এক.
প্রতি জন্মদিনে ইচ্ছেটা মাথার ভেতর বন্যার পানির মত উপচে ওঠে। সারাবছর থেতিয়ে থাকলেও এই দিনে আর পারেনা উন্নিশা।
বাড়ীতে কেউ নেই। তবুও ডান হাতটা বাড়িয়ে ছিটকিনি আটকে দেয়। এটা বাবার ঘর। এক কোণে মা’র শাড়ি রাখার আলমারিটা এখনও অক্ষত আছে।আলমারি ভর্তি শাড়ি। মা মারার যাবার পর থেকে সেগুলো পড়ার কেউ নেই। আলামারীর একটা চাবি উন্নিশার দখলে। তার বড় ভাই বউকে নিয়ে শ্বশুর বাড়ীরই একটা ফ্ল্যাটে শরণ বানিয়েছে। ভাবী এখানে এই মধ্যবিত্ত এলাকায় টিনের চালের নিচে কুঁড়েসম নীরে থাকতে পারেনা। তার পক্ষে শাশুড়ীর পুরাতন শাড়ি পড়ার বিষয়টা ঠিক তাই বাস্তবিকও না।
উন্নিশার জীবনের বিশেষ দিন আজ এই উনিশে শ্রাবন। এমনই একদিন ছিল তার সেই জন্মতিথির বৃষ্টি প্রহর- নবজাতকের আগমনে সেদিনের সেই ভার্সিটি কোয়ার্টারে মুখরিত ছিল অনেকগুলো মানুষ। পরদিন দুধে আলতা কন্যার মুখ দেখে তার আপ্লুত বাবা বউয়ের জন্য একটা শাড়ি কিনে এনিছিলেন। সবুজ জমিন, মাঝে মাঝে আরও ঘন সবুজ কারুকাজ, কালো সূতোর রেখায় টানা পাড়-একটা জামদানি শাড়ি। বাবাকে তার মা বলেছিল, ‘তোমার কি মাথা নষ্ট নাকি-মেয়ের জন্য কিছু আনবা তা না এনেছো তার মার জন্য?’ কতবার সেই বাবার পাগলামি নিয়ে কথা পাড়ত মেয়ের কাছে মা। উন্নিশা মুগ্ধ হয়ে শুনত, বুঝত কত গভীর প্রেম ছিল তাদের মধ্যে। কোনদিন দু’জনের কারও মাঝে একটুও তর্কের মত কটূ বাক্যও উচ্চারিত হতে শোনেনি উন্নিশা। একদম রেল লাইনের মত সমান্তরাল দাম্পত্য জীবন ছিল তাদের। অথচ এক পাশের লাইনের সীমানা রচিত হয়ে গেলো। মা মরে গেলো হঠাৎ একদিন। তখন মাত্র বছর দশেক বয়স উন্নিশার। অসহায়, নিঃস্ব মেয়েটাকে আরও ভীষণ একা করে দিলো প্রকৃতি। অনাহুত ঘটনাগুলো একই সংসারে একই পাত্রে পুনঃ পুনঃ কেনো ঘটতে থাকে এর উত্তর অবশ্য সে পায়নি কোন বই পুস্তকে খুঁজেও।
ভাঁজ করে রাখা আছে শাড়িটি আলমারির ভেতর। সবগুলো শাড়ির উপরে। ডান হাতটা বাড়িয়ে বের করে আনে সে। আলতো করে বিছিয়ে দেয় খাটের উপর। একটা দুটো করে ভাঁজ কয়েকটা খুলে ফেলে। তারপর পেছনের দিকে তাকায়। আলমারির গায়ে বড় লম্বা আয়না। তাকিয়ে থাকে নিজের মুখের দিকে। চেহারাটা সৃষ্টিকর্তা এমনই বানিয়েছে অসুন্দর শব্দ কেউ উচ্চারণ করতে পারবেই না। কিছু সৌন্দর্য্য থাকে যা সর্বজন মাত্রই স্বীকার করতে বাধ্য । ঠিক তেমনি উন্নিশার চেহারা। তবুও আয়নার দিকে তাকাতে তাকাতে মিষ্টি হাসিটা পুরুষ্ট ঠোঁটের কোল ছেড়ে নেমে গিয়ে খাটের উপরে শাড়ির ভাঁজে মিশে যায়। দৃষ্টি আবার শাড়ির দিতে ফেরাতে তাই বাধ্য হয় উন্নিশা। নিজের অবয়বে এতক্ষণ তাকিয়ে থাকার শক্তি তার নেই। আজকাল আরও বেশি কমে গেছে যেন।
