর হাতে সেইদিনের সেই ডায়েরী। আমি তেমন কোন উৎসাহ বোধ করলাম না। রিপনের পীড়াপিড়িতে উঠে ফ্রেশ হয়ে নিলাম। মা নাস্তা দিলেন দুইজন নাস্তা করে আমার ঘরে গিয়ে বসলাম আমার খাটের উপরে। ‘তোর ব্যপারটা কি বলতো? এই সকালে? ঘটনা কি?
-তোর জন্য একটা জিনিস আছে। রিপনের মুখে কেমন যেন একটা বিষাদের ছায়া।
-মুখ এমন করে রেখেছিস কেন? বৌ মরে গেছে নাকি? আমি কৌতুক করে বলি।
-আরে ধুর বেটা। দোস্ত তুই না করিস না। তুই একটু কষ্ট করে এই ডায়রীটা পড়ে দেখ। জানি তুই পড়িস না। তারপরেও পড়ে দেখ। এটা পড়ে আমার মন খারাপ।
-সাল তো দেখলাম ১৯৭১। মনে হয় স্বাধীনতা যুদ্ধের সময় কার লেখা তাই না?
-হুম। একজন মহিলার লেখা ডায়েরী। পড়ে দেখ। আমি পড়েছি। অনেক আফসোস হচ্ছে। শেষের কয়েকটা পাতা মিসিং। আমার মনে হচ্ছে কি যেন একটা মিস করে ফেললাম। খারাপ লাগছে আমার।
-বাদ দে না রিপন। কার না কার লেখা। তাই নিয়ে তুই মুখ কালো করে বসে আছিস। আচ্ছা বাবা পড়ছি আমি। পড়বনা তা তো বলি নাই। কোন দেশদ্রোহী রাজাকারের ডায়রী না তো।
-তুই কয়টা মহিলা রাজাকারের কথা শুনেছিস? রিপনের গলায় উষ্মা লক্ষ্য করে আর ঠাট্টা করলাম না। বেচারা এমনিতেই আবেগাপ্লুত হয়ে আছে।
-কোন রাজাকার না। এমন একজন মহিলার লেখা যার মধ্যে দেশপ্রেম ছিল। দেশের খাতিরে ...... বলে রিপন চুপ করে থাকে।

আমি আর কথা বাড়ালাম না। ওর হাত থেকে নিয়ে ডায়রীর পাতা উল্টালাম। মাঝে মাঝে একটু একটু করে লেখা। খুব যত্ন করে লেখা নয়। কোথাও কোথাও অস্পষ্ট। পড়তে কষ্ট হয়। পাতাগুলাও হলুদ হয়ে গেছে। ডায়রীর অনেক পৃষ্ঠাই নেই। সামান্য কয়েকটা লেখা দেখা যাচ্ছে। আমি প্রথম থেকে যেই যেই পাতায় লেখা আছে পড়তে শুরু করলাম...

(২৭ আগষ্ট)

নিজের কথা লিখব বলে কখন ভাবি নি। দেশের যেই অবস্থা তাতে মন ভাল লাগে না। সারাদিন ঘরে বন্দী হয়ে থাকতে হয়। কবে যে আমাদের এই দেশ স্বাধীন হবে? খোলা মাঠে একটু প্রাণভরে কবে শ্বাস নিতে পারব? আমার কিছু ভাল লাগে না। চারিদিকে শুধু হাহাকার আর হাহাকার। মাঝে মাঝে মনে হয় মরে যাই। এইভাবে বেঁচে থাকার চেয়ে মরে যাওয়াও তো ভাল। এত কষ্ট করে লেখাপড়া করেছি। শুধু মেয়ে বলে ঘরে আটকে থাকতে হচ্ছে। ছেলেরা যুদ্ধে যায় কিন্তু আমরা পারছি না। কিন্তু আর কতদিন?

