সাত মা

মা (মে ২০১১)

মামুন ম. আজিজ
  • ৬৮
  • ৮০
(এক)
প্রতিটি ভোরের মতই কাছাকাছি তিনটি মসজিদের আযান শোনা গেলো। একের পর এক। শেষের আযানটি সবচেয়ে জোরে শুনল হাসপাতালের জেগে থাকা প্রতিটি মানুষ। এই মসজিদটি হাসপাতালটির একেবারে খুব কাছে। মাঝে একটা তিনতলা বিল্ডিংয়ের কঙ্কাল মানে ছাদগুলো হয়েছে কেবল। ওটা পেরলেই মসজিদ। তিনতলার উপরে ছাদ হয়েছে। সংস্কার চলছে। সংস্কার চলছে অনেকদিন ধরেই। কাজ যেন আর শেষ হয়না।

পুরাণ ঢাকায় অনেক বাড়ীই এই মসজিদের মত আধা সংস্কারের পর থমকে থাকে। আসলে ওটাই একধরনের শেষের পর্যায়, এক ধরনের সমাপ্তি। নতুন ঢাকায় হয়তো চাকচিক্যটাই ইম্পরট্যান্ট । দালানের চাকচিক্য আর রূপ সেখানে অনেক কিছুর পরিচায়ক। পুরাতন ঢাকাতো, ওত চাকচিক্য দিয়ে কি হবে। বাস করাটাই মুখ্য। তাছাড়া হতে পারে সংকীর্ণ গলি এবং সরু পথের কারণে মনুষ্য মানসিকতাও সংকীর্ণতা গ্রহণ করতেই বাধ্য হয়। চলাচলেরই পথ নেই তার আবার দালান কোঠার সৌন্দর্য্য! ইদানীং অনেক পুরানো, নবাবী যুগের দালান কোঠা ভেঙে নতুন নতুন সুউচ্চ কিংবা মধ্য উচ্চ দালান তৈরি হচ্ছে। এর ফলে সরু গলি, পুরাণ বাড়ীর ধ্বংস উন্মাদ হাহাকার আর নতুন দালানের আস্ফালনের এক মিলিত মিশ্র জট ঘরানার সৌন্দর্য ভিন্ন রূপ নিয়ে নেয়ার পায়তারা করছে বর্তমানে।

জেনারেল হাসপাতালটি সেই নতুন স্থাপত্য আস্ফালনের এক নীরব কর্মী দালান। ঢাকা শহরের অলি গলি, মধ্যম সড়ক, রাজ পথ এবং উন্নত থেকে অনুন্নত এলাকায় এত এত পদের হাসপাতাল আর ক্লিনিক গড়ে উঠেছে যে সেসব হাসপাতালের প্রকারভেদ নির্ণয়ে করা বড় দুরূহ এক কাজ। তবে খুব সাধারণ ভঙ্গিতে যদি উন্নত, অনুন্নত এবং মধ্যম উন্নত এই তিনভাগে ভাগ করার একটা অপচেষ্টা নেয়া যায় তবে এই হাসপাতালটি মধ্যম উন্নত ভাগের শেষ দিকে স্থান দেয়া যায়। মানে অনুন্নতের কাছাকাছি। স্থানীয় মানুষের তড়িৎ প্রয়োজন মেটানোর খুব প্রচেষ্টা এখানে আছে তাই ব্যবস্থা যতই অপ্রতুল হোক না কেনো।

যে কোন হাসপাতালেই ঘুম বিষয়টি খুব একটা নিয়মে আবদ্ধ হতে পারে না। এখানে কেউ অর্ধ ঘুম, কেউ নির্ঘুম আবার কেউ অনবরত ঘুমের প্রচেষ্টায় রত থাকে । কাছের আযানটা শুনে যারা জেগে উঠেছিল তারা ছাড়াও হাসপাতালের প্রায় সবাই জেগে উঠল বিকট শব্দটা শুনে। আযান শেষ হবার মিনিট সাতেক পরেই। ভয়াবহ শব্দ। আশে পাশের প্রতিটা বাড়ীতে একের পর এক আলো জ্বলতে শুরু করল। তখনও ভোরের ক্ষয়িষ্ণু আঁধারকে সূর্যটা গিলে খেতে পারেনি।

প্রথমটার পরে মিনিট ক্ষণ বিরতি। তারপর একের পর এক অনেকগুলো প্রকম্পিত শব্দ। জ্বলে ওঠা বাতিগুলো মুহূর্তে সব নিভে গেলো। পূর্বাকাশে সূর্য উদয় হবার প্রস্তুতিটা নিচ্ছে বলে মনে হচ্ছিল কিন্তু দাউ দাউ করে জ্বলে উঠল আগুন। আগুণ লেগেছে হাসপাতালের যে পাশে মসজিদ তার উল্টো পাশে- পূর্ব দিকে, হাসপাতাল থেকে মাত্র ৫০ গজের মধ্যেই। বাঁশ আর টিনের চালার অনেকগুলো সারি সারি ঘর। ইটের দেয়াল আছে আবার আছে বাঁশের বেড়াও। টিনের চালা জ্বলছে, বাঁশের বেড়া জ্বলছে। জ্বলছে সারি সারি ঘরগুলোর সাথে লাগোয়া একটা দোতলা অর্ধ সমাপ্ত বাড়ি। ওটার নিচতলায় একটা কেমিক্যাল কারখানা। এখনও মাঝে মাঝে বিস্ফোরণের আওয়াজ আসছে। মানুষের চিৎকার , হৈ চৈ বাড়ছে । বেড়েই চলেছে।

আগুনে পুড়তে থাকা দোতলা বাড়িটার অন্যপাশে একটা লম্বা চালা ঘর। পুরোটাই বাঁশ আর কাঠের। ভেতরে কাঠের আসবাবপত্র তৈরির কারখানা। তারপর একটা দেড়/দুই ফুট চওড়া অর্ধ আবদ্ধ নর্দমা। তারপরই হাসপাতাল। কোন আলাদা বাউন্ডারি দেয়াল নেই।

অন্ধকার সম্পূর্ণ শেষ হবার আগেই পাশাপাশি কাছাকাছি সবহগুলো বাড়ি খালি হয়ে গেছে। সবাই ভয়ে নেমে পড়েছে পথে। হাসপাতালের ভেতরেও গুঞ্জন বেড়ে গেছে। প্রথমে বিস্ফারণের শব্দ নিয়ে আতঙ্ক বিরাজ করতে না করেতেই অনেকের চোখে পড়ে গেলো আগুনের জ্বল জ্বলে শিখার লকলক করে ডনে বামে উপরে নিচে এগিয়ে চলার গতি।

খুব বেশী লোক নেই হাসপাতালে। তারপরও কম না। ডিউিটিরত ডাক্তার তিন জন, হাসপাতালের নাইট শিফটের কর্মীগণ। রোগীও আছে দুতলা আর তিনতলায় কয়েকজন। কয়েকজন রোগীর দেখাশোনার জন্য হাসপাতালে থেকে যাওয়া নারী পুরুষ। এই একটু আগে হাসপাতালের মেইন গেইট খুলেছিল দারোয়ান। দু'জন লোক ফজর নামাজের জন্য মসজিদের দিকে এগিয়ে ছিলেন। তারা মসজিদে পৌঁছানোর আগেই এই আজব । রোগী ডাক্তার আর কর্মীরা সব হুড়মুড় করে নিচের গেটে জড়ো হলো মুহূর্তে। মুহূর্তে একদল মানুষ হাজির হলো রাস্তায়। দারোয়ান দ্রুত একবার হাসপাতালের ভেতরটা দেখে নিল। আর কেউ চোখে না পড়ায় কিছু না ভেবে দ্রুত পরপর দুটো গেটই লক করে সেও নেমে গেলো রাস্তার জনারণ্যে। একবারও মনে হলো না উপরে আরও আর কেউ থাকতে পারে। কিংবা ভেবেছে এই বিপদেইতো গজিয়ে ওঠে একপাল লুটেরা। হাসপাতালটা লুট হবার আগে গেটটা বন্ধ থাকুকই না ।