মা মারা গিয়েছিল ভাদ্র মাসে। ঠিক তার আগের মাসে শ্রাবন সন্ধ্যার জন্মদিনের দিন মা এই শাড়িটা তাকে দিয়ে দিয়েছিল। বলেছিল, ‘এতো তোর জন্মের শাড়ি। সারা জীবন আগলে রাখিস।’ বলতে বলতে শাড়িটি পড়িয়ে দিচ্ছিল মা। দুচোখ বেয়ে জল নেমে আসছিল মাযের। ডানহাতটা বুকের কাছে টেনে নিয়ে একটা গভীর দীর্ঘশ্বাস নিয়ে মা বলেছিল,‘এই তো মানুষে কপাল মারে, ভাগ্যের উপর কারও হাত নেই, তবুও তুইতো বেঁচে আছিস, এই তো কত পাওয়া। ভাগ্যের উপর কারও হাত নেই মা, তোর ভবিষ্যত ভেবে খুব কষ্ট হয় মারে, খুব কষ্ট।’
সালোয়ারটা উন্নিশা খুলে ফেলে খুব দ্রুতই। অভ্যাস হয়ে গেছে। আয়নায় চোখ ফেলাতে চায়না। তবুও চলে যায়। পরণে শুধু সেলোয়ার আর বক্ষবন্ধনী, কালো রং। ওটা খোলে না। ডান হাত উঁচিয়ে বুকের উপর লম্বা চুলের চলে আসা রেশমী গোছাটা সরিয়ে দেয় পেছনে। চোখ হতে অজান্তেই তার পানি চলে আসে। আজকাল অবশ্য দুঃখ কষ্ট বোধ কমে গেছে তবে নির্জীবতা বেড়েছে, বেড়েছে উদাসিনতাও। কষ্ট হয় কারন হঠাৎ করে কেনো যে তার শুণ্য ডাঙ্গায় জল ছিটাতে এল তানযির স্যার- ভেবে পায়না। যত ভাবতে চায় ততই মনে হয় এ যেন মায়া কিংবা সহানুভূতি। সমাজতো তাই শেখায়। না হোক স্যার বিদেশে থেকে এসেছেন, তাই বলে সমাজের থেকে উত্তীর্ণ হওয়া কি এতই সোজা?
মা’র ব্লাউজ এখন গায়ে লাগে। সেই দশ বছর বয়সে লাগতো না। অবশ্য মা সেই ঘটনার পর থেকে কোনদিন তাকে হাফ হাতা কোন কিছু পড়তে দিতোনা। ব্লাউজতো তাই পড়া সম্ভবই ছিলনা। মা রাজী হতেন না। আজ কে মানা করবে। কেউ নেই কোথাও আশেপাশে। বাবা অফিসে গেছেন সেই কখন।
ব্লাউজটাও পড়ে ফেললো। কিভেবে আজ সেলোয়ারটাও খুলে মা’র সবুজ একটা ছায়া গলিয়ে দিলো গলা দিয়ে। তারপর দুটো ফিতে যখন বিপত্তি ঘটালো, চোখের সামনে গড়ে তোলা ঠুনকো বাধ নিমিষে ভেঙ্গে গেলো। কান্নার বন্যায় ভেসে গেলো মসৃন দুটো গাল। এত ভাল লাগে তার শাড়ি পড়তে। কিন্তু সে কেনো পড়তে পারবেনা। প্রকৃতি তার প্রতি এত নিষ্ঠুর কেনো?- খাটের উপর ধপাস করে বসে পড়ে। মাথাটা গুজে দেয় নগ্ন দু’উরুর মাঝে। অজান্তেই ডান হাতে টেনে নেয় শাড়িটা। তারপর উঠে দাঁড়িয়ে এক হাতে প্যাচিয়ে নেয় কোমড়ে, গোজা কিংবা কুচি দেয়া সম্ভবপর হয়ে ওঠেনা। আঁচলটা উঠিয়ে দেয় বাম কাঁধে। আয়নায় তাকিয়ে থাকে অনেকটা ক্ষণ। এ যেন সেই অমর কাল, যার শুরু সেন শেষ নেই। চোখ দিয়ে গলগল করে পানি বেরিয়ে আসে। আজ যেন শপৎ করেছে , ঐ বিভৎস দৃশ্যে, আয়নার ভেতরে, দৃষ্টিকে সে আজ কবর দেবেই...