(৭ সেপ্টেম্বর)
ঘরে এত অশান্তি যে আর পারি না। কতদিন এইভাবে চলবে? মাঝে মাঝে ঘরে একফোটা খাবার থাকে না। না খেয়ে কতদিন চলা যায়? বড় ভাই জামালুদ্দিন কয়েক দিন পরপর আসে আবার উধাও হয়ে যায়। কিছুই বুঝি না উনার গতিবিধি। আমার ভাল লাগছে না ইদানিং উনার চালচলন। পাকিস্তান আলাদা হয়ে যাক এটা সে সহ্যই করতে পারে না। ভাবী একদিন মুক্তিযুদ্ধের কথা বলায়, ভাই ভাবির গালে একটা চড় মারে। মানুষ এমন নিষ্ঠুর হয় কিভাবে? আমার দেখা মতে আমার ভাবী দুনিয়ার শ্রেষ্ঠ মেয়েদের একটি। ইদানিং ভাই বাড়িতে থাকলেও চালচলন বদলে যাচ্ছে। কথায় কথায় সবার সাথে খারাপ ব্যবহার করছে।

(১০ সেপ্টেম্বর)

মায়ের প্রচন্ড জ্বর হয়েছে। সারাদিন মাথায় পানি ঢেলেও জ্বর কমানো যাচ্ছে না। পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী গ্রামের বাজারে ঢুকে সব তছনছ করে নিয়ে যায়। গ্রামের নামকরা ডাক্তার ব্রজেশ্বর সাহা কে বাসায় গিয়ে সবার সামনেই গুলি করে মেরে ফেলে। আমাদের দেশ কেমন নরক হয়ে গেল। ঘটনার এখানেই শেষ নয়। ব্রজেশ্বর বাবুর একমাত্র মেয়ে নন্দা কে ঘর থেকে উঠিয়ে নিয়ে গেছে। নন্দার মা বাধা দিতে গেলে, এক হানাদার শয়তান বেয়নেট দিয়ে তার পেটে এমনভাবে আঘাত করে যে সঙ্গে সঙ্গে তিনিও পৃথিবীর মায়া ত্যাগ করে স্বামীর সহযাত্রী হন। আমি যেন কেমন হয়ে গেছি। এখন আর চোখে পানি আসে না। লিখতে গিয়ে হাত কাঁপে না। নন্দা আর আমি একই সাথে লেখা পড়া করেছি। জানি না নন্দা কোথায় আছে। হতভাগী বেঁচে আছে না মরে গেছে।

(২১ সেপ্টেম্বর)

সর্বনাশের চুড়ান্ত হয়েছে। আমাদের গ্রামের উত্তর পাড়ায় হানাদার বাহিনী আক্রমন করে তছনছ করে ফেলেছে। কত মানুষ মেরে ফেলেছে বলতে পারছি না। কে জানবে আর কেই বা বলবে এইসব কথা। গ্রাম থেকে কত মেয়েকে যে উঠিয়ে নিয়ে গেছে ওরা সংখ্যাটা জানা নেই। গতকাল রাতের অন্ধকারে আমরা পালিয়ে আসি বড় খালার বাড়িতে। অসহায় এই পরিবারটার উপরে আমরা এখন গোদের উপরে বিষফোঁড়া হয়ে গেছি। আমাদের যত্ন করতে খালা কোন কিছুর কমতি করছে না। খালার একটাই ছেলে ফরিদ। আমার চেয়ে দুই বছরের ছোটই হবে। শুনলাম মুক্তিযুদ্ধে গেছে। মনে মনে বললাম, সাবাস ফরিদ সাবাস। দেশের মানুষকে শত্রুমুক্ত করতে লড়াই কর ভাই। জয় তোদের হবেই। আল্লাহ তোদের সহায় ভাই। এই দোয়া করা ছাড়া আর কিই বা করা আছে?

(৩ অক্টোবর)

দুইমাসের উপরে হয়ে গেল জামাল ভাই এর কোন খবর নেই। একাবারে যেন উধাও হয়ে গেছে। মা কেমন যেন হয়ে গেছে। কথাই বলে না। কিছু বললে কেমন যেন ফ্যালফ্যাল করে তাকিয়ে থাকে। শরীর অনেক দুর্বল হয়ে গেছে। এভাবে আর কতদিন? বাবাকে প্রায় কাঁদতে দেখি। আগে যেই মানুষটার চোখে কখনই কাঁদতে দেখি নি আজ তার চোখে পানি দেখতে কার ভাল লাগে? কে বুঝবে আমাদের কষ্ট?

