আজকের দিনটাকে সোহাগীর অন্যদিনের দিনের থেকে একটু আলাদা মনে হচ্ছে। আগামী দিন নববর্ষ । বছরের কয়টা দিনই বা আর ওদের উৎসবের উপলক্ষ হয়ে আসে? আর সোহাগীর নববর্ষের আনন্দ আর দশটা মানুষের মত নয়। উৎসব উপলক্ষে তার দুটি ফুলের মালা কিংবা দুটি ফুল বেশি বিক্রি হলেই সে খুশি। নববর্ষের দিনে তার ফুল আর ফুলের মালা সব খেকে বেশি বিক্রি হয়। সেজন্য নববর্ষ এলেই তার মনটা খুশিতে নেচে ওঠে। গত তিন মাস ধরে সে প্রতিদিন দু’একটি করে টাকা জমিয়ে রাখছিল, যাতে করে এইসময়ে কিছু বেশি করে ফুল কেনা যায়। এই তিন মাসে তা প্রায় তিনশোর কাছাকাছি টাকা জমাতে পেরেছিল। বেশি জমাবেই বা কি করে? কতই বা বিক্রি হয় প্রতিদিন? প্রতিদিন ত্রিশ থেকে চল্লিশ টাকার ফুল কিনে ফুলের মালা আর তোড়া তৈরি করে সে, কোনদিন ষাট থেকে সত্তর টাকা বিক্রি হয়, আর ভাগ্য ভাল হলে টাকার অংকটা হয়তো একশোর কাছাকাছি এসে দাড়ায়। কিন্তু তাদের সংসারে খরচটা ও তো কম নয়। সংসার বলতে সে, তার মা, আর ছোট তিন ভাই বোন, মোট পাঁচ জন। ছোট বলতে গেলে সেওতো ছোট, কতইবা বয়স তার, নয় কিংবা দশ। পথের পরে তাদের সংসার, আজ এখানে কাল ওখানে। মা ব্যথার রোগী, সব সময় পেটের ব্যথায় কান্নাকাটি করে। প্রায় তিন বছর হলো তার বাবা তাদের ফেলে রেখে অন্য কোথায় বিয়ে করেছে, তাদের কোন খোঁজ খবর নেয়না। ইদানিং সে তার ৬ বছরের বোন সোহেলীকে তার সাথে ফুল বিক্রি করতে নেয়। পথের পরে থাকতে অনেক ঝক্কি ঝামেলাই তাদের পোহাতে হয়, আর পুলিশের তাড়া তো আছেই, এই তো কদিন আগে বিশ্বকাপ উপলক্ষে পথের পরের ভাসমান মানুষ উচ্ছেদ অভিযান চলেছে। তাদের আস্তানা ছিল পলাশী বাজারের পাশের রাস্তায়, বড় বড় যে গাছগুলো আছে তার একটা গাছের নিচে। অনেক দিন ধরেই ওখানে তারা ছিল কিন্তু পুলিশ এসে এবার তাদের উঠিয়ে দেয়। পুলিশের চোখ ফাঁকি দিতে কত জায়গায়ই না ঘুরে বেড়িয়েছে তারা। এখন অবশ্য পুনরায় তারা সেখানে ফিরে এসেছে। নবর্ষের সময়টাও হয়তো এখানেই কাটবে তাদের। নববর্ষের সময় কি মেলাটাই না হয় ঢাকা শহরে, সব মানুষজন রাস্তায় নেমে আসে। আর কি বাহারি রঙ্গে সাঁজে লোকজন, তা দেখে সোহাগীর ভীষন হাসি পায়। তা সে সাজুকগে, কিন্তু এই সময় মানুষগুলোর মন অনেক ভাল থাকে, ফুল নিয়ে গেলে অনেকেই তারা খুশি মনে কিনে নেয়। অন্য সময় যেমন ‘একটা ফুলের