মোবাইলের আওয়াজ ভেঙে দিলো এই আত্মহরণ যোগ। তানযির স্যার কল করেছেন। একজন অসাধারণ মানুষ। অসাধারণ মানুষের কল রিসিভ না করার অর্থ হলো তার অসাধারণত্বকে অপমান করা। এই কাজটা উন্নিশা কখনও করবে না। এই লোকটাকে সে প্রবল জোয়ারের মত ভালোবেসে ফেলেছে। কিন্তু অমাবশ্যার উন্নিশা, তার জোয়ার সে অমানিশায় ঢেকে রেখেছে, দেখছে না কেউ।
দুই.
‘উন্নিশা, তুমি মনে হয় কাঁদছ, কেনো বলোতো?’
‘স্যার, কান্নার বিষয়টি কী মানুষের ব্যত্তিগত অধিকারের মধ্যে পড়ে না?’
‘তা অবশ্যই পড়ে, এবং কাছের মানুষের পক্ষে সেটা জানার চেষ্টা করাটাও অধিকারের মধ্যে পড়ে।’
‘আপনি আমার কাছের মানুষ নয়, আপনি কেবল আমার স্যার, আপনার অধিকারের সীমানা নিশ্চয় আমাকে আপনার শেখানোর প্রয়োজন নেই।’
‘তুমি খুব বেশি আফসেট মনে হচ্ছে, কী হয়েছে বলবে?’
‘সরি্য স্যার, এই যে স্যার আর কাঁদছিনা, আর কী কোন শব্দ পাচ্ছেন?’
‘গুড গার্ল, লক্ষ্মী মেয়ে, কিন্তু স্যার বলাটা ছাড়ছো না কেনো?’
‘স্যার কে স্যার বলবো না তো কী বলবো?’
‘আমি তোমাকে অলরেডি প্রপোজ করে ফেলেছি, এখনও কি স্যার বলতে হবে। আর তুমিও ফাইনাল ইয়ারের এক্সাম দিয়ে ফেলেছো, সো স্যার শব্দটা দয়া করে কী রিপলেস করা যায় না..?’
‘যায় না স্যার, কারন আপনি প্রপোজড করেছেন, আমি কিন্তু একসেপ্ট করিনি।’
‘কেনো করছোনা, তুমি কি আমাকে তোমার যোগ্য মনে করছোনা, নাকি অন্য কেউ...অন্য কারও...’
‘স্যার আপনি কিন্তু আমাকে অপমনা করছেন, আপনি খুব ভালো করইে জানেন এবং সবই বোঝেন। শুধু শুধু এই অবোধ বালক সেজে আমার কাছে নিজেকে ছোট করবেন না। আমি আপনাকে অনেক বেশি রেসপেক্ট করি।’
‘কিন্তু আমি যে ভালোবাসা চাই, রেসপেক্ট এ পেট ভরছে না উন্নিশা।’
‘আপনার কী এটা ফেসিনেশন বা সিমপ্যাথি টাইপ কিছু মনে হচ্ছেনা..?
‘না, কারন আমি জানি আমি তোমাকে ভালবাসি...এবং সে কারনেই আমি বিশ্বাস করি তুমি এখনই আমাকে জানাবে তুমি আজ তোমার এই বিশেষ দিনটির প্রভাতে কেনো কাঁদছিলে?’
