চাওয়া না চাওয়া কিংবা যুক্তি তর্ক-অত কিছু মিশিয়ে হালকা জীবনটাকে জটিল করিনি ছাত্রী জীবনে। একটা রাতের ঘুম, তারপর ঘুম থেকে উঠে সকালেই ‘না’ বলে দিয়েছি কত প্রিয় বন্ধুর প্রেম নিবেদন। কথা বলতে ভালো লাগতো, বলতাম, অনেক ছেলে বন্ধু ছিল। তাই বলে ঢলে পড়া নয় কারও বাহু বন্ধনে। আমি একটু আগে আগেই টের পেতাম। মেয়েরা সকলেই নাকি সেরকম টের পায়, কেউ কেউ গ্রহণ করে না পাওয়া টা। আমি করতাম। তাই বুঝি হৃদয়ে অহরহই অনেকের প্রস্তাব ঝুপ করে আমার কানে এসে সুড়সুড়ি দিতো। আর আমি না বলার সিদ্ধান্তে চরম সিদ্ধহস্ত তখন।
পলকের প্রতি আমার বেশ দূর্বলতা অবশ্য আমি ঘোরে বেঘোরে টের পেতাম। পলক, আমার এক ক্লাশ উপরে পড়তেন ভার্সিটিতে। তবুও বন্ধুত্ব হয়েছিল। আপনি থেকে তুমি হয়েছিলো সরল সহজেই সম্বোধন। আমি কখনই গৃহবন্দী মেয়ে ছিলাম না। উশৃংখলও তাই বলে ছিলাম না কখনই। শৃংখলে হাত বাঁধা স্বাধীন তরুণীটি ছিলাম। পলকে সাথে লাইব্রেরীর নিচে বসে কত দিন বাদামের খোসা ছিলতাম, বাদাম চিবাতাম। পলকের চোখে ধীরে ধীরে ভালোবাসার ঘনঘটা দেখতে পাচ্ছিলাম। তারপর একরাতে ফোনে এলো সেই চিরায়ত প্রস্তাব। ভালোবাসার প্রস্তাব। আমি সেবারও এক ঘুমে রাত পার করেই সকালে জানিয়েছিলামি- না। বন্ধু আছি সেটাই তা ভালো। পলক বলেছিলো, তরু বন্ধু তো আছিই, থাকবো, তবে অপেক্ষার ডালপালা হয়ে থাকলাম, যদি কোনদিন তরু থেকে লতা হও, আমাকে আঁকড়ে ধরতে পারো।
আমি অট্রহাসিতে মেতেছিলাম। বলেছিলাম, দূর! তুম্ওি কি সবার মত ছ্যাবলা হলে?
পলক জেনেছি এখনও বিয়ে করেনি। জানার সূত্র ফেসবুক প্রোফাইল। ফেসবুকে ওর এড রিকোয়েস্ট আমার পাতায় মুথ থুবড়ে পড়ে আছে মাস তিনেক ধরে। ফেসবুকে প্রকৃত নাম লিখি না সচারচর। চেষ্টা করেও কেউ পুরনো বন্ধু বা প্রেমিক হিসেবে আমাকে খুঁজে পাবে না। হঠাৎ একদিন কেনো জানি তরুলতা লিখেছিলাম। সেদিনই পলকের রিকোয়েস্ট এসেছিলো। তাতে বুঝলাম নিয়মিতই সে আমাকে সার্চ করে বেড়ায়। বেচারার জন্য মায়া হয়। খুব খারাপ ছেলে তাকে কখনও মনে হয়নি।
অথচ আজ নিজের জন্য এত গহীন কষ্ট। সেই দৃঢ় চেতা তরু আমি কেমন করে একদিনেই বদলে গিয়েছিলাম। যে বাবা ছিল আমার সবচেয়ে প্রিয় ব্যক্তি। আমার প্রানবন্ত স্বাধীনতা যার কারণেই উদিত সূর্য হয়েছিল চিরকাল। সেই তিনি আপন খেয়ালে পাত্র ঠিক করেছিলেন। পাত্রটি ডাক্তারি পাশ করে বিদেশে থেকে সবে উচ্চ ডিগ্রি নিয়ে এসেছে। পরিবারও বেশ মালদার। পৈত্রিক চালু ব্যবসা বানিজ্য আছে তাদের। বাবা না বলার কোন সুযোগ দেননি। সেদিন বুঝেছিলাম আমার অবাধ সেই স্বাধীনতার মূল্যই বাবার এই একক সিদ্ধান্তে না বলতে পারা। পলক তবে কি দোষ করেছিলো? কিংবা অন্যরা? ভাবার সময় পাইনি। নিজেকে হঠাৎ একরাতে এক সুঠাম দেহের ডাক্তারের শয়ন কক্ষে নির্জনতায় আবিষ্কার করলাম ঝলমলে সাজে নতুন ভাবে। সব বদলে গেলো। একটা ভালো চাকুরীর প্রস্তাব ছিলো। বিয়ের পরে শ্বশুর বাড়ী থেকে চাকুরী না করার উপর নিষেধাজ্ঞা আসল। আমার বর ডাঃ আবরার হাসান মুকিত। আধুনিক নাম, ফ্যামিলির সবাই উচ্চ শিক্ষিত। অথচ আমার স্বাধীনতা সেই উচ্চ শিক্ষার মাঝে ভূলুণ্ঠিত হলো।