(৮ অক্টোবর)

ফরিদের চিঠি এসেছে। জানিয়েছে ভাল আছে। কিন্তু কোথায় আছে সেটা জানায়নি। দোয়া চেয়েছে সবার কাছে। ছোট একটা চিঠি। কতবার সেটা আমরা সবাই পড়েছি গুনে বলতে পারছি না। মুক্তিযুদ্ধে যাবার পরে এটাই ওর প্রথম চিঠি। ভাবীর শরীর অসুস্থ। তার শরীরে একটা শিশু বেড়ে উঠছে কিন্তু শিশুর পিতা লাপাত্তা। ভাবীর মুখের দিকে তাকাতে পারি না। যোগাযোগের কোন মাধ্যমও নেই। পোষ্ট অফিস আগুন দিয়ে পুড়িয়ে শেষ করে দিয়েছে। কয়েকজন কর্মচারীকে মেরে ফেলেছে।

(২০ অক্টোবর)

শরীর ভাল নেই। দেশ কোন পরিনতির দিকে যাচ্ছে বুঝতে পারছি না। গ্রামের রাজাকার বাহিনীর অত্যাচারে মানুষের জান অতিষ্ট করে ফেলছে। জামাল ভাই এর জন্য ভয় হয়। মুক্তিযুদ্ধের কথা শুনলেই গালাগাল দিয়ে উঠত। উনি কি তবে দেশের মানুষের বিরুদ্ধে গেলেন? তাহলে আর বেঁচে থেকে লাভ কি? এমন ভাই থাকার চেয়ে না থাকাই তো ভাল। এতদিন হয়ে গেল তার কোন খবর নেই। উড়ো খবরে একবার কার কাছে যেন শুনলাম কুমিল্লা আছে। আল বদর করছে। কিন্তু এই আল বদরটা কি? বাবাকে জিজ্ঞাসা করেছিলাম। বাবা কোন কথা বলে নি।
.........................................................

(২৩ ডিসেম্বর)

যেখানে লুকিয়ে রেখে গিয়েছিলাম ডায়রীটা সেখানেই পেলাম। এটাই আমার শেষ লেখা। এরপর আর কখনও কিছু লিখবনা। আমার লেখা কেউ পড়ুক বা না পড়ুক, লিখে নিজের শেষ জ্বালাটা মিটাতে চাই। বাংলাদেশ স্বাধীন হয়েছে। আজ থেকে আমরা নিজেদের দেশে থাকব। আমার জীবনের সবকিছু শেষ হয়ে গিয়েছে। আফসোস নেই। দেশের জন্য কিছুই তো করতে পারলাম না নিজের শরীর হায়নাদের সামনে দিয়ে দেয়া ছাড়া। জীবনে আর কোন কিছুই চাওয়া পাওয়ার নেই আমার। এখনও বেঁচে আছি। বহাল তবিয়তেই আছি। নিজের অস্তিত্বের মধ্যে আর একটা অস্তিত্ব ধারণ করছি। এতেও আমার কোন কষ্ট নেই। লোকে আমাকে ধর্ষিতা বলবে? নষ্টা বলবে? বলুক। দুঃখ নেই। এই ক’দিনে এত কিছু দেখেছি আর শুনেছি যে কষ্টের অনুভুতি হারিয়ে গেছে আমার। সবাই হয়ত বলবে আমার সতীত্ব নষ্ট হয়েছে; আমি বলব এটাই আমার দেশপ্রেম। এটাই তো দিতে পারতাম একজন অবলা মেয়ে হিসাবে। মরে গেলে ভাল ছিল। কিন্তু আমার যে মৃত্যু নেই। মরতে চাইও না। চাইবোই বা কেন? আমার পেটে যে আমার যুদ্ধের চিহ্ন। আমি একে মিটতে দেব না।

