আষাঢ় শুরু হওয়ার আগে এতো বৃষ্টি কখনও হয়েছে বলে মনে হয় না। গত তিন দিন থেকে আবিরাম ঝরেই যাচ্ছে। তাও আবার অল্প-স্বল্প নয়। ঘরের চাল উড়ানো বাতাস,সাথে চাবুকের মত ধারালো বৃষ্টি। গাঁয়ে পরলে মনে হয় ঝলতে থাকে। সাধারণত এতো জোরে বাতাস হলে বৃষ্টি কম হয়। এবার তার উল্টো হচ্ছে। যেমনি বাতাস তেমনি বৃষ্টি। রাস্তাঘাট সব পানির নিচে। আর মানুষ বন্ধী ঘরের ভেতর। সবার ধারণা এইবার দেশের অর্ধেকটাই পানিতে তলিয়ে যাবে। ম্যাজিক আলী অবশ্য এই কথা মানে না। এর আগেও অনেকবার এমন হয়েছে, কই দেশতো তলায় নাই। কিন্তু ওইদিন হাটের মধ্যে মাস্টার সাহেবকে বলতে শুনছে কি সব বিজ্ঞানের কথা। পৃথিবী আর বেশিদিন থাকবে না। মাটির নিচে পানি নাকি শুকিয়ে যাচ্ছে। মানুষ গাছ কেটে উজাড় করে দিতেছে,আর তাই বৃষ্টি বাদল বাড়তেছে। ম্যাজিক আলীর ভয় হয়। পরে অবশ্য অন্য কথা ভেবে একটু সাহস পায়। ঝড় বৃষ্টিতো দেয় আল্লাহপাক। তার এখনও মনে আছে, বছর দুই আগে স্কুলের মাঠে মাহফিলে এক হুজুর বলছিলেন-“ও মিয়ারা! তোমরা দেখছ নাকি? আইজকাল মানুষ গান বানাইছে, আল্লাহ্ মেঘদে পানিদে......। আরে নাচলে-কুদলে কি আল্লাহ্ পানি দিবো? দিবো না। যা দেওয়ার তা তিনি মিকাইল(আঃ)রে বুজাইয়া দিছেন। কি পরিমান পানি পড়বো আর কি পড়বো না তা আল্লাহর হুকুমে মিকাইল(আঃ) ঠিক করবো। খামাখা নাচ-গান বাদ দেও। আল্লাহর নাম লও।” মাস্টার সাহেবের চেয়ে মাওলানা সাহেবের কথাই তার বেশি মনে ধরলো।
লুঙ্গিটা হাঁটু সমান উঠিয়ে বহুকাল আগের একটা ছাতা মাথায় ম্যাজিক আলী পানি জমা ভাঙা রাস্তা দিয়ে হেটে যাচ্ছে। অনেক সাবধানী পা ফেলা। না দেখে পা দিলেই গর্তের মধ্যে ডুব দিয়ে উঠতে হবে। তাতে ম্যাজিক আলীর সমস্যা নাই। সমস্যা হল তার দুইটা লুঙ্গির একটা ভিজা অবস্থায় বাড়িতে রেখে এসেছে। এইটাও যদি ভিজে তাহলে সারাদিন ভিজা লুঙ্গিতেই থাকতে হবে। আমিতো ম্যাজিক আলী। ম্যাজিক দিয়ে কি একটা লুঙ্গিও শুকাতে পারবো না? এই কথা ভেবে হেসে ওঠে ম্যাজিক আলী। সে জানে,তার ক্ষমতা কতো সীমিত।
ছোটবেলা থেকে বাবার সাথে গ্রামে গ্রামে ঘুরে ম্যাজিক দেখাত সে। তখন অবশ্য তার কাজ ছিল বাবাকে সাহায্য করা আর ছোটখাটো কয়েকটা ম্যাজিক শেখা। ভালোই লাগত বাবার সাথে ঘুরে বেড়াতে। মাঝে মাঝে ম্যাজিক আলীও কয়েকটা ম্যাজিক দেখাত। লোকে বলত, ‘পোলাতো বাপের চাইতে বড় ম্যাজিক দেখায়। বড় হইয়া নাম করবো।’ বাবার সাথে ২/১ টা ম্যাজিক দেখিয়েই সে নাম পেয়েছে ‘ম্যাজিক আলী’। এখন আর কেউ তাকে অন্য নামে চিনেনা।ম্যাজিক আলী নিজেও মাঝে মাঝে ভুলে যায় তার সত্যিকারে নাম কি।