কত সহজ জীবন ছিলো। সহজ সিদ্ধান্ত নেয়ার অবাধ আনন্দ ছিলো। মুকিতকে তালাক দেবো ...এমটা ভাবছি আজ কমপক্ষে তিনশটা রাত ধরেই। তবুও কোন প্রভাতেই আমার সিদ্ধান্ত নেয়া হয় না। আমার কি কারও সাহায্য দরকার। কেউ একজন খুব কাছের...! অথচ গর্ব ছিলো নিজ মনে আমার সিদ্ধান্ত হীনতায় ভুগিনি কখনও। আবহাওয়ার পরিবর্তনের পরে প্রকৃতির রূপে কত পরিবর্তন হয়। আমার জীবনের হাওয়া বদলিয়েছে সেই কবেই, মনের পরিবর্তন তো হতে বাধ্য। পলকের সাথে যোগাযোগ করলে কেমন হয়! যদি কঠিন সিদ্ধান্তটা আলাপচারিতায় সহজ করে নেয়া যায়।...তিন দিন লাগলো আরও আমার শুধু পলকের ফ্রেন্ড রিকোয়েস্ট একসেপ্ট করার সিদ্ধান্ত নিতে। যাক তবুও অনেকদিন পরে একটু হালকা মনে হলো নিজেকে। কোন একটা সিদ্ধান্ত নিতে তো পেরেছি। না হলে বাবার বাড়ী কখন যাব সে সিদ্ধান্ত নেয়ার ক্ষমতাও আমার খর্ব হয়েছে। আামারই যেতে ইচ্ছা করে না। কেনো শুকিয়ে গেছি, বাবু হয় না কেনো...দূর এত প্রশ্নের উত্তর দেয়ার আমার কি ঠেকা। বাবাকে কোনদিন বলতেও পারব না। কেমনে কওে বলব এ কথা- বাবা মুকিতের কাছে কেবল একটি খাবার বই আর কিছু তো নই। এক খাবার তার আবার বেশিদিন যে ভালো লাগে না।...পলককে এড করেই একটা বার্তা দিয়েছিলাম... ‘পলক , কেমন আছো?’
পলক সকালেই রিপ্লাই দিয়েছিলো। অনেক কথা হলো। ঐদিনই ফোন নম্বর আদান প্রদান হয়ে গেলো। আমিও যেন হাফ ছেড়ে বাঁচলাম। কাউকে যেন নতুন করে পেলাম। তরু লতা যেন সেই পুরাতন ডালপালাকে পেলো। পলকের পুরো ফেসবুক প্রোফাইল ঘেটে দেখলাম কোথাও এমন কোন নিদর্শন নেই যে সে বিয়ে করেছে। আসলেই তবে বিয়ে করেনি। ফেসবুকে ছেলেরা বউকে খুশি করার জন্য বিয়ে সংক্রান্ত ছবি, তথ্য দিয়ে ভরিয়ে ফেলে। এটা প্রায় সার্বজনিন। আমার অনেক পুরাতন বন্ধুর প্রোফাইলে ঢুকে বউ প্রীতির আতিশায্য দেখে আমি মিটিমিটি হেসেছি কত। বলেই ফেললাম, বিয়ে করো নি কেনো এখনও?
যদি বলি তোমার জন্য। যদি কোনদিন ফিরে আস...
তাই নাকি। আগে আমার লম্পট স্বামীটার হাত থেকে মুক্ত হই। সত্যি বল না কিভাবে কি করি। আর পারছি না। তোমাকে সব বলব। বুকে চাপা কষ্টগুলো কাউকে বলা হয় না। ও জানো এতটা নিচে নেমেছে, আমার সামনেই গালফ্রেন্ডের সাথে কথা বলে, বলে কিনা সে এখনও আনমেরিড। চিন্তা করো। আর কথা কি সামনেই তো...ছি: ছি:
আর কি করে। কি? তুমি কিছু বলো না কেনো?