খালার বাড়িতে থাকাকালীন সময়ে হানাদার বাহিনী হামলা করে। অনেক মেয়েদের সাথে আমাকেও নিয়ে যায়। মা অজ্ঞান হয়ে পড়ে গেলেন। বাবাকে চোখের সামনে গুলি করে মারলো। ভাবী আমাকে ঠেকাতে গিয়ে পেটের উপরে বুট জুতার এত জোরে লাথি খেলেন যে সাথে সাথে আমার আর বুঝতে বাকী রইল না কি হতে যাচ্ছে। সহ্য করতে পারলাম না। তখন দিগবিদিক জ্ঞানশুন্য হয়ে কি করেছিলাম মনে পড়ে না। পাগলের মত উর্দুতে চিৎকার করে বলেছিলাম, জানোয়ার! লে চল মুঝে, কাহা জানা হেয়। এর পরে সম্ভবত আমি নিজেও অজ্ঞান হয়ে যাই। আর কিছু মনে নেই।

কতক্ষন বেহুঁশ ছিলাম জানি না। চোখ খুলে দেখি একটা অন্ধকার ঘরে নিজেকে। হাত বাঁধা। দূরে কোথা থেকে যেন একটা মেয়ের চিৎকার শুনতে পাচ্ছিলাম। নিশ্চই অত্যাচার করে করে মেরে ফেলবে একটি অসহায় মেয়েকে। কাঁদতে গিয়ে পারলাম না। চোখ থেকে মনে হয় যেন পানি না রক্ত বেরিয়ে এল। বারবার মায়ের মুখটা ভেসে উঠতে লাগল। প্রথমে মনে করতে পারছিলাম না যে বাবাকে আমার সামনেই মেরে ফেলেছে। পরে মনে পড়ে গেল। কতক্ষন এভাবে চলে গেল জানিনা। একটু পরে ঘরেরে দরজা খুলে এক লোক এল পাকিস্তানি আর্মির পোষাক পরা। আমাকে উর্দুতে বলল, তু উর্দু জানতি হ্যায়? আমি বললাম, উর্দু নেহি তুঝ জ্যায়সা জানওয়ারো কা জুবান জানতি হু। এই কথা বলার সাথে সাথে লোকটা তার বলিষ্ঠ হাত দিয়ে আমার মুখে একটা চড় মারে। মনে হল আমি ব্যথা তেমন পেলাম না। শরীর থেকে অনুভুতিও দূর হয়ে গেছে মনে হয়। আমার চুল ধরে এক হ্যাঁচকা টান দিয়ে দাঁড় করাল। তাল সামলাতে না পেরে লোকটার গায়ে হুমড়ি খেয়ে পড়লাম। খা খা করে হেসে বলল, লাড়কি তেরে সাথ বিস্তার মেয় বহুত মাজা আয়েগা। অবধারিত ভাবে কি হতে যাচ্ছে বুঝে গেলাম। জানি প্রতিবাদ করে লাভ হবে না। গায়ের শক্তিতে আমি পারবো না এদের সাথে। আমাকে ধরে নিয়ে গেল ওদের অফিসারের কামরায়। আমাকে ঘরে ঢুকিয়ে দিয়ে দরজা বন্ধ করে দিল। কমান্ডারের বয়স বেশী হবে না। ৩৫-৪০ এর মধ্যে কিছু হবে। আমি মনে মনে ভাবতে লাগলাম কখন দেশ স্বাধীন হবে। কখন আমি মাকে দেখতে পারব। এরপরে ঘটনা আর লিখতে ভাল লাগছে না। আমার কথা আমার থাক। সারারাত আমাকে ঐ লোক ধর্ষণ করে গেল। আমার শরীর মনে হল যেন টুকরা টুকরা হয়ে গিয়েছে। শেষের দিকে আমি আবার অজ্ঞান হয়ে যাই। আমার সাথে আনা অন্য মেয়েগুলার কপালে কি ঘটেছে? হয়ত আমার চেয়ে একটু বেশি বা কম এইত? পাক হানাদার পশুর সামনে নিজের শরীর মেলে দিয়ে গিয়ে মনে হয়েছিল একবার, আমি একটা বেশ্যা হয়ে গেলাম। পরক্ষণেই মনে হল, না তো! আমি কেন বেশ্যা হব? আমি তো আমার বাবার আদরের মেয়ে ময়না। বাবা আমাকে ময়না পাখি বলেই ডাকতো। বাবার কথা মনে করে চোখ দিয়ে পানি চলে এল। নিজের শরীরের আর সম্ভ্রমের কথা মনে রইল না। এক নাগাড়ে ৮ দিন ধরে ৫ জন পাক বাহিনির লোক আমাকে ক্রমাগত ধর্ষণ করে চলে। উর্দু ভাষা পারতাম দেখে দয়া করে আমাকে খাবার দেয়া হত। আমি বাঁচতে চাই। আমি দেশকে স্বাধীন দেখতে চাই। খাবার গিলতে পারতাম না, কিন্তু ক্ষুধার তাড়নায় পানি দিয়ে গিলে নিতাম।

