..তখন আছিল ভর দুপুর, দোকানে নিরিবিলি পরিবেশ। কাষ্টমার ছিলনা একদম। ঠিক তেমন সময় শিলু এসে প্রন্তাবটা দিছিল অকস্মাৎ। ওমন অপ্রত্যাশিত একটা প্রস্তাবে যে কেউ হলেই ভ্যাবচ্যাকা খাইবো । একটু সময় লাগছিলো নিজেরে সামালাইতে আমারও। সেই সামলানোর ক্ষণটুকু তার মিষ্টি অথচ ক্ষুরধার লম্বাটে মুখটার দিকে অপলক তাকায় ছিলাম। গরীব মানুষ, এই মাত্র মেট্রিক পর্যন্ত পড়ছিলাম টাইনা টুইনা, তবুও হুট করে কোন সিদ্ধান্ত আমি কোনদিন নিছি বইলা মনে পড়ে না। যে কারণে নিজেরে নিজে খুব সাবধানী ভাবতাম। এখন আর ভাবার অবশ্য কোন কারণই নাই। সে যাক, যা বলতাছিলাম-শিলুরে আমার ভাল লাগতো অনেক আগে থাইক্যাই। আড়তদারের মাইয়্যা, গ্রামে হেগোর ব্যাপক অবস্থা। পাকা বাড়ি, হের উপর সুন্দরীও আছিলো বেশ। সবাইই শিলুরে পাইবার চাইতো। আমি অবশ্য সেই কারণে না। একদিনেই যে তার প্রেমে পড়ছিলাম তাও না। আমার ছোট দোকান, রকমারী জিনিসের দোকান। মোবাইলে হেয় টাকা ভরতে আইতো, কখনও আইতো টুকটাক ¯েœা পাউডারও কিনতে। কথা হইতো। আমারে হেয় জহির ভাই জহির ভাই কইয়া কত কথা কইতো। অনেক ভাবলাম। মনে সাহস আনলাম। আমার ছোট পরিবার। দুইবোন আছিলো একজন বড় আর একজন ছোট আমার। দুজনেরই বিয়া দিয়া দিছি। ঘরে তখন মা একা আর আমি। তেমন জমি জমা নাই তবে বসত ভিটাটা প্রায় বিঘা দুয়েক হবে আর এই দোকানটা আছে । পজিশন ভালো, হাটের শুরতেই । যদিও বিক্রি বাটা তেমন নাই। চইলা যায় কোনমতে। কতদিন ভাবছি বেইচ্যা দিয়া ঢাকা যামু গা। মা’র চিন্তা করলেই আর সে পথে এগোনো হইতো না। বেশি চিন্তা করলে যা হয় আর কি। তবুও এক রাতে ভাইব্বা মনে হইলো শিলুরে বিয়া করনের ক্ষমতা আছে আমার। দিয়া দিলাম পরদিনই প্রস্তাব। এক্কারে সোজা সাপ্টা প্রস্তাব। কইলাম-তুমি কি কাউরে ভালবাসো, যদি না বাস তাইলে আমারে ঐ সুযোগটা দিবা? হেয় দিলো না। কইলোও না কাউরে ভালোবাসে কিনা। তয় আমি ধীরে ধীরে বুইঝা গেলাম। হেয় ঘটনার পর অনেকদিন পার হইছে। আমার সাথে শিলুর ব্যবহার কোন রকম বদলায় নাই। প্রথম প্রথম আমার নিজেরই হের সাথে কথা কইতে লজ্জা লাগতো। প্রেম প্রত্যাখ্যান করছে। ভাবছিলাম কমু তোমার কাছে কিছু বেঁচমুনা, পরে ভাইবা দেকলাম, মনের কথা কইছি এইটাই বড়। হের লাইগা আবার এত গোস্বা কেন করমু। আমি স্বাভাবিক হইলাম। শিলু প্রায় রোজ রোজ মোবাইলে টাকা ভরে। কয়দিন পর আমি বিকাশ চালু করলাম যখন দোকানে, শিলু একটা একাউন্টও করল। মাঝে মাঝে টাকাও তোলে। নিশ্চয় হের প্রেমিক পাঠায়। আমি বুইঝা গেলাম।... হেই মাইয়্যা ঐ ভরদুপুরে আইসা কইলো হের আর কোন উপায় নাই, আমি হেরে ভালবাসি যদি সত্যি তাইলে আমি তারে বিয়া কইরা শহরে চইলা যাইতে পারমু কিনা। অবাক তো হমুই।