কি জানি, সেই তরু নেই আর সেই তরু। আমি নিজেকে খুুব দূর্বল ভাবি। কেনো জানি না। বাবার বাড়ী যেতে ইচ্ছা করে না। বাবার কাছে তার ডাক্তার জামাই দুনিয়র সর্বশ্রেষ্ট মানুষ। একাট ভন্ড ডাক্তার। তুমি জানো ও বড় বড় হোটেলগুলোতেও নষ্ট নারীর সান্নিধ্য পেতে যায়। টাকার অভাব নেই তো। আমিও জেদ করেছি। আমাকে ছুঁতে দেবো না কোনদিন।
তবে তো তোমার খুব কষ্ট তরুলতা। নিঃসঙ্গ জীবন।
আর তুমি যে বিয়েই করো নি। প্রেমে ট্রেমে পরো নি আর। ভার্জিনই রয়ে গেলে। ছিঃ কি বলছি তোমাকে এসব।
ঐ যে তোমার জন্য অপেক্ষা করে আছি। তুমি লতা হয়ে আঁকড়ে ধরবে। ...
বেশি কষ্টের পরে আমিও অনেক নেতিয়ে ছিলাম। কাল হলো। দুদিনের মাথায় পলকের সাথে দেখা হলো। পলক জানালো ওর পরিচিত উকিল আছে। আমার বিষয়ে আলাপ করেছে। কোন সমস্যা হবে না। আমি মনে মনে বোকার মত পলকের গলায় ঝুলে পড়বো কিনা ভেবে অবাক হচ্ছিলাম। এ কি ভাবনা। ভুলে যাই মেয়েরা ঝুলে পড়ার যুগ কবেই ছেড়ে এসেছে। এতো আধুনিক যুগ। নিজের অধিকার নিজেকেই আদায় করে নেয়ার যুগ। তবে কেনো লম্পট স্বামীর ঘর করেই চলেছি। সে কি বাবার প্রতি জিদ। না ভয়, কুণ্ঠা...!
আরও এক সপ্তাহ পেরিয়ে যাবার পর পলক জানালো, উকিল জানিয়েছে মুকিতের সম্পর্কে কিছু প্রমাণ যোগাড় করা সম্ভব কিনা। তালাক পেতে এবং ক্ষতিপূরণ পেতে সহজ হবে। আমি বললাম, চেষ্টা করে দেখি তবে কি ধরনের প্রমাণ যদি একটু ডিটেইলস জানাতে।
তারপরই সুযোগটা কাজে লাগালো পলক। আমাকে ওর বাসায় যেতে বললো। ভুল সিদ্ধান্ত নিতে মানুষের দেরী হয় না। আমারও হলো না। কফি শপে দেখা করার পর ওর সাথে সুরসুর করে চলে গেলাম ওর ফ্ল্যাটে। কেউ ছিল না। পিযাসী দেহ মন আমার ওর সামান্য ইশারাতেই ঢলে পড়ল। লতা আঁকড়ে ধরল ডালপালা পলকের। দ্বিতীয় পুরষের স্বাদ পেলাম। আমি কি প্রচন্ড ভুল করলাম?
...ভুলটা বুঝতে সময় লেগেছিলো মাত্র দুই দিন। পলক মোবাইলে করেই ভিডিওটি দেখিয়েছিলো। খুব স্বাভাবিক ছিলো সে। একটু তার হাত বা গলা কাঁপছিলো। স্পষ্ট জানিয়ে দিলো, এটা আমাদের সেদিনের একান্তের সেই মিলনের ভিডিও। ওটা ছিল তার এক বন্ধুর ফ্ল্যাট। ক্যামেরা লুকানো ছিল।
লম্পট পলক ভিডিওটা বন্ধ করতে করতে বলল, আমাকে দশ লক্ষ টাকা দাও না হলে এই ভিডিও আমি ছড়িয়ে দেবো।
আমি থ মেরে গেলাম। অবাক তাকিয়ে রইলাম পলকের নষ্টদুটো চোখের দিকে। সে অনেকটা সময়। তারপর বললাম, কেনো পলক, কেনো? একি তোমাকে ফিরিয়ে দেয়ার প্রতিশোধ, নাকি আমার দূর্বলতার সুযোগ...?
পলক হাসল, বললো, আমার একটা তিন বছর বয়সী ছোট মেয়ে আছে। ওর জন্মগত মাথায় একটি টিউমার রয়েছে। ওটা ওপারেশন করতে হবে। দেরী করলে বাঁচবে না। তোমাার সাথে এই প্রতারণা টুকো করাটাই আমার জন্য সহজ ছিলো। কি বলো? এমনে চাইলে কি টাকা দিতে?