‘স্যার, আপনি ভেবেছেন লম্বা বাক্যের ফাঁকে বিশেষ দিনের কথা স্মরণ করিয়ে আমাকে সারপ্রাইজ দেবেন। আমি জানি আপনি ভার্সিটির রেজিষ্টার থেকেই আমার জন্মদিন জেনে নিতে পারেন খুব সহজেই। তবুও আপনার খুশির জন্য সারপ্রইজড হলাম।’
‘তুমি না... বাই দ্যা ওয়ে, হ্যাপী বার্থডে টু উই উন্নিশা। এবার বলনা প্লিজ কাঁদছিলে কেনো?’
‘থ্যাঙ্ক্ওু ফর ইওর উইশ স্যার। স্যার, আমার আবার কান্না আর হাসি। আচ্ছা আপনি কি শাড়ি পড়াতে জানেন? আমার আজকে খুব শাড়ি পড়তে ইচ্ছে করছে। আমার জন্মদিনের দিন বাবা মাকে একটা শাড়ি দিয়েছিলেন, আমি সেটাই গায়ে জড়িয়ে আছি।’
‘না জানাটাই স্বাভাবিক নয় কি? কিন্তু মেয়েরা সেটা সকলে এমনতেই পারে। আমার দুই বোনকে দেখেছি। কেউ শেখায়নি। সবাই দুপধাপ শাড়ি পড়া শিখে ফেলেছে। একবার হলো কি...আচ্ছা থাক সে কাহিনী হাতে হাত রেখে বলার মত, ফোনে বললে জমবে না। ’
‘আপনি এসব কি বলছেন স্যার। আপনি কি জানেন আমি শাড়িটা গায়ে জড়ানোর আগে একটা ছায়া পড়তে চেয়েছিলাম, সেটাও আমি পড়তে পারিনি। আমার মত একটা অসহায়কে, একটা বাতিল মেয়েকে আপনি কেনো ভালবাসবেন।’
‘এটা কি শব্দ-বাতিল! ডু ইউ মিন ইউসড, আই ডোন বিলিভড ইট...’
‘স্যার আমি ফোন রাখব, আপনি ভাল করেই জানেন আমি কি বুঝাচ্ছি, আপনি কেনো এত ভোলা সাজছেন, আমি কি-বাতিল, কেনো বাতিল, তা যদি আপনার জানা না থাকে, আপনার ভার্সিটির কোয়ার্টারে কাউকে জিজ্ঞেস করবেন। আমরা কিন্তু একসময় ওখানে থাকতাম। আব্বু তখন ভার্সিটির শিক্ষক ছিলেন।’
‘তুমি আবার কাঁদছ?’
‘আপনি কাঁদানোর মতই কথা বলছেন। আমি রাখছি স্যার...’
‘প্লিজ ...প্লিজ, উন্নিশা। আমি যদি এসে তোমাকে শাড়ি পড়িয়ে দেই..’
‘কেনো আপনি আমাকে শাড়ি পড়িয়ে দেবেন, ছিঃ ছিঃ আপনার তো চরিত্র ভাল নয়। ...আচ্ছা যদি আমিও আপনার মত চরিত্রটি খারাপ বানিয়ে শাড়ি আপনার দুহাতের আবদেনে গায়ে জড়িয়েও নেই, তবুও কিন্তু আপনি আমাকে নিয়ে ঘুরতে বের হতে পারেবনা। শুধুতো চোহারায় মজেছেন, বাকী আর কী কিছু লাগবেনা? আপনি কী একটি বার আপনার চোখদুটো বন্ধ করে কল্পনা করবেন আমার মত একটা মেয়ে শাড়ি পড়ে আঁচল ঝুলিয়ে আপনার পাশে হাঁটছে -দৃশ্যটা কি ভয়াবব, কি কুৎসিৎ! আরেকটা কথা স্যার, যা নিজে পড়া যায়না অন্যের হাতে তা কয়দিনই বা আর পড়া যাবে। আপনি তো কেবল শাড়ির কথাই দেখেলেন, এমনি কত কিছুই আমি করতে পারিনা। এমনি কত কাজ। আমি অসম্পূর্ণ স্যার। আমাকে দিয়ে আপনার চলবেনা। ’
‘উন্নিশা, এসব কথার কোন মানে হয়? আমি তো সব জানিই। ঘটনার পেছনের ইতিহাসও জেনেছি । এখানে কেন্টিনের এক লোকের কাছে বিস্তারিতও শুনলাম। কি ভয়াবহ! কিন্তু কি করার আছে বলো তো কার। সবই অদৃষ্ট।’
‘না অদৃষ্ট না। অদৃষ্ট কখনও কখনও হাতের মুঠোতেও থাকে। আপনি চাইলেই আপনার অদৃষ্ট থেকে আমাকে সরিয়ে দিতে পারেন এখুনি। এই মুহূর্তেই। আমি সেটাই চাচ্ছি।’
‘আচ্ছা ঠিকাছে, তুমি ভার্সিটিতে এস। আসার সময় একটা সাদা কাগজে লিখে নিয়ে আসবে ঠিক কি কি কাজ করতে মানুষের দু’টো হাত লাগে। আমি তোমার উত্তরের প্রতিটির কাউন্টার লজিক দেবো। যদি আমি সেটা দিতে পারি তবে আমি জিতব, সে ক্ষেত্রে প্রেম বিষয়ে আমার প্রস্তাব তোমাকে মানতেই হবে। আর না পারলে তুমি জিতে গেলে। কোন কথা বলবেনা। এক ঘন্টার মধ্যে লিখে চলে আস। আমি ডিপার্টমেন্টে আছি।’
তিন.