চমকপ্রদ ঘটনা ঘটলো ৯ দিন পরে। ঘরের এক কোনায় বসে আমি কিছু কথা শুনতে পেলাম। মনে হল গলার স্বর আমার অনেক চেনা।
-পাকিস্তান জিন্দাবাদ। পাকিস্তান জিন্দাবাদ।
-সাবাস। তেরে লিয়ে এক তোফা হ্যায়।
-জ্বী জনাব।
-যা বেটা উস কামরে মে যা, অর বাহুত অ্যায়াশ মাস্তি কার। ইয়ে তেরে তোফা হ্যায়।
-শুকরিয়া হুজুর।

আমি মনে মনে প্রমাদ গুনতে লাগলাম। বুঝে গেলাম কে আসছে। আমাদের দেশের কুলাঙ্গার জারজ রাজাকার কেউ। আজকে আমার তাদেরও ভোগের সামগ্রী হতে হবে। ভিক্ষার চাল কাড়া আর আকাড়া। কিন্তু এ কোন বিপদ? খাটের তোষক দিয়ে আমি আমার পুরো শরীর ঢেকে বসলাম। মুখ ঢাকা। লোকটা ঘরে ঢুকে দরজা বন্ধ করে দিয়ে আমার কাছে এগিয়ে এল। আমি আর জড়সড় হয়ে গেলাম। নোংরা মানুষটা আমাকে বলল, ঢেকে ঢুকে আর লাভ নেই। ঢাকার মত আর আছে কি? আর পারলাম না। তোষকের আড়াল থেকে মুখ বের করে লোকটার উদ্দেশ্যে একটা কথাই বললাম, ভাইয়া ছিহঃ। এত জোরে বলেছিলাম যে লোকটা যেন বোধহীন হয়ে গেল আমাকে দেখে। প্রচন্ড আঘাত পেয়ে এত জোরে ঘুরে দৌড় দেয় যে বন্ধ দরজার জোরে বাড়ি খেয়ে পড়ে যায়। আবার উঠে দরজা খুলে দৌড়ে বের হয়ে যায়।

বিশেষ আর কিছু মনে নেই। শুধু মনে পড়ে ঐ রাতেই মুক্তি বাহিনী এসে হামলা করে সবকয়টা পাক অফিসারদের হত্যা করে। যে কয়টা মেয়ে ছিল তাদের সবাইকে উদ্ধার করে নিয়ে যায় তাদের সাথে। আমদের শরীরের উপরে কয়দিন বীরত্ব দেখানো পুরুষ মানুষ গুলোকে দেখতে পেলাম রক্তাক্ত অবস্থায় উঠানে পড়ে আছে। ঘৃণায় একদলা থুথু ফেললাম একজনের মুখে। ফরসা হবার আগেই আমরা বেরিয়ে পড়লাম। যাবার সময় ব্যারাকের পাশে একটা গাছে দেখলাম একটা লাশ ঝুলে আছে। মুখের দিকে না তাকালেও পোষাক চিনলাম। আমরা এগিয়ে চললাম। সামনে। কোন এলাকায় ছিলাম মনে নেই। কাউকে জিজ্ঞাসাও করিনি। কি যেন একটা কথা মনে করতে চাইলাম। অনেক জরুরী। কাউকে চিনি না কিন্তু মনে হল .........***