আমি কি বলবো বুঝতে পারি না। সব মিথ্যে। নিশ্চয় এ কথাও মিথ্যে। সন্তান, অসুখ ..কি বিশ্বাস করব? কেনো করব? কেবল যেন ভিডিও টা সত্যি মনে হচ্ছিলো। আমার উদোম দেহটা সত্যি মনে হচ্ছিল। মনে পড়ল প্রথম যেদিন মুকিতের লাম্পট্য ধরা পড়েছিলো সেদিনের কথা। সেটা বিয়ের সাত দিনের মাথায়। একটা ফোন এসেছিলো। তারপরই ইমার্জেন্সী রোগী দেখতে হাসপাতালে যাচ্ছে বলে চলে গেলো। ও যাবার আধঘন্টান পরে ফোন দিয়েছিল এক বান্ধবী। জানালো ওদের বিল্ডিংয়ে লিফটে দেখেছে মুকিতকে খুব ব্যস্ততার মধ্যে ছিলো। হাতে নাতে ধরে ফেলেছিলাম। এক উঠতি মডেলের ফ্ল্যাট ওটা। মুকিতের বান্ধবী। ওরা দুজন আমার হাতদুটো চেয়াওে বেঁধে রেখেছিলো আমি চেয়ে চেযে দেখেছিলাম নিজ হাসবেন্ডের পরনারী রতি ক্রীয়া। সেই সাত দিনের পর কতগুলো দিন, মাস কেটেছে, মুকিত তাকে ছুঁতে পারেনি। আমার সামনেই বাসায় বান্ধবী নিয়ে এসেছে। পলকই ছুঁয়েছে সেই সাত দিনের পর কেবল। ছোঁয়াকে বন্দী করেছে ভিডিওর পাতায়!
টাকা আমাকে মুকিত অঢেলই দেয়। টাকাটাও একটা মুখ্য বিষয় যা আমাকে চুপ রেখেছে হয়তো। সিদ্ধান্ত হঠাৎ নিয়ে ফেললাম। বললাম, পলক তুমি ভিডিও ছড়িয়ে দাও। যা ইচ্ছে তাই করো। কেবল তোমার মেয়ের ঠিকানা আর ডাক্তারের ঠিাকানাটা দাও। ওর চিকিৎসার সব খরচ আমি দেবো। তুমি চিন্তা করো না কিন্তু আমি আর ব্ল্যাক মেইল হতে চাই না কারও কাছে। তোমার এই ভিডিও আমাকে মুক্তি দেবে মুকিতের কাছ থেকে, এবং তোমার মত নষ্ট বন্ধু থেকেও। মুকিত নিশ্চয় ভিডিও প্রকাশ হবার পর আমাকে আর বউ করে সাজিয়ে রাখবে না। ঘরে সাজানোর জিনিষটাও শুদ্ধ হওয়া চাই। হা হা হা!
আমি কফি শপ থেকে হন্ত দসন্ত হয়ে ছুটে বের হলাম। আমি একটু কাঁদবোনা। তার জন্য আমার প্রয়োজন ক’ফোটা বৃষ্টি। সত্যি মুহূর্তেই বৃষ্টি শুর হলো। আমি হেঁটে চললাম ভিজতে ভিজতে। আমি নিজের মাঝে সব ব্যথা ভুলে হঠাই এক অভিনব আনন্দ টের পেলাম নিজের সহজ সিদ্ধান্তে।
০১ ফেব্রুয়ারী - ২০১১
গল্প/কবিতা:
৭৮ টি
বিজ্ঞপ্তি
এই লেখাটি গল্পকবিতা কর্তৃপক্ষের আংশিক অথবা কোন সম্পাদনা ছাড়াই প্রকাশিত এবং গল্পকবিতা কর্তৃপক্ষ এই লেখার বিষয়বস্তু, মন্তব্য অথবা পরিণতির ব্যাপারে দায়ী থাকবে না। লেখকই সব দায়ভার বহন করতে বাধ্য থাকবে।
প্রতি মাসেই পুরস্কার
বিচারক ও পাঠকদের ভোটে সেরা ৩টি গল্প ও ৩টি কবিতা পুরস্কার পাবে।
লেখা প্রতিযোগিতায় আপনিও লিখুন
-
প্রথম পুরস্কার ১৫০০ টাকার
প্রাইজ বন্ড এবং সনদপত্র।
-
দ্বিতীয় পুরস্কার ১০০০ টাকার
প্রাইজ বন্ড এবং সনদপত্র।
-
তৃতীয় পুরস্কার সনদপত্র।
আগামী সংখ্যার বিষয়
লেখা জমা দেওয়ার শেষ তারিখ ২৫ ডিসেম্বর,২০২৪