কিভাবে ঠেকাবে। কিভাবে জিতবে? সবদিকেই যে তার হার। মন যে টানছে ভীষন। তানযির স্যারকে যে মনের একটা অংশ বারবার না হারানোর উপদেশ দিয়েই যাচ্ছে। কিন্তু না ঠিক হবে না । কাজের বুয়া চলে আসবে একটু পড়ে। বুয়াকে দিয়ে শাড়িটা পড়ে বের হলে কেমন হয়। নিশ্চয় স্যার শাড়ির আঁচলের নিচে অপরূপ নারীর শূণ্য হাত কখনও দেখেনি। ভড়কে যেতেও পারে। বুয়া আসুক আগে। উন্নিশা স্যারের এসাইনমেন্টে নিয়েই বসলো বরং।
উন্নিশার কাছে সুন্দর সুন্দর কিছ লেখার প্যাড আছে। এমন প্যাডেই তো প্রেমিক প্রেমিকারা সেই আগের যুগে পত্র লিখত। এখনও একদম ফুরিয়ে যায়নি সে আবেদন। আর তার কিনা লিখতে হবে উভয় হাতের প্রয়োজনীতার ক্ষেত্র। কি উপহাস! হঠাৎ নিজেকে দু’হাতে দেখেতে ইচ্ছে হয়। স্যারকে জড়িয়ে ধরার সাধ জাগে। স্মৃতিতে দু’হাত একটু একটু স্পষ্ট এখনও, সেটা সেই আট বছর বয়সের। ওই বয়সেই তো ঘটেছিল সেই জীবন বদলে দেয়া বিপ্রতীপ ঘটনা। স্কুল থেকে হেঁটে হেঁটে কোয়ার্টারে ফিরছিলো। কে জানত, রাজনৈতিক দলগুলোর ছত্র ছায়ায় থাকা হারামী ছাত্রগুলো রাজনীতির নামে অস্ত্র নীতিও চর্চা করতে নামে। তাও সেই সময়। একটা গুলি এসে বাম হাতে বিধেঁছিল। প্রায় চার ঘন্টা সে পড়েছিল ঝোপের আড়ালে। অনেক রক্ষক্ষরণ হলো। হাতটা আর বাঁচানো সম্ভব হয়নি ডাক্তারের পক্ষে। পঁচন ধরেছিল ক’দিনেই। কনুইয়ের উপর থেকে কেটে ফেলে দিলেন ডাক্তার। অনেক দুঃখ কষ্ট নিয়ে মা হাসপাতালের বেডে বসে বলেছিল, ‘যাক তোর প্রাণটা তো বেঁচেছে, অস্ত্রের ঝনঝানিতে এই ক্যাম্পাসে কত প্রাণইতো গেছে, উন্নিশাতো বরং লাকি। একটাই হাত, ও না থাকলে কি, আমার হাতই তোর হাত মামণি।’
তারপর পর আর কোন বাম হাতের দৃশ্য স্মৃতিতে নেই। একটা শুকনো শূণ্যতা। কামিজের লম্বা লম্বা হাতের ভেতর ফাঁপা দুঃখ, শুণ্য বাস্তবতা। হাফ হাতা কিংবা ব্লাউজ পড়লে শুণ্যতা মিশে যায় বাতাসে। সেটা ভীষণ কুৎসিৎ রাসায়নিক মিশ্রন, বাম হাতের শূণ্যতা আর বাতাসের মিলন।