--------------------
আমি পড়া শেষ করে মুখ তুলে তাকালাম রিপনের দিকে।
-পরের পৃষ্ঠাগুলো নেই। রিপন জবাব দেয়।
আপনার ভালো লাগা ও মন্দ লাগা জানিয়ে লেখককে অনুপ্রানিত করুন
প্রজাপতি মন চমত্কার লেখা, ভালো লাগলো পড়ে, যুদ্ধের অনেক জানা-অজানা কথায় জানলাম.
সৌরভ শুভ (কৌশিক ) নির্লিপ্ত অন্তঃক্ষরণ ,লেখাটি পড়ে ভরিল মন /
Dr. Zayed Bin Zakir (Shawon) অনেক ধন্যবাদ
রোদের ছায়া অনেক দেরিতে হলেও যে লেখাটি পড়লাম তাতে আমি মুগ্ধ /প্রিয়তে নিলাম,,
Dr. Zayed Bin Zakir (Shawon) joti ভাই ও সূর্য ভাই কে আমার অনেক অনেক ধন্যবাদ
সূর্য CD 40.....সিরিজের একটা ইন্টিগ্রেটেড সার্কিট (আইসি) ব্লক ডায়াগ্রাম/পিন কনফিগারেশনের বই অনেক কষ্টে জোগাড় করেছিলাম। নতুন নতুন সার্কিট ডিজাইন করতে অনেকটা নেশার মতো লাগতো। হঠাত করে সেই বইটা আমার এক আত্মীয়ের কনফেকশনারীতে দেখতে পাই। পেস্ট্রি প্যাকেট করে দিচ্ছে হা হা হা হা। এমেরিকার প্রকাশিত বইটা দেখে চোখে কতটা জল এসেছিল তা এমন ভূক্তভোগীই জানে। তোমার লেখাটা পড়ে ঠিক সেই রকম একটা দগদগে ঘা যেন নতুন করে দেখা দিল। অনেক সুন্দর লিখেছ শাওন।
খন্দকার আনিসুর রহমান জ্যোতি অদ্ভুত ফিনিসিং। খুব ভালো গল্প ।শুভ কামনা জাকির ভাই। পাওনাটা দিয়ে দিলাম ......................
Dr. Zayed Bin Zakir (Shawon) অনেক অনেক ধন্যবাদ আশা

০১ ফেব্রুয়ারী - ২০১১ গল্প/কবিতা: ৭৪ টি

বিজ্ঞপ্তি

এই লেখাটি গল্পকবিতা কর্তৃপক্ষের আংশিক অথবা কোন সম্পাদনা ছাড়াই প্রকাশিত এবং গল্পকবিতা কর্তৃপক্ষ এই লেখার বিষয়বস্তু, মন্তব্য অথবা পরিণতির ব্যাপারে দায়ী থাকবে না। লেখকই সব দায়ভার বহন করতে বাধ্য থাকবে।

প্রতি মাসেই পুরস্কার

বিচারক ও পাঠকদের ভোটে সেরা ৩টি গল্প ও ৩টি কবিতা পুরস্কার পাবে।

লেখা প্রতিযোগিতায় আপনিও লিখুন

  • প্রথম পুরস্কার ১৫০০ টাকার প্রাইজ বন্ড এবং সনদপত্র।
  • দ্বিতীয় পুরস্কার ১০০০ টাকার প্রাইজ বন্ড এবং সনদপত্র।
  • তৃতীয় পুরস্কার সনদপত্র।

আগামী সংখ্যার বিষয়

গল্পের বিষয় "স্থিতিশীলতা”
কবিতার বিষয় "স্থিতিশীলতা”
লেখা জমা দেওয়ার শেষ তারিখ ২৫ নভেম্বর,২০২৪