মালা ন্যান না স্যার’ বলে গলা শুকিয়ে গেলেও কেউ তেমন একটা কিনতে চায়না। সোহাগীর মনে হয় উৎসব আসলেই স্যারদের মন অনেক ভাল হয়ে যায়, তাই যত বেশি বেশি উৎসব হবে ততই ভাল। সে ভাবে এবারের নববর্ষে তার ছোট বোন সোহেলীর সাথে সাথে তার ৪ বছরের বোন সোফিয়াকেও সে ফুল বিক্রি করতে নেবে। তিন জন মিলে তারা অনেক বেশি বেশি ফুল বিক্রি করতে পারবে। কিন্তু এই সময়ে ফুল পাওয়াটা যে এক মহা যন্ত্রনা। ফুল গুলো অনেক চড়া দামে বিক্রি হয়। অনেক সময় পাওয়াই যায়না। তাই সে মতলব আটে নববর্ষের আগের দিনই ফুল কিনে রাখবে, আর পানির ঝাপটা দিয়ে সেগুলোকে তরতাজা রাখতে হবে। যেই ভাবা সেইমতো কাজ, সে সকাল- সকাল তার বোন সোহেলীকে নিয়ে শাহাবাগ থেকে পুরো তিনশো টাকার ফুল কিনে আনলো। অনেক রকম ফুল আনলো, গোলাপ রজনীগন্ধা আরও কত কি। খুশিতে তার মনটা নেচে উঠছে আর ভাবছে অনেক টাকা লাভ হবে তাদের। তার বোন দ’ুটি বায়না ধরলো, বলল, আপা কাল নববর্ষের দিন আমাদের বাঁশি কিনে দিতে হবে, সবাই কি সুন্দও পু-প্যা করে বাঁশি বাজায় আমরাও বাঁশি বাজাবো। সোহাগী তার বোনদের আবদার মেটানোর আশ্বাস দিলো। তারা সবাই মিলে ফুল নিয়ে বসে গেলো, কোন-কোন ফুল দিয়ে মালা গাঁথা চলল,কোনটিতে আবার তৈরি হলো ফুলের তোড়া সারা দিনই চলল তাদের এই ফুল নিয়ে কাজ। ফুলের মালা আর ফুলের তোড়া থরে থরে সাজিয়ে রাখল তারা। এই কাজ করতে করতে প্রায় বিকেল হয়ে গেল। সোহাগীর যেন আর তর সইছেনা, কখন দিনটা শেষ হবে,কখন আসবে নববর্ষের সেই সময়। এ যেন এক অন্যরকম প্রতীক্ষা এরকম প্রতীক্ষা নববর্ষের জন্য আমরাও হয়তো করিনা। যা হোক বিকেল হয়ে আসল, কিন্তু আজকের বিকেলটা কেমন যেন অন্যরকম মনে হচ্ছে সোহাগীর কাছে। আকাশটা আস্তে আস্তে কাল মেঘে ছেয়ে যাচ্ছে। আলো আঁধারীর মাঝে কেমন যেন অন্যেরকম এক পরিবেশ তৈরি হল। কেমন যেন একটা অচেনা অপরিচিত রুপ, বুকের ভিতরটা কেমন যেন করে উঠল, এ যেন কাল বৈশাখীর পূর্বাভাস । তাহলে কি কাল বৈশাখী তার প্রলয় নাচন শুরু করবে? পথের পরের মানুষগুলোর কাছে কালবৈশাখীর এই ঝড়ো হাওয়া সবসময় ভীতিকর। এই সময়ে তাদেরকে প্রকৃতির কাছে অসহায় আত্মসমর্পন করতে হয়, নিজেদের আয়ত্মে কিছুই থাকেনা। সোহাগীর আশংকাই সত্যি হলো কালবৈশাখী তার সমস্ত বৈশিষ্ট্য নিয়ে উপস্থিত হলো। শুরু হলো প্রচন্ড ঝড়, চারদিকে শুধু ধূলি