না ! অসংখ্য, অজস্র, অগুনিত কাজে মানুষের দু’টি হাত লাগে। স্যার বুঝতে চাইছেন না, এক হাতে জীবন চলেনা। মা, বলেছিল, তার হাতই উন্নিশার হাত। অথচ মা’ পরবর্তীতে কোনদিন এটা হাফ হাতার ফ্রকও তাকে পড়তে দেননি। বাবাও তাই বলে এসেছেন। এক হাতের জীবন ভীষণ করুনার জীবন। সবাই করুনা করে। সে তাই লুকিয়ে রাখাটাই শ্রেয় মেনে নিয়েছে। মা ঠিকই করতেন।
কাগজে একটা দাগও দিতে পারেনা উন্নিশা। কি লিখবে? শাড়ি পড়তে দু’হাত লাগে, শাড়ির নিচে ছায়ার ফিতে লাগাতে দু’হাত লাগে। দোকানের সেলোয়ার কিনে সেটাতে সারাজীবন আবার টেইলার্স এর কাছ থেকে ইলাস্টিক লাগিয়ে নিতে হযেছে। হায়রে জীবন! উন্নিশা লিখতে শুরু করে। এক একে লিখতে লিখতে পুরো পৃষ্টা ভরিয়ে ফেলে। তারপর অজান্তেই মনের সাগরে ভেসে ওঠে সেই উত্তরের খেয়া। স্যারতো এত কিছু জানতে চাননি। একটাই উত্তর যথেষ্ট। সে বুঝে ফেলে লেখারইবা কি দরকার। একটাই বাক্য। মুখেই বলে ফেলবে।
বুয়াকে দিয়ে শাড়ি পাড়ানোর সাহস হয়না। শাড়ি পড়ে আচলের নিচে হাতহীণ শূণ্যতা সে সহ্য করতে পারবেনা। ফাঁকা হাত কামিজের এর চেয়ে অনেক ভালো। স্যারের জন্য কেনা ‘শরদিন্দুর ঐতিহাসিক কাহিনী সমগ্র’ নামের মোটা বইটা ব্যাগে ঢুকিয়ে রওনা দেয়। স্যারের বই পড়ার খুব বাতিক। এমন একটা ভালো বই স্যার পেয়ে খুব খুশি হবেন। কিন্তু স্যারকে খুশি করে তার কী লাভ?-সে জানে না। সে স্যারকে খুশিইতো করতে চায় আসলে।
চার.
মাত্র আট মাস আগে আমেরিকা থেকে পিএইচডি করে দেশে এসে ঢাকা ভার্সিটিতে যোগ দেয়া তুখোড় শিক্ষক তানযির স্যার ডিপার্টমেন্টে নিজের রুমেই অপেক্ষা করছিলেন। সন্দিহান ছিলেন হয়তো আসবেনা উন্নিশা। না এলে নিজেই কী একবার ওদের বাসায় চলে যাবেন-ভেবে পাচ্ছিলেন না।
পায়ের আওয়াজে চোখ ল্যাপটপের উপর থেকে উঠাতেই তাই আধাআধি চমকালেন তিনি। তারপর হাসলেন। বসতে বললেন উন্নিশাকে। হাত বাড়ালেন, ‘দাও, লিস্টটা দাও।’
উন্নিশা ব্যাগ খুলে বইটা বাড়িয়ে দিলো। স্যার বলেলেন, ‘কী এটা?’
