১.........
বর্ষা __________এই শব্দটা আমার জীবনে এমন ভাবে জড়িয়ে আছে যে আমি চাইলেও বৃষ্টি জিনিষটাকে ঊপেক্ষা করতে পারিনা।
আমার জীবনটাই বুঝি একটা বর্ষাস্নাত জীবন। বর্ষার সাথে আমার সখ্যতা সেই ছোটবেলা থেকেই। জানালা দিয়ে বৃষ্টি দেখে দেখে কবিতা লিখতাম।প্রথম কবিতার নাম _______ সেটাও -‘বর্ষা’। যতই দিন যায়, বর্ষার সাথে সখ্যতা আমার বাড়তেই থাকে। আজও মনে পরে বৃষ্টির দিনে স্কুলে যাওয়ার সময় ছাতা থাকা স্বত্তেও বৃষ্টিতে ভিজতাম। রাস্তায় জমে থাকা পানি ছিটাটাম। শুধু তাইনা, আমার জীবনের অনেক গুরুত্বপূর্ণ দিন ছিল বৃষ্টির দিন।
সবগুলো এখানে বলে শেষ করা যাবেনা।
বর্ষা_________ হায় বর্ষা,কতবার কতভাবে ভেজালে আমায়। তবু সাধ মেটেনা।
২.........
তার সাথে আমার প্রথম পরিচয় বর্ষাকালে। প্রতিদিন বৃষ্টিতে কাকভেজা হয়ে ক্যাম্পাসে যেতাম। বৃষ্টি ভেজা এমনই দিনে তার সাথে কথা ___ প্রথমদিন দু একটা,তারপর হাজার_____ লক্ষ______ কোটি___________ আমাদের কথা বর্ষার বৃষ্টির মতই দ্রুত বাড়তে থাকে। সে সবার প্রথমে আমাকে যে গানটা শুনতে দিয়েছিল সেটা হল – “আজ এই আকাশ কালো হয়ে বৃষ্টি ঝড়ে তোকেই ধরে ......”।সারাদিন এই গানটাই শুনতাম।তখনও বুঝিনি সে আমার জীবনে কি!বুঝতে পারলাম যখন সে দূরে গেলে প্রথম বারের মত। তার সাথে আমার বন্ধুত্বের ২ মাসের মাথাতেই ক্যাম্পাস বন্ধ হয়ে গেল,এক মাসের বর্ষাকালীন ছুটি।
মনে পড়ে শেষদিন আকাশ ভেঙে বৃষ্টি নেমেছিল।সে ব্যাগ নিয়ে শাটল ট্রেনে উঠল বাড়ি যাবে বলে।আমরা একসাথে বৃষ্টিতে ভিজে স্টেশনে নামলাম।রিকশায় উঠলাম দুজন।তাকে বাস স্টেশনে নামিয়ে দিয়ে আমি বাসায় ফিরে এলাম।নামার সময় সে যখন আমায় বলল,”বাই,ভাল থাকিস”,তখন বুকটা ধক করে উঠল।মনে হল আমার ভেতরের কোন অংশ তার সাথে চলে যাচ্ছে। পরে বুঝতে পেরেছিলাম সেটা ছিল মন, আমার মন।কখন যে তা ওই মানুষটার দখলে চলে গিয়েছিল আমি টের পাইনি সামান্য টুকু।টের পেলাম আরও কিছুদিন পর,যখন সে তার বাড়িতে আর আমি আমার বাড়িতে,আর আমাদের সঙ্গী ঝুম বর্ষা। বৃষ্টি দেখলেই তার চলে যাওয়ার মুখটা ভেসে ওঠে মনের পর্দায়, বৃষ্টির শব্দের ভেতর তার সেই হাসির শব্দ শুনতে পাই। কি হল আমার !!!_____________কি হল ???ভাবতে ভাবতেই জবাব এলো______”ভালবাসা”। সেই আমার প্রথম বর্ষাস্নাত ভালবাসা। তখন প্রতিদিন ঝমঝমিয়ে বৃষ্টি নামত আর আমি তার দেয়া গানটি শুনে শুনে তার কথাই ভাবতাম---“আজ এই আকাশ কালো হয়ে বৃষ্টি ঝড়ে তোকেই ধরে ......ছন্নছাড়া হয়ে আমি খুঁজি তোরে আপন মনে.........।“
বৃষ্টি ভালবাসতাম খুব,তারচেয়েও বেশি ভালবেসে ফেললাম তাকে। কিন্তু বলতে সাহস করিনি কখনো।
বৃষ্টির তালে তালে আমাদের বন্ধুত্বও বেড়ে যেতে থাকল, মেঘের সীমানা ছুঁয়ে আমরাও ভেসে যেতে লাগলাম। এরপর পাঁচটি বর্ষা কেটেছে তার সাথে। প্রতিবার বাড়ি যাওয়ার সময় বৃষ্টিতে ভিজে আমি তাকে স্টেশনে দিয়ে আসতাম। সে আমার মাথায় হাত রেখে আলতো করে হেসে বলতও,”ভাল থাকিস।” ভাগ্যিস বৃষ্টির জন্য আমার চোখের জল সে দেখতে পেতনা। তাই বুঝতনা আমার ভালবাসা টুকুও। আমার ভালবাসা হয়ত বৃষ্টির মতই ঝাপসা ছিল,তাই সে টের পায়নি।
৩.........
এমনিভাবে পাঁচ বছর পর এলো আরেক বর্ষা,এল আমার জীবনের মোড় ঘুরিয়ে দেয়া আরেকটা বৃষ্টি ভেজা দিন।সেদিন ছিল আমাদের ক্যাম্পাসের শেষ দিন। সেদিন শেষবারের মত বৃষ্টিতে ভিজে তাকে বিদায় দিয়েছিলাম স্টেশনে। বৃষ্টিটাও বোধহয় খুব বেশি ছিল সেদিন।আকাশের কান্না,আমার কান্না,তার কান্না............সব মিলেমিশে একাকার।সে আমার চোখের দিকে তাকাল,শেষবারের মত মাথায় হাত রেখে বলল,”ভাল থাকিস”। কেন সে বুঝলনা তাকে ছাড়া ভাল থাকা আমার পক্ষে সম্ভব না !!! কেন আমাকে ফেলে চলে গেল এভাবে !!! আজও সেই দৃশ্য আমার চোখে ভাসে,আমি ঝুম বৃষ্টিতে দাঁড়িয়ে তার চলে যাওয়া পথের পানে চেয়ে ছিলাম।সে চলে গেল,দূরে......আরও দূরে।মনে হল বৃষ্টির ভেতর হঠাৎ করে হারিয়ে গেল সে,মিলিয়ে গেল চোখের পলকে। আমি একা হয়ে গেলাম ,বড্ড একা। সঙ্গী হয়ে রইল আজীবনের সঙ্গী বর্ষা, আর তার দিয়ে যাওয়া সেই গান __________ ”মেঘে মেঘে কত বেলা কেটে যায় শুধু,বিষাদের ভেলায়......,
তুই ছাড়া একা একা দিন কাটেনা, স্মৃতির ছাঁয়ায়।
তুই রবি আমারি, তুই ছবি আমারি,
তোরে ছাড়া বাঁচি আমি কেমনে.........
আজ এই আকাশ কালো হয়ে বৃষ্টি ঝড়ে তোকেই ধরে ......
ছন্নছাড়া হয়ে আমি খুঁজি তোরে আপন মনে.........।“
সেদিন আমি বৃষ্টিতে ভিজেছিলাম সারাদিন।ধুয়ে যাক আমার কান্না,সব এলোমেলো স্মৃতি ,ধুয়ে যাক আমার বৃষ্টি ভেজা ভালবাসা। বৃষ্টিতে শুরু, বৃষ্টিতে শেষ।
কিন্তু কিছুই তো শেষ হয়না। বর্ষা আসে, বর্ষা যায়। আমি বৃষ্টিতে ভিজি। অবিরাম __________ হারিয়ে যাই সেই বর্ষায়, যখন আমার পাশে আমার ভালবাসার মানুষটি ছিল।প্রতিটা বর্ষায় আমি আরও একা হয়ে যেতে থাকলাম। সবাই আমাকে ছেড়ে ধীরে ধীরে দূরে চলে যেতে থাকল।কিন্তু বর্ষা তো বারবার ফিরে আসে, বৃষ্টির জল নিয়ে,আমার স্মৃতির কারখানা নিয়ে।এমনি ভাবে কাটে আরও কিছু বছর,আর কিছু বৃষ্টির দিন __________
৪............
অনেক বড় অসুখ আমার । খুবি অদ্ভুত,আজব অসুখ_________ এখন বর্ষা মানে আমার জন্য বিভীষিকা । আমি বৃষ্টি সহ্য করতে পারিনা, বৃষ্টির শব্দ কানে এলে আমি পাগল হয়ে যাই।কিছুতেই ঠিক থাকতে পারিনা,মরে যেতে ইচ্ছে হয়। তাই বৃষ্টি এলে আমাকে একটা অন্ধকার ঘরে আটকে রাখা হয়। দরজা জানালা সব বন্ধ রাখা হয়, যেন আমি বৃষ্টির শব্দ শুনতে না পাই। বিগত পাঁচ বছর ধরে আমার এই অসুখ । ডাক্তারের নিষেধ , আমি যেন কোনভাবেই বৃষ্টির সংস্পর্শে না আসি। তানাহলে ভয়ঙ্কর কিছু ঘটে যেতে পারে।
কিন্তু খুব অদ্ভুত ব্যাপার হল,বৃষ্টি এলে আমি টের পাই। আমার মাথার ভেতর তখন বৃষ্টির শব্দ শুনতে পাই। আমি চিৎকার করে মাথা চেপে ধরি। কিন্তু বৃষ্টি বন্ধ হয়না ......অবিরাম ঝরতে থাকে। আমি বুঝতে পারি আমার অসুখটা আরও বাড়ছে , বেড়ে চলে বৃষ্টিও।
বাইরে এখন বর্ষার ঝুম বৃষ্টি , আমার ঘরের দরজা জানালা সব বাহির থেকেবন্ধ। তবু আমি বৃষ্টি টের পাচ্ছি, বৃষ্টির শব্দ শুনছি। সেই গানটাও মনের মধ্যে গুনগুন করে বাজে , যে গানে লেখা ছিল -------- “বড় একা আমি
নিজের ছায়ার মত,
শূন্যতার মত,
দীর্ঘশ্বাসের মত,
নিঃসঙ্গ বৃক্ষের মত,
নির্জন নদীর মত,
বিচ্ছিন্ন দ্বিপের মত,
মৌন পাহাড়ের মত,
আজীবন সাজাপ্রাপ্ত,দন্ডপ্রাপ্ত আসামির মত,
বড় একা আমি,বড় একা__________________”।