আর ধূলি, কিছুই দেখা যাচ্ছিলনা। গাছের ডালগুলো মড় মড় করে ভেঙ্গে পড়ছিলো। তাদেরকেও যেন উড়িয়ে নিয়ে যাবে, তারা কোন রকমে বড়গাছটিকে আকড়ে ধরে রেখেছিলো। কিন্তু তাদের বাক্স-পেটরা তল্পি-তল্পাগুলি যে দিক খুশি ইচ্ছা মতো উড়িয়ে নিচ্ছিলো কাল বৈশাখীর সেই প্রচন্ড ঝড়ো বাতাস। কোথা থেকে যেন প্রকান্ড ডাল উড়ে এসে আঘাত করলো সোহাগীর মাথায় সে সংজ্ঞা হারালো। তার থরে থরে সাজানো ফুলগুলোর আর কোন চিহ্ন নেই, সবকিছু তছনছ করে দিয়ে গেল প্রলয়ংকারী কালবৈশাখী। একসময় সবকিছু শান্ত হয়ে আসল, প্রকৃতির বুকে যেন, এক হিমশীতল বাতাস বয়ে গেল। সোহাগীর মাথায় আঘাতটা গুরুতর ছিল, মাথার দিকটা যেখানে আঘাত লেগেছিলো ক্রমে ক্রমে ফুলে আসছিলো। তার মা এবং ভাই-বোনগুলো তাকে ঘিরে বসে কান্নাকাটি করছে, রাস্তা দিয়ে যে লোকগুলো যাচ্ছিলো কেউ বা উঁকি দিয়ে একটু দেখল,আবার অনেকেই নিজের মনে যাচ্ছিলো যার যার গন্তব্যে।আস্তে আস্তে রাত বেড়ে চলল, তখন রাত প্রায় বারোটা,চারদিকে হয়তো শুরু হয়েছে নববর্ষ উদযাপনের শেষ প্রহরের প্রস্তুতি। সোহাগীর একটু একটু করে জ্ঞান ফিরলো। জ্ঞান ফিরেই সে তার মাকে জিজ্ঞাসা করলো ‘মা আমার ফুল ফুলের মালা’। তার বোন সোহেলী জানাল সব ঝড়ে উড়ে গেছে।পরক্ষনেই আবার চোখ বন্ধ করলো। সকাল হয়ে গেছে, লোকজন বের হয়ে গেছে রাস্তায়। রমনার বটমূলে হয়তো বসে গেছে গানের জলসা। কিন্তু সোহাগীর আর আজ কোন তাড়া নেই, সে ঘুমিয়ে আছে। তার বোন সোহেলী ঝড়ের সময় উড়ে যাওয়া কয়েকটি ফুল আশে পাশে খুজে পেয়েছিলো, তারই কয়েকটা সোহাগীর মাথার কাছে রাখলো, আর সে তখনো অকাতরে ঘুমোচ্ছে।
০১ ফেব্রুয়ারী - ২০১১
গল্প/কবিতা:
৯ টি
বিজ্ঞপ্তি
এই লেখাটি গল্পকবিতা কর্তৃপক্ষের আংশিক অথবা কোন সম্পাদনা ছাড়াই প্রকাশিত এবং গল্পকবিতা কর্তৃপক্ষ এই লেখার বিষয়বস্তু, মন্তব্য অথবা পরিণতির ব্যাপারে দায়ী থাকবে না। লেখকই সব দায়ভার বহন করতে বাধ্য থাকবে।
প্রতি মাসেই পুরস্কার
বিচারক ও পাঠকদের ভোটে সেরা ৩টি গল্প ও ৩টি কবিতা পুরস্কার পাবে।
লেখা প্রতিযোগিতায় আপনিও লিখুন
-
প্রথম পুরস্কার ১৫০০ টাকার
প্রাইজ বন্ড এবং সনদপত্র।
-
দ্বিতীয় পুরস্কার ১০০০ টাকার
প্রাইজ বন্ড এবং সনদপত্র।
-
তৃতীয় পুরস্কার সনদপত্র।
আগামী সংখ্যার বিষয়
লেখা জমা দেওয়ার শেষ তারিখ ২৫ নভেম্বর,২০২৪