খুব স্মিতিত একটা হাসি ঠোঁটের কোনে ফুটিয়ে তুলে উন্নিশা বলল, ‘স্যার আপনার জন্য একটা বই। আমার খুব পছন্দের। আপনার মনে হয় ভাল লাগবে। অবশ্য যদি প্রেমের ভূত মাথা নষ্ট না করে দিয়ে থাকে...’ শেষ বাক্যটা খুব আস্তে বলল। স্যার শুনল কিনা বোঝা গেলোনা। তবে জিজ্ঞেস করলেন, ‘বইয়ের জন্য ধন্যবাদ। দেখতো জন্মদিন তোমার, আমারই কিছু দেয়ার কথা। কি লজ্জা। বলোতো কি দেয়া যায়?’
‘সত্যি দেবেন স্যার। সত্যি। তবে আমাকে নিয়ে খেলাটা বন্ধ করে দিন।’
স্যার এবার হেসে উঠলেন, ‘বন্ধ করবো বলেই তো লিখে আনতে বললাম। কই দাও।’
‘সে অনেক অনেক কাজ স্যার লিখে শেষ করা যাবেনা। তবে আমার মনে হয় আপনি একটা শুধু একটা কাজের এন্টি লজিক দিন। তবেই আমি মেনে নেবো। তবেই আমার জন্য যথেষ্ট। ’
উন্নিশার চেহারাটা মুহূর্তে যেন আরও বিষণ্ন কিন্তু মধুর হয়ে গেলো। যেন সন্ধ্যার ঝড়ো হাওয়য় প্রকৃতির সবুজ বৃক্ষে প্রাণের জোয়ার কিন্তু অজানা ঝড়ের উৎকণ্ঠা। একটা মায়াময় আবহ। তানযির স্যার মুগ্ধ হয়ে তাকিয়ে থাকলেন। উন্নিশা বলে চলেছে, মাথাটা তার নিচু কিছুটা।
‘স্যার, ভালবাসা, প্রেম, বিয়ে, দুটি মানুষের কাছে আসা এসবের মাঝে আলিঙ্গন, বন্ধন বা ইংরেজিতে হাগ বলে একটা অনস্বীকার্য শব্দ রয়েছে। আপনি আমাকে বলেন একটা হাতে প্রেমিককে কিভাবে আলিঙ্গন করা সম্ভব। কখনই সম্ভব নয়, কখনই নয়, এ হয়ে উঠবে এক অসম্পূর্ণ বন্ধন, এ যে আধাআধি স্পর্শ। আপনি বলেন স্যার আলিঙ্গনের জন্য কী দু’টি হাত প্রয়োজন নয়? বলেন স্যার।’ বলতে বলতে নিচু মাথা উচুঁ করে ফেলেছে উন্নিশা। হঠাৎ যেন একটা জিদ্ কাজ করছে প্রাণে। কথাগুলা বলার সময় সে চোখটা বন্ধ করে ফেলবে ভেবেছিল অথচ এখন খুলে রেখেছে। এক দৃষ্টিতে বড় বড় করে চোখ মেলেছে স্যারের দিকে।
তানযির স্যার প্রচন্ড বিস্ময় নিয়ে এই বুদ্ধিমতি সুন্দরী মেয়েটার দিকে তাকিয়ে থাকলেন কিছুক্ষন। তারপর চেয়ারটা ছেড়ে উঠে এলেন। উন্নিশার ডান পাশে এসে দাঁড়ালেন। বাম হাতের তালুতে চেপে ধরলেন উন্নিশার ডান হাত । তারপর চোখের দিকে চোখ রেখে উঠে দাঁড়াতে বললেন। মন্ত্রমুগ্ধ হয়ে অজান্তেই উন্নিশা উঠে দাঁড়াল । মুহূর্তে তানযির স্যার তাকে ডান হাতে জড়িয়ে কাছে টেনে নিলেন তারপর দ্রুত উঠানামা করতে থাকা উন্নিশার উন্নত বুকটা নিজের বুকের সাথে চেপে ধরে কানের কাছে মুখ নিয়ে ফিসফিসিয়ে বললেন, ‘এই বাম হাতটা আমার, ডান হাতটা তোমার, আর অন্য হাতটা দু’জনার ভাগাভাগি। আমরা যদি দুটি প্রাণ এক করে নেই, এক হয়ে যায় দুটি তনু, তিনটে হাতে কী তবে আমাদের এক প্রাণ-এক দেহ চলবেনা?