(দুই)
আগুনের শিখা বাড়ছে লকলকিয়ে। ঘন আগুনের মেঘে ঐ উপরে আকাশে। আগুনের কালো ধোঁয়ার কুন্ডুলিতে ভোরের সূর্য মুখ লুকিয়েছে। তীব্র পোড়া গন্ধ। সবকিছু মিলিয়ে পুরো মহল্লা জুড়ে ভোরের শান্ত সুনির্মল পরিবেশের মৃত্যুই শুধু নয় এক নীরব ভয়াবহতা দাপিয়ে বেড়াচ্ছে মাটি থেকে আকাশ।

মসজিদের নামায পড়াচ্ছেন হুজুর। অনাগত বিপদের আশঙ্কা হুজুরের মনেও হয়তো। তাই তার কণ্ঠ কাঁপছে, পড়ছে দ্রুত সূরা কেরাত।

সরু রাস্তায় একদল মানুষ আতঙ্কে ছুটছে। এপাশ থেকে ওপাশ। কেউ কাঁদছে। স্বজনের সন্ধানে চিৎকার করছে। হয়তো কাছাকাছি স্বজনকে পেলেই জড়িয়ে ধরছে। কেউ খুঁজেই পাচ্ছে না। মনে অজানা আশংকা তাদের।

থেমে থেমে বিস্ফোরণের শব্দ এখনও আসছে। বাঁশ কাঠ ফাটার আওয়াজ গুলো সে বিস্ফোরণের শব্দে অনেকটা ম্রিয়মাণ। ধোঁয়া বাড়ছে। ধোঁয়ার সাথে ভীষণ তীব্র একটান ঝাঁঝ বাতাসে ছড়াচ্ছে।

কয়েকজন মানুষের আর্ত করুন চিৎকারও আসেছ আগুনে লাগা ঘরগুলো থেকে। সেগুলো থেমেও যাচ্ছে দ্রুত। এক এক বার চিৎকার মানে যেন এক জন আটকে পড়া মানুষের মৃত্যু। দর্শকের মাঝে ভীতি, শঙ্কা। পানি দিতে কাছে যাবে সে সাহস পাচ্ছে না হাজার হাজার মানুষ। কেউ কেই পানি নিজে ছুটছে। কাছে গেলেই ধোঁয়ার ঝাঁঝ দুরে সরিয়ে দিচ্ছে। অথচ আগুণ চারপাশে ছড়াচ্ছেও দ্রুত। বিশেষ সচেতন কেউ কেউ মোবাইলটা দিয়ে ফায়ার সার্ভিসকে জানিয়েও দিয়েছে। কিন্তু বাস্তব সত্য মানলে এই সরু পথে তাদের গাড়ী কি আদৌ ঢুকবে?

হাসপাতালের আয়া স্বপ্না রাণী। চল্লিশ ঊর্ধ্ব বয়স। সে এখন হাসপাতালের সিঁড়ির দোতলায় দাঁড়িয়ে। নিচ তলায় নেমেছিল সে আর নার্স নাহিদা পারভিন। তারা নামার আগেই সিঁড়ির গেইট, মেইন গেইট সব বন্ধ করে গেছে দারোয়ান। একরাশ আতঙ্ক আর ভয় নিয়ে কাঁপতে কাঁপতে নাহিদা তিনতলায় ফিরে গেছে। সেখানে আটকা পড়া ক'জনার কাছে গিয়ে তার ভয় যেন আরও বেড়ে গেলো।

স্বপ্না রাণী দোতলার সিঁড়ির জানালা দিয়ে দেখল ঐ দূরের দোতলায় একটা মানুষ পুড়ছে। সে কি গগন বিদারী আর্তনাদ। তারপর আবার সেই বিস্ফোরণের শব্দ। হঠাৎ তার মনে হলো এ যেন কিয়ামত। সে আর তাকাতে পারল না। এর বেশী আর্তনাদ শোনার সাহস তার হয়না। এক নিঃশ্বাসে উঠে গেলো তিনতলায় । তার কেবল মনে পড়ছে তার ছেলেটার কথা। সে কাঁপছে এখন। উপরে অন্যদের কাছে গিয়ে শুধু বলল, 'আমরা আটকা পইড়া গেছি।'
নার্স নাহিদা , আয়া স্বপ্না রাণী সহ বাকী সবার মাঝে এখন আতঙ্ক পূর্ণ মাত্রায় ছড়াল।

বোমা ফাটার মত শব্দগুলো শোনার পর থেকেই এই অনুন্নত ছোট জেনারেল হাসপাতালের লেবার ওয়ার্ড আর মহিলা ওয়ার্ডের অল্প ক'জন রোগী শঙ্কিত হয়। তারা বুঝতে পাড়ছিল না কি হচ্ছে। যেদিক থেকে শব্দ আসছিল সেদিকে কেবল একটিই জানালা। তাও বন্ধ ছিল। ভয়ে কেউ কাছে যাবার সাহসও পাচ্ছিল না। এদের মধ্যে কয়েকজন তো একেবারে বলতে গেলে হাঁটা চলারই সক্ষম নয় এখন।

প্রথমে ভাবল কোথাও কাছে দূরে বোমা পড়ল। নাকি গোলাগুলি! তারা সবাই তখন ভয়ে জড়সড়। একদিন আগে ভূমিষ্ঠ শিশুটিও কেঁপে কেঁপে উঠছিল প্রতিটি প্রকম্পিত শব্দে। তার মা নিজের শারীরিক যন্ত্রণা ভুলেও শিশুকে জড়িয়ে ধরে রেখেছে বুকে। সে ভুলে গেছে তার আপন কষ্ট । কেবল ভাবনা তা মেয়েটার কি হবে? এই তো মা। মা তো এমনই। উদরজাত সৃষ্টির প্রতি প্রেম।

লেবার ওয়ার্ডটিতে গতকাল শিশু প্রসবকারিণী সুমনা ইয়াসমিন নামের এই মহিলা ছাড়াও ছিল আরেকজন গর্ভবতী। চারমাসের প্রেগন্যান্ট। পেটে অসম্ভব বেদনা নিয়ে ভর্তি হয়েছিল মাত্র আগের সন্ধ্যায়। ব্যথা এখনও কমেনি। ডাক্তাররা পরীক্ষা নিরীক্ষা করতে দিয়েছেন। এখনও কারণ অনুসন্ধান হয়নি। মেয়েটার বয়স খুব বেশী না । সবে ২০ পেরিয়েছে। ইরিনা। ভালবাসার বিয়ে। হাসপাতালে সাথে তার মা ছিল। ফজরের আযানের সাথে সাথে সে বাড়ী গিয়েছিল মেয়ের জন্য খাবার আনতে। কাছেই ইরিনার বাবার বাড়ী। লেবার ওয়ার্ডের এই দুই নারীর কাছে বাহিরের অশনি ঘটনার খবর সবার পরেই এসেছে। নবজাতকের চেয়ে জীবনের দ্বিতীয় ভোর কাটছে সেই আনন্দে আত্মহারা হয়ে মনে মনে ভাবছিল নানান ভবিষ্যৎ। আরেকজন পেট চেপে অপেক্ষা করছিল কখন মা ফিরবে। চিৎকার চ্যাঁচাম্যাচি আর পুনঃপুন: বোমার মত শব্দ তাদেরকেও আতঙ্কিত করে। তারপর পাশের জেনারেল ওয়ার্ড থেকে আয়ার ভীত কণ্ঠ ভেসে আসতেই তারাও বুঝতে চায় কি হলো। কি ভয়াবহ দুর্যোগ এলো, কি হতে পারে? কোন আন্দোলন, মারামারি, দাঙ্গা , জঙ্গি হামলা কি?
ইরিনা পেটের ব্যথা নিয়েই উঠে এগোতে গেলে গেলে সুমনা জিজ্ঞেস করে , 'কই যাও। আমার ভয় করতেছে, আমারেও একটু নিয়া যাবা ধরে। খালা যে কই গেলো?

সুমনার খালা শাশুড়ি ছিলেন সাথে তার দেখা শোনার জন্য। ঢাকায় তার তেমন কাছের কেউ নেই। স্বামী তার এই মহল্লাতেই একটা বড়সড় কনফেকশনারীর মালিক। একা নয়। খালাত ভাইয়ের সাথে শেয়ারে। এই খালাদের বাড়ীটা কাছেই। সে বাড়ীর একটা ফ্লাটে তারা স্বামী স্ত্রী দুজন ভাড়া থাকে। এলাকায় খালার দাপোটও আছে। হাসাপাতালের তাই ডাক্তার অপারেশন করার কথা বললেও খালার ধমকে ডাক্তার অপেক্ষা করে একদিন। তাতেই নরমাল ডেলিভারি হয়ে গেলো। সেই খালাই রাত জেগে থাকেন সাথে। সুমনার মা নেই। খালার কাছে তর্জন গর্জন শুনলেও তার মাঝেই মার প্রতিচ্ছবি খুঁজে নেয় সে। তার শাশুড়ির গ্রাম থেকে আসেনি এই খালারই ভরসায়। কিন্তু সেই খালা কই?

লেবার ওয়ার্ডে সদ্য জাত শিশুটাকে একা ফেলে পাশের রুমে এগিয়ে যায় দু'জন। সেখানে তখন ভীষণ আতঙ্কে কিংকর্তব্যবিমুঢ় আয়া স্বপ্না রাণী, নার্স নাহিদা, সুমনার খালা, বিছানায় শোয়া মৃতপ্রায় বৃদ্ধা নছিমন বিবি আর এপেনডিঙ্রে অপারেশন হওয়া পৌঢ় বয়সের আমেনা খাতুন। আয়া স্বপ্না যখন খবর দিল তখন আগুনের শিখার ছায়া একমাত্র জানালার কাচেও পড়েছে। দেখেছে তারাও।


(তিন)
আগুন লাগার কারণ নিয়ে লোকজনের মধ্যে কানাঘুষা। শব্দের কারণটা কেউ বুঝতে পারছিলনা। হাসপাতাল সংলগ্ন কাঠের দোকানটাও ছুঁয়েছে মরণ কামড় দেয়া আগুন। বোমার মত শব্দগুলো এখন থেমে গেছে । কাঠের দোকানটার ভেতরে থাকা তিনজন কর্মচারী বের হয়ে দর্শকের সারি তে দাঁড়িয়ে এখন তাদেও কাজের স্থান পুড়তে দেখছে। একটু আগেও তারা সেখানে শুয়ে ছিল। কি ভয়াবহ!

মসজিদে নামায শেষ হয়েছে অনেক আগেই। হুজুর মাইকে ঘোষণা দিচ্ছে। সবাইকে ঘর থেকে বের হয়ে আগুন নিভাতে বলছে। বিদ্যুৎ না থাকায় ব্যটারীর মাইকে সে আওয়াজ জন হৈচৈয়ের মাঝেই হারিয়ে যাচ্ছে।

হাসপাতালের মহিলা ক'জন সে ডাকে ভীত হয়। সূর্য আকাশে উকি দিলেও আগুনের কালো ধোঁয়া আর বিদ্যুতের অভাব হাসপাতালের তিনতলায় এক আবছা আঁধার নিয়ে এলো। ভয়ের সাথে পরিবশেটাও জমেছে ঠিক।
নছিমন বিবির মেজ ছেলে ছিল হাসপাতালের ভেতরেই। আমেনা বেগমের স্বামীও ছিলেন। বাসায় তার দুই ছেলে মেয়ে একা। মেয়েটার বয়স ১৯। বাসা সামলানোর মত বয়স তার হয়েছে। বাসা এখান থেকে দুটো গলি পড়ে। তবুও তার মনে ভয়। বোমার বিস্তার কোন দিকে কতদূরে কিংবা আগুন ছুটেছে কানদিকে কিছুই তার জানে না। নিজে নড়তে পাড়ছে না। দুই দিন হলো অপারেশনটা হলো। মনে তবুও কেবল ছেলে মেয়ে দুটোর জন্য ভাবনা। স্বামী বের হয়েছিলেন মসজিদে নামাজ পড়তে । আমেনা বেগম মনে মনে প্রার্থনা করছে স্বামী যেন বাসায় চলে যায়।

স্বপ্না রাণী নছিমন বিবির দিকে তাকিয়ে বলে ওঠে, ' আপনার পোলাডরে তো নামায পড়তে দেখিনাই একদিনও, হেয়ও বুড়া মারে থুইয়্যা পালালো! এক ঠিলে দুই পাখী, নিজেও বাঁচলো বুইড়া মাও মরলো' কথা গুলো বলেই সে হু হু করে কেঁদে ফেলে।

নছিবন বিবি দাঁতহীন মুখেই খিঁচিয়ে ওঠে, 'পালাইছে বেশ করছে। হে আমর পোলা, সাত রাজার ধন, হে বাঁচলেই মুইর শান্তি, তুমি আয়া কি বুঝবা?'

'আমি কি বুঝমু, তাইতো আমি কি বুঝমু...'
কাঁদতে কাঁদতে রুম থেকে বের হয়ে সামনের করিডরে গ্রিল ধরে দাঁড়ায়। ছেলেটার মুখ ভেসে ওঠে মানসে। কতদিন তার সাথে কথা হয় না। অথচ মাঝে মাঝেই চোখে পড়ত। হাসপাতালের ছাদে কাপড় শুকাতে গিয়ে অনেকদিন ছেলেডারে ঐ খানে ঢুকতে দেখেছে। ঐখানটাই পুড়ছে এখন দাউ দাউ করে। ওখানে ছোট খাট অনেক রকম দোকান ছিল। এই রিকশার একটা গ্যারেজ, দুটো লোহা লক্কড়ের ভাঙরির দোকান। সামনে একটা পুরি পেঁয়াজুর সাথে চা সিগারেটের আড্ডা খানা, পেছনে ছিল একটা ক্লাব ঘর। সাথে লাগোয়া কয়েক ঘর স্বল্প আয়ের মানুষের বসবাস। ক্লাব ঘরের গা ঘেঁষে যে গলিটা অনেকদূর এগিয়ে গেছে এবং তারপর সেটা ওপাশের একটা দোতলা অর্ধ সমাপ্ত ইট খসে পড়া বাড়ির কাছে গিয়ে অন্ধ গলি হয়ে গেছে। ওটার নামই এলাকায় কুখ্যাত গাঞ্জা গলি। সব পুড়ছে। গাজা ডাইল সব পুড়ে এতক্ষণে নিশ্চিত ছাই। কিন্তু তার ছেলে! সে কি আজকেও ছিলো? মন একবার বলছে ছিলো না আরেকবার বলছে ছিলো।

মা ছেলে দুজনেরই তাদের দুজেনের প্রতি অভিমান। কেউ কারও সাথে কথা বলে না। মার মন বারবার বলতে চায়। ছেলের বোধহয় চায়ওনা। শেষবার যখন কথা হয়েছিল, সেও মাস ছয়েক আগে। ঐ গাঞ্জা গলির ভেতরেই। ছেলের পিছু পিছু গিয়েছিল। ছেলে বেশী কথা বলতে চায়নি। মাকে বিদায় করার জন্যই ব্যস্ত ছিল। কিন্তু পোড় খাওয়া স্বপ্না রাণী ওখানে যা দেখেছিল তাতে তার মনে সন্দেহের গভীর দানা বেঁধে যায় এবং সে খোঁজ খবর নিয়ে জেনেও যায়। জানতে পারে তার ছেলে ঐ অন্ধ জগতের অনেক উপরেই পৌঁছে গেছে। কেবল ডাইল গাঁজার ব্যবসার মাঝে তার বিচরণ নয়। গোপনে ওখানে গোপন আস্তানায় আড়াল ঘরে অস্ত্র পাতি বোমা এসবের কারবারের সাথেও তার ছেলে জড়িয়েছে। ফেরানোর কোন পথ তার চোখে পড়ে না। সে চুপ থাকে। পাছে তার কারণে ছেলের বিপদ হওয়ার আগেই কোন বিপদ ঘটে যায়। আর কেউ বুঝুক না বুঝুক সে বুঝে যায় বোমার মত বিস্ফোরণের শব্দগুলো আসলেই বোমা। গাঁজা গলিতে ছিল বোমার কারখানা। জঙ্গিদের জন্য গোপনে সেখানে বোমা তৈরি হতো।

সেই সেদিনের টান বাজারের সুন্দরী দেহ প্রসারিণী স্বপ্না রাণীর ঐসব খোঁজ খবর বের করার মত দু একজন পরিচিত জনের সাথে এখনও যোগাযোগ আছে। তাদের মাধ্যমেই ছেলেকে ওপথ থেকে ফেরানোর উপায় খুঁজছিল সে। মনে পড়ে সেই সময়ের কথা। তার ঘরে খদ্দের অভাব হতো না কখনও। নিজের জীবনটাকে ঘৃণ্য ভাববে সেই ফুসরতটুকু ছিল না। ছেলেটা তখন ছোট, কথাও বলতে শেখেনি ঠিকমত। বড্ড জ্বালাতন করত। বাধ্য হয়ে ঘরে বাইরে একটা ভ্যানের উপর শিকল দিয়ে বেঁধে রাখত ব্যবসার সময়টুকু। নিত্যদিন একটা শিশু সবার চোখের সামনে থাকত শিকলে বাঁধা। পাড়ার ভেতর আবার চোখ! পোষা কোন প্রাণীকে যেমন মানুষ কাছ দিয়ে যাবার সময় হাত বুলিয়ে যায়, তেমনি খদ্দেররা দেহ উপভোগের এই আদি এবং নিগৃহ মজাটুকু উপভোগ করে চলে যাবার সময় হাত বুলিয়ে যেত ছেলেটার গায়। কেউ যেত দুটো পয়সা তার দিকে ছুড়ে দিয়ে। কখনও ছেলেটা থাকত ঘুমিয়ে আর কখনও বা তাকিয়েই থাকত ফ্যাল ফ্যাল করে। স্বপ্না রাণীর আজ সে সব ভাবলে ভয়াবহ কষ্ট হয়। কিন্তু এ সবই নিয়তি। মানুষের কি করার আছে। জীবনে সবচেয়ে ভালো যে উপহার নিয়তি তাকে দিয়েছে সে এই আয়ার কাজ। একটা এনজিওর এক ডাক্তার আপা নারীদের যৌন রোগ সম্পর্কে শিক্ষা দিতে যেত। তার সাথে ভালো সম্পর্ক ছিল। টান বাজার উঠে যাবার পর দেহ ব্যবসার প্রতি ঘৃনাভাবটা জীবনে ভাবার সময় আসে। তখন সেই ডাক্তার আপা তাকে এই কাজটি জুটিয়ে দেয়। অবশ্য ততদিনে দেহের রূপ তার অস্তমিত অনেকটাই। দেহ তখন পড়ন্ত বিকেলের রক্তিম সূর্য। ছেলেটাকে মানুষ করা সবরকম চেষ্টাই সে করেছে। কিন্তু কি হবে টান বাজার থেকে যখন বের হয় তখনই ছেলে সব বোঝার মত বয়সে পৌঁছে গিয়েছিল। তার বয়স ছিল তখন চৌদ্দ। অসময়ে শিকলে যারে বেঁধেছিল তারে আর কোন বন্ধনে বাঁধতে পারেনি। বাপের পরিচয়টা যে বড় প্রয়োজন এই পুরুষ শোষিত সমাজে।

একবার ভাবে ওমন ছেলে বেঁচে না থাকলেই তো ভাল। আপদ গেলো। কিন্তু পরক্ষণেই মন মানে না। মা তো। চোখের কান্না তার বাঁধ মানে না।


(চার)
আমেনা বেগম ছেলে মেয়েদের জন্য অস্থির হয়ে উঠেছেন। বিছানা থেকে উঠে বসেছেন টেনশেনে। তিনি চিৎকার করে বলছেন,' কারো কাছে কি একটা মোবাইল আছে? কারও কাছে?'
তিনি জানতে যাচ্ছেন তাদের বাড়ীটা বিপদ মুক্ত তো? তিন সন্তানদ্বয়ের জন্য কাতর হচ্ছেন বারবার।

ইরিনা মোবাইলটা এগিয়ে দেয় আমেনা বেগমের দিকে। অনেকক্ষণ ধরে সে মার মোবাইলে চেষ্টা করেছে। নেটওয়ার্ক পাওয়া যাচ্ছে না। প্রচণ্ড বিজি। মনে হয় এলাকার সব মানুষ এক সাথে মোবাইলে আত্মীয় স্বজনকে বিপদের খবর জানাতে ব্যস্ত।

পাশের রুম থেকে শিশুর কান্না শোনা যায়। সুমনা 'আমার মামণি!' বলেই ছুটে যেতে থাকে। হুমড়ি খেয়ে পড়ে যাবার আগেই তার খালা শাশুড়ি ধরে ফেলেন। সুমনা খালাকে জড়িয়ে ধরে প্রচণ্ড গর্জনে কেঁদে ও ে, আমার মেয়েটার কি হবে? কে বাঁচাবে তাকে। কে?

খালা তাকে বিছানায় বসিয়ে দিয়ে নবজাতককে নিয়ে আসতে যান। আনার পথেই দেখতে পান জানালার ওপাশে কেবল ধোঁয়া আর ধোঁয়া। প্রচণ্ড ভয় এবার তার মধ্যেও চলে এলো। তিনি দেখেলেন তার বাড়ী দিকেও দ্রুত এগিয়ে যাচ্ছে আগুন। আগুনের উপর নানা দিক থেকে এখন পানি ফেলার চেষ্টা চলছে। কিন্তু আগুন যেন তাতে বেড়ে যাচ্ছে আরও বেশী। এর আগেও পুরান ঢাকায় অনেক আগুন লাগা দেখেছেন তিনি তার জীবনে। কিন্তু এ যেন অন্যরকম। এ যেন থামার নয়। পরক্ষণেই মনে পড়ে। দোতলা বিল্ডিংটার নিচতলায় একটা কেমিক্যাল কারখানা ছিল। ওটাও তো পুড়ছে, কেমিক্যালের কারণেই এই বীভৎস আগুন না তো! বাসার কথা মনে পড়ে। সবাই কি নেমে যেতে পেড়েছে। তার দুই ছেলে, ছোট মেয়েটা। সুমনার দিকে ফেরে,'তোমার মোবাইলটা কোথায়?'
'খুঁজে পাচ্ছিনা খালা। বিছানার পাশেই রেখেছিলাম। কে যেন নিল?'
বলেই আয়া স্বপ্নার দিকে তাকালো। নাহিদা বলে উঠল, ' মোবাইল নিলে সুমিই নিয়েছে। ওই মেয়েটাই ভোরে লেবার ওয়ার্ডে গিয়েছিল মুছতে। ওর চোরের স্বভাবও আছে। ছেমড়িতো পালিয়েছে। আমরা তিনতলার এই ক'জন বাদে আর সবাই চলে গেলো। কেউ একবার ভাবলোওনা উপরে আমরাও আছি। কি আজব!'
নাহিদা তার মোবাইলটা বের করে এগিয়ে দিল। মাত্র ৩ টাকা আছে মোবাইলে। রাতে জেগে থাকতে হবে দেখে জেগে জেগে কথা বলেছে অনেকক্ষণ প্রেমিক পুরুষ নাঈমের সাথে। একবার সে ভবল নাঈমকে জানাবে , কিন্তু সে টেনশন করবে ভেবে আর জানায়নি।

শিশুটিসহ এখানে মোট আটজন নারী। ভয়াবহ বিপদ । মোবাইল মাত্র দুটো। তাও একটার টাকা প্রায় নেইই। স্বগোত্রীয় মোবাইলে কল করা যেতে পারে অন্তত। সুমনা বুদ্ধিমতী মেয়ে। তার স্বামীরও একই সিম। স্বামীকে মোবাইলে কল দিয়ে পেলো বেশ কয়েকবার পরে। বলল, কল বেক কর। ব্যাক কল আসল। মুহূর্তে খালা ছিনিয়ে নিয়ে নিজের ছেলে মেয়েদের কথা আগে জানতে চাইল। সুমনার স্বামী জানাল সবাই এখন রাস্তায়। নিরাপদেই আছে। চোখের সামনে বাড়ী পুড়ছে কিন্তু কিছু করতে পারছে না।
নিজেরা বাঁচবে কি না ঠিক নাই আগে ছেলে মেয়ের খোঁজ সবার আগে। এই না হলে মা। মায়ের অন্তরে বিপদে আপদে সদাই তো কেবল ছেলে মেয়ের চিন্তা আগে।

সুমনার স্বামী ভেবেছিল হাসপাতালে আগুন পৌঁছাবে না। কিন্তু এখন আর সে রকম ভাবা যাচ্ছে না। আগুনের তাপ যেমন বেশী তেমনি বেশী তার গতি। হাসপাতালের দিকেই যাচ্ছে এখন আগুন। কাঠের দোকানে পুরোটাই পুড়ছে। সুমনার স্বামীটি জানাল সে হাসপাতালের দিকেই আসছে। সুমনা তাকে তাদের বন্দী দশা জানানোর আগেই কেটে গেলো লাইন।

নাহিদা নিচে গিয়েছিল। অনেকক্ষণ চিৎকার করল, কে শোনে কার কথা। কিন্তু ভয়াবহ ঘটনাটা সে নিচে থেকে জেনে গেলো। হাসপাতালের এক কোনায় আগুন ধরে গেছে। আগ্রাসী আগুন ঠিকই পেরিয়েছে গেছে ড্রেনের বাধা।


(পাঁচ)
হাসপাতাল নিয়ে যাদের এতক্ষণ মাথা ব্যথা ছিল না তারাও এবার ছুট আসছে। দারোয়ানকেও দেখা যাচ্ছে। দারোয়ান লোকটা তার নিজের সাড়া দেহ তল্লাশি কোরেও কোথাও চাবির গোছাটা খুঁজে পেলো না। সে ছুটছে উদভ্রান্তের মত । হাসপাতালের চারপাশে খুঁজছে চাবির গোছা। কোথাও নেই। তার পাশে এসে হাজির হয়েছে সুমনার স্বামী। হাসপাতালের কর্মীও এসেছে আরও দু একজন। তাদের চোখে আতঙ্ক। তারা দেখতে পাচ্ছে স্পষ্ট। নিচ তলার ভেতর আগুন ঢুকে গেছে।

এতক্ষণের বিস্তর জনগণ বুঝে গেছে এ আগুনের সামনে দাঁড়ানো অনেক কঠিন। কেমিক্যাল কারখানার কারণেই আগুনের এই ভয়াবহতা সে কথা তারা বুঝতে পারছে। বড় রাস্তায় এখন ফায়ার সার্ভিসের সাইরেন শোনা যাচ্ছ। লম্বা পাইপ জোড়া লাগিয়ে লাগিয়ে তারা এগোচ্ছে আগুন নিভাতে।

দারোয়ান কেঁচি গেটের বড় তালা দুটো ভাঙার জন্য একটা লোহার রড যোগারা করে ফেলেছে। কিন্তু গেটের কাছে বেশিক্ষণ এখন আর থাকা যাচ্ছে না নিচ তলার চেয়ার টেবিলে আগুন ধরে গেছে। ধোঁয়া এগিয়ে আসছে। জড়িয়ে ধরতে চাচ্ছে। সাথে বিষণ্ণ এক ঝাঁঝ । দাঁড়ানোই যায় না। সুমনের স্বামীও চেষ্টা করলেন। পারা যাচ্ছে না। হঠাৎ কোথা থেকে নছিবন বিবির ছেলেও ছুটে এসে রড টা ছিনিয়ে নিল। নাকে তার রোমাল বাঁধা। প্রায় ভেঙেই ফেলেছিল তালাটা। কিন্তু তার আগেই সে অজ্ঞান হয়ে পড়ে গেলো।

নছিবন বিবি ছেলের কথা ভাবছিলেন। ছেলের বিপদে নাকি মায়ের মন বুঝতে পারে। হঠাৎ তিনি চিৎকার করে কেঁদে উঠলেন। এই বয়সেও। হয়তো বয়সের অভিজ্ঞতায় ছেলের বিপদে বুঝটা বেশীই হলো।

ইরিনার মোবাইল এখনও নেটওয়ার্ক খুঁজে পেলো না। রাগে ইরিনা মোবাইলটা একটা আছাড়ই দিয়ে দিলো। ভাঙলো না। পেছনের কভারটা কেবল খুলে গেলো। হাতে নিয়ে আর চালুও করতে পারলনা। নিজের উপর রাগ হচ্ছে। মোবাইলটা তাকে দিয়েছিল তার স্বামী। যদি আর ঠিক না হয়? এদিকে পেটের ব্যাথাটাও বেড়েছে। কত সাধের সন্তান তার পেটে। কি হবে? পৃথিবীর মুখ দেখার আগেই কি নেবে বিদায়?? সে ভীত শঙ্কিত হয়। নাকে এখন তাদের ধোঁয়ার গন্ধ আসছে। বিকট কটু গন্ধ। সে গন্ধে মন আরও উচাটন হয় । মার কথা মনে পড়ে। মা কি কোন বিপদে পড়ল ?

আমেনা বেগম কাঁদছে। ভাবছে তার ছেলেটা যে ঘুম কাতুরে স্বভাবের। তার ঘুম ভাঙবে তো? মায়ের মন মানেনা। স্বামীটি তার কি বাড়ির দিকে ছুটে গেছে? নাকি তার জন্য উতলা হয়ে আছেন। কি জানি? নার্স মেয়েটি যেন আমেনা বেগমের মনের কথা ধরে ফেলেছে। বলে উঠল, 'বোমার শব্দে নিশ্চিত সবার ঘুম ভেঙেছে। না হলে অনেকইে ঘরে ঘুমের মধ্যে পুড়ে মরত।'
'ঠিক বলেছো? কিন্তু আমরা জেগে উঠেও বের হব কি করে?'

স্বপ্না রাণী তখনও ঠায় দাড়িয়ে। চোখ ছলছল। হঠাৎ চোখ যায় মসজিদের তিনতলায়। এই করিডর থেকে মসজিদের ছাদের অল্প জায়গাই দেখা যায় কেবল। মাঝের আরেকটা নির্মীয়মাণ বিল্ডিঙের কারণে এর বেশী আরি দেখা যায় না এখন। কে যান ডাকছে? হালকা শব্দ। হ্যাঁ, তাকেই তো ডাকছে। চিনল। আমেনা বেগমের স্বামী একজন। আরেকজন মহিলাকেও তার চেনা চেনা লাগছে। চিনল ভালকরে মিটিমিটিয়ে তাকাতেই। ইরিনা মেয়েটার মা।

(ছয়)
আমেনার স্বামী আর ইরিনার মা, এই দুজন হাসপাতালের গেট বন্ধ দেখে প্রথমে ভেবেছিল সবাইকে হাসপাতাল থেকে বের করে নিরাপদ স্থানে সরিয়ে নেয়া হয়েছে। কিন্তু মোবাইলে যোগাযোগ করতে পারল না। মনের ভয়ও দূর হলো না। বেশ অনেকবার চিৎকার করে ডাকল। কেউ সাড়াও দিল না। হাসপাতালে চেনা জানা কোন চেহারাও ধারে কাছে চোখে পড়ল না তখন।

দুজনে কি করবে ভেবে না পেয়ে মসজিদের দিকে পা বাড়ায়। আমেনার স্বামী নামায পড়তে যায় প্রত্যেক বেলো । সেখান থেকে হাসপাতালটা দেখা যায় এ তথ্য তার জানা। মসজিদেও তিনতলা থেকে অনেক উঁকি ঝুঁকি মেরে তারা হাসপাতালের বারান্দায় আবিষ্কার করে আয়া স্বর্ণা রাণীকে। আশ্বস্ত হয়।

স্বর্ণা রাণী আঙ্গুল উঁচিয়ে দেখায় তারা বেঁচে আছে মোট সাতজন। তারপর আবার সেটা পরিবর্তন করে আঙ্গুল উঁচিয়ে বলে আটজন। দুইদিনের শিশুটিও তো একজন মানুষ। স্বর্ণা রাণী পেছনে ফিরে ইরিনাকে ডাকে। আমেনা বেগমকেও জানায়। সে হঠাৎ চিৎকার করে ওঠে। আমেনা বেগম উঠে আসতে চেষ্টা করেন পারেন না। তাকে ধরে ধরে করিডরে গ্রিলের কাছে নিয়ে আসে নাহিদ। নাহিদের কাঁধে ভর দিয়েও জোড়ে চিৎকার করে ছেলেমেয়েদের খবর জানতে চান। অতদূরে সে আওয়াজ পৌঁছায় না । চারদিকে নিরবচ্ছিন্ন বিভীষিকা আর আগুনের ধ্বংসলীলার শব্দে।

সিঁড়ি দিয়ে আগুনের ধোঁয়া আসতে শুরু করেছে। পোড়া পোড়া গন্ধ। ওষুধ পুড়ছে নিচতলার ছোট ওষুধালয়ে। ধোঁয়ার ঝাঁঝটা হাসপাতালের ভেতর তাই আরও বেড়ে যাচ্ছে।

ভয়ও বাড়তে শুরু করেছে নারী ক'জনার। ওদিকেও শঙ্কিত ভীষণ দূরে মসজিদের ছাদের নিচে দাঁড়ানো দুজন নারী পুরুষ। তারা ভেবে পাচ্ছে না কি করা যায়। মুহূর্তে কিছু না বলেই মসজিদের খোলা কিনারায় এসে নিচে তাকান ইরিনার মা। তার বয়স বড় জোড় পয়তালি্লশ। শক্ত সমর্থ মহিলা। দ্বিতীয়বার বোধহয় ভাবলেন না। এক লাফে পেড়িয়ে গেলেন মাঝের তিন চার ফুট । পাশের বাড়ীটার তিনতলায় এসে আছড়ে পড়লেন। গায়ে গায়ে বাড়ী থাকার সুবিধা এখন ভোগ করলেন তিনি। তার পা একটা কাঠের টুকরোয় লেগে ছিলে গেলো অনেকটা। শাড়ীর নিচের দিকে একটা চিরও ধরল। একজন মা'র কাছে সন্তানের চেয়ে এসব তো ক্ষুদ্র বালু কণা। মার এই আকস্মিত বীরচিত কাজের বিস্মিত ইরিনা চিৎকার করে উঠলো 'মা!'।

আমেন বেগমের স্বামী মহিলার এ সাহস দেখে আর কি দেরী করেন। তিনিও লাফ দিলেন। তারপর দুজনেই তর তর করে সিঁড়ি বেয়ে উঠে গেলেন চারতলায়। সেখানে ক'দিন আগে মাত্র ঢালাই দেয়া হয়েছে। কিন্তু একি! তারা খেয়াল করলেন হাসপাতালের ছাদে একখানা উঁচু দেয়াল । দেয়াল ঘেঁেষ চারতলার ঘর করার ভবিষ্যত পরিকল্পনায় দেয়াল আর বাউন্ডারী একই। প্রায় ১০ ফুট উঁচু। অবশ্য জানালার জন্য কিঞ্চিৎ জায়গা ফাঁকা। কিন্তু সে ফাাঁকা হাতের সীমনার বাইরে। এই নিমীয়মাণ বাড়ীর সীমনা থেকে একটু দূরে। কিন্তু তাতে কি। নির্ভয়ে শাড়ীটার আঁচল কোমড়ে জড়িয়ে ছাদের থেকেই দুটো ইট কুড়িয়ে তার উপর দাঁড়িয়ে হাতটা বাড়িয়ে সেই জানালার মত অংশটার একটা কোণা ধরেই ফেললেন। মেয়ের দিকে তাকানোর একটা চেষ্টা করতে গিয়ে দেখলেন এখান থেকে করিডর অতটা স্পষ্ট না। মেয়ের কথা মনে হতেই যেন সাহসটা আরেকটু বাড়ল। তারপর পা টা একটা খাঁচে বাঁধিয়ের শরীরটা উপরে এলিয়ে দিলেন। একটু হাত ফসকালেই সরাসরি নিচে। কিন্তু তিনি সফল হলেন। উঠে গেলেন হাঁচড়ে পাঁচড়ে। বারবার কেবল ইরিনার মুখটা ভাসছিল তার চোখে। আমেনার স্বামীর মাথায় এ বুদ্ধি বা সাহসই এলো না। ইরিনার মা এখন আর মহিলাই নয় তিনি একজন মা। কেবলই মা। যার একমাত্র সন্তান এখন মৃত্যুর অতি নিকটে। তাকে ফিরিয়ে আনতেই হবে। দৌড়ে ছাদের গেটের দিকে গিয়ে টানলেন। ছাদের গেটও বন্ধ। এবার একটু দীর্ঘশ্বাস ছাড়লেন।

অনেক সময় বিপদেও সময় মাথা কাজ করে না। এটাই সহজ স্বাভাবিক মানসিকতা। কিন্তু এই মুহূর্তে হঠাৎ স্বর্ণার কাজ করলো। ছেলের চিন্তা তাকে এতক্ষন এই চাবিটার কথা মনেই করতে দেয়নি। ছাদের একটা গোপন চাবি নাহিদার কাছে আছে। সে জানে। নাহিদাকে ডাকলো। নাহিদ ছুটে গেলে ছুটে গেলো সিঁড়ির দিকে। চাবি দোতলায় । নার্সদের বসার টেবিলের সাথে নাহিদার নিজের একাট ড্রয়ারে আছে। সেখানে রাখা। কিন্তু কি ভয়াবহ! তার দম আটকে আসছে। নিজ থেকে আরও বেশি করে ধোঁয়া আসছে এখন। আর এগোতেই পারছে না। হঠাৎ পাশে দেখলো সুমনা এসে দাঁিড়য়েছে। বলল, 'কোথায় তোমার ছাদের চাবি কোথায়?'
' ঐ তো ঐ ড্রয়ারে দিদি। কিন্তু পা বাড়ালেই তো দম বন্ধ হয়ে আসছে। '
সে কথা শোনার আগেই সেই অসুস্থ দেহে সুমনা ছুটে গেলো। এবং সত্যি এক দৌড়েই সে পুরো ড্রয়ারটাই খূলে নিযে আসলো। সত্যি আনলো। তারপর ঢলে পড়লো । তাকে ধরে ফেলল নাহিদা। জ্ঞান হারাবার আগে শেষ একটা কথা বলে গেলো,'নাহিদা আমার মামণিকে বাঁিচও।'
স্বর্ণা রাণী ছুটে এল। দু'জন মিলে তাকে কোলে করে উপরে নিয়ে গেলো। মাথায় মুখে পানি ছিটাতেই তার জ্ঞান ফিরে আসতে দেরী হলো না। জ্ঞান ফিরে পেয়েই তার প্রথম জিজ্ঞাসা 'কোথায় আমার মামণি, কোথায়?'
খালা সুমনার কোলে বাচ্চাটাকে দিয়ে বলল, খাওয়া , মেযেটার খিদে পেয়েছে। কাঁদছে। খালার কোল থেকে ছোঁ মেরে তুলে নিল সুমনা। ঠিক পাখির মত। মেয়েটাকে বুকের দুখ খাওয়াতে খাওয়াতেই সে অন্যদের সাথে ধীরে ধীরে এগোলো ছাদে। নাহিদ আমেনা বেগমকে ধরে ধরে সিড়ি পর্যন্ত নিয়ে এল। কিন্ত নছিবন বিবিকে কিভাবে আনবে? কে আনবে?
নাহিদ আর স্বর্ণা তাকে কোলে করে আনতে চাইল । সে রাজী হলো না। বলল,'আমি এখানেই থাকি, কেবল পারলে আমার ছেলেটার কোন খোজ জানায় দে যাইও।'
সে নড়লই না।
বাকীরা এখন সবাই ছাদে পৌঁছে গেছে। ইরিনাকে তার মা জড়িয়ে ধরে রেখেছে। ছাড়ছেনই না।



(সাত)
ইরিনার মা ছাদ থেকে ছাদে যাবার অবিশ্বাস্য কাজটি নিচ থেকে অনেকেরই চোখে পড়ে। চোখে থেকে মুখে মুখে ছড়াতেই সে কথা চলে আসে সুমনার স্বামী , দড়োয়ান সবার কানে। নছিমন বিবির ছেলের মুখে পানি ছিটানো হচ্ছিল। ছাদ দিয়ে বের হয়ে হাবর কথা শুনে সেও যেন জ্ঞান ফিরে পেলো। ফায়ার সার্ভিস এর লোকজন তখন আগুন নিভানোর প্রস্তুতি নিচ্ছে।

ছাদের উপর একদল নারী। উপরে তখন কালো ধোয়ার চাঁদর। এপাশ থেকে ওপাশে ছুটছে আগুনের প্রেতাত্মা। এক বিভৎস পরিবেশ। কেমন শিউরে ওঠার মত। ছাদের পূর্ব কিনারে যাওয়াই যাচ্ছেনা। প্রচন্ড তাপের আঁচ। গা দিয়ে সবার ঘাম ঝরছে। সেটা ভয় এবং কষ্ট দুয়ের কারনেই।

স্বর্ণার মন তবুও উঁকি দিতে চাচ্ছে বারবার। ভীষণ তাপের সাথে সেই ঝাঁঝও তো আছে। আগুনের লাল শিখা উঠে গেছে অনেক উপরে আকাশে। তার চারাপাশে ঘন কালো অন্ধাকার যেন মৃত্যুর ডাক। কত জন মরল কে জানে?

এখনও এতজন নারীর মনের আতঙ্ক কাটে নি। নামবে কি করে? ছয় জন মা। সবার মনে সন্তানের চিন্তা। নামার চেয়ে সন্তানের খবর নিতেই বেশেী ব্যস্ত। ওদিকে নিচে তখনও একা বিছানায় কাতরাচ্ছেন নছিবন বিবি।
নাহিদা নছিবন বিবির ছেলের খবর জানাার সাথে সাথে নিচে নেম যায় আবার। সেখানে একা আল্লাহর নাম নিচ্ছেন নছিবন। তিনি ধরেই নিয়েছেন তিনি মরতে যাচ্ছেন। এই সময় ছেলের খবর শুনে তিনি শান্তির নিঃশ্বাস নিলেন। নাহিদা বলল ছেলেকে দেখতে হলে আপনাকে তো উপরে যেতেই হবে। তিনি এবার উঠলেন । খুঁড়িয়ে খুঁড়িয়ে নাহিদার গায়ে ভর কর তিনিও চলে এলেন ছাদে। আগুনের শিখা মুহুর্তে তার মনে মৃতু্য আতঙ্ক সঞ্চার করল।

সুমনা এক দৌড়ে নিচে নেমে গেলো আবার । বিছানার চাদর নিয়ে এলো দুটো। সুমনার গায়ে এখন অসম সহ্য ক্ষমতা। প্রসবের সকল যন্ত্রনা সে মুহু মুহু ভুলে যাচ্ছে। কেবল সন্তানকে বাঁচানোর চিন্তাই এখন তার একমাত্র মুখ্য এবং প্রানন্তকর কাজ দুনিয়ায়।

সুমনার স্বামী, দাড়োয়ান, নছিমনের ছেলে এবং আরও কয়েকজন মিলে পাশের নির্মীয়মাণ বাড়ীটার ঢোকার অস্থায়ী দূর্বল গেটটা এক রকম ভেঙেই ভেতরে ঢুকলো। মুহূর্তে উঠে গেলো উপরে। ছাদে। স্বামীকে দেখে সুমনার সাহস যেন বেড়ে গেলো আরও বহুগুণ। চাদরটাকে দোলনার মত করে তাতে সন্তানকে বেঁধে নামিয়ে দিল জঠর ছেড়া সন্তানকে স্বামীর কাছে। এখন সে মুক্ত । এখন সে হাপাচ্ছে। নিজের মনের শান্তি ফিরে পাচ্ছে তবুও। মেয়েটাতো বাঁচল। আগুনের শিখা হাসপাতালকে এখন আরও বেশী করে জাপটে ধরছে। ছাদের উপেরও আঁচ আসছে। ঝাঁঝের পরিমাণ কমে এসেছে । তবুও দম নেয়াটা আসলেই কষ্টের এখানে। সব অঙ্েিজন যেন গিলে খেয়েছে আগুন। কিভাবে অসুস্থ মানুষগুলো নিচে নামকে কেউ বুঝতে পারছে না। মুক্তির এত কাছে এসেও তারা আটকে আছে। একবার মনে মনে ভাবে সবাই লাফ দিয়ে দেবে নাকি? তারপর দেয় না।

ইরিনার সেই সাহসী মা ইরিনা কে পাওয়ার পর আর সাহসী নেই। এখন যেন দুর্বল কোমল মা। এখন মেয়ের সেবায় ব্যস্ত। মেয়ের মাথায়, গায় পেটে হাত বুলিয়ে দিচ্ছেন। বার বার জানতে চাচ্ছেন পেটের ব্যাথা কমতো?
ওদিকে সবাই ভাবছে কেবল কিভাবে নামবে নিচে?

দাড়োয়ানটা অনেক খুঁজে একটা ভাঙা মইয়ের মত কিছু খুঁজে আনল। এক বাঁশের মই। তাও কয়েকটা কাঠ নড়বড়ে । এই দিয়ে ঐ দূর্বল সন্তানের প্রেমে মত্ত নারীগুলো নামকে কি করে?
কিন্তু না মৃতু্য যখন দুয়ারে, মনে যখন সন্তানের চিন্তা আর প্রাণে যখন বাঁচার আশা তখন অনেক অসাধ্যই সাধ্য করা যায়। স্বর্ণা রাণী আর নাহিদা খুব সহজেই সেই এক বাঁশের মই বেয়ে নিচে নেমে এল। দড়োয়ানের উপর সবাই যে আক্রোশটা জমিয়ে রেখেছিল। সেটা আর বহিঃপ্রকাশ করা হলো না। সে বেচারা অন্তত একটা মইতো জোগাড় করেছে। দাড়োয়ান হঠাৎ সেই মই বেয়ে নিজেই উপরে হাসপাতালে ছাদে উঠে গেলো। নিচ থেকে নবজাতক কে নামানো বিছানোগুলো ফেরত চাইলো।

সেই বিছানা দিয়ে বেঁধে সেই প্রথমে নামাল নছিবন বিবিকে। তারপর আমেনা বিবিকে। ইরিনা আর তার মা দাড়োয়ানের হাত ধরে অনেক কষ্টে নিচে নামল। সুমনার কষ্ট হচ্ছিল। টলছিল। তার আগেই সে লাফ দিলো। পা টা সম্ভবত মচকে গেলো। তবুও সে তাকিয়ে আছে স্বামীর কোলে মেয়ের দিকে। ওখানেই যেন তার সব আনন্দ। পায়ে ব্যাথা করছে , ফুলে উঠেছে কিছুটা। সেগুলো তো সেকেন্ডারী বিষয়। মূল বিষয় মেয়েটা এখন বিপদ মুক্ত। সুমনার খালা শাশুড়ীকে নিয়ে সবার শেষে নামলো দাড়োয়ান। দাড়োয়ানের ভুল এখন পূর্ণ ক্ষমা যোগ্য হয়ে গেলো।

হাসপাতালে বন্দী ক'জন যখন ছাদে উপর থেকে পাশের বিল্ডিং দিয়ে নেমে নিচে রাস্তায় চলে এল ততক্ষণে হাসপাতালের পুরোটাই ধোঁয়ার ছেয়ে গেছে। ফায়ার সার্ভিসের লোকজন হাসপাতালের আগুন নিভানোর সর্বাত্মক চেষ্টা করে চলেছে। ওদিকে যা পুড়েছে যা গেছে তো গেছে, দেখা যাক হাসপাতালটা বাঁচে কিনা। মৃতু্য ধোঁয়ার ঝাঁঝ ও কমে এসেছে অনেক। হতো সব ক্যামিক্যাল আর ওষুধ এতক্ষণে পুরে শেষে।


(পরিশিষ্ট)
নছিবন বিবি নিচে নামলেন ছেলের কোলে চড়ে। তিনি ছেলের গলা জড়িয়ে ধরেই আছেন। নিচে নেমে ছেলে যখন কোল থেকে নামাতে গেলো। বুড়ি আর নামলোই না। এ তার শান্তির ঘুম। এ চিরতরের। সেই বুড়ি আর জাগলেন না কোনদিন। এক পরম শান্তিতে ছেলের গলা জড়িয়ে ত্যাগ করলো সে ইহধাম।

বুড়ির মৃতু্যতে সাতজন মায়ের বাকী ছয়জনের সবার চোখে জল এল। জল এল হয়তো অনাগত কোন একদিনের মা আজকের তরুনী নার্স নাহিদার চোখেও। এই তো কিছুক্ষণ আগেও সবাই এক সাথে ছিল। বুড়িটা এখন আর নেই। সুমনার খালা শাশুড়ী চোখ মুতে মুছতে ছুটে গেলেনে নিজের পরিবারের খোঁজে। আমেনা বেগম স্বামীর কাছ থেকে জানলেন ছেলে মেয়েরা নিরাপদেই আছে। কথা হয়েছে। ওদিকে আগুন ছড়ায়নি। চারদিক থেকে পানি ছিটিয়ে সেদিকের আগুন থামানো হয়েছে। আমেনা বেগমের মুখে এতক্ষণ পর হাসি ফুটল।

হাসপাতালের সাদা বিছানাটা মাটিতে পড়ে আছে। স্বর্ণা রাণী নছিবণ বিবির গায়ে সাদা বিছানাটা উঠিয়ে ঢেকে দিল। তারপর সে তাকিয়ে থাকল আগুনের দিকে। আগুনের শিখা এখন আর অনেক উপরে উঠছেনা। কিন্তু জ্বলছে, পুড়ছে । হয়তো পুড়ছে এখনও তার ছেলেটাও। সে এক দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকে। চোখের কোণ বেয়ে নেমে আসে জল। ঐ তো তার ছেলে, ঐ তো ছুটে আসছে। আগুণের ভেতর থেকে যেন বেড়িয়ে এল। সে কি চোখে ভুল দেখেছে? কি মিষ্টি মুখ ছেলেটার। কোন নষ্ট যুবকের ছাপ নেই সেখানে। তার ছেলে যেন আগুনে পুড়ে পূত পবিত্র হয়ে ফিরে আসছে তার দিকে।

'সরেন সরেন, জায়গা দিন'- ফায়ার সার্ভিসের লোকগুলো চিৎকার করতে থাকে। সেই সাত জন মা, তাদের একজন মৃত, সেই আটজন বন্দী নারী এখন নিজেদের আপন জগতে বিচরণ করছে। শুধুই নিজের জগতে। যেখানে নিজের স্বামী সন্তান কিংবা প্রেমিক। সেখানে আর কেউ নেই। মরণের অপারে যে গেছে সেও হয়তো শান্তিতে আছে। জেনে তো গেলো ছেলেটার খবর।

কিন্তু স্বর্ণার কান্না থামছেই না। সে এক কোনে বসে একাকী চোখের জল ফেলছে। তার যে আর কেউই রইল না। একটু আগেই কানে কানে ভীড়ের মধ্যে পরিচতি কে যেন বলে গেলো, 'খালা তোমার পোলাডারে রাইতে গাঞ্জা গলিতে ঢুকবার দেখছিলাম।'
আপনার ভালো লাগা ও মন্দ লাগা জানিয়ে লেখককে অনুপ্রানিত করুন
মোঃ আল-মামুন শেখ আমার ভত্তি কাজে লেগেছে অভিনন্দন বিজয়ী ভাই ।
গুলতি বাবু বড় ভাই (মামুন ম. আজিজ) ছোডু মুকে এককান বড় কতা কই, আফনে সবার গল্প-কবিতা পড়েন বালা কতা। কমেন্ট করেন ওইডাও জব্বর অয়। কিন্তু আফনে হুট-হাট কইরা অনেকের লেহায় এমুন মন্তুব্য করেন, উনি নাকি এই সাইটের সেরা লেখক ইত্যাদি ইত্যাদি। আবার অন্যহানে দেকতে পাই আফনে এ সংকার সম্ভাব্য কয়েকটি অতি বালা লেকা বলে মন্তুব্য করলেন। যেগুলা আফনের কাচে বালা লাকছে, সেগুলার নাম ও লেককের নামও প্রকাশ করচেন। আফনে যদি রেজাল্ট ঘোষণার আগে এমুন কতা বলেন, মন্তুব্য করেন তাইলে এই কতাগুলোরও একটা প্রতিক্রিয়া অয়। অন্যরাও না বুইজা সেগুলারে আচ্চামত ভোট দিতে পারে। অর্থাত আফনের কথায় কিছু কিছু লেকার বেশ প্রচার-পাবলিসিটি অইতাছে। অন্য লেখকরা কিন্তু এখানে মাইর খাইতাছে। এচাড়াও ন্যায়সঙ্গত কতা অইছে, আফনেরে রেজাল্ট ঘুষুনার আগে এমুন লেখা জরিপের কাজ বা দায়িত্ব কেডা দিছে হেইডাও আমাগো জানার অদিকার আচে। করতিপকখ কি এমুন দায়িত্ব আফনের দিছে? যদি না দিয়া তাকে, তাইলে অনধিকার চর্চার কি দরকার। সুতরাং সাধু সাবধান! ছোড ভাইয়েয় কতায় মাইন্ড করবেন না। মুরুক্কু মানুষ আমি। ভুল-ভাল অইয়া যায়। অল্পবিদ্যা তো! তাই ডেঞ্জারাস মনে অইতে পারে। এগুলান বয়সের দোষ আরকি!
মিজানুর রহমান রানা লেখক কিন্তু তার চরিত্রগুলোর মনের কথা অর্থাৎ একটি চরিত্র মনে মনে কি ভাবছে তা অবিরত বর্ননা দিয়ে যায়। অথচ মনের কথা কিন্তু কারও বোঝার কথা নয়। লেখক তার গল্পের স্রষ্টা বলেই সৃষ্ট চরিত্রগুলোর মনের কথা বুঝতে পারেন।---------যুক্তিসম্পন্ন কথা। আমি সাপোর্ট করছি।
মামুন ম. আজিজ সকল কে এই ক্ষুদ্র বিজয়ে সহায়তা করার জন্য আন্তরিক ধন্যবাদ জ্ঞাপন করছি।
দীপক সাহা বিজয়ী হবার জন্য অভিনন্দন। আবার বিজয়ী হিসাবে দেখতে চাই।
আহমেদ সাবের আপনাকে অভিনন্দন।
ঝরা পারফেক্ট আপনি প্রথম হওয়ার যোগ্য
উপকুল দেহলভি মহান আল্লাহর সর্ব্বোচ্চ প্রশংসা বর্ণনা করিতেছি, যিনি আসমান ও যমিনের সৃষ্টিকর্তা। যার হাতে আমার জীবন মরণ। অভিনন্দন বন্ধু। খুব আনন্দিত হলাম আমার ভোট খানি কাজে লেগেছে।

০১ ফেব্রুয়ারী - ২০১১ গল্প/কবিতা: ৭৮ টি

বিজ্ঞপ্তি

এই লেখাটি গল্পকবিতা কর্তৃপক্ষের আংশিক অথবা কোন সম্পাদনা ছাড়াই প্রকাশিত এবং গল্পকবিতা কর্তৃপক্ষ এই লেখার বিষয়বস্তু, মন্তব্য অথবা পরিণতির ব্যাপারে দায়ী থাকবে না। লেখকই সব দায়ভার বহন করতে বাধ্য থাকবে।

প্রতি মাসেই পুরস্কার

বিচারক ও পাঠকদের ভোটে সেরা ৩টি গল্প ও ৩টি কবিতা পুরস্কার পাবে।

লেখা প্রতিযোগিতায় আপনিও লিখুন

  • প্রথম পুরস্কার ১৫০০ টাকার প্রাইজ বন্ড এবং সনদপত্র।
  • দ্বিতীয় পুরস্কার ১০০০ টাকার প্রাইজ বন্ড এবং সনদপত্র।
  • তৃতীয় পুরস্কার সনদপত্র।

আগামী সংখ্যার বিষয়

গল্পের বিষয় "ছোটবেলা”
কবিতার বিষয় "ছোটবেলা”
লেখা জমা দেওয়ার শেষ তারিখ ২৫ ডিসেম্বর,২০২৪