...জেলখানায় আছি চার পাঁচদিন হয়েছে। ভয়াবহ বোরিং সময়। তার উপর বিনা অপরাধে আছি এখানে। কি জানি ছাড়া পাই কিনা। আপন চাচা যদি দয়া করে মাফ দেয়! জহির ভাইয়ের সাথে গতকাল পরিচয় হয়েছে। আর আজই সে এই লম্বা কাহিনী বলতে শুরু করেছে। বিরক্ত হচ্ছিলাম, যদিও সময় কাটছিল, তার চেয়ে বড় কথা এই শেষ লাইনে এসে এইবার মন কেড়েছে গল্প। বাকীটা শুনতে ইচ্ছে করছে। বললাম, একেবারে সরাসির বিয়ে করতে বলল আপনাকে, তাও ভাগিয়ে নিয়েই- কিন্তু কেনো?
আরে মিয়া হেই কথাই তো কইতাছি। ঐখানেই তো টার্নিং। হের বাপে শিলুর বিয়া ঠিক করছিলো। গ্রামের সবাই জানে। আব্বাস ঢালীর পোলা, আক্কাস। আমারই সমবয়সী। না খাইয়্যা থাকছে কত। আমগো বাড়ীর থেইক্যা চালও ধার দিছি কত। আব্বাস ঢালী পরে ভ্যান চালাইতো। বহুত কষ্টে এক টুকরো ধানি জমি ছিলো সেইটা বেইচ্যা আক্কাসরে পাঠাইছিলো সিংগাপুর কামলা খাটতে। একলগে হের লগে কত ঘুরছি। সিনেমা দেখতে গেছি। সিংগাপুর থেইক্যা আমার কাছে ফোন টোনও করতো, কত কি কইতো, শুনে মাঝে মাঝে নেশার মত লাগতো। বিদেশ যাইতে মন চাইতো। অন্তত শহরে যাবার ইচ্ছেটা প্রবল হচ্ছিল মনে। সিংগাপুওে বলে টাকা ছিটাইলেই সব মেলে। সুন্দরী ফর্সা অনেক মাইয়াগো লগে হের নাকি খাতির। হেরা বলে ডিনারের দাওয়াত দেয়। রাতে একলগে বিছানায় শোয়। হেইসব কইতো , আমি শুইনা মজা পাইতাম। গ্রামে এখন হেগোর দুতলা পাকা বাড়ি। যে আব্বাস ঢালী জীবনে গামছা ছাড়া পড়ে নাই, হেয় দামী দামী পাঞ্জাবী পড়ে। হাটে দুইটা বড় কাপড়ের দোকান দিছে। লোক রাইখ্যা চালায়। শিলুর বাপের লগে ভীষণ খাতির এখন। শিলুর লগে তাই বিয়া ঠিক হইছে শুইনা অবাক হইনাই। তয় খারাপ লাগছিলো, বিদেশের ঐ সব ফর্সা মাগীর ফর্সা গতর ছাইড়া শিলুর দেহে কি প্রেম সে দিবার পারব আমি বুঝতে পারি, আমি কষ্ট পাই। শিলুরে তাই কই-আমি জানি শহরে তোমার শিক্ষিত প্রেমিক আছে। তার কাছে চইলা যাও। উত্তর দেয়-‘ গেলে তো যাইতামই ই, তুমি বিয়া করবা কিনা কও। রাজী থাকলে কও, পরশু সন্ধ্যায় আমরা রওনা দিমু। ভাইবা দেকো আইজ রাত। তোমার দোকান নগদ টাকায় কেনা জন্য আমার হাতে লোকও আছে। ভাল দাম দিবো। ভাইব্যা দেখো। আমি কিন্তু জানি তুমি আমারে ভালবাসো।’
আমি সারারাত ভাবলাম। জীবন আর ভবিষ্যতের সব অংক কইষা ফেললাম। ...