বেখেয়ালে হাটতে গিয়ে গর্তের মধ্যে পা দিয়ে ফেললো সে। তাও ভালো যে ছোট গর্ত ছিল। না হয় আজ পুরোই ভিজতে হতো।আকাশের দিকে তাকায় ম্যাজিক আলী। নীল রঙের আকাশটায় কেউ মনে হয় কালো রঙ ছড়িয়ে দিয়েছে। আর মাঝে মাঝে তার বজ্র কণ্ঠে পুরো পৃথিবীকে শাসাচ্ছে। নিথর গাছগুলো বাতাসের সাথে এদিক ঐদিক দুলতেছে। স্তব্ধ চারপাশে শুধু বৃষ্টির রিমঝিম শব্দ। দৃষ্টির সীমানায় কোন মানুষ নাই। পৃথিবীটা তার চির চেনা রূপ ছেড়ে যেন অন্য কোন রূপে সেজেছে। পৃথিবীর এই রূপ ভালো লাগেনা ম্যাজিক আলীর। নিজের অজান্তেই একটা দীর্ঘশ্বাস চলে আসে। ছোটবেলায় বৃষ্টি এলে কত আনন্দ করতো সে। ব্যাঙের বিয়ে দিয়ে বৃষ্টির জন্য গান গাইত। গ্রামের সব ছেলেরা মিলে কাদায় নেমে মারামারি,একসাথে পুকুরে ঝাপাঝাপি আর ডুব সাঁতারের খেলা এখনও তার চোখে ভাসে। সেই দিনগুলো অনেক আগেই হারিয়ে ফেলেছে সে। বৃষ্টি এখন আর তার ভালো লাগেনা। আকাশে মেঘ দেখলেই তার ভয় হয়।
দাড়িয়ে রইলো সে। আর হাটতে পারেনা না। হেটেই বা কি হবে। কোথায় যাবে তাইতো সে জানে না। পা দুটো অবশ হয়ে আসে। তার সমস্ত শরীর কাঁপতে শুরু করেছে। বৃষ্টির পানিতে ভিজে এই কাঁপুনি না। ঠাণ্ডার কাঁপুনির চেয়ে এই কাঁপুনি অনেক নিষ্ঠুর হয়। এই জীবনে বহুবার তাকে এই কাঁপুনি সহ্য করতে হয়েছে। গতকাল থেকে শুধু পানি ছাড়া আর কিছুই তার ভাগ্যে জোটে নাই। তিনদিনের বৃষ্টিতে হাট বসেনাই। ম্যাজিক আলীরও কোন রোজগার হয় নাই। সামান্য কিছু টাকা যা ছিল বউ এর জন্য ওষুধ কিনে আর গতদুই দিনের খাবার কিনেই সব শেষ। আজকের কোন উপায় হয় নাই। কি করবে সে বুজতেছে না। আজকের দিনটায় মনে হয় না খেয়েই থাকতে হবে। ম্যাজিক আলী আর তার বউ জীবনে অনেক দিন উপাস থেকেছে কিন্তু সাত বছরের ছেলেটাকে নিয়ে যত ভাবনা। সে তো আর উপাস থাকতে পারেনা। ছেলেটার কথা ভাবতেই কষ্ট লাগে তার। কিছুই সে দিতে পারেনাই ছেলেটাকে। অথচ তার ছেলেবেলা কিন্তু ভালোই কেটেছে। আশেপাশে তিন চার গ্রামেও ম্যাজিক আলীর বাবার নাম ছিল। মোড়লদের বাড়িতে বা বড় কোন গেরস্থ বাড়িতে বিয়ে-শাদি, আকিকার অনুষ্ঠান হলেই ডাক পরত তার। বাবার সাথে সাথে ম্যাজিক আলীও যেত সেই সব অনুষ্ঠানে। আর গ্রামের মেলা, যাত্রা মানেই ম্যাজিক শো হওয়া চাই। তাই টাকা-পয়সার তেমন সমস্যা তাদের ছিলোনা। দূরের গ্রামে গেলেই তার বাবা সাথে করে বাদাম,বিস্কুট আর কত রকমের খেলনা নিয়ে আসতো তার হিসেব নাই। অথচ ম্যাজিক আলী তার ছেলেটাকে খেলনাতো দূরে থাক ভালো একটা জামা কিনে দিতেও অনেকবার ভাবতে হয়। তার বউ যে বাড়িতে কাজ করে সেইখান থেকে মাঝে মাঝে পুরানো জামাকাপড় পায়। ওইগুলো পেয়েই ছেলেটা খুশি। বাড়ির মালিকদের কাছে ওইগুলো পুরানো হলেও ম্যাজিক আলীর কাছে কিন্তু নতুনই মনে হয়। সমস্যা হল গেঞ্জিগুলো ছেলেটার গাঁয়ে বেশ বড় হয়,তাও ওইটা পরেই সে মহাখুশি। ২/৩ দিনেও গাঁ থেকে খুলতে চায় না। ছেলের হাসি মুখ দেখলে তার মনটা ভরে যায়। হাটের মধ্যে ম্যাজিক পুটলি থেকে ডুগডুগিটা বের করে দুইটা নাড়া দিতেই তাকে ঘিরে মানুষ জড়ো হতে থাকে। ম্যাজিক আলী তার ম্যাজিক শুরু করে। একটা ম্যাজিক শেষ হয়তো ওমনি হাত তালিতে পুরো হাট কেঁপে ওঠে। আরও মানুষ এসে জড়ো হয়। তার ছেলেটার চোখে আনন্দের ঝিলিক দেখা যায়। ম্যাজিক দেখানোর ফাকে বাবার কানে ফিসফিস করে বলে যায়- ‘আব্বা! আইজ মনে হয় মেলা টাকা উঠবো। বহুত মানুষ আইছে ম্যাজিক দেখতো’। ম্যাজিক আলী একটু হাসে ছেলের কথায়। বাপ-বেটার এই হাসি বেশিক্ষণ স্থায়ী হয় না। ম্যাজিক আলী আসরের শেষ ম্যাজিক দেখানোর সময় তার ছেলেটা অনেক উৎসাহে একটা চাদর বিছিয়ে দেয় টাকা উঠানোর জন্যে। উজ্জ্বল চোখ দুটোতে তার অনেক স্বপ্নের আভা ফুটে উঠে। ধীরে ধীরে লোক কমতে থাকে। কয়েকটা কাঁচা পয়সা আর কিছু ছেঁড়া টাকা এসে জমে চাদরটাতে। ম্যাজিকের আসর ভাঙে,ছেলেটারও স্বপ্ন ভাঙে। ভাবলেশহীন চোখে সে টাকা কুঁড়াতে থাকে। ছেলেটার মুখের দিকে তাকিয়ে চোখে পানি এসে যায় ম্যাজিক আলীর। তবুও মুখে হাসি এনে ছেলেটার মাথায় হাত রেখে বলে-‘মন খারাপ করছ ক্যানরে বাপ? কাইল দেখবি আরও টাকা উঠবো।’ ছেলেও একটু হাসে বাবার মুখে তাকিয়ে। আর কিছুই বলেনা। ম্যাজিক আলীর খুব বেশি একটা খারাপ লাগেনা। কম হোক বেশি হোক তবু কয়েকটা গরম ভাত আর আলু সিদ্ব খাওয়ার মতো টাকা অন্তত জোগাড়তো হয়। কিন্তু বর্ষার দিনে তা নিয়েও সংশয়। বৃষ্টি থাকলে হাটে লোক আসেনা, ম্যাজিকেরও আসর বসেনা।
আকাশের বুক চিঁরে এইপাশ থেকে ওইপাশ জোরা আলোর রেখা ফুটে উঠে। সহসা বিকট শব্দে বাজ পড়ে। ম্যাজিক আলী বিরক্ত হয়ে তাকায় আকাশের দিকে। আজকে সারাদিনেও মনে হয় না বৃষ্টি থামবে। উল্টো আরও বাড়তেছে। ভেবে পায় না সে কি করবে। গতকাল মহাজনের আড়তে বস্তা তুলে চাল-ডাল কেনার মতো টাকা হয় নাই। কয়েকটা রুটি আর আলু ভাজি কিনে নিয়ে গিয়েছিলো। বউ-ছেলে এতো ক্ষুধার্ত ছিল যে তাদের খায়িয়ে একটা শুকনো রুটির বেশি দ্বিতীয়টা আর মুখে দিতে পারেনাই ম্যাজিক আলী। বাধ্য হয়ে মিথ্যা বলল সে আড়তেই খেয়ে এসেছে। ওই নিয়েই কাল সারাদিন ছিল আর আজও সকাল শেষ হয়ে দুপুরের কাছাকাছি। আড়তের বস্তা নামিয়ে তবু রুটি কেনা যাবে এই আশায় আজও সে এসেছিল। এতো বৃষ্টি যে শিয়াল কুকুর ও রাস্তায় আসেনা,মানুষ দূরে থাক। তাই মহাজনও আজ আড়ত খোলে নাই। অন্য কোনও কাজ খুজে বেড় করবে তারও উপায় নাই। কাজ কে দিবে? সব মানুষতো বাড়িতেই বসে আছে। বউটা সুস্থ থাকলেও একটা উপায় হতো। যে বাড়িতে সে কাজ করে ওইখান থেকে চেয়ে অন্তত পেট ভরার মতো কিছু খাবার আনতে পারত। প্রায়ই তার বউ আসার সময় বাসি পলাও,মাংস,রোষ্ট নিয়ে আসে। আজও হয়তো ভালো কিছুই পেতো। কিন্তু সেও আজ পাঁচদিন জ্বরে পড়ে আছে। ছেলেটাকে মায়ের পাশে রেখে ম্যাজিক আলী এসেছিলো কাজের খোঁজে। কোন উপায়ই হল না। আজ বোধয় না খেয়েই থাকতে হবে। এখন আর সে হাটতেও পারেতেছে না। পা দুটো তার শরীরটাকে আর বইতে পারে না। ক্ষুধা আর ক্লান্তিতে নিস্তেজ হয়ে পড়ে সে। এমন কোন ম্যাজিক কি নাই যাতে পেট ভরে। থাকলে ভালো হতো। যে করেই হোক ম্যাজিক আলী তা শিখে নিতো। এই ম্যাজিক যে তার অনেক দরকার। না,আর কোন ভাবেই সে দাড়িয়ে থাকতে পারতেছে না।
বাড়ির দিকে পা ফেলতে শুরু করলো ম্যাজিক আলী। চারপাশ যেন আরও অন্ধকার হয়ে আসতেছে। বৃষ্টির ঝাপটা এসে ভিজিয়ে দিচ্ছে তাকে। ছাতা শুধু তার মাথাকেই বাচাতে পারতেছে,বাকি শরীর ভিজে সাড়া। এলোমেলো পা ফেলতে থাকে ম্যাজিক আলী। ভাবতে থাকে, বর্ষা কেন আসে। উপরওয়ালা কি জানেনা তার মতো ম্যাজিক আলীরা বৃষ্টি চায় না। আকাশে মেঘ জমলেই ম্যাজিক আলীরা আতঙ্কে গুটিয়ে যায়। এই আতঙ্ক চরম দারিদ্রের,ক্ষুধার। জীবন নামের পাপের খাতায় বৃষ্টি তাদের জন্য অভিশাপ হয়ে দেখা দেয়।
ম্যাজিক আলীকে দেখেই তার ছেলেটা দৌড়ে আসলো। বাবার হাত ধরে জিজ্ঞেস করলো- ‘আব্বা, খাওন আনো নাই? অনেক ভুক লাগছে।’ কোন কথাই বলতে পারেনা ম্যাজিক আলী। ছেলের একটা প্রশ্নই যেন তার বাকি শক্তিটুকুও কেড়ে নিয়েছে। ছেলের মাথায় হাত দিয়ে দাড়িয়ে আছে সে। ছেলেটা আবার জিজ্ঞেস করলো, ‘আব্বা, আমরা কি আইজ ভাত খামু না?’
বৃষ্টির বেগ আরও বেড়েছে। বাপ-বেটা দুই জনই দাড়িয়ে আছে বৃষ্টিতে। ছেলেটা দাড়িয়ে আছে বাবার মুখের দিকে তাকিয়ে। ম্যাজিক আলীর সমস্ত শরীর বেয়ে বৃষ্টির ফোটা পড়তেছে। আর তাই হয়তো ছেলেটা বুজতেছেনা, বৃষ্টির ফোটার সাথে ম্যাজিক আলীর চোখের পানিও ঝরতেছে । যার সাথে মিশে আছে সব প্রশ্নের উত্তর।
০৯ জুলাই - ২০১১
গল্প/কবিতা:
১ টি
বিজ্ঞপ্তি
এই লেখাটি গল্পকবিতা কর্তৃপক্ষের আংশিক অথবা কোন সম্পাদনা ছাড়াই প্রকাশিত এবং গল্পকবিতা কর্তৃপক্ষ এই লেখার বিষয়বস্তু, মন্তব্য অথবা পরিণতির ব্যাপারে দায়ী থাকবে না। লেখকই সব দায়ভার বহন করতে বাধ্য থাকবে।
প্রতি মাসেই পুরস্কার
বিচারক ও পাঠকদের ভোটে সেরা ৩টি গল্প ও ৩টি কবিতা পুরস্কার পাবে।
লেখা প্রতিযোগিতায় আপনিও লিখুন
-
প্রথম পুরস্কার ১৫০০ টাকার
প্রাইজ বন্ড এবং সনদপত্র।
-
দ্বিতীয় পুরস্কার ১০০০ টাকার
প্রাইজ বন্ড এবং সনদপত্র।
-
তৃতীয় পুরস্কার সনদপত্র।
আগামী সংখ্যার বিষয়
লেখা জমা দেওয়ার শেষ তারিখ ২৫ নভেম্বর,২০২৪