তখন বিকেলের সূর্যটা দিগন্তের কাছে একটা লাল বলের মতো ঝুলছিল। রাখাল ছেলে সবেমাত্র ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা গরুগুলোকে জড়ো করছে। মাঠে বেশ কয়েকটা ছেলে ছুটোছুটি খেলছে। সূর্যের সোনালি আলোকছটা ছোট্ট নদীটার বুকে ঢেউ খেলছে। শিমুলতলীর ছোট বড় সবার মনে ভয় জমাট বেঁধেছে। উঠতি বয়সের ছেলেগুলো রাতের আঁধারে না বলে কয়ে বাড়ি ছেড়ে চলে যাচ্ছে। কেউবা বাবা- মার সম্মতিতে যোগ দিচ্ছে যুদ্ধে। সূর্যটা ডুবে যেতেই শিমুলতলীতে অন্ধকার নেমে এলো।
মানিক অল্পক্ষণ আগে মোল্লাবাড়ি থেকে ফিরেছে। এরমধ্যে তার মা মেহেরজানও ফিরেছে। মেহেরজান রোগে- শোকে পঞ্চাশ ছুঁই ছুঁই এক বৃদ্ধা। মাথার চুলে পাক ধরেছে। মুখের চামড়ায় ভাঁজ পড়েছে।
চুলোর পাড় থেকে তিনি ছেলেকে ডেকে বললেন, মানিক খবর কি কিছু শুনেছিস?
: কি খবর মা?
: ওই যে শহরে বলে যুদ্ধ বাঁধিছে। মানুস নাহি গরু ছাগলের নাহান মারতিছে। সগলে গেরামে চইলে আসতিছে।
: তা শুনিছি মা।
মানিকের কথা শেষ না হতেই বাইরে থেকে কে যেন মানিকের নাম ধরে ডেকে ওঠে।
: মানিক ও মানিক।
: কিডারে?
: আমি শহিদ।
মানিক ঘর থেকে বেরিয়ে আসে। ঘর বলতে গোলপাতার ছাওয়া পাট খড়ির একটা দো-চালা। যার ভেতর অনায়াসে বাতাস আসা যাওয়া করতে পারে। এই ঘরটাই হাসমত আলি গতবার রেখে গেছে। গতবার বৃষ্টির দিনে পুকিয়ার বিলে মাছ মারতে গিয়েছিল হাসমত। এভাবে সে প্রায় যায়। তবে গতবার একরাত্রিতে মাছ মারতে গিয়ে হাসমত আর ফিরে আসেনি। সবাই বলে ভূতে নাকি মেরে লাশ কোথাও পুঁতে রেখে গেছে। অবশ্য লাশ কেউ খুঁজে পায়নি। আবার অনেকে বলে মাতবরের সাথে জমিজমা নিয়ে ঝামেলা আছে তাই মাতবর মাইরে লাশ গুম কইরে ফেলাইছে। সে এক আজগুবি কাহিনিই হয়ে গেছে। কেউ এর সঠিক রহস্য ভেদ করতে পারেনি।
: কিরে শহিদ খবর কি?
: শিমুলতলীর স্কুলের মাঠে মিলিটারি আইছে। গেরাম ছাইরে সব পালাতিছে। আমাগো মতন ছাওয়ালরে ধইরে নিয়ে যাতিছে। মোহন ভাইরা যুদ্ধে যাতিছে। আইজই যাতি হবি, তুই যদি চাস তয় যাতি পারিস।
: যাব না মানে ! আমিও যুদ্ধে যাব। তুই দাঁড়া, আমি মাক কয়া আসি।
মানিক আবার ঘরে ঢোকে। ঘরে ঢুকেই সে মায়ের মুখোমুখি হয়।
: কিডারে মানিক?
: মা শহিদ আয়ছে। ওরা সবাই যুদ্ধে যাতিছে, আমিও যাব মা।
: নারে মানিক তোক আমি যাতি দেব না। তোক ছাড়া আমি থাকতি পারব নারে বাপ।
: মা মিলিটারিরা কুত্তার মতন মানুষ মারতিছে আর আমরা চুপ মাইরে বইসে থাকপ মা, ইডা কেমন কইরে হয় মা?
: তাও বাপ, তুই যাইসনে।
: না মা, তুমি আমাক মানা কইরো না। আমি যুদ্ধি যাবই কলাম। তোমার জন্যি ঝলমলে একখান সূর্য আর সবুজ দেশ নিয়ে আসপ মা। লক্ষী মা আমার মানা কইরো না।
মানিক বেরিয়ে আসার আগে মাকে সালাম করে। মা মানিকের মাথায় হাত বুলিয়ে বলেন, তোর আশা য্যান পুর্ণি হয় বাপ। তোর আশা য্যান পুর্ণি হয়।
মানিক বেরিয়ে আসে। ময়লা লুঙ্গিটা এক ভাঁজ করে উরুর উপর গিঁট মারে। মা পেছনে দাঁড়িয়ে থাকেন। দু চোখের জলে মায়ের সারা মুখ প্লাবিত হয়। একবার তিনি মানিকের নাম ধরে ডেকে ওঠেন। কিন্তু মানিক ততক্ষণে আঁধারে মিশে গেছে। রাতের অন্ধকারের ভেতর মানিক আর শহিদ যেন হঠাৎ তলিয়ে যায়।
মেহেরজান চোখের জলে বুক ভাসান। একমাত্র ছেলে যুদ্ধে চলে গেল। যদি যুদ্ধ থেকে আর না ফিরে! মেহেরজান এই ভেবে কাঁদতে থাকেন। বুকের ভেতর ছলকে ছলকে ওঠে অদম্য এক কষ্টের বল।
আকাশের সীমানায় লাল আগুনের গোলার মত গুলির ফুলঝুরি ঝরতে থাকে। কালচে নীল আকাশটায় হাজার তারা যেন বোবা কান্নায় ফেটে পড়েছে। নদীর পানি কালো একটা হাঙ্গরের মত বিশাল হা করে থাকে। ছোট একটা নৌকা। ওরা পাঁচ জন। মানিক, শহিদ, রতন মোহন ও ফটিক। নৌকার পাটাতনে এরা চুপচাপ বসে থাকে। তাকিয়ে থাকে আঁধারের শরীরের দিকে। নদীর কল কল ছল ছল ছলাৎ শব্দে ওদের বুকের পাটা ফুলে ওঠে।
একরাতে শিমুলতলী গ্রাম উজার হয়ে যায়। আগুনের লেলিহান শিখায় সব পুড়ে ছারখার হয়ে যায়। ঘুমের ঘোরে অনেকেই আগুনের খাদ্য হয়েছে। তারমধ্যে বয়েসি বুড়ো লোক, ছোট শিশু, মা আর গবাদি পশু। সব পুড়ে কালো কয়লা হয়ে যায়। মতলব আলি ব্যাপারির সহায়তায় অনেকেই মিলিটারিদের হাতে ধরা পড়ে। আর ধরা পড়া মানে অমানুষিক নির্যাতনের পরে মৃতু্য।
আর এদিকে মেহেরজান শুধু চোখের জল ফেলেন। কেঁদে কেঁদে বলেন, আল্লারে আমার ছাওয়ালরে ঘরে ফিরায়ে দাও। যাকে দেখেন তাকেই মানিকের কথা জিজ্ঞেস করেন।
এক সময় যুদ্ধ শেষ হয়, একে একে সবাই ফিরতে শুরু করে। এক সূর্য ফোটা সকালে শহিদ, রতন, ফটিক ওরা ফিরে আসে। ওদের হাতে স্বাধীন দেশের পতাকা পত পত করে ওড়ে। মেহেরজান খবর পেয়ে ছুটে যান ওদের কাছে। তখন সূর্যটা বেশ আলো ছড়াচ্ছে। চারদিকে আলোয় উদ্ভাসিত বিজয়ের গান নরম বাতাসে দোল খাচ্ছে। মানুষ ছুটোছুটি করে আনন্দে। কেউবা প্রিয়জনের লাশের ব্যবস্থা করতে ছোটে আর ছোটে।
রতন, শহিদ ও মোহন বসে কথা বলছিল। এমন সময় মেহেরজান, এসে পেঁৗছলেন সেখানে।
: ও রতন, ও শহিদ ও মোহন, বাজানরা ফিরে আয়ছো।
ওরা সবাই মেহেরজানের কথায় মুখ ফিরে তাকায়। দেখে যে আর কেউ নয় মানিকের মা। ওরা মুখের কথা হারিয়ে ফেলে। নিস্তব্ধতা নেমে আসে ওদের চোখে মুখে। বেশ কিছুক্ষণ পরে শহিদ মুখ খোলে।
: হ খালা, আয়ছি।
: তা মানিকরে দেকতি পাতিছি না যে! মানিক কোনে?
এ কথার জবাব ওরা কেউ দেয় না। শুধু চুপ করে দাঁড়িয়ে থাকে।
: ও বাজানরা কথা কইচ্ছো না ক্যা? আমার মানিক কোনে রতন?
এরপর আর চুপ থাকতে পারে না ওরা। মেহেরজানের কাছে রক্তমাখা একটা শার্ট বের করে দেয়।
: ও খালা এই শার্টখেন পইরে তুমার মানিক যুদ্ধ করিছে। মুক্তিযুদ্ধ করিছে খালা মুক্তিযুদ্ধ।
মেহেরজান রক্তমাখা কিছুক্ষণ তাকিয়ে থাকেন। তারপর চিৎকার দিয়ে বলেন, ও আমার মানিকরে, বাপরে তুই ফিরে আয়রে বাপ।
: ও খালা কাইন্দ না। অনেক মানিকই তো চইলে গেছে, ওদের রক্তের দাম দিয়েই তো স্বাধীনতা আইছে।
: ওরে আমার মানিকরে, ফিরে আয়রে বাপ, আরেকবার ফিরে আয়।
: ও খালা কাইন্দ না। তোমার মানিকের রক্তের বিনিময়ে এই দেশ আইছে। শত্রু নিপাত গেছে।
এবার শহিদ এগিয়ে আসে। বলে, ও খালা কাইন্দ না। তোমার মানিকের রক্তেই তো ওই আকাশের সূর্য ফুটিছে। আর তার জন্যিইতো আমরা সবাই লড়াই করিছি।
মেহেরজান ওদের কারো কথাই শুনলেন না। রক্তমাখা জামাটা বুকে জড়িয়ে বাড়ির দিকে পা বাড়ালেন। সূর্যটা তখন নীল আকাশে কিরণ ছড়িয়ে যাচ্ছে। আর হাওয়ায় বিজয়ের আনন্দে মুখরিত হয়েছে জনপদ।
১৩ জুলাই - ২০১১
গল্প/কবিতা:
১০ টি
বিজ্ঞপ্তি
এই লেখাটি গল্পকবিতা কর্তৃপক্ষের আংশিক অথবা কোন সম্পাদনা ছাড়াই প্রকাশিত এবং গল্পকবিতা কর্তৃপক্ষ এই লেখার বিষয়বস্তু, মন্তব্য অথবা পরিণতির ব্যাপারে দায়ী থাকবে না। লেখকই সব দায়ভার বহন করতে বাধ্য থাকবে।
প্রতি মাসেই পুরস্কার
বিচারক ও পাঠকদের ভোটে সেরা ৩টি গল্প ও ৩টি কবিতা পুরস্কার পাবে।
লেখা প্রতিযোগিতায় আপনিও লিখুন
-
প্রথম পুরস্কার ১৫০০ টাকার
প্রাইজ বন্ড এবং সনদপত্র।
-
দ্বিতীয় পুরস্কার ১০০০ টাকার
প্রাইজ বন্ড এবং সনদপত্র।
-
তৃতীয় পুরস্কার সনদপত্র।
আগামী সংখ্যার বিষয়
লেখা জমা দেওয়ার শেষ তারিখ ২৫ নভেম্বর,২০২৪