শিলু শিক্ষিত মেয়ে। চালাক চতুর। ঢাকায় যাবার টিকিট সব কেটেই রেখেছিলো। যেন জানতোই আমি রাজী হব। আমিও ভাবলাম শুধুই সারারাত উথাল পাতাল অংক কষলাম। সেইতো রওয়ানা দিছি একসাথে। মা মারা যাবার পর থেইক্যা আমার কোন পিছু টান নেই। তার উপোর নিজেই তো শহরে যাবার জন্য ব্যতিব্যস্ত হইছি কতবার। দোকানও বিক্রির ব্যবস্তা করে ফেলেছে শিলু। তার মানে তার পরিকল্পনায় আমি আছি, ছিলাম। আমি তো বাতাসে উড়ছি তখন। শিলুর মিষ্টি মুখ, সাগরের ঢেউ এর মত উত্তাল দেহ ভৈরবীর সুর কানে বাজছে। সেখানে আমার স্পর্শের নিরঙ্কুশ হাতছানি। আমি দু এক পাতা সাহিত্য পড়া মানুষ কেবল। মনে তবুও সাহিত্যের বন্যার তোড় টের পাচ্ছিলাম। দোকান বিক্রি করে দিলাম । লোকটাকে চিনি শিলুর বাবার দোকানের এক কর্মচারী। ঐ পোলা নিজে কতবার কইছে দোকানডা বেচলে যেন হের কাছেই বেচি। ভাল টাকা দিলো। বসত ভিটাও আমার দোকানের একমাত্র কর্মচারী আমার বিশ্বস্ত লাভলু মিয়ার দায়িত্বে দিয়ে গেলাম। ওটা নিয়ে পরে চিন্তা করা যাবে। নির্দিষ্ট দিনে আমরা ঢাকার উদ্দেশ্যে রওয়ানা দিযে দিলাম। কোথায় উঠব তারপর কি করব কেমনে চলবে সবই শিলুর ঠিক করা ছিলো। ওর এক বান্ধবী থাকে ঢাকায়। সে একটা দুরুমের বাসা ভাড়া করেছে আমাদের জন্য। সেখানে উঠব। আমার জন্য সেই বান্ধবীর শশুরের কাপড়ের বড় দোকান, সেখানে চাকুরীরও ব্যবস্থা নাকি করেছে। আমরা ঢাকা পৌঁছে গেলাম সকালেই। সেখান থেকে নির্দিষ্ট গন্তব্যে পৌঁছাতে সময় লাগলো আধ ঘন্টা রিকশায় বসে এই সময়টাতে দুবার জিজ্ঞেস করলাম , শিলু বিয়ে টা আমরা কবে করব সেটাও কি প্লান করেছো? সে উত্তর ...
...সব ঠিক ঠাক মতো হয়ে গেলো, চাকুরীটাও নিশ্চয় শুরু করেছিলেন। তারপর কি সেখান থেকে চুরি টুরি করে ধরা পড়েছেন নাকি?
আরে না ভাই । অত সোজা হলে তো হতোই। নিজের উপর নিজের যখন মানুষের রাগ হয় তখন কেমন লাগে বোঝেন? বোঝেন না। নিজের ভেরতরটা শূণ্য হয়ে যায়। নিজের উপর রাগ হইলো সবচাইতে কষ্টের। ভীষণ শূণ্যতার। রাতে হেইদিন যখন ভবিষ্যতের অংক কষতাছিলাম চোখ লাইগ্য আসছিলো। হেরপরের টুকু তো স্বপ্নেই দেখছিলাম কেবল। ও তো বাস্তব না ভাই। তয় সেই স্বপ্ন বাস্তব হইবো ভাইবা শিলুর প্রস্তাবে রাজী হইয়া দোকান সত্যি সত্যি বেইচা দিলাম। ওর বাবার সেই কর্মচরীর কাছে না । দোকান কিনছিলো আমার নিজের কর্মচারী লাভলু। শিলু তলে তলে হেরে প্রস্তাব দিয়া রাখছিলো কবে আল্লাই জানে। আমিও বসত বাড়িটাও হেরে দেখতে দিয়া আইলাম আরও বড় ভোদাইর মত। তবে সাবধানী মানুষ তো আরও কয়েক ধাপ ভাইবা রাখছিলাম। যদি সত্যি সত্যি এমন হয় যে শিলু আমারে ব্যবহার করতাছে গ্রাম থেকে ভাগার জন্য, হতেও পারে। চালু মেয়ে। সে ক্ষেত্রে আমি কি করেবো? তাও ভাবলাম। শহরে আমার বড় দুলাভাই থাকে। আপা দুলাভাই অনেকবার কইছে সব বেইচ্যা ঢাকায় যাইতে, কইছে তাগো বাড়ির কোনায় একটা দোকান দিতে আমারে। আমি তেমন গা করি নাই। ভাবলাম আপারে একখান ফোন দিয়া কই, দোকানটা দেয়া যাইবো কিনা। ফোন দিলাম। আপায় কইলো খালি আছে। চাইলে দোকান দিবার পারমু। আপা কইলো সত্যি আসবি নাকি। বললাম ভাবতাছি। আসলেই ভাবতাছিলাম। সত্যি অংক মিলে যাইতে লাগলো। আমি কিন্তু শিউর ছিলাম শহরে হের প্রেমিক ছিলোই। হের নামডাও আমি জানতাম। শা..শা ..আরে আপনার নামেই নাম কিন্তু...শাকিল। হায় আল্লাহ আপনে না তো আবার। মজা করলাম । কিছু মনে কইরেন না। সে যাক। যদি শিলু আমার লগে হারামীপনা করবারই চায়, শহরে গিয়া সেই প্রেমিকার লগে চইলাই যাইবো এমন তর পরিকল্পনা কইরাই থাকে। নো প্রোবলেম দোকানের প্রস্তাব লুফে নিবো। আপা দুলভাইও খুশি হইবো। শিলুরেতো আগেই হারাইছি। নতুন কইরা আর কি হারাব। পাইলে বোনাস। না পাইলে ঢাকা যাওযাডা হইলো এই সুযোগে আর কি। সেইটাও তো আমারই ইচ্ছা। ঢাকায় নতুন করে ব্যবসা শুরু করমু। যা টাকা আছে তাতে মাল তোলা যাইবো। দুলাভাইযের বাড়ি, ভাড়া নিশ্চয় লাগবো না।
...এইবার আমি একটু অন্যমনস্ক হইলাম। অনেকটাই মিলে যাচ্ছে। কিন্তু শোনার আগ্রহ হারালাম না। বললাম , তারপর জহির ভাই?
...তারপর আর কইয়ো না। খালি কষ্ট আর শুন্যতা। শূন্যতা আর কষ্ট। সময় মতো ঢাকায় তো পৌঁছাইলাম। দিনটা ছিল শুক্রবার। শুক্রবার দিনেও কেমন এমন মিছা কথা কইতে পারে কোনদিন ভাবি নাই। প্রথমে তো ভাবছিলাম শিলুরে হারাই ফেলাইছি। মাইয়্যাডাওে আনইনা হারাই ফেললাম! আসলে হইছিলো কি পানি খাইবার চাইলো শিলু। বাস ষ্টেশনে তখন আমরা। একটা চকিতে শিলুরে বসতে বইলা আমি রাস্তার অন্যপাশে দোকানে ঢুকলাম। পানি কিনে নিয়ে এসে দেখি শিলু নাই। আশপাশ খুঁজলাম, কোথাও চোখে পড়লো না। শিলুর সাথে একটা ভ্যানিটি ব্যাগ আর আর একটা কাপড় চোপড়ের মাঝারি ব্যাগ ছিলো। সে দুটো ও নাই। মনে পড়লো ওর ভ্যানিটি ব্যাগের মধ্যে আমার দোকান বিক্রির আশি হাজার টাকার পুরোটাই ছিলো। একটু হতবিহ্বল হয়ে পড়লাম। বসে পড়লাম। সময় নিলাম। বুঝলাম আমার অংক কষার পরের টা ঘটছে। কেবল অংকে টাকাটা হারানোর হিসাবটা ছিলো না। এই গরমিলের জন্য সামনে যে কত কষ্ট আছে তখনও বুঝি নাই। ঢাকায় সেটা আমার ছিলো দ্বিতীয় বার আসা। বোনের বাসায একবার আসছিলাম। সে বছর পাঁচেক আগে। বোন দুলাইভাইয়ের ঠিকানা ছিলো কাছে। ফোন নম্বরও। দুলাইভাই বড় ব্যবসা করে। রোড সিমেন্টের ব্যবসা। একতলা টিনের বাড়ি ছিলো তখন । পরে শুনেছি তিনতলা পাকা বাড়ি বানাইছে। সেই বাড়ির এক কোনে রাস্তা পাশে একটা দোকান দিতে কয় আপায় আমারে। দুলাভাইও শেষবার বাড়ি গেছিল যথন একই কথা কইছিলো। আমি শিলুরে মন থেইক্যা দুর করতে চাইলাম। যে ঠিকানায় আমাদের যাবার কথা সেই ঠিকানা আমার জানা নেই। ভাইব্যা আর কি লাভ। বোন দুলাইভাইয়ের ঠিকানায় তাই নতুন জীবনের স্বপ্ন বুনতে বুনতে হাজির হলাম সাত সকালে। একমাত্র ভাইগ্না আমার। পকেটে মাত্র তিনশত সত্তুর টাকা নগদ। এক কেজি আপেল কিনলাম একশত দশ টাকা দিয়া। দুপুর পার হইলো। খাইয়া দাইযা ঘুমাইলাম। বিকালে আপারে কইলাম , আপা দোকান কই , দোকান ডা দিমু ভাবতাছি।
আপা কইলো, তোর দুলাভাইতো দোকানডা পঞ্চাশ হাজার টাকা এডভান্স দিযা একজনরে ভাড়া দিব ঠিক কইরা ফেলছিলো। কাল আমি তোর মুখে ইচ্ছা শুইনা হেরে কইলাম, ওইটা কেনসিল কইরা দাও, জহির হের গ্রামের দোকান বেচলে যা পাইবো তোমারে কিছু এডভান্সও দিতে পারবো দোকনও সাজাইতে পারব। তোর দুলাভাই মাটির মানুষ। তয় হেরও টাকা দরকার। তোর লাইগ্যা কইছে পঁচিশ হাজার এডভান্স আর ভাড়া মাসে পাঁচহাজার দিলেই হইবো। এর চেয়ে সস্তায় কোথায় কিন্তু তুই দোকান পাবি না। ...আমি অবাক হয়ে আপার দিকে তাকিয়ে থাকলাম। আপা কইলো তুই রাজী থাকলে কাইলই বাড়ি যা, দোকান বেচে চলে আয়, পজিশন গিয়া দেখ নিচে, দারুন চলব তোর এইখানে রকামরি দোকান। আমি কিছু বলতে পারলাম না। দুলাভাইযের সাথে দেখা করতে মন চাইলো না। ভাবলাম । ভাইবা ঠিক করলাম আর কি করার বসত ভিটাটা বেইচা দিয়া আছি। এমনেতেই গ্রামে মুখ লুকাইয়া গোপনেই যেতে হবে। কোনমতে বেচে দিয়া এক্কেবারে চলে আসাই শ্রেয়। অনেক টাক পাওযা যাবে। দোকানও হবে, একটা ব্যাংক ব্যালেন্সও । আপারে কইলাম, তুমি ব্যবস্থা কর, আমি দু একদিনের মধ্যেই আসতাছি।
শাকিল ভাই, এর পর যা সব নিজের পায় নিজে কুড়াল মারা কয় না, হেইডা হইছে। বাড়ি ফিরা গেলাম সেই রাতে। আমার কর্মচারী ছিল যে, ঐ যে লাভলু, হেরে ফোন দিয়া গোপনে গ্রামের বাইরে দেখা করতে বললাম। সে আইলো। কইলাম , কালপরশুর মধ্যি আমার ভিটাডা বেচার ব্যস্তা কইরা দিতে। সে রাজী হইলো। দুদিন পর হেরে ফোন দিলাম। হে কাইটা দিলো। ওদিকে আপায় কল দেয়, কয় টাকার জোগার হইছে নি। আমি বলি এইতো আর মাত্র দুদিন। পরের দিনও লাভলু ফোন ধরলোনা। রাতের গভীরে গোপনে গ্রামের লোকচক্ষু এড়িয়ে আমার বাড়িতে গিয়া উঠলাম। আমারে বাড়িতে ঢুকবার দেয় না। আমি গন্ডগোল লাগাই দিলাম। লাভলুর বউ কয়, হেই বাড়ি বলে হেরা কিনছে। শরীরটা কেমন জ্বলে কন। পাড়া প্রতিবেশি ছুইটা আসলো কয়েকজন। কইলো হ তুমিতো বাড়ি দোকান সব লাভলুরে বেইচা দিছো। বেইচা দিছি! আমি আকাশ থেইকা পড়ি। লাভলু ঘরের থেইক্যা বের হয়। হাতে হের দলিল। সেখানে আমার সই। বুঝবার পারি- দোকান বেচার সময় বাড়িও বেইচা দিছি। হায়রে আমি বলে সাবধানী মানুষ! কষ্টে তখন বুকটা ফাইটা যায়। কে জানত একটু পরে সব চেয়ে বড় ধাক্কাডা আইবো। আইলো দ্রুতই। শিলুর বাপ সেই রাতেই পুলিশ নিয়া ছুইটা আইলো। কোন কথাই কাউরে শোনাইতে পারলাম না। আমার নামে মামলা হইলো -আমি নারী পাচার করছি। শিলু এখন নাকি দুবাই, হেরে আমি বলে পাচার করছি। মাইর যা দিলো থানায় শাকিল ভাই। কইয়েন না। তবুও তা সহ্য হইছে, সময় গেছে ব্যথা গেছে। মনের ভেতর যে কষ্ট। নিজের উপর নিজের রাগ...খাইযা ফেলে কিচ্ছু ভালো লাগে না। আরেকবার যদি সুযোগ পাইতাম। কি থেইক্যা কি হইয়া গেলো...আপনারে পাইয়্যা একটু হালকা হইলাম, কিছু মনে কইরেন না...
আমি ঠোটের উপর ঠোট চেপে হাতটা মাথার চুলে ঢুকিয়ে দিলাম। মাথাটা নাড়ালাম হালকা। কী বলব বুঝতে পারলাম না। মনে হলো একবার বলে দেই, জহির ভাই আমি সেই শাকিল, আপনি ঠিক নামই জানতেন। শিউলি মানে আপনার শিলু বাস ষ্ট্যান্ডে আপনাকে ফেলে সেদিন আমার কাছেই চলে এসেছিলো। পুরাতন ঢাকায় আমার চাচার স্বর্ণের বড় দোকান। দোকানের পেছনে একটা ছোট ঘর দোকানের ভেতর দিয়ে পথ আছে, বাইরে দিয়েও। ওটাই আমার থাকার জায়গা। চাচার বাড়ি থেকে তিন বেলা খাবার আসে। অন্য কর্মচারীদের চাচা বিশ্বাস করে না। তাই দোকানে থাকতে হয়। আগে চাচার বাসাতেই থাকতাম। ওখানে থেকেই ইন্টার পর্যন্ত পড়েছিলাম। ডিগ্রীতে ভর্তিও হয়েছিলাম, চাচার দোকানে বিশ্বাসী লোক দরকার, ভাল মাইনে দিতে চাইলো আমিও রাজী হয়ে গেলাম। তার উপর ছোট থেকে তার নুন খাচ্ছি। আমার আব্বাও গ্রামে একা পেরে উঠছিলেন না। আমার গ্রাম কিন্তু আপনাদের উপজেলা সদরেই। ওখানেই শিউলির সাথে পরিচয় হয়েছিল। সে অনেক কথা । আমাদের প্রেমে খুঁত ছিলনা। অন্ত আমি তো তাইই ভাবতাম। কত টাকা পাঠাতাম শিউলিকে। প্রতি মাসেই। ঢাকায় চলে আসতে চাইলো। জোর করে বিয়ে দিচ্ছে বাবা মা। বয়স্ক পাত্র। না পালালে উপায় নেই। আমিও রাজি হলাম। শিউলিই সব পরিকল্পনা করেছে। ঢাকায় ওর এক বান্ধবী আছে আমি জানতাম। সেখানে থাকবে বলল, তারপর সময় দেখে বিযে করে নেবো। তার মধ্যে আমিও চাচাকে বুঝাব, আমি রাজী হলাম। কিন্তু বাস ষ্ট্যান্ট থেকে যখন আমার সাথে রওয়ানা দিলো তখন জানালো ওর বান্ধবী গ্রামে গেছে হঠাৎ, একদিন পরে আসবে। এই একদিন আসলে কোথায় থাকবে সে ভাবতে পারছিল না। সে চাচ্ছিল আমিই বলি। আমিই বললাম, আসলে আমিও পায়ে কুড়াল মারলাম। বড় সড় কোঁপ। সারাদিন ঘূরে ফিরে বেড়ালাম। আমি ওর হাত ধরে হাঁটছি ঢাকা শহরে, আমারে তখন পায় কে। একসাথে খেলাম । চাচাকে বলে ছুটি নিয়েছিলাম। বলেছিলাম একটু গাজীপুর যেতে হবে। ডিগ্রী পরীক্ষাটা দেবো , ওটার কাজেই জাতীয় ভার্সিটিতে যাওয়া লাগে। আগেও গেছি। চাচা রাজী হয়েছিল। রাতে দোকান বন্ধ করার আগেই চলে এলাম। কর্মচারীরা সব চলে যাবার পর পেছনের দরজা দিয়ে শিলুকে ঢুকালাম। পুরুষ মানুষ তো। ওর মত সুন্দরী প্রেমিকা একসাথে এক বিছানায় থাকবে। আমি তো ভেইে আত্তহারা। একটু ঠোঁটের স্পর্শতো চাইতেই পারি। ওর কড়া নির্দেশ। পাশে থাকাই যাবে না। আমি বাধ্য হয়ে নিচে থাকলাম। মনে মনে খুশিই ওর মত সতী সাবিত্রি পেয়ে। এই মাসেই বিয়ে করে ফেলব। ওর বান্ধবীর বাসায় দিয়ে এসেই কাল চাচীকে বলব। চাচী খুব ফ্রি আমার সাথে; উনি বুঝবেন বিষয়টা। কিন্তু হায়! দোকানের প্রায় পনের ভরি স্বর্ণ কখন যে ব্যাগে ঢুকিযে ফেলেছিল। চাচাকে কি বলব! ভাতিজা হয়েছি তো কি? উনি ব্যবসায়ী মানুষ, জেলে ঢুকিয়েই ছাড়লেন। ওর বান্ধবীর একটা নম্বর ছিল। সেখানে কল দিয়ে জেনেছিলাম দুবাই চলে গেছে সকালেই। সাথে তার স্বামী। বান্ধবীর ঠিকানাটা চেয়েছিলাম। কেটে দিয়েছিল, ওর বান্ধবী এরপর আর কখনও মোবাইল ধরেনি।
...বলতে পারলাম না এসব জহির ভাইকে। কেবল বললাম, আপনি ঠিকই বলেন, আপন ভুলে নিজের উপর মানুষের যখন নিজেরই রাগ হয় -সে ভীষণ কষ্টের, সে ভীষণ যন্ত্রনার, সে ভীষণ